তিনি বিশুদ্ধ বিশ্বাসের অধিকারী ছিলেন — আল-বাক্বারাহ ১৩৫-১৩৭

ইহুদি, খ্রিস্টানরা রাসুল মুহাম্মাদ عليه السلام-কে মানুষ হিসেবে বেশ পছন্দই করতো। তারা জানতো: তিনি একজন সৎ, বিনয়ী মানুষ, কোনো অন্যায় করেন না, ধনী-গরিব পার্থক্য করেন না। এমনকি তারা রাসুলের عليه السلام কাছে নিজেদের সম্পদ আমানত হিসেবেও রেখে যেত। সবদিক থেকে তারা রাসুলকে عليه السلام একজন অনুসরণ করার মত আদর্শ মানুষ হিসেবেই মানতো। কিন্তু তারপরেও যখন রাসুল عليه السلام তাদেরকে হাজারো যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করতেন যে, তারা ভুল পথে আছে, তাদের ধর্মগ্রন্থগুলো বিকৃত হয়ে গেছে, তখন তারা আর রাসুলের عليه السلام কথা শুনত না। বরং উলটো বলতো—

2_135_title

2_135ওরা বলে, “তোমরা ইহুদি কিংবা খ্রিস্টান হয়ে যাও, তাহলেই পথ পাবে।” বলে দাও, “আমরা বরং ইব্রাহিমের পথ অনুসরণ করবো, তিনি বিশুদ্ধ বিশ্বাসের অধিকারী ছিলেন। তিনি কখনই আল্লাহর تعالى সাথে শিরককারীদের একজন ছিলেন না।” [আল-বাক্বারাহ ১৩৫]

প্রথমে আমাদের বোঝা দরকার: তারা যখন বলছে ইহুদি বা খ্রিস্টান হয়ে যেতে, তারা আসলে কোন ধর্মের দিকে ডাকছে।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

তোমাদের উপরে আমি যে অনুগ্রহ করেছি, তা মনে করো — আল-বাক্বারাহ ১২২

মুসলিমরা যারা মনে করেন: ইসলামে প্রবেশ করার কারণে তাদের এক পা ইতিমধ্যে জান্নাতে চলে গেছে, আর একটু হলেই অন্য পা-টাও জান্নাতে চলে যাবে, তাদের জন্য আল-বাক্বারাহ’র এই আয়াতগুলো চিন্তার ব্যাপার, কারণ বনি ইসরাইল ঠিক একইভাবে চিন্তা করতো—

2_122

ইসরাইলের বংশধরেরা, তোমাদের উপরে আমি যে অনুগ্রহ করেছি, তা মনে করো। আমি অবশ্যই তোমাদেরকে সব জাতির থেকে বেশি অনুগ্রহ করেছি। [আল-বাক্বারাহ ১২২]

2_122_v2

কু’রআন পড়ার সময় আমরা যখন বনী ইসরাইল বা ইসরাইলের বংশধরদের কথা পড়ি, তখন ভাবি, “আরে, ওই ইহুদিরা কি খারাপটাই না ছিল। আল্লাহ কতবার ওদেরকে বাঁচিয়েছিলেন, তারপরেও ওরা কত খারাপ কাজ করতো। মুসা عليه السلام নবীকে কী কষ্টটাই না দিয়েছিল। ওদের থেকে আমরা কত ভালো জাতি।”

আসলেই কি তাই?

তারা তাদের নবীর عليه السلام অপমান করেছিল, অনেক মুসলিমরাও তাদের নবী মুহাম্মাদের عليه السلام অপমান করেছে: তাঁর নামে কয়েক লক্ষ জাল হাদিস প্রচার করে স্বল্প শিক্ষিত  মুসলিমদেরকে চরম ভুল পথে নিয়ে গেছে, বিদ’আত দিয়ে মুসলিম জাতির একটা বড় অংশকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছে।

বনী ইসরাইলেরা অহংকারী ছিল, তারা মনে করত: তারা হচ্ছে এক বিশেষ জাতি, যাদেরকে আল্লাহ تعالى বিশেষ সন্মান দিয়েছেন এবং তাদের মতো সন্মানিত জাতিকে আল্লাহ تعالى বিশেষ ভাবে রক্ষা করবেন।[২] এই গৌরব নিয়ে নাক উঁচু করে চলে শেষ পর্যন্ত তারা চরম অপমানিত হয়েছিল। তাদের উপরে আল্লাহর تعالى বিশেষ অনুগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। এক হিটলারই ৫৯ লক্ষ ইহুদিকে মেরে ফেলেছিল।

অনেক মুসলিম একই কাজ করেছে: তারা মনে করেছে তারা হচ্ছে সবচেয়ে সন্মানিত উম্মাহ, তারা যেভাবেই জীবনযাপন করুক না কেন, আল্লাহর تعالى বিশেষ অনুগ্রহ তারা পাবেই। যার ফলাফল: আজকে তারা এক চরম অপমানিত জাতি। সবসময় ভয়ে থাকে কবে তাদেরকে অন্য ‘কাফির’ দেশগুলো আক্রমণ করে শেষ করে দিবে। অন্য দেশতো দূরের কথা, নিজের দেশের সেক্যুলার সরকার কবে ধরে নিয়ে যাবে, এই আতংকে দিন পার করে।

বনী ইসরাইলরা তাদের ধর্ম গ্রন্থের বিকৃত অনুবাদ করত, নিজেদের সুবিধামতো কিছু নির্দেশ মানত, অসুবিধাজনক নির্দেশগুলো কৌশলে পরিবর্তন করে দিত—অনেক মুসলিম কু’রআনকে নিয়ে একই কাজ করেছে গত হাজার বছরে। এবং এখন সেটা আরও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। ইহুদিরা তাদের রাবাইদেরকে (আমাদের যেমন মাওলানা, শায়খ) অতিমানব পর্যায়ের মনে করে তাদের অন্ধ অনুসরণ করত। নিজেরা ধর্মীয় বই না পড়ে তাদের রাবাইরা যা বলত, সেটাকেই তারা ধর্মের অংশ মনে করত। আজকে অনেক মুসলিম নিজেরা কু’রআন না পড়ে মাওলানা-শায়খ-পীররা যা বলে, সেটাই অন্ধভাবে অনুসরণ করছে। অনেকে আবার তাদেরকে ঐশ্বরিক-মানব পর্যায়ের সন্মান দিয়ে মাজারে তাদের পূজা করছে।

কু’রআনে যেখানেই দেখবেন ইসরাইলের বংশধরদেরকে কিছু বলা হচ্ছে, মনে রাখবেন, এই কথাগুলো আসলে মুসলিমদেরকেই শেখানোর জন্য বলা হচ্ছে। কু’রআন শুধুই একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ নয় যে, এর মাধ্যমে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে শুধু ইতিহাস শেখাবেন, বরং কু’রআনের প্রতিটি আয়াত হচ্ছে মুসলিমদের জন্য পথ নির্দেশ। আল্লাহ تعالى ওদের মাধ্যমে আমাদেরকে–মুসলিমদেরকে দেখিয়ে দিচ্ছেন কী কী ভুল করা যাবে না; করলে কী ধরনের অপমান-দুঃখ-কষ্ট দুনিয়াতে ভোগ করতে হবে। মুসলিমদের ইতিহাস দেখলে দেখবেন বনী ইসরাইলদের সাথে আমাদের খুব একটা পার্থক্য নেই। তারা যে ভুলগুলো করেছিল, মুসলিমরাও সেগুলো করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে।[৩] যখনি বনী ইসরাইলদেরকে নিয়ে কোনো আয়াত পড়বেন, নিজেকে জিজ্ঞেস করবেন, “আমরাও একই ভুল করছি না তো?”

এই আয়াতে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো: আল্লাহ تعالى দুইবার ‘আমি’ বলেছেন, যেখানে কু’রআনে তিনি বেশিরভাগ আয়াতে ‘আমরা ‘ বা ‘রাজকীয়-আমি’ ব্যবহার করেন। সাধারণত ‘আমরা’ বা ‘রাজকীয়-আমি’ ব্যবহার করা হয় সম্মান, মর্যাদার সাথে দূরত্ব বোঝাতে। কু’রআনে খুব অল্প কিছু আয়াতে আল্লাহ تعالى এই দূরত্ব দূর করে তাঁর تعالى বান্দাদের কাছে এসে ‘আমি’ ব্যবহার করেন। এই আয়াতে তিনি দুই-দুইবার ‘আমি’ ব্যবহার করে বনি ইসরাইলকে এবং আমাদেরকে শেখাচ্ছেন: তিনি নিজে থেকে বনি ইসরাইলকে কতই না অনুগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু কী দুঃখের ব্যাপার সে জন্য তারা আল্লাহর تعالى প্রতি আরও নিবেদিত, কৃতজ্ঞ না হয়ে উলটো তাদের ধর্মীয় গুরুদের কাছে নিজেদেরকে সঁপে দিয়েছে।

ইসরাইল কী?

‘ইসরাইল’ একটি হিব্রু শব্দ, যার অর্থ–আল্লাহর বান্দা। নবী ইয়াকুব عليه السلام এর আরেকটি নাম হলো ইসরাইল। কু’রআনে ইহুদিদেরকে ‘ইয়াকুবের বংশধর’ না বলে ‘ইসরাইলের বংশধর’ বলা হয়েছে, যেন ইহুদিরা এটা ভুলে না যায় যে, তারা ‘আল্লাহর বান্দার’ বংশধর। তাদেরকে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে: তারা যেন তাদের রাবাইদের উপাসনা না করে, শুধুমাত্র আল্লাহরই উপাসনা করে।[৪]

আরেকটি ব্যাপার হলো: বনী ইসরাইল বলতে আজকের  ‘ইসরাইল’ নামক দেশে যারা থাকে, তাদেরকে বোঝায় না। বর্তমান ইসরাইল মূলত একটি সেক্যুলার দেশ। সেই দেশে সেক্যুলার-নাস্তিক বাসিন্দাদের সাথে তাদের ধর্মপ্রাণ ইহুদি বাসিন্দাদের মধ্যে ব্যাপক পরিমাণে সংঘর্ষ চলছে, যেমন  কিনা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেও  চলছে।[২৬৮] মুসলিম দেশগুলোতে যেমন শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে সবসময় মারামারি লেগেই আছে, সেক্যুলার সরকার ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের কোণঠাসা করে রেখেছে, অনুরূপ একই ঘটনা ঘটছে ইহুদিদের দুটি চরমপন্থি সম্প্রদায়ের মধ্যে এবং ইসরাইলের সেক্যুলার সরকার এবং ধর্মপ্রাণ ইহুদিদের মধ্যে।[২৬৯]

ইসরাইলের সংবাদ মাধ্যমগুলো কিছুদিন দেখলে এবং বিবিসির ডকুমেন্টারি দেখলে বুঝতে পারবেন: ইসরাইলে আজকে কী ভয়াবহ অবস্থা চলছে। অনেক মুসলিম দেশের মতো ইসরাইলেও অল্প কিছু এলাকা ছাড়া বাকি সব জেলাগুলো একেকটা যুদ্ধ ক্ষেত্রের মতো এবং পুরো দেশটি একটি গৃহ যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।[২৬৭] যারা বলে: মুসলিম জাতি হচ্ছে একটা খারাপ জাতি, অন্যদের সাথে ঝামেলা তো করেই, নিজেদের ভেতরেও মারামারি করে নিজেদেরকে শেষ করে দিচ্ছে— তাদেরকে ইসরাইলের খবরের কাগজগুলো কয়েকদিন পড়তে বলেন।

বনি ইসরাইল টাইপের মুসলিমরা

হাজার বছর আগে বনি ইসরাইলকে আল্লাহ تعالى অনেক সন্মান দিয়েছেন, কারণ তারা বড় বড় নবীদের عليه السلام বংশধর।[৬] এছাড়াও তাদের জন্য আল্লাহ تعالى মহাবিশ্ব পরিচালনার স্বাভাবিক নিয়ম ভেঙে, এমন সব অসাধারণ অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়েছেন, যেটা তিনি খুব কম করেছেন। শুধু তাই না, তারা মনে করত: তারা যতই কুকর্ম করুক, তাদের নবীদের عليه السلام উসিলায় ঠিকই তারা কিয়ামাতের দিন পার পেয়ে যাবে—হাজার হলেও নবী মুসা عليه السلام আছেন না? খোদ আল্লাহর تعالى সাথে কথা বলেছেন এমন একজন নবী! তার মতো এত বড় নবী عليه السلام  সুপারিশ করলে তাদের জান্নাতে যাওয়া আর ঠেকায় কে?[৬]

এই একই ধারণা আজকাল অনেক বনী ইসরাইল টাইপের মুসলিমদের মধ্যেও আছে, যারা মনে করে: তাদের বিরাট সব গুনাহ রাসুল মুহাম্মাদ عليه السلام এর অনুরোধ শুনেই আল্লাহ تعالى মাফ করে দেবেন। আবার অনেকে মনে করে: একজন পীর ধরলে, বা কোনো মাজারে মুরিদ হলে, বা কোনো শেখের-মাওলানার বায়াত নিলে, কিয়ামাতের দিন সেই পীর-শেখ-মাওলানা তাদের হয়ে আল্লাহর تعالى কাছে তদবির করে জান্নাতে যাবার জন্য ভিসা করে দিবেন।

এভাবে একমাত্র আল্লাহর تعالى যে ক্ষমতা আছে, সেই ক্ষমতা কোনো মানুষকে দিয়ে দেওয়া —এগুলো সবই একধরনের শির্‌ক এবং এই সব শাফাআতের ধারণা যে ভুল[২৬৫], তা আল্লাহ تعالى কু’রআনে একবার দুইবার নয়, বহু বার, বহু ভাবে, বহু উদাহরণ দিয়ে আমাদের সাবধান করেছেন। শুধুমাত্র বিশেষ কিছু প্রেক্ষিতে শাফাআত করা  হবে, তা পরে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

মানুষ কেন শাফাআত পাওয়ার চেষ্টা করে?

আসুন বোঝার চেষ্টা করি মানুষ কেন এই ধরনের শির্‌ক করে: শাফাআত পাওয়ার চেষ্টা করে। ধরুন, আপনি একটা কোম্পানিতে চাকরি করেন, যার চেয়ারম্যান খুবই ন্যায়পরায়ণ মানুষ। তিনি কাউকে কোনো ছাড় দেন না। প্রত্যেকের সাথে সমান আচরণ করেন এবং প্রত্যেকের কাজের খুঁটিনাটি হিসাব রাখেন। এখন তার অধীনে যে ডিরেকটররা আছে, তার মধ্যে একজন হচ্ছে আপনার মামা। আপনি জানেন যে আপনি যদি অফিসে একটু দেরি করে আসেন, মাঝে মধ্যে না বলে ছুটি নেন, হাজার খানেক টাকা এদিক ওদিক করে ফেলেন, তাতে কোনো সমস্যা নেই। চেয়ারম্যানের কাছে যদি একদিন ধরা পড়েও যান, আপনার মামা ঠিকই আপনাকে বাঁচিয়ে দেবে। হাজার হোক, মামা তো। সেজন্য মামাকে খুশি রাখার জন্য আপনি প্রতি মাসে তার বাসায় উপহার নিয়ে যান, অফিসে তাকে শুনিয়ে সবার কাছে তার নামে প্রশংসা করেন, তার জন্মদিনে বিপুল আয়োজন করে অনুষ্ঠান করেন। যেভাবেই হোক মামাকে হাতে রাখতেই হবে। মামা না থাকলে সর্বনাশ।

এই হচ্ছে শির্‌কের সমস্যা। মুসলিমরা জানে যে, আল্লাহ تعالى হচ্ছেন Absolute Just – পরম বিচারক, পরম ন্যায়পরায়ণ। তিনি মানুষের সব অপকর্ম খুঁটিনাটি কিয়ামতে দেখাবেন। এখন মানুষ যে প্রতিদিন ইসলামের বড় বড় নিয়ম ভাঙছে, নিজের সুবিধার জন্য ঘুষ দিচ্ছে, সুদ নিচ্ছে– এগুলোর প্রত্যেকটা যদি গুণে গুণে হিসাব করা হয় এবং প্রতিটা অপকর্মের বিচার করা হয়, তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে! বেহেশত পাওয়ার কোনো আশাই থাকবে না! তাহলে কী করা যায়? দেখি আল্লাহর تعالى অধীনে কাউকে হাত করা যায় কি না। তাহলে তাকে দিয়ে কিয়ামতের দিন আল্লাহকে تعالى বলালে হয়ত আল্লাহ تعالى কিছু বড় দোষ মাফ করে দিবেন।

অনেকে মনে করেন: কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহ تعالى তার বিচার করবেন, এবং বিচারের পরে দেখা যাবে তার অবস্থা খুবই খারাপ, তখন সে কিয়ামতের মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে তার পির-দরবেশ-শেখ-মাওলানাদেরকে খুঁজে বের করতে পারবে এবং তাদেরকে গিয়ে অনুরোধ করতে পারবে: যদি তারা সুপারিশ করে তাকে বাঁচাতে পারে। আবার অনেকে মনে করে: আল্লাহ تعالى যখন কিয়ামতে তার বিচার করে তার উপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হবেন, তখন সে যদি মরিয়া হয়ে আল্লাহকে تعالى অনুরোধ করে, “ও আল্লাহ, আমি লক্ষ লক্ষ টাকার ঘুষ খেয়েছি জানি—আমি খুবই দুঃখিত। কিন্তু আপনি আমার অমুক-বাগ শরীফের হুজুরকে একবার ডাকেন। আমি বিশ বছর তার বায়াতে ছিলাম। তাকে লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়েছি, তাকে কতবার হাজির বিরিয়ানি খাইয়েছি। উনি আমার জন্য কিছু বলবেন।”

আবার অনেকে ধরে নেয় যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ تعالى যখন তার বিচার করে তার উপরে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে থাকবেন, তখন সে যদি আল্লাহকে تعالى অনুরোধ করে, “ও আল্লাহ, আমি পর্দা না করে সারা জীবন নির্লজ্জের মতো ঘুরে বেড়িয়েছি, বান্ধবীদের কাছে ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গিবত করেছি, হিন্দি সিরিয়াল দেখে শাশুড়ির সাথে অনেক কুটনামি করেছি—আমি অনেক অপরাধ করে ফেলেছি। কিন্তু আপনি একটু নবীকে عليه السلام ডাকেন। আমি ওনার জন্য অনেক দুরুদ পড়েছি, তাঁর জন্য কত মিলাদ দিয়েছি, তাঁর জন্য সুন্নত নামাজ পড়েছি। উনাকে একটু ডাকেন, উনি আমার জন্য আপনাকে কিছু বলবেন, প্লিজ।”

বাকারাহ-এর ৪৮, ১২৩, ২৪৫ আয়াতে স্পষ্ট করে একই কথা বার বার বলা হয়েছে: কেউ অন্য কারও সাহায্যে নিজে থেকে এগিয়ে আসবে না। আপনার পির, দরবেশ, মাওলানা, শেখ—কেউ নিজে থেকে এগিয়ে আসবে না আপনার অপকর্মের জন্য সুপারিশ করতে, এমনকি তারা করলেও তা গ্রহণ করা হবে না। তারা সবাই, এমনকি আল্লাহর تعالى সবচেয়ে কাছের নবী, রাসুলরাও সেদিন আল্লাহর تعالى ভয়ে থাকবেন, নিজেদেরকে নিয়ে চিন্তিত থাকবেন—

أُو۟لَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إِلَىٰ رَبِّهِمُ ٱلْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُۥ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُۥٓ ۚ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحْذُورًا
ওরা যাদেরকে সাহায্যের জন্য ডাকে, তারা নিজেরাই তো তাদের প্রভুর অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে—যদিও তারা তাঁর সবচেয়ে কাছের। তারা সবাই তাঁর করুণার আশা করে, তাঁর শাস্তিকে প্রচণ্ড ভয় পায়। নিঃসন্দেহে, তোমার প্রভুর শাস্তি অত্যন্ত ভয় পাওয়ার মতো। [আল-ইসরা ১৭:৫৭]

أَفَمَنْ حَقَّ عَلَيْهِ كَلِمَةُ ٱلْعَذَابِ أَفَأَنتَ تُنقِذُ مَن فِى ٱلنَّارِ
তার কী হবে যার জন্য শাস্তির হুকুম অবধারিত হয়ে গেছে? তুমি (মুহাম্মাদ) কি তাদেরকে বাঁচাতে পারবে যারা ইতিমধ্যেই আগুনে নিমজ্জিত?[আজ-জুমার ৩৯:১৯]

কী ধরনের শাফাআত হবে?

তবে কিয়ামতের দিন একেবারেই যে কোনো ধরনের শাফাআত হবে না—সেটা ভুল ধারণা। আল্লাহ تعالى যখন বিশেষ কিছু কারণে কাউকে অনুমতি দিবেন, তখন শুধু তারাই শাফাআত করতে পারবে। কু’রআনের অন্যান্য আয়াতে এই ধরনের সুপারিশের ঘটনা বলা আছে—

يَوْمَئِذٍ لَّا تَنفَعُ ٱلشَّفَٰعَةُ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ ٱلرَّحْمَٰنُ وَرَضِىَ لَهُۥ قَوْلًا
সেদিন কোনো সুপারিশ কাজে লাগবে না, তবে তার সুপারিশ ছাড়া, যাকে পরম করুণাময়  অনুমতি দিবেন, যার কথায় তিনি সন্তুষ্ট। [সূরা তাহা ২০:১০৯]

শাফাআত পাবার জন্য তিনটি শর্ত[২৬৫] জরুরি—

১) আল্লাহ تعالى যার শাফাআত গ্রহণ করবেন, তাকে প্রথমে তিনি অনুমতি দিবেন। আল্লাহর تعالى অনুমতি ছাড়া কেউ শাফাআত করতে পারবে না।[২০:১০৯, ২:২৫৫, ৫৩:২৬]
২) যিনি শাফাআত করবেন, তার প্রতি আল্লাহ تعالى সন্তুষ্ট থাকতে হবেন।[২১:২৮, ৫৩:২৬]
৩) যার জন্য শাফাআত করা হবে, তার ঈমান থাকতে হবে—নামাজ, যাকাত, গরিবদের হক আদায় ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে পাশ করতে হবে।[৭৪:৩৮-৪৮]

যদি আল্লাহ تعالى কারও প্রতি সন্তুষ্ট না হন, সে যদি নিজেই ঘোরতর অপরাধী হয়ে আল্লাহর تعالى ক্রোধের কারণ হয়ে থাকে, তাহলে সে আর শাফাআত পাবে না।[২৬৬] শাফাআত পাবার পূর্বশর্ত হচ্ছে ঈমান থাকা।[৪] আর ঈমান একটি হাই স্ট্যান্ডার্ড, যা ‘ইসলাম’ থেকে আরও উপরের একটি অবস্থা। বাকারাহ-এর প্রথম কয়েকটি আয়াতে ঈমানের হাই স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে বলা হয়েছে। প্রথমে একজন ইসলামে প্রবেশ করে ‘মুসলিম’ হন, তারপরে ‘ঈমান’ অর্জন করে অনেকে ‘মুমিন’ পর্যায়ে যেতে পারেন, এবং কিছু সৌভাগ্যবান মানুষ একসময় ‘ইহসান’ অর্জন করে সর্বোচ্চ পর্যায় ‘মুহসিন’ পর্যন্ত যেতে পারেন।

قَالَتِ ٱلْأَعْرَابُ ءَامَنَّا ۖ قُل لَّمْ تُؤْمِنُوا۟ وَلَٰكِن قُولُوٓا۟ أَسْلَمْنَا وَلَمَّا يَدْخُلِ ٱلْإِيمَٰنُ فِى قُلُوبِكُمْ
মরুবাসি আরবরা বলে, “আমরা ঈমান এনেছি।” তাদেরকে বলো, “তোমরা ঈমান আনোনি, বরং তোমরা কেবল সমর্পণ (আসলাম) করেছ। তোমাদের অন্তরে ঈমান এখনো প্রবেশ করেনি।” [আল-হুজুরাত ৪৯:১৪]

সুতরাং কেউ যদি ধরে নেয়: সে নামাজ না পড়ে, রোজা না রেখে, সামর্থ্য থাকতে যাকাত না দিয়ে, হজ্জ না করে, বড় বড় কবিরা গুনাহ করে, শুধুমাত্র কোনো নবী-পীর-দরবেশের সুপারিশ পেয়ে জান্নাতে চলে যাবে, তাহলে শাফাআত সম্পর্কে তার একেবারেই ভুল ধারণা আছে। শাফাআত শুধু তারাই পাবে যারা মূলত ঈমানদার। ইসলামের মূল পাঁচটি ভিত্তি সম্পর্কে সে যথেষ্ট নিষ্ঠাবান ছিল, কিন্তু তার দুর্বলতার কারণে সে কিছু পাপ করে ফেলেছে, বা অল্প কিছু ভালো কাজের অভাবে জান্নাত হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছে, তখন তাদের শাফাআত পাওয়ার সুযোগ হতে পারে।[২৬৬][৯]

মানুষ একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারে যে, শাফাআতের পেছনে ছোটাছুটি করাটা কতটা বোকামি। কারও যদি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রাফিক জ্যামে বসে কোনো হুজুরের কাছে যাবার সময় থাকে, তাহলে তার সেই সময়টা নফল নামাজ পড়ে, অথবা কু’রআন পড়ে বিরাট সওয়াব অর্জন করে, স্বয়ং আল্লাহকে تعالى আরও বেশি খুশি করাটা কি বেশি যুক্তিযুক্ত নয়? কারও যদি পকেটে যথেষ্ট টাকা থাকে হুজুরের সেবা করার জন্য, তাহলে কি তার সেই টাকাটা গরিব, ইয়াতিম মানুষদেরকে সাদাকা দিয়ে বিশাল সওয়াব অর্জন করে, আল্লাহকে تعالى আরও খুশি করাটা বেশি যুক্তিযুক্ত নয়? সরাসরি আল্লাহকে تعالى আরও বেশি খুশি করার চেষ্টা না করে, তার অধীনে অন্য কারও জন্য আমাদের সীমিত জীবনের মূল্যবান সময় ব্যায় করাটা কি কোনো যৌক্তিক কাজ?

সূত্র:

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
  • [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
  • [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
  • [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
  • [১৫] তাফসির আল জালালাইন।
  • [২৬৫] শাফাআ’তের শর্তগুলো — http://www.islam-qa.com/en/21672
  • [২৬৬] শেখ ইয়াসির কাজির শাফাআতের উপর লেকচার— http://www.youtube.com/watch?v=X5OQ8HSchYE
  • [২৬৭] ইসরাইলে গৃহ যুদ্ধ — http://www.globalresearch.ca/israels-coming-civil-war-the-haredi-jews-versus-secular-zionist-militarism/5323834
  • [২৬৮] ইসরাইলে ইহুদি ধর্মাবলম্বী এবং সেক্যুলারদের মধ্যে সঙ্ঘাত — http://hrsbstaff.ednet.ns.ca/morrison/50%20Extended%20Essays/p&cs_anon_essay.pdf
  • [২৬৯] ইহুদিদের সাথে গণতন্ত্রের সঙ্ঘাত — http://forward.com/articles/175013/is-rise-of-jewish-fundamentalism-endangering-israe/?p=all

আমরা শুনলাম এবং আমরা অস্বীকার করলাম — আল-বাক্বারাহ ৯২-৯৩

কোনো এক অদ্ভুত কারণে হাজার হাজার বছর আগে থেকেই মানুষের গরুর প্রতি একধরনের বিশেষ প্রীতি ছিল। প্রাচীন মিশরীয়রা গরু পূজা করত।[১৮২] বনী ইসরাইল জাতি গরু পূজা করত। আজকে অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী গরুকে দেবতা মনে করে। তারা গরুকে এক বিশেষ পবিত্র সৃষ্টি মনে করে বছরে এক বিশেষ দিন গরুর সন্মানে উদযাপন করে।[১৮২] শয়তান পূজারিরা গরুর মাথার কঙ্কাল এবং রক্ত ব্যবহার করে। এমনকি শয়তানের চিত্রকর্মে তাকে গরুর মত শিং দেওয়া হয়। নানা ধরনের প্রাচীন জাদু, ডাইনীবিদ্যায় গরুর জিনিসপত্র ব্যবহার করা হয়।[১৮৩] এমনকি আমাদের সময় স্কুলে বাংলা কোর্সে এত প্রাণী থাকতে গরুর রচনাই লিখতে দেওয়া হত ।

2_92

কোনো সন্দেহ নেই, মুসা তোমাদেরকে পরিষ্কার নিদর্শন এনে দেখিয়েছিল। তারপর সে যখন অনুপস্থিত ছিল, তোমরা বাছুরকে পূজা করাশুরু করলে। তোমরা চরম অন্যায়কারী ! [আল-বাক্বারাহ ৯২]

আল্লাহর تعالى বাণী নিয়ে মানুষের তামাশা করার প্রবণতার আরেকটি উদাহরণ আমরা এই আয়াতে পাব। বনী ইসরাইলিরা দেখল যে, নবী মূসা عليه السلام আল্লাহর تعالى কাছ থেকে যে তাওরাতের বাণী নিয়ে এসেছেন, সেই বাণী মেনে চলাটা বেশ কঠিন। তখন তারা সেটা থেকে বাঁচার জন্য অজুহাত খোঁজা শুরু করল। প্রথমে তারা নবী মূসাকে عليه السلام বলল: তার মুখের কথা তারা বিশ্বাস করবে না, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর تعالى কাছ থেকে নিজের কানে না শুনছে।[৪][৮]

তখন নবী মূসা عليه السلام তাদের মধ্য থেকে ৭০ জন প্রতিনিধিকে বাছাই করে তূর পাহাড়ে নিয়ে গেলেন। সেখানে আল্লাহ تعالى তাদেরকে সরাসরি তাওরাত মেনে চলার হুকুম দিলেন। তারপর সেই প্রতিনিধিরা ফিরে এসে নিজ নিজ গোত্রের সামনে স্বীকার করল যে, আল্লাহ تعالى সত্যিই তাদেরকে তাওরাত মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এর সাথে তারা আর একটি কথা যোগ করে দিল: “আল্লাহ বলেছেন যে, তোমাদের পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব, ততটুকু মেনে চলবে। যা মেনে চলতে পারবে না, তা তিনি ক্ষমা করে দিবেন।”

এরপর থেকে তাওরাতের যেই নির্দেশই তাদের কাছে কঠিন মনে হতো, সেটাকেই তারা ছেড়ে দিত — এই মনে করে যে, আল্লাহ তা ক্ষমা করে দিবেন।[৪][৮] তাদের এই ভণ্ডামিতে আল্লাহ تعالى রেগে গিয়ে এক অসাধারণ ঘটনা ঘটালেন —  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

তখনি কেন তোমরা অহংকারী হয়ে যাও — আল-বাক্বারাহ ৮৭

আল্লাহ تعالى আমাদেরকে ইসলাম দিয়েছেন, যেন আমরা ইসলাম অনুসারে আমাদের জীবন গড়ে তুলি। কিন্তু অনেককেই দেখা যায় তাদের লাইফ স্টাইল, সংস্কৃতি, ফ্যাশন, দুই নম্বরি ব্যবসায় যেন কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্য ইসলামকে তাদের ইচ্ছামত পরিবর্তন করেন, যাতে করে সেই ‘ইসলাম’ মানতে নিজেদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন করতে না হয়। যেমন, আপনি আপনার প্রতিবেশীকে একদিন বললেন, “চৌধুরী সাহেব, ভাই কিছু মনে করবেন না, আপনার ব্যবসাটা কিন্তু হারাম ব্যবসা। আপনার ঘরের মেয়েরা যেই ধরনের কাপড় পড়ছেন, সেটা ইসলামের দৃষ্টিতে একেবারেই নিষিদ্ধ। আর আপনার ছেলেমেয়ের বিয়েতে যে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা উড়ালেন, আল্লাহর تعالى কাছে তার জবাব কীভাবে দেবেন?”

সাথে সাথে তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠবেন, “কি! আপনি কি বলতে চাচ্ছেন ইসলাম কী আমি সেটা জানি না? আপনাদের মত তালেবানদের জন্য আজকে ইসলামের এই অবস্থা। দেশটাকে আপনারা আরেকটা আফগানিস্তান বানিয়ে ফেলছেন।”

এধরনের মানুষদেরকে যখন কেউ বার বার নিষেধ করতে থাকে, এবং তাদের আসল জায়গায়: ব্যাংক ব্যালেন্স এবং সম্পত্তিতে সমস্যা তৈরি করে —তখন তারা তাদের ‘সোনার ছেলেদের’ ফোন করেন, “তোমাকে একটা লোকের নাম-ঠিকানা পাঠাচ্ছি। একে সরিয়ে ফেল।”

এদের উদাহরণ হলো এই আয়াতের বনী ইসরাইলের মতো—

2_87

আমি অবশ্যই মুসাকে কিতাব দিয়েছিলাম। তারপর তার সমর্থন করে ধারাবাহিকভাবে কয়েকজন রাসুল/বার্তাবাহক পাঠিয়েছিলাম। আর আমি মরিয়মের সন্তান ঈসাকে একদম পরিষ্কার নিদর্শন দিয়েছিলাম এবং তাকে পবিত্র রূহ দিয়ে শক্তিশালী করেছিলাম। যখনি কোনো রাসুল/বার্তাবাহক এমন কিছু নিয়ে আসে, যা তোমাদের কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে যায়, তখনি কেন তোমরা অহংকারী হয়ে যাও? কেন তাদের কয়েকজনকে তোমরা মিথ্যাবাদীর কালিমা দাও, কয়েকজনকে খুন করো? [আল-বাক্বারাহ ৮৭]

Corruption-1

মানুষের মধ্যে একটা স্বভাবজাত প্রবৃত্তি আছে আইনকে নিজের সুবিধামত বিকৃত করে, অন্যের সাথে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করার, যাতে করে তারা তাদের স্বার্থপর সাম্প্রদায়িক, জাতিগত, দলগত উদ্দেশ্যগুলো হাসিল করতে পারে। এটা সাধারণত সেই সব সমাজে দেখা যায়, যেখানে মানুষ ন্যায়ভাবে চলার ন্যূনতম ধারণাগুলো হারিয়ে ফেলে।[৬]

একটা ছোট বাচ্চা চেষ্টা করে কীভাবে বাবা-মার কাছ থেকে ঘরের নিয়ম কানুনে শুধুমাত্র তার জন্য বিশেষ ছাড় পাওয়া যায়, “বাবা, আমি জানি আমাদের দিনে একটার বেশি চকলেট খাওয়া নিষেধ। কিন্তু শুধু আমাকে দিনের বেলা একটা, আর রাতের বেলা আরেকটা দেওয়া যায়? আমি ছোটকে দেখাব না। একদম লুকিয়ে লুকিয়ে খাব।” তারপর মানুষ বড় হলে মন্ত্রীকে ফোন করে, “সালাম মন্ত্রী সাহেব, সংসদে ওই বিলটা পাশ হলে কিন্তু আমাদের দল আর এই বছর গাড়ি পাবে না। আপনি ব্যবস্থা করুণ যেভাবেই হোক সেই বিলটা যেন পাশ না হয়। আমি আপনাকে খুশি করে দেব। গুলশানে দুটো বাড়ি আর আগামি দশ বছরের জন্য আপনার রঙিন পানির সাপ্লাই আমার দায়িত্ব। আপনার আর কী লাগবে শুধু বলেন আমাকে।” ধর্মীয় দলগুলোর মধ্যে চলে আরেক ধরনের আলোচনা, “হুজুরে পাক, আপনি দেশের সবচেয়ে বড় মুফতিদের একজন। এই ফতোয়াটা মঞ্জুর করে দেন। আমরা অমুক গ্রুপের সাথে চুক্তি করেছি। তারা আগামি বছর বাজারে হালাল সাবান ছাড়তে যাচ্ছে। সেখান থেকে ২০% কমিশন আমরা পাবো। শুধু দরকার এই ফতোয়াটা পাশ করার। তাহলেই সবাই অন্য সব সাবান বাদ দিয়ে, এই হালাল সাবান কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। আপনার মসজিদ করার জন্য যত বাজেট লাগে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”

সঠিক আইন, ন্যায়নীতি, আদর্শ তৈরি হয় নিরপেক্ষতা, পক্ষপাতহীনতা থেকে, যা মানুষের কামনা-বাসনা দিয়ে বিকৃত হয় না। এটা মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়, এর জন্য মানুষের উর্ধে কোনো উৎস দরকার, যার মধ্যে মানুষের যে মানবিক দুর্বলতাগুলো রয়েছে, সেগুলো নেই।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

তোমরা কি বুদ্ধি ব্যবহার করো না? — আল-বাক্বারাহ ৭৬-৭৯

মসজিদে বসে নামায শেষে চৌধুরী সাহেব তার বন্ধুর সাথে ব্যবসার ব্যাপারে আলাপ করছেন। তিনি দুঃখ করে বন্ধুকে বললেন, “ভাই, ট্যাক্স দিতে দিতে অবস্থা খারাপ। ব্যবসার খরচ করে কুলাতে পারছি না।” বন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি ট্যাক্স পুরোটা দেন নাকি? আমি তো নামমাত্র ট্যাক্স দেই।” তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “বলেন কি? কীভাবে?” বন্ধু বললেন , “আমি একজনকে টাকা খাওয়াই। সে আমাকে ট্যাক্স সার্টিফিকেট দিয়ে দেয়। আপনার সাথে কালকে পরিচয় করিয়ে দেব।” চৌধুরী সাহেব এদিক ওদিক তাকিয়ে নিচু গলায় বললেন, “ছি, ছি, ভাই। মসজিদে বসে এই সব কথা বলতে হয় না, এটা আল্লাহর ঘর। চলেন, ওই চায়ের দোকানে গিয়ে বাকি আলাপ করি।”

আল্লাহর تعالى সম্পর্কে এই ধরনের চরম অবমাননাকর ধারণার একটি উদাহরণ দেওয়া আছে এই আয়াতে—

2_76

যখন তারা বিশ্বাসীদের সাথে দেখা করে, তখন বলে, “আমরা ঈমানদার”; কিন্তু যখন তারা নিজেদের মধ্যে থাকে, তখন বলে, “তোমরা কেন তাদেরকে বলে দিলে আল্লাহ আমাদেরকে কী প্রকাশ করেছেন? তারা তো আল্লাহর সামনে এনিয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাঁড় করাবে? তোমরা কি বুদ্ধি ব্যবহার করো না?” [আল-বাক্বারাহ ৭৬]

  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

তোমাদেরকে যা বলা হয়েছে সেটা করো — আল-বাক্বারাহ ৬৮-৭১

ধর্মীয় নিয়ম-কানুনগুলোকে কীভাবে খামোখা ঘাঁটাঘাঁটি করে কঠিন বানানো যায়, যাতে তার অনুসরণ করা মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়, এবং ধর্মীয় নির্দেশ শেষ পর্যন্ত মানতে না পারলে কীভাবে সব দোষ আল্লাহকে تعالى দেওয়া যায় — তার কিছু অভিনব উদাহরণ আমরা সূরা আল-বাক্বারাহ’র ৬৭-৭১ আয়াতে দেখতে  পাবো। প্রথমত আজকের যুগের মুসলিমদের একইভাবে ধর্মকে পেঁচিয়ে কঠিন বানানোর একটি উদাহরণ দেই—

চৌধুরী সাহেব সম্প্রতি ধর্মের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস হয়েছেন। তিনি তার জীবন থেকে, ধর্মীয় নির্দেশের বিরুদ্ধে যায়, এমন সব ব্যাপার একে একে দূর করার চেষ্টা করছেন। একদিন এলাকার জ্ঞানীগুণী হাজি সাহেবকে মসজিদে আলোচনায় বলতে শুনলেন, “মুসল্লি ভাইয়েরা, আজকাল টিভিতে অনেক হারাম জিনিস দেখানো হয়। টিভি আমাদের কিশোর-তরুন সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। টিভি দেখা হারাম। আপনারা আজকেই টিভির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিন।”

  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

তুমি কি আমাদের সাথে ফাজলেমি করছ? — আল-বাক্বারাহ ৬৭

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে কিছু সাইকোলজি শেখাবেন: ১) কীভাবে মানুষের সবচেয়ে ভয়ংকর মানসিক দুর্বলতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং ২) কীভাবে একটি মোক্ষম মানসিক আক্রমণকে প্রতিহত করে, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ঠিক রেখে, লক্ষ্যে স্থির থাকতে হয়—

2_67

মনে করে দেখো, যখন মূসা তার লোকদেরকে বলেছিল, “আল্লাহ তোমাদেরকে একটি গরু জবাই করতে আদেশ করেছেন।” তখন তারা বলল, “তুমি কি আমাদের সাথে ফাজলেমি করছ?” তিনি উত্তর দিলেন, “আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই, যেন আমি নির্বোধ-অবিবেক-লাগামহীন হয়ে না যাই।” [আল-বাক্বারাহ ৬৭]

ধরুন আপনাকে একজন মুসলিম ভাই খুব আগ্রহ নিয়ে ইসলামের কথা বলছে। আপনার কোনো ভুল সংশোধন করার জন্য কিছু উপদেশ শোনাচ্ছে, কু’রআন-হাদিস থেকে কোটেশন দিচ্ছে। কিন্তু আপনার সেটা সহ্য হচ্ছে না। আপনি কোনো যুক্তি দিয়ে তাকে খন্ডন করতে পারছেন না। আর আপনার কাছে কোনো বিকল্প প্রস্তাবও নেই। সেই অবস্থায় আপনি যদি তাকে পুরোপুরি নাস্তানাবুদ করে দিতে চান, তাহলে সোজা তার মুখের উপর কর্কশ ভাষায় জোর গলায় বলুন, “কী সব আবোল তাবোল কথা বলছেন! আপনার কি মাথা খারাপ নাকি? এই সব গাঁজাখুরি কথাবার্তা কোথা থেকে পান আপনারা? ইসলাম মোটেও এটা সমর্থন করে না!”

এর ফলাফল হবে নিচের যেকোনো একটি—

  • ১) সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তার কথার খেই হারিয়ে ফেলবে এবং তার নিজের উপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। সে তখন মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে গিয়ে আমতা আমতা করে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলা শুরু করবে।
  • ২) সে অপমানে রেগে গিয়ে নিজের আহত ইগোকে বাঁচানোর জন্য: তার ইসলাম নিয়ে কত পড়াশোনা আছে, সে কোথা থেকে কী ডিগ্রি পেয়েছে, সে কোন শাইখের কাছ থেকে কী ফতোয়া শুনেছে — এইসব নিয়ে অনর্থক বক্তৃতা শুরু করে দিবে।

এই পদ্ধতিটি সাইকোলজির ভাষায় ‘গ্যাসলাইটিং’ এর একটি উদাহরণ। কাউকে তার নিজের সম্পর্কে সন্দেহে ফেলে দেওয়া, তার কথা, কাজকে একেবারেই ফালতু-ভুল-পাগলের প্রলাপ ইত্যাদি বলে বোঝানোর চেষ্টা করা, যেন সে নিজের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, রেগে গিয়ে উল্টোপাল্টা আচরণ শুরু করে — এটা হচ্ছে গ্যাসলাইটিং।[১৫২] যারা অহরহ গ্যাসলাইটিং করেন, তারা একধরনের বিকৃত মানসিকতার অধিকারী এবং তাদের জন্য বিশেষ ধরনের মানসিক চিকিৎসা রয়েছে। এধরনের মানুষরা সাধারণত পরিবর্তীতে নানা ধরণের জটিল মানসিক রোগের শিকার হন। যেমন, সাইকোপ্যাথরা অহরহ গ্যাসলাইটিং করেন।[১৫২]

  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

যাতে করে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পারো – বাকারাহ ৫৬

এর আগের আয়াতে নবী মুসা عليه السلام বনি ইসরাইলিদের একদল প্রতিনিধিকে নিয়ে পাহাড়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি তাদেরকে আল্লাহর تعالى দেওয়া শারি‘আহ সম্পর্কে জানান। এবং শারী‘আহর মূলনীতি লেখা পাথরের ফলকগুলো দেখান। কিন্তু প্রতিনিধিরা বলল যে, তারা শুধু মুসা عليه السلام-এর মুখের কথায় এত বড় একটা ব্যাপার মেনে নেবে না, তারা আল্লাহকে تعالى নিজের চোখে দেখতে চায়, নিজের কানে শুনতে চায়।[৩] তখন তাদের উপরে এক ভয়ংকর বজ্রপাত হলো এবং তারা নিষ্প্রাণ হয়ে গেল—

ThunderStrike

2_56

তারপর তোমাদেরকে নিষ্প্রাণ অবস্থা থেকে আবার প্রাণ দেওয়া হলো, যাতে করে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পারো। [আল-বাকারাহ ৫৬]

  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

তিনি বারবার ক্ষমা করেন – বাকারাহ ৫৩-৫৪

অনেকে মনে করেন, ইসলাম হচ্ছে নবী মুহাম্মাদ عليه السلام প্রচারিত একটি নতুন ধর্ম। এটি একটি ভুল ধারণা। ইব্রাহিম, ইয়াকুব, মুসা, ঈসা, মুহাম্মাদ (আল্লাহ تعالى তাদের সবার উপরে শান্তি দিন) — সকল নবীই একই ধর্ম প্রচার করে গেছেন: ইসলাম।[৬] ইসলাম শব্দের অর্থ: আল্লাহর تعالى ইচ্ছার কাছে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করা। আজকের যুগের মুসলিমদের মতো বনি ইসরাইলিদেরকেও নবী মুসা عليه السلام-এর মাধ্যমে আল্লাহ تعالى সম্পূর্ণ ধর্মীয় বিধান বা শারি‘আহ দিয়েছিলেন। বনি ইসরাইলিরা ছিল সেই যুগের মুসলিম—

2_53

মনে করে দেখো, যখন আমি মুসাকে কিতাব দিয়েছিলাম—যা এক সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী—যাতে করে তোমরা সঠিক পথে চলতে পারো। [বাকারাহ ৫৩]

justiceআল্লাহ تعالى বনি ইসরাইলকে নবী মুসা عليه السلام এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ শারি‘আহ দিয়েছিলেন, যেন তারা সঠিকভাবে সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি পরিচালনা করতে পারে। এই আয়াতের শেষে تَهْتَدُونَ ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ সাধারণত করা হয়, “সঠিক পথ পাও।” কিন্তু এটি এসেছে اهتدى থেকে, যার অর্থ হচ্ছে: দেখানো সঠিক পথে চলার জন্য নিজে থেকে আন্তরিক চেষ্টা করা।[৮] এখানে একটি খুব সূক্ষ্ম ভাষাগত পার্থক্য আছে। আল্লাহ تعالى মানুষকে সঠিক পথে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘাড় ধরে দাঁড় করিয়ে রাখেন না, বরং তিনি মানুষকে সঠিক পথ কোনটা সেটা দেখিয়ে দেন, তারপর মানুষের কাজ হচ্ছে সেই সঠিক পথে চলার চেষ্টা করা। মানুষকে সেই চেষ্টাটা করতে হবে, চেষ্টা ছাড়া কেউ সঠিক পথ পাবে না এবং চেষ্টা ছাড়া কেউ সঠিক পথে টিকেও থাকতে পারবে না।[১] যারা ফিলসফিকাল তর্ক দেখায়, “আল্লাহ যদি চাইতেন, তাহলে তো আমি সবসময় ভালোই থাকতাম। তিনি চাননি দেখেই তো আমি ভালো থাকতে পারিনি…”—তাদেরকে اهتدى এর মানে ঠিকভাবে বুঝতে হবে।

একটা উদাহরণ দেই—

আপনি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন, একসময় একটা চৌরাস্তা মোড়ে গিয়ে একটা সাইন বোর্ড দেখলেন: “চট্টগ্রাম ৫০ মাইল”, কিন্তু আপনি সেদিকে না গিয়ে দূরে একটা সিনেমা হল দেখা যাচ্ছে, সেদিকে যাওয়া শুরু করলেন। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ঠিকই আপনাকে সঠিক পথ দেখিয়েছিল, কিন্তু আপনি اهتدى (সঠিক পথে চলার চেষ্টা) করেননি।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)