এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে ‘ক্রিমিনাল সাইকোলজি’ শিখিয়েছেন। একজন অপরাধী চারভাবে তার অপরাধের শাস্তি থেকে বাঁচার চেষ্টা করে, যেগুলো কিয়ামাতের দিন কোনোই কাজে আসবে না—
সাবধান সেই দিনের ব্যাপারে: ১) যেদিন কেউ অন্য কারও জন্য একটুও এগিয়ে আসবে না, ২) কোনো বিনিময় নেওয়া হবে না, ৩) কারও সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না — ৪) সেদিন কেউ কারও সাহায্য পাবে না। [আল-বাক্বারাহ ১২৩]
প্রথমে সে চেষ্টা করে তার দোষকে অন্য কারও ঘাড়ে চাপানোর। সে প্রমাণ করে দেখানোর চেষ্টা করে যে, আসলে অপরাধটা সে করেনি, অন্য কেউ করেছে। যেমন, “আমি তো ইচ্ছা করে ঘুষ খাইনি! ওরা আমাকে সেধে একটা ফ্লাট দিয়েছিল দেখেই তো আমি ওদেরকে প্রজেক্টের কন্ট্রাক্টটা দিয়েছিলাম। ওরা আমাকে ফ্লাট দিলো কেন? এটা ওদের দোষ!”
যদি এতে কাজ না হয়, তখন সে যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করে যে, আসলে সে অপরাধ করতে বাধ্য হয়েছিল অন্য কারও জন্য: “আমি তো ইচ্ছা করে হাতাকাটা ব্লাউজ, আর ফিনফিনে পাতলা শাড়ি পরে বিয়েতে যাইনি। আমি যদি হিজাব করে বিয়েতে যেতাম, তাহলে আমার স্বামীকে সবাই ‘মোল্লা-তালেবান-ব্যাকডেটেড’ বলত। ওর জন্যই তো আমি স্মার্টভাবে সেজে বিয়েতে যেতে বাধ্য হয়েছি। এতে আমার তো কোনো দোষ নেই? দোষ হচ্ছে সমাজের!”
এধরনের চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই, কারণ: “সেদিন কেউ অন্য কারও জন্য একটুও এগিয়ে আসবে না।”
এগুলো যখন কোনো কাজে আসে না, তখন অপরাধীরা চেষ্টা করে টাকা খাওয়ানোর, সম্পত্তির লোভ দেখানোর: “জজ সাহেব, আমার কেসটা ছেড়ে দ্যান, আমি আপনাকে খুশি করে দিবো। উত্তরায় আমার অনেক প্লট আছে। আপনার রঙিন পানির সাপ্লাই নিয়ে আর কোনো চিন্তা করতে হবে না।” কিয়ামাতের দিন কেউ যদি গিয়ে বলে, “আমি তো তিন-তিনবার হাজ্জ করেছি! এই দেখেন আমার পাসপোর্ট: তিনবার ভিসা দেওয়া আছে। সুদের লোন নিয়ে কেনা আমার একমাত্র বাড়িটা তিনটা হজ্জ দিয়ে মাফ করা যায় না?”
আল্লাহ تعالى বলে দিয়েছেন যে, তাঁর সাথে এসব কিছুই চলবে না: “কোনো বিনিময় নেওয়া হবে না।” আমাদের হারাম সম্পত্তি হালাল করে যেতে হবে, যাদের হক মেরে দেওয়া হয়েছে, তাদের হক আদায় করে যেতে হবে। সেটা না পারলে হারাম সম্পত্তি দান করে দিতে হবে। কিন্তু হারাম টাকায় করা সম্পত্তি সারাজীবন ভোগ করে, মানুষের হক মেরে গিয়ে, তারপর সেটা সালাত, সিয়াম, হাজ্জ দিয়ে বিনিময় করা যাবে না। কিয়ামাত এধরনের ব্যবসা করার জায়গা নয়।
অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা করে যখন লাভ হয় না, তখন অপরাধীরা চেষ্টা করে ওপরের লেভেলের কোনো মামা-চাচা-খালু ধরার, কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি দিয়ে সুপারিশ করার, বা কোনো ক্ষমতাশালী কারও সাথে যদি তার ওঠা-বসা থাকে তাহলে সেটার ভয় দেখানোর। যেমন, “আমার মামা ছিলেন হজ্জ সেন্টারের চেয়ারম্যান। তিনি বিশ বার হজ্জ কাফেলা নিয়ে গেছেন। তাকে একটু ডাকুন, তিনি আমার হয়ে সুপারিশ করবেন।”
সেটা করে লাভ না হলে, শেষ ভরসা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে যে, তার সাথে কোনো সন্মানিত বা বিখ্যাত মানুষের সম্পর্ক আছে, এবং সে জন্য তাকে একটু বিশেষ ‘খাতির’ করতে হবে: “আমার বাবা সিলেটের অমুক পিরের ভগ্নিপতির মামার শ্যালক ছিলেন। আমি নিজে সৈয়দ বংশের সন্তান! আমরা সবাই আধ্যাত্মিক পরিবারে জন্মেছি। আমাকে তো খন্দকার বংশের মতো দেখলে হবে না!”
আল্লাহ تعالى সোজা বলে দিয়েছেন, “সেদিন কারও সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না।” شفاعة (শাফাআত) অর্থাৎ সুপারিশ-এর দুটি পদ্ধতিই এখানে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে—১) কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি নিজে থেকে অন্য কোনো অপরাধীর জন্য সুপারিশ করতে পারবে না, ২) কোনো অপরাধীকে অনুমতি দেওয়া হবে না, অন্য কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক উপস্থাপন করার।
সকল চেষ্টা যখন বিফল হয়, তখন অপরাধীরা শেষ ভরসা হিসেবে গায়ের জোর দেখানোর চেষ্টা করে। তার দলের সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে মারামারি, খুনাখুনি করে পার পাওয়ার চেষ্টা করে। তাদেরকে আল্লাহ تعالى শেষ কথা জানিয়ে দিয়েছেন, “সেদিন কেউ কারও সাহায্য পাবে না।” আল্লাহর تعالى সামনে তার দলের সাঙ্গপাঙ্গরা, ভাড়াটে খুনিরা কেউ কিছুই করতে পারবে না। উলটো ওরা সবাই ভয়ে, আতঙ্কে থর থর করে কাঁপতে থাকবে—নিজেদেরকে কীভাবে বাঁচানো যায়, সেই চিন্তায় উদ্ভ্রান্ত হয়ে যাবে।
“সেই দিনের ব্যাপারে সাবধান: যেদিন কেউ কারও জন্য এগিয়ে আসবে না”—আপনি যেই আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখার জন্য তার বিয়ের অনুষ্ঠানে অর্ধ নগ্ন হয়ে গেলেন, যেই বন্ধুর সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখার জন্য তার বাচ্চার বার্থডে পার্টিতে গিয়ে ছেলে-মেয়ে মাখামাখি করে নাচ-গান করলেন, যেই প্রতিবেশীর সামনে স্ট্যাটাস ঠিক রাখার জন্য সুদের লোন নিয়ে নতুন মডেলের গাড়ি কিনলেন—সেই আত্মীয়-বন্ধু-প্রতিবেশীরা কেউ কিয়ামাতের দিন আপনাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে না।
সেদিন আমরা যখন নিজেদের দোষে জান্নাত হারিয়ে ফেলব, তারপর ভয়ংকর কিছু সত্তা এসে নিষ্ঠুরভাবে আমাদেরকে টেনে হিঁচড়ে জাহান্নামের আগুনের দিকে নিয়ে যেতে থাকবে, তখন আমরা যতই হাহাকার করি, “আমার ছেলেটা আমাকে শেষ করে দিয়েছে। ওকে ধরেন! ওর পড়ালেখার জন্য দিনরাত দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে আমি নামাজ পড়তে পারিনি। ওকে নিয়ে যান, আমাকে ছেড়ে দেন!”
“আমার মেয়েটার জন্য আজকে আমি শেষ! ও কার না কার সাথে প্রেম করে, এই ভয়ে আমি কোচিং সেন্টারে গিয়ে বসে থাকতাম। আমার বদলে ওকে ধরেন, আমাকে মাফ করে দেন!”
“আমার স্বামীর জন্য আমি হিজাব করিনি। আমার স্বামীকে জাহান্নামে নেন, আমাকে বাঁচান! আমি তো বুঝতে পারিনি এরকম হবে!”
“আমার বউয়ের শপিং-এর খরচের জন্য দিনরাত চাকরি-ব্যবসা করতে গিয়ে আমি ইসলাম শিখতে পারিনি। আমার দোষ নেই! আমার বউকে জাহান্নামে নেন। প্লিজ, আমাকে ছেড়ে দেন!”
—কোনো লাভ হবে না। জাহান্নামের আগুনের শিখা ক্ষুধার্ত হিংস্র বাঘের মতো আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে।
يُبَصَّرُونَهُمْ ۚ يَوَدُّ الْمُجْرِمُ لَوْ يَفْتَدِي مِنْ عَذَابِ يَوْمِئِذٍ بِبَنِيهِ ﴿١١﴾ وَصَاحِبَتِهِ وَأَخِيهِ ﴿١٢﴾ وَفَصِيلَتِهِ الَّتِي تُؤْوِيهِ ﴿١٣﴾ وَمَن فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا ثُمَّ يُنجِيهِ ﴿١٤﴾ كَلَّا ۖ إِنَّهَا لَظَىٰ
সেদিন তাদের একে অন্যকে দেখতে বাধ্য করা হবে। অন্যায়কারীরা চাইবে যেন সে নিজেকে সেই দিনের শাস্তি থেকে বাঁচাতে পারে: তার নিজের সন্তান, সহধর্মিণী, ভাই, নিকটাত্মীয়দের বিনিময়ে হলেও, যারা কিনা তাকে আশ্রয় দিয়েছিল। এমনকি পৃথিবীর সবার বিনিময়ে হলেও সে নিজেকে বাঁচাতে চাইবে। কখনই নয়! সেটা এক হিংস্র আগুণের শিখা! [আল-মা’আরিজ ৭০:১১-১৫]
বাকারাহ-এর এই আয়াতটি হচ্ছে আমাদের জন্য একটি সাবধান বাণী: আমাদেরকে Sense of Priority ঠিক করতে হবে। সব সময় মাথায় রাখতে হবে: আমি সমাজ, সংস্কৃতি, আত্মীয়তা, বন্ধুত্ব, সন্তানদের জন্য নিজেকে ব্যস্ত রাখতে গিয়ে যেন আমার প্রভুকে ভুলে না যাই। আমার প্রভু সবার আগে। আমার সন্তান স্কুলে আধা ঘণ্টা বেশি সময় বসে থাকতে পারে, কিন্তু তাই বলে তাকে তাড়াতাড়ি আনতে গিয়ে আমি আমার প্রভুর সাথে যুহরের ওয়াক্তের মিটিংটা মিস করতে পারি না। আমার বান্ধবী তার গায়ে-হলুদে না যাবার জন্য মন খারাপ করতে পারে, কিন্তু তাই বলে আমার প্রভুর সামনে দাঁড়িয়ে আমি সাজব কিছু পরপুরুষের মনোরঞ্জন করার জন্য—এটা হতে পারে না। আমার প্রতিবেশী আমার ভাঙা গাড়ি দেখে আমাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে পারে, কিন্তু আমার প্রভু আমাকে দেখছেন, আর আমি ব্যাংকে বসে হারাম লোনের কাগজে সই করছি—এটা হতে পারে না। ‘লোকে কী বলবে’—সেটা আমি ভয় পাই না, বরং ‘আমার প্রভু রাগ করবেন’—সেটা আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পাই।
সূত্র:
- [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
- [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
- [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
- [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
- [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
- [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
- [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
- [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
- [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
- [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
- [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
- [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
- [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
- [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
- [১৫] তাফসির আল জালালাইন।