যাতে করে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পারো – বাকারাহ ৫৬

এর আগের আয়াতে নবী মুসা عليه السلام বনি ইসরাইলিদের একদল প্রতিনিধিকে নিয়ে পাহাড়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি তাদেরকে আল্লাহর تعالى দেওয়া শারি‘আহ সম্পর্কে জানান। এবং শারী‘আহর মূলনীতি লেখা পাথরের ফলকগুলো দেখান। কিন্তু প্রতিনিধিরা বলল যে, তারা শুধু মুসা عليه السلام-এর মুখের কথায় এত বড় একটা ব্যাপার মেনে নেবে না, তারা আল্লাহকে تعالى নিজের চোখে দেখতে চায়, নিজের কানে শুনতে চায়।[৩] তখন তাদের উপরে এক ভয়ংকর বজ্রপাত হলো এবং তারা নিষ্প্রাণ হয়ে গেল—

ThunderStrike

2_56

তারপর তোমাদেরকে নিষ্প্রাণ অবস্থা থেকে আবার প্রাণ দেওয়া হলো, যাতে করে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পারো। [আল-বাকারাহ ৫৬]

এই আয়াত নিয়ে দুটি মতবাদ আছে ১) যাদের উপরে বজ্রপাত হয়েছিল, তারা মারা গিয়েছিল, ২) তারা আসলে মারা যায়নি, বরং অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, বা গভীর কোমায় চলে গিয়েছিল। মাউতের অর্থ দুটোই হয়—মৃত্যু, গভীর ঘুম।[৭][২] যেমন, সূরা কাহফে আল্লাহ تعالى যখন একদল তরুণকে গভীর ঘুম পাড়িয়ে দেন, এবং তারপর তিনি তাদেরকে জাগিয়ে তোলেন, সেখানে তিনি এই আয়াতের মতো بعث ব্যবহার করেছেন, যার অর্থ— আবারও জাগিয়ে তোলা, জ্ঞান ফেরানো, স্বাস্থ্য ফিরিয়ে দেওয়া।[৫] যেহেতু সূরা কাহফে তরুণরা মারা যায়নি, বরং এক গভীর ঘুমে বা কোমায় চলে গিয়েছিল, যার মাধ্যমে তাদের আয়ু অনেক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, এবং তারপর তাদেরকে بعث বা জাগিয়ে তোলা হয়, তাই মনে করা হয় বাকারাহ-এর এই আয়াতে বনী ইসরাইলিদেরকে মৃত্যুর কাছাকাছি একটা অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যেহেতু আল্লাহ تعالى বাকারাহ-তে এর আগে একটি আয়াতে বলেছেন: সব মানুষকে একবার মৃত্যু দেওয়া হবে এবং কিয়ামতের দিন আরেকবার জীবন দেওয়া হবে, তাই বনী ইসরাইলিদের দুই বার মৃত্যু হতে পারে না।

যদি সেই প্রতিনিধিরা মরে পড়ে থাকত, তাহলে রাজনৈতিক সমস্যা হতো। বনি ইসরাইলিরা ভাবত যে, তাদের দলনেতাদেরকে পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে নবী মুসা عليه السلام তাদেরকে গোপনে মেরে ফেলে রেখে এসেছে। আল্লাহ تعالى তাকে বনি ইসরাইলিদের এমন অপবাদ থেকে রক্ষা করলেন, তিনি আবার তাদেরকে জাগিয়ে তুললেন।[৪]

mountains

এই আয়াতের শেষে একটি অদ্ভুত কথা আছে—যাতে করে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পারো। কেন কৃতজ্ঞতার প্রশ্ন আসলো? যদি বলা হতো: “যাতে করে তোমরা আমার অনুগত হতে পারো”, বা “যাতে করে তোমরা তোমাদের ভুল বুঝতে পারো” — তাহলে কি বেশি প্রাসঙ্গিক হতো না?

এখানে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে শেখাচ্ছেন: তাঁর আইন মেনে চলা, তাঁর নবীর عليه السلام প্রতি অনুগত হওয়াটা হচ্ছে তাঁরই প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানোর সামিল।[১] আমরা যখন আল্লাহর تعالى নির্দেশকে অমান্য করতে থাকি, তখন আমরা তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ে যাই। যখন আমরা অফিসের কাজ, বাচ্চাকে স্কুল আনা-নেওয়া, সপ্তাহের বাজার, মেহমানদারী করতে গিয়ে ওয়াক্তের পর ওয়াক্ত নামায ছেড়ে দেই, আমরা শুধু তাঁর অবাধ্যই হই না, তাঁর প্রতি আমরা অকৃতজ্ঞ হয়ে যাই। যদি আমরা সত্যিই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হতাম, তাহলে কখনই অফিসের বস-সন্তান-ঘরের কাজ থেকে তাঁকে কম গুরুত্ব দিতাম না। যিনি আমাদের স্বাস্থ্য, সম্পত্তি, সংসার, সন্তান, সঙ্গ, সন্মান, সম্ভ্রম সবকিছুর মালিক, তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে বা কিছুকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া, সেগুলোর পেছনে দৌড়াতে গিয়ে তাঁকেই ভুলে যাওয়া এবং ‘লোকে কী বলবে’ এই ভয়ে তাঁর নিষেধ অমান্য করা—এধরনের কাজগুলো তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন ছাড়া আর কিছু নয়।

কু’রআনে একটি ব্যাপার বার বার ঘুরে ফিরে আসে: আল্লাহর تعالى প্রতি আমাদেরকে কৃতজ্ঞতা দেখাতে হবে। প্রশ্ন আসে: আল্লাহর تعالى প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানোর জন্য এত জোর দেওয়া হয়েছে কেন? আল্লাহর تعالى তো কোনো কিছুর দরকার নেই? আমরা কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করলেই কী, আর না করলেই কী? তাঁর তো কোনো লাভ-ক্ষতি হচ্ছে না?

টাইম ম্যাগাজিনের ২০১০ সালের নভেম্বর সংখ্যায় একটি আর্টিকেল বের হয়েছে কৃতজ্ঞতার উপকারিতার উপরে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০০৩ সালে ২,৬১৬ জন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের উপরে গবেষণা করে দেখা গেছে: যারা অপেক্ষাকৃত বেশি কৃতজ্ঞ, তাদের মধ্যে মানসিক অবসাদ, দুশ্চিন্তা, অমূলক ভয়-ভীতি, অতিরিক্ত খাবার অভ্যাস এবং মদ, সিগারেট ও ড্রাগের প্রতি আসক্তির ঝুঁকি অনেক কম। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে: মানুষকে নিয়মিত আরও বেশি কৃতজ্ঞ হতে অনুপ্রাণিত করলে, মানুষের নিজের সম্পর্কে যে হীনমন্যতা আছে, নিজেকে ঘৃণা করা, নিজেকে সবসময় অসুন্দর, দুর্বল, উপেক্ষিত মনে করা, ইত্যাদি নানা ধরণের সমস্যা ৭৬% পর্যন্ত দূর করা যায়।

২০০৯ সালে ৪০১ জন মানুষের উপর গবেষণা করা হয়, যাদের মধ্যে ৪০%-এর ক্লিনিকাল স্লিপ ডিসঅর্ডার, অর্থাৎ জটিল ঘুমের সমস্যা আছে। তাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ, তারা একনাগাড়ে বেশি ঘুমাতে পারেন, তাদের ঘুম নিয়মিত হয়, রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন এবং দিনের বেলা ক্লান্ত-অবসাদ কম থাকেন।

নিউইয়র্কের Hofstra University সাইকোলজির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ড: জেফ্রি ফ্রহ ১০৩৫ জন ১৪-১৯ বছর বয়সি শিক্ষার্থীর উপর গবেষণা করে দেখেছেন: যারা বেশি কৃতজ্ঞতা দেখায়, তাদের পরীক্ষায় ফলাফল অপেক্ষাকৃত বেশি ভালো, সামাজিক ভাবে বেশি মেলামেশা করে এবং হিংসা ও মানসিক অবসাদে কম ভোগে। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এই মানসিক সমস্যাগুলো মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তাদের মধ্যে বাবা-মার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ আশংকাজনকভাবে কম।

Wall Street Journal একটি আর্টিকেলে বলা হয়েছে:

Adults who frequently feel grateful have more energy, more optimism, more social connections and more happiness than those who do not, according to studies conducted over the past decade. They’re also less likely to be depressed, envious, greedy or alcoholics. They earn more money, sleep more soundly, exercise more regularly and have greater resistance to viral infections.

যে সব পূর্ণ বয়স্করা প্রতিনিয়ত কৃতজ্ঞতা অনুভব করেন: তাদের কর্মস্পৃহা, সাফল্যে আস্থা, সামাজিক মেলামেশা এবং সুখ অনুভূতি অন্যদের থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি হয় – প্রায় এক যুগ গবেষণার ফল থেকে এটি জানা গেছে। তাদের ডিপ্রেশন, ঈর্ষা, লোভ বা অ্যালকোহল আসক্তি হবার সম্ভাবনা কম। তারা অপেক্ষাকৃত বেশি আয় করেন, ঠিকভাবে বেশি ঘুমাতে পারেন, নিয়মিত বেশি ব্যায়াম করেন এবং তাদের ভাইরাস জনিত অসুখের প্রতি প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকে।

এবার বুঝতে পারছেন, কেন আল্লাহ تعالى আমাদেরকে প্রতিদিন ৫ ওয়াক্তে, কমপক্ষে ১৭ বার বলতে বলেছেন:

আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামিন

সমস্ত প্রশংসা এবং ধন্যবাদ আল্লাহর, যিনি সৃষ্টিজগতের প্রভু। [ফাতিহা ১:২]

green_landscape

সুত্র:

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *