সূরা আল-বাক্বারাহ’র ধারাবাহিক এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ عز وجل আমাদেরকে হাজ্জের সম্পর্কে শিক্ষা দেবেন, যেগুলো শুধু হাজ্জেই নয়, বরং প্রতিটি মুসলিমের জন্য সারাজীবনের শিক্ষা—
তোমরা হাজ্জ এবং উমরা ঠিকভাবে সম্পন্ন করো আল্লাহর উদ্দেশ্যে । কিন্তু যদি তা করতে বাঁধা পাও, তাহলে তোমাদের জন্য যা সহজ, তা কুরবানি করো। আর যতক্ষণ না কুরবানি যথাস্থানে না পৌঁছায়, ততক্ষণ পর্যন্ত মাথা কামাবে না। তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ থাকলে, বা মাথার ত্বকে কষ্ট থাকলে, সে তার বদলে রোজা রাখবে, বা দান করবে, অথবা কুরবানি করবে। তারপর যখন তোমরা নিরাপদ অবস্থায় যাবে, তখন যদি কেউ একসাথে উমরা এবং হাজ্জ করে শেষ করতে চায়, তাহলে তার জন্য সহজ এমনকিছু সে কুরবানি করবে। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে সে হাজ্জের সময় তিন দিন রোজা রাখবে, এবং বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর সাতদিন রোজা রাখবে, এভাবে মোট দশদিন হবে। —এই নিয়মগুলো তাদের জন্য, যাদের নিকটজনেরা মাসজিদুল হারামের আশেপাশে বসবাস করে না। আল্লাহর প্রতি সাবধান থাকো, আর জেনে রেখো: আল্লাহ খুবই কঠিন শাস্তি দেন। [আল-বাক্বারাহ ১৯৬]
তোমরা হাজ্জ এবং উমরা ঠিকভাবে সম্পন্ন করো আল্লাহর عز وجل উদ্দেশ্যে
এখানে আল্লাহ عز وجل বিশেষভাবে বলছেন যে, হাজ্জ এবং উমরা করো আল্লাহর عز وجل উদ্দেশ্যে। আল্লাহ عز وجل শুধুই আমাদেরকে বলতে পারতেন, ‘হাজ্জ এবং উমরা ঠিকভাবে সম্পন্ন করো’। কিন্তু তিনি যোগ করেছেন, “আল্লাহর عز وجل উদ্দেশ্যে”। প্রশ্ন আসে, আল্লাহ عز وجل ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্যে কি হাজ্জ বা উমরা হয়?
চৌধুরী সাহেব বুঝতে পারলেন, এলাকার মানুষের কাছে তার জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য এবং আগামী ইলেকশনে জেতার জন্য তার নামের আগে ‘আলহাজ্ব’ লাগানোটা জরুরি হয়ে পড়েছে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী গতবার ইলেকশনের আগে হাজ্জ করে এসে, আলহাজ্ব টাইটেল লাগিয়ে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে গেছে। মানুষ কেন জানি তার আলহাজ্ব উপাধি দেখেই তার উপর বেশি ভরসা করা শুরু করে দিয়েছে। ইলেকশনের পোস্টারগুলোতে তার নামের আগে বড় করে আলহাজ্ব লেখা থাকে, আর চৌধুরী সাহেবের নামের আগে কিছু থাকে না, ব্যাপারটা বড়ই চোখে লাগে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, জলদি হাজ্জ করে এসে নতুন করে ইলেকশনের পোস্টার ছাপাবেন। তাহলে এইবার আলহাজ্ব টাইটেলের সুবাদে তার ইলেকশনে জেতা আর কেউ ঠেকাতে পারবে না।
উমরা বাধ্যতামূলক কিনা এই নিয়ে মতভেদ রয়েছে। এক পক্ষের মত হলো: যেহেতু আল্লাহ عز وجل বলেছেন হাজ্জ এবং উমরা ঠিকভাবে সম্পন্ন করতে, তিনি বলেননি, শুধু হাজ্জ ঠিকভাবে সম্পন্ন করতে, তাই উমরা হবে হাজ্জের মতোই বাধ্যতামূলক। অপরপক্ষের মতো হলো, এখানে বলা হয়েছে শেষ করতে, শুরু করতে নয়। অর্থাৎ কেউ যদি ইহরাম বেঁধে ফেলে হাজ্জ বা উমরাহ’র নিয়তে, তাহলে তাকে তা ঠিকভাবে শেষ করতে হবে। উমরা যে বাধ্যতামূলক নয়, এই নিয়ে হাদিসগ্রন্থগুলোতে সমর্থন বেশি বলে তাফসীরবিদরা দাবি করেন।[১৪][১২][৪]
কিন্তু যদি তা করতে বাঁধা পাও, তাহলে তোমাদের জন্য যা সহজ, তা কুরবানি করো
হাজ্জ করতে নানা বাঁধা আসতে পারে। শত্রুপক্ষের আক্রমণ, দেশের কাফির সরকারের দুর্নীতি, যাত্রাপথে ডাকাতি —এরকম নানা ধরনের কঠিন বাঁধা আসতে পারে, যখন হাজ্জ শেষ করতে পারাটা কারো জন্য সম্ভব নাও হতে পারে, এমনকি জীবনের উপর ঝুঁকি হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আল্লাহ عز وجل আমাদেরকে একটি সহজ পথ দেখিয়ে দিয়েছেন: কুরবানি করে ইহরাম শেষ করা। এবং তিনি عز وجل এও বলে দিয়েছেন, হাজ্জ শেষ করতে পারিনি দেখে মনের দুঃখে আমরা যেন আবার হাজ্জের সব জমানো টাকা খরচ করে কুরবানি করে ভাসিয়ে না ফেলি। সহজে পাওয়া যায় এমন কুরবানির পশু কুরবানি দিলেই হবে। কোনো জোর-জবরদস্তি নেই, কোনো বাড়াবাড়ির সুযোগ নেই। উট দিলে সবচেয়ে ভালো, না হলে একটা গরু, সেটাও সম্ভব না হলে একটা ভেড়া।[১৪] এমনকি এক দলের পক্ষ থেকে একটি মাত্র কুরবানি করলেও হবে।[১১] আল্লাহ عز وجل আমাদের জন্য ইসলামকে অনেক সহজ করে দিয়েছেন, কিন্তু মানুষই ধর্মকে বাড়াবাড়ি করে কঠিন করে ফেলে।
আর যতক্ষণ না কুরবানি যথাস্থানে না পৌঁছায়, ততক্ষণ পর্যন্ত মাথা কামাবে না
কুরবানি শেষ হলে, মাথা কামিয়ে ইহরাম শেষ করতে হবে। যথাস্থান বলতে এমন জায়গা বোঝানো হয়েছে, যেখানে কুরবানি করা বৈধ, বা যেই জায়গায় কেউ বাধার সম্মুখীন হয়েছে এবং তার পক্ষে আর এগোনো সম্ভব নয়।[১৪] তবে মহিলাদের বেলায় অবশ্যই মাথা কামাতে হবে না। কারো মতে তিন আঙ্গুল পরিমাণ, কারো মতে এক তৃতীয়াংশ বা চতুর্থাংশ চুল, কারো মতে মাথার চারিপাশেই যতটুকু কাটা সঙ্গত, ততটুকু কাটতে হবে।[১৪]
কেউ যদি কোনোভাবেই নিজে কুরবানির পশু জবাই করতে না পারে, তাহলে সে তার দলের মানুষদের সাথে টাকা পাঠিয়ে দিতে পারে, এবং একটা দিন ঠিক করে নিতে পারে, যেদিন কুরবানি হবে, যেদিন সে মাথা কামিয়ে ইহরাম শেষ করতে পারবে।[১২]
তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ থাকলে, বা মাথার ত্বকে কষ্ট থাকলে, সে তার বদলে রোজা রাখবে, বা দান করবে, অথবা কুরবানি করবে
কেউ যদি বাঁধা না পায়, কিন্তু অসুস্থ হয়ে যায়, বা মাথার ত্বকে কোনো ক্ষত বা অসুখ থাকে, যার কারণে সে মাথা কামাতে পারছে না, তাহলে সে মাথা কামানোর বদলে একটা ভেড়া কুরবানি দেবে।[১৪]
তারপর যখন তোমরা নিরাপদ অবস্থায় যাবে, তখন যদি কেউ একসাথে উমরা এবং হাজ্জ করে শেষ করতে চায়…
বাঁধা দূর হয়ে গেলে, বা অসুস্থতা আর না থাকলে, কেউ যদি একসাথে উমরা এবং হাজ্জ করতে চায়, তাহলে সে উমরা এবং হাজ্জের অংশ হিসেবে অবশ্যই কুরবানি দেবে। কুরবানি দেওয়াটা যে শুধু অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বদলা হিসেবে করতে হয়, তা নয়, বরং যারা কোনো সমস্যা ছাড়াই স্বাভাবিকভাবে উমরা এবং হাজ্জ করতে পারেন, তাদের জন্যও বাধ্যতামূলক।
যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে সে হাজ্জের সময় তিন দিন রোজা রাখবে, এবং বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর সাতদিন রোজা রাখবে, এভাবে মোট দশদিন হবে
যদি কারো পক্ষে কুরবানি করা সম্ভব না হয়, তাহলে সে আরাফার দিন সহ তিনদিন রোজা রাখবে। আরেক মত হলো: ইহরাম বাঁধার পর থেকে আরাফার দিন পর্যন্ত যেকোনো তিনদিন রোজা রাখা যাবে। আরেক মত হলো: মাক্কা’য় থাকাকালীন যে কোনো তিন দিন রোজা রাখা যাবে।[১৪]
তারপর কেউ যখন তার বাড়ি ফিরে যাবে, তখন সে বাকি সাত রোজা রাখবে। আরেক মত হলো ইহরাম শেষ হওয়ার পরই বাকি সাত রোজা রাখা যাবে, বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগেই।[১৪]
আল্লাহর প্রতি সাবধান থাকো, আর জেনে রেখো: আল্লাহ عز وجل খুবই কঠিন শাস্তি দেন
হাজ্জের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহকে عز وجل খুশি করা। অন্য কোনো উদ্দেশ্য যেন আমাদের মধ্যে চলে না আসে। আলহাজ্ব টাইটেল পাওয়া, বিয়ের পূর্বশর্ত হিসেবে হাজ্জ করা, স্বামী বা স্ত্রী সাথে করে ধরে নিয়ে এসেছে, তাই হাজ্জ করছি —এসব যেন উদ্দেশ্য হয়ে না যায়। হাজ্জ হবে একমাত্র আল্লাহর عز وجل জন্য। সবসময় আল্লাহর عز وجل প্রতি সাবধান থেকে। আল্লাহর عز وجل প্রতি সাবধান থাকাটা কত জরুরি তা এরপরের আয়াতেই আল্লাহ عز وجل আমাদের আবারো সাবধান করে দেবেন।
উমরাহ এবং হাজ্জের নিয়মগুলো আমাদেরকে ভালো করে শিখতে হবে। আমরা যেন খামখেয়ালি করে আনুষ্ঠানিক ইবাদতগুলোতে ফাঁকি না দেই, নিজের সুবিধামত ভাবে না করি। একইসাথে মনে রাখতে হবে, উমরাহ এবং হাজ্জ করার সময় আমরা যেন কোনো নিয়ম না ভাঙ্গি, আইন শুঙ্খলা নষ্ট না করি, অন্যের সমস্যা না করি। হাজ্জের সময় অন্যায় করাটা অনেক বড় অপরাধ। এজন্য আল্লাহ عز وجل ভীষণ কঠিন শাস্তি দেবেন বলেছেন।[৪]
হাজ্জ নির্দিষ্ট কিছু মাসে করা যাবে। সুতরাং এই মাসগুলোতে যে তা করবে, হাজ্জে কোনো ধরনের অশ্লীলতা, নিষিদ্ধ কাজ, বা কারো সাথে ঝগড়া হতে পারবে না। আর তোমরা ভালো কাজ যা-ই করো না কেন, তার সবই আল্লাহ জানেন। হাজ্জের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্থান সাথে নিয়ে নাও, আর সবচেয়ে ভালো সংস্থান হচ্ছে তাকওয়া। বুদ্ধিমানেরা: আমার প্রতি সাবধান! [আল-বাক্বারাহ ১৯৭]
হাজ্জ নির্দিষ্ট কিছু মাসে করা যাবে
উমরা বছরের যে কোনো সময় করা যায়, কিন্তু হাজ্জের মাসগুলো নির্দিষ্ট। হাজ্জের দিনগুলো কোনগুলো, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। একপক্ষের মত হচ্ছে: শাওয়াল, যুল-ক্বাদা, যুল-হিজ্জাহ এই তিন মাসগুলোর পুরোটাই হাজ্জের মাস। আরেক পক্ষের মত হচ্ছে: শাওয়াল, যুল-ক্বাদা পুরো মাস এবং যুল-হিজ্জাহ’র প্রথম দশ দিন।[১২][১৪]
কোনো ধরনের অশ্লীলতা, নিষিদ্ধ কাজ, বা কারো সাথে ঝগড়া হতে পারবে না
হাজ্জে কোনো ধরনের رَفَث অর্থাৎ অশ্লীলতা, নিজের কামনাকে পূরণ করার জন্য অশ্লীল কাজ, নারী পুরুষের মধ্যে অশ্লীল কথা, প্রেমের কথা, স্ত্রীদের সাথে মিলন — এই সবকিছু নিষিদ্ধ।[৫][১৪][১২] হাজ্জের সময় বিপুল সংখ্যক নারী-পুরুষ এক জায়গায় হয়, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে তাওয়াফ করতে হয়, জামারাতে ঢিল ছুড়তে হয়। অনেকের কাছেই হাজ্জ করতে গিয়ে এই ব্যাপারটা দেখে একটা ধাক্কা লাগে। এইরকম পরিস্থিতিতে পড়ে অনেকের মনেই কামনা জাগতে পারে, অশ্লীল কাজের দিকে মনোযোগ চলে যেতে পারে। আজকাল শোনা যায়, অনেক দুষ্ট লোক এই সুযোগে অল্প বয়স্কা নারীদের গায়ে পড়ে অশ্লীল কাজ করে। সেরকম যেন না হয়, সে জন্য আল্লাহ عز وجل এই আয়াতে প্রথমেই এই ব্যাপারটা কঠিন ভাষায় নিষেধ করে দিয়েছেন।
আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, হাজ্জে যারা যায়, তারা সবাই অতি ভদ্রলোক এবং উচ্চমার্গের ঈমানদার নন। অনেক বদ লোকেরাও হাজ্জে যায়, যারা হাজ্জের আগে এবং পরে জঘন্য সব অশ্লীল কাজে ডুবে থাকে। হাজ্জে যাওয়া নারীরাও সবাই সতীসাধ্বী নন। সুতরাং হাজ্জ করার সময় নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। একইসাথে যারা স্বামী বা স্ত্রীকে ছেড়ে বহুদিন দূরে থেকে হাজ্জ করছেন, তারা নিজেদের ব্যপারে সাবধান থাকবেন। শয়তান এই সময়টায় অনৈতিক কাজ করানোর সুযোগ ছেড়ে দেবে না।
এরপর আল্লাহ عز وجل বলেছেন, কোনো ধরনের فُسُوق হতে পারবে না। আরবি ফাসিক অর্থ: যে অবাধ্য, ইচ্ছা করে পাপ করে।[৫] যারা সীমালঙ্ঘন করে তাদেরকে ফাসিক বলা হয়। কু’রআন মানুষকে কিছু সীমা দিয়ে দিয়েছে, যেগুলো আমাদের অতিক্রম করার কথা না। আমরা যখনি সেগুলো অতিক্রম করব, তখনি আমরা ভুল পথে যাব, ফাসিক হয়ে যাব।[৪]
যারা কাফির তারা ফাসিকের অন্তর্ভুক্ত, কারণ তারা আল্লাহর عز وجل দেওয়া সীমালঙ্ঘন করেছে। একজন মুসলিম ফাসিক হয়ে যাবে, যদি সে স্বভাবগত পাপী হয়। একজন মুসলিম যখন কোনো বড় কাবিরা গুনাহ করে এবং তার জন্য তাওবাহ করে না, অথবা একজন মুসলিম যখন কোনো ছোট গুনাহ করতেই থাকে এবং সেটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়, তাদেরকে ফুকাহাদের (ইসলামিক আইনবিদ) ভাষায় ফাসিক বলা হয়। আর যে প্রকাশ্য গুনাহ করে এবং সেটা নিয়ে তার মধ্যে কোনো অনুতাপ থাকে না, তাকে ফাজির বলা হয়।[৪]
এরপর আল্লাহ عز وجل বলছেন, কোনো ধরনের جِدَال হতে পারবেন না। জিদাল অর্থ তর্কাতর্কি, ঝগড়া-বিবাদ করা। হাজ্জে গিয়ে আমি ঠিক, তুমি ভুল, ওরা সব বিদআতি, আমরা সব সাহিহ, আজকে হাজ্জ হবে না, কালকে হবে, তোমার আক্বিদা ভুল, আমার আক্বিদা সাহিহ —এইসব তর্কাতর্কি করে ঝগড়া বাধিয়ে দেওয়াটা পুরোপুরি নিষিদ্ধ। হাজ্জ হচ্ছে মুসলিম উম্মাহ’র ঐক্য। ঐক্য করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করার মতো বড় ভুল আর হতে পারে না। একইসাথে হাজ্জের ব্যবস্থাপনা নিয়ে তর্ক করা, হাজ্জ অপারেটরের লোকজনদের সাথে কলে পানি নেই কেন, তরকারিতে ঝাল বেশি কেন, মিনার তাবুতে এয়ারকন্ডিশন কাজ করে না কেন —এইসব নিয়েও ঝগড়া করা যাবে না।
হাজ্জের সময়টা মুসলিমদের মধ্যে আলোচনা, জ্ঞান বিনিময় করার একটা বিরাট সুযোগ। এই সময় অনেকেই আক্বিদা, বিদআত, ফিকহ, কোন মাযহাব ঠিক —এই সব ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মাথা গরম করে ফেলতে পারেন। লক্ষ্য রাখতে হবে, সেটা যেন ঝগড়ার পর্যায়ে না যায়।[১৪]
একটি লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার হলো, হাজ্জের সময় শিয়া, সুন্নি, কাদিয়ানি, আহলে কু’রআন, আহলে হাদিস —সবাই একসাথে হয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজ পড়েন। মিনায় একই তাঁবুর নীচে গাদাগাদি করে ঘুমান। রাস্তায় লাইন ধরে মসজিদে ঢোকেন, জামারাতে ধাক্কাধাক্কি করে পাথর ছুড়তে যান। যেই শিয়া, সুন্নি, কাদিয়ানীরা হাজ্জের বাইরে একজন আরেকজন দুই চোখে দেখতে পারেন না, পারলে খুনাখুনি করে ফেলেন, তারাই হাজ্জের সময় গিয়ে একে অন্যের ভাই হয়ে যান। ঐক্যের এত সুন্দর নিদর্শন আর কিছু হতে পারে না। হাজ্জ আমাদেরকে দেখিয়ে দেয় যে, আমরা সবাই কোনো এক বড় উদ্দেশ্যে ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ঠিকই এক হতে পারি। হাজ্জের বাইরে আমরা যদি এই ঐক্য ধরে রাখতে পারতাম, তাহলে আজকে মুসলিম জাতি কত উপরে উঠতে পারত!
হাজ্জের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্থান সাথে নিয়ে নাও
আগেকার যুগে অনেকে সময় মানুষ কোনোমতে মাক্কায় যাওয়ার মতো অর্থ নিয়ে হাজ্জ করতে চলে যেত। তারপর মাক্কায় গিয়ে মানুষের কাছে হাত পাততো থাকা-খাওয়ার জন্য। এভাবে তারা নিজেদের এবং অন্যদের জন্য সমস্যা তৈরি করতো। আল্লাহ عز وجل বলে দিচ্ছেন, হাজ্জ করতে গেলে, আমরা যেন থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নিয়ে যাই।
আর সবচেয়ে ভালো সংস্থান/পাথেয় হচ্ছে তাকওয়া
আল্লাহ عز وجل বলছেন, فَإِنَّ خَيْرَ ٱلزَّادِ ٱلتَّقْوَىٰ — সবচেয়ে ভালো সংস্থান হচ্ছে তাকওয়া। এর মানে এই নয় যে, আমরা কোনো টাকা-পয়সা ছাড়াই শুধু তাকওয়া নিয়ে হাজ্জ করতে চলে যাবো। অনেকে কোনোমতে মাক্কা পর্যন্ত পৌঁছানোর সামর্থ্য নিয়েই হাজ্জে চলে যান, এই ভরসায় যে, আল্লাহ عز وجل অবশ্যই কোনো না কোনো ব্যবস্থা করে দেবেন। আল্লাহর عز وجل উপর অবশ্যই আস্থা রাখতে হবে, কিন্তু একইসাথে নিজের সংস্থান নিজেই সাথে নিয়ে যেতে হবে।[৪] নিজের সংস্থান নিজের সাথে নিয়ে নেওয়া মানে এই না যে, তার আল্লাহর عز وجل উপর কোনো ভরসা নেই। বরং আল্লাহ عز وجل আমাদেরকে তাকওয়াকেও একধরনের সংস্থান হিসেবে বলে ভারসাম্য শিক্ষা দিচ্ছেন। আমাদেরকে শারীরিক সংস্থান নিতে হবে, একইসাথে আত্মিক সংস্থান হিসেবে তাকওয়া সাথে নিতে হবে। আমরা যেন শুধু শারীরিক সংস্থানের চিন্তায় তাকওয়া হারিয়ে না ফেলি। ফাইভ স্টার হোটেলে থাকার মতো যথেষ্ট টাকা না হলে হাজ্জ করতে যাবো না, মাসজিদুল হারামের থেকে বেশি দূরে থাকার প্যাকেজ পাওয়া গেলে এই বছর হাজ্জ করা বাদ দিয়ে দেবো, এই সব যেন আমাদেরকে আল্লাহর عز وجل প্রতি সাবধান থাকা থেকে ভুলিয়ে না দেয়। মৃত্যুর পরে আমাদের একমাত্র সংস্থান হবে তাকওয়া, আর কিছু নয়।[১৪] যারা এটা বুঝতে পারে, তারাই বুদ্ধিমান। একারণেই আল্লাহ عز وجل বলছেন—
বুদ্ধিমানেরা: আমার প্রতি সাবধান!
যারা لبب লুব্ব অর্থাৎ বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন, উপলব্ধি করতে পারে, মুক্ত চিন্তার অধিকারী, তারা আল্লাহর عز وجل প্রতি সাবধান থাকে। ‘উলুল আলবাবআল্বাব’ হচ্ছে যাদের মন পরিষ্কার, যারা সুস্থ বিবেক, বুদ্ধির অধিকারী। এদের মাথা ভর্তি টিভি সিরিয়াল, গানের কথা, খেলার স্কোর, কোন তারকা কবে কাকে বিয়ে করলো, কার সাথে কবে কার ছাড়াছাড়ি হলো, কোন তারকা কোন ধরনের ফ্যাশন ফলো করছে —এই সব আবর্জনা দিয়ে তাদের মাথা গিজগিজ করে না। এরা যখন চুপচাপ বসে থাকে, তখন এদের মাথায় টিভির অনুষ্ঠান, কোনো মুভির দৃশ্য ঘোরাফেরা করে না। এরা যখন রাতে শুতে যায়, এদের মাথায় গানের সুর বাজতে থাকে না। বই নিয়ে পড়তে বসলে ফেইসবুক, খেলা, রেস্টুরেন্টে খাওয়ার কথা মনে পড়ে না। এদের মাথা পরিষ্কার, এরা বিবেক-বুদ্ধির অধিকারী, চিন্তাশীল, উপলব্ধিতে মগ্ন —এরা ‘উলুল আলবাবআল্বাব’। —এরাই আল্লাহর عز وجل প্রতি সাবধান হতে পারে।[১]
হাজ্জ হচ্ছে কিয়ামতের রিহার্সাল। কিয়ামতে সব মানুষ যখন একই পোশাকে, লাইন ধরে, হাশরের মাঠে একসাথে হবে, সারি ধরে হেঁটে যাবে, সবাই এক নিয়ম অনুসরণ করবে —সেটার একটা রিহার্সাল হচ্ছে হাজ্জ। হাজ্জের সময় একজন হাজ্জি এমন অনেক কিছু উপলব্ধি করেন, যেটা তিনি অন্য কোনো সময় উপলব্ধি করতে পারেন না। প্রতিটি দিন হাজ্জিদের কোনো না কোনো নতুন অভিজ্ঞতা হয়, সেই অভিজ্ঞতা থেকে নতুন উপলব্ধি হয়, উপলব্ধি থেকে নিজের মধ্যে পরিবর্তন আসে। একারণেই হাজ্জের এই রিহার্সাল মানুষকে দুনিয়ার সব অপ্রয়োজনীয় চিন্তা থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার মন, উপলব্ধি এবং বিবেকবুদ্ধির অধিকারী হতে সাহায্য করে। এভাবে তারা ‘উলুল আলবাবআল্বাব’ হয়ে যায়।[১]
হাজ্জ করে আসার পর বাংলাদেশি অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে আমূল পরিবর্তন দেখা যায়। হাজ্জের আগে যাকে দেখা যেত দিনরাত অন্য মাযহাবের মানুষদের গালিগালাজ করত, এর ভুল ধরত, ওকে কাফির গালি দিত, নিজের মতের সাথে মিল না পেলে কাউকে বিদআতি, খারিজি, মুনাফিক ইত্যাদিটি লেবেল দিত, সেই একই মানুষ হাজ্জ করে আসার পর রাতারাতি পাল্টে গিয়ে সবার সাথে সুন্দরভাবে মিলে মিশে চলা শুরু করে। হাজ্জ তার সঙ্কীর্ণ মনটাকে খুলে দেয়, একরোখা চিন্তাভাবনাকে প্রসারিত করে, তার চারপাশের মুসলিমদেরকে নতুন করে জানতে এবং বুঝতে শেখায়। এভাবে মুসলিমরা উলুল আল্বাবের বৈশিষ্ট্য অর্জন করে, তাদের তাকওয়া আরও বেড়ে যায়।
তোমাদের কোনো পাপ হবে না যদি হাজ্জের সময় তোমরা তোমাদের রবের অনুগ্রহ অন্বেষণ করো। তোমরা যখন আরাফাত থেকে ঢলের মতো নেমে আসবে, তখন মুযদালিফার কাছে এসে আল্লাহর যিকর করো। তাঁর যিকর করো, যেভাবে করতে তিনি তোমাদেরকে দেখিয়েছেন। নিঃসন্দেহে তোমরা একসময় পথহারা ছিলে। [আল-বাক্বারাহ ১৯৮]
এখানে আল্লাহ عز وجل আবারো বলছেন যে, হাজ্জ করতে গিয়ে কেউ যদি ব্যবসা করে, হালাল রুজির অনুসন্ধান করে, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। বরং অনেকের জন্য ব্যবসার একটি বড় সুযোগ হচ্ছে হাজ্জের সময়। এসময় হাজ্জি ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য নিয়ে এসে অন্য হাজ্জিদের মধ্যে বিক্রি করলে হাজ্জিরাই বরং উপকৃত হবে। এভাবে তারা নিজেরাও স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে, একইসাথে অন্য হাজ্জিদেরও কাজে লাগবে।[১২][৮] তবে এই আয়াতে আল্লাহ عز وجل আদেশ করেননি, “হাজ্জের সময় তোমাদের রব্বের অনুগ্রহ অনুসন্ধান করো”, বরং তিনি বলেছেন,
“তোমাদের কোনো পাপ হবে না যদি …”
—এথেকে বোঝা যায়, হাজ্জের সময় ব্যবসা করাটা যেন কারো আসল উদ্দেশ্য হয়ে না যায়। বরং হাজ্জ ঠিকভাবে করাটা হতে হবে তার আসল উদ্দেশ্য। ব্যবসা করতে গিয়ে যদি সে তার হাজ্জের ক্ষতি করে ফেলে, তাহলে সে ব্যবসার থেকে অনেক বড় কিছু হারিয়ে ফেলবে।[৪]
আরাফাত থেকে হাজ্জিরা যখন মুযদালিফায় আসবেন, তখন তারা বেশি করে আল্লাহর عز وجل যিকরে মগ্ন থাকবেন। একইসাথে তারা আল্লাহর عز وجل ইবাদত এমনভাবে করবেন, যেভাবে করতে তিনি মানুষকে শিখিয়েছেন। “
তাঁর যিকর করো, যেভাবে করতে তিনি তোমাদেরকে দেখিয়েছেন
” —এর মাধ্যমে আল্লাহ عز وجل জোর দিচ্ছেন যে, মানুষ যদি নিজের ইচ্ছামত ইবাদত করার পদ্ধতি বের করে, তাহলে হবে না, বরং ইবাদত হতে হবে আল্লাহর عز وجل শেখানো পদ্ধতি অনুসরণ করে। এর বাইরে যে যা-ই করবে, তা বিদআত হওয়ার বিরাট ঝুঁকি রয়েছে।
তারপর যেখান থেকে সবাই ফিরে আসে, সেখান থেকে ঢলের মতো নেমে আসো। আল্লাহরকাছে ক্ষমা চাও। অবশ্যই আল্লাহ অনেক ক্ষমা করেন, নিরন্তর করুণাময়। [আল-বাক্বারাহ ১৯৯]
হাজ্জ সাম্যের প্রতীক। এখানে উচ্চ বংশের কারো জন্য আলাদা পথ, গাড়ির ব্যবস্থা করার সুযোগ নেই। একজন গরিব কৃষক হাজি যেভাবে, যে রাস্তা দিয়ে ফিরে আসবেন, একজন আরব প্রিন্সও সেভাবেই, সেই রাস্তা দিয়ে পায়ে হেঁটে ফিরে আসবেন। একারণেই আল্লাহ تعالى বলেছেন, أَفِيضُوا۟ উপচে পড়া পানির ঢলের মতো নেমে আসতে। মানুষের ঢলে কাউকে আলাদা করে চেনা যায় না। সবাই এক হয়ে যায়। যদি তা না হয়, তাহলে কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটে তা আমরা ২০১৫ সালের হাজ্জে দেখেছি, যেখানে প্রিন্সের গাড়ির বহরের জন্য জায়গা করতে গিয়ে শত শত হাজ্জি পদদলিত হয়ে মারা গেছেন।
আল্লাহর عز وجل কাছে ক্ষমা চাও
হাজ্জের মতো একটা কঠিন কাজ করে, যেখানে কিনা বছরের পর বছর কষ্ট করে টাকা জমিয়ে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মাক্কায় গিয়ে, দিনের পর দিন কষ্ট করে হাজ্জের অনুষ্ঠানগুলো করতে হয় —এই সব করার পরে ক্ষমা চাইতে হবে?
আল্লাহ عز وجل যদি অনুগ্রহ করে আমাদের ইবাদতগুলো কবুল করে না নেন, তাহলে আমরা শেষ! আমাদের একটা নামাজও কবুল হবে না, কারণ নামাজে দাঁড়িয়ে এমন কোনো চিন্তা নেই, যা আমরা করি না। আমাদের রোজা কবুল হবে না, কারণ রোজা রেখে আমরা মিথ্যা বলি, গীবত করি, অন্যের উপর অন্যায় করি, নিজের সুবিধার জন্য টাকা এদিক ওদিক করি, হিন্দি সিরিয়াল দেখি। আমাদের যাকাত কবুল হবে না, কারণ যাকাত দেওয়ার সময় আমরা যতভাবে সম্ভব কম সম্পত্তির হিসেব করে, যাদেরকে যাকাত দিলে বেশি নাম হবে, তাদেরকে দেই। আমাদের হাজ্জ কবুল হবে না, কারণ হাজ্জের টাকায় মিশে আছে ব্যাঙ্কের সুদ, মামা-চাচা-খালু ধরে অন্যায়ভাবে জোগাড় করা চাকরি বা ব্যবসার আয়।
একারণে আমাদের প্রতিটি ইবাদতের পরে আল্লাহর عز وجل কাছে ভিক্ষা চাইতে হবে, যেন তিনি অনুগ্রহ করে আমাদের ভুলত্রুটিগুলো উপেক্ষা করে তা গ্রহণ করে নেন। নবী ইব্রাহিম عليه السلام যেভাবে কা’বা বানানোর পর আকুলভাবে আল্লাহকে عز وجل অনুরোধ করেছিলেন,
“নিঃসন্দেহে আপনি বার বার ক্ষমা করেন, নিরন্তর দয়াময়”
—ঠিক একইভাবে আমাদেরকেও হাজ্জ সহ যেকোনো ইবাদতের পরে আল্লাহর عز وجل পবিত্র নামের দোহাই দিয়ে তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে, তার দয়া ভিক্ষা চাইতে হবে। নবী ইব্রাহিম-এর عليه السلام মতো একজন নবী যদি কা’বা-র মতো বিরাট সন্মানের স্থাপনা বানিয়ে আল্লাহর عز وجل কাছে সেটা গ্রহণ করার জন্য ভিক্ষা চাইতে পারেন, তাহলে আমরা কোথাকার কে?
সূত্র:
- [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
- [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
- [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
- [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
- [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
- [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
- [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
- [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
- [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
- [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
- [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
- [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
- [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
- [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
- [১৫] তাফসির আল জালালাইন।
- [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ।