আমাদের সাথে আল্লাহকে নিয়ে তর্ক করছ কেন? — আল-বাক্বারাহ ১৩৯

ধরুন অফিসের ক্যান্টিনে বসে আপনারা কয়েকজন গল্প করছেন। এর মধ্যে একজন বসের নামে নানা ধরনের বাজে মন্তব্য করছে। সে বলে যাচ্ছে বস ফাঁকিবাজ, অফিসে দেরি করে আসে। অফিসের রিসিপশনিস্টের সাথে বেশি মেলামেশা করে। লোকটা দেখতেও বদখৎ। কয়েকদিন আগে নতুন গাড়ি কিনল। নিশ্চয়ই ঘুষের টাকায় কেনা। গুলশানে নাকি একটা বাড়ি আছে। মনে হয় জালিয়াতি করে কিনেছে…

হঠাৎ করে তার পেছন থেকে বসের গম্ভীর গলা শোনা গেল, “চৌধুরী সাহেব! এদিকে তাকান। কী বলছিলেন আমাকে নিয়ে?” সাথে সাথে চৌধুরী সাহেবের চোখ বড় হয়ে, মুখ রক্তশূন্য হয়ে ফ্যাঁকাসে হয়ে গেল। সে কাঁপতে কাঁপতে ঘুরে তাকিয়ে দেখল, বস ঠিক তার পেছনের চেয়ারেই এতক্ষণ বসে ছিলেন।

যদি চৌধুরী সাহেব জানতেন বস পেছনে বসে আছেন, সব কথা শুনতে পাচ্ছেন, তাহলে কি তিনি কখনো বসকে নিয়ে এধরনের কথা বলতেন? বলতেন না, হাজার হলেও তার চাকরির মায়া আছে।  আমাদের উপর কারো ক্ষমতা আছে এমন কাউকে নিয়ে আমরা কখনো তাকে শুনিয়ে তার নামে আজেবাজে কথা বলি না।

অথচ আল্লাহ تعالى আমাদের সব কথা শুনতে পাচ্ছেন, আমাদের সব কাজ দেখতে পাচ্ছেন, আমরা তাকে নিয়ে কী বলছি, কী লিখছি, কী পড়ছি —সব তিনি দেখছেন। কিন্তু তারপরেও আমরা ঠিকমতো পড়াশুনা না করে তাঁকে নিয়ে যা মনে হয় বলি। যা মনে হয় লিখি। নানা ধরনের আপত্তিকর বই, আর্টিকেল পড়ি, কার্টুন, চলচ্চিত্র দেখি, যেখানে তাঁর সম্পর্কে নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর, এমনকি অশালীন কথাও লেখা থাকে। দলের স্বার্থ ঠিক রাখার জন্য নিজেদের মতকে আল্লাহর تعالى নির্দেশ বলে চালিয়ে দেই। অন্য দলের মানুষরা সঠিক কথা বলছে জানার পরেও নিজের দলকে খুশি রাখার জন্য অন্যায় তর্ক করি।

শুধু তাই না, আজকাল অনেক ‘আধুনিক মুসলিম’দের ধর্ম নিয়ে, আল্লাহর تعالى অস্তিত্ব নিয়ে নানা ধরনের ফিলসফিকাল যুক্তিতর্ক করতে শোনা যায়। এদের প্রতি আমাদের জবাব—

2_139_title

2_139বলো, “আমাদের সাথে আল্লাহকে নিয়ে তর্ক করছ কেন, যেখানে কিনা তিনি আমাদের প্রভু, তোমাদেরও প্রভু?” আমরা যা করি, তা আমাদের হবে, তোমরা যা করো, তা তোমাদের হবে। আমরা শুধুমাত্র তাঁরই প্রতি একান্ত নিবেদিত। [আল-বাক্বারাহ ১৩৯]

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى ইহুদি, খ্রিস্টানদেরকে চ্যালেঞ্জ করতে বলছেন যে, ইসলাম যে প্রভুর উপাসনা করতে বলছে, তিনি তো তাদেরও প্রভু। মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদিরা একই আল্লাহকেই  تعالى তো উপাসনা করে। এই তিন ধর্মের স্রষ্টা তো কোনো ভিন্ন স্রষ্টা নন। আরবি বাইবেলে তো গড লেখা নেই, লেখা আছে আল্লাহ تعالى। আরব দেশগুলোর আরব খ্রিস্টানরা তো আল্লাহকে تعالى গড ডাকেন না, আল্লাহই تعالى ডাকেন। এমনকি যীশু, তার ভাষা আরামাইক-এ, তিনি আল্লাহকে تعالى আল্লাহ تعالى নামেই ডাকতেন। একারণেই কু’রআনে তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে: যাকে নিয়ে তারা মুসলিমদের সাথে তর্ক করছে, তিনি তো তাদেরও প্রভু। তাদের কি একটা বারও আত্মা কাঁপে না আল্লাহর تعالى সম্পর্কে বানিয়ে কথা বলতে? আল্লাহর تعالى কিতাবকে নিজেদের সুবিধা মতো পরিবর্তন করে নিতে?

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বিশেষভাবে ‘রব্ব’ – প্রভু শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেননি খালিক্ক বা সৃষ্টিকর্তা। কারণ একজন সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেই দায়িত্ব ছেড়ে দিতেন পারেন। তার সৃষ্টির উপর কোনো অধিকার নাও থাকতে পারে, এবং তিনি সৃষ্টির দেখাশুনা নাও করতে পারেন। যেমন, যেই জাপানি কোম্পানি আমার গাড়ি বানিয়েছে, তাদের আমার গাড়ির উপর কোনো অধিকার নেই। এখন সেই গাড়ির মালিক আমি। এই গাড়ি নিয়ে এখন আমি যা খুশি করতে পারি। গাড়ি যদি আমার কথামতো না চলে, তাহলে তাকে ধোলাইখালে নিয়ে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে বিক্রিও করে দিতে পারি।

একইভাবে রব্ব (প্রভু) তাঁর সৃষ্টির উপর সম্পূর্ণ অধিকার রাখেন। সমস্ত সৃষ্টি সেই রাব্ব-এর দাস, তাঁর আদেশ মানতে বাধ্য। তিনি তাঁর সৃষ্টিকে নিয়ে যা খুশি করতে পারেন। আল্লাহকে تعالى নিয়ে মুখ খোলার আগে আমাদের এই ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে যে, আমরা তাঁর মামুলি দাস, তিনি আমাদের প্রভু। তিনি শুনছেন আমরা কী বলছি, কেন বলছি, বলে কী ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছি।

আমরা যেন কারো সাথে তর্ক করতে গিয়ে শুধুই তর্কে জেতার জন্য তাঁর নামে বানিয়ে কথা না বলি। আমরা যেন ইসলামিক দলের কাছ থেকে ফান্ড পাওয়ার জন্য আল্লাহকে تعالى নিয়ে দলের স্বার্থ মতো বই না লিখি, অন্যের সমালোচনা না করি। মালয়েশিয়া, সৌদি আরবে পড়াশুনার স্কলারশিপ চলে যাবে, এই ভয়ে ‘বড় হুজুর’ যা লিখতে বলেন, যা প্রচার করতে বলেন, সেটাই যেন না করি। নিজের দলের, মাযহাবের, হুজুরের ভুল দেখেও মুখ বন্ধ করে না থাকি —পাছে আমার নাম, চাকরি, মর্যাদা, স্কলারশিপ চলে যায়। আমরা কার ব্যাপারে কথা বলছি, কলম ধরছি, দুনিয়ার লোভে সেটা ভুলে গেলে হবে না।

“আমরা যা করি, তা আমাদের, তোমরা যা করো, তা তোমাদের।”

অনেকে এই আয়াত পড়ে মনে করেন যে, মানুষ যে যার মতো যা খুশি করুক, কোনো সমস্যা নেই। কুরআনের এই আয়াতে মানুষকে তার ইচ্ছামত চলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। — না, এটি ভুল ধারণা। এই আয়াতে সেই কথা বলা হয়নি, বরং বলা হচ্ছে: আমরা ভালো, খারাপ যা-ই করছি, তা আমাদের হিসাবের খাতায় লেখা হচ্ছে। সেগুলোর জন্য জবাব আমরা দেবো, ভালো কাজের পুরষ্কার আমরা পাবো, আমাদের অন্যায়ের শাস্তি আমরা পাবো। একইভাবে অন্যেরা যা করছে, তা তাদের হিসাবের খাতায় লেখা হচ্ছে। সেগুলোর দায়িত্ব তারা নেবে। তাদের কাজের জবাব আমরা দেবো না। সুতরাং নাস্তিক, সেক্যুলার, ‘আধুনিক মুসলিম’, ইহুদি, খ্রিস্টান ভাই-বোনেরা সাবধান! “আমরা যা করি, তা আমাদের, তোমরা যা করো, তা তোমাদের” হবে।

আমরা শুধুমাত্র তারই প্রতি একান্ত নিবেদিত

এই আয়াতের শেষটা খুব সুন্দর। যারা পুরোপুরি আল্লাহর تعالى প্রতি নিবেদিত, তারা বলে, “وَنَحْنُ لَهُۥ مُخْلِصُونَ”। মুখলিসুন এসেছে ইখলাস থেকে, যার অর্থ একান্ত নিবেদিত, আন্তরিক, পরিষ্কার, পবিত্র হওয়া। যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে, সে মুখলিস।[৪] এটি এমন পরিশুদ্ধতা যে এর মধ্যে খারাপ কিছু মিশে নেই। যখন আমাদের কাছে একবিন্দু তরল থাকে, যা এতটাই বিশুদ্ধ যে, তার মধ্যে বিন্দুমাত্র অবিশুদ্ধতা নেই, সেটা মুখলিস।[১১] এর আরেকটি অর্থ হলো, কেউ যখন লোকজনদের মধ্য থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে, লোকে কী বলল তার পরোয়া করে না, একান্ত নিবেদিতভাবে আল্লাহর تعالى ইবাদত করে —এরা হলো মুখলিসুন।[১১] আল্লাহ تعالى আশা করেন আমরা এদের মতো হই।

একজন মুখলিস কখনো পরোয়া করেন না মানুষ তাকে দাড়িওয়ালা, সন্ত্রাসী, অশিক্ষিত, আনস্মার্ট বলল কিনা। মানুষ তাকে তাবলীগী, জামাতি, সালাফি, ওয়াহাবি, আহলে হাদিস, আহলে কুরআন ইত্যাদি লেবেল দিলেও তিনি পাত্তা দেন না। একজন মুখলিস পরোয়া করেন না ফেইসবুকে তাকে নিয়ে মানুষ কীসব কুৎসা রটাচ্ছে। তিনি একান্ত নিবেদিতভাবে আল্লাহর تعالى প্রতি শ্রদ্ধায়, ভালবাসায় ডুবে থেকে তাঁর ইবাদতে মগ্ন থাকেন।

তার কথা, চিন্তায়, কল্পনায় শুধুই আল্লাহ تعالى। তিনি বই পড়লে বেশিরভাগ সময় আল্লাহকে تعالى নিয়ে বই পড়েন। তিনি কথা বললে ঘুরে ফিরে আল্লাহকে تعالى নিয়েই কথা বলেন। তিনি কোনো গল্পের আসরে বসলে আল্লাহ تعالى ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে কথা শুরু হলে, আস্তে করে উঠে চলে যান। তিনি কোনো অনুষ্ঠানে গেলে মানুষের মাঝে আল্লাহর تعالى কথা ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ ছেড়ে দেন না। আশেপাশের মানুষের কথা, লেখা, কটূক্তি; টিভিতে খেলা, তারকা শো, টক শো; কম্পিউটারে, মোবাইলে ফেইসবুক, ভিডিও গেম সহ নানা প্রলোভন —কোনো কিছুই তাকে তার উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে না। তার এবং আল্লাহর تعالى মাঝে খুব সুন্দর একটা সম্পর্ক রয়েছে, যা শুধু আল্লাহ تعالى এবং তিনিই জানেন, আর কেউ জানে না।

আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এই আয়াতে একদল মুসলিমের উদাহরণ দিয়েছেন, যারা এক কঠিন স্ট্যান্ডার্ড অর্জন করতে পেরেছে। তিনি চান আমরা তাদের মতো ইখলাস অর্জন করি, মুখলিসুনদের একজন হয়ে যাই। আসুন আমরা সবাই চেষ্টা করি: এই স্ট্যান্ডার্ড অর্জন করে জান্নাতে গিয়ে তাঁকে সামনা-সামনি দেখতে পাওয়ার বিরাট সন্মান অর্জন করতে। তাঁর সাথে প্রাণ খুলে কথা বলতে পাওয়ার বিরাট সন্মান অর্জন করতে। আমাদের রব্বকে, যাকে নিয়ে আমরা সারাজীবন কত সাধনা করেছি, কত চিন্তা করেছি, কত কল্পনা করেছি, একদিন তাঁকে সামনাসামনি দেখতে পাবো, তাঁর কথা শুনতে পাবো, তাঁর সাথে কথা বলতে পারবো —এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে!

এটা যে কত বড় ব্যাপার, তা একজন মুখলিস ঠিকই ধরতে পারেন। তখন তিনি আরও উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েন ইসলাম নিয়ে পড়াশুনা করতে, নিজেকে পরিবর্তন করতে, আন্তরিকভাবে তাওবাহ করতে, লোকজন এবং আশেপাশের নানা প্রলোভন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে একান্তভাবে আল্লাহর تعالى প্রতি নিবেদিত হয়ে যেতে।

সূত্র:

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
  • [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
  • [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
  • [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
  • [১৫] তাফসির আল জালালাইন।