তুমি কি দেখোনি তোমার প্রভু হাতিওয়ালাদের কী অবস্থা করেছিলেন? —আল-ফীল

তুমি কি দেখোনি তোমার প্রভু হাতিওয়ালাদের কী অবস্থা করেছিলেন? তিনি কি তাদের পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দেননি? তাদের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি পাঠিয়েছিলেন। যারা ওদেরকে পোড়া মাটির পাথর ছুরে মারলো। তারপর ওরা চিবানো খড়কুটোর মতো পড়ে রইল। —আল-ফীল

রাসুল عليه السلام জন্ম হওয়ার কয়েক বছর আগে ইয়েমেনের একজন গভর্নর আবরাহা দেখল যে, মক্কায় কা’বাকে ঘিরে ব্যাপক ব্যবসা-বাণিজ্য হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ মানুষ হাজ্জ করতে আসে। সে সুযোগে মক্কাবাসীরা হাজিদের সাথে ব্যবসা করে অনেক সম্পদের অধিকারী হয়ে যায়। তখন সে ভাবল যে, সে-ও একটা বিরাট গির্জা তৈরি করবে এবং হাজ্জের মতো সেই গির্জাতে তীর্থযাত্রা করার প্রচলন করবে। কিন্তু তার পরিকল্পনা কাজে লাগলো না। তার সাধের গির্জাতে বেশি মানুষ আসলো না। শুধু তাই না, কিছু আরব গিয়ে তার গির্জায় আগুন লাগিয়ে দিলো। তখন সে মহা ক্ষেপে গিয়ে তার বাহিনী নিয়ে মক্কায় গেল কা’বা ধ্বংস করে দিতে।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

যে নিজে থেকে ভালো কাজ করে, আল্লাহ অবশ্যই তার মূল্যায়ন করেন — আল-বাক্বারাহ ১৫৮

2_158_title

2_158সাফা এবং মারওয়াহ আল্লাহর تعالى নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি। তাই যারা কা’বা ঘরে হাজ্জ বা উমরাহ করে, তারা এদুটিকে ঘিরে ঘুরলে কোনো দোষ নেই। আর যে নিজে থেকে ভালো কাজ করে, আল্লাহ تعالى অবশ্যই তার মূল্যায়ন করেন, তিনি সব কিছুর ব্যাপারে জানেন। [আল-বাক্বারাহ ১৫৮]

সাফা এবং মারওয়া আল্লাহর تعالى নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি। এই আয়াতে নিদর্শন বলতে শা’আইর شَعَآئِرِ ব্যবহার করা হয়েছে, যার একবচন শা’ইরাহ شعيرة এসেছে شعر থেকে। এর অর্থ: কোনো স্থাপত্য, চিহ্ন, যা দেখে মানুষের কোনো উপলব্ধি হয়। কোনো কিছু দেখে আমরা যখন কোনো স্মৃতিচারণ করি, আমাদের মধ্যে আবেগের সৃষ্টি হয়, সেটা شعيرة।[১] যেমন বাঙালিদের شعيرة হচ্ছে স্মৃতিসৌধ, যা আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। সেরকম সাফা এবং মারওয়া আমাদেরকে নবী ইব্রাহিম عليه السلام এর স্ত্রীর পানির খোঁজে ছোটাছুটি করার কথা মনে করিয়ে দেয়। তাদের ভীষণ কঠিন সব পরীক্ষা আল্লাহর تعالى প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রেখে নির্দ্বিধায় পার করার চেতনায় আমাদের উদ্বুদ্ধ করে।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

কী ওদের কিবলা পালটিয়ে দিলো? — আল-বাক্বারাহ ১৪২-১৪৪

সূরা আল-বাক্বারাহ’র এই আয়াতে কিবলা পরিবর্তনের ঘটনা নিয়ে সুধীবৃন্দরা অনেক তর্ক দাঁড় করিয়েছেন। তাদের দাবি: যেখানে নবী ইব্রাহিম عليه السلام কা’বা মুখি হয়ে সালাত পড়তেন, সেখানে কেন রাসুল মুহাম্মাদ عليه السلام আল-আক্বসা মুখি হয়ে সালাত পড়তেন? উনি কেন নবী ইব্রাহিমের عليه السلام বিরোধিতা করলেন? কেনই বা মুসলিমদেরকে কা’বা মুখি হয়ে সালাত পড়তে হবে, যেখানে কিনা আল্লাহ تعالى কোনো একটি দিকে নির্দিষ্ট নন? যেকোনো একদিকে মুখ করে সালাত পড়লেই তো হয়?

আবার অমুসলিমরা দাবি করেন: হিন্দুদের মতো মুসলিমরাও কা’বা পূজা করে। দেখো না সবাই কা’বা মুখি হয়ে সালাত পড়ে? হাজ্জ হচ্ছে গণপূজা, যেখানে লক্ষ লক্ষ মুসলিম গিয়ে একদম কা’বার সামনে মাথা নত করে। কা’বার সামনে এভাবে মাথা নত করাটা পূজা না তো কী?

অন্যদিকে ইহুদি, খ্রিস্টানরা দাবি করে: মুসলিমদের একসময় আল-আক্বসা মুখি হয়ে সালাত পড়াটা ঐতিহাসিকভাবে ভুল ঘটনা, কারণ রাসুল মুহাম্মাদ عليه السلام -এর মারা যাওয়ার প্রায় একশ বছর পরে আল-আক্বসা মসজিদ তৈরি হয়েছে। এমনকি উমার (রা) যখন জেরুজালেম দখল করেন, তখন আল-আক্বসার জায়গায় ছিল শুধুই কিছু ময়লার স্তূপ। উনিই তো আল-আক্বসার গম্বুজ তৈরি করেন। তাহলে আগে আল-আক্বসা ছিল কীভাবে? সুতরাং কু’রআনে ভুল আছে! —ইহুদি, খ্রিস্টানদের এই যুক্তি এবং ঐতিহাসিক দলিল অনেক ‘আধুনিক মুসলিম’ এবং নাস্তিকরা লুফে নিয়েছে।

আসুন এই ভুল ধারণাগুলোর অবসান করি—

2_142_title

2_142লোকদের মধ্যে বোকাগুলো বলবে, “কী ওদের প্রার্থনার দিক (কিবলা) পালটিয়ে দিলো, যেদিকে তারা মুখ করতো?” বলো, “পূর্ব, পশ্চিম সব আল্লাহর تعالى। তিনি যাকে চান তাকে সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করেন।” [আল-বাক্বারাহ ১৪২]

ঘটনার প্রেক্ষাপট
রাসুল মুহাম্মাদ عليه السلام যখন মক্কায় ছিলেন, তখন তিনি যখন সালাত পড়তেন, তার সামনে কা’বা এবং আক্বসা দুটোই থাকতো। কিন্তু তিনি যখন মদিনা হিজরত করলেন, তখন মক্কা পড়ে গেল একদিকে, আর আক্বসা পড়ে গেল আরেকদিকে। যার ফলে তিনি যখন আক্বসা মুখি হয়ে সালাত পড়তেন, তখন কা’বা থাকতো তার পেছন দিকে। নবী ইব্রাহিমের عليه السلام প্রতি ভালবাসা, এবং তার চেয়েও বেশি কা’বার প্রতি টানের কারণে তিনি মাঝে মাঝেই আকাশের দিকে নির্বাক হয়ে তাকাতেন। যদিও তিনি মুখে কিছু বলতেন না, কিন্তু তিনি মনে মনে চাইতেন আল্লাহ تعالى যেন কা’বাকে কিবলা করে দেন। আল্লাহ تعالى তার এই গোপন চাওয়া পূরণ করলেন। সূরা আল-বাক্বারাহ’র আয়াত নাজিল হলো। আক্বসা থেকে কিবলা ঘুরে গেল কা’বার দিকে।[১৪]

2_144

আমি অবশ্যই দেখেছি তোমাকে বার বার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে। তাই আমি তোমাকে সেই কিবলা দিলাম, যা তুমি পছন্দ করো। এখন তুমি মাসজিদুল-হারাম-এর (কা’বা) দিকে মুখ করো। তোমরা (বিশ্বাসীরা) যেখানেই থাকো না কেন, এর দিকে মুখ করো। যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে, তারা খুব ভালো করে বোঝে যে, এটি তাদের প্রভুর কাছ থেকে আসা সত্য। ওরা কী করে সে ব্যাপারে আল্লাহ تعالى বেখেয়াল নন। [আল-বাক্বারাহ ১৪৪]

কিন্তু আল-আক্বসা কেন কিবলা ছিল?
কা’বা থাকতে আল-আক্বসা কেন কিবলা হয়েছিল? এটা কি নবী ইব্রাহিমের عليه السلام বিরোধিতা হয়ে গেল না? এর উত্তর আছে পরের আয়াতে—  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

আমার প্রতিশ্রুতি অন্যায়কারীদের কাছে পৌঁছাবে না — আল-বাক্বারাহ ১২৪-১২৫

আপনি বহুবছর বিদেশে কাজ করে দেশে ফিরছেন। এর মধ্যে আপনার এক সন্তান হয়েছে, যাকে আপনি এর আগে কখনো দেখেননি। দেশে ফিরে আপনি তাকে প্রথম বারের মতো দেখবেন, এই খুশিতে আপনি আত্মহারা। কয়েকটা দিন সন্তানের সাথে হেসে-খেলে দিন পার করতে না করতেই, একরাতে স্বপ্ন দেখলেন: আপনি কুরবানি করছেন, আপনার হাতে রক্তাক্ত ছুড়ি, কিন্তু একি! কুরবানির পশুর জায়গায় পড়ে রয়েছে আপনার মৃত সন্তান! আপনি ঘুম ভেঙ্গে লাফ দিয়ে জেগে উঠলেন। এরকম একটা জঘন্য স্বপ্ন দেখে অস্থিরতায় ঘেমে গেলেন। স্বপ্নটা এতটা বাস্তব ছিল, মনে হচ্ছিল ভবিষ্যতের কোনো একটা ঘটনা আপনি নিজের চোখে ঘটতে দেখছেন। এত ভয়ঙ্কর বাস্তব স্বপ্ন আপনি এর আগে কখনো দেখেননি।

পরদিন আপনি ছেলের সাথে খেলছেন। কিন্তু আপনার মন বসছে না। বার বার রাতের দুঃস্বপ্নের কথাটা মনে হচ্ছে। সেদিন রাতে আবারো আপনি সেই স্বপ্নটা দেখলেন। চিৎকার দিয়ে লাফ দিয়ে জেগে উঠলেন। পরদিন আবারো একই স্বপ্ন। কয়েকদিন একই স্বপ্ন দেখার পর আপনি বুঝতে পারলেন, এটা কোনো সাধারণ স্বপ্ন নয়। আপনাকে এই ঘটনা ঘটাতে হবে। আপনাকে স্বপ্নের মাধ্যমে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে এই কাজ করার।

আপনি স্ত্রীকে বলতে গেলেন। আর দশজনের মতো যদি আপনার স্ত্রী হতো, তাহলে সে চিৎকার দিয়ে উঠত, “কী! তোমার কি মাথা খারাপ? জলদি ডাক্তার দেখাও। খবরদার যদি আর কখনো এই কথা শুনি, তাহলে আমি কালকেই আমার ছেলেমেয়ে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যাব।” কিন্তু না, আপনার পরহেজগার, একান্ত নিষ্ঠাবান স্ত্রী আপনাকে বোঝালেন, “আল্লাহর تعالى নির্দেশ আমাদেরকে মানতেই হবে।”

আপনি ভাবলেন: ছেলেকে ঘটনাটা খুলে বলি, তাহলে অন্তত ছেলেটা ভয় পেয়ে চিৎকার শুরু করবে, কিছু একটা ঘটাবে, আর আপনাকে এই কাজটা করতে হবে না। কিন্তু ছেলেকে বলার পর সে শান্ত ভাবে আপনাকে বোঝালো, “বাবা, আল্লাহই تعالى তোমাকে এই কাজ করতে বলছেন। তোমাকে তো অবশ্যই আল্লাহর تعالى নির্দেশ মানতে হবে। চিন্তা করো না বাবা, আমি একটুও কাঁদবো না। তুমি কুরবানি করার আগে আমার চোখটা ঢেকে দিও, যাতে আমি ভয় পেয়ে সরে না যাই।” আপনার বুক ভেঙ্গে গেল। আপনি বুঝতে পারলেন, আপনাকে এই কাজটা করতে হবেই।

বহুবছর আগে আপনাকে এরকম আরেকটা কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। আপনার কাছে নির্দেশ এসেছিল: আপনার স্ত্রী এবং শিশু বাচ্চাটাকে মরুভূমিতে রেখে আসতে হবে। আপনি স্ত্রীকে বললেন, “আমার কাছে নির্দেশ এসেছে, তোমাকে এবং বাচ্চাটাকে মরুভূমিতে রেখে আসতে হবে।” আপনার স্ত্রী কিছুক্ষণ পাথরের মতো দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নীরবে মেনে নিলেন। আপনি তাদেরকে নিয়ে উটের পিঠে চড়ে, শিশুকে বুকে নিয়ে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে মরুভূমিতে চলছেন। এই ভয়ঙ্কর যাত্রায় বাচ্চাটা যে কোনো সময় মারা যেতে পারে। কিন্তু তারপরেও আপনি যাচ্ছেন।

গহীন মরুভূমিতে বহুদূর যাওয়ার পর তাদেরকে একটা জায়গায় থামতে বললেন। সেখানে তাদেরকে দাঁড় করিয়ে রেখে আপনাকে বিদায় নিতে হবে। নিজের ভেতরের কান্না আটকে রেখে, শোকে পাথর হয়ে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। আপনার স্ত্রী বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আপনার চলে যাওয়া দেখলেন। আপনি চলে যাচ্ছেন, আর হাজারো দুশ্চিন্তা আপনার মাথায় আসছে, “ওদের কাছে যে খাবার রেখে এসেছি, সেটা তো কিছুক্ষণ পরেই শেষ হয়ে যাবে? ওরা পানি পাবে কোথা থেকে? পানি থাকা তো দূরের কথা, চারিদিকে যতদূর চোখ যায়, কোনো গাছপালাও নেই। এভাবে কতক্ষণ বেঁচে থাকবে ওরা?”

এরকম ভয়ঙ্কর কিছু পরীক্ষা, যেগুলো আমরা আমাদের জীবনে দেওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারি না, নবী ইব্রাহিম-এর عليه السلام জীবনে সত্যি সত্যিই ঘটেছিল, যার উল্লেখ এই আয়াতে এসেছে—

2_124

মনে কর দেখো, যখন ইব্রাহিমকে তার প্রভু কিছু নির্দেশ দিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন, এবং তিনি তার সব পূরণ করেছিলেন।
আল্লাহ تعالى বলেন, “আমি তোমাকে মানবজাতির ইমাম করবো।”
ইব্রাহিম বলেন, “আমার বংশধরেরাও কি?”
আল্লাহ تعالى বলেন, “আমার প্রতিশ্রুতি অন্যায়কারীদের কাছে পৌঁছাবে না।” [আল-বাক্বারাহ ১২৪]

2_124_title

আমাদের যখন বাচ্চাদেরকে স্কুলে আনতে যেতে দেরি হয়, জ্যামে আটকিয়ে থাকি, পুরো সময়টা আতংকে থাকি: বাচ্চাদের কিছু হলো কিনা; কোনো ছেলেধরা এসে ধরে নিয়ে গেল কিনা। সেখানে নবী ইব্রাহিম عليه السلام নিজের হাতে তার শিশু সন্তানকে, স্ত্রীকে মরুভূমিতে রেখে এসেছিলেন। তিনি জানতেন সেখানে তাদের বাঁচার কোনোই উপায় নেই। তারা পিপাসায় কাতরাতে কাতরাতে ভীষণ কষ্ট পেয়ে মারা যাবে। তারপরেও তিনি সেই কঠিন পরীক্ষা দিয়েছেন, কারণ আল্লাহর تعالى আদেশের উপর কোনো কথা নেই।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)