দেখবে, এরা তাদের জীবনটাকে অন্য সবার থেকে বেশি কামড়ে ধরে থাকতে চায় — আল-বাক্বারাহ ৯৪-৯৬

আজকে যদি আমাকে ডাক্তার বলে: আপনার রক্তে ক্যান্সার ধরা পড়েছে এবং আপনি আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মারা যাবেন, সিঙ্গাপুরে গিয়েও লাভ হবে না—আমি তখন কী করব? আমি কি তখন কাঁথা জড়িয়ে টিভির সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফালতু তারকা শো, টক শো, হিন্দি সিরিয়াল দেখব? আমি কি পরদিন অফিসে গিয়ে কলিগদের সাথে শেষ বারের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মারব? আমি কি আমার ছেলেমেয়েকে শেষ বারের মতো একটু খুশি করার জন্য ভিডিও গেম কিনে দেব, যেখানে তারা রামদা-ছুরি নিয়ে একপাল অর্ধ মৃত, রক্তাক্ত জম্বিকে মেরে কোনো এক বিকৃত কারণে বড়ই আনন্দ পায়? আমি কি এই অবস্থায় আমার মেয়েকে নৃত্য শিল্পী বানাব, ছেলেকে ব্যান্ডের দলে যোগ দেওয়াব, যেন তারা সেগুলো করে আমার মৃত্যুর পরে আমার জন্য ‘অশেষ সওয়াব’ অর্জন করে?

না, আমরা তখন এগুলোর কিছুই করব না, কারণ জীবনের শেষ দিনগুলি এভাবে নষ্ট করার মতো বোকামি আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু আজকে আমরা ঠিকই সেগুলো করে যাচ্ছি এটা ভালো করে জেনে যে: আমরা আজকে হোক, কালকে হোক, একদিন না একদিন মারা যাবই। তারপর একসময় আমাদেরকে আবার জাগিয়ে তোলা হবে এবং তারপর আমাদেরকে ধরে নিয়ে বিশ্বজগতের সর্বোচ্চ ক্ষমতাবানের সামনে দাঁড় করানো হবে: আমাদের জীবনের প্রতি মুহূর্তের হিসাব দেওয়ার জন্য। সেদিন তাঁর সামনে মাথা নিচু করে আমরা তাঁকে কী বলব—সেটা ঠিক করে রেখেছি কি?

কোনো কারণে আমরা এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি চিন্তা করতে চাই না। এরকম চিন্তা মাথায় এলেই আমাদের কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। আমরা দ্রুত চিন্তার টপিক পাল্টে ফেলি। যদি আমাদের কোনো বন্ধু বা আত্মীয় আমাদেরকে এই ব্যাপারটি নিয়ে কিছু বলা শুরু করে, আমরা জলদি তাকে বলি, “কি বলছেন এইসব! আস্তাগফিরুল্লাহ! এই সব মরা-টরার কথা শুনতে ভালো লাগছে না। বাদ দেন এইসব। আসেন অন্য কিছু নিয়ে কথা বলি।”

2_94

বলে দাও, “যদি আখিরাতের জীবনটা আল্লাহর সান্নিধ্যে তোমাদের জন্যই হয়ে থাকে, অন্য কারো জন্য না হয়, তাহলে এখনই মরে যেতে চাচ্ছ না কেন? তোমরা না বড়ই সত্যবাদী?” [আল-বাক্বারাহ ৯৪]

Dubai

  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

আমরা শুনলাম এবং আমরা অস্বীকার করলাম — আল-বাক্বারাহ ৯২-৯৩

কোনো এক অদ্ভুত কারণে হাজার হাজার বছর আগে থেকেই মানুষের গরুর প্রতি একধরনের বিশেষ প্রীতি ছিল। প্রাচীন মিশরীয়রা গরু পূজা করত।[১৮২] বনী ইসরাইল জাতি গরু পূজা করত। আজকে অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী গরুকে দেবতা মনে করে। তারা গরুকে এক বিশেষ পবিত্র সৃষ্টি মনে করে বছরে এক বিশেষ দিন গরুর সন্মানে উদযাপন করে।[১৮২] শয়তান পূজারিরা গরুর মাথার কঙ্কাল এবং রক্ত ব্যবহার করে। এমনকি শয়তানের চিত্রকর্মে তাকে গরুর মত শিং দেওয়া হয়। নানা ধরনের প্রাচীন জাদু, ডাইনীবিদ্যায় গরুর জিনিসপত্র ব্যবহার করা হয়।[১৮৩] এমনকি আমাদের সময় স্কুলে বাংলা কোর্সে এত প্রাণী থাকতে গরুর রচনাই লিখতে দেওয়া হত ।

2_92

কোনো সন্দেহ নেই, মুসা তোমাদেরকে পরিষ্কার নিদর্শন এনে দেখিয়েছিল। তারপর সে যখন অনুপস্থিত ছিল, তোমরা বাছুরকে পূজা করাশুরু করলে। তোমরা চরম অন্যায়কারী ! [আল-বাক্বারাহ ৯২]

আল্লাহর تعالى বাণী নিয়ে মানুষের তামাশা করার প্রবণতার আরেকটি উদাহরণ আমরা এই আয়াতে পাব। বনী ইসরাইলিরা দেখল যে, নবী মূসা عليه السلام আল্লাহর تعالى কাছ থেকে যে তাওরাতের বাণী নিয়ে এসেছেন, সেই বাণী মেনে চলাটা বেশ কঠিন। তখন তারা সেটা থেকে বাঁচার জন্য অজুহাত খোঁজা শুরু করল। প্রথমে তারা নবী মূসাকে عليه السلام বলল: তার মুখের কথা তারা বিশ্বাস করবে না, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর تعالى কাছ থেকে নিজের কানে না শুনছে।[৪][৮]

তখন নবী মূসা عليه السلام তাদের মধ্য থেকে ৭০ জন প্রতিনিধিকে বাছাই করে তূর পাহাড়ে নিয়ে গেলেন। সেখানে আল্লাহ تعالى তাদেরকে সরাসরি তাওরাত মেনে চলার হুকুম দিলেন। তারপর সেই প্রতিনিধিরা ফিরে এসে নিজ নিজ গোত্রের সামনে স্বীকার করল যে, আল্লাহ تعالى সত্যিই তাদেরকে তাওরাত মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এর সাথে তারা আর একটি কথা যোগ করে দিল: “আল্লাহ বলেছেন যে, তোমাদের পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব, ততটুকু মেনে চলবে। যা মেনে চলতে পারবে না, তা তিনি ক্ষমা করে দিবেন।”

এরপর থেকে তাওরাতের যেই নির্দেশই তাদের কাছে কঠিন মনে হতো, সেটাকেই তারা ছেড়ে দিত — এই মনে করে যে, আল্লাহ তা ক্ষমা করে দিবেন।[৪][৮] তাদের এই ভণ্ডামিতে আল্লাহ تعالى রেগে গিয়ে এক অসাধারণ ঘটনা ঘটালেন —  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

ওদের বিশ্বাস একেবারেই নগণ্য পর্যায়ের — আল-বাক্বারাহ ৮৮-৯১

আপনি পাড়ার কলেজের শিক্ষক মীর-জাফর সাহেবকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করছেন, “ভাই, কিছু চরমপন্থি দলের উল্টোপাল্টা কাজকর্মকে ইসলামের শিক্ষা বলে প্রচার করে ধর্মের বিরুদ্ধে লেখালেখি করছেন, এটা তো অন্যায়। চেতনার নাম করে কিশোর-তরুণদের উত্তেজনার ড্রাগ দিয়ে, তাদেরকে রাজনৈতিক নেতাদের হাতের পুতুল বানাচ্ছেন, এটা কি একটা বিরাট প্রতারণা নয়? পাবলিসিটির লোভে আপনি মানুষকে অহেতুক ফুসলিয়ে, তাদেরকে সস্তা আবেগের খোরাক দিচ্ছেন, আল্লাহর تعالى কাছে এসবের জবাব কীভাবে দেবেন?”

কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। তার উত্তর, “ভাই, আমাকে এইসব ফালতু নীতিকথা বলে লাভ নেই। আমি একজন বিদেশ থেকে পিএইচডি করা শিক্ষিত মানুষ। আমি জানি আমি যা করছি সেটা ঠিক কাজ। আমাকে এই সব সব হাজার বছরের পুরনো আরব কেচ্ছা কাহিনী শুনিয়ে কোনো লাভ নেই। আমি কোনো গ্রামের অর্ধশিক্ষিত লোক না যে, আপনার এই সব শাস্তির কথা শুনে ভয় পাব। আপনি অন্যদিকে দেখেন।”

এই ধরনের মানুষরা কোনো আধুনিক সৃষ্টি নয়। হাজার বছর আগেও এই ধরনের মানুষ ছিল—

2_88

ওরা বলে, “(তোমরা যাই বলো না কেন) আমাদের অন্তর একদম সুরক্ষিত, কিছুই ঢুকবে না।” কিসের সুরক্ষিত? বরং আল্লাহ ওদেরকে ঘৃণা ভরে পরিত্যাগ করেছেন ওদের অবিশ্বাসের জন্য। ওদের বিশ্বাস একেবারেই নগণ্য পর্যায়ের। [আল-বাক্বারাহ ৮৮]

  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

তখনি কেন তোমরা অহংকারী হয়ে যাও — আল-বাক্বারাহ ৮৭

আল্লাহ تعالى আমাদেরকে ইসলাম দিয়েছেন, যেন আমরা ইসলাম অনুসারে আমাদের জীবন গড়ে তুলি। কিন্তু অনেককেই দেখা যায় তাদের লাইফ স্টাইল, সংস্কৃতি, ফ্যাশন, দুই নম্বরি ব্যবসায় যেন কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্য ইসলামকে তাদের ইচ্ছামত পরিবর্তন করেন, যাতে করে সেই ‘ইসলাম’ মানতে নিজেদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন করতে না হয়। যেমন, আপনি আপনার প্রতিবেশীকে একদিন বললেন, “চৌধুরী সাহেব, ভাই কিছু মনে করবেন না, আপনার ব্যবসাটা কিন্তু হারাম ব্যবসা। আপনার ঘরের মেয়েরা যেই ধরনের কাপড় পড়ছেন, সেটা ইসলামের দৃষ্টিতে একেবারেই নিষিদ্ধ। আর আপনার ছেলেমেয়ের বিয়েতে যে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা উড়ালেন, আল্লাহর تعالى কাছে তার জবাব কীভাবে দেবেন?”

সাথে সাথে তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠবেন, “কি! আপনি কি বলতে চাচ্ছেন ইসলাম কী আমি সেটা জানি না? আপনাদের মত তালেবানদের জন্য আজকে ইসলামের এই অবস্থা। দেশটাকে আপনারা আরেকটা আফগানিস্তান বানিয়ে ফেলছেন।”

এধরনের মানুষদেরকে যখন কেউ বার বার নিষেধ করতে থাকে, এবং তাদের আসল জায়গায়: ব্যাংক ব্যালেন্স এবং সম্পত্তিতে সমস্যা তৈরি করে —তখন তারা তাদের ‘সোনার ছেলেদের’ ফোন করেন, “তোমাকে একটা লোকের নাম-ঠিকানা পাঠাচ্ছি। একে সরিয়ে ফেল।”

এদের উদাহরণ হলো এই আয়াতের বনী ইসরাইলের মতো—

2_87

আমি অবশ্যই মুসাকে কিতাব দিয়েছিলাম। তারপর তার সমর্থন করে ধারাবাহিকভাবে কয়েকজন রাসুল/বার্তাবাহক পাঠিয়েছিলাম। আর আমি মরিয়মের সন্তান ঈসাকে একদম পরিষ্কার নিদর্শন দিয়েছিলাম এবং তাকে পবিত্র রূহ দিয়ে শক্তিশালী করেছিলাম। যখনি কোনো রাসুল/বার্তাবাহক এমন কিছু নিয়ে আসে, যা তোমাদের কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে যায়, তখনি কেন তোমরা অহংকারী হয়ে যাও? কেন তাদের কয়েকজনকে তোমরা মিথ্যাবাদীর কালিমা দাও, কয়েকজনকে খুন করো? [আল-বাক্বারাহ ৮৭]

Corruption-1

মানুষের মধ্যে একটা স্বভাবজাত প্রবৃত্তি আছে আইনকে নিজের সুবিধামত বিকৃত করে, অন্যের সাথে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করার, যাতে করে তারা তাদের স্বার্থপর সাম্প্রদায়িক, জাতিগত, দলগত উদ্দেশ্যগুলো হাসিল করতে পারে। এটা সাধারণত সেই সব সমাজে দেখা যায়, যেখানে মানুষ ন্যায়ভাবে চলার ন্যূনতম ধারণাগুলো হারিয়ে ফেলে।[৬]

একটা ছোট বাচ্চা চেষ্টা করে কীভাবে বাবা-মার কাছ থেকে ঘরের নিয়ম কানুনে শুধুমাত্র তার জন্য বিশেষ ছাড় পাওয়া যায়, “বাবা, আমি জানি আমাদের দিনে একটার বেশি চকলেট খাওয়া নিষেধ। কিন্তু শুধু আমাকে দিনের বেলা একটা, আর রাতের বেলা আরেকটা দেওয়া যায়? আমি ছোটকে দেখাব না। একদম লুকিয়ে লুকিয়ে খাব।” তারপর মানুষ বড় হলে মন্ত্রীকে ফোন করে, “সালাম মন্ত্রী সাহেব, সংসদে ওই বিলটা পাশ হলে কিন্তু আমাদের দল আর এই বছর গাড়ি পাবে না। আপনি ব্যবস্থা করুণ যেভাবেই হোক সেই বিলটা যেন পাশ না হয়। আমি আপনাকে খুশি করে দেব। গুলশানে দুটো বাড়ি আর আগামি দশ বছরের জন্য আপনার রঙিন পানির সাপ্লাই আমার দায়িত্ব। আপনার আর কী লাগবে শুধু বলেন আমাকে।” ধর্মীয় দলগুলোর মধ্যে চলে আরেক ধরনের আলোচনা, “হুজুরে পাক, আপনি দেশের সবচেয়ে বড় মুফতিদের একজন। এই ফতোয়াটা মঞ্জুর করে দেন। আমরা অমুক গ্রুপের সাথে চুক্তি করেছি। তারা আগামি বছর বাজারে হালাল সাবান ছাড়তে যাচ্ছে। সেখান থেকে ২০% কমিশন আমরা পাবো। শুধু দরকার এই ফতোয়াটা পাশ করার। তাহলেই সবাই অন্য সব সাবান বাদ দিয়ে, এই হালাল সাবান কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। আপনার মসজিদ করার জন্য যত বাজেট লাগে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”

সঠিক আইন, ন্যায়নীতি, আদর্শ তৈরি হয় নিরপেক্ষতা, পক্ষপাতহীনতা থেকে, যা মানুষের কামনা-বাসনা দিয়ে বিকৃত হয় না। এটা মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়, এর জন্য মানুষের উর্ধে কোনো উৎস দরকার, যার মধ্যে মানুষের যে মানবিক দুর্বলতাগুলো রয়েছে, সেগুলো নেই।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

তোমরা কী করে যাচ্ছ, সেটা আল্লাহর অজানা নয় — আল-বাক্বারাহ ৮৪-৮৬

এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে রাজনীতি কত নোংরা হতে পারে, তা শেখাবেন। মানুষ কীভাবে নিজের স্বার্থের কারণে নিজের ভাইকে খুন করতে পারে, নিজের ভাইকে ঘর থেকে বের করে দিতে পারে এবং দরকারের সময় রাতারাতি ভোল পাল্টে দুমুখো সাপ হয়ে যেতে পারে, তা এই আয়াত দ্বারা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আজকের মুসলিমরা যে সাচ্চা বনী ইসরাইল হয়ে গেছে, সেটা আপনি নিজেই দেখতে পাবেন—

মনে করে দেখ, যখন আমি তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম, “তোমরা তোমাদের রক্ত ঝরাবে না এবং নিজেরদেকে তোমাদের ঘর থেকে বের করে দিবে না।” তোমরাই তো  তখন কথা দিয়েছিলে, আর তোমরাই ছিলে তার সাক্ষী!  [আল-বাক্বারাহ ৮৪]

“তোমরা তোমাদের রক্ত ঝরাবে না” 
  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

তোমরা কথা দিয়ে কথা রাখোনি — আল-বাক্বারাহ ৮৩ — পর্ব ২

গত পর্বে এই আয়াতের প্রথম তিনটি অঙ্গীকার — একমাত্র আল্লাহকে প্রভু হিসেবে নেওয়া, বাবা-মার প্রতি ইহসান এবং আত্মীয়দের প্রতি ভালো ব্যবহারের উপর আলোচনা হয়েছে। এই পর্বে আয়াতের বাকি অঙ্গীকারগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো। আমরা মুসলিমরা প্রতিদিন কত অঙ্গীকার ভাঙছি, সেটা এই আয়াত থেকে পরিষ্কার হয়ে বেড়িয়ে যাবে—

2_83

মনে করে দেখ, যখন আমি বনী ইসরাইলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম: “আল্লাহ ছাড়া আর কোনো কিছুরই ইবাদত করবে না; বাবা-মার জন্য সবকিছু সবচেয়ে ভালোভাবে করবে; এবং নিকটাত্মীয়, অসহায়-এতিম আর গরিব-সামর্থ্যহীনদের সাথেও; মানুষের সাথে খুব সুন্দর ভাবে কথা বলবে; সালাত প্রতিষ্ঠা করবে এবং যাকাত দিবে।” এরপরও তোমাদের কয়েকজন ছাড়া বাকি সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলে। তোমরা কথা দিয়ে কথা রাখোনি। [আল-বাক্বারাহ ৮৩]

বনী ইসরাইলিরা ছিল সেই যুগের মুসলিম। তাদের কাছ থেকে আল্লাহ تعالى কিছু অঙ্গীকার নিয়েছিলেন। তারা সেগুলো মানেনি। আল্লাহ تعالى তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। আজকের যুগের মুসলিমরা হচ্ছে বনী ইসরাইলের উত্তরসূরি। আমরা কতখানি সেই অঙ্গীকার মানছি দেখা যাক—  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

তোমরা কথা দিয়ে কথা রাখোনি — আল-বাক্বারাহ ৮৩ – পর্ব ১

আল্লাহ تعالى এই আয়াতে আমাদেরকে এমন কিছু করতে বলবেন, যেগুলো আমরা সচরাচর শুনতে চাই না। বরং কেউ আমাদেরকে এই কথাগুলো বললে আমাদের গা জ্বালা করে, আমরা নানা টালবাহানা করে, অজুহাত দেখিয়ে এগুলো এড়িয়ে যেতে যাই। আজকে আমরা মুসলিমরা কত নীচে নেমে গেছি, সেটা এই আয়াত থেকে একেবারে পরিষ্কার হয়ে বেড়িয়ে যাবে—

2_83

মনে করে দেখ, যখন আমি বনী ইসরাইলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম: “আল্লাহ ছাড়া আর কোনো কিছুরই ইবাদত করবে না; বাবা-মার জন্য সবকিছু সবচেয়ে ভালোভাবে করবে; এবং নিকটাত্মীয়, অসহায়-এতিম আর গরিব-সামর্থ্যহীনদের সাথেও; মানুষের সাথে খুব সুন্দর ভাবে কথা বলবে; সালাত প্রতিষ্ঠা করবে এবং যাকাত দিবে।” এরপরও তোমাদের কয়েকজন ছাড়া বাকি সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলে। তোমরা কথা দিয়ে কথা রাখোনি। [আল-বাক্বারাহ ৮৩]

CityRuin

বনী ইসরাইলিরা ছিল সেই যুগের মুসলিম। তাদের কাছ থেকে আল্লাহ تعالى কিছু অঙ্গীকার নিয়েছিলেন। তারা সেগুলো মানেনি। আল্লাহ تعالى তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। আজকের যুগের মুসলিমরা হচ্ছে বনী ইসরাইলের উত্তরসূরি। আমরা কতখানি সেই অঙ্গীকার মানছি দেখা যাক—  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

আমরা জাহান্নামে কয়েকটা দিন মাত্র থাকব — আল-বাক্বারাহ ৮০-৮২

আপনি চৌধুরী সাহেবকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করছেন তার হারাম ব্যবসাটা বন্ধ করার জন্য। কিন্তু সে পাত্তা দিচ্ছে না। তার কথা হচ্ছে, “ভাই, বুঝলাম এই ব্যবসার জন্য আমার শাস্তি হবে। কিন্তু একদিন না একদিন তো জান্নাতে যাবই। কত হাজার টাকা এতিম খানায় দিলাম, গরিব আত্মীয়স্বজনদের দিলাম। জীবনে কত নামায পড়েছি, রোযা রেখেছি। কয়েকটা দিন না হয় জাহান্নামে কষ্ট করলামই। কী যায় আসে?” এই ধরনের মানুষদেরকে আল্লাহ تعالى সতর্ক করছেন—

2_80

আর ওরা বলে, “আগুন আমাদেরকে মাত্র কয়েকটা দিনই স্পর্শ করবে।” বল, “তোমরা কি আল্লাহর কাছ থেকে কোনো অঙ্গীকার নিয়েছ, কারণ আল্লাহ তার অঙ্গীকার ভাঙ্গেন না? নাকি তোমরা আল্লাহর সম্পর্কে না জেনেই কথা বল?” [আল-বাক্বারাহ ৮০]

যারা কু’রআন কখনো পুরোটা একবারও অর্থ বুঝে পড়ে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেননি, তারা এই ধরনের কথা বলেন। ইসলাম সম্পর্কে তারা নিজেদের ভেতরে একটা ধারণা করে নিয়েছেন। তাদের কাছে ইসলাম হচ্ছে: জীবনে যত খারাপ কাজ করেছি, তার জন্য কিছু সময় জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে, তারপর জান্নাতে গিয়ে পার্টি আর পার্টি। অনেকের মধ্যে একটা ধারণা আছে: যারা নামে মুসলিম (ঈমান না থাকলেও), তারা  সবাই জান্নাতে যাবেই। পাপের জন্য কয়েকটা দিন হয়ত জাহান্নামে শাস্তি পেতে হবে। তারপর জান্নাতে গিয়ে সব ভুলে যাবে। তাই এই দুনিয়ায় যে পাপ করছি, সেটা কোনো ব্যাপার না। একদিন না একদিন তো জান্নাতে যাবই। “হাজার হোক, আমার নাম আব্দুল্লাহ। আমার পাসপোর্টে ধর্ম লেখা আছে ‘ইসলাম’। আমি মুসলিম দেশে জন্মেছি! আমি জান্নাতে যাব না তো যাবে কে?”[১৬৮]  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

তোমরা কি বুদ্ধি ব্যবহার করো না? — আল-বাক্বারাহ ৭৬-৭৯

মসজিদে বসে নামায শেষে চৌধুরী সাহেব তার বন্ধুর সাথে ব্যবসার ব্যাপারে আলাপ করছেন। তিনি দুঃখ করে বন্ধুকে বললেন, “ভাই, ট্যাক্স দিতে দিতে অবস্থা খারাপ। ব্যবসার খরচ করে কুলাতে পারছি না।” বন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি ট্যাক্স পুরোটা দেন নাকি? আমি তো নামমাত্র ট্যাক্স দেই।” তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “বলেন কি? কীভাবে?” বন্ধু বললেন , “আমি একজনকে টাকা খাওয়াই। সে আমাকে ট্যাক্স সার্টিফিকেট দিয়ে দেয়। আপনার সাথে কালকে পরিচয় করিয়ে দেব।” চৌধুরী সাহেব এদিক ওদিক তাকিয়ে নিচু গলায় বললেন, “ছি, ছি, ভাই। মসজিদে বসে এই সব কথা বলতে হয় না, এটা আল্লাহর ঘর। চলেন, ওই চায়ের দোকানে গিয়ে বাকি আলাপ করি।”

আল্লাহর تعالى সম্পর্কে এই ধরনের চরম অবমাননাকর ধারণার একটি উদাহরণ দেওয়া আছে এই আয়াতে—

2_76

যখন তারা বিশ্বাসীদের সাথে দেখা করে, তখন বলে, “আমরা ঈমানদার”; কিন্তু যখন তারা নিজেদের মধ্যে থাকে, তখন বলে, “তোমরা কেন তাদেরকে বলে দিলে আল্লাহ আমাদেরকে কী প্রকাশ করেছেন? তারা তো আল্লাহর সামনে এনিয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাঁড় করাবে? তোমরা কি বুদ্ধি ব্যবহার করো না?” [আল-বাক্বারাহ ৭৬]

  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

তারা আল্লাহর বাণী শুনত, তারপর তা পরিবর্তন করে দিত — আল-বাক্বারাহ ৭৫-৭৬

ধর্ম হচ্ছে একমাত্র হাতিয়ার: যা ব্যবহার করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে দিয়ে কোনো প্রশ্ন না করিয়ে বড় কোনো উদ্দেশ্যে কাজ করানো যায়। কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন করা দরকার? কিছু খ্যাতনামা আলেমকে হাত করে, তাদেরকে দিয়ে কিছু ভুয়া হাদিস বানিয়ে, ফতোয়া জারি করে দিন। লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রেমী বান্দা ঝাঁপিয়ে পড়বে উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে। কোনো অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করা দরকার? একটি মাজার খুলে মোটাসোটা নূরানি চেহারার দেখতে একটা লোককে ভাড়া করে এনে, তার নামে গ্রামে-গঞ্জে নানা অলৌকিক কাহিনী প্রচার করে দিন। তারপর একজন রসায়নবিদ ভাড়া করে কিছু কেমিক্যাল ব্যবহার করে সবার সামনে কিছু চমৎকার ‘জাদু’ দেখিয়ে দিন। হাজার হাজার মানুষ সরল মনে সেই মাজারের মুরিদ হয়ে, নিয়মিত এসে লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে যাবে।

ধর্ম ব্যবহার করে একদম প্রথম ‘ইসলামিক’ রাজবংশ উমাইয়া[১৬৫] থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর মুসলিম সম্রাটরা পর্যন্ত ব্যাপক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করে গেছেন[১৬৭]। আর নিরক্ষর, মূর্খ মুসলিমরা কু’রআন-হাদিস নিজেরা না পড়ে, আল্লাহ تعالى প্রদত্ত মস্তিস্কটা ব্যবহার না করে, সেই রাজনৈতিক নেতাদের হাতের পুতুল হয়ে এমন সব কাজ করে গেছেন, যা ধর্ম হিসেবে ইসলামের ব্যাপক বদনাম করে দিয়েছে। আজকের যুগেও রাজনীতি এবং ফিকহ শাস্ত্রে অনভিজ্ঞ ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনতার একটা বিরাট অংশকে একদল ঝানু, দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদ-আলেম হাত করে রেখেছে কু’রআন এবং হাদিসের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যাখ্যা করে। অনেক সৎ, সাহসী আলেম কলম তুলে ধরেছিলেন তাদের বিরুদ্ধে। তারপর সেই আলেমদের অনেকেই হয় জেলে গেছেন, চরম অত্যাচারের শিকার হয়েছেন (যেমন, ইবন তাইমিয়া[১৬৬], প্রধান চার মাযহাবের ইমামরা), না হয় তাদেরকে গুম করে ফেলা হয়েছে।

2_75

তোমরা কি অনেক আশা করো যে, তারা তোমাদের সমর্থনের জন্য বিশ্বাস করবে, যখন তাদের মধ্যে কিছু লোক আল্লাহর বাণী শুনত, তারপর তারা তা ভালো করে বোঝার পরেও তা বিকৃত করত? এবং তারা নিজেরা সেই ঘটনা জানতোও? [আল-বাক্বারাহ ৭৫]

corruption13.gif

লোকমুখে প্রচলিত হাজার হাজার জাল হাদিসকে আজকাল আমরা ধর্মের অংশ বলে মানা শুরু করে দিয়েছি। এই জাল হাদিসগুলো যে ইসলাম সম্পর্কে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, এমন মানুষরাই শুধু প্রচার করে যাচ্ছে তা নয়, এমনকি কিছু মসজিদের অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেওয়া ইমাম, বিভিন্ন ওয়াজ-মাহফিলে আসা কিছু ‘আলেমকেও’ দেখবেন সেই হাদিসগুলোর সত্যতা যাচাই না করে ব্যাপকহারে প্রচার করে যাচ্ছেন। এই প্রচার কাজ জনপ্রিয় কিছু টিভি চ্যানেলগুলিতেও হয়ে থাকে। এরকম বহুল প্রচলিত কয়েকটি জাল হাদিস এবং যে সব হাদিস বিশারদ তাদেরকে জাল প্রমাণ করেছেন, তার কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো—

জাল হাদিস যেই হাদিস বিশারদরা জাল প্রমাণ করেছেন
জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীনে যেতে হলেও যাও। ইবন জাওযি, ইবন হিব্বান, নাসিরুদ্দিন আলবানি
জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে বেশি পবিত্র। আল-খাতিব আল-বাগদাদি—হিস্টরি অফ বাগদাদ
দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। আস-সাগানি, নাসিরুদ্দিন আলবানি
নিজের কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ সর্বোত্তম জিহাদ। ইবন তাইমিয়্যাহ, ইবন বাআয।
সবুজ গাছপালা, শস্যর দিকে তাকিয়ে থাকলে দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধি পায়। আয-যাহাবি
আযানের মধ্যে আঙ্গুল চুম্বন করে চোখে মোছা। আস-সুয়ুতি, আলবানি
সুরা ইয়াসিন কু’রআনের হৃদয়। একবার সুরা ইয়াসিন পড়লে দশবার কু’রআন খতম দেওয়ার সমান সওয়াব পাওয়া যায়। ইবন আবি হাতিম, আলবানি
মৃতের জন্য সুরা ইয়াসিন পড়। আদ-দার কুদনি
আমি জ্ঞানের শহর এবং আলি তার দরজা। ইমাম-বুখারি
আমি তোমাদেরকে দুটি উপশম বলে দিলাম—মধু এবং কু’রআন। আলবানি

জাল হাদিসের উপর দুটি উল্লেখযোগ্য বই হলো—

কারা হাদিস জাল করে?

হাদিস জাল করার উদ্দেশ্য অনেকগুলোঃ

  • মুনাফিকরা এবং কাফিররা মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য মুসলিম ছদ্মবেশে জাল হাদিস প্রচার করতো।[১৬০]

  • আলেমদের মধ্যে যারা নিজেরা যত বেশি হাদিস সংগ্রহ করেছে বলে দাবি করতে পারতন, তিনি তত বেশি সন্মান পেতেন। তাই সন্মানের লোভে অনেক মাওলানা, পীর, দরবেশ নিজেদের বানানো হাদিস প্রচার করে গেছেন।[১৬০] “এই হাদিসটির ইস্‌নাদ আমার কাছে একদম রাসুলুল্লাহ عليه السلام থেকে এসে পৌঁছেছে”—এই ধরনের দাবি করতে পারাটা একটা বিরাট গৌরবের ব্যাপার ছিল, এখনও আছে। অনেকেই বোঝেন না, এটা কত ঝুঁকিপূর্ণ একটা দাবি এবং কীভাবে তিনি একটি ভুল হাদিসকে বয়ে বেড়াতে পারেন।

  • রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য আগেকার রাজা-বাদশা, শাসকরা আলেমদের ব্যবহার করে মিথ্যা হাদিস প্রচার করতো, এখনও করে।[১৬০] জনতাকে কোন প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য হাদিসের চেয়ে মোক্ষম অস্ত্র আর কিছু ছিল না।

  • ধর্মের প্রতি মানুষকে আরও অনুপ্রাণিত করার জন্য নানা চমকপ্রদ, অলৌকিক ঘটনায় ভরপুর জাল হাদিস প্রচার করা হত, যেগুলো শুনে সাধারণ মানুষ ভক্তিতে গদগদ হয়ে যেত। এখনও গ্রামে-গঞ্জে এই ধরনের অনেক ভুয়া হাদিস প্রচার করা হয়।[১৬০]

  • ধর্মীয় উপাসনালয় এবং বিশেষ স্থানগুলোতে মানুষের আনাগোনা বাড়ানো এবং তা থেকে ব্যবসায়িক লাভের জন্য জাল হাদিস ব্যবহার করে সেসব স্থানের অলৌকিকতা, বিশেষ ফজিলত প্রচার করা হত। সাধারণ মানুষ তখন ঝাঁকে ঝাঁকে সেই সব অলৌকিক, প্রসিদ্ধ স্থানে গিয়ে তাদের বিপুল পরিমাণের অর্থনৈতিক লাভ করে দিয়ে আসতো।[১৬০] যেমন, “যে হজ্জের উদ্দেশে মক্কায় গেছে কিন্তু মদিনায় গিয়ে আমার (মুহাম্মাদ عليه السلام) কবর জিয়ারত করেনি সে আমাকে অপমান করেছে।”

  • এক শ্রেণীর ভন্ড মৌলভীরা মানুষের কাছে ধর্মকে সহজ করে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য হাদিস জাল করেছে। এসব হাদিসগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো খুব অল্প কাজ করে বিপুল পরিমাণ নেকির বর্ণনা দেয়া থাকে। যেমন, “যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম রবিউল আউয়াল মাসের খবর পৌঁছাবে তার জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম হয়ে যাবে” — এই জাতীয় অনেক হাদিস পাবেন যা খুব সহজে কারো জন্য জান্নাত বাধ্যতামূলক বা জাহান্নাম নিষেধ হয়ে যাওয়ার লোভ দেখায়।

  • বিভিন্ন মতের অনুসারীরা তাদের ভ্রান্ত আকিদার সত্যতা প্রমাণের জন্য হাদিস জাল করেছে। যেমন, শিয়ারা ইমাম মাহদী ও আলী(রা) নিয়ে অসংখ্য জাল হাদিস তৈরী করেছে: “আমি জ্ঞানের শহর এবং আলি তার দরজা।” “প্রত্যেক নবীর একজন উত্তরসূরি আছে। আমার উত্তরসূরি আলি।” একইভাবে সুন্নিরা শিয়াদেরকে ভুল প্রমাণ করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে অনেক জাল হাদিস তৈরি করেছে।

ইতিহাসের কিছু বিখ্যাত হাদিস জালকারি

খলিফা মাহদি আব্বাসির শাসনামলে আব্দুল কারিম বিন আল আরযাকে যখন শাস্তি স্বরূপ হত্যা করার জন্য আনা হয়, তখন সে প্রায় চার হাজার হাদিস জাল করার কথা স্বীকার করেছিলেন।[১৬০][১৬১]

আবু আসমা নুহ বিন আবি মারিয়াম কু’রআনের প্রতিটি সূরার নানা ধরণের ফজিলত নিয়ে শত শত জাল হাদিস প্রচার করেছেন, যখন তিনি লক্ষ করেছিলেন মানুষ কু’রআনের প্রতি বেশি মনোযোগ দিচ্ছিল না। যেমন, সূরা ইয়াসিন কু’রআনের দশ ভাগের একভাগ, অমুক সূরা পড়লে কু’রআন খতমের সওয়াব পাওয়া যায় ইত্যাদি।  [কিতাব আল মাউজুয়াত – ইবন জাওযি, পৃষ্ঠা ১৪][১৬১]

ওয়াহাব বিন মুনাব্বিহ নানা ধরণের ভালো কাজের বিভিন্ন ধরণের ফজিলত নিয়ে অনেক হাদিস জাল করেছেন। তিনি একজন ইহুদি ছিলেন মুসলমান হবার আগে।  [আল মাউজুয়াত][১৬১]

আবু দাউদ নাখায়ি একজন অত্যন্ত নিবেদিত প্রাণ ধার্মিক ছিলেন। তিনি রাতের বেশিরভাগ সময় নামায পড়তেন এবং প্রায়ই দিনে রোজা রাখতেন। তিনিও নানা ধরণের বানানো হাদিস প্রচার করেছেন মানুষকে ধর্মীয় কাজে মাত্রাতিরিক্ত মগ্ন রাখার জন্য। [আল মাউজুয়াত-৪১][১৬১]

যারা ধর্মকে বিকৃত করে, তারা সত্য মেনে নিবে না

এই আয়াতের পটভূমি হচ্ছে: মদিনায় প্রথম দিকের মুসলিমরা অনেক আশা করেছিল যে, সেখানকার ইহুদীরা সহজেই রাসুলকে عليه السلام গ্রহণ করে, ইসলামকে মেনে নিয়ে তাদেরকে সমর্থন করবে। যেহেতু ইহুদীরা ধর্মের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস ছিল, আল্লাহর تعالى প্রতি বিশ্বাস করত এবং মুসা নবীর عليه السلام অনুসারী ছিল, মুসলিমরা স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নিয়েছিল যে, ইহুদীরা হবে তাদের সবচেয়ে কাছের এবং ইহুদীরা তাদের সাহায্যে সবার আগে এগিয়ে আসবে।[৩][১১] কিন্তু এই আয়াতে আল্লাহ تعالى সেই সরলমনা মুসলিমদেরকে বাস্তবতা শেখাচ্ছেন: যেই জাতি জেনে বুঝে আল্লাহর تعالى বাণীকে বিকৃত করে নিজেদের লাভের জন্য, কীভাবে মুসলিমরা আশা করে যে, সেই জাতি তাদের সুবিধামত বানানো ধর্মটাকে ছেড়ে দিয়ে ইসলামকে মেনে নিবে, যার উপর তাদের আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না?

এই আয়াতে আমাদের একটা শেখার ব্যাপার রয়েছে: সবাইকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পরিবর্তন করা যায় না, বিশেষ করে যারা যথেষ্ট পড়াশুনা করে, জেনে-বুঝে বিকৃত ধর্ম প্রচার করছে।[১১] এই ধরনের মানুষদেরকে আপনি যদি বোঝাতে যান তারা কী ভুল করছে, প্রথমত তারা তা স্বীকার করবে না, দ্বিতীয়ত তারা আপনাকে পথের কাঁটা হিসেবে দেখে, আপনাকে দূর করে ফেলার জন্য অনেক নীচে নামতে পারে।

আজকাল গ্রামে গঞ্জে অনেক পীর, দরবেশ, ‘হাজি সাহেবের’ উদ্ভব হয়েছে, যারা ইসলামের নামে বিকৃত শিক্ষা প্রচার করছে। আমরা যদি আশা করি যে, এদের কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে গেলে, কু’রআন-হাদিস থেকে কোটেশন দিলে, তারা নিজেদের ভুল বুঝে ভালো হয়ে যাবে, তাহলে আমাদের আশাহত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যেই মানুষ ইসলাম সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করার পরেও নিজের কথাকে আল্লাহর বাণী বলে চালিয়ে দেওয়ার মতো ভয়ংকর আস্পর্ধা দেখাতে পারে, তার মতো স্বার্থপর, বিকৃত মানসিকতার মানুষ হতে পারে না। তবে আমরা যেহেতু জানি না মানুষের মনের খবর, তাই আমাদের উচিত সবাইকেই দাওয়াত দেওয়া। যাদের ভেতরে আল্লাহর تعالى ভীতি আছে এবং যারা অজ্ঞতাবশত ইসলামকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে, তারা হিদায়াত পাবে, আল্লাহ تعالى যদি চান।

2_76

যখন তারা বিশ্বাসীদের সাথে দেখা করে, তখন বলে, “আমরা ঈমানদার”; কিন্তু যখন তারা নিজেদের ভেতরে একাকি থাকে, তখন বলে, “তোমরা কেন তাদেরকে বলে দিলে আল্লাহ আমাদেরকে কি প্রকাশ করেছেন? তারা তো আল্লাহর সামনে এনিয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাঁড় করাবে? তোমাদের কি কোনো বুদ্ধি নেই?” [আল-বাক্বারাহ ৭৬]

এই ধরনের মানুষরা সাধারণত দল বেঁধে থাকে, কারণ তারা জানে একা একা এরকম অন্যায় করে টিকে থাকা মুশকিল। অনেক সময় এদের দলের কেউ ভুল করে কোনো সত্য কথা ফাঁস করে দেয়। তখন শুরু হয় তার উপর আক্রমণ। তাকে হয় দল ছাড়া করা হয়, না হয় গুম করে ফেলা হয়।

এই ধরনের মাফিয়া মানসিকতা কিছু কিছু আলেমের মধ্যেও রয়েছে। ধরুন, কোনো বিশেষ মতবাদের অনুসারী কয়েকজন আলেমের একটা দল, অন্য কোনো মতবাদের অনুসারী একজন আলেমকে ভুল প্রমাণ করে বইয়ের উপর বই লিখে, মসজিদে খুতবার পর খুতবা দিয়ে এসেছে। কিন্তু একদিন তাদের একজন উপলব্ধি করল যে, কাজটা ঠিক হচ্ছে না, কারণ তাদের যুক্তি এবং দলিলে কিছু ভুল আছে। এখন তার সামনে দুইটা পথ খোলা: ১) সত্য কথা বলে দল থেকে বহিস্কার হয়ে যাওয়া। যার ফলাফল: তার দলের বাকিরা তখন তাকে নিয়েই বই লিখতে বসবে। তার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করবে। মসজিদের খুতবায় তাকে বদনাম করে তার ক্যারিয়ার শেষ করে দিবে। যদি দলের বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে তাকে হয়ত গুম করে ফেলা হবে। অথবা, ২) ‘বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে ক্ষুদ্র ত্যাগ করে’ দলের খ্যাতি, অগাধ ফান্ড, সুসজ্জিত অফিস, লাইব্রেরী ইত্যাদি না হারিয়ে, দলের বাকিদের সাথে মিলমিশ করে খারাপ কাজটা মুখ বুজে চালিয়ে যাওয়া — এই আশা করে যে, বাকি অনেক ভালো কাজের বিনিময়ে এই খারাপ কাজটা আল্লাহ تعالى মাফ করে দেবেন।

বহুল প্রচলিত কিছু জাল হাদিসের একটি তালিকা

জাল হাদিস যেই হাদিস বিশারদরা জাল প্রমাণ করেছেন
জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীনে যেতে হলেও যাও। ইবন জাওযি, ইবন হিব্বান, নাসিরুদ্দিন আলবানি
জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে বেশি পবিত্র। আল-খাতিব আল-বাগদাদি—হিস্টরি অফ বাগদাদ
দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। আস-সাগানি, নাসিরুদ্দিন আলবানি
নিজের কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ সর্বোত্তম জিহাদ। ইবন তাইমিয়্যাহ, ইবন বাআয।
সবুজ গাছপালা, শস্যর দিকে তাকিয়ে থাকলে দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধি পায়। আয-যাহাবি
আল্লাহ সেই বান্দাকে ভালবাসেন যে তাঁর ইবাদতে ক্লান্ত, নিস্তেজ হয়ে পড়ে। আদ-দারকুতনি
সুদ খাওয়ার ৭০ পর্যায়ের নিষেধাজ্ঞা আছে, এর মধ্যে আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচেয়ে ছোট অপরাধ হচ্ছে মায়ের সাথে ব্যভিচার   করা। ইবন জাওযি, আল হুয়ায়নি (দুর্বল বা জাল হাদিস)
মুহাম্মাদকে عليه السلام সৃষ্টি না করলে আল্লাহ কোনো কিছুই সৃষ্টি করতেন না। মুহাম্মাদ عليه السلام—এর নূর থেকে সমস্ত সৃষ্টি জগত সৃষ্টি হয়েছে। আয-যাহাবি, ইবন হিব্বান, নাসিরুদ্দিন আলবানি
যে শুক্রবার মুহাম্মাদ عليه السلام এর প্রতি ৮০বার দুরুদ পাঠাবে তার ৮০ বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। আল্লামা সাখায়ি, আলবানি
আযানের মধ্যে আঙ্গুল চুম্বন করে চোখে মোছা। আস-সুয়ুতি, আলবানি
এক ঘণ্টা গভীরভাবে চিন্তা করা ৬০ বছর ইবাদতের সমান। ইবন জাওযি
যারা মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেয় এবং মানুষকে ইসলাম গ্রহন করায় তাদের জন্য জান্নাত নিশ্চিত। আস-সাগানি
সুরা ইয়াসিন কু’রআনের হৃদয়। একবার সুরা ইয়াসিন পড়লে দশবার কু’রআন খতম দেওয়ার সমান সওয়াব পাওয়া যায়। ইবন আবি হাতিম, আলবানি
মৃতের জন্য সুরা ইয়াসিন পড়। আদ-দার কুদনি
আরবদেরকে ভালোবাসো, কারণ আমি একজন আরব, কু’রআন আরবিতে নাজিল হয়েছে এবং জান্নাতের ভাষা হবে আরবি। আবি হাতিম—জারহ ওয়া তাদিল
পাগড়ী পরে নামায পড়লে পাগড়ী ছাড়া ১৫টি নামায পড়ার সমান সওয়াব। ইবন হাজার—লিসানুল মিজান
আমি জ্ঞানের শহর এবং আলি তার দরজা। ইমাম-বুখারি
প্রত্যেক নবীর একজন উত্তরসূরি আছে। আমার উত্তরসূরি আলি। ইবন জাওযি, ইবন হিব্বান, ইবন মাদিনি
আমার উম্মতের আলেমরা বনি ইসরাইলিদের নবীদের সমান। আলেমদের ইজমা দ্বারা স্বীকৃত
আমার পরিবার, সাহাবীরা আকাশের তারার মত, তাদের মধ্যে যাকেই তোমরা অনুসরণ করবে, তোমরা সঠিক পথে   থাকবে। আহমাদ হানবাল,   আয-যাহাবি, আলবানি
বিশ্বাসীর অন্তরে আল্লাহ تعالى থাকেন। আয-যারকাশি, ইবন তাইমিয়া
যে নিজেকে জেনেছে, সে আল্লাহকেও تعالى জেনেছে। আস-সুয়ুতি, ইমাম নাওয়ায়ি
আমি তোমাদেরকে দুটি উপশম বলে দিলাম—মধু এবং কু’রআন। আলবানি
যদি আরবদের অধঃপতন হয়, তাহলে ইসলামেরও অধঃপতন হবে। ইবন আবি হাতিম
যে কু’রআন শেখানোর জন্য কোন পারিশ্রমিক নেয়, সে কু’রআন শিখিয়ে আর কোন সওয়াব পাবে না। আয-যাহাবি
বিয়ে কর, আর কখনও তালাক দিয়ো না, কারণ তালাক দিলে আল্লাহর تعالى আরশ কাঁপে। ইবন জাওযি
যে বরকতের আশায় তার ছেলের নাম মুহাম্মাদ রাখবে সে এবং তার ছেলে জান্নাত পাবে। ইবন জাওযি
যে হজ্জের উদ্দেশে মক্কায় গেছে কিন্তু মদিনায় গিয়ে আমার কবর জিয়ারত করেনি সে আমাকে অপমান করেছে। আস-সাগানি, ইবন জাওযি, আশ-শাওকানি
যে আমার (মুহম্মাদ عليه السلام) কবর জিয়ারত করে তার জন্য সুপারিশ করা আমার জন্য ওয়াজিব হয়ে যায়। আলবানি
যে স্ত্রী তার স্বামীর অনুমতি না নিয়ে ঘরের বাইরে যায়, সে ফেরত না আসা পর্যন্ত আল্লাহর অসন্তুষ্টিতে থাকবে, বা যতক্ষন না তার স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়। আলবানি
যদি নারী জাতি না থাকতো, তাহলে আল্লাহর تعالى যথাযথ ইবাদত হতো। শেখ ফয়সাল
নারীর উপদেশ মেনে চললে অনুশোচনায় ভুগবে। শেখ ফয়সাল

সূত্র:

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা বাকারাহ এর উপর লেকচার।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন — আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি।
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি।
  • [১৬০] হাদিসের নামে জালিয়াতি – ডঃ খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গির, ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়।
  • [১৬১] 100 Fabricated Hadith – Shaikh Faisal, Darul Islam Publications.
  • [১৬২] The prevalence of Concocted and Weak Hadith – Moulana Shams Pirzada. Published by Idara Dawatul Quran.
  • [১৬৩] 52 Weak hadith – Dr. Ibrahim B. Syed, President, Islamic Research Foundation International, Inc.
  • [১৬৪] প্রচলিত ভুলের সংকলন – মাওলানা মুহাম্মাদ মালেক।
  • [১৬৫] উমায়্যাদ রাজবংশ — http://en.wikipedia.org/wiki/Umayyad_Caliphate
  • [১৬৬] ইবন তাইমিয়্যাহ — http://www.britannica.com/EBchecked/topic/280847/Ibn-Taymiyyah
  • [১৬৭] ইসলাম বিংশ শতাব্দীতে রাজনীতির একটি হাতিয়ার — http://www.globalresearch.ca/the-powers-of-manipulation-islam-as-a-geopolitical-tool-to-control-the-middle-east/25199