ওদেরকে ভয় করো না, আমাকে ভয় করো — আল-বাক্বারাহ ১৪৯-১৫০

হিজরতের পর প্রথম দিকে মুসলিমরা আল-আক্বসাকে কিবলা হিসেবে অনুসরণ করত। রাসূলের عليه السلام বড় ইচ্ছা ছিল যে, আল্লাহ تعالى যেন কা’বাকে কিবলা করে দেন। তার عليه السلام মনের বাসনা আল্লাহ تعالى পূরণ করলেন, কা’বাকে কিবলা করে দিলেন, কু’রআনের আয়াত নাজিল হলো। কিন্তু রাসূল عليه السلام যখন কিবলা পরিবর্তনের আয়াত মানুষকে তিলাওয়াত করে শোনালেন, তখন নানা ধরনের সমস্যা শুরু হলো। কিছু মানুষ মনে করা শুরু করলো, “একি! এতো দেখি রাসূল যা চায় সেটাই কয়েকদিন পর কুরআনের আয়াত হয়ে নাজিল হয়? আসলেই কু’রআনের আয়াতগুলো আল্লাহর تعالى কাছ থেকে আসে তো? নাকি সব রাসূলের عليه السلام বানানো কথা?”[১]

আবার অনেক মুসলিম, যারা আগে ইহুদি, খ্রিস্টান ছিলেন, তারা এত দিন ধরে আল-আক্বসাকে কিবলা মেনে এসেছিলেন। তাদের আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ইহুদি, খ্রিস্টানরা সবাই তখনো আল-আক্বসাকে কিবলা অনুসরণ করছে। তখন সে যদি সবাইকে অপমান করে কা’বাকে কিবলা অনুসরণ করা শুরু করে, তাহলে ব্যাপারটা কেমন দেখাবে? “লোকে কী বলবে” এই ভয়ে অনেকে একাকী প্রার্থনা করার সময়, বা তাদের ইহুদি, খ্রিস্টান আত্মীয়দের সাথে চলাফেরা করার সময় কা’বার দিকে ঘুরে দাঁড়াতো না।[১]

2_149_150_title

আল্লাহ تعالى কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশ দিয়ে পর পর তিনটি আয়াত নাজিল করলেন। এরকম অভূতপূর্ব ঘটনা কু’রআনে বিরল, যেখানে একই নির্দেশ পর পর তিনবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায়, কিবলা পরিবর্তনের ব্যাপারটি কতটা বিতর্কিত ছিল, এবং তখনকার মুসলিমদের অনেকেরই এটা মেনে নিতে যথেষ্ট কষ্ট হয়েছিল।[৬]

2_149

তুমি যেখান থেকেই শুরু করে থাকো না কেন, মাসজিদুল-হারামের দিকে ঘুরে দাঁড়াও। এটা তোমার প্রভুর কাছ থেকে আসা সত্য বাণী। তোমরা কী করছ, সে ব্যাপারে আল্লাহ বিন্দুমাত্র বেখেয়াল নন। [আল-বাক্বারাহ ১৪৯]

যারা সন্দেহ করেছিল যে, রাসূল عليه السلام হয়তো বানিয়ে আয়াত বলছেন, তাদেরকে আল্লাহ تعالى সাবধান করে দিলেন, “এটা তোমার প্রভুর কাছ থেকে আসা সত্য বাণী।” আর যারা ‘লোকে কী বলবে’ এই ভয়ে, প্রার্থনা করার সময় আল-আক্বসার দিকে মুখ করে থাকতো, তাদের জন্য আল্লাহর تعالى সাবধান বাণী: “তোমরা কী করছ, সে ব্যাপারে আল্লাহ বিন্দুমাত্র বেখেয়াল নন।”  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

ওরা তাকে খুব ভালো করে চেনে — আল-বাক্বারাহ ১৪৫-১৪৭

আমরা অনেক সময় মুসলিমদের ভেতরকার সমস্যা নিয়ে এত বেশি হতাশ হয়ে পড়ি যে, অন্য ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেও যে ব্যাপক সমস্যা আছে, তা ভুলে যাই। এই সুযোগে কিছু সুধীবৃন্দ এবং নাস্তিকরা, অমুসলিমদের মগজ ধোলাইয়ের শিকার হয়ে ইসলামের নামে গালিগালাজ করে একচোট দেখিয়ে দেয় যে, ইসলাম হচ্ছে যত নষ্টের মূল। অথচ একটু খোঁজ-খবর নিলেই দেখা যায়, ইহুদি, খ্রিস্টান, হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেও ভয়াবহ সমস্যা রয়েছে। এরকম একটি সমস্যা আল্লাহ تعالى এই আয়াতে উল্লেখ করেছেন—

2_145_title

2_145যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে, তাদেরকে তুমি যদি সবরকম নিদর্শন এনেও দেখাও, তবুও তারা তোমার কিবলা অনুসরণ করবে না। তুমি কখনই তাদের কিবলার অনুসারী হবে না। এমনকি ওরা একে অন্যের কিবলাও অনুসরণ করে না। তোমার কাছে যে জ্ঞান এসেছে, তা  আসার পরেও যদি তুমি ওদের খেয়াল-খুশি মতো করতে যেতে, তাহলে তুমিও সীমালঙ্ঘনকারীদের একজন হয়ে যেতে। [আল-বাক্বারাহ ১৪৫]

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বলছেন যে, অন্য ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে কোনো ঐক্য নেই। ইহুদিদের কিবলা হচ্ছে বাইতুল-মাকদিস, যা আমরা আল-আক্বসা নামে চিনি।[৪] খ্রিস্টানদের কিবলা হচ্ছে পূর্ব দিক।[৪] তারা চার্চগুলোকে পূর্বমুখী করে তৈরি করে। কারণ তারা বিশ্বাস করে যীশু যখন আবার আসবেন, তখন তিনি পূর্ব দিক থেকে আসবেন।[২৭৭] এরা একে অন্যের কিবলাকে অনুসরণ বা সমর্থন করা তো দূরের কথা, অস্বীকার করে। ইহুদিরা মনে করে যীশু হচ্ছেন এক বড় প্রতারক, ভণ্ড নবী।[২৭৬]

কু’রআনে বনী ইসরাইল বলতে আজকের ‘ইসরাইল’ নামক দেশে যারা থাকে, তাদেরকে বোঝায় না। বর্তমান ইসরাইল মূলত একটি সেক্যুলার দেশ। সেই দেশে সেক্যুলার-নাস্তিক বাসিন্দাদের সাথে তাদের ধর্মপ্রাণ ইহুদি বাসিন্দাদের মধ্যে ব্যাপক পরিমাণে সংঘর্ষ চলছে, যেমন কিনা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেও চলছে।[২৬৮] মুসলিম দেশগুলোতে যেমন শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে সবসময় মারামারি লেগেই আছে, সেক্যুলার সরকার ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের কোণঠাসা করে রেখেছে, অনুরূপ একই ঘটনা ঘটছে ইহুদিদের দুটি চরমপন্থী সম্প্রদায়ের মধ্যে। তার উপর ইসরাইলের সেক্যুলার সরকার এবং ধর্মপ্রাণ ইহুদিদের মধ্যে লেগে আছে বিরাট কোন্দল।[২৬৯]  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

কী ওদের কিবলা পালটিয়ে দিলো? — আল-বাক্বারাহ ১৪২-১৪৪

সূরা আল-বাক্বারাহ’র এই আয়াতে কিবলা পরিবর্তনের ঘটনা নিয়ে সুধীবৃন্দরা অনেক তর্ক দাঁড় করিয়েছেন। তাদের দাবি: যেখানে নবী ইব্রাহিম عليه السلام কা’বা মুখি হয়ে সালাত পড়তেন, সেখানে কেন রাসুল মুহাম্মাদ عليه السلام আল-আক্বসা মুখি হয়ে সালাত পড়তেন? উনি কেন নবী ইব্রাহিমের عليه السلام বিরোধিতা করলেন? কেনই বা মুসলিমদেরকে কা’বা মুখি হয়ে সালাত পড়তে হবে, যেখানে কিনা আল্লাহ تعالى কোনো একটি দিকে নির্দিষ্ট নন? যেকোনো একদিকে মুখ করে সালাত পড়লেই তো হয়?

আবার অমুসলিমরা দাবি করেন: হিন্দুদের মতো মুসলিমরাও কা’বা পূজা করে। দেখো না সবাই কা’বা মুখি হয়ে সালাত পড়ে? হাজ্জ হচ্ছে গণপূজা, যেখানে লক্ষ লক্ষ মুসলিম গিয়ে একদম কা’বার সামনে মাথা নত করে। কা’বার সামনে এভাবে মাথা নত করাটা পূজা না তো কী?

অন্যদিকে ইহুদি, খ্রিস্টানরা দাবি করে: মুসলিমদের একসময় আল-আক্বসা মুখি হয়ে সালাত পড়াটা ঐতিহাসিকভাবে ভুল ঘটনা, কারণ রাসুল মুহাম্মাদ عليه السلام -এর মারা যাওয়ার প্রায় একশ বছর পরে আল-আক্বসা মসজিদ তৈরি হয়েছে। এমনকি উমার (রা) যখন জেরুজালেম দখল করেন, তখন আল-আক্বসার জায়গায় ছিল শুধুই কিছু ময়লার স্তূপ। উনিই তো আল-আক্বসার গম্বুজ তৈরি করেন। তাহলে আগে আল-আক্বসা ছিল কীভাবে? সুতরাং কু’রআনে ভুল আছে! —ইহুদি, খ্রিস্টানদের এই যুক্তি এবং ঐতিহাসিক দলিল অনেক ‘আধুনিক মুসলিম’ এবং নাস্তিকরা লুফে নিয়েছে।

আসুন এই ভুল ধারণাগুলোর অবসান করি—

2_142_title

2_142লোকদের মধ্যে বোকাগুলো বলবে, “কী ওদের প্রার্থনার দিক (কিবলা) পালটিয়ে দিলো, যেদিকে তারা মুখ করতো?” বলো, “পূর্ব, পশ্চিম সব আল্লাহর تعالى। তিনি যাকে চান তাকে সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করেন।” [আল-বাক্বারাহ ১৪২]

ঘটনার প্রেক্ষাপট
রাসুল মুহাম্মাদ عليه السلام যখন মক্কায় ছিলেন, তখন তিনি যখন সালাত পড়তেন, তার সামনে কা’বা এবং আক্বসা দুটোই থাকতো। কিন্তু তিনি যখন মদিনা হিজরত করলেন, তখন মক্কা পড়ে গেল একদিকে, আর আক্বসা পড়ে গেল আরেকদিকে। যার ফলে তিনি যখন আক্বসা মুখি হয়ে সালাত পড়তেন, তখন কা’বা থাকতো তার পেছন দিকে। নবী ইব্রাহিমের عليه السلام প্রতি ভালবাসা, এবং তার চেয়েও বেশি কা’বার প্রতি টানের কারণে তিনি মাঝে মাঝেই আকাশের দিকে নির্বাক হয়ে তাকাতেন। যদিও তিনি মুখে কিছু বলতেন না, কিন্তু তিনি মনে মনে চাইতেন আল্লাহ تعالى যেন কা’বাকে কিবলা করে দেন। আল্লাহ تعالى তার এই গোপন চাওয়া পূরণ করলেন। সূরা আল-বাক্বারাহ’র আয়াত নাজিল হলো। আক্বসা থেকে কিবলা ঘুরে গেল কা’বার দিকে।[১৪]

2_144

আমি অবশ্যই দেখেছি তোমাকে বার বার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে। তাই আমি তোমাকে সেই কিবলা দিলাম, যা তুমি পছন্দ করো। এখন তুমি মাসজিদুল-হারাম-এর (কা’বা) দিকে মুখ করো। তোমরা (বিশ্বাসীরা) যেখানেই থাকো না কেন, এর দিকে মুখ করো। যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে, তারা খুব ভালো করে বোঝে যে, এটি তাদের প্রভুর কাছ থেকে আসা সত্য। ওরা কী করে সে ব্যাপারে আল্লাহ تعالى বেখেয়াল নন। [আল-বাক্বারাহ ১৪৪]

কিন্তু আল-আক্বসা কেন কিবলা ছিল?
কা’বা থাকতে আল-আক্বসা কেন কিবলা হয়েছিল? এটা কি নবী ইব্রাহিমের عليه السلام বিরোধিতা হয়ে গেল না? এর উত্তর আছে পরের আয়াতে—  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)