এমন মানুষও আছে, যে আল্লাহকে ﷻ অনেক খুশি করার চেষ্টায় নিজেকে পুরোপুরি নিবেদিত করে দেবে — আল-বাক্বারাহ ২০৭-২০৯

ধরুন আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, আপনি কাজের পাশাপাশি সন্ধ্যায় ইউনিভারসিটি গিয়ে পার্টটাইম মাস্টার্স বা পিএইচডি করবেন। আপনার পরিবার আপনার এই সিদ্ধান্ত শুনে বড়ই খুশি হবে। বংশে একজন মাস্টার্স/পিএইচডি করা ছেলে/মেয়ে থাকবে, কী সৌভাগ্যের ব্যাপার! ক্লাসে যাওয়ার আগে আপনার জন্য নাস্তা টেবিলে রাখা থাকবে। ক্লাস করে এসে আপনি যেন শান্তিতে ঘুমোতে পারেন, সেজন্য বাচ্চাদেরকে আগেই ঘুম পাড়িয়ে রাখা হবে। মেহমানরা বেড়াতে এসে যেন আপনার পড়াশুনায় ক্ষতি না করে, সেজন্য চৌদ্দগুষ্টিতে সাবধান নোটিস চলে যাবে। কেউ যদি এসেও পড়ে, আপনি দেখা করতে না আসলে কোনো সমস্যা নেই, কারণ আপনার পরীক্ষা চলছে। আপনার পরীক্ষার সময় বাড়িতে কারফিউ পড়ে যাবে। কেউ জোরে টিভি ছাড়বে না, ফোনে গল্প করবে না, আপনাকে যথাসাধ্য সবরকম শান্তির ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। কিছুক্ষণ পর পর নাস্তা এবং চা আসতে থাকবে। একসময় আপনি গ্রাজুয়েট করবেন, আপনার স্বামী-স্ত্রী-বাবা-মা গর্ব করে সবার কাছে আপনার অর্জনের কথা বলবে।

কিন্তু ধরুন আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, কাজের পাশাপাশি আপনি একটা ইসলামিক ডিগ্রির জন্য পড়াশুনা করবেন, বা এলাকার মুসলিম ভাইবোনদের সাথে নিয়মিত ইসলামি আলোচনায় অংশ নেবেন। আপনার পরিবারের সদস্যরা এই কথা শোনার পর আপনার উপর শুরু হবে তাদের যাবতীয় দাবি এবং অভিযোগের বৃষ্টি। এমনিতেই কাজের বাইরে আপনাকে কম পাওয়া যায়, এখন কেন আরও কম পাওয়া যাবে? যেই কাজ করতে আপনি বাধ্য নন, কেন আপনি সেই কাজের পিছনে এত সময় দেবেন? এগুলো না করে শুধু নামাজ-রোজা করলে ক্ষতি কী হবে? আমরা কী মুসলিম না? এগুলো না করলে কী জান্নাতে যাওয়া যায় না? —এরকম হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যে আপনি কোনোমতে সবাইকে দিনের পর দিন ম্যানেজ করে, নিয়মিত তাদের কটু কথা শুনে হয়তো সপ্তাহে একদিন, দু’দিন করে ইসলামের জন্য পড়াশুনা করবেন, কোনো ইসলামি আলোচনা, সেচ্ছাসেবী কাজে মাসে এক-দুইবার অংশ নেবেন। কিন্তু আপনার এই কাজে সাহায্য করার জন্য কেউ টিভি দেখা কমিয়ে দেবে না, ফোনে গল্প করা বন্ধ করবে না, আপনার পড়ার সময় বাচ্চাগুলোকে অন্য ঘরে খেলতে নিয়ে যাবে না। আপনার পরীক্ষাই চলুক, কোনো জরুরি প্রোগ্রামই থাকুক, বা রংপুরে কম্বল বিতরণের দায়িত্বই থাকুক না কেন, বাসায় কোনো মুরব্বি আত্মীয় আসলে, শ্বশুর-শাশুড়ি আসলে, বাচ্চাদের পরীক্ষা চললে কেউ আপনাকে একটুও ছাড় দেবে না। আপনাকে তখন সব বাদ দিয়ে সামাজিকতা করতে হবে। বরং যখন আপনার পড়াশুনার বেশি চাপ যাবে, বা ইসলামি কাজে একটু বেশি সময় দিতে হবে, তখনি আপনার কাছের জনের মাথা বেশি গরম হয়ে যাবে, নিয়মিত ঝগড়া শুরু হবে। আত্মীয়স্বজন নিয়মিত আপনাকে ফোন করে আবার ‘সাধারণ মুসলিম’ হয়ে যাওয়ার জন্য বার বার আপনাকে বোঝাবে। কবে কোন মুসলিমকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল, জেলে নিয়ে কীভাবে পায়ের নখ তুলে নির্যাতন করেছিল, কোন ইসলামি দল কবে কোন নিরীহ মুসলিমকে ঘোল খাইয়েছিল —এই সব বলে আপনাকে নিয়মিত ভয় দেখাবে।

এইসব হাজারো ঝড়-ঝাপটা, প্রতিকূলতার মধ্যেও আপনি দাঁতে দাঁত চেপে ধৈর্য ধরে প্রতিদিন হাসিমুখে চেষ্টা করে যান। কারণ আপনার মতো মানুষদের কথাই আল্লাহ تعالى গর্ব করে কু’রআনে বলেছেন—

2_207

এমন মানুষও আছে, যে আল্লাহকে تعالى অনেক খুশি করার চেষ্টায় নিজেকে পুরোপুরি নিবেদিত করে দেবে। আল্লাহ تعالى তার বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত মমতাবান। [আল-বাক্বারাহ ২০৭]

2_207_title

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বলছেন যে, এমন মানুষ আছে, যারা يَشْرِى ইয়াশরি অর্থাৎ নিজেকে বিক্রি করে দেবে। সে নিজের সময়, মেধা, সম্পদকে বিক্রি করবে। আমরা প্রতিদিন জীবনের ১০-১২ ঘণ্টা বিক্রি করে দেই অফিসে, ব্যবসায়, পড়াশুনায়, যেন একসময় গিয়ে ব্যাংকে কিছু টাকা পেতে পারি। এভাবে আমরা প্রতিনিয়ত নিজের সত্তাকে বিক্রি করি, যেন এর বিনিময়ে কিছু না কিছু দুনিয়াতে পেতে পারি। এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এমন একজনের কথা বলছেন, যে তার নিজের সময়, সম্পদ, মেধা, এমনকি দরকার পড়লে নিজের দেহকেও বিক্রি করে দেবে আল্লাহর مَرْضَات মারদাত অর্থাৎ সন্তুষ্টি পাওয়ার আশায়। তবে শুধুই সন্তুষ্টি বা رضا পাওয়ার আশায় নয়, বরং مَرْضَات মারদা-ত, অত্যন্ত সন্তুষ্টি পাওয়ার আশায়। সে মনে প্রাণে চায় যেন আল্লাহ تعالى তার উপর অনেক খুশি হন। এর জন্য সে যে কোনো ত্যাগ করতে রাজি।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

মানুষের মাঝে এমন লোক আছে, জীবন সম্পর্কে যার দৃষ্টিভঙ্গি শুনলে তুমি মুগ্ধ হবে — আল-বাক্বারাহ ২০৪-২০৬

আগামী নির্বাচনের একজন প্রতিদ্বন্দ্বী আলহাজ্ব চৌধুরী সাহেব মসজিদে জুমুআহ’য় মাইক নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। নির্বাচনে দেওয়া কিছু প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে তিনি কথা বলবেন, “ভাই সব, আমি আপনাদের এলাকারই সন্তান। এই এলাকার আলো, মাটি, বাতাস খেয়ে আমি বড় হয়েছি। আমি এই বছর হজ্জে গিয়ে আল্লাহর কাছে অনেক কান্নাকাটি করেছি, আমাকে তিনি যেন এলাকার খেদমত করার সম্মান দেন। আপনারা যদি আমাকে সুযোগ দেন, তাহলে আমি এই এলাকার চেহারা পালটিয়ে দেবো ইন-শাআ-আল্লাহ। এলাকায় এতিমখানা হবে, মাদ্রাসা হবে, এই মসজিদের উপরে দুই তলা হবে সবার আগে। এলাকায় আমি নষ্ট সংস্কৃতি মোটেও ঢুকতে দেবো না। এলাকার ক্যাবল অপারেটরদের সব হিন্দি চ্যানেল বন্ধ করে দিতে বলবো। আমি আল্লাহর تعالى শপথ করে বলছি, আমাদের এই এলাকা দুই বছরের মধ্যে হয়ে যাবে পবিত্র মদিনা শহরের এক প্রতিচ্ছবি।” —বিপুল করতালি এবং ‘আল্লাহু আকবার’ এর মধ্য দিয়ে তার ভাষণ শেষ হয়।

2_2042_205

মানুষের মাঝে এমন লোক আছে, জীবন সম্পর্কে যার দৃষ্টিভঙ্গি শুনলে তুমি মুগ্ধ হবে। সে আল্লাহর تعالى শপথ নিয়ে বলে তার মনে কী আছে। অথচ দেখা যায় সে একজন চরম ঝগড়াটে প্রতিদ্বন্দ্বী। যখন সে কাজে ফিরে যায়, সে দ্রুত চেষ্টা করে যেন অনিষ্ট করতে পারে, যেন ধ্বংস করতে পারে শস্য ফলন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। আল্লাহ تعالى কোনো ধরনের অনিষ্ট করা পছন্দ করেন না। [আল-বাক্বারাহ ২০৪-২০৫]

নির্বাচন শেষ। চৌধুরী সাহেব জয়ী হয়েছেন। তার আলিশান ড্রয়িং রুমে তিনি তার ‘সোনার ছেলেদের’কে রাতের পার্টির আয়োজনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছেন, “রাতে ফাইভ স্টার হোটেলের সব ব্যবস্থা ঠিক আছে? মন্ত্রী সাহেব আসবেন ঠিক আটটায়। বিদেশি গায়িকারা যেন আগে থেকেই গান শুরু করে না দেয়। কাস্টমস থেকে রঙিন পানি ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছিস তো? স্যার কিন্তু বিদেশি ব্র্যান্ড ছাড়া কিছু পান করেন না। আর এলাকার ডেভেলপারদেরকে আগামীকাল ডাক। এলাকায় যত কাজ হচ্ছে, তার সবগুলোর তালিকা চাই। কে আমাকে কত দিবে, তার উপর নির্ভর করবে, কে কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। আর আমার প্রতিদ্বন্দ্বীর ড্রাইভারটা গত কালকে আমাকে দেখে সালাম দেয়নি। ওর একটা পা ভেঙ্গে দিয়ে আয়।”

2_204-205

  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

অনেকে আছে যারা শুধুই চায়, “ও রব্ব, আমাদেরকে দুনিয়াতে দিন” — আল-বাক্বারাহ ২০০-২০২

আমরা যখন হাজ্জ করতে যাই, আমাদের উদ্দেশ্য থাকে কীভাবে আমরা আল্লাহকে تعالى খুশি করতে পারি, যেন তিনি আমাদেরকে জান্নাত দেন। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, অনেকে হাজ্জে যান, কারণ তার দুনিয়াতে অনেক কিছু দরকার, এবং তিনি শুনেছেন হাজ্জে গিয়ে চাইলে নাকি সব পাওয়া যায়। যার ফলে তার হাজ্জে যাওয়াটা হয়ে যায়, মন্ত্রীর কাছে গিয়ে তদবির করার মতো একধরনের তদবির অনুষ্ঠান। হাজ্জে গিয়ে তার দু’আ হয়, “ও আল্লাহ, تعالى আমার ব্যবসাটা ভালো করে দিন, আমাকে চাকরিতে প্রমোশন দিন। আমাকে একটা বাড়ি কিনতে দিন। আমার ছেলেমেয়েকে বিদেশে পাঠাতে দিন। আমার জমিগুলোকে নিরাপদ রাখুন। আমার স্ত্রীর অত্যাচার দূর করে দিন। আমার ডায়াবেটিস ঠিক করে দিন।…” —অবশ্যই এগুলো চাওয়াটা দোষের নয়, কিন্তু আমাদেরকে বুঝতে হবে: এই মহাবিশ্বে আমাদের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য কী। কেন আমাদেরকে সৃষ্টি করে এই পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। আমরা যদি দুনিয়ার পেছনে দৌড়াতে গিয়ে এই বিরাট ব্যাপারটাকে বেশি গুরুত্ব না দেই, ভুলে যাই, হাজ্জের মতো এত বড় একটা সুযোগ পেয়েও উপলব্ধি না করি, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, কারণ আল্লাহ تعالى বলেছেন—

2_200

হাজ্জের অনুষ্ঠানগুলো শেষ করার পর, আল্লাহকে تعالى বেশি করে মনে করবে, যেভাবে তোমাদের বাপদাদাদের মনে করো। না, বরং তারচেয়ে বেশি করে! কারণ অনেকে আছে যারা শুধুই চায়, “ও রব্ব, আমাদেরকে দুনিয়াতে দিন” —এদের জন্য পরকালে বিন্দুমাত্র কোনো ভাগ থাকবে না। [আল-বাক্বারাহ ২০০]

আগেকার আমলে হাজ্জ শেষ হওয়ার পর হাজ্জিরা একসাথে বসে তাদের বাপ-দাদাদের কৃতিত্ব নিয়ে গল্প করতো —কে কবে কাকে কত খাইয়েছে, কত সাহায্য করেছে, কত জমিজমা করেছে, কত যুদ্ধ করেছে, কত বীর পদক পেয়েছে ইত্যাদি।[১২][১৪][৬] আজকের দিনে আমরা বাপ-দাদাদের নিয়ে এভাবে গর্ব করি না। আমাদের গল্পগুলো হয়ে গেছে: কার বাবা মন্ত্রী, কার দাদা জমিদার ছিলেন, কে সৈয়দ বংশের, কার চাচা হাজ্জ কাফেলার চেয়ারম্যান ইত্যাদি। হাজ্জের মতো এত মূল্যবান সময়গুলো আমরা পার করি এসব খোশ গল্প করে।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

বুদ্ধিমানেরা: আমার প্রতি সাবধান! — আল-বাক্বারাহ ১৯৬-১৯৯

সূরা আল-বাক্বারাহ’র ধারাবাহিক এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ عز وجل আমাদেরকে হাজ্জের সম্পর্কে শিক্ষা দেবেন, যেগুলো শুধু হাজ্জেই নয়, বরং প্রতিটি মুসলিমের জন্য সারাজীবনের শিক্ষা—

2_196

তোমরা হাজ্জ এবং উমরা ঠিকভাবে সম্পন্ন করো আল্লাহর উদ্দেশ্যে । কিন্তু যদি তা করতে বাঁধা পাও, তাহলে তোমাদের জন্য যা সহজ, তা কুরবানি করো। আর যতক্ষণ না কুরবানি যথাস্থানে না পৌঁছায়, ততক্ষণ পর্যন্ত মাথা কামাবে না। তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ থাকলে, বা মাথার ত্বকে কষ্ট থাকলে, সে তার বদলে রোজা রাখবে, বা দান করবে, অথবা কুরবানি করবে। তারপর যখন তোমরা নিরাপদ অবস্থায় যাবে, তখন যদি কেউ একসাথে উমরা এবং হাজ্জ করে শেষ করতে চায়, তাহলে তার জন্য সহজ এমনকিছু সে কুরবানি করবে। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে সে হাজ্জের সময় তিন দিন রোজা রাখবে, এবং বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর সাতদিন রোজা রাখবে, এভাবে মোট দশদিন হবে। —এই নিয়মগুলো তাদের জন্য, যাদের নিকটজনেরা মাসজিদুল হারামের আশেপাশে বসবাস করে না। আল্লাহর প্রতি সাবধান থাকো, আর জেনে রেখো: আল্লাহ খুবই কঠিন শাস্তি দেন। [আল-বাক্বারাহ ১৯৬]

তোমরা হাজ্জ এবং উমরা ঠিকভাবে সম্পন্ন করো আল্লাহর عز وجل উদ্দেশ্যে

এখানে আল্লাহ عز وجل বিশেষভাবে বলছেন যে, হাজ্জ এবং উমরা করো আল্লাহর عز وجل উদ্দেশ্যে। আল্লাহ عز وجل শুধুই আমাদেরকে বলতে পারতেন, ‘হাজ্জ এবং উমরা ঠিকভাবে সম্পন্ন করো’। কিন্তু তিনি যোগ করেছেন, “আল্লাহর عز وجل উদ্দেশ্যে”। প্রশ্ন আসে, আল্লাহ عز وجل ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্যে কি হাজ্জ বা উমরা হয়?

চৌধুরী সাহেব বুঝতে পারলেন, এলাকার মানুষের কাছে তার জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য এবং আগামী ইলেকশনে জেতার জন্য তার নামের আগে ‘আলহাজ্ব’ লাগানোটা জরুরি হয়ে পড়েছে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী গতবার ইলেকশনের আগে হাজ্জ করে এসে, আলহাজ্ব টাইটেল লাগিয়ে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে গেছে। মানুষ কেন জানি তার আলহাজ্ব উপাধি দেখেই তার উপর বেশি ভরসা করা শুরু করে দিয়েছে। ইলেকশনের পোস্টারগুলোতে তার নামের আগে বড় করে আলহাজ্ব লেখা থাকে, আর চৌধুরী সাহেবের নামের আগে কিছু থাকে না, ব্যাপারটা বড়ই চোখে লাগে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, জলদি হাজ্জ করে এসে নতুন করে ইলেকশনের পোস্টার ছাপাবেন। তাহলে এইবার আলহাজ্ব টাইটেলের সুবাদে তার ইলেকশনে জেতা আর কেউ ঠেকাতে পারবে না।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংসের পথে ছুঁড়ে দেবে না — আল-বাক্বারাহ ১৯৫

সূরা বাক্বারাহ’র এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আদেশ দেবেন, যা প্রতিটি মুসলিমের উচিত প্রতিদিন সকালে উঠে নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়া। দরকার হলে মোবাইল ফোনে, কম্পিউটারে ওয়ালপেপার সেট করে রাখা। এই আয়াতগুলো আমাদেরকে বিরাট সব শিক্ষা দেয়, যা মুসলিম জাতি যদি নিজেদের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে পারতো, তাহলে আজকে তাদের এত হতাশাকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না—

2_195_title

2_195

আল্লাহর تعالى পথে খরচ করো। আর নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংসের পথে ছুঁড়ে দেবে না। ভালো কাজ সুন্দরভাবে করো। যারা ভালো কাজ সুন্দরভাবে করে, নিঃসন্দেহে আল্লাহ تعالى তাদেরকে ভালবাসেন। [আল-বাক্বারাহ ১৯৫]

আল্লাহর تعالى পথে খরচ করো

আল্লাহর تعالى পথে খরচ বহুভাবে করা যায়। ইসলামের প্রচারে সাহায্য করতে খরচ করা, নিজে ইসলাম নিয়ে পড়াশুনা করতে খরচ করা, অভাবী প্রতিবেশী, আত্মীয়, এতিম, অসহায় মানুষদের জন্য খরচ করা, পরিবারের জন্য খরচ করা[৩৩৭] — এসব কিছুই আল্লাহর تعالى পথে খরচ করার অন্তর্ভুক্ত। একইসাথে দেশে ইসলামের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করে এমন সত্যিকারের ইসলামি দলকে সাহায্য করা, মানুষকে ইসলামের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন দিতে আগ্রহী করা ইত্যাদি নানা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও খরচ করা যায়। মুসলিমদেরকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করতে, অত্যাচারিত মুসলিমদের পাশে দাঁড়াতে খরচ করাও আল্লাহর تعالى পথে খরচ করার অন্তর্ভুক্ত।[১১]

এই আয়াতের আগের কয়েকটি আয়াত যুদ্ধ সম্পর্কিত। এখানে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে তাঁর تعالى পথে খরচ করতে বলছেন, কারণ যুদ্ধ করতে গেলে সম্পদের দরকার। যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জাম তৈরি করতে এবং কিনতে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন হয়। একই সাথে যুদ্ধ চলাকালীন সময়েও প্রতিদিন প্রচুর খরচ করতে হয় বাহিনীর খাবার, বাসস্থান, চিকিৎসা, অস্ত্র, যানবাহনের যোগান দিতে। যদি মুসলিমরা যুদ্ধের জন্য অর্থ খরচ না করে, তাহলে যুদ্ধ চলবে কীভাবে?  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

তাদেরকে যেখানে পাও সেখানেই হত্যা করো — আল-বাক্বারাহ ১৯০-১৯৪

“তোমরা তাদেরকে যেখানে পাও সেখানেই হত্যা করো”, “যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত লড়াই করে যাও” — কুর’আনে এরকম কিছু আয়াত রয়েছে, যা দেখলে কিছু অমুসলিমদের খুশিতে দাঁত বের হয়ে যায়। তারা এই আয়াতগুলো পড়ে ভাবে, “এই তো পেয়েছি! এইবার মুসলিমরা যাবে কই?” এই ধরনের আয়াতগুলোর আগে-পিছে কিছু না পড়েই, আয়াতগুলোকে কাটছাঁট করে ব্যাপক প্রচার করে, যেন তারা মানুষকে দেখাতে পারে যে, ইসলাম একটি অসহনীয়, আগ্রাসী, অশান্তির ধর্ম, আর তারা নিজেরা কত সাধু।

আসুন দেখি, তারা কী প্রচার করে, আর কুর’আনে আসলে কী বলা আছে—

2_190_193

১৯০ যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর পথে লড়াই করো, কিন্তু সীমা অতিক্রম করবে না। যারা সীমা অতিক্রম করে, তাদেরকে আল্লাহ কখনোই ভালোবাসেন না। ১৯১ তাদেরকে যেখানে পাও সেখানেই হত্যা করো। আর সেখান থেকে বের করে দাও, যেখান থেকে ওরা তোমাদেরকে একদিন বের করে দিয়েছিল। অন্যায় বাঁধা, নির্যাতন (ফিতনা) হত্যার চেয়েও খারাপ। তবে মসজিদুল হারাম-এর কাছে ওদের সাথে লড়াই করবে না, যদি না তারা সেখানে তোমাদের সাথে লড়াই শুরু না করে। আর যদি তারা সেখানে লড়াই করেই, তাহলে তাদেরকে হত্যা করো — অবিশ্বাসীদের এটাই উচিত প্রাপ্য। ১৯২ কিন্তু ওরা যদি বন্ধ করে, তবে অবশ্যই, আল্লাহ অনেক ক্ষমা করেন, তিনি নিরন্তর দয়ালু। ১৯৩ যতক্ষণ পর্যন্ত অন্যায় বাঁধা, নির্যাতনের (ফিতনা) অবসান না হয় এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত লড়াই করে যাও। কিন্তু ওরা যদি বন্ধ করে, তাহলে কোনো বিরোধ থাকা যাবে না, শুধু মাত্র অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে ছাড়া। [আল-বাক্বারাহ]

2_190_title

কুর’আনে যত জায়গায় আল্লাহ تعالى কিতাল (যুদ্ধ, লড়াই) এর আদেশ দিয়েছেন, তার প্রত্যেকটির পেছনে কোনো না কোনো প্রেক্ষাপট রয়েছে। এমন কোনো আয়াত পাওয়া যাবে না, যেখানে আল্লাহ تعالى মুসলিমদেরকে কোনো কারণ ছাড়াই নিজে থেকেই গিয়ে মারামারি করতে বলেছেন, মানুষকে জোর করে মুসলিম বানানোর জন্য বা নিজেদের আধিপত্য প্রসার করার জন্য। যেমন, আল-বাক্বারাহ’র এই আয়াতগুলোতে মুসলিমদের লড়াই করার নির্দেশ তখনি দেওয়া হয়েছে, যখন মানুষ তাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। যুদ্ধ, লড়াই এর ব্যাপারে কুর’আনে সবসময় শর্ত হচ্ছে: আত্মরক্ষা বা ইসলাম মেনে চলতে বাঁধা দেওয়া।[২][৪][১১]  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

ওরা তোমাকে নতুন চাঁদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে — আল-বাক্বারাহ ১৮৯

2_189_title

ওরা তোমাকে নতুন চাঁদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। বলো, “এটি মানুষের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের হিসেব রাখা এবং হাজ্জের সময় নির্ধারণ করার জন্য।” আর পেছন দিক দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলে সেটা বেশ ধার্মিকতা হয়ে গেল না। বরং আল্লাহর تعالى প্রতি সাবধান থাকাটাই হচ্ছে আসল ধার্মিকতা। তাই দরজা দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করো, আর আল্লাহর تعالى প্রতি সাবধান থেকো, যেন তোমরা সফল হতে পারো। [আল-বাক্বারাহ ১৮৯]

চাঁদ – এক অসাধারণ সৃষ্টি

আল্লাহ تعالى চাঁদকে বিশেষভাবে সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের জন্য উপযোগী করার জন্য। পৃথিবীর উপরের পৃষ্ঠটি একটি পাতলা খোলসের মতো, যা অনেকগুলো টুকরোতে ভাগ করা। এই টুকরোগুলোকে বলা হয় ‘টেক্টনিক প্লেট’। এই প্লেটগুলো ক্রমাগত নড়াচড়া করে, সম্প্রসারিত হয়, একটা প্লেট অন্য প্লেটের নীচে আটকিয়ে যায় এবং একসময় হঠাৎ করে ছুটে যায়, আর তখন ভুমিকম্প হয়।

চাঁদের আকর্ষণের কারণে পৃথিবীর উপরের স্তর ক্রমাগত টান পড়ে। এর ফলে প্লেট টেকটনিক্স হয়। পৃথিবীতে প্রাণ টিকে থাকার জন্য হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং সালফারের ক্রমাগত সরবরাহ দরকার। পৃথিবীর ভেতর থেকে এই প্রয়োজনীয় পদার্থগুলো বেরিয়ে আসে এই প্লেটগুলোর নড়াচড়ার কারণে।[৩৩১] অনেক আগে আদি প্রাণীগুলোর বেঁচে থাকার জন্য যে পুষ্টির দরকার ছিল, তা সরবরাহ করেছিল এই প্লেট টেক্টনিক্স—প্লেটগুলোর ক্রমাগত সম্প্রসারণ, নড়াচড়া এবং ভুমিকম্প।

Convection

যদি চাঁদ না থাকতো, তাহলে প্লেট টেকটনিক্স হতো না, পৃথিবীতে জটিল প্রাণ টিকে থাকতো না, কোনোদিন মানুষ আসতে পারতো না। মানুষকে পাঠানোর জন্য দরকার ছিল চাঁদকে ঠিক এখন যে আকৃতি এবং দূরত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে, ঠিক সেভাবেই রাখা।[৩২৬]

চাঁদ হচ্ছে পৃথিবীর স্ট্যাবিলাইজার। এটি পৃথিবীকে নিজের অক্ষের উপর বেশি দোলা থেকে রক্ষা করে। এর টানের কারণে পৃথিবী ঘোরার সময় লাটিমের মতো হেলে দুলে না ঘুরে একই অক্ষের উপর ঘোরে। যদি এরকম না হতো, পৃথিবীতে ঋতুগুলো ভয়ঙ্কর হতো। পৃথিবীর আবহাওয়া খুব দ্রুত চরমভাবে পরিবর্তন হতো। জটিল প্রাণ থাকতে পারতো না। মানুষ তো দূরের ব্যাপার। যেরকম কিনা মঙ্গল গ্রহে হয়েছে। মঙ্গল গ্রহের পৃথিবীর মতো চাঁদ না থাকার কারণে সেখানে আবহাওয়া চরম হয়ে গেছে।[৩২৬]

শুধু তাই না, চাঁদ পৃথিবীর ঘোরার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। চাঁদের টানে সমুদ্র পৃষ্ঠের পানির ঘর্ষণের কারণে পৃথিবীর ঘোরার গতি নিয়ন্ত্রিত থাকে। চাঁদ না থাকলে এক দিনের দৈর্ঘ্য হতো মাত্র ৬ ঘণ্টা![৩২৭]

চাঁদের কারণে যে পূর্ণ সূর্য গ্রহণ হয়, সেটা একটা বিরাট ব্যাপার। সূর্যের ব্যাস চাঁদের থেকে প্রায় ৪০০গুণ বেশি। যদি সূর্য চাঁদের থেকে প্রায় ৪০০ গুণ দূরে না থাকতো, তাহলে আকাশে সূর্য এবং চাঁদের আকৃতি প্রায় সমান হতো না এবং কোনোদিন পূর্ণ সূর্য গ্রহণ হতো না। সূর্য এবং চাঁদের আকৃতি এবং দূরত্ব এত নিখুঁত অনুপাতে আল্লাহ تعالى রেখেছেন দেখেই পূর্ণ সূর্য গ্রহণের সময় চাঁদ সূর্যকে একদম সঠিক মাপে ঢেকে ফেলে।

TotalSolarEclipse  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

জেনে শুনে মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করতে কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দিবে না —আল-বাক্বারাহ ১৮৮

আল্লাহ تعالى এর আগের আয়াতে আমাদেরকে রোজা রেখে তাকওয়া অর্জন করার কথা বলছিলেন। এখন আসবে তাকওয়া অর্জনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা: আমরা কীভাবে সম্পদ ভোগ করি। কারণ মসজিদে বসে তাকওয়া দেখানো অনেক সোজা কাজ। কিন্তু মসজিদ থেকে বের হয়ে যখন আমরা চাকরি করি, ব্যবসা করি, সরকারি প্রজেক্ট হাতাই, কর্মচারীর বেতন দেই — তখন দেখা যায় আমাদের তাকওয়া আসলে কতখানি।

2_188_title

2_188
তোমরা মিথ্যা দিয়ে একে অপরের সম্পদ ভোগ করবে না। জেনে শুনে মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করতে কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দিবে না। [আল-বাক্বারাহ ১৮৮]

মানুষের তাকওয়ার পরীক্ষা তখনি হয়, যখন সে কোনো ধর্মীয় পরিবেশ থেকে দূরে গিয়ে দুনিয়ার প্রলোভনের মুখোমুখি হয়। জায়নামাজে বসে নামাজ পড়ার সময় আমাদের সামনে কোনো প্রলোভন থাকে না। কিন্তু চোখের সামনে যখন নগদ টাকা চলে আসে, তখনি দেখা যায় আমাদের তাকওয়া আসলে কতদূর।

তোমরা মিথ্যা দিয়ে একে অপরের সম্পদ ভোগ করবে না

এই একটি বাক্য দিয়ে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে যাবতীয় ছলচাতুরি, ধোঁকাবাজি, ফাঁকিবাজি, দুই নম্বরি পদ্ধতি সব বাতিল করে দিয়েছেন। সাড়ে আটটায় বাসা থেকে বের হয়ে যখন অফিসে নয়টার বদলে সাড়ে নয়টায় গিয়ে পৌঁছাই এবং বসের সামনে পড়ে বলি, “আজকে রাস্তায় এমন জ্যামে আটকে ছিলাম, জীবনেও এত জ্যামে পড়িনি।” — তখন আমরা মিথ্যা দিয়ে অফিসের সম্পদ ভোগ করি। সেই সম্পদ হচ্ছে আমার বেতন, যা অফিস আমাকে দিচ্ছে। তেল নিয়ে যখন রশিদে বেশি করে লিখে দিতে বলি, যেন অফিস থেকে বেশি টাকা তুলতে পারি, তখন মিথ্যা দিয়ে অফিসের সম্পদ ভোগ করি। অফিসে কাজের সময় ৯-৫টা, কিন্তু এর মধ্যে যখন এক ঘণ্টা ফেইসবুক, এক ঘণ্টা ইউটিউব, লিঙ্কড ইন, টুইটার, ব্যক্তিগত ইমেইল, এক ঘণ্টা ফোনে গল্প, তিন বার চা খেতে আরও এক ঘণ্টা, লাঞ্চের সময় বিরতি থাকে আধা ঘণ্টা অথচ নামাজের নাম করে এক ঘণ্টা বিরতি নেওয়া, এরপরও কাজের ফাঁকে এক ঘণ্টা ইসলামিক আর্টিকেল পড়া —এসব করে দিন পার করি, তারপর মাস শেষে গিয়ে পুরো বেতন তুলে নিয়ে আসি, তখন আমরা মিথ্যা দিয়ে অন্যের সম্পদ ভোগ করি। আমাদেরকে যদি ৯-৫টা অফিসে বসে কী করেছি তার হিসেব দিতে বলা হয়, তাহলে দেখা যাবে ৩-৪ ঘণ্টা হবে কাজ, আর বাকি ৪-৫ ঘণ্টা থাকবে মিথ্যা আর মিথ্যা।

ব্যবসায়ে কত ভাবে মিথ্যা দিয়ে আমরা লাভ করি, তা নিয়ে বিরাট বই লেখা যাবে। ক্লায়েন্টকে কম কাজ করে দিয়ে যখন বেশি টাকা দিতে বলি, তখন মিথ্যা দিয়ে ক্লায়েন্টের সম্পদ ভোগ করি। আউটসোর্স কাজে ৪০ ঘণ্টা কাজ করে যখন ৪৫ ঘণ্টার বিল পাঠাই, তখন মিথ্যা দিয়ে অন্যের  সম্পদ ভোগ করি। দোকানে বাটখারায় কারচুপি করে যখন কাস্টমারকে কম মাল দেই, বিদেশ থেকে মেয়াদ উত্তীর্ণ মাল এনে দেশের মানুষের কাছে বিক্রি করি, অনভিজ্ঞ কাস্টমার পেয়ে দশগুণ বেশি দাম চাই — তখন আমরা মিথ্যা দিয়ে অন্যের সম্পদ ভোগ করি।

আমরা কখন মিথ্যা দিয়ে অন্যের সম্পদ ভোগ করছি তা ধরার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে নিজেকে জিগ্যেস করা: আমাকে যে টাকা দিচ্ছে, সে যা ধরে নিয়েছে আমি করবো, আমি কি ঠিক তাই করছি? সে যদি সবসময় আমার পাশে বসে আমাকে দেখত, তাহলে কি আমি ঠিক একই কাজ করতাম?

জেনে শুনে মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করতে কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দিবে না

এই একটা কাজে আমরা সবচেয়ে দক্ষ। অন্য যে কোনো জাতিকে ঘুষ কত প্রকার, কী কী, তা আমরা শেখাতে পারবো। সরকারি পর্যায়ে একদম উপর থেকে শুরু করে একদম নিচের কেরানি পর্যন্ত ঘুষ ছাড়া কাজ করে না। এমনকি হাজ্জে যাওয়ার সময় বিনা ঝামেলায় ইমিগ্রেশন পার পেতে হলে অনেক সময় পাসপোর্টের মধ্যে কয়েকটা নোট ঢুকিয়ে অফিসারকে দিতে হয়। আর পাসপোর্টের ভেরিফিকেশনের সময় পুলিশ বাসায় আসলে তাকে ঘুষ দেওয়াটা তো অনেকটা অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে।

কেউ দুই নম্বর মাল এনে ব্যবসা করছে। কয়েকদিন পর পর পুলিশ এসে ঝামেলা করছে। কোনো সমস্যা নেই, উপরের অফিসারকে ঘুষ দিয়ে দাও, আর পুলিশ আসবে না। কাস্টমস থেকে মাল ছাড়াতে মোটা অংকের কর দিতে হবে, কাস্টমস অফিসারকে ঘুষ খাওয়াও, মাল ছেড়ে দেবে। সরকারি প্রজেক্টের কন্ট্রাক্ট পাওয়া দরকার, মন্ত্রীকে ঘুষ খাওয়াও, অন্য কেউ আর পাবে না। নিজের বাড়িতে জলদি পানি, বিদ্যুতের সংযোগ নেওয়া দরকার, সরকারি অফিসে গিয়ে কেরানি থেকে শুরু করে বিভিন্ন অফিসারকে ঘুষ খাওয়াও, অন্যদের আগে আমার বাড়িতে সংযোগ চলে আসবে, যদিও কিনা অন্যরা আমার আগে দরখাস্ত করেছিল। রাস্তায় সার্জন ধরেছে পুরনো গাড়ি থেকে বিষাক্ত ধোঁয়া বের হওয়ার জন্য, সমস্যা নেই, ঘুষ দিয়ে দাও, পার পেয়ে যাবে। এভাবে আমরা চাকরি, ব্যবসা, বাড়ি, গাড়ি, জমি, পড়ালেখা সবজায়গায় অন্যকে টপকে নিজে বেশি সুবিধা পাওয়া জন্য, অন্যায়ভাবে কিছু আদায় করার জন্য নানাভাবে কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দিয়ে যাচ্ছি। এসব করে আমরা অন্যের হক মেরে দিচ্ছি। দেশের জনগণ তাদের প্রাপ্য সুবিধা, সম্পদ, সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, আর আমরা অন্যায়ভাবে ফায়দা লুটছি। এই সব কিছুই আল্লাহ تعالى এক বাক্যের মধ্যে নিষেধ করে দিয়েছেন, “জেনে শুনে মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করতে কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দিবে না।

আল্লাহ تعالى এই আয়াতে অন্যায়ভাবে বোঝাতে اِثْم ব্যবহার করেছেন। اِثْم  -কে বাংলায় ‘পাপ’, ‘অন্যায়’ অনুবাদ করা হয়। ইছম শুধু পাপই নয়, একই সাথে এটি হচ্ছে অন্তরের এমন এক অবস্থা, যা মানুষকে ভালো কাজ থেকে দূরে রাখে, খারাপ কাজ করতে উৎসাহ দেয় এবং এক সময় মানুষ আর নিজেকে পাপ থেকে দূরে রাখতে পারে না।[মুতারাদিফাতুল কুর’আন] যেমন, মদ খাওয়াকে আল্লাহ تعالى ইছম বলেছেন, কারণ মদ থেকে শুরু হয় আসক্তি, পরিবারে অশান্তি, পরিবার ভেঙে যাওয়া, সন্তানের বখাটে হয়ে নানা ধরনের অপরাধে ঝুঁকে পড়া। শুধুমাত্র ব্রিটেনেই বছরে ৬.৪ বিলিয়ন পাউন্ড নষ্ট হয় অ্যালকোহল জনিত অর্থনৈতিক ক্ষতিতে, ৭.৩ বিলিয়ন পাউন্ড অ্যালকোহল জনিত অপরাধ দমনে, ২.৭ বিলিয়ন পাউন্ড অ্যালকোহল আসক্ত মানুষদের চিকিৎসায়, এবং বছরে ১০ লক্ষের বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয় অ্যালকোহল জনিত অসুস্থতা ও অপরাধের কারণে! এক ইংল্যান্ডে অ্যালকোহলের কারণে যে পরিমাণ অর্থ নষ্ট হয়, তা দিয়ে পৃথিবীতে ১.৬ বিলিয়ন অভাবী মানুষের অভাব দূর করে দেওয়া যেত—আর কেউ কোনোদিন অভাবে না খেয়ে মারা যেত না।

কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দিয়ে অন্যের সম্পদ ভোগ করা اِثْم ইছম, কারণ এভাবে অন্যায়ভাবে ভোগ করা সম্পদ সহজে হজম হয় না। এই হারাম সম্পদ হজম করতে গেলে আরও অনেক হারাম কাজ করতে হয়। এভাবে একটার পর একটা পাপ থেকে পাপের চক্রের মধ্যে মানুষ আটকে যায়। শুধু তাই না, একবার যখন মানুষ কর্তৃপক্ষকে টাকা খাইয়ে অন্যায় সুবিধা পেয়ে যায়, তখন তার লোভ হয়ে যায়। তারপর থেকে সে বার বার চেষ্টা করে অন্যায় সুবিধা পাওয়ার।

যেমন, চৌধুরী সাহেব বিশাল পরিমাণের ঘুষ খাইয়ে একটা সরকারি প্রজেক্টের কন্ট্রাক্ট হাতালেন। এর জন্য তিনি মন্ত্রীকে গুলশানে দুইটা ফ্ল্যাট কিনে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিলেন। তারপর ব্যাংকের লোণ নিয়ে জোগাড় করা সেই বিশাল অংকের ঘুষ, সুদ সহ শোধ করতে গিয়ে, এবং মন্ত্রীকে কথা দেওয়া দুইটা ফ্ল্যাটের টাকা উঠানোর জন্য শেষ পর্যন্ত তাকে প্রজেক্টের অনেক টাকা এদিক ওদিক সরিয়ে ফেলতে হলো। দুই নম্বর সস্তা কাঁচামাল সরবরাহ করতে হলো। যোগ্য কনট্রাক্টরদের কাজ না দিয়ে অযোগ্য, সস্তা কনট্রাক্টরদের কাজ দিতে হলো। এরপর একদিন তার প্রজেক্ট ধ্বসে পড়ল। তার নামে ব্যাপক কেলেঙ্কারি হয়ে মামলা হয়ে গেলো। মামলায় উকিলের টাকা জোগাড় করতে তাকে আরও বিভিন্ন উপায়ে টাকা মারা শুরু করতে হলো। তারপর কয়েকদিন পর পর তাকে পুলিশ ধরতে আসে, আর তিনি পুলিশের উপরের তলার লোকদের ঘুষ খাইয়ে পুলিশকে হাত করে ফেলেন। প্রজেক্টে দুর্নীতির কারণে ভুক্তভুগি মানুষদের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাকে অনেক টাকা খরচ করে কিছু ‘সোনার ছেলে’ পালতে হয়। তারা মাঝে মাঝেই খুন, ধর্ষণ করে, হোটেলে থেকে … করে এসে বিরাট বিল ধরিয়ে দেয়। তারপর তাদেরকে যখন পুলিশ ধরতে আসে, তিনি পুলিশকে টাকা খাইয়ে তাদেরকে রক্ষা করেন। এত দুশ্চিন্তার মধ্যে তিনি রাতে ঘুমাতে পারেন না। দুশ্চিন্তা ভুলে থাকার জন্য তাকে নিয়মিত মদ খাওয়া ধরতে হয়। এভাবে একটার পর একটা পাপে তিনি জড়িয়ে পড়তে থাকেন। পাপের ধারাবাহিকতা তার জীবনটাকে ঘিরে ফেলে।

আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এই এক আয়াতে এমন এক অসাধারণ মূলনীতি শিখিয়ে দিয়েছেন, যা বাস্তবায়ন করলে আমাদেরকে বইয়ের পর বই আইন পড়তে হবে না। মানুষের তাকওয়াই যথেষ্ট হবে মানুষকে হারাম সম্পদ থেকে দূরে রেখে, সম্পদের সুষ্ঠু বিতরণ, সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। একই সাথে এটি এমন একটি বাজার তৈরি করবে, যেখানে গ্রাহকরা ঠকবে না। বিক্রেতা এবং গ্রাহকের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে। গ্রাহকরা নির্দ্বিধায় আরও বেশি করে পণ্য কিনবে। যার ফলে বিক্রেতারাই আরও বেশি লাভবান হবেন। সবচেয়ে বড় কথা: হারাম সম্পত্তি নিয়ে চাকুরীজীবী এবং ব্যবসায়ীরা আল্লাহর تعالى শাস্তিতে জর্জরিত হয়ে জীবন পার করবেন না। তারা সুস্বাস্থ্য, শান্তি, সম্মান নিয়ে নিজে এবং পরিবারকে নিয়ে আল্লাহর تعالى অসীম বরকতে জীবন পার করবেন। তারপর মৃত্যুর পরে গিয়ে পাবেন বিশাল পুরস্কার। সব দিকে থেকেই তারা জয়ী হবেন। শুধু দরকার এই জীবনে একটু লোভ সামলানো, নিজের বিবেককে আরও শক্ত করা এবং ‘অন্যরাও করে, তাই আমিও করি’ —এই চিন্তা করে গা ভাসিয়ে না দেওয়া।

সূত্র:

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
  • [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
  • [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
  • [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
  • [১৫] তাফসির আল জালালাইন।
  • [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ।

আমাকে যে ডাকে, আমি তার ডাকেই সাড়া দেই, যখনি সে ডাকে — আল-বাক্বারাহ ১৮৬

কু’রআনের সবচেয়ে সুন্দর আয়াতগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে সুরাহ আল-বাক্বারাহ’র ১৮৬ আয়াতটি। এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে বলবেন তিনি আমাদের কত কাছের, আমাদের কাছ থেকে তিনি কত আশা করেন যে আমরা শুধুই তাঁকেই تعالى ডাকি—

2_186_title
2_186

আমার বান্দারা যখন তোমাকে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে: অবশ্যই আমি তো সবসময় কাছেই আছি। আমাকে যে ডাকে, আমি তার ডাকেই সাড়া দেই, যখনি সে ডাকে। তাহলে তারাও যেন আমার ডাকে সাড়া দিতে চেষ্টা করে, আমার উপর বিশ্বাস রাখে, যেন তারা সঠিক পথে চলতে পারে। [আল-বাক্বারাহ ১৮৬]

এখানে আল্লাহ تعالى শুরু করছেন, “যখন আমার বান্দারা আমাকে ডাকে।” তিনি বলেননি ‘যদি’ আমার বান্দারা আমাকে ডাকে। বরং তিনি تعالى বলেছেন ‘যখন’ আমার বান্দারা আমাকে ডাকে। আল্লাহ تعالى যেন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন: কখন আমরা তাঁকে ডাকবো? তিনি تعالى তো আমাদের ডাকে সারা দেওয়ার জন্য সবসময়ই আছেন। আমরাই বরং তাঁর تعالى সাথে কথা বলছি না।[১] আমরা গিয়ে অফিসের বসের কাছে অন্যায় তদবির করছি প্রমোশনের জন্য। আত্মীয়ের কাছে গিয়ে অন্যায় সুপারিশ চাচ্ছি চাকরির জন্য। পিরের কাছে গিয়ে হাজার টাকার দক্ষিণা দিয়ে সন্তান চাচ্ছি। মন্ত্রীর কাছে গিয়ে সরকারি প্রজেক্টের কন্ট্রাক্টের জন্য দরাদরি করছি।  ডাক্তারের কাছে আর্তনাদ করছি, “ও ডাক্তার! ওকে বাঁচান! আপনি ছাড়া আর কেউ ওকে বাঁচাতে পারবে না।” —আমরা এদেরকে যেই ক্ষমতা দিচ্ছি, সেই ক্ষমতা তাদের নেই। তারপরেও তাদের কাছে আমরা কত অনুনয় বিনয় করছি। অথচ যিনি একমাত্র দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন, তাঁকেই تعالى আমরা ডাকছি না।

بَلْ إِيَّاهُ تَدْعُونَ فَيَكْشِفُ مَا تَدْعُونَ إِلَيْهِ إِن شَآءَ وَتَنسَوْنَ مَا تُشْرِكُونَ

না! বরং তোমরা শুধুমাত্র তাঁকেই ডাকো। তাহলে তিনি তোমাদেরকে সেই পরিস্থিতি থেকে বের করে আনবেন, যা তোমাদেরকে তাঁকে ডাকতে বাধ্য করেছে, যদি তিনি তা ইচ্ছা করেন। আর তখনি তোমরা ওদেরকে ভুলে যাবে, যাদেরকে তোমরা তাঁর জায়গা দিয়ে দিয়েছিলে। [আল-আনআম ৬:৪১]

অবশ্যই, আমি তো সময় কাছেই আছি

আল্লাহ تعالى সবসময় আমাদের কাছেই আছেন, কিন্তু আমরা তাঁর এবং আমাদের মধ্যে নানা ধরনের দেওয়াল তৈরি করেছি। আমরা মনে করি সরাসরি আল্লাহর تعالى কাছে চাইলে হবে না, একটা তাবিজ পড়তে হবে, গলায় সূরার ফলক ঝুলাতে হবে। ইমাম ভাড়া করে এনে তিনদিনে ভর ভর করে কু’রআন খতম দিয়ে তারপরে চাইতে হবে, এর আগে চাইলে হবে না। মাওলানার দরবারে গিয়ে আর্জি পেশ করতে হবে, শুধু নামাজে দু’আ করলে হবে না। মসজিদের ইমামকে দিয়ে বলাতে হবে, আমি নিজে বললে হবে না, কারণ আমার অনেক পাপ। —এভাবে আমরা নিজেরাই আল্লাহকে تعالى ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। আমাদের জীবনে আল্লাহ تعالى আর প্রতি মুহূর্তের সাথী নন। বরং বছরে একদিন সারা রাত নফল নামাজেই শুধুমাত্র তাঁকে কাছে মনে হয়। সপ্তাহে একদিন মসজিদে দশ মিনিটের জন্য তাঁকে আমরা কাছে মনে করি, আর বাকি দিনগুলো তাঁকে এড়িয়ে চলি।

ٱدْعُوا۟ رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً

তোমাদের প্রভুকে ডাকো বিনম্র হয়ে, একান্ত গোপনে। [আল-আ’রাফ ৭:৫৫]

এভাবে আল্লাহর تعالى সাথে আমরা নিজেরাই একধরনের কৃত্রিম সম্পর্ক তৈরি করেছি। এই কৃত্রিম সম্পর্কের কারণে আল্লাহ تعالى আর আমাদের সুখ-দুঃখের সাথী নন। বরং বড় ধরনের বিপদে পড়লেই শুধুমাত্র তাঁর কথা মনে হয়। অথচ আল্লাহ تعالى এই আয়াতে আমাদেরকে বলছেন, “অবশ্যই” তিনি সবসময় আমাদের কাছেই আছেন। তিনি কখনোই আমাদের থেকে দূরে চলে যান না। আমরা যেন বিনম্র হয়ে একান্ত গোপনে আল্লাহর تعالى কাছে চাই।

আয়াতটি কিন্তু এমন নয় যে, “আমার বান্দারা যখন তোমাকে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে, ‘তাদেরকে বলে দাও যে’, আমি সবসময়ই কাছেই আছি।” এখানে বান্দারা জিজ্ঞেস করছেন রাসুলকে عليه السلام। কিন্তু আল্লাহ تعالى রাসুলকে عليه السلام উত্তর দিতে না বলে, নিজে থেকেই তাঁর বান্দাদেরকে উত্তর দিচ্ছেন। শুধু তাই না, এই আয়াতে তিনি বার ‘আমি’ বলছেন— “আমার বান্দারা”, “আমার ব্যাপারে”, “আমি কাছেই”। কু’রআনে এটা বিরল। কু’রআনে সাধারণত আল্লাহ تعالى তাঁর সম্মান বজায় রেখে আরবিতে “আমরা” (হিন্দি বা উর্দুতে ‘হাম’) ব্যবহার করেন। এটি তাঁর সম্মান এবং দূরত্ব দুটোই নির্দেশ করে। কিন্তু এই আয়াতে তিনি তাঁর বান্দাদের নিজে থেকে উত্তর দিচ্ছেন। বিরল ‘আমি’ শব্দটি বার বার ব্যবহার করছেন, যেন আমরা উপলব্ধি করি যে, আমাদেরকে তিনি تعالى কত কাছের মনে করেন, তিনি تعالى আমাদেরকে কত ভালবাসেন, তিনি تعالى কত আশা করেন যে, আমরা যেন সরাসরি তাঁর কাছেই চাই।

আমাকে যে ডাকে আমি তার ডাকেই সাড়া দেই, যখনি সে ডাকে

অনেক সময় আমরা ভাবি: আল্লাহ تعالى কি আর আমার মতো পাপী বান্দার দু’আ শুনবেন? তিনি শুনবেন হাজি সাহেবের দু’আ, মসজিদের ইমামের দু’আ, মাওলানা, মুফতি সাহেবদের দু’আ। আমার মতো মামুলি বান্দার দু’আ তিনি কি শুনবেন? এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বলছেন, যে-ই তাঁকে ডাকে, তিনি তার ডাকেই সাড়া দেন।

এখানে তিনি বিশেষভাবে বলছেন, ٱلدَّاعِ – অর্থাৎ যে তাঁকে ডাকছে, তাকে তিনি বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছেন আদ-দাঈ অর্থাৎ আহ্বানকারী হিসেবে। তাঁর কাছে সে লক্ষ কোটি মানুষের ভিড়ে মামুলি কেউ একজন নয়। বরং সে বিশেষ একজন দাঈ। আমরা যখন আল্লাহকে تعالى ডাকি, তাঁর কাছে প্রার্থনা করি, তখন আল্লাহ تعالى লক্ষ কোটি মানুষের ভিড়েও আমাদের প্রত্যেককে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেন। আমরা প্রত্যেকে তাঁর تعالى পুরো মনোযোগ পাই। তিনি تعالى একনিষ্ঠ হয়ে আমাদের প্রত্যেকের ডাক শোনেন।

আমরা অনেক সময় মনে করি, আল্লাহ تعالى এত বড় মহাবিশ্ব চালাচ্ছেন, কত কোটি কোটি সৃষ্টি তাঁর, তাঁর কি আর আমার কথা শোনার মতো সময় আছে? এধরনের চিন্তা মানুষের নির্বুদ্ধিতা বা সীমাবদ্ধতা ছাড়া কিছু নয়। আমরা মনে করছি যে, আল্লাহর تعالى মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতার একটা সীমা আছে। তিনি প্রতিটি মানুষকে ঠিক মতো ‘খেয়াল’ করতে পারেন না, বা তাঁর মনোযোগ কম-বেশি হয়। মুখে না বললেও, আমরা অনেকেই আমাদের চিন্তা, কাজের মধ্যে দিয়ে অনেক সময় দেখিয়ে দেই যে, আল্লাহ تعالى বোধহয় আমাকে এখন খেয়াল করছেন না, বা আমার দু’আ ঠিকমতো শুনছেন না। তখন আমরা তাঁকে ‘ঠিকমতো’ শোনানোর জন্য তাবিজ পড়ি, ঘরের দেওয়ালে সুরাহ ঝুলাই, হাজি, ইমাম, মাওলানা সাহেবের কাছে গিয়ে দু’আ করতে বলি। আল্লাহর تعالى সম্পর্কে কতই না অপমানজনক ধারণা আমাদের!

এই আয়াতে আরেকটি লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার হলো, তিনি تعالى বলেননি, তিনি ‘মুসলিমদের’ ডাকে সাড়া দেন। বরং তিনি تعالى বলেছেন, যে-ই তাঁকে ডাকে, তিনি তারই ডাকে সাড়া দেন। তিনি تعالى মুসলিম, অমুসলিম সবার রাব্ব। সবাইকে তিনি تعالى ভালবাসেন, সবার যত্ন নেন, সবার প্রভু তিনি। সবার ডাকে তিনি تعالى সাড়া দেন।[১] আমরা অনেক সময় প্রশ্ন করি, আল্লাহ تعالى কেন অমুসলিমদের এত কিছু দেন? কেন তিনি অমুসলিমদের সমস্যার সমাধান করে দেন? অমুসলিমরা প্রার্থনা করে যা চায়, সেটা পেয়ে যায় কীভাবে, যদি তারা আল্লাহরই تعالى ইবাদত না করে? —এর উত্তর রয়েছে এই আয়াতে। যে-ই তাঁকে تعالى ডাকে, যখনি ডাকে, তিনি تعالى তারই ডাকে সাড়া দেন।

যখনি সে ডাকে

এখানে আল্লাহ تعالى বিশেষভাবে বলছেন, তাঁকে ডাকার জন্য কোনো উপলক্ষ দরকার নেই। তিনি تعالى মানুষের ডাকে সবসময় সাড়া দেন। শুক্রবারে জুমুআহ’য় তাঁকে تعالى ডাকলে তিনি সাড়া দেন, শনিবারে রাতে ডাকলেও তিনি সাড়া দেন। অন্যান্য ধর্মের মতো তিনি تعالى আমাদের কাছে শুধু বিশেষ কিছু মুহূর্তে উপস্থিত থাকেন না। আমাদের জন্য তাঁর দরজা সবসময় খোলা। আমরা যেন কখনোই এমনটা না ভাবি যে, আমার একটা জরুরি দরকারে আল্লাহর تعالى কাছে দু’আ করা দরকার, শবে বরাত আসুক, তখন করবো, এর আগে করলে খুব একটা লাভ হবে না। সেদিন পর্যন্ত আমরা বাঁচবো তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। একারণেই যে কোনো সময় দু’আ করতে আল্লাহ تعالى বলেছেন। তিনি تعالى আয়াতটি “যে-ই আমাকে ডাকে, তার ডাকেই আমি সাড়া দেই” বলেই শেষ করে দিতে পারতেন। তা না করে তিনি تعالى বিশেষভাবে যোগ করেছেন, “যখনি সে ডাকে”।[১]

তাহলে তারাও যেন আমার ডাকে সাড়া দিতে চেষ্টা করে

আল্লাহ تعالى আমাদের ডাকে সাড়া দেবেন কিনা, তাঁর জন্য তিনি আমাদেরকে একটা শর্ত দিয়ে দিয়েছেন: আমাদেরকে তাঁর কথা শুনতে হবে। কোটি টাকার ঘুষ খেয়ে, হারাম টাকায় হাজ্জে গিয়ে চোখের পানি নাকের পানি একাকার করে আল্লাহ تعالى কাছে চাইলে, সেটা তাঁর ডাকে সাড়া দেওয়া হলো না। দিনে পাঁচ ওয়াক্তের মধ্যে এক ওয়াক্ত নামাজ না পড়ে, শুধু শুক্রবার জুমুআহ’য় গিয়ে হাত তুললে, তাঁর ডাকে সাড়া দেওয়া হলো না। গরিব আত্মীয়স্বজনদের কোনো খবর না রেখে, এলাকার এতিমদের জন্য কিছু না করে, সারাদিন নিজের ব্যবসার জন্য দু’আ করলে, তাঁর ডাকে সাড়া দেওয়া হলো না। আমাদেরকে তাঁর تعالى ডাকে সাড়া দিতে হবে। তবেই তিনি تعالى আমাদের ডাকে সাড়া দেবেন বলে কথা দিয়েছেন। তাঁর تعالى ডাকে সাড়া দেওয়া মানে হচ্ছে তাঁর আদেশ-নিষেধ মানা, ইসলাম অনুসারে জীবন পার করা।[১২][১৪]

وَقَالَ رَبُّكُمُ ٱدْعُونِىٓ أَسْتَجِبْ لَكُمْ ۚ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِى سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ

তোমাদের প্রভু বলেন, “আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো। সাবধান! যারা তাদের অহংকারের কারণে আমাকে ডাকে না, তারা অবশ্যই জাহান্নামে অপমানিত হয়ে প্রবেশ করবে।” [গাফির ৪০:৬০]

আল-বাক্বারাহ’র আলোচ্য এই আয়াতে আল্লাহ تعالى যদি বলতেন, “তাহলে তারা যেন আমার ডাকে সাড়া দেয়” — তাহলে সর্বনাশ হয়ে যেত। আমরা তখন আর তাঁর কাছে কিছু চেয়ে পাওয়ার আশা আর করতে পারতাম না, কারণ আমরা প্রত্যেকেই আমাদের জীবনে বহুবার তাঁর কথা শুনিনি। বহুবার তাঁর অবাধ্য হয়েছি। আমাদের কথা, কাজ, চিন্তার মাধ্যমে বহুবার তাঁর অপমান করেছি। — বরং তিনি এই আয়াতে বলেছেন, فَلْيَسْتَجِيبُوا۟ لِى অর্থাৎ সাড়া দিতে ‘চেষ্টা’ যেন করে। আমরা যেন অন্তত আন্তরিক চেষ্টাটা করি তাঁর কথা শোনার। আমাদের চেষ্টাটাই যথেষ্ট তাঁর কাছে। তাহলেই তিনি تعالى আমাদের ডাকে সাড়া দেবেন।[১] আর কোনো শর্ত তিনি আমাদেরকে দেননি। তাঁর কাছে চাওয়াটা তিনি আমাদের জন্য কত সহজ করে দিয়েছেন। তারপরেও আমরা কোনো কিছু দরকার হলে তাঁর কাছে হাত তুলে দু’আ করি না, বরং অন্য কারো বা কিছুর কাছে ধর্না দেই।

আমার উপর বিশ্বাস রাখে

এই অংশটুকু গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ تعالى বলছেন, যদি আমরা তাঁর تعالى সাড়া পাওয়ার আশা রাখি, তাহলে আমরা যেন তাঁর প্রতি বিশ্বাস রাখি যে, তিনি অবশ্যই আমাদের জন্য যা ভালো, সেটাই তিনি আমদেরকে দেবেন। অনেকেই কয়েকদিন দু’আ করে হতাশ হয়ে অভিযোগ করেন, “আল্লাহর تعالى কাছে কতই তো চাইলাম। কই? কিছুই তো পেলাম না?” অনেকে চাকরির জন্য কয়েক বছর দু’আ করে হতাশ হয়ে দু’আ করা ছেড়ে দেন। অনেকে বিয়ের জন্য সুযোগ্য পাত্র-পাত্রীর জন্য দু’আ করতে করতে হতাশ হয়ে যান। অনেকে ব্যবসা ভালো হওয়ার জন্য দু’আ করে ফল না পেয়ে আশা ছেড়ে দেন। —এগুলো হচ্ছে ঈমানের পরীক্ষা। যেদিন আমরা আল্লাহর تعالى কাছে দু’আ করে আশা ছেড়ে দেই, অভিযোগ করি, সেই দিন আমরা ঈমানের পরীক্ষায় হেরে যাই। আমাদের আল্লাহর تعالى উপর আসলে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল না যে, তিনি সত্যিই আমাদেরকে দেবেন, বা আমার জন্য যেটা সবচেয়ে ভালো, সেটাই তিনি تعالى দেবেন। সত্যিই যদি বিশ্বাস থাকতো, তাহলে আমরা কোনোদিন অভিযোগ করতাম না। আমাদের অভিযোগই আমাদের ঈমানের শূন্যতা প্রকাশ করে দেয়।

অনেক সময় আমরা ঠিক যা চাই, সেটাই না পেলে মনে করি যে, আল্লাহ تعالى আমাদের দু’আ শুনছেন না। আল্লাহ تعالى তিনভাবে আমাদের দু’আর উত্তর দেন[১২][১৪]

  • ১) আমরা যা চাই ঠিক সেটা দুনিয়াতে দিয়ে।
  • ২) আমরা যা চাই সেটাতে আমাদের কল্যাণ না থাকলে, তার থেকে ভালো কিছু দিয়ে।
  • ৩) দুনিয়াতে না দিয়ে আখিরাতে প্রতিদান দিয়ে, সেটা সমপরিমাণ গুনাহ মাফ করে দিয়ে হলেও।

সুতরাং আমরা যখন কোনো কিছু চেয়েও পাই না, আমাদের এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ تعالى ঠিকই শুনেছেন আমাদের চাওয়া। কিন্তু তিনি অন্য কিছু দিয়ে আমাদের চাওয়ার উত্তর দিয়েছেন। সেটা হয়তো দুনিয়ার জীবনেই দিয়েছেন, যা আমি ভালো করে ভেবে দেখিনি দেখে এখনো উপলব্ধি করিনি। অথবা তিনি এর প্রতিদান আমাকে আখিরাতে দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি যা চেয়েছি, তার বিনিময়ে আমি কিছু না কিছু পাবোই, যদি তিনি ইচ্ছা করেন।

যেমন, কেউ একজন অনেক দু’আ করছে: তার যেন চাকরিতে প্রমোশন হয়। এর জন্য সে সবরকম চেষ্টাও করেছে। ঠিকমতো নামাজ, রোজা, যাকাত আদায় করেছে। চেষ্টা করেছে কু’রআন অনুসারে নিজের জীবন চালানোর। একইসাথে চাকরিতে যথাসাধ্য নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছে, যেন তার পারফরমেন্স নিয়ে কোনো অভিযোগ না থাকে। কিন্তু তারপরেও তার প্রমোশন না হয়ে, তার এক শত্রু কলিগের প্রমোশন হলো। তার উপর দেখা গেল তার স্ত্রী গর্ভবতী হয়ে গেলেন। এত বড় বাড়তি খরচ কীভাবে চালাবেন, সেই দুশ্চিন্তায় তার রাতে ঘুম হয় না।

এই ধরনের পরিস্থিতে পড়ে অনেকেই আল্লাহর تعالى উপর আশা হারিয়ে ফেলেন। তখন তারা ভেবে দেখেন না যে, সেই প্রমোশনটা হলে তাকে প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত অফিসের পেছনে ছুটতে হতো। অতিরিক্ত দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে প্রায়ই নামাজ ছুটে যেত। পরিবারের সাথে সময় দিতে পারতেন না। তার ছেলে মেয়েগুলো উচ্ছন্নে যেত। উপরের পদে নানা ধরনের অন্যায় সিদ্ধান্ত নিতে হতো। যার কারণে তার আয় হারাম হয়ে যেত। বিশাল পরিমাণের হারাম সম্পত্তি নিয়ে চাকুরী জীবন শেষ করতে হতো।

এই সব ক্ষতি থেকে আল্লাহ تعالى তাকে বাঁচালেন তার দু’আর উত্তরে চাকরিতে প্রমোশন না দিয়ে। দেখা গেল তার সন্তানদের সে বছর কোনো অসুখই হলো না। তার স্ত্রীর ডেলিভারিতে কোনো বাড়তি খরচ হলো না। বাড়ির দেওয়ালের আস্তর খসে পড়ে মেরামতে হাজার হাজার টাকার খরচ করতে হলো না। শুধু তাই না, তার যেই সন্তানটি হলো, সেই সন্তান বড় হয়ে বিপুল হালাল সম্পত্তির মালিক হয়ে বাবা-মাকে নিয়ে সুখে শান্তিতে বাস করতে লাগল। সেই সন্তানকে নিয়ে বাবা-মার সে কী গর্ব! এই সব কিছু সে পেল তার দু’আর উত্তর হিসেবে। সে আসলে যা চেয়েছিল: জীবনে সচ্ছলতা, সম্মান, শান্তি —সেই আসল চাওয়া আল্লাহ تعالى তাকে ঠিকই দিলেন, কিন্তু অন্যভাবে। এমন ভাবে দিলেন, যেটা তার জন্য সবচেয়ে ভালো হলো। চাকরিতে প্রমোশন তাকে এগুলো এনে দিত না।

কিন্তু আফসোস, চাকরিতে প্রমোশনের দু’আ কবুল না হওয়ায় সে এসবের কিছুই বুঝলো না, বোঝার চেষ্টাও করলো না।

যেন তারা সঠিক পথে চলতে পারে

এই হচ্ছে আসল পাওয়া। আল্লাহর تعالى কাছে আমাদের যত চাওয়া আছে, তার সবচেয়ে বড় পাওয়া হচ্ছে সঠিক পথে চলতে পারা। কারণ সঠিক পথের গন্তব্য হচ্ছে জান্নাত। যারা দুনিয়াতে সঠিক পথ খুঁজে পেয়েছে, তারা আল্লাহর تعالى অনুগ্রহে শেষ পর্যন্ত জান্নাতে গিয়ে পৌঁছুবে। জান্নাতে গিয়ে পৌঁছুলে সারাজীবনের যত চাওয়া, পাওয়া, ইচ্ছে ছিল, সব সেখানে মনে করা মাত্র এসে হাজির হবে। আর সবচেয়ে বড় পাওয়া হবে যে, সেখানে গিয়ে আমরা আল্লাহকে تعالى দেখতে পাবো। সারাজীবন যাকে না দেখে ডেকেছি, তাঁকে নিজের চোখে দেখতে পাবো। এরচেয়ে বড় পাওয়া আর কিছু হতে পারে না।

সুত্র:

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
  • [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
  • [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
  • [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
  • [১৫] তাফসির আল জালালাইন।

যাতে করে তোমরা আল্লাহর প্রতি সচেতন হও —আল-বাক্বারাহ ১৮৩-১৮৫,১৮৭

সূরা আল-বাক্বারাহ’র নিচের কয়েকটি আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে সিয়াম অর্থাৎ রোজা রাখার নির্দেশ দেবেন এবং কেন আমরা রোজা রাখি, রোজা রেখে কী লাভ, তা শেখাবেন।

2_183_title

2_183তোমরা যারা বিশ্বাস করেছ, শোনো, তোমাদের উপর রোজা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যে রকম তোমাদের পূর্বপুরুষদের উপর করা হয়েছিল। যাতে করে তোমরা আল্লাহর প্রতি সচেতন হও। [আল-বাক্বারাহ ১৮৩]

এখানে আল্লাহ تعالى বলছেন যে, রোজা রাখার উদ্দেশ্য না খেয়ে থাকা নয়, বরং রোজা রাখার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি সচেতনতা বাড়ানো। প্রথমে বোঝা দরকার তাকওয়া কী।

তাকওয়া শব্দটির অর্থ সাধারণত করা হয়—আল্লাহকে ভয় করা। এটি পুরোপুরি সঠিক অনুবাদ নয়, কারণ ‘ভয়’ এর জন্য আরবিতে ভিন্ন শব্দ রয়েছে—যেমন খাওফ خوف, খাশিয়া خشي, হিযর حذر; শুধু কু’রআনেই ১২টি আলাদা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন গভীরতার ভয়, সতর্কতা, আতঙ্ক ইত্যাদি তুলে ধরার জন্য। এর মধ্যে ‘তাক্বওয়া’ হচ্ছে ‘সবসময় পূর্ণ সচেতন’ থাকা বা আল্লাহর কথা মনে রেখে নিজেকে অন্যায় থেকে দূরে রাখা।[১][২]

ধরুন, আপনি প্রতিদিন কী করেন, সেটা নিয়ে একটা ‘রিয়েলিটি টিভি শো’ বানানো হচ্ছে। আপনার বাসার সবগুলো রুমে ক্যামেরা বসানো হয়েছে। আপনি ঘুম থেকে ওঠার পর ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত সবসময় আপনার সাথে একজন ক্যামেরাম্যান আপনার দিকে ক্যামেরা তাক করে রেখেছে। আপনি কী বলছেন, কী করছেন, কী খাচ্ছেন, কী দেখছেন, সবকিছু প্রতি মুহূর্তে রেকর্ড করা হচ্ছে। কল্পনা করুন, যদি এরকম কোনো ঘটনা ঘটে তাহলে আপনার মানসিক অবস্থা কী হবে? আপনি প্রতিটা কথা বলার আগে চিন্তা করবেন যে, আপনার কথাগুলো মার্জিত হচ্ছে কি না, আপনার হাঁটার ধরন ঠিক আছে কি না, আপনি উল্টোপাল্টা দিকে তাকালে সেটা আবার রেকর্ড হয়ে গেলো কি না। আপনি টিভিতে যেসব হিন্দি সিরিয়াল, বিজ্ঞাপন, মুভি দেখেন, যেসব গান শুনেন, ইন্টারনেটে যে সব সাইট ঘুরে বেড়ান, সেগুলো ক্যামেরায় রেকর্ড হয়ে গেলে লোকজনের কাছে মান-সন্মান থাকবে কি না। এই যে ক্যামেরাম্যানের প্রতি আপনার চরম সচেতনতা, এটাই তাক্বওয়া। আল্লাহর تعالى প্রতি আপনার ঠিক একই ধরনের সচেতনতা থাকার কথা।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)