আমাকে মনে করো, আমিও তোমাদেরকে মনে করবো — আল-বাক্বারাহ ১৫২

2_152_title

2_152তাই আমাকে মনে করো, আমিও তোমাদেরকে মনে করবো। আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, আর আমার প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ো না। [আল-বাক্বারাহ ১৫২]

কু’রআনে একটি ব্যাপার বার বার ঘুরে ফিরে আসে: আল্লাহর تعالى প্রতি আমাদেরকে কৃতজ্ঞতা দেখাতে হবে। প্রশ্ন আসে: আল্লাহর تعالى প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানোর জন্য এত জোর দেওয়া হয়েছে কেন? আল্লাহর تعالى তো কোনো কিছুর দরকার নেই? তাহলে কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে কার কী লাভ হচ্ছে?

টাইম ম্যাগাজিনে একটি আর্টিকেল[২৮৫] বের হয়েছে কৃতজ্ঞতার উপকারিতার উপরে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০০৩ সালে ২,৬১৬ জন বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষের উপরে গবেষণা করে দেখা গেছে: যারা অপেক্ষাকৃত বেশি কৃতজ্ঞ, তাদের মধ্যে মানসিক অবসাদ, দুশ্চিন্তা, অমূলক ভয়-ভীতি, অতিরিক্ত খাবার অভ্যাস এবং মদ, সিগারেট ও ড্রাগের প্রতি আসক্তির ঝুঁকি অনেক কম। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে: মানুষকে নিয়মিত আরও বেশি কৃতজ্ঞ হতে অনুপ্রাণিত করলে, মানুষের নিজের সম্পর্কে যে হীনমন্যতা আছে, নিজেকে ঘৃণা করা, নিজেকে সবসময় অসুন্দর, দুর্বল, উপেক্ষিত মনে করা, ইত্যাদি নানা ধরণের সমস্যা ৭৬% পর্যন্ত দূর করা যায়।

২০০৯ সালে ৪০১ জন মানুষের উপর গবেষণা করা হয়, যাদের মধ্যে ৪০%-এর ক্লিনিকাল স্লিপ ডিসঅর্ডার, অর্থাৎ জটিল ঘুমের সমস্যা আছে। তাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ, তারা একনাগাড়ে বেশি ঘুমাতে পারেন, তাদের ঘুম নিয়মিত হয়, রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন এবং দিনের বেলা ক্লান্ত-অবসাদ কম থাকেন।

নিউইয়র্কের Hofstra University সাইকোলজির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ড: জেফ্রি ফ্রহ ১০৩৫ জন ১৪-১৯ বছর বয়সি শিক্ষার্থীর উপর গবেষণা করে দেখেছেন: যারা বেশি কৃতজ্ঞতা দেখায়, তাদের পরীক্ষায় ফলাফল অপেক্ষাকৃত বেশি ভালো, সামাজিক ভাবে বেশি মেলামেশা করে এবং হিংসা ও মানসিক অবসাদে কম ভোগে। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এই মানসিক সমস্যাগুলো মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তাদের মধ্যে বাবা-মার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ আশংকাজনকভাবে কম।

Wall Street Journal একটি আর্টিকেলে[২৮৬] বলা হয়েছে

যেসব বয়ঃস্থ মানুষ প্রতিনিয়ত কৃতজ্ঞতা অনুভব করেন: তাদের কর্মস্পৃহা, জীবনসম্বন্ধে তাদের আস্থা, তাদের সামাজিক মেলামেশা, এবং তাদের সুখানুভূতি কৃতজ্ঞতাবোধহীনদের তুলনায় অনেক অনেক বেশি হয়ে থাকে –প্রায় এক যুগ গবেষণার ফল থেকে এটি জানা গেছে। এদের মধ্যে হতাশা, ঈর্ষা, লোভ অথবা মদ্যপানে আসক্তি আসার সম্ভাবনা কম। এরা অপেক্ষাকৃত বেশি আয় করে থাকে, এরা গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়ে, এরা নিয়মিত ব্যায়াম করার সুযোগ পায় এবং ভাইরাসজনিত রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাও এদের বেশি।

এবার বুঝতে পারছেন, কেন আমাদের প্রতিদিন ৫ ওয়াক্তে, কমপক্ষে ১৭ বার সুরা ফাতিহায় বলা উচিত—

আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামিন
সমস্ত প্রশংসা এবং ধন্যবাদ আল্লাহর, যিনি সৃষ্টিজগতের প্রভু। [ফাতিহা ১:২]

“আমাকে মনে করো”

ٱذْكُرُوا۟ এসেছে ذكر থেকে, যা কু’রআনে অনেকগুলো অর্থে এবং উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে: ১) উল্লেখ করা, ২) মুখস্থ করা, ৩) পুনরায় মনে করা, ৪) মনে রাখা, ৫) কিছু নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা, ৬) উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা, ৭) উপলব্ধি করে অনুতপ্ত হওয়া, ৮) কোনো শিক্ষাকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা ইত্যাদি।[১৪২] আল্লাহ تعالى আমাদেরকে বলছেন: তিনি আমাদের যা কিছু দিয়েছেন, তার সব আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, মানুষকে মনে করিয়ে দিতে হবে, নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে। যদি আমরা তা করি, তাহলেই আমরা তাক্বওয়া অর্থাৎ আল্লাহর تعالى প্রতি সবসময় গভীরভাবে সচেতন থাকতে পারবো।

অনেক সময় আমরা যিকর বলতে শুধু নিজেকেই মনে করানো বুঝি। কিন্তু যিকরের একটি অর্থ হলো: কাউকে মনে করানো, উল্লেখ করা। ধরুন, আপনার পরিবারের এক সদস্য গত কয়েক ঘণ্টা ধরে সোফায় বসে একটার পর একটা চ্যানেল পাল্টাচ্ছে, আর হাতে চিপস নিয়ে যাবর কাটছে। আপনি তাকে গিয়ে তাগাদা দিলেন: সে কী চরম অর্থহীন একটা কাজ করে জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করছে — সেটা ভালো করে বোঝালেন। তাকে আল্লাহর تعالى কথা মনে করিয়ে দিলেন — তখন এটা যিকর হয়ে যাবে। যিকর মানে শুধুই নিজে নিজে দু’আ পড়া নয়।[১]

এছাড়াও, আল্লাহকে تعالى মনে করা মানে শুধু মুখে যিকর করাই নয়, বরংতাঁর আদেশ অনুসারে কাজ করা, এবং নিষেধ অনুসারে খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকাই হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে তাঁকে মনে করা।[৪] [১৪] কারণ আমরা যখন আল্লাহর تعالى নির্দেশকে অমান্য করতে থাকি, তখন আমরা তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ে যাই। যখন আমরা অফিসের কাজ, বাচ্চাকে স্কুলে আনা-নেওয়া, সপ্তাহের বাজার, মেহমানদারী করতে গিয়ে ওয়াক্তের পর ওয়াক্ত নামাজ ছেড়ে দেই, আমরা শুধু তাঁর অবাধ্যই হই না, তাঁর প্রতি আমরা অকৃতজ্ঞও হয়ে যাই। যদি আমরা সত্যিই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হতাম, তাহলে কখনই অফিসের বস-সন্তান-ঘরের কাজ থেকে তাঁকে কম গুরুত্ব দিতাম না।

যিনি আমাদের স্বাস্থ্য, সম্পত্তি, সংসার, সন্তান, সঙ্গ, সম্মান, সম্ভ্রম —সবকিছুর মালিক, তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে বা কিছুকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া, সেগুলোর পেছনে দৌড়াতে গিয়ে তাঁকেই ভুলে যাওয়া এবং ‘লোকে কী বলবে’ এই ভয়ে তাঁর নিষেধ অমান্য করা—এধরনের কাজগুলো তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন ছাড়া আর কিছু নয়।

“আমিও তোমাকে মনে করবো”

আল্লাহ تعالى আমাদের কথা মনে করবেন! সৃষ্টিজগতের মহান সম্রাট আমাদের কথা বলবেন! এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে?

একটা উদাহরণ দেই। ধরুন, চৌধুরী সাহেব একজন মন্ত্রীর কাছে মাসের পর মাস ধরে তদবির করছেন তার একটা পদোন্নতির ব্যাপারে। একদিন তাকে মন্ত্রী ফোন করে বলল, “চৌধুরী সাহেব, খুশির খবর। আজকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে আপনার কথা বললাম। প্রধানমন্ত্রী নিজে আপনার কাগজ-পত্র দেখতে চাইলেন, আপনার ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন।” —এই কথা শুনে চৌধুরী সাহেব আনন্দে গদগদ হয়ে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী নিজে তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছেন? কী সৌভাগ্যের কথা!

এবার চিন্তা করে দেখুন, আপনি যখন আল্লাহ ﷻ কে স্মরণ করছেন, এই যে আর্টিকেলটা পড়ছেন, হতে পারে এই মুহূর্তে এক ঐশ্বরিক সমাবেশে উচু-পর্যায়ের সৃষ্টিদের সাথে, মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ-ক্ষমতাবান নিজে আপনার ব্যাপারে কথা বলছেন। আপনি যে তাঁকে মনে করছেন, সেটা তিনি নিজে লক্ষ্য করছেন। তিনি এই মুহূর্তে আপনাকে পুরস্কার লিখে দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন, হয়তো বা আপনার ভাগ্য পরিবর্তনেরও নির্দেশ দিচ্ছেন। আপনার এই মুহূর্তটি কত বড় সম্মানের একটি মুহূর্ত!

“আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, আর আমার প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ো না”

এই অংশে আল্লাহ تعالى বলছেন: তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে এবং তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞ না হতে। কেন তিনি শুধুই কৃতজ্ঞ হতে বলে আয়াত শেষ করে দিলেন না? আলাদা করে অকৃতজ্ঞ হতে না বলার প্রয়োজন কী ছিল?

আল্লাহ تعالى জানেন: আমরা তাঁর প্রতি যথাযথ কৃতজ্ঞতা দেখাতে পারবো না। তিনি যে প্রতিদিন আমাদেরকে কত কিছু দেন, আমাদের অগোচরে কত বিপদ থেকে বাঁচান, আমাদের না জানিয়ে কত দিক থেকে সমস্যাগুলোকে সহজ করে দেন —সেটা আমরা উপলব্ধি করতে পারবো না, তাঁকে যথাযথ সম্মানও করতে পারবো না। তাই আমরা তাঁর প্রতি ঠিকমতো কৃতজ্ঞতা না দেখালেও, অন্তত যেন অকৃতজ্ঞতা না দেখাই। অকৃতজ্ঞতা দেখালে তিনি তা ছেড়ে দেবেন না।

আমরা কীভাবে আল্লাহর تعالى প্রতি অকৃতজ্ঞতা দেখাই, তার কিছু উদাহরণ দেই—

বিশ বছর পড়াশুনা করে বের হওয়ার পর দেখা যায় আর চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যবসার সুযোগ নেই। মাসের পর মাস ইন্টার্ভিউ দিতে দিতে অবস্থা কাহিল। বাসায় এসে রাতে খেতে বসলে বাবা-মা ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’ দিয়ে বলেন, “এভাবে আর কতদিন চলবে? একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে?” বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি, মাথার উপরে ছাদ, শোয়ার বিছানা, কল ছাড়লেই পরিষ্কার পানি, চুলায় গ্যাস, ইলেক্ট্রিসিটি, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, তিনবেলা খাওয়ার ব্যবস্থা, ফ্রিজ ভর্তি খাবার —এতসব থাকতেও প্রতিদিন নিজের ভেতরে হাহাকার চলে, “ও আল্লাহ تعالى, এভাবে আর কত দিন? কেন আপনি আমার সাথেই এরকম করছেন? আমার বন্ধুদের চাকরি হয়, আমার কেন হয় না? চাচাতো ভাইয়েরা বাড়ি-গাড়ি করে ফেলেছে, আর আমি বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি? কেন আপনি আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছেন?”

একদিন চাকরি-ব্যবসা হয়। সম্পত্তির মালিক হয়। বিয়ে হয়। তারপর দেখা যায় সন্তান হচ্ছে না। বছরের পর বছর পার হয়ে যাচ্ছে। অনেক ডাক্তার দেখিয়ে লাভ হচ্ছে না। কত গরিবদের খাওয়ানো, মাজারে দান, পানি-পড়া, ডাব-পড়া, তেল-ম্যাসাজ, কালো জিরা চলে। অথচ হিসেব করলে দেখা যাবে: ভালো বেতনের চাকরি, যথেষ্ট সম্পত্তি, গুণবতী স্ত্রী, সুস্থ বাবা-মা, নিজের বাড়ি, গাড়ি, বাসায় চাকর —সব আছে। এতসবকিছু থাকতেও সে মনের দুঃখে নামাজ পড়া ছেড়ে দিয়েছে, আর প্রতি দিন আক্ষেপ করছে, “ও আল্লাহ تعالى, আপনি আমাদের সাথে এরকম কেন করছেন? আমরা কি খুব বেশি কিছু চাই আপনার কাছে? সবার সন্তান আছে। আমাদেরকে কেন দেবেন না? আমরা কী অন্যায় করেছি?”

আমাদের অনেকেরই বেলায় দেখা যায়: স্বাস্থ্য, সম্পত্তি, সংসার, সন্তান, সঙ্গ, সম্মান, সম্ভ্রম—এগুলোর কোনো একটা বা দুটা যদি না থাকে, বা কম থাকে, শুরু হয় হতাশা, আক্ষেপ, দুঃখ, আল্লাহকে تعالى নিয়ে অভিযোগ। যেমন ধরুন, কারো স্বাস্থ্য, সম্পত্তি, সন্তান, সঙ্গ, সম্মান, সম্ভ্রম —এই সবই আছে, শুধু সংসারে ঝামেলা। শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে প্রায়ই সমস্যা, কটু কথা থেকে ঝগড়া। ব্যাস, তার জীবন যেন বরবাদ হয়ে যায়। যখনি তার সাথে দেখা হয়, আধাঘণ্টা ধরে তার জীবনের করুণ কাহিনীর বর্ণনা। দুই-একদিন পরপর কাউকে ফোন করে এক ঘণ্টা ধরে তার শোকগাঁথা না শোনালে তার বুকের পাথর নামে না। নামাজে আল্লাহর تعالى কাছে কত অভিযোগ, “ও আল্লাহ تعالى, শেষ পর্যন্ত এই রেখেছিলেন আমার কপালে? আমাকে কেন এত শয়তান স্বামী/স্ত্রী দিলেন? আমার বন্ধুরা কত ভালো পরিবার পেয়েছে। আমি কি একটু শান্তির জীবন পেতে পারতাম না?”

যখন আমাদের জীবনে কোনো দিক থেকে কিছু কম থাকে এবং আমরা আশেপাশের মানুষের দিকে তাকিয়ে দেখি: তাদের তো সেটা ঠিকই আছে, তখন প্রশ্ন করা শুরু করি, “তাহলে আমার নেই কেন? আমি কী দোষ করেছি?” কিন্তু আমরা কখনো খুঁজে দেখি না যে, যাদেরকে দেখে আক্ষেপ করছি, তাদর স্বাস্থ্য, সম্পত্তি, সংসার, সন্তান, সঙ্গ, সম্মান, সম্ভ্রম —এই সবগুলোর মধ্যে কোনোদিকে কিছু একটা কম আছে কিনা। আমরা শুধু দেখি: আমার যা নেই বা যা কম আছে, সেটা আর কার কার আছে। যাদের আছে, “ওরা কতই না সুখী। শুধু আমি হচ্ছি পোড়া কপাল।” খোঁজ নিলে দেখা যায়, তারাও একই কথা ভাবছে। তাদের যা নেই, সেটা আমার কেন আছে, তা নিয়ে তাদের কত না হা-হুতাশ।

অনেক বছর আগে আল্লাহ যখন ইবলিসকে তাঁর সান্নিধ্য থেকে বের করে দিচ্ছিলেন, তখন ইবলিস একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ শপথ করেছিল, যা থেকে তার মানুষকে ধ্বংস করার অন্যতম একটি প্রধান পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়—

(ইবলিস বলল) “আমি মানুষের কাছে আসব: ওদের সামনে থেকে, ওদের পেছন থেকে, ওদের ডান দিক থেকে এবং ওদের বাম দিক থেকে। আপনি দেখবেন ওরা বেশিরভাগই কৃতজ্ঞ না।” [আ’রাফ ৭:১৭]

ইবলিস অনেক আগেই বলে গিয়েছিল যে, আমরা বেশিরভাগই আল্লাহর تعالى প্রতি কৃতজ্ঞ হবো না, যার কারণে আমরা দুনিয়া এবং আখিরাতে পস্তাবো। আজকে আমরা ওরই কথা প্রতিনিয়ত সত্যি প্রমাণ করে দিচ্ছি।

এখন, আমাদের কারো জীবনে যদি দশটা দিকের মধ্যে তিনটা দিকে সমস্যা থাকে, তাহলে আমরা সেই তিনটা দিকও কেন ভালো হলো না, তা নিয়ে প্রতিনিয়ত আক্ষেপ করতে পারি, অথবা বাকি সাতটা দিকে আল্লাহ যে আমাদের যথেষ্ট ভালো রেখেছেন, তা নিয়ে প্রতিদিন তাঁকে কৃতজ্ঞতা দেখাতে পারি। কোনটা করবো, তা ঠিক করতে এই আয়াতটি কিছুটা অনুপ্রেরণা দেবে—

মনে করে দেখো, তোমাদের প্রভু কথা দিয়েছিলেন, “যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তাহলে আমি তোমাদেরকে আরও দিতেই থাকবো। কিন্তু তোমরা যদি অকৃতজ্ঞ হও… আমার শাস্তি প্রচণ্ড কষ্টের।” [ইব্রাহিম ১৪:৭]

আল্লাহর تعالى উপরে যারা পুরোপুরি নির্ভর করতে পারেন, তারা গাজার বোনদের মত নিশ্চিন্তে হিজাব পরে রাতে ঘুমাতে যান। কারণ তারা মেনে নিয়েছেন: আল্লাহ تعالى যদি চান, তাহলে আজকে রাতেই তিনি শহিদ হবেন। তখন উদ্ধারকারীরা যেন তাকে বেপর্দা অবস্থায় দেখে না ফেলে। তারা তাদের ছেলেমেয়েদেরকে বাইরের পোশাক পরিয়ে, পকেটে খাবার গুঁজে দিয়ে বিছানায় শোয়ান। হয়ত আজকে রাতেই তার সন্তানরা একা একা রাস্তায় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পড়ে থাকবে। আগামীকাল থেকে বাবা-মা ছাড়া জীবন পার করতে হবে —তাই তারা প্রস্তুত। ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই, সবই আল্লাহর تعالى ইচ্ছে। আল্লাহ تعالى যখন চাইবেন, তখন তা হবেই।

এই ধরনের মুমিনদের চাকরি নিয়ে অস্থিরতা থেকে মানসিক চাপ (স্ট্রেস), প্রেমে বিফলতার কারণে হতাশা, অপারেশনের আতঙ্কে রাতে ঘুম না হওয়া, ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে উচ্চ রক্তচাপ বাঁধিয়ে ফেলা —এই সব সমস্যায় জীবন জর্জরিত হয়ে যায় না। এই সমস্যাগুলো আমাদের মত নড়বড়ে ঈমানের মানুষদের সমস্যা, যারা আল্লাহর تعالى প্রতি কৃতজ্ঞ হয় না, এবং প্রতিনিয়ত আল্লাহর تعالى প্রতি অকৃতজ্ঞতা দেখায়।

আসুন আমরা কু’রআনের আয়াতগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করি। আল্লাহ تعالى আমাদেরকে কু’রআন দিয়েছেন এক আত্মিক নিরাময় হিসেবে। আমাদের অনেক মানসিক সমস্যার সমাধান রয়েছে কু’রআনে। নিয়মিত বুঝে কু’রআন পড়লে আমরা খুব সহজেই ওষুধের উপর আমাদের নির্ভরতা কমিয়ে আনতে পারব। স্ট্রেস-ডিপ্রেশন থেকে মুক্ত হয়ে শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ জীবন যাপন করতে পারব — ইন শাআ আল্লাহ।

সূত্র:

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
  • [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
  • [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
  • [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
  • [১৫] তাফসির আল জালালাইন।
  • [১৪২] ذكر যিকর শব্দের বিস্তারিত অর্থ।
  • [২৮৫] Szalavitz, M. and Szalavitz, M. (2015). Why Gratitude Isn’t Just for Thanksgiving | TIME.com. [online] TIME.com. Available at: http://healthland.time.com/2012/11/22/why-gratitude-isnt-just-for-thanksgiving/ [Accessed 28 Apr. 2015].
  • [২৮৬] Beck, M. (2015). Thank You. No, Thank You. [online] WSJ. Available at: http://www.wsj.com/articles/SB10001424052748704243904575630541486290052 [Accessed 28 Apr. 2015].

আর শেখায় যা তোমরা কখনো জানতে না — আল-বাক্বারাহ ১৫১

2_151যেমন আমি তোমাদেরই মধ্যে থেকে একজনকে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছি, যে তোমাদেরকে আমার আয়াত শোনায়, পবিত্র করে, বিধি-বিধান এবং প্রজ্ঞা শেখায়। আর শেখায় যা তোমরা কখনো জানতে না। [আল-বাক্বারাহ ১৫১]

মানুষকে ইসলামের দাওয়াহ দেওয়ার সময় যারা দাওয়াহ দেন, তাদেরকে এই তিনটি বাধা পার করতে হয়—

১) তুমি কে? তোমার কথা আমি কেন শুনবো?
২) তোমার ধর্ম কি আমার ধর্মের থেকে বেশি সঠিক? তুমি কি মনে করো যে, তুমি সঠিক পথে আছে, আর আমরা সবাই ভুল পথে আছি?
৩) আমাদেরকে কেন সবদিক থেকে তোমাদের মতোই হতে হবে?

নবী, রাসূলদেরকে এই বাধাগুলো পার করতে হয়েছে। তাদেরকে এমন সব সময়ে, এমন সব মানুষের কাছে পাঠানো হয়েছিল, যারা একেবারেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। একশ্রেণীর মানুষের চরম অন্যায়ের কারণে আরেক শ্রেণীর মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে গিয়েছিল। তারপরও নবী, রাসূলরা অত্যাচারিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে এই কঠিন বাধাগুলোকে অতিক্রম করে অত্যাচারী মানুষগুলোকে পথ দেখিয়ে গেছেন।

এখন আমাদের কাছে যদি বাইরের দেশ থেকে কেউ এসে ধর্ম প্রচার করা শুরু করে, তাহলে প্রথমেই আমাদের মনে হবে যে, সে কোথাকার কে, যে আমাদেরকে ধর্ম শেখাতে এসেছে? সে কীভাবে বুঝবে আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের মানসিকতা, আমাদের সীমাবদ্ধতা? তার দেশে অনেক কিছু চলতে পারে, যেটা আমাদের দেশে চলবে না। আবার আমাদের অনেক কিছুই তার সংস্কৃতি অনুসারে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। আমাদেরকে কি সব দিক থেকে তার মতো, তার দেশের মানুষের মতো হতে হবে নাকি?

একারণে যখন কোনো নবী বা রাসুল তাদের এলাকার মানুষের মাঝে বড় হয়ে, তাদেরই মাঝে ধর্ম প্রচার করতেন, তখন তাদেরকে এই সমস্যাটার সম্মুখীন হতে হতো না। তারা তাদের আশেপাশের মানুষের সংস্কৃতি, রীতিনীতি, মানসিকতা ভালো করে বুঝতেন এবং সে অনুসারে তাদেরকে ধর্ম শেখাতে পারতেন। একারণে একজন বাঙালি দাঈ যতটা না ভালোভাবে বাঙালীদের মাঝে ইসলামের শিক্ষা প্রচার করতে পারবেন, মানুষকে বোঝাতে পারবেন, মানুষের ভেতরে পরিবর্তন আনতে পারবেন, একজন আরব বা ইংরেজ দাঈ সেভাবে পারবেন না। ভাষা, সংস্কৃতি, রীতিনীতি, আদব-কায়দা একটা বিরাট বাধা হয়ে থাকবে সাধারণ মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতার পথে।

2_151_title2  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

ওদেরকে ভয় করো না, আমাকে ভয় করো — আল-বাক্বারাহ ১৪৯-১৫০

হিজরতের পর প্রথম দিকে মুসলিমরা আল-আক্বসাকে কিবলা হিসেবে অনুসরণ করত। রাসূলের عليه السلام বড় ইচ্ছা ছিল যে, আল্লাহ تعالى যেন কা’বাকে কিবলা করে দেন। তার عليه السلام মনের বাসনা আল্লাহ تعالى পূরণ করলেন, কা’বাকে কিবলা করে দিলেন, কু’রআনের আয়াত নাজিল হলো। কিন্তু রাসূল عليه السلام যখন কিবলা পরিবর্তনের আয়াত মানুষকে তিলাওয়াত করে শোনালেন, তখন নানা ধরনের সমস্যা শুরু হলো। কিছু মানুষ মনে করা শুরু করলো, “একি! এতো দেখি রাসূল যা চায় সেটাই কয়েকদিন পর কুরআনের আয়াত হয়ে নাজিল হয়? আসলেই কু’রআনের আয়াতগুলো আল্লাহর تعالى কাছ থেকে আসে তো? নাকি সব রাসূলের عليه السلام বানানো কথা?”[১]

আবার অনেক মুসলিম, যারা আগে ইহুদি, খ্রিস্টান ছিলেন, তারা এত দিন ধরে আল-আক্বসাকে কিবলা মেনে এসেছিলেন। তাদের আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ইহুদি, খ্রিস্টানরা সবাই তখনো আল-আক্বসাকে কিবলা অনুসরণ করছে। তখন সে যদি সবাইকে অপমান করে কা’বাকে কিবলা অনুসরণ করা শুরু করে, তাহলে ব্যাপারটা কেমন দেখাবে? “লোকে কী বলবে” এই ভয়ে অনেকে একাকী প্রার্থনা করার সময়, বা তাদের ইহুদি, খ্রিস্টান আত্মীয়দের সাথে চলাফেরা করার সময় কা’বার দিকে ঘুরে দাঁড়াতো না।[১]

2_149_150_title

আল্লাহ تعالى কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশ দিয়ে পর পর তিনটি আয়াত নাজিল করলেন। এরকম অভূতপূর্ব ঘটনা কু’রআনে বিরল, যেখানে একই নির্দেশ পর পর তিনবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায়, কিবলা পরিবর্তনের ব্যাপারটি কতটা বিতর্কিত ছিল, এবং তখনকার মুসলিমদের অনেকেরই এটা মেনে নিতে যথেষ্ট কষ্ট হয়েছিল।[৬]

2_149

তুমি যেখান থেকেই শুরু করে থাকো না কেন, মাসজিদুল-হারামের দিকে ঘুরে দাঁড়াও। এটা তোমার প্রভুর কাছ থেকে আসা সত্য বাণী। তোমরা কী করছ, সে ব্যাপারে আল্লাহ বিন্দুমাত্র বেখেয়াল নন। [আল-বাক্বারাহ ১৪৯]

যারা সন্দেহ করেছিল যে, রাসূল عليه السلام হয়তো বানিয়ে আয়াত বলছেন, তাদেরকে আল্লাহ تعالى সাবধান করে দিলেন, “এটা তোমার প্রভুর কাছ থেকে আসা সত্য বাণী।” আর যারা ‘লোকে কী বলবে’ এই ভয়ে, প্রার্থনা করার সময় আল-আক্বসার দিকে মুখ করে থাকতো, তাদের জন্য আল্লাহর تعالى সাবধান বাণী: “তোমরা কী করছ, সে ব্যাপারে আল্লাহ বিন্দুমাত্র বেখেয়াল নন।”  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

ভালো কাজে এগিয়ে থাকার জন্য একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করো — আল-বাক্বারাহ ১৪৮

চারিদিকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে এত ষড়যন্ত্র, ইসলামের বিরুদ্ধে লেখালেখি, টিভিতেও মুসলিমদের অবমাননা, সরকারগুলোর ইসলামী দলগুলোকে মেরে শেষ করে ফেলা,  ইন্টারনেটে নবী, রাসুল (তাঁদের সকলের উপর শান্তি বর্ষিত হোক) কে অপমান করে হাজারো ওয়েবসাইট, মাযহাবে-মাযহাবে ষড়যন্ত্র, ঝগড়াঝাটি, মারামারি, ইলিউমিনাটি, সিক্রেট সোসাইটি, কন্সপিরেসি থিওরি  —এত সব ব্যাপার দেখে মুসলিমরা অনেক সময় ঘাবড়ে যায়। দিনরাত চিন্তা করতে থাকে- এত বিরাট সংঘবদ্ধ শত্রুর বিরুদ্ধে কীভাবে মোকাবেলা করবে? কীভাবে সবাইকে প্রতিহত করে নিজেদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করবে? কীভাবে ‘খিলাফত’ নিয়ে আসবে?

দিনরাত দুশ্চিন্তায় তাদের ঘুম হয় না। সারাদিন ইন্টারনেট ঘেঁটে এইসব নিয়ে পড়তে পড়তে তাদের চোখ গর্তে ঢুকে যায়। চারিদিকে এত মিথ্যা, প্রতারণা, বিরোধ, ষড়যন্ত্র দেখে তারা আশা হারিয়ে ক্যান্সার রুগীর মত শুকিয়ে যায়। নেতিবাচক কথা, চিন্তার ভারে ন্যুব্জ হয়ে যায়। এদেরকে আল্লাহ পরামর্শ দিচ্ছেন—

2_148_title

2_148
প্রত্যেকের আপন লক্ষ্য রয়েছে, যেদিকে সে ঘুরে দাঁড়ায়। তাই ভালো কাজে এগিয়ে থাকার জন্য একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করো। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, আল্লাহ تعالى তোমাদেরকে এক জায়গায় করবেন। অবশ্যই আল্লাহর تعالى যেকোনো কিছু করার ক্ষমতা আছে। [আল-বাক্বারাহ ১৪৮]

ইসলামের বিরুদ্ধে কে, কী করছে, এই সব নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে, আমাদেরকে প্রতিযোগিতা করতে হবে- আমরা কে, কত বেশি ভালো কাজ করতে পারি। আল্লাহ প্রত্যেককে বিশেষ লক্ষ্য দিয়েছেন। আমাদেরকে সেই লক্ষ্য উপলব্ধি করে চেষ্টা করে যেতে হবে সেই লক্ষ্য অর্জনে কাজ করার।[৬][২] এর জন্য দিনের পর দিন বসে থাকলে হবে না, প্রতি মুহূর্তে প্রতিযোগিতা করতে হবে। আল্লাহ تعالى আমাদেরকে ভালো কাজে দ্রুত চেষ্টা করার জন্য তাগাদা দিয়েছেন। বসে বসে সময় নষ্ট করলে আল্লাহর تعالى প্রতি অবাধ্যতা দেখানো হবে। আমাদের উপর থেকে আল্লাহর تعالى দেওয়া সময়ের বরকত চলে যাবে।[৪]

আমাদের সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। দুনিয়াতে আমাদের সেই প্রতিযোগিতার সময়সীমা প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই শেষ ঘণ্টা বাজল বলে…  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

ওরা তাকে খুব ভালো করে চেনে — আল-বাক্বারাহ ১৪৫-১৪৭

আমরা অনেক সময় মুসলিমদের ভেতরকার সমস্যা নিয়ে এত বেশি হতাশ হয়ে পড়ি যে, অন্য ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেও যে ব্যাপক সমস্যা আছে, তা ভুলে যাই। এই সুযোগে কিছু সুধীবৃন্দ এবং নাস্তিকরা, অমুসলিমদের মগজ ধোলাইয়ের শিকার হয়ে ইসলামের নামে গালিগালাজ করে একচোট দেখিয়ে দেয় যে, ইসলাম হচ্ছে যত নষ্টের মূল। অথচ একটু খোঁজ-খবর নিলেই দেখা যায়, ইহুদি, খ্রিস্টান, হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেও ভয়াবহ সমস্যা রয়েছে। এরকম একটি সমস্যা আল্লাহ تعالى এই আয়াতে উল্লেখ করেছেন—

2_145_title

2_145যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে, তাদেরকে তুমি যদি সবরকম নিদর্শন এনেও দেখাও, তবুও তারা তোমার কিবলা অনুসরণ করবে না। তুমি কখনই তাদের কিবলার অনুসারী হবে না। এমনকি ওরা একে অন্যের কিবলাও অনুসরণ করে না। তোমার কাছে যে জ্ঞান এসেছে, তা  আসার পরেও যদি তুমি ওদের খেয়াল-খুশি মতো করতে যেতে, তাহলে তুমিও সীমালঙ্ঘনকারীদের একজন হয়ে যেতে। [আল-বাক্বারাহ ১৪৫]

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বলছেন যে, অন্য ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে কোনো ঐক্য নেই। ইহুদিদের কিবলা হচ্ছে বাইতুল-মাকদিস, যা আমরা আল-আক্বসা নামে চিনি।[৪] খ্রিস্টানদের কিবলা হচ্ছে পূর্ব দিক।[৪] তারা চার্চগুলোকে পূর্বমুখী করে তৈরি করে। কারণ তারা বিশ্বাস করে যীশু যখন আবার আসবেন, তখন তিনি পূর্ব দিক থেকে আসবেন।[২৭৭] এরা একে অন্যের কিবলাকে অনুসরণ বা সমর্থন করা তো দূরের কথা, অস্বীকার করে। ইহুদিরা মনে করে যীশু হচ্ছেন এক বড় প্রতারক, ভণ্ড নবী।[২৭৬]

কু’রআনে বনী ইসরাইল বলতে আজকের ‘ইসরাইল’ নামক দেশে যারা থাকে, তাদেরকে বোঝায় না। বর্তমান ইসরাইল মূলত একটি সেক্যুলার দেশ। সেই দেশে সেক্যুলার-নাস্তিক বাসিন্দাদের সাথে তাদের ধর্মপ্রাণ ইহুদি বাসিন্দাদের মধ্যে ব্যাপক পরিমাণে সংঘর্ষ চলছে, যেমন কিনা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেও চলছে।[২৬৮] মুসলিম দেশগুলোতে যেমন শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে সবসময় মারামারি লেগেই আছে, সেক্যুলার সরকার ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের কোণঠাসা করে রেখেছে, অনুরূপ একই ঘটনা ঘটছে ইহুদিদের দুটি চরমপন্থী সম্প্রদায়ের মধ্যে। তার উপর ইসরাইলের সেক্যুলার সরকার এবং ধর্মপ্রাণ ইহুদিদের মধ্যে লেগে আছে বিরাট কোন্দল।[২৬৯]  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

কী ওদের কিবলা পালটিয়ে দিলো? — আল-বাক্বারাহ ১৪২-১৪৪

সূরা আল-বাক্বারাহ’র এই আয়াতে কিবলা পরিবর্তনের ঘটনা নিয়ে সুধীবৃন্দরা অনেক তর্ক দাঁড় করিয়েছেন। তাদের দাবি: যেখানে নবী ইব্রাহিম عليه السلام কা’বা মুখি হয়ে সালাত পড়তেন, সেখানে কেন রাসুল মুহাম্মাদ عليه السلام আল-আক্বসা মুখি হয়ে সালাত পড়তেন? উনি কেন নবী ইব্রাহিমের عليه السلام বিরোধিতা করলেন? কেনই বা মুসলিমদেরকে কা’বা মুখি হয়ে সালাত পড়তে হবে, যেখানে কিনা আল্লাহ تعالى কোনো একটি দিকে নির্দিষ্ট নন? যেকোনো একদিকে মুখ করে সালাত পড়লেই তো হয়?

আবার অমুসলিমরা দাবি করেন: হিন্দুদের মতো মুসলিমরাও কা’বা পূজা করে। দেখো না সবাই কা’বা মুখি হয়ে সালাত পড়ে? হাজ্জ হচ্ছে গণপূজা, যেখানে লক্ষ লক্ষ মুসলিম গিয়ে একদম কা’বার সামনে মাথা নত করে। কা’বার সামনে এভাবে মাথা নত করাটা পূজা না তো কী?

অন্যদিকে ইহুদি, খ্রিস্টানরা দাবি করে: মুসলিমদের একসময় আল-আক্বসা মুখি হয়ে সালাত পড়াটা ঐতিহাসিকভাবে ভুল ঘটনা, কারণ রাসুল মুহাম্মাদ عليه السلام -এর মারা যাওয়ার প্রায় একশ বছর পরে আল-আক্বসা মসজিদ তৈরি হয়েছে। এমনকি উমার (রা) যখন জেরুজালেম দখল করেন, তখন আল-আক্বসার জায়গায় ছিল শুধুই কিছু ময়লার স্তূপ। উনিই তো আল-আক্বসার গম্বুজ তৈরি করেন। তাহলে আগে আল-আক্বসা ছিল কীভাবে? সুতরাং কু’রআনে ভুল আছে! —ইহুদি, খ্রিস্টানদের এই যুক্তি এবং ঐতিহাসিক দলিল অনেক ‘আধুনিক মুসলিম’ এবং নাস্তিকরা লুফে নিয়েছে।

আসুন এই ভুল ধারণাগুলোর অবসান করি—

2_142_title

2_142লোকদের মধ্যে বোকাগুলো বলবে, “কী ওদের প্রার্থনার দিক (কিবলা) পালটিয়ে দিলো, যেদিকে তারা মুখ করতো?” বলো, “পূর্ব, পশ্চিম সব আল্লাহর تعالى। তিনি যাকে চান তাকে সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করেন।” [আল-বাক্বারাহ ১৪২]

ঘটনার প্রেক্ষাপট
রাসুল মুহাম্মাদ عليه السلام যখন মক্কায় ছিলেন, তখন তিনি যখন সালাত পড়তেন, তার সামনে কা’বা এবং আক্বসা দুটোই থাকতো। কিন্তু তিনি যখন মদিনা হিজরত করলেন, তখন মক্কা পড়ে গেল একদিকে, আর আক্বসা পড়ে গেল আরেকদিকে। যার ফলে তিনি যখন আক্বসা মুখি হয়ে সালাত পড়তেন, তখন কা’বা থাকতো তার পেছন দিকে। নবী ইব্রাহিমের عليه السلام প্রতি ভালবাসা, এবং তার চেয়েও বেশি কা’বার প্রতি টানের কারণে তিনি মাঝে মাঝেই আকাশের দিকে নির্বাক হয়ে তাকাতেন। যদিও তিনি মুখে কিছু বলতেন না, কিন্তু তিনি মনে মনে চাইতেন আল্লাহ تعالى যেন কা’বাকে কিবলা করে দেন। আল্লাহ تعالى তার এই গোপন চাওয়া পূরণ করলেন। সূরা আল-বাক্বারাহ’র আয়াত নাজিল হলো। আক্বসা থেকে কিবলা ঘুরে গেল কা’বার দিকে।[১৪]

2_144

আমি অবশ্যই দেখেছি তোমাকে বার বার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে। তাই আমি তোমাকে সেই কিবলা দিলাম, যা তুমি পছন্দ করো। এখন তুমি মাসজিদুল-হারাম-এর (কা’বা) দিকে মুখ করো। তোমরা (বিশ্বাসীরা) যেখানেই থাকো না কেন, এর দিকে মুখ করো। যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে, তারা খুব ভালো করে বোঝে যে, এটি তাদের প্রভুর কাছ থেকে আসা সত্য। ওরা কী করে সে ব্যাপারে আল্লাহ تعالى বেখেয়াল নন। [আল-বাক্বারাহ ১৪৪]

কিন্তু আল-আক্বসা কেন কিবলা ছিল?
কা’বা থাকতে আল-আক্বসা কেন কিবলা হয়েছিল? এটা কি নবী ইব্রাহিমের عليه السلام বিরোধিতা হয়ে গেল না? এর উত্তর আছে পরের আয়াতে—  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

তোমরা কী করো, সে ব্যাপারে আল্লাহ বেখেয়াল নন — আল-বাক্বারাহ ১৪০

চৌদ্দশ বছর আগে একদিনের ঘটনা: কয়েকজন উচু পর্যায়ের খ্রিস্টান পাদ্রীরা হন্তদন্ত হয়ে বড় পাদ্রীর সাথে দেখা করতে গেছেন। তিনি এক জরুরি গোপন বৈঠক ডেকেছেন। বাইবেলের কিছু বাণী নিয়ে বিরাট বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। মক্কায় কুরাইশ বংশে এক মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক নাকি দাবী করছেন: তিনিই হচ্ছেন বাইবেলে ভবিষ্যত বাণী করা শেষ নবী! বাইবেলেই নাকি এক আরব নবীর আগমনের কথা ভবিষ্যত বাণী করা আছে। তারা বাইবেল ঘেটে সেই সব বাণী পড়ে, মক্কার সেই মধ্য বয়স্ক লোকের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে দেখেছেন, বাইবেলে তার সম্পর্কে যা যা লেখা আছে, তার সব মিলে যায়! হায়, হায়, এখন কী হবে!

তাদের এত বড় চার্চ, এত ক্ষমতা, রাজকীয় সন্মান, বিরাট লোকলস্কর সব শেষ হয়ে যাবে। এতদিন তারা বাইবেল বিকৃত করে, নিজেদের সুবিধা মত বাণী ঢুকিয়ে মানুষকে বোকা বানিয়ে যে আরাম-আয়েসের জীবন পার করছিলেন, তা সব শেষ হয়ে যাবে। সর্বনাশ! যেভাবেই হোক সেই লোকটাকে থামাতেই হবে। বড় পাদ্রী গম্ভীর গলায় বললেন, “যান, ব্যবস্থা করুন। লোকটাকে যেন কালকে থেকে আর খুঁজে পাওয়া না যায়।”

2_140_title

2_140

তোমরা কি বলছ যে, ইব্রাহিম, ইসমাইল, ইসহাক, ইয়াকুব এবং তার বংশধর গোত্ররা ইহুদি বা খ্রিস্টান ছিল? ওদেরকে বলো, “তোমরা কি বেশি জানো, নাকি আল্লাহ تعالى?” ওর চেয়ে বড় অন্যায়কারী আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর تعالى কাছ থেকে পাওয়া প্রমাণ লুকিয়ে রাখে? তোমরা কী করো, সে ব্যাপারে আল্লাহ تعالى কখনই বেখেয়াল নন। [আল-বাক্বারাহ ১৪০]

বিংশ শতাব্দীর ঘটনা: কয়েকজন ‘বিখ্যাত হুজুর’ হন্তদন্ত হয়ে ‘বড় হুজুরের’ সাথে দেখা করতে গেছেন। ‘বড় হুজুর’ এক গোপন বৈঠক ডেকেছেন। বিদেশ থেকে কিছু শেখ এসে কুরআন এবং সহিহ হাদিস ব্যবহার করে তাদের দলের প্রচার করা নানা শিক্ষাকে বিদআত বলে দাবি করছে। উপমহাদেশে শত বছর ধরে চলে আসা তাদের বিখ্যাত দরবার শরিফ, সেই শেখদের প্রচারের কারণে বিতর্কের মুখে পড়েছে। তাদের দরবার শরিফের অনুসারীরা আজকাল নানা ধরনের প্রশ্ন করা শুরু করেছে। টিভিতে নানা ধরনের অনুষ্ঠানে তাদের শত বছর থেকে চলে আসা নানা ইবাদতকে ভুল বলে প্রচারণা করা হচ্ছে। হুজুররা সেই শেখদের সব দাবিকে একেবারে উড়িয়েও দিতে পারছেন না, কারণ সেই শেখদের দলিল বড়ই শক্ত। হায়, হায়, এখন কী  হবে!

এভাবে চলতে থাকলে তো তাদের লক্ষ লক্ষ অনুসারী হারিয়ে যাবে! তাদের দরবার শরিফের মাদ্রাসা, ইসলামিক রিসার্চ কমপ্লেক্স, কোটি কোটি টাকার যাকাত-সাদাকা ফান্ড, আলিশান ভবন, লাইব্রেরি, বিদেশ যাওয়ার ফান্ড  —এগুলো সব তো হুমকির মুখে পড়বে। এতদিন তারা কেউ কেউ নিজেদের মত ফাতওয়া, বিদআহ প্রচলন করে বই বিক্রি করে, মানুষকে বিভ্রান্ত করে, নানা ধরনের ধর্মীয় উৎসব, ফান্ড কালেকশন, সরকারী পলিসির ব্যবস্থা করে যে বিশাল সম্পত্তি, প্রতিপত্তির আয়োজন করেছেন, সেগুলো তো শেষ হয়ে যাবে। তাদেরকে আবার গরীবি জীবনে ফিরে যেতে হবে!

এরকম কোনোভাবেই হতে দেওয়া যাবে না। ‘বড় হুজুর’ গম্ভীর গলায় বললেন, “এই সব শেখদের দলিলগুলো যেভাবেই হোক ভুল প্রমাণ করে তিন সপ্তাহের মধ্যে বই বেরুন করুন। ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করুন। এদের বিরুদ্ধে পীর, বুজুর্গদের অপমান করার কালিমা লাগিয়ে দিন। মানুষ তখন এদেরকে আর সহ্য করতে পারবে না। এদেরকে দেশ ছাড়া করে ছাড়বে। আর সরকারকে জানিয়ে দিন: এই সব শেখরা আফগানিস্তানে টেরোরিস্টদের মদদ দেয়। তাহলে সরকার আর এদেরকে দেশে ঢুকতে দেবে না।”

“ওর চেয়ে বড় অন্যায়কারী আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর تعالى কাছ থেকে পাওয়া প্রমাণ লুকিয়ে রাখে?”

তোমরা কি বেশি জানো?
ইহুদি, খ্রিস্টানরা দুই পক্ষই নিজেদের মতো দাবি করত যে, সব সত্যিকারের নবী এসেছেন তাদের বংশে, সব নবীরা আসলে তাদেরই ধর্ম প্রচার করে গেছেন, বাকি সব নবী ভন্ড। অথচ তারা ভালো করে জানতো: নবী ইব্রাহিম عليه السلام, ইসমাইল عليه السلام, ইসহাক عليه السلام, ইয়াকুব عليه السلام—এরা কেউ ইহুদি বা খ্রিস্টান ছিলেন না, বরং তারা সবাই এক আল্লাহর উপাসনা করতেন। আজকে যে ইহুদি, খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার হচ্ছে, সেগুলোর উদ্ভব হয়েছে এই নবীদের মারা যাওয়ার বহু পরে। কিন্তু তারপরেও ইহুদি, খ্রিস্টানরা দাবি করে যাচ্ছে যে, তাদের ধর্মই সঠিক ধর্ম! একারণেই আল্লাহ تعالى তাদেরকে বিদ্রুপ করে জিগ্যেস করতে বলছেন, “তোমরা কি বেশি জানো, নাকি আল্লাহ تعالى ?[৬] [৩]

ওর চেয়ে বড় অন্যায়কারী আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর تعالى কাছ থেকে পাওয়া প্রমাণ লুকিয়ে রাখে?

অনেক সময় আমরা ইসলামের উপর বই বা আর্টিকেল পড়ে উপলব্ধি করি যে, আমরা এতদিন যা শিখে এসেছি, তার মধ্যে ভুল রয়েছে। হাজার বছর থেকে বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা কিছু রীতিনীতি, ধারণাগুলো আসলে ইসলাম সমর্থন করে না। অনেক সময় দেখা যায়: আমরা যে দলের শিক্ষা এতদিন অনুসরণ করে এসেছি, তার বিরুদ্ধে কুরআন, সাহিহ হাদিসেই যথেষ্ট শক্ত দলিল আছে। তখন আমরা অনেক সময় ভাবা শুরু করি, “এই খবর যদি মানুষকে জানানো হয় তাহলে ফিতনা তৈরী হবে। মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে যাবে। হুজুরদের প্রতি শ্রদ্ধা উঠে যাবে। এরচেয়ে বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্রতর ত্যাগ করা ভালো। থাক না কিছু কথা গোপন। আল্লাহ تعالى মাফ করবেন।”

না! আল্লাহ تعالى কঠিনভাবে সাবধান করেছেন—

“ওর চেয়ে বড় অন্যায়কারী আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর تعالى কাছ থেকে পাওয়া প্রমাণ লুকিয়ে রাখে?”

তোমরা কী করো, সে ব্যাপারে আল্লাহ تعالى কখনই বেখেয়াল নন

আমরা অনেক সময় টিভিতে কোনো আপত্তিকর কিছু দেখার সময় ভাবি, “থাক, একটু আকটু দেখলে কিছু হবে না। আল্লাহ تعالى অত কিছু ধরেন না।” ব্যাংক থেকে আসা মাসিক স্টেটমেন্ট-এ সুদের পরিমাণ দেখে নিজেকে বোঝাই, “এত অল্প ব্যাপারে আল্লাহ تعالى কিছু মনে করেন না। আমি না নিলে অন্য কেউ তো ঠিকই নিত।” বছরের এক বিশেষ রঙ ছোড়াছুড়ির উৎসবে, বিপরীত লিঙ্গের গায়ে হাত দিয়ে রঙ ঘসাঘসি করে এসে ফেইসবুকে পোস্ট দেই, “আহ হা, তোমরা এইসব ছোটখাটো ব্যাপারে এমন বাড়াবাড়ি করছ কেন? আল্লাহ تعالى অনেক বড়। তিনি এসব ছোটখাটো ব্যাপারে ধরেন না।” অফিসে কেউ এসে তার ফাইলটা সবার আগে পাস করার জন্য একটা দামী বিদেশী সিগারেট সাধলে, তাতে টান দিয়ে ভাবি, “একটু আধটু টানলে আল্লাহ تعالى ধরেন না। আল্লাহ تعالى অনেক বড়। আমার মত মামুলি বান্দার দিকে নজর রাখার সময় কোথায় তার?”

আল্লাহ تعالى সাবধান করে দিয়েছেন—

তোমরা কী করো, সে ব্যাপারে আল্লাহ تعالى কখনই বেখেয়াল নন।

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আরবিতে অত্যন্ত কঠিনভাবে বলেছেন وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ — খবরদার! আল্লাহ تعالى এক মুহুর্তের জন্যও বেখায়াল নন! আমরা টিভিতে আড়চোখে তাকিয়ে কী দেখি, তা আল্লাহ تعالى খুব ভালোভাবে খেয়াল করেন। আমরা বাচ্চাদেরকে স্কুলে দেওয়ার সময় কাকে ফোন করে কী অফার দেই, সেটা আল্লাহ تعالى খুব ভালো করে শোনেন। চাকরির ইন্টারভিউ এর আগে মামা-চাচা-খালুকে কী অনুরোধ করি, সেটা আল্লাহ تعالى রেকর্ড করে রাখেন। বিল দিতে বলার সময় কত টাকা বাড়িয়ে লিখতে বলি, যেন অফিস থেকে বেশি টাকা আদায় করা যায়, সেটার আল্লাহ تعالى হিসেব রাখেন। আল্লাহ تعالى এক মুহুর্তের জন্যও বেখায়াল নন।

আল্লাহ الغفور আল-গাফুউর — অনেক পাপ ক্ষমা করেন, الغفار আল-গাফফার — বার বার ক্ষমা করেন। কিন্তু তাই বলে তিনি غَٰفِل গাফিল — বেখায়াল, অসতর্ক, উদাসীন নন। আমাদের নিয়ত যদি হয় আল্লাহর تعالى ক্ষমার গুণের ফায়দা উঠিয়ে পাপ করে যাওয়া, তাহলে সেটার ক্ষমা পাওয়ার সম্ভাবনা কম।

আল্লাহ تعالى তাওবাহ বা আন্তরিক ক্ষমা প্রার্থনা গ্রহণ করেন, বার বার করেন, যদি সেই ক্ষমা প্রার্থনার সাথে সেই পাপ আর কখনো না করার প্রতিশ্রুতি থাকে। তাওবাহ এসেছে ت و ب থেকে যার অর্থ: ফিরে আসা। আমরা যদি শুধু মুখে বলি, “আল্লাহ, আমি ভুল করেছি, আমাকে ক্ষমা করে দিন”—তাহলে সেটা তাওবাহ হলো না। তাওবাহ হচ্ছে: ১) যেই ভুল কাজটা করছিলাম সেটা করা বন্ধ করা, ২) অন্যের সাথে অন্যায় করলে তার প্রায়শ্চিত্ত করা বা তাদের কাছে ক্ষমা চাওয়া, ৩) একই সাথে আল্লাহর تعالى কাছে ভুল করার জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং ৪) সেই ভুল ভবিষ্যতে আর না করার জন্য প্রতিজ্ঞা করা।[৫] তাহলেই সেটা তাওবাহ হবে।

আসুন আমরা আন্তরিকভাবে আল্লাহর تعالى কাছে তাওবাহ করি। এতদিন আল্লাহকে تعالى উপেক্ষা করে যে সব খারাপ কাজ করছিলাম, ধরে নিচ্ছিলাম যে, আল্লাহ تعالى অতশত খেয়াল করেন না, সেগুলোর জন্য আন্তরিকভাবে অনুশোচনা করি। আল্লাহ تعالى কখনই গাফিল নন, কিন্তু তিনি গাফুউর, গাফফার। তাঁর কাছে আকুলভাবে ক্ষমা চেয়ে নিজেকে সংশোধন করলে, তিনি ক্ষমা করে দেবেন বলে কু’রআনে বার বার কথা দিয়েছেন।

সূত্র:

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
  • [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
  • [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
  • [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
  • [১৫] তাফসির আল জালালাইন।

আমাদের সাথে আল্লাহকে নিয়ে তর্ক করছ কেন? — আল-বাক্বারাহ ১৩৯

ধরুন অফিসের ক্যান্টিনে বসে আপনারা কয়েকজন গল্প করছেন। এর মধ্যে একজন বসের নামে নানা ধরনের বাজে মন্তব্য করছে। সে বলে যাচ্ছে বস ফাঁকিবাজ, অফিসে দেরি করে আসে। অফিসের রিসিপশনিস্টের সাথে বেশি মেলামেশা করে। লোকটা দেখতেও বদখৎ। কয়েকদিন আগে নতুন গাড়ি কিনল। নিশ্চয়ই ঘুষের টাকায় কেনা। গুলশানে নাকি একটা বাড়ি আছে। মনে হয় জালিয়াতি করে কিনেছে…

হঠাৎ করে তার পেছন থেকে বসের গম্ভীর গলা শোনা গেল, “চৌধুরী সাহেব! এদিকে তাকান। কী বলছিলেন আমাকে নিয়ে?” সাথে সাথে চৌধুরী সাহেবের চোখ বড় হয়ে, মুখ রক্তশূন্য হয়ে ফ্যাঁকাসে হয়ে গেল। সে কাঁপতে কাঁপতে ঘুরে তাকিয়ে দেখল, বস ঠিক তার পেছনের চেয়ারেই এতক্ষণ বসে ছিলেন।

যদি চৌধুরী সাহেব জানতেন বস পেছনে বসে আছেন, সব কথা শুনতে পাচ্ছেন, তাহলে কি তিনি কখনো বসকে নিয়ে এধরনের কথা বলতেন? বলতেন না, হাজার হলেও তার চাকরির মায়া আছে।  আমাদের উপর কারো ক্ষমতা আছে এমন কাউকে নিয়ে আমরা কখনো তাকে শুনিয়ে তার নামে আজেবাজে কথা বলি না।

অথচ আল্লাহ تعالى আমাদের সব কথা শুনতে পাচ্ছেন, আমাদের সব কাজ দেখতে পাচ্ছেন, আমরা তাকে নিয়ে কী বলছি, কী লিখছি, কী পড়ছি —সব তিনি দেখছেন। কিন্তু তারপরেও আমরা ঠিকমতো পড়াশুনা না করে তাঁকে নিয়ে যা মনে হয় বলি। যা মনে হয় লিখি। নানা ধরনের আপত্তিকর বই, আর্টিকেল পড়ি, কার্টুন, চলচ্চিত্র দেখি, যেখানে তাঁর সম্পর্কে নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর, এমনকি অশালীন কথাও লেখা থাকে। দলের স্বার্থ ঠিক রাখার জন্য নিজেদের মতকে আল্লাহর تعالى নির্দেশ বলে চালিয়ে দেই। অন্য দলের মানুষরা সঠিক কথা বলছে জানার পরেও নিজের দলকে খুশি রাখার জন্য অন্যায় তর্ক করি।

শুধু তাই না, আজকাল অনেক ‘আধুনিক মুসলিম’দের ধর্ম নিয়ে, আল্লাহর تعالى অস্তিত্ব নিয়ে নানা ধরনের ফিলসফিকাল যুক্তিতর্ক করতে শোনা যায়। এদের প্রতি আমাদের জবাব—

2_139_title

2_139বলো, “আমাদের সাথে আল্লাহকে নিয়ে তর্ক করছ কেন, যেখানে কিনা তিনি আমাদের প্রভু, তোমাদেরও প্রভু?” আমরা যা করি, তা আমাদের হবে, তোমরা যা করো, তা তোমাদের হবে। আমরা শুধুমাত্র তাঁরই প্রতি একান্ত নিবেদিত। [আল-বাক্বারাহ ১৩৯]

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى ইহুদি, খ্রিস্টানদেরকে চ্যালেঞ্জ করতে বলছেন যে, ইসলাম যে প্রভুর উপাসনা করতে বলছে, তিনি তো তাদেরও প্রভু। মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদিরা একই আল্লাহকেই  تعالى তো উপাসনা করে। এই তিন ধর্মের স্রষ্টা তো কোনো ভিন্ন স্রষ্টা নন। আরবি বাইবেলে তো গড লেখা নেই, লেখা আছে আল্লাহ تعالى। আরব দেশগুলোর আরব খ্রিস্টানরা তো আল্লাহকে تعالى গড ডাকেন না, আল্লাহই تعالى ডাকেন। এমনকি যীশু, তার ভাষা আরামাইক-এ, তিনি আল্লাহকে تعالى আল্লাহ تعالى নামেই ডাকতেন। একারণেই কু’রআনে তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে: যাকে নিয়ে তারা মুসলিমদের সাথে তর্ক করছে, তিনি তো তাদেরও প্রভু। তাদের কি একটা বারও আত্মা কাঁপে না আল্লাহর تعالى সম্পর্কে বানিয়ে কথা বলতে? আল্লাহর تعالى কিতাবকে নিজেদের সুবিধা মতো পরিবর্তন করে নিতে?

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বিশেষভাবে ‘রব্ব’ – প্রভু শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেননি খালিক্ক বা সৃষ্টিকর্তা। কারণ একজন সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেই দায়িত্ব ছেড়ে দিতেন পারেন। তার সৃষ্টির উপর কোনো অধিকার নাও থাকতে পারে, এবং তিনি সৃষ্টির দেখাশুনা নাও করতে পারেন। যেমন, যেই জাপানি কোম্পানি আমার গাড়ি বানিয়েছে, তাদের আমার গাড়ির উপর কোনো অধিকার নেই। এখন সেই গাড়ির মালিক আমি। এই গাড়ি নিয়ে এখন আমি যা খুশি করতে পারি। গাড়ি যদি আমার কথামতো না চলে, তাহলে তাকে ধোলাইখালে নিয়ে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে বিক্রিও করে দিতে পারি।

একইভাবে রব্ব (প্রভু) তাঁর সৃষ্টির উপর সম্পূর্ণ অধিকার রাখেন। সমস্ত সৃষ্টি সেই রাব্ব-এর দাস, তাঁর আদেশ মানতে বাধ্য। তিনি তাঁর সৃষ্টিকে নিয়ে যা খুশি করতে পারেন। আল্লাহকে تعالى নিয়ে মুখ খোলার আগে আমাদের এই ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে যে, আমরা তাঁর মামুলি দাস, তিনি আমাদের প্রভু। তিনি শুনছেন আমরা কী বলছি, কেন বলছি, বলে কী ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছি।

আমরা যেন কারো সাথে তর্ক করতে গিয়ে শুধুই তর্কে জেতার জন্য তাঁর নামে বানিয়ে কথা না বলি। আমরা যেন ইসলামিক দলের কাছ থেকে ফান্ড পাওয়ার জন্য আল্লাহকে تعالى নিয়ে দলের স্বার্থ মতো বই না লিখি, অন্যের সমালোচনা না করি। মালয়েশিয়া, সৌদি আরবে পড়াশুনার স্কলারশিপ চলে যাবে, এই ভয়ে ‘বড় হুজুর’ যা লিখতে বলেন, যা প্রচার করতে বলেন, সেটাই যেন না করি। নিজের দলের, মাযহাবের, হুজুরের ভুল দেখেও মুখ বন্ধ করে না থাকি —পাছে আমার নাম, চাকরি, মর্যাদা, স্কলারশিপ চলে যায়। আমরা কার ব্যাপারে কথা বলছি, কলম ধরছি, দুনিয়ার লোভে সেটা ভুলে গেলে হবে না।

“আমরা যা করি, তা আমাদের, তোমরা যা করো, তা তোমাদের।”

অনেকে এই আয়াত পড়ে মনে করেন যে, মানুষ যে যার মতো যা খুশি করুক, কোনো সমস্যা নেই। কুরআনের এই আয়াতে মানুষকে তার ইচ্ছামত চলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। — না, এটি ভুল ধারণা। এই আয়াতে সেই কথা বলা হয়নি, বরং বলা হচ্ছে: আমরা ভালো, খারাপ যা-ই করছি, তা আমাদের হিসাবের খাতায় লেখা হচ্ছে। সেগুলোর জন্য জবাব আমরা দেবো, ভালো কাজের পুরষ্কার আমরা পাবো, আমাদের অন্যায়ের শাস্তি আমরা পাবো। একইভাবে অন্যেরা যা করছে, তা তাদের হিসাবের খাতায় লেখা হচ্ছে। সেগুলোর দায়িত্ব তারা নেবে। তাদের কাজের জবাব আমরা দেবো না। সুতরাং নাস্তিক, সেক্যুলার, ‘আধুনিক মুসলিম’, ইহুদি, খ্রিস্টান ভাই-বোনেরা সাবধান! “আমরা যা করি, তা আমাদের, তোমরা যা করো, তা তোমাদের” হবে।

আমরা শুধুমাত্র তারই প্রতি একান্ত নিবেদিত

এই আয়াতের শেষটা খুব সুন্দর। যারা পুরোপুরি আল্লাহর تعالى প্রতি নিবেদিত, তারা বলে, “وَنَحْنُ لَهُۥ مُخْلِصُونَ”। মুখলিসুন এসেছে ইখলাস থেকে, যার অর্থ একান্ত নিবেদিত, আন্তরিক, পরিষ্কার, পবিত্র হওয়া। যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে, সে মুখলিস।[৪] এটি এমন পরিশুদ্ধতা যে এর মধ্যে খারাপ কিছু মিশে নেই। যখন আমাদের কাছে একবিন্দু তরল থাকে, যা এতটাই বিশুদ্ধ যে, তার মধ্যে বিন্দুমাত্র অবিশুদ্ধতা নেই, সেটা মুখলিস।[১১] এর আরেকটি অর্থ হলো, কেউ যখন লোকজনদের মধ্য থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে, লোকে কী বলল তার পরোয়া করে না, একান্ত নিবেদিতভাবে আল্লাহর تعالى ইবাদত করে —এরা হলো মুখলিসুন।[১১] আল্লাহ تعالى আশা করেন আমরা এদের মতো হই।

একজন মুখলিস কখনো পরোয়া করেন না মানুষ তাকে দাড়িওয়ালা, সন্ত্রাসী, অশিক্ষিত, আনস্মার্ট বলল কিনা। মানুষ তাকে তাবলীগী, জামাতি, সালাফি, ওয়াহাবি, আহলে হাদিস, আহলে কুরআন ইত্যাদি লেবেল দিলেও তিনি পাত্তা দেন না। একজন মুখলিস পরোয়া করেন না ফেইসবুকে তাকে নিয়ে মানুষ কীসব কুৎসা রটাচ্ছে। তিনি একান্ত নিবেদিতভাবে আল্লাহর تعالى প্রতি শ্রদ্ধায়, ভালবাসায় ডুবে থেকে তাঁর ইবাদতে মগ্ন থাকেন।

তার কথা, চিন্তায়, কল্পনায় শুধুই আল্লাহ تعالى। তিনি বই পড়লে বেশিরভাগ সময় আল্লাহকে تعالى নিয়ে বই পড়েন। তিনি কথা বললে ঘুরে ফিরে আল্লাহকে تعالى নিয়েই কথা বলেন। তিনি কোনো গল্পের আসরে বসলে আল্লাহ تعالى ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে কথা শুরু হলে, আস্তে করে উঠে চলে যান। তিনি কোনো অনুষ্ঠানে গেলে মানুষের মাঝে আল্লাহর تعالى কথা ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ ছেড়ে দেন না। আশেপাশের মানুষের কথা, লেখা, কটূক্তি; টিভিতে খেলা, তারকা শো, টক শো; কম্পিউটারে, মোবাইলে ফেইসবুক, ভিডিও গেম সহ নানা প্রলোভন —কোনো কিছুই তাকে তার উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে না। তার এবং আল্লাহর تعالى মাঝে খুব সুন্দর একটা সম্পর্ক রয়েছে, যা শুধু আল্লাহ تعالى এবং তিনিই জানেন, আর কেউ জানে না।

আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এই আয়াতে একদল মুসলিমের উদাহরণ দিয়েছেন, যারা এক কঠিন স্ট্যান্ডার্ড অর্জন করতে পেরেছে। তিনি চান আমরা তাদের মতো ইখলাস অর্জন করি, মুখলিসুনদের একজন হয়ে যাই। আসুন আমরা সবাই চেষ্টা করি: এই স্ট্যান্ডার্ড অর্জন করে জান্নাতে গিয়ে তাঁকে সামনা-সামনি দেখতে পাওয়ার বিরাট সন্মান অর্জন করতে। তাঁর সাথে প্রাণ খুলে কথা বলতে পাওয়ার বিরাট সন্মান অর্জন করতে। আমাদের রব্বকে, যাকে নিয়ে আমরা সারাজীবন কত সাধনা করেছি, কত চিন্তা করেছি, কত কল্পনা করেছি, একদিন তাঁকে সামনাসামনি দেখতে পাবো, তাঁর কথা শুনতে পাবো, তাঁর সাথে কথা বলতে পারবো —এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে!

এটা যে কত বড় ব্যাপার, তা একজন মুখলিস ঠিকই ধরতে পারেন। তখন তিনি আরও উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েন ইসলাম নিয়ে পড়াশুনা করতে, নিজেকে পরিবর্তন করতে, আন্তরিকভাবে তাওবাহ করতে, লোকজন এবং আশেপাশের নানা প্রলোভন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে একান্তভাবে আল্লাহর تعالى প্রতি নিবেদিত হয়ে যেতে।

সূত্র:

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
  • [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
  • [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
  • [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
  • [১৫] তাফসির আল জালালাইন।

আল্লাহর চেয়ে সুন্দর রঙ আর কে দিতে পারে? — আল-বাক্বারাহ ১৩৮

হাজার বছর ধরে মানুষের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে নানা রঙের নানা ধরনের মাহাত্ম্য বের হয়েছে। হিন্দু ধর্মে লাল পবিত্রতার প্রতীক, তাই বিভিন্ন উৎসবে লাল রঙের ব্যবহার দেখা যায়, যেমন বিয়ে, শিশু জন্ম। হলুদ হচ্ছে জ্ঞান এবং শিক্ষার রঙ, তাই বিষ্ণু এবং গণেশ হলুদ রঙের কাপড় পড়ে। নীল স্থিরতা, সাহসিকতা, একনিষ্ঠতার রঙ, তাই রাম, কৃষ্ণর রঙ নীল।[২৭২]

খ্রিস্টানরা কোনো ব্যক্তিকে খ্রিস্ট ধর্মের দীক্ষা দেওয়ার সময় হলুদ রঙের পানিতে গোসল করায়। একইভাবে নবজাতক শিশুকেও, যে কিনা জন্ম হয়েছে পাপী হয়ে, তাকে হলুদ রঙের পানি দিয়ে ‘বাপটাইজ’ করানো হয়। তখন সে যীশুর জীবন দানের ফলে মানুষের সব পাপ কেটে যাওয়ার দাবীদার হয়ে যায়।[৮]

এভাবে যুগে যুগে নানা ধর্মে, বিভিন্ন রঙের বিভিন্ন মাহাত্ম্য বের হয়েছে। ধর্মীয় উৎসবগুলোতে নানা রঙের ছড়াছড়ি দেখা যায়।[৮] একইসাথে মুসলিমদের মধ্যে নানা রঙ নিয়ে নানা ধরনের কুসংস্কার চলে এসেছে। কু’রআনে এই সব ফালতু ধারণাকে ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে—

2_138_title

2_138আমরা আল্লাহর تعالى রঙে রঞ্জিত। আল্লাহর تعالى চেয়ে সুন্দর রঙ আর কে দিতে পারে? আমরা শুধুমাত্র তাঁরই দাস। [আল-বাক্বারাহ ১৩৮]

অনেকে এই আয়াতের অনুবাদ পড়ে ভাবেন, “আল্লাহর تعالى আবার রঙ আছে নাকি? আস্তাগফিরুল্লাহ! কী সব কুফরি কথাবার্তা!” এই আয়াতে ‘আল্লাহর تعالى রঙ’ বলতে একধরনের প্রতীকী অর্থে বোঝানো হয়েছে। আমরা যেমন বলি “তার হৃদয়ে বসন্তের হাওয়া লেগেছে” তখন কিন্তু আমরা ধরে নেই না যে, তার হৃদপিণ্ডে বসন্তের বাতাস ঢুকেছে। এই কথাটা কেউ গ্রীষ্মকালেও বলতে পারে, আবার শীতকালেও বলতে পারে, এর সাথে বসন্ত ঋতুর কোনো সম্পর্ক নেই। একইভাবে এই আয়াতে আক্ষরিক অর্থে কোনো রঙ বোঝানো হয়নি, এটি একটি আরবি প্রবাদ বাক্য। এমনকি যারা কু’রআনে আল্লাহর تعالى সিফাত-এর আক্ষরিক অর্থ করেন, যেমন আল্লাহর تعالى হাত বলতে আক্ষরিক অর্থে হাতই বোঝান, তারাও এই আয়াতে রঙ বলতে আক্ষরিক অর্থে রঙ দাবি করেননি।

এই আয়াতে صِبْغَة বা রঙ-এর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। রঙ যেমন দেখলেই সনাক্ত করা যায়, ঠিক একইভাবে যাদের খাঁটি ঈমান রয়েছে, তাদের কথাবার্তা, কাজ, আচরণ দেখলেই তাকে সনাক্ত করা যায়। একজন প্রকৃত মুসলিমকে দেখলেই বোঝা যায় যে, সে আল্লাহর تعالى রঙে রঞ্জিত।[৪] যদি কোনো মুসলিম-এর কথা-কাজ-আচরণ দেখে কোনোভাবেই বোঝা না যায় যে, সে একজন মুসলিম, তাহলে তার ভেতরে তাওহীদের অভাব রয়েছে। সে এখনো আল্লাহর تعالى রঙে রঞ্জিত হতে পারেনি।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

তিনি বিশুদ্ধ বিশ্বাসের অধিকারী ছিলেন — আল-বাক্বারাহ ১৩৫-১৩৭

ইহুদি, খ্রিস্টানরা রাসুল মুহাম্মাদ عليه السلام-কে মানুষ হিসেবে বেশ পছন্দই করতো। তারা জানতো: তিনি একজন সৎ, বিনয়ী মানুষ, কোনো অন্যায় করেন না, ধনী-গরিব পার্থক্য করেন না। এমনকি তারা রাসুলের عليه السلام কাছে নিজেদের সম্পদ আমানত হিসেবেও রেখে যেত। সবদিক থেকে তারা রাসুলকে عليه السلام একজন অনুসরণ করার মত আদর্শ মানুষ হিসেবেই মানতো। কিন্তু তারপরেও যখন রাসুল عليه السلام তাদেরকে হাজারো যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করতেন যে, তারা ভুল পথে আছে, তাদের ধর্মগ্রন্থগুলো বিকৃত হয়ে গেছে, তখন তারা আর রাসুলের عليه السلام কথা শুনত না। বরং উলটো বলতো—

2_135_title

2_135ওরা বলে, “তোমরা ইহুদি কিংবা খ্রিস্টান হয়ে যাও, তাহলেই পথ পাবে।” বলে দাও, “আমরা বরং ইব্রাহিমের পথ অনুসরণ করবো, তিনি বিশুদ্ধ বিশ্বাসের অধিকারী ছিলেন। তিনি কখনই আল্লাহর تعالى সাথে শিরককারীদের একজন ছিলেন না।” [আল-বাক্বারাহ ১৩৫]

প্রথমে আমাদের বোঝা দরকার: তারা যখন বলছে ইহুদি বা খ্রিস্টান হয়ে যেতে, তারা আসলে কোন ধর্মের দিকে ডাকছে।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)