তখনি কেন তোমরা অহংকারী হয়ে যাও — আল-বাক্বারাহ ৮৭

আল্লাহ تعالى আমাদেরকে ইসলাম দিয়েছেন, যেন আমরা ইসলাম অনুসারে আমাদের জীবন গড়ে তুলি। কিন্তু অনেককেই দেখা যায় তাদের লাইফ স্টাইল, সংস্কৃতি, ফ্যাশন, দুই নম্বরি ব্যবসায় যেন কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্য ইসলামকে তাদের ইচ্ছামত পরিবর্তন করেন, যাতে করে সেই ‘ইসলাম’ মানতে নিজেদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন করতে না হয়। যেমন, আপনি আপনার প্রতিবেশীকে একদিন বললেন, “চৌধুরী সাহেব, ভাই কিছু মনে করবেন না, আপনার ব্যবসাটা কিন্তু হারাম ব্যবসা। আপনার ঘরের মেয়েরা যেই ধরনের কাপড় পড়ছেন, সেটা ইসলামের দৃষ্টিতে একেবারেই নিষিদ্ধ। আর আপনার ছেলেমেয়ের বিয়েতে যে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা উড়ালেন, আল্লাহর تعالى কাছে তার জবাব কীভাবে দেবেন?”

সাথে সাথে তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠবেন, “কি! আপনি কি বলতে চাচ্ছেন ইসলাম কী আমি সেটা জানি না? আপনাদের মত তালেবানদের জন্য আজকে ইসলামের এই অবস্থা। দেশটাকে আপনারা আরেকটা আফগানিস্তান বানিয়ে ফেলছেন।”

এধরনের মানুষদেরকে যখন কেউ বার বার নিষেধ করতে থাকে, এবং তাদের আসল জায়গায়: ব্যাংক ব্যালেন্স এবং সম্পত্তিতে সমস্যা তৈরি করে —তখন তারা তাদের ‘সোনার ছেলেদের’ ফোন করেন, “তোমাকে একটা লোকের নাম-ঠিকানা পাঠাচ্ছি। একে সরিয়ে ফেল।”

এদের উদাহরণ হলো এই আয়াতের বনী ইসরাইলের মতো—

2_87

আমি অবশ্যই মুসাকে কিতাব দিয়েছিলাম। তারপর তার সমর্থন করে ধারাবাহিকভাবে কয়েকজন রাসুল/বার্তাবাহক পাঠিয়েছিলাম। আর আমি মরিয়মের সন্তান ঈসাকে একদম পরিষ্কার নিদর্শন দিয়েছিলাম এবং তাকে পবিত্র রূহ দিয়ে শক্তিশালী করেছিলাম। যখনি কোনো রাসুল/বার্তাবাহক এমন কিছু নিয়ে আসে, যা তোমাদের কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে যায়, তখনি কেন তোমরা অহংকারী হয়ে যাও? কেন তাদের কয়েকজনকে তোমরা মিথ্যাবাদীর কালিমা দাও, কয়েকজনকে খুন করো? [আল-বাক্বারাহ ৮৭]

Corruption-1

মানুষের মধ্যে একটা স্বভাবজাত প্রবৃত্তি আছে আইনকে নিজের সুবিধামত বিকৃত করে, অন্যের সাথে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করার, যাতে করে তারা তাদের স্বার্থপর সাম্প্রদায়িক, জাতিগত, দলগত উদ্দেশ্যগুলো হাসিল করতে পারে। এটা সাধারণত সেই সব সমাজে দেখা যায়, যেখানে মানুষ ন্যায়ভাবে চলার ন্যূনতম ধারণাগুলো হারিয়ে ফেলে।[৬]

একটা ছোট বাচ্চা চেষ্টা করে কীভাবে বাবা-মার কাছ থেকে ঘরের নিয়ম কানুনে শুধুমাত্র তার জন্য বিশেষ ছাড় পাওয়া যায়, “বাবা, আমি জানি আমাদের দিনে একটার বেশি চকলেট খাওয়া নিষেধ। কিন্তু শুধু আমাকে দিনের বেলা একটা, আর রাতের বেলা আরেকটা দেওয়া যায়? আমি ছোটকে দেখাব না। একদম লুকিয়ে লুকিয়ে খাব।” তারপর মানুষ বড় হলে মন্ত্রীকে ফোন করে, “সালাম মন্ত্রী সাহেব, সংসদে ওই বিলটা পাশ হলে কিন্তু আমাদের দল আর এই বছর গাড়ি পাবে না। আপনি ব্যবস্থা করুণ যেভাবেই হোক সেই বিলটা যেন পাশ না হয়। আমি আপনাকে খুশি করে দেব। গুলশানে দুটো বাড়ি আর আগামি দশ বছরের জন্য আপনার রঙিন পানির সাপ্লাই আমার দায়িত্ব। আপনার আর কী লাগবে শুধু বলেন আমাকে।” ধর্মীয় দলগুলোর মধ্যে চলে আরেক ধরনের আলোচনা, “হুজুরে পাক, আপনি দেশের সবচেয়ে বড় মুফতিদের একজন। এই ফতোয়াটা মঞ্জুর করে দেন। আমরা অমুক গ্রুপের সাথে চুক্তি করেছি। তারা আগামি বছর বাজারে হালাল সাবান ছাড়তে যাচ্ছে। সেখান থেকে ২০% কমিশন আমরা পাবো। শুধু দরকার এই ফতোয়াটা পাশ করার। তাহলেই সবাই অন্য সব সাবান বাদ দিয়ে, এই হালাল সাবান কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। আপনার মসজিদ করার জন্য যত বাজেট লাগে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”

সঠিক আইন, ন্যায়নীতি, আদর্শ তৈরি হয় নিরপেক্ষতা, পক্ষপাতহীনতা থেকে, যা মানুষের কামনা-বাসনা দিয়ে বিকৃত হয় না। এটা মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়, এর জন্য মানুষের উর্ধে কোনো উৎস দরকার, যার মধ্যে মানুষের যে মানবিক দুর্বলতাগুলো রয়েছে, সেগুলো নেই।

আমি অবশ্যই মুসাকে কিতাব দিয়েছিলাম

যখন মানুষকে তার খেয়াল খুশি মতো ন্যায়, নীতি, আদর্শ তৈরি করার সুযোগ দেওয়া হয়, তখন ধর্মীয় নিয়মকানুনগুলো চ্যালেঞ্জ করে তাদেরকে এই ধরনের প্রশ্ন করতে দেখা যায়—

“আগেকার যুগে হিজাবের দরকার ছিল, কারণ তখনকার সংস্কৃতি ছিল আলাদা। মানুষগুলো ছিল অশিক্ষিত, বর্বর। আইন শৃঙ্খলা ছিল খুবই দুর্বল। আজকের আধুনিক যুগে এবং সংস্কৃতিতে হিজাবের কোনো দরকার নেই।”
“একজন পরিণত বয়সের দায়িত্ববান পুরুষ যদি আরেকজন পরিণত বয়সের নারীর সাথে স্বেচ্ছায়, উভয়ের অনুমতিতে লিভ টুগেদার করতে চায়, তাহলে সমস্যাটা কোথায়? কেন আমরা মানুষকে খামোখা বিয়ে নামের একটা নিছক অনুষ্ঠান করতে বাধ্য করছি, তারপর তাদেরকে তালাকের মতো একটা কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি?”
“সুদের ফলে ব্যাংক তৈরি হচ্ছে, মানুষের চাকরির ব্যবস্থা হচ্ছে, কত প্রজেক্ট হচ্ছে, ধনীর টাকা গরিবের কাজে লাগছে। সুদ হারাম হওয়ার পেছনে কোনো কারণ থাকতে পারে না।”

ইত্যাদি। ইত্যাদি।

মানুষের চিন্তা-ভাবনা তার কামনা-বাসনা নিয়ে প্রভাবিত। সে যতই চেষ্টা করুক না কেন, তার চিন্তার পরিধি, তার উপলব্ধির সীমা থাকবেই। আর বিভিন্ন যুগে মানুষের সংস্কৃতি, অভ্যাসের ফলে তার কাছে কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল — সেটাতে পরিবর্তন আসবেই। একই ভাবে পরিসংখ্যানের উন্নতির সাথে সাথে মানুষ বুঝতে শেখে: মানুষের কোন কাজটা ভুল ছিল, যা তারা আগে একসময় ঠিক মনে করত। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে যেই ধরনের কাপড় পড়াটা মানুষের কাছে অত্যন্ত আপত্তিকর, অশ্লীল মনে হতো, আজকে সেই ধরনের কাপড় পড়াটা একেবারেই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। পঞ্চাশ বছর আগের যৌন কর্মীদের পোশাক [দেশে: ওড়না ছাড়া সালওয়ার-কামিজ; বিদেশে: শর্ট স্কার্ট, টাইট্‌স] আজকে ভদ্র ঘরের মেয়েরা পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পঞ্চাশ বছর আগে যেই শব্দগুলো মুখে উচ্চারণ করলে মুরব্বীরা চড় মেরে দাঁত ফেলে দিত, আজকে সেই সব শব্দগুলো কিশোর-তরুণদের নিত্যদিনের কথাবার্তার অংশ হয়ে গেছে। আগে মারিজুয়ানা সম্পূর্ণ অবৈধ ছিল। কয়েক বছর আগে আমেরিকার কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে মারিজুয়ানা বৈধ করা হয়েছে। পঞ্চাশ বছর আগেও সমকামীদের বিয়ে ছিল সামাজিকভাবে ভয়ংকর ঘৃণিত, আইনত অবৈধ ব্যাপার। আজকে কয়েকটি দেশে সরকারি পর্যায়ে অনুপ্রেরণা দিয়ে সেটাকে বৈধ করা হয়েছে। এমনকি কিছু চার্চ এগিয়ে এসেছে সমকামীদের বিয়ের অনুষ্ঠান করার ব্যবস্থা করতে।

একইভাবে একশ বছর আগে সাদা এবং কালো চামড়ার মানুষদের মধ্যে যে সামাজিক বৈষম্য স্বাভাবিক ছিল, যে দাস প্রথা প্রচলিত ছিল —সেটা আজকে বেশিরভাগ দেশে আইনত নিষিদ্ধ। যুগে যুগে মানুষের কাছে কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ, তা পরিবর্তন হয়। তাই কোনো দলের, সমাজের, দেশের মানুষকে যদি দায়িত্ব দেওয়া হয় সারা পৃথিবীর সব মানুষের জন্য ‘জীবনযাপনের নিয়মকানুন’ বা ‘ধর্ম’-কে নির্ধারণ করতে, তাহলে সেটাতে পক্ষপাতিত্ব, ভুল, সীমাবদ্ধতা থাকবেই। সেই ‘মানবধর্ম ভার্শন-১’-এ পঞ্চাশ বছর যেতে না যেতেই ভুল বের হবে। সেগুলো ঠিক করে ‘মানবধর্ম ভার্শন-২’ বের করার পর একশ বছর যেতে না যেতেই আবারও কিছু ভুল বের হবে। সেগুলো ঠিক করে আরেকটা ‘মানবধর্ম ভার্শন-৩’ বের করার পর দেখা যাবে পঞ্চাশ বছর পরে এমন ভয়ংকর ফলাফল হয়েছে যে, প্রথম ভার্শনে আবার ফেরত যেতে হচ্ছে। এভাবে সময়ের সাথে মানুষের জ্ঞান, উপলব্ধি, পরিসংখ্যানের উন্নতির সাথে সাথে সেই ধর্মের নিত্য নতুন ভার্শন বের হতেই থাকবে।

একারণে ধর্ম আসতে হবে মানুষের ঊর্ধ্বে কারো কাছ থেকে, যার পক্ষে সারা পৃথিবীর সব মানুষের চাহিদা, প্রেক্ষাপট, সীমাবদ্ধতা একই সাথে বোঝা এবং বিবেচনা করা সম্ভব। যার কাছে মানব জাতির অতীতের সব জ্ঞান রয়েছে এবং যিনি মানুষের ভবিষ্যৎ দেখতে পান। শুধুমাত্র সে রকম কোনো সত্তার পক্ষেই সম্ভব পৃথিবীর সব মানুষের জন্য সমান ভাবে কাজে লাগবে এবং অনন্তকাল পর্যন্ত মানবজাতির কল্যাণ হবে, এমন সঠিক নিয়মকানুন নির্ধারণ করা।

তারপর তার সমর্থন করে ধারাবাহিকভাবে কয়েকজন রাসুল/বার্তাবাহক পাঠিয়েছিলাম

মানুষের উপরে আল্লাহর تعالى অসীম অনুগ্রহ যে, তিনি মানুষকে বার বার নবী, রাসুল পাঠিয়ে সঠিক পথ দেখিয়েছেন। তিনি যদি প্রথম মানুষ আদমকে عليه السلام তাঁর বাণী দিয়ে আর কোনো নবী, রাসুল না পাঠাতেন, তাহলে আজকে আমরা বেশিরভাগ মানুষ বন্য মানুষ হয়ে যেতাম। মারামারি, কাটাকাটি, অবাধ যৌনাচার করে পশুর মতো জীবন যাপন করতাম। আজকে পৃথিবীতে যে কয়েকশ কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষ আছে, যারা সঠিক ভুল যাই হোক না কেন, অন্তত চেষ্টা করে যাচ্ছে তাদের মতো করে স্রস্টার আনুগত্য করার, ভালোভাবে চলার, পাপ থেকে দূরে থাকার —তার কারণ আল্লাহ تعالى আমাদেরকে বার বার নবী, রাসুল পাঠিয়েছিলেন। যদি তা না হতো, তাহলে আজকে পৃথিবীতে বেশিরভাগ মানুষ কোনো ধরনের ধর্ম না মেনে পশুর থেকেও খারাপ জীবন যাপন করত।

ধর্ম থেকে সরে গেলে মাত্র কয়েক শতাব্দীর মধ্যে একটা জাতি কোথায় চলে যায়, তার উদাহরণ আমরা অনেক ধ্বংস হয়ে যাওয়া জাতির অবশিষ্ট থেকে জানতে পারি। পম্পেই নগরী ছিল একটি অত্যন্ত ধনী, প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রাচুর্যে ভরা শহর। এই নগরীকে আল্লাহ تعالى একটি প্রকাণ্ড আগ্নেয়গিরি দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।

Pompeii Explosion

১৮ শতাব্দীতে প্রত্নতত্ত্ববিদরা যখন পম্পেই খোঁড়াখুঁড়ি করলেন, তখন তারা ভয়াবহ সব জিনিস খুঁজে পেলেন। তারা দেখলেন, নগরীর রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছিল পতিতালয়, দেয়ালে জঘন্য যৌন চিত্রকর্ম। সমকামিতা এবং পুরুষ মহিলার একসাথে গোসল খানার ছড়াছড়ি। এমনকি ফসিল হয়ে জমে যাওয়া সমকামি জুটির উদাহরণ পর্যন্ত পাওয়া গেছে। ধ্বংস হয়ে যাওয়া পম্পেই নগরিতে আল্লাহ تعالى আমাদের শেখার জন্য কিছু উদাহরণ রেখে দিয়েছেন, যেন আমরা জানতে পারি: কী কারণে তাদের সেই ভয়ংকর পরিণতি হয়েছিল।[১৭৮]

তারপর ওরা যখন ওদেরকে পাঠানো সতর্কবাণী ভুলে গেল, তখন আমি ওদের জন্য সব (প্রাচুর্যের) দরজা খুলে দিলাম। এতসব পেয়েও ওরা যখন আয়েশ করতে থাকল, তখন আমি হঠাৎ করে ওদেরকে আঘাত করলাম। ওরা বিস্ময়ে থ বনে গেল! অন্যায়কারীদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হলো —সমস্ত প্রশংসা-ধন্যবাদ বিশ্বজগতের প্রতিপালকের। [আল-আনআ’ম ৬:৪৪-৪৫]

Pompeii

দুঃখজনক ভাবে আজকে অনেক দেশের সামাজিক, নৈতিক অবস্থা পম্পেই নগরীর মতো জঘন্য হয়ে গেছে। এবং সেই দেশগুলোতেই কিছু প্রকাণ্ড আগ্নেয়গিরি ঘুমিয়ে আছে, যা যে কোনো সময় ফেটে পড়ার সম্ভাবনা আছে। সেই আগ্নেয়গিরিগুলো এতোটাই অতিকায় যে, সেগুলোর যে কোনো একটা ফাটলে একটা মহাদেশের বিরাট অংশ ধ্বংস হয়ে পুরো মহাদেশ আগ্নেয়গিরির ছাই দিয়ে ঢেকে যাবে। সেখানকার প্রাণী এবং উদ্ভিদের একটা বিরাট অংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।[১৭৯]

যখনি কোনো রাসুল/বার্তাবাহক এমন কিছু নিয়ে আসে, যা তোমাদের কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে যায়, তখনি কেন তোমরা অহংকারী হয়ে যাও?

যখন আমাদেরকে কেউ বলে, “ভাই, আপনি যে ব্যাংকের সুদের লোণ নিয়ে গাড়িটা কিনলেন, এটা তো হারাম। এভাবে প্রতিদিন একটা হারাম গাড়িতে করে পরিবারকে নিয়ে চলাফেরা করবেন?” সাথে সাথে আমরা বলি, “আপনি আমাকে এইসব বলার কে? আমাকে জ্ঞান দিতে আসছেন কেন? আপনি নিজে কি মহাপুরুষ নাকি?” —এটা হচ্ছে অহংকার। শয়তান অহংকারের কারণে নিজেকে আদমের থেকে বড় কিছু মনে করে সারাজীবনের জন্য শেষ হয়ে গেছে। আজকে আমরা নিজেদেরকে আল্লাহর تعالى আদেশ-নিষেধের উর্ধে মনে করে নিজেদেরকে শেষ করে ফেলছি—
“কেন আমি সুদ নিতে পারব না? এটা হচ্ছে আমার জমানো টাকার আয়। এই সম্পদ আমার প্রাপ্য।”
“কেন আমি গুলশানের ওই বাড়িটা লোণ নিয়ে কিনতে পারব না? আমি এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উপরের শ্রেণীর ম্যানেজার। একমাত্র ওই বাড়িটাই আমার স্ট্যাটাসের সাথে মানায়।”
“মদ বিক্রি করলে অসুবিধা কি? আমি তো মদ খাই না। কু’রআনে তো মদ খাওয়া নিষেধ বলছে, কেনা-বেচা নিয়ে কোনো বাঁধা নাই। তাছাড়া আমি এই ব্যবসার টাকায় দেশে মসজিদ-মাদ্রাসা দিয়েছি!”

—এই হচ্ছে বনী ইসরাইলী মানসিকতা। এই মানসিকতা নিয়ে কোনো জাতি বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি।

রাসুল শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো বার্তাবাহক। হাজার বছর আগে টিভি, পত্রিকা, ইন্টারনেট ছিল না। তখন আল্লাহর تعالى পক্ষ থেকে প্রেরিত কিছু বিশেষ মানুষ সশরীরে মানুষের কাছে যেতেন আল্লাহর تعالى বাণী নিয়ে, যাদেরকে ইসলামের পরিভাষায় রাসুল বলা হয়। আজকে তাদের উত্তরসূরি হিসেবে আল্লাহ تعالى আপনাকে, আমাকে বার বার বার্তাবাহক পাঠান বিভিন্ন আধুনিক মাধ্যমে। আমাদের কাছে রাসুলদের উত্তরসূরি আ’লেমরা এসে ইসলামের ব্যাপারে আমাদেরকে বলেন। টিভি ছাড়লে প্রায়ই আমরা ইসলামের কোনো না কোনো অনুষ্ঠান দেখতে পাই, মাঝে মাঝে কু’রআন, হাদিস শুনতে পাই। পত্রিকা খুললে মাঝে মাঝেই ইসলামের উপর কোনো আর্টিকেলে চোখ আটকে যায়। ইন্টারনেটে গেলে শত শত আর্টিকেল, ইসলামের বাণী আনা-নেওয়া করতে দেখা যায়। এভাবে আল্লাহ تعالى বার বার আমাদের কাছে তাঁর বাণী পাঠান। এরপরও আমরা সেগুলোকে উপেক্ষা করতে থাকি। বনী ইসরাইলের রাসুলদেরকে অস্বীকার করে আল্লাহর تعالى বাণীর সাথে কুফরি করা, আর আজকে চারিদিকে ইসলামের জ্ঞানের এত সহজ উৎস থাকার পরেও, আমাদের সেগুলোকে উপেক্ষা করে আল্লাহর تعالى বাণীর সাথে কুফরি করা —খুব একটা পার্থক্য আছে কি?

কেন তাদেরকে তোমরা মিথ্যাবাদীর কালিমা দাও?

ধরুন কেউ একজন আপনার বন্ধুবান্ধবের কাছে ধীরে ধীরে অনেক জনপ্রিয় হয়ে যাচ্ছে তার সততা, সুন্দর ব্যবহার, ধর্মের প্রতি গভীর জ্ঞান এবং ভালোবাসার কারণে। আপনি লক্ষ্য করছেন আস্তে আস্তে সবাই তার দিকে ঝুঁকে পড়ছে, তার সাথে বেশি সময় কাটাচ্ছে, আর আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই অবস্থায় আপনি যদি তার জনপ্রিয়তা নষ্ট করে দিতে চান, সবাইকে আপনার কাছে ফিরিয়ে আনতে চান, তাহলে আপনার সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র হচ্ছে Character Assasination, বা চারিত্রিক আক্রমণ। আপনি আপনার বন্ধুদেরকে বলা শুরু করুণ, “দোস্ত, ও বলে যে, ও নাকি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে, সারাদিন ধর্ম নিয়ে থাকে। অথচ কয়েকদিন আগে ওকে দেখলাম রেস্টুরেন্টে বসে একটা মেয়ের সাথে হাত ধরে হাসাহাসি করতে। কিছু একটা ঘাপলা আছে..।.” ব্যাস, সবার মনের মধ্যে তার সম্পর্কে সন্দেহ ঢুকে যাবে। সবাই আস্তে আস্তে তার উপর ভরসা হারিয়ে ফেলবে। যখনি সে কিছু বলার চেষ্টা করবে, সবাই ভাববে, “ও মিথ্যা কথা বলছে না তো?”

রাজনীতিতে এই পদ্ধতিটি অনেক বেশি ব্যবহার করা হয়। এক দল আরেক দলের সদস্যদেরকে বিভিন্ন ভাবে মিথ্যাবাদী, প্রতারক প্রমাণ করার চেষ্টা করে। কারণ দেশের জনগণের কাছে কারো জনপ্রিয়তা নষ্ট করে দেওয়ার জন্য সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র হচ্ছে তাকে মিথ্যাবাদী, প্রতারক হিসেবে সন্দেহ সৃষ্টি করা। তাহলে জনগন আর তার কথা পাত্তা দিবে না, তার উপর ভরসা হারিয়ে ফেলবে, এবং সে ভোটে হেরে যাবে। একারণেই দেখবেন নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলের সদস্যরা উঠেপড়ে লাগে প্রতিদ্বন্দ্বীদের জীবন ঘাঁটাঘাঁটি করে কিছু একটা কলঙ্ক খুঁজে বের করার জন্য।

এই অত্যন্ত সফল পদ্ধতিটি আগেকার যুগের মানুষরা ব্যবহার করেছে নবী, রাসুলদের বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে তারা মিথ্যাবাদির কালিমা দিয়েছে, যেন মানুষ তাদের কথা আর মনোযোগ দিয়ে না শুনে। একজন নবী, রাসুলকে যদি মিথ্যাবাদী হিসেবে প্রমাণ করা যায়, বা সন্দেহ সৃষ্টি করা যায়, তাহলে আর কিছু করার দরকার নেই। সেই নবী, রাসুলের জন্য বাণী প্রচার করাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। কেউ আর তার কথা শুনে সেটাকে সত্য হিসেবে মেনে নিয়ে তাদের পুরো জীবনটা পাল্টে ফেলার মতো ঝুঁকি নিতে আর সাহস করবে না।

কয়েকজনকে খুন করো?

পৃথিবীতে আর কোনো জাতি নেই যাদের ইতিহাস বনী ইসরাইলিদের মতো এতটা অকৃতজ্ঞতা, অবাধ্যতায় ভরপুর।[৬] তারা নৃশংসভাবে কয়েকজন নবীকে হত্যা করেছিল। যেমন, নবী জাকারিয়াকে عليه السلام তারা পাথর মেরে হত্যা করেছিল।[২][৬] নবী ইয়াহিয়ার عليه السلام মাথা কেটে তৎকালীন ইহুদি রাজার স্ত্রীকে একটা থালায় করে উপহার দিয়েছিল।[৩]  তারা ভেবেছিল নবী ঈসাকে عليه السلام তারা ক্রুশ বিদ্ধ করে হত্যা করেছে, কিন্তু তাকে আল্লাহ تعالى তাকে নিজের কাছে তুলে নেন। তারা মনে করত যে, শুধুমাত্র তারাই হবে আল্লাহর تعالى মনোনিত একমাত্র ধর্মপ্রচারক জাতি এবং নবীরা عليه السلام শুধুমাত্র তাদের বংশেই জন্মাবে।[৮] তারা নিজেদেরকে পৃথিবীতে একমাত্র আল্লাহর تعالى ধর্মের বাহক মনে করত। এই অন্ধবিশ্বাস থেকে তারা নবী মুহাম্মাদকেও عليه السلام অস্বীকার করেছিল। এমনকি আজও অনেক সনাতন ইহুদিরা এই একই বিশ্বাস করে। তাদের বংশের বাইরে কেউ ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করতে পারে না। যদি করেও, তাকে তারা ইহুদি বংশের একজনের সমান অধিকার দেয় না।[৮] ধর্ম তাদের কাছে একটি বংশগত অধিকার। তারা মনে করে আল্লাহর تعالى সাথে তাদের বিশেষ সম্পর্ক আছে: প্রত্যেক ইহুদিকে তিনি জান্নাতের টিকেট দিয়ে রেখেছেন।[৩]

বনী ইসরাইলের যোগ্য উত্তরসূরি হচ্ছে মুসলিমরা। মুসলিম আলেমরা, যারা নবীদের عليه السلام দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আল্লাহর تعالى বাণীকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেন —তাদেরকে হত্যা করার শত শত ঘটনা রয়েছে মুসলিমদের ইতিহাসে। একদম সাহাবীদের সময় থেকে শুরু করে আজকের যুগ পর্যন্ত অনেক সাহাবী, ইমাম, আলেমকে মুসলিমরা হত্যা করেছে, যখন তাদের কথা এবং কাজ সেই সময়ের সমাজ, সংস্কৃতি এবং ক্ষমতাধীন রাজা বা সরকারের বিরুদ্ধে চলে গেছে।[১৭৬]

আজও অনেক সময় মসজিদের ইমামকে কখনো দেশের সরকার বা এলাকার এমপি সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বললে, তাকে আর পরদিন থেকে মসজিদে দেখা যায় না। কোনো আলেম কলম, মাইক হাতে নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে, কয়েকদিন পর তাকে গুম করে ফেলা হয়। এমনকি ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং দলগুলোর মধ্যে এতটাই তিক্ততা তৈরি হয়েছে যে, এই সব দলের অনেক আলেমদেরকে নামাজ শেষে মসজিদ থেকে ফেরার পথে আর কোনোদিন বাড়ি পৌঁছুতে দেখা যায় না।[১৭৭]

Persecution

আল্লাহ تعالى এই আয়াতে বনী ইসরাইলের ইতিহাস শিখিয়ে মুসলিমদেরকে সাবধান করে দিয়েছেন। ইতিহাস পড়লে দেখবেন, যখনি ইসলামের ইতিহাসে দেশের রাজা, নেতারা ইসলামের বাণীর প্রচারকদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে, নিজেদের খেয়াল খুশি মতো আইন তৈরি করে ধনীর জন্য এক স্ট্যান্ডার্ড, গরিবের জন্য আরেক স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করেছে, নিজেদেরকে আইনের উর্ধে নিয়ে গেছে, তখনি সেই মুসলিম জাতিগুলোর পরিণতি হয়েছে বনী ইসরাইলের মতো। তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে, বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে দুর্বল হয়ে গেছে। তারপর তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কাফির শক্তিগুলো তাদেরকে দখল করে শাসন করে গেছে, এখনও করে যাচ্ছে।

মুসলিম জাতিগুলোর এই করুণ পরিণতি চলতেই থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা আল্লাহর تعالى আইনকে নির্দলীয়, নিরপেক্ষভাবে বাস্তবায়ন না করছে, এবং আল্লাহর تعالى আদেশকে নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার উপরে স্থান না দিচ্ছে।[৬] বাংলাদেশ আজকে একই পথে চমৎকার ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা আস্তে আস্তে দেখতে পাচ্ছি কীভাবে কাফির শক্তিগুলো একে একে আমাদের দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে।

সে দিন হয়ত বেশি দূরে নেই যখন আমরা ব্রিটিশ আমলের মতো আবারও আরেক কাফির শক্তির অধীনে পরাধীন হয়ে মানবেতর জীবন যাপন শুরু করব। বহু যুগ ব্রিটিশরা আমাদের শোষণ করে ফকির বানিয়ে দিয়ে নিজেরা বড়লোক হয়ে গিয়েছিল। তারপর পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের শোষণ করে ফকির বানিয়ে দিয়ে নিজেরা বড়লোক হয়ে গিয়েছিল। আমরা এদিকে দুর্ভিক্ষে, মহামারিতে মরে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। দু’ দুটো গণআন্দোলন এবং একটি স্বাধীনতা যুদ্ধ করে নিজেদের শেষ রক্ষা করতে হয়েছিল। এভাবে আমাদের উপর প্রতিবেশী দেশগুলোর শোষণ চলতে থাকলে একদিন হয়ত আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করতে হবে।

আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেদের মধ্যে যা আছে, তা পরিবর্তন করে।  [আর-রাদ ১৩:১১]

সূত্র:

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা বাকারাহ এর উপর লেকচার।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন — আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি।
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি।
  • [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
  • [১৭৬] কেনিয়া-তে মুসলিম স্কলার হত্যা — http://www.onislam.net/english/news/africa/464777-muslim-scholar-shot-dead-in-kenya.html
  • [১৭৭] রাশিয়াতে মুসলিম স্কলার হত্যা — http://www.onislam.net/english/news/europe/463856-muslim-scholar-killed-in-dagestan.html
  • [১৭৮] পম্পেই নগরীতে যৌনতার ছড়াছড়ি —http://www.islamicity.com/science/QuranAndScience/destruction/GeneratedFilesnoframe/ThePeopleofLutandTheCitywhichwasTurnedUpsideDown.htm,http://en.wikipedia.org/wiki/Erotic_art_in_Pompeii_and_Herculaneum 
  • [১৭৯] ইয়েলোস্টোন সুপার ভলকানো ফাটলে কী হবে — http://www.mnn.com/earth-matters/wilderness-resources/stories/what-if-yellowstones-supervolcano-erupts

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

One thought on “তখনি কেন তোমরা অহংকারী হয়ে যাও — আল-বাক্বারাহ ৮৭”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *