এরপরেও কিছু লোক আছে যারা অন্যদেরকে আল্লাহর সমান গুরুত্ব দেয়— আল-বাক্বারাহ ১৬৫-১৬৭

আমরা জীবনে প্রায়ই এমন কিছু পরিস্থিতিতে পড়ি, যখন ইসলামের নিয়ম মেনে চললে, আল্লাহর تعالى নির্দেশ অক্ষরে-অক্ষরে পালন করলে দেখা যাবে যে, আত্মীয়-বন্ধুদের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটবে, ব্যবসায় কোনো বড় কাস্টমার হারিয়ে ফেলব, চাকরিতে প্রমোশন হাতছাড়া হয়ে যাবে, সমাজে স্ট্যাটাস নষ্ট হয়ে যাবে, লোকজন নানা কথা বলাবলি করবে ইত্যাদি। জীবনে প্রায়ই এমন ঘটনা আসে, যখন নিজেকে বোঝাতে হয়, “থাক না, একদিনেরই তো ব্যাপার। একটু ঘুষ খেলে কী হয়। সবাই খাচ্ছে না?” অথবা হয়তো নিজেকে যুক্তি দেখাই, “আমি যদি এটা না করি, তাতে কী হবে? আমার পরে যে আসবে সে তো ঠিকই করবে। তারচেয়ে এবার একটু অন্যায় করি। পরে বেশি করে ভালো কাজ করে পাপ কেটে নেবো।”

স্ট্যাটাস, সম্পত্তি, ক্ষমতা, সম্মানকে আমরা এতটাই ভালবাসি যে, এদেরকে ধরে রাখার জন্য মাঝে মাঝেই ইসলামকে বিসর্জন দিয়ে দেই। জেনে শুনে আল্লাহর تعالى নির্দেশ অমান্য করি। মনে মনে আল্লাহর تعالى সাথে পাপ-পুণ্যের লেনদেনের হিসেব করি। তাঁকে تعالى বোঝানোর চেষ্টা করি: কেন তাঁর تعالى নিষেধ এবার মানছি না, এবং কেন তাঁর تعالى উচিত এবার আমাকে মাফ করে, আরেকবার সুযোগ দেওয়া।

যারা এধরনের কাজ করেন, তাদের কী হবে, তা এই আয়াতে বলা হয়েছে—  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

এসবের মধ্যে বিবেক-বুদ্ধির মানুষদের জন্য অবশ্যই বিরাট নিদর্শন রয়েছে — আল-বাক্বারাহ ১৬৪ — ২য় পর্ব

2_164_title2

প্রথম পর্বে দেখানো হয়েছে: আকাশ এবং পৃথিবীর সৃষ্টি নিয়ে কেউ যদি গভীরভাবে ভেবে দেখে, সে দেখবে যে, এসবের সৃষ্টির মধ্যে একই মূলধারার ডিজাইন লক্ষ্য করা যায়, একজন স্রষ্টারই স্বাক্ষর স্পষ্ট ভাবে ফুটে ওঠে। একইভাবে কেউ যদি দিন-রাতের পরিবর্তন নিয়ে ভেবে দেখে: কীভাবে দিন-রাতের দৈর্ঘ্য পরিবর্তন হয়, কেন রাতের আকাশে অন্ধকার থাকে, কীভাবে প্রতি বছর একই দৈর্ঘ্যের দিনরাত হয়, তাহলে সে দেখবে এটা বিশেষভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, যেন মানুষের মতো জটিল প্রাণ একদিন পৃথিবীতে আসতে পারে।

তারপর কেউ যদি পানিতে ভেসে চলা জাহাজগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখে: কীভাবে এত ভারি একটা জিনিস পানিতে ভেসে আছে, তাহলে সে দেখবে: পানির এক বিশেষ গুণ ‘প্লবতা’র কারণেই তা হয়। যদি এই বিশেষ গুণ পানিতে দেওয়া না হতো, তাহলে সভ্যতা গড়ে উঠত না, কোনো প্রাণী পানিতে ভেসে থাকতে পারতো না। প্রাণী জগৎ কখনই আজকে এই পর্যায়ে আসতে পারতো না। কেউ একজন ইচ্ছে করে এই ব্যাপারগুলো নির্ধারণ করেছেন দেখেই আজকে মানুষ পৃথিবীতে বাস করতে পারছে, এত বৈচিত্র্যের উদ্ভিদ এবং প্রাণী জগৎ হতে পেরেছে, পৃথিবী মানুষের বসবাসের জন্য এত আরাম দায়ক হয়েছে।

এবার আয়াতের বাকি নিদর্শনগুলো নিয়ে দেখি—  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

এসবের মধ্যে বিবেক-বুদ্ধির মানুষদের জন্য অবশ্যই বিরাট নিদর্শন রয়েছে — আল-বাক্বারাহ ১৬৪ পর্ব ১

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বুদ্ধিমান মানুষদের চিন্তা করার জন্য কিছু নিদর্শন দিয়েছেন। তিনি تعالى বলছেন যে, যদি মানুষ বুদ্ধিমান হয়, তাহলে এই ব্যাপারগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে মানুষ এই উপসংহারে পৌঁছাবেই: আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ থাকতেই পারে না।

2_164_title

2_164আকাশ এবং পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিন-রাতের পরিবর্তনে, মানুষের জন্য পণ্য নিয়ে সমুদ্রে ভেসে চলা জাহাজে, আকাশ থেকে আল্লাহর পাঠানো পানিতে, যা মৃত জমিকে আবার প্রাণ দেয়, এর মধ্যে সব ধরণের প্রাণীকে ছড়িয়ে দেয়, বাতাসের পরিবর্তনে এবং আকাশ এবং পৃথিবীর মাঝখানে মেঘের নিয়ন্ত্রিত চলাচলে —এসবের মধ্যে বিবেক-বুদ্ধির মানুষদের জন্য অবশ্যই বিরাট নিদর্শন রয়েছে। [আল-বাক্বারাহ ১৬৪]

এই আয়াতে একটি খুবই শক্তিশালী বাণী রয়েছে। আল্লাহ تعالى কে —তা তিনি শুধু কু’রআন, হাদিসের বাণীর মাধ্যমেই আমাদেরকে জানাননি, আমাদের চারপাশের এই বিশাল জগতের মধ্যে পরিষ্কারভাবে তাঁর تعالى পরিচয় ছড়িয়ে রয়েছে। তাঁকে জানার জন্য যে, আমাদের শুধু হালাক্বাতে গিয়ে লেকচার শোনা, মসজিদে গিয়ে খুতবা শোনা, বা শুধু ধর্মীয় বই পড়তে হবে তা নয়, তাঁর এই বিশাল সৃষ্টিজগৎ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে, পৃথিবী ঘুরে দেখলে, আকাশ নিয়ে চিন্তা করলে, আমরা তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারবো। আল্লাহর تعالى আয়াত ءَايَٰت—যার অর্থ নিদর্শন—দুই ভাবে আমাদের কাছে এসেছে: ১) তাঁর পাঠানো বাণীর মাধ্যমে, এবং ২) তাঁর সৃষ্টিজগতের মাধ্যমে।[১] যারা বুদ্ধিমান, তারা সৃষ্টিজগতের মধ্যেই আল্লাহর পরিচয় تعالى খুঁজে পায়। তাঁর একত্ব এবং মহত্ত্ব উপলব্ধি করে বিস্ময়ে মাটিতে লুটিয়ে যায়।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

তিনি ছাড়া উপাসনার যোগ্য আর কিছু নেই — আল-বাক্বারাহ ১৬৩

ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এসেছে এই আয়াতে—

2_163_title

2_163তোমাদের উপাসনার যোগ্য সত্তা একজন। তিনি ছাড়া উপাসনার যোগ্য আর কিছু নেই। পরম দয়ালু তিনি, নিরন্তর করুণাময় তিনি। [আল-বাক্বারাহ ১৬৩]

“তোমাদের إِلَٰه ‘ইলাহ’ একজন” — إِلَٰه ইলাহ শব্দটিকে সাধারণত উপাস্য বা উপাসনার যোগ্য প্রভু অনুবাদ করা হয়। কিন্তু ইলাহ অর্থ আসলে হচ্ছে: কোনো কিছু বা কাউকে এতটাই চাওয়া হয়, এতটাই ভালবাসা হয় যে, ভালবাসা তখন উপাসনার পর্যায়ে চলে যায়। হৃদয়ে তখন দিন, রাত শুধু ইলাহ-এর চিন্তা ঘোরে। ইলাহ হয়ে যায় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ আকাঙ্খা। বাকি সব কিছু ইলাহ’র কাছে তখন তুচ্ছ। মন তখন ইলাহকে পাওয়া, ইলাহকে তুষ্ট করার চিন্তায় বিভোর হয়ে যায়।[১] [১১]

হাজার বছর ধরে মানুষের ইলাহ ছিল বিভিন্ন দেব-দেবী, সূর্য, চাঁদ, তারা, গরু ইত্যাদি নানা প্রাকৃতিক বস্তু, এমনকি বিভিন্ন বিখ্যাত মানুষও। এদেরকে তুষ্ট করার জন্য, এদের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার জন্য মানুষ এমন কিছু নেই, যা করতো না, সেটা মানুষ কুরবানী করে হলেও। ইলাহ যে শুধু এধরনের কোনো প্রাকৃতিক কিছু বা মানুষ হতে হবে তা নয়, এটি যে কোনো কিছু হতে পারে। কারো বেলায় ইলাহ হয় তার সম্পদ। কারো বেলায় তা হয় তার মান-সম্মান, সমাজে স্ট্যাটাস। কারো বেলায় ইলাহ হয়ে যায় তার জৈবিক কামনা। কারো বেলায় তার ইলাহ হয়ে যায় তার স্বামী, বা স্ত্রী, এমনকি সন্তানরাও। মানুষ তখন এসব ইলাহ’কে পেতে গিয়ে তার সমস্ত মনোযোগ, সময়, শক্তি দিয়ে দেয়। শুধু তাই না, অনেক সময় মানুষ একাধিক ইলাহ’কে একই সাথে পাওয়ার চেষ্টা করে। তখন শুরু হয় একাধিক ইলাহ’র মধ্যে প্রতিযোগিতা। শেষ পর্যন্ত একাধিক ইলাহ’র কোনোটাকেই ঠিক মতো না পেয়ে অশান্তি, অতৃপ্তিতে, হতাশায় ডুবে যায়।[১১]  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

যারা আমার পাঠানো পরিষ্কার প্রমাণ এবং পথনির্দেশ গোপন করে — আল-বাক্বারাহ ১৫৯-১৬২

একটি ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা বসে কারিকুলাম ঠিক করছেন। একজন প্রস্তাব দিলেন প্রথম দুই সেমিস্টার রিয়াদুস সালেহীন পড়াতে। সবাই সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। আরেকজন প্রস্তাব দিলেন এর সাথে সহিহ বুখারী পড়াতে। সেটাও সবাই একবাক্যে রাজি। এরপর আরেকজন বেহেশতি জেওর, কাসাসুল আনবিয়া ঢুকিয়ে দিতে বললেন। সেটাও পাশ হয়ে গেল।

এরমধ্যে একজন বললেন, প্রতি সেমিস্টারে কুরআনের এক পারার অর্থসহ তিলাওয়াত শেখাতে। এই প্রস্তাব শুনে অন্যেরা আঁতকে উঠলেন, “না, না, শুধু আরবি তিলাওয়াতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখুন। মানুষকে কুরআন অর্থসহ শেখালে বিভ্রান্তি হবে। মানুষ নিজে থেকেই নিজেদের মত যা খুশি বুঝে নিয়ে আমল করা শুরু করে দেবে। কুরআন সবার জন্য নয়। কুরআন বুঝতে গেলে অনেক বছর আরবি শিখতে হয়, আরবি ব্যাকরণে অভিজ্ঞ হতে হয়, কমপক্ষে ১৪টা তাফসির পড়তে হয়। এগুলো সব না শিখিয়ে শুধু কুরআন অর্থ সহ শেখালে সর্বনাশ হয়ে যাবে। সাধারণ মানুষকে কুরআন থেকে যত দূরে রাখা যায়, ততই বরং কম ফিতনা হবে।”

2_159_title

2_159যারা আমার পাঠানো পরিষ্কার প্রমাণ এবং পথনির্দেশ গোপন করে, আমি মানুষের জন্য কিতাবে পরিষ্কার করে দেওয়ার পরেও, ওদেরকে আল্লাহ ঘৃণা ভরে পরিত্যাগ করেন, এবং অভিশাপকারীরা ওদেরকে অভিশাপ দেয়। [আল-বাক্বারাহ ১৫৯]

হাজার বছর আগে ইহুদি রাবাইরা (ধর্মীয় পন্ডিতরা) তাওরাতকে শুধুমাত্র নিজেদের মধ্যেই কুক্ষিগত করে রেখেছিল। সাধারণ ইহুদিরা কখনো তাওরাত নিজেরা পড়তে পারতো না, সেটা তাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। তাওরাতকে জনসাধারণের ধরাছোয়ার বাইরে রেখে রাবাইরা নিজেদের ইচ্ছামত শরীয়াহ বানিয়ে, নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করার জন্য ইচ্ছেমত হালাল, হারাম নির্ধারণ করে গেছে। নানা ধরনের ধর্মীয় রীতিনীতি ঢুকিয়ে গেছে, যেগুলো তাদেরকে ক্ষমতা, সম্পত্তি, প্রতিপত্তি এনে দিয়েছে। নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য তাওরাতের পরিষ্কার নিষেধকেও বৈধ বলে চালিয়ে দিয়েছে। এভাবে তারা সফল ভাবে কয়েকশত বছর ধরে সাধারণ মানুষকে আল্লাহর পরিষ্কার বাণী, পথনির্দেশ থেকে দূরে রেখে একটা পুরো জাতিকে ভুল পথে নিয়ে গেছে।[১][১১]

একইভাবে গত কয়েক শতকে উপমহাদেশের মানুষদেরকে কৌশলে কুরআন থেকে দূরে রেখে কয়েকটা প্রজন্ম তৈরী করা হয়েছে, যারা কুরআন সম্পর্কে নুন্যতম জ্ঞানও রাখে না। এরা জানে না কুরআনে পরিষ্কারভাবে কী হালাল, কী  হারাম বলা আছে। কুরআনে তাওহীদের শিক্ষা কী, তা তারা জানে না। তারা শুধু পড়েছে কিছু গৎবাঁধা বই, যেই বইগুলোর অনেকগুলোতেই নানা ধরনের জাল হাদিস, বিদআতের ছড়াছড়ি।[১১] এভাবে একটি পুরো জাতিকে কুরআনে নিরক্ষর করে রেখে গেছে কিছু ইসলামী দল এবং ‘আলেম’ নিজেদের ইচ্ছামত ধর্ম ব্যবসা করার জন্য। এদের পরিণাম ভয়ঙ্কর—  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

যে নিজে থেকে ভালো কাজ করে, আল্লাহ অবশ্যই তার মূল্যায়ন করেন — আল-বাক্বারাহ ১৫৮

2_158_title

2_158সাফা এবং মারওয়াহ আল্লাহর تعالى নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি। তাই যারা কা’বা ঘরে হাজ্জ বা উমরাহ করে, তারা এদুটিকে ঘিরে ঘুরলে কোনো দোষ নেই। আর যে নিজে থেকে ভালো কাজ করে, আল্লাহ تعالى অবশ্যই তার মূল্যায়ন করেন, তিনি সব কিছুর ব্যাপারে জানেন। [আল-বাক্বারাহ ১৫৮]

সাফা এবং মারওয়া আল্লাহর تعالى নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি। এই আয়াতে নিদর্শন বলতে শা’আইর شَعَآئِرِ ব্যবহার করা হয়েছে, যার একবচন শা’ইরাহ شعيرة এসেছে شعر থেকে। এর অর্থ: কোনো স্থাপত্য, চিহ্ন, যা দেখে মানুষের কোনো উপলব্ধি হয়। কোনো কিছু দেখে আমরা যখন কোনো স্মৃতিচারণ করি, আমাদের মধ্যে আবেগের সৃষ্টি হয়, সেটা شعيرة।[১] যেমন বাঙালিদের شعيرة হচ্ছে স্মৃতিসৌধ, যা আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। সেরকম সাফা এবং মারওয়া আমাদেরকে নবী ইব্রাহিম عليه السلام এর স্ত্রীর পানির খোঁজে ছোটাছুটি করার কথা মনে করিয়ে দেয়। তাদের ভীষণ কঠিন সব পরীক্ষা আল্লাহর تعالى প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রেখে নির্দ্বিধায় পার করার চেতনায় আমাদের উদ্বুদ্ধ করে।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

এরাই হচ্ছে তারা, যাদের জন্য বিশেষভাবে তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে অভিবাদন এবং অনুগ্রহ — আল-বাক্বারাহ ১৫৬-১৫৭

আমাদের জীবনে প্রায়ই কষ্ট, দুর্দশা আসে। তখন আমরা অনেকেই দিশেহারা হয়ে যাই। কাউকে তখন ভাগ্য, যোগ্যতার অভাব অথবা কপালকে দোষ দিতে দেখা যায়। আবার কারো বেলায় সেটা অন্য কারো দোষ: সমাজের দোষ, দেশের দোষ, সরকারের দোষ, না হলে বউয়ের দোষ। অনেককে আবার নানা ধরনের দার্শনিক প্রশ্ন করতে দেখা যায়: “আমার কেন এরকম হলো? আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, সারাজীবন মানুষের সেবা করেছি। তাহলে আমার কপালে এত দুঃখ-কষ্ট কেন?”

—এধরনের আহাজারি, দোষারোপ করে কোনো লাভ হয় না। বরং নেতিবাচক কথা এবং চিন্তা আমাদের মানসিক অবস্থাকে আরও খারাপ করে দেয়। নিজের ভেতরের তিক্ততা অন্যের মধ্যেও ছড়িয়ে দেয়। অন্যদের জন্য সে তখন মানসিক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যরা তখন তাদের মন খারাপ হয়ে যাওয়ার ভয়ে এই ধরনের মানুষদের এড়িয়ে চলে।

অথচ একজন মুসলিমের কখনোই এভাবে চিন্তা করার কথা না। মুসলিমদের যে ধরনের মানসিকতা থাকার কথা, যা থাকলে একজন মুসলিম যে কোনো বিপদ, কষ্টের সময় হাসিমুখে পার করতে পারে, তা আল্লাহ تعالى এই দুটি আয়াতে আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছেন—

2_156_157_revised

2_156_157দুর্দশা আঘাত করলে যারা সাথে সাথে বলে, “আমরা তো আল্লাহরই تعالى সম্পত্তি, আর অবশ্যই আমরা আল্লাহর تعالى কাছেই ফিরে যাচ্ছি।” এরাই হচ্ছে তারা, যাদের জন্য বিশেষভাবে তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে অভিবাদন এবং অনুগ্রহ। আর এরাই তারা, যারা সঠিক পথ পেয়ে গেছে। [আল-বাক্বারাহ ১৫৬-১৫৭]

আমরা অনেকেই মুখে ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ বলি, কিন্তু উপলব্ধি করি না কত বড় একটা কথা আমরা বলছি। এর অর্থ: “আমরা তো আল্লাহরই تعالى সম্পত্তি, আর আল্লাহর تعالى কাছেই আমরা ফিরে যাবো।” আমরা যদি এই কথাটির উদ্দেশ্য আত্মস্থ করতে পারি, তাহলে আমাদের জীবন পাল্টে যাবে। আসুন কিছু উদাহরণ দেখি—  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

আমি অবশ্যই তোমাদেরকে কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবোই — আল-বাক্বারাহ ১৫৫

কু’রআনে এমন  কিছু আয়াত রয়েছে যেগুলো আমাদেরকে জীবনের বাস্তবতা মনে করিয়ে দেয়। কিছু আয়াত রয়েছে যা আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়: আমরা কীভাবে নিজেরাই নিজেদের জীবনটাকে কষ্টের মধ্যে ফেলে দিই। আর কিছু আয়াত রয়েছে যা আমাদেরকে জীবনের সব দুঃখ, কষ্ট, ভয় হাসিমুখে পার করার শক্তি যোগায়। এরকম একটি আয়াত হলো—

2_155_title

2_155আমি অবশ্যই তোমাদেরকে কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবোই: মাঝে মধ্যে তোমাদেরকে বিপদের আতঙ্ক, ক্ষুধার কষ্ট দিয়ে, সম্পদ, জীবন, পণ্য-ফল-ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে। আর যারা কষ্টের মধ্যেও ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে, তাদেরকে সুখবর দাও। [আল-বাক্বারাহ ১৫৫]

আমি অবশ্যই তোমাদেরকে কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবোই

আল্লাহ تعالى শুরু করছেন: وَلَنَبْلُوَنَّكُم بِشَىْءٍ — আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এই দুনিয়াতে কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষা নেবেনই, নেবেন। এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি আরবিতে দুই বার জোর দিয়ে এ কথা বলেছেন। কারো বেলায় সেই পরীক্ষা হয়তো চাকরি হারিয়ে ফেলে অভাবে, কষ্টে জীবন পার করা। কারো বেলায় হয়তো বাবা-মা, স্বামী, স্ত্রী, সন্তানদের জটিল অসুখের চিকিৎসায় দিনরাত সংগ্রাম করা। কারো বেলায় হয়তো নিজেরই নানা ধরনের জটিল অসুখ। কারো বেলায় আবার জমি-জমা, সম্পত্তি নিয়ে আত্মীয়স্বজনদের সাথে শত্রুতা, শ্বশুর-শাশুড়ির অত্যাচার, দুশ্চরিত্র স্বামী, পরপুরুষে আসক্ত স্ত্রী, ড্রাগে আসক্ত ছেলে, পরিবারের মুখে কালিমা লেপে দেওয়া মেয়ে —কোনো না কোনো সমস্যায় আমরা পড়বোই। এই সমস্যাগুলো হচ্ছে আমাদের জন্য পরীক্ষা।

পৃথিবীতে আমরা এসেছি পরীক্ষা দিতে —এটা হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা। হিন্দি সিরিয়াল, মিউজিক, ভিডিও গেম, রংবেরঙের পানীয়, হাজারো বিনোদন সবসময় আমাদেরকে চেষ্টা করে এই বাস্তবতাকে ভুলিয়ে দিতে। আমরা নিজেদেরকে প্রতিদিন নানা ধরনের বিনোদনে বুঁদ করে রেখে জীবনের কষ্ট ভুলে থাকার চেষ্টা করি। আমরা বিনোদনে যতই গা ভাসাই, ততই বিনোদনের প্রতি আসক্ত হয়ে যাই। যতক্ষণ বিনোদনে ডুবে থাকি, ততক্ষণ জীবনটা আনন্দময় মনে হয়। তারপর বিনোদন শেষ হয়ে গেলেই অবসাদ, বিরক্তি, একঘেয়েমি ঘিরে ধরে। ধীরে ধীরে একসময় আমরা জীবনের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠি। “কেন আমার নেই, কিন্তু ওর আছে?” “কেন আমারই বেলায় এরকম হয়, অন্যের কেন এরকম হয় না?” —এই সব অসুস্থ প্রশ্ন করে আমরা আমাদের মানসিক অশান্তিকে জ্বালানী যোগাই। এত যে অশান্তি, তার মূল কারণ হলো: আমরা যে এই জীবনে শুধু পরীক্ষা দিতে এসেছি —এই কঠিন বাস্তবতাটা ভুলে যাওয়া।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

না! তারা জীবিত, বরং তোমরাই তা উপলব্ধি কর না — আল-বাক্বারাহ ১৫৪

আপনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন। সামনে হঠাৎ দেখলেন, দুইজন মস্তান এসে এক মহিলার সাথে অশালীন ব্যবহার করছে। তাঁর জিনিসপত্র কেড়ে নিচ্ছে। তাঁর সম্ভ্রমহানি করছে। আশেপাশে মানুষগুলো দেখেও না দেখার ভান করে যে যার মতো হেঁটে যাচ্ছে। আপনার স্ত্রী রাগে, ঘৃণায় দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, “দিনদিন মানুষ কী পশু হয়ে যাচ্ছে? দিনদুপুরে একজন মহিলার সাথে এরকম হচ্ছে, আর কেউ এগিয়ে আসছে না?” আপনার মাথায় রক্ত উঠে গেল। আপনি শার্টের হাতা গুটিয়ে তাদের দিকে এগোচ্ছেন, আর সাথে সাথে আপনার স্ত্রী আপনাকে শক্ত করে জাপটে ধরে চোখ লাল করে তাকিয়ে বললেন, “কী করছ! তোমার কি মাথা খারাপ নাকি? দেখছ না লোকগুলো মস্তান? আমাকে বিধবা করে দেওয়ার ইচ্ছা আছে নাকি? এই মূহুর্তে বাসায় চলো।”

একদিন হঠাৎ রাস্তায় হইচই শুনে আপনি বাসার বারান্দা দিয়ে নীচে তাকিয়ে দেখলেন, কয়েকজন লোক একজন টুপি-দাড়িওয়ালা লোককে ধরে ব্যাপক পেটাচ্ছে। লোকটা বাঁচাও, বাঁচাও বলে গোঙাচ্ছে, কিন্তু আশেপাশে কেউ এগিয়ে আসছে না। একটু দূরে মানুষজন আড়চোখে দেখে, দ্রুত না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছে। আপনার বাবা-মা আপনার পাশে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছেন, আর আফসোস করছেন, “ইস, দেশটার কী অবস্থা! এরা দিনের বেলা সবার সামনে যা খুশি করে বেড়াচ্ছে, কেউ কিছু বলছে না। সব কাপুরুষ হয়ে গেছে।” আপনি সাথে সাথে হাতে একটা লাঠি নিয়ে নীচে যেতে নিলেন, আর আপনার বাবা-মা চিৎকার করে উঠলেন, “কোথায় যাচ্ছ? খবরদার, ঘরের বাইরে বের হবে না। ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে। আমি তোমার বাবা, আমি বেঁচে থাকতে তোমাকে নীচে যেতে দিবো না।”

একটা সময় ছিল, যখন একদল মানুষ কোনো ধরনের শারীরিক, মানসিক অত্যাচার, মৃত্যুর পরোয়া না করে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে গেছেন, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। স্বামী-স্ত্রী একসাথে যুদ্ধে গেছেন। বাবা-ছেলে একে অন্যের পিঠে পিঠ লাগিয়ে তলোয়ার নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। মা নিজের হাতে ছেলেকে যুদ্ধের পোশাকে সাজিয়ে যুদ্ধ করতে পাঠিয়েছেন। তাদের কারণে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাওয়া একটা জাতির হাত থেকে মানুষ মুক্তি পেয়েছে। তাঁদের আত্মত্যাগের কারণেই আজকে আমরা ইসলাম পেয়েছি, নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবি করতে পারছি। তারা আল্লাহর تعالى কাছে এতটাই সন্মানিত যে, আল্লাহ تعالى তাদেরকে ‘মৃত’ বলতে পর্যন্ত আমাদেরকে কঠিন নিষেধ করেছেন—

2_154_title

2_154আল্লাহর تعالى রাস্তায় যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে, তাদেরকে মৃত বলবে না। না! তারা জীবিত, বরং তোমরাই তা উপলব্ধি কর না। [আল-বাক্বারাহ ১৫৪]

  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

যারা ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে, আল্লাহ অবশ্যই তাদের সাথে আছেন —আল-বাক্বারাহ ১৫৩

আল-বাকারাহ’র এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে জীবনের সকল বিপদ-আপদ, দুঃখ, হতাশাকে হাসিমুখে পার করার জন্য এক বিরাট মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছেন—

2_153_title

2_153যারা বিশ্বাস করেছ, শোনো: ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করো এবং সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। যারা ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে, আল্লাহ تعالى অবশ্যই তাদের সাথে আছেন।  [আল-বাক্বারাহ ১৫৩]

আমাদের জীবনে যখন কোনো বড় বিপদ আসে, কষ্টে চারিদিকে অন্ধকার দেখতে থাকি, তখন মুরব্বিদেরকে বলতে শোনা যায়, “সবুর করো, সব ঠিক হয়ে যাবে।” দেশে-বিদেশে মুসলিমদেরকে মেরে শেষ করে ফেলা হচ্ছে, কু’রআন পোড়ানো হচ্ছে, রাস্তাঘাটে টুপি-দাড়িওয়ালা কাউকে দেখলে পেটানো হচ্ছে, আর মসজিদের ইমামদেরকে জুম্মার খুতবায় বলতে শোনা যাচ্ছে, “সবর করেন ভাই সাহেবরা। সব ঠিক হয়ে যাবে। ইসলামের বিজয় নিকটেই—ইন শাআ আল্লাহ।”

ব্যাপারটা এমন যে, আমরা ধৈর্য নিয়ে চুপচাপ বসে থেকে শুধু নামাজ পড়লেই আল্লাহ تعالى আমাদের হয়ে আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিবেন। এই অত্যন্ত প্রচলিত ভুল ধারণাগুলোর মূল কারণ হচ্ছে ‘সবর’ শব্দের অর্থ ঠিকমত না জানা এবং কু’রআনের এই আয়াতে ব্যবহৃত বিশেষ কিছু শব্দের অর্থগুলো ঠিকমত না বোঝা।

এই আয়াতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ রয়েছে: ১) সবর صبر এবং ২) আস্তাই’-নু أستعين । সবর শব্দটির সাধারণত অর্থ করা হয়: ধৈর্য ধারণ করা। কিন্তু সবর অর্থ মোটেও শুধুই ‘ধৈর্য ধারণ করা’ নয় যে, আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব, অত্যাচার মুখ বুঝে সহ্য করে যাব, অবস্থার পরিবর্তনে কিছুই করব না, এই ভেবে যে, একদিন আল্লাহ تعالى সব ঠিক করে দিবেন। প্রাচীন আরবরা যখন ‘সবর’ বলত, তখন এর মধ্যে কোনো দুর্বলতার ইঙ্গিত ছিল না। প্রাচীন আরব কবি হাতিম আত-তাঈ এর একটি কবিতায়[৭] আছে,

তলোয়ার নিয়ে আমরা তাদের বিরুদ্ধে সবর করলাম, কষ্ট এবং যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেল, স্থির হয়ে গেল।

আরেকটি কবিতা জুহাইর ইবন আবি সুল্মা[৭] এর লেখা—

শক্তিশালী যুদ্ধের ঘোড়ায় চেপে রাজার জামাইরা যুদ্ধের ময়দানে সবর করল, যখন অন্যরা আশা হারিয়ে ফেলেছিল।

উপরের উদাহরণে সবর-এর ব্যবহার দেখলেই বোঝা যায়, সবর মানে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা নয়। সবর এর অর্থ হচ্ছে: প্রতিকূলতার মধ্যে ধৈর্য নিয়ে, লক্ষ্য ঠিক রেখে, অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সুযোগের অপেক্ষা করা।[৫] সবরের তিনটি অংশ রয়েছে: ১) ধৈর্যের সাথে কষ্ট, দুর্ভোগ সহ্য করা, ২) অবস্থার পরিবর্তন করতে গিয়ে কোনো পাপ করে না ফেলা, ৩) আল্লাহর تعالى আনুগত্য থেকে সরে না যাওয়া।[৪] মানুষ সাধারণত সবর বলতে প্রথমটিকেই বুঝে থাকে। কিন্তু একজন মুসলিমের জন্য এই তিনটিই বাধ্যতামূলক। এই তিনটির একটি যদি বাদ যায়, তাহলে তা কু’রআন এবং হাদিসের ভাষায় সবর নয়।[৪]

আস্তা’ই-ন এর অর্থ করা হয়: সাহায্য চাও। কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে: আপনি একা চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারছেন না, আপনি এখন সহযোগিতা চান। যেমন: রাস্তায় আপনার গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। আপনি একা ঠেলে পারছেন না। তখন আপনি রাস্তায় কাউকে অনুরোধ করলেন আপনার সাথে ধাক্কা দেবার জন্য। এটা হচ্ছে আস্তা’ই-ন। কিন্তু আপনি যদি আরামে গাড়িতে এসি ছেড়ে বসে থেকে রাস্তায় কাউকে বলতেন ধাক্কা দিতে, তাহলে সেটা আস্তাই’ন হতো না।[১] একারণেই আমরা সূরা ফাতিহাতে বলি: ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তাই’ন—আমরা যথাসাধ্য চেষ্টার সাথে সাথে আল্লাহর تعالى কাছে সাহায্য চাই।

এই দুটি শব্দ যখন একসাথে হয়: আস্তাইনু বিস-সাবরি أ سْتَعِينُوا۟ بِٱلصَّبْرِ তখন এর মানে দাঁড়ায়: যতই কষ্ট, দুর্ভোগ হোক, অবস্থার পরিবর্তন করতে গিয়ে কোনো পাপ কাজ না করে হালাল উপায়ে চেষ্টা করতে থাকা, নিজের ঈমানকে ঠিক রাখা এবং একই সাথে আল্লাহর تعالى কাছে সাহায্য চাওয়া।

সালাহ (নামাজ) শব্দটির একটি অর্থ হলো ‘সংযোগ’, আর সালাহ’র বহুবচন হলো সালাত। সালাতের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর تعالى সাথে আমাদের সম্পর্ক স্থাপন করি, সবসময় তাঁকে মনে রাখি। আল্লাহ تعالى আমাদেরকে দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ একারণেই দিয়েছেন, যেন আমরা কাজের চাপে পড়ে, হিন্দি সিরিয়াল আর  খেলা দেখতে গিয়ে বা রাতভর ভিডিও গেম খেলতে গিয়ে তাঁকে ভুলে না যাই। কারণ তাঁকে ভুলে যাওয়াটাই হচ্ছে আমাদের নষ্ট হয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপ। যখনি আমরা আল্লাহকে تعالى একটু একটু করে ভুলে যাওয়া শুরু করি, তখনি আমরা আস্তে আস্তে অনুশোচনা অনুভব না করেই খারাপ কাজ করতে শুরু করি। আর এখান থেকেই শুরু হয় আমাদের পতন।

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন তার কিছু উদাহরণ দেই—

আপনি অনেক চেষ্টা করেও একটা ব্যবসা ধরতে পারছেন না। মাত্র কয়েক লাখ টাকা ঘুষ দিতে না পারার জন্য কাজটা আপনার হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু না, আপনি ঘুষ দেবেন না, মামা-চাচা ধরবেন না, মন্ত্রীকে একটা ফ্লাট কিনে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে তদবির করবেন না।  আপনি ধৈর্য ধরে, কোনো পাপ না করে, নামাজে আল্লাহর تعالى কাছে সাহায্য চাইবেন এবং একই সাথে চেষ্টা করতে থাকবেন: অন্য কোনো হালাল উপায়ে এগোনো যায় কি না। যদি শেষ পর্যন্ত কোনো হালাল উপায়ে ব্যবসাটা না-ও হয়, ভালো কথা, অন্য কিছুর জন্য চেষ্টা করবেন। আল্লাহর تعالى উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখবেন যে, আপনার ভালোর জন্য আল্লাহ تعالى আপনাকে সেই ব্যবসাটা করতে দিতে চাননি অথবা আপনার ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করা হয়েছে মানুষের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য।

আপনার বাচ্চার ১০৪ ডিগ্রি জ্বর। আপনি তার মাথায় পানি না ঢেলে, তাকে ডাক্তার না দেখিয়ে, জায়নামাজে বসলেন আল্লাহর تعالى কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য—এটা এই আয়াতের শিক্ষা নয়। আপনি বাচ্চার চিকিৎসার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন, আর নামাজে বারবার আল্লাহর تعالى কাছে সাহায্য চাইবেন—এটাই এই আয়াতের শিক্ষা। আবার অনেকে বাচ্চার কঠিন অসুখ হলে এবং অনেক চেষ্টার পরও অসুখ ভালো না হলে, আল্লাহর تعالى উপর রাগ করে নামাজ পড়া ছেড়ে দেন, “কেন আমার বাচ্চারই এই কঠিন অসুখটা হবে? আমি কী অন্যায় করেছি? ওই ঘুষখোর চৌধুরী সাহেবের বাচ্চার কিছু হয় না কেন?”—ঠিক এই কাজটা করতেই এই আয়াতে মানা করা আছে।

দেশে ইসলামের দুর্দিন যাচ্ছে, মুসলিমদের ধরে মেরে ফেলা হচ্ছে, মসজিদে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আপনার টুপি-দাড়ি বা হিজাব দেখে একদিন আপনাকে রাস্তায় কিছু বখাটে যুবক ধরে মারধোর করল, আর আপনি ঘরে বসে শুধুই আল্লাহর تعالى কাছে কান্নাকাটি করছেন, যেন আল্লাহ تعالى দেশের অবস্থার পরিবর্তন করে দেন, আবার দেশের মুসলিমদেরকে ক্ষমতা দিয়ে দেন, দেশে ইসলামের রাজত্ব কায়েম করে দেন—এটা এই আয়াতের শিক্ষা নয়। এই আয়াতের শিক্ষা হচ্ছে: আপনার প্রতিবাদ করার সুযোগ থাকলে, আপনি ন্যায় বিচার পাবার জন্য পুলিশের কাছে যাবেন, দরকার হলে সেই যুবকগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করবেন। যতদিন ন্যায় বিচার না পাচ্ছেন: চেষ্টা চালিয়ে যাবেন, কয়েকজনের সাহায্য নিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করবেন, পত্রিকায় লেখালেখি করবেন এবং একই সাথে প্রতিদিন আল্লাহর تعالى কাছে নামাজে সাহায্য চাইবেন। কিন্তু কখনই প্রতিশোধ নেওয়ার মনোভাব থেকে কু’রআনের বিরুদ্ধে যায়, এমন কোনো কাজ করে ফেলবেন না। যেমন, বোমাবাজি, রাস্তায় নিরীহ মানুষের গাড়ি ভাঙা, নিরীহ মানুষের জীবনে সমস্যার সৃষ্টি করা ইত্যাদি কু’রআনের শিক্ষার বিরোধী কোনো কাজ করবেন না। আল্লাহর تعالى উপর ভরসা রাখবেন যে, তিনি একদিন না একদিন ন্যায় বিচার করবেনই, সেটা এই দুনিয়াতে না হলে, আখিরাতে অবশ্যই হবে।

আয়াতের শুরুটা খুব গুরুত্বপূর্ণ: يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ — “যারা ঈমান এনেছ, শোনো।” আল্লাহ تعالى এখানে বিশেষভাবে ঈমানের সাথে সবর এবং সালাতকে জুড়ে দিয়েছেন। কারণ যারা ঈমান আনেন, তাদেরকে প্রতিনিয়ত সবরের পরিচয় দিতে হয়। আমরা যারা ইসলাম মেনে চলার চেষ্টা করি, আমাদের সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে অনেক সময় আমাদের কাছের মানুষরা আমাদের মনের এমন সব দুর্বল জায়গায় আঘাত করে, এমন সব খারাপ কাজ করে, যার জন্য আমরা ভেতরে ভেতরে জ্বলে পুড়ে মরি। আমরা ইচ্ছা করলেই এমন এক চরম প্রতিশোধ নিতে পারি যে, এর পরে ওরা আর কোনোদিন আমাদের সাথে এরকম করার কথা চিন্তাও করবে না—শুধু দরকার একটুখানি অন্যায় করা, ইসলামের গণ্ডির বাইরে এক পা দেওয়া। কিন্তু আল্লাহর تعالى কথা মনে রেখে আমরা তা করি না। ঈমান নষ্ট করার ঝুঁকি নিই না। রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে অস্থির হয়ে এপাশ-ওপাশ করতে থাকি, মনে মনে রিহার্সাল করতে থাকি: একটা উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য কী কী বলা যায়, কী কী করা যায়—কিন্তু পরদিন ঠিকই নিজেকে সংবরণ করি, যেন এমন কোনো কিছু করে না ফেলি, যার জন্য আল্লাহকে تعالى জবাব দিতে পারব না —এটা সবরের লক্ষণ।

আল-বাক্বারাহ’র এই আয়াতে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভারসাম্য শিখতে পারি: বিপদে পড়লে আল্লাহর تعالى কাছে ধৈর্যের সাথে চেষ্টা এবং নামাজ —এই দুটোর মাধ্যমেই সাহায্য চাইতে হবে। এর একটিও বাদ দিলে হবে না। আর যারা ধৈর্য ও নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে, আল্লাহ تعالى তাদের সাথে থাকবেন বলে তিনি কথা দিয়েছেন।

আমরা অনেক সময় জীবনে দুঃখ-কষ্টে পড়লে একাকী অনুভব করি, নিজেকে অসহায় ভাবি। মনে মনে হাহাকার করি, “কেউ কি নেই যার কাছে গিয়ে একটু মনের কষ্টের কথা বলতে পারি, একটু বুকটা হালকা করতে পারি?” —এর উত্তর আল্লাহ تعالى দিয়েছেন:

যারা ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা (সবর) করে, আল্লাহ تعالى অবশ্যই তাদের সাথে আছেন।

আমরা যখন সবর করছি, তিনি আমাদের পাশে আছেন। আমাদের কখনো একাকী অনুভব করার, নিজেকে নিরুপায়, অসহায় মনে করার কোনো কারণ নেই, কারণ আল্লাহ تعالى অবশ্যই আছেন আমাদের পাশে। আমরা যে কোনো সময় নামাজে দাঁড়িয়ে, তাঁর সামনে মাথা নত করে বুকের ভেতর জমে থাকা সব দুঃখ, কষ্ট, অপমান, হতাশা উজাড় করে দিতে পারি। তিনি অবশ্যই তা শুনবেন। তিনি আস-সামি’: সব কিছু শোনেন। আমরাই বরং তাঁর সাথে কথা বলি না।

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
  • [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
  • [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
  • [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
  • [১৫] তাফসির আল জালালাইন।