এরাই হচ্ছে তারা, যাদের জন্য বিশেষভাবে তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে অভিবাদন এবং অনুগ্রহ — আল-বাক্বারাহ ১৫৬-১৫৭

আমাদের জীবনে প্রায়ই কষ্ট, দুর্দশা আসে। তখন আমরা অনেকেই দিশেহারা হয়ে যাই। কাউকে তখন ভাগ্য, যোগ্যতার অভাব অথবা কপালকে দোষ দিতে দেখা যায়। আবার কারো বেলায় সেটা অন্য কারো দোষ: সমাজের দোষ, দেশের দোষ, সরকারের দোষ, না হলে বউয়ের দোষ। অনেককে আবার নানা ধরনের দার্শনিক প্রশ্ন করতে দেখা যায়: “আমার কেন এরকম হলো? আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, সারাজীবন মানুষের সেবা করেছি। তাহলে আমার কপালে এত দুঃখ-কষ্ট কেন?”

—এধরনের আহাজারি, দোষারোপ করে কোনো লাভ হয় না। বরং নেতিবাচক কথা এবং চিন্তা আমাদের মানসিক অবস্থাকে আরও খারাপ করে দেয়। নিজের ভেতরের তিক্ততা অন্যের মধ্যেও ছড়িয়ে দেয়। অন্যদের জন্য সে তখন মানসিক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যরা তখন তাদের মন খারাপ হয়ে যাওয়ার ভয়ে এই ধরনের মানুষদের এড়িয়ে চলে।

অথচ একজন মুসলিমের কখনোই এভাবে চিন্তা করার কথা না। মুসলিমদের যে ধরনের মানসিকতা থাকার কথা, যা থাকলে একজন মুসলিম যে কোনো বিপদ, কষ্টের সময় হাসিমুখে পার করতে পারে, তা আল্লাহ تعالى এই দুটি আয়াতে আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছেন—

2_156_157_revised

2_156_157দুর্দশা আঘাত করলে যারা সাথে সাথে বলে, “আমরা তো আল্লাহরই تعالى সম্পত্তি, আর অবশ্যই আমরা আল্লাহর تعالى কাছেই ফিরে যাচ্ছি।” এরাই হচ্ছে তারা, যাদের জন্য বিশেষভাবে তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে অভিবাদন এবং অনুগ্রহ। আর এরাই তারা, যারা সঠিক পথ পেয়ে গেছে। [আল-বাক্বারাহ ১৫৬-১৫৭]

আমরা অনেকেই মুখে ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ বলি, কিন্তু উপলব্ধি করি না কত বড় একটা কথা আমরা বলছি। এর অর্থ: “আমরা তো আল্লাহরই تعالى সম্পত্তি, আর আল্লাহর تعالى কাছেই আমরা ফিরে যাবো।” আমরা যদি এই কথাটির উদ্দেশ্য আত্মস্থ করতে পারি, তাহলে আমাদের জীবন পাল্টে যাবে। আসুন কিছু উদাহরণ দেখি—

গত আট বছর থেকে হাসান বেকার। রাস্তায় রাস্তায় চাকরির জন্য ঘুরে জুতা ছিঁড়ে গেছে, কিন্তু একটা সুযোগও পাওয়া যায়নি। বাড়ি ফিরে প্রতিদিন গরিব বাবা-মাকে জোর করে হাসি দিয়ে সান্ত্বনা দিতে হয়। স্ত্রীর কাছ থেকে, “তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না”, “আমার বান্ধবীর স্বামী চাকরি করতে পারলে, তুমি পারো না কেন” —এই সব কথা সহ্য করতে হয়। প্রতিদিনের এই অসহ্য অপমান, বন্ধুদের নতুন গাড়ি-বাড়ি, ফেইসবুকে তাদের পরিবারদের নিয়ে দেশের বাইরে বেড়াতে যাওয়ার ছবি; জন্মদিন, বিয়ের অনুষ্ঠানে তাদের খুশির ফোয়ারা —এই সব দেখতে দেখতে হাসানের ভেতরটা একেবারে ভেঙ্গে গেছে। তার এই অসহ্য জীবনটা আর বয়ে বেড়াতে ইচ্ছা করে না।

একদিন দুপুরে জানালার পাশে বসে, আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসান চিন্তা করছে: “এই জীবনটা রেখে কী লাভ? বছরের পর বছর অকর্মা হয়ে, বাবা-মা, স্ত্রীর ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকার জন্য কি আমি বিশ বছর পড়াশুনা করেছি? আমার মত একটা আবর্জনা এই পৃথিবী থেকে চলে গেলে কার কী যায় আসে? কালকে যদি আমি বিষ খেয়ে মারা যাই, কারো কিছু যাবে আসবে না। ফেইসবুকে আমার মৃত্যুর খবর বন্ধুরা প্রচার করবে। দুই চারজন লাইক দিবে, ব্যাস শেষ। দাঁড়াও, আজকে রাতেই আমি…”

ঠিক তখনি তার মনে পড়লো—

দুর্দশা আঘাত করলে যারা সাথে সাথে বলে, “আমরা তো আল্লাহরই تعالى সম্পত্তি, আর অবশ্যই আমরা আল্লাহর تعالى কাছেই ফিরে যাচ্ছি।” এরাই হচ্ছে তারা, যাদের জন্য তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে অভিবাদন এবং অনুগ্রহ। আর এরাই তারা, যারা সঠিক পথ পেয়ে গেছে।

হাসান বুঝতে পারলো, সে আসলে আল্লাহর تعالى সম্পত্তি। আল্লাহ تعالى তাকে দুনিয়াতে যেভাবে রাখতে চেয়েছেন, যেসব সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা দিতে চেয়েছেন, সে ঠিক সেগুলোই পেয়েছে। একইভাবে তার বাবা-মা, পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন — তারা সবাই আল্লাহর تعالى সম্পত্তি। আল্লাহ تعالى তাঁর সম্পত্তিকে কীভাবে রাখবেন, কী সুযোগ সুবিধা দেবেন, কী অসুবিধায় রাখবেন —সেটা সম্পূর্ণ তাঁর تعالى ইচ্ছা। এখানে সে অভিযোগ করার কে? বরং আল্লাহর تعالى সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এসব আজেবাজে চিন্তা করে, তারপর যখন তাঁর সামনে দাঁড়াবো, তখন তাঁকে কী জবাব দেবো?

আরেকটি ঘটনা দেখি—

আব্দুল্লাহ সাহেব আইসিইউ-তে তার সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চার ইউনিটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তার বাচ্চার নাকে নল, বুকে নল, সারা শরীরে তার জড়ানো। বাচ্চার নষ্ট হয়ে যাওয়া হৃৎপিণ্ডকে কোনোভাবে চালিয়ে রাখা হয়েছে। ডাক্তাররা বলেছেন, এভাবে যতদিন বাঁচিয়ে রাখা যায়, কিন্তু বাচ্চার আর সুস্থ হয়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি যেন মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেন।

আব্দুল্লাহ সাহেব পাথরের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার শিশুটির দিকে। তার মনে অজস্র চিন্তা চলছে, “এরকম একটা নিষ্পাপ বাচ্চার কেন এত কষ্ট? আমি জীবনে কী এত বড় পাপ করেছিলাম যে, আমার সাথেই এরকম হলো? আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, রমজানে রোজা রাখি। তারপরেও আমার সাথেই এরকম কেন হলো? ইসলাম ধর্ম আসলেই সত্যি ধর্ম তো?”

ঠিক তখনি তার মনে পড়লো—

দুর্দশা আঘাত করলে যারা সাথে সাথে বলে, “আমরা তো আল্লাহরই تعالى সম্পত্তি, আর অবশ্যই আমরা আল্লাহর تعالى কাছেই ফিরে যাচ্ছি।” এরাই হচ্ছে তারা, যাদের জন্য তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে অভিবাদন এবং অনুগ্রহ। আর এরাই তারা, যারা সঠিক পথ পেয়ে গেছে।

আব্দুল্লাহ সাহেব ভেবে দেখলেন, তিনি যে বাচ্চাটাকে নিয়ে এত কিছু ভেবে চলেছেন, সে বাচ্চাটাকে তো তিনি তৈরি করেননি। এই বাচ্চাটা তো আল্লাহর تعالى সম্পত্তি। আল্লাহ تعالى তাঁর সম্পত্তিকে নিয়ে কী করবেন, সেটা সম্পূর্ণ তাঁর ইচ্ছে। এখানে আব্দুল্লাহ সাহেবের বলার কিছুই নেই। এই বাচ্চাটা তো একদিন না একদিন আল্লাহর تعالى কাছে ফিরে যেতই, সেটা আজ হোক, কাল হোক, আর সত্তর বছর পরেই হোক না কেন। আল্লাহ تعالى তার এই সম্পত্তিকে পৃথিবীতে কয়েকদিন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এখানে তিনি অভিযোগ করার কে?

বরং তিনি নিজেই তো আল্লাহর تعالى সম্পত্তি। এই বাচ্চাটার মতো তাকেও তো আল্লাহর تعالى কাছে ফেরত যেতে হবে। তাকে আল্লাহ تعالى জীবনে কী পরীক্ষা দেবেন, কীভাবে রাখবেন, এগুলো সবই তাঁর ইচ্ছা। সুতরাং এসব অপ্রীতিকর, অসম্মানজনক চিন্তা করে কোনো লাভ নেই। বরং আমার জীবনের এই ঘটনাটাকে একটা পরীক্ষা হিসেবে নিয়ে, পরীক্ষাটা কীভাবে পাশ করা যায়, সেই চিন্তা করতে হবে। না হলে আল্লাহ تعالى যখন আমাকে তাঁর কাছে ফেরত নেবেন, তখন কীভাবে তাঁকে মুখ দেখাবো?

আসাবা এবং মুসিবা

এই আয়াতে দুটো গুরুত্বপূর্ণ শব্দ রয়েছে: أَصَٰبَ  আসাবা এবং مُصِيبَ মুসিবাহ। এই দুটো শব্দই এসেছে صوب থেকে, যার অর্থ হচ্ছে একদম জায়গা মতো আঘাত করা, যেমন বর্শা ছুঁড়ে লক্ষ্যভেদ করা। এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়। কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। সময় মতো নিশানা করে জায়গা মতো আঘাত করা।[১]

আসাবা হচ্ছে বিপদ, দুর্দশা আঘাত করা, একদম সময়মত, জায়গা মতো।[১] আর মুসিবাহ হচ্ছে আল্লাহর تعالى পক্ষ থেকে আসা যে কোনো কষ্ট, বিপদ, দুর্দশা, যা কোনো মানুষের জীবনে কোনো ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে।[১৪] এটি কোনো দুর্ভাগ্য নয়। ‘দুর্ভাগ্য’, ‘হতভাগা’, ‘পোড়া কপাল’, ‘অশুভ’, ‘কু’ বলে কিছু ইসলামে নেই। আল্লাহ تعالى কাকে কী বিপদ, কষ্ট, সমস্যা দেবেন, তা তিনি নিজে পরিকল্পনা করেন। যারা এটা ঠিক মতো উপলব্ধি করতে পারেন, তাদের জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। তারা আর তাদের জীবনটাকে বিধর্মী বা নাস্তিকদের মতো করে দেখেন না।

যারা এই আয়াতের অর্থ ঠিকভাবে বুঝবেন, তারা কখনো তাদের পরিবারে সমস্যার জন্য একে অন্যকে দোষারোপ করবেন না। কোনো শাশুড়ি তার বউকে ছেলে সন্তান জন্ম না দেওয়ার জন্য দোষ দেবেন না। কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে চাকরি হারানোর জন্য দায়ী করবেন না। কোনো স্ত্রী তার সন্তানদের পেট খারাপের জন্য কাজের লোককে দোষ দেবেন না। যে কোনো ধরনের মুসিবাহ’য় পড়লে, অন্য কারো দোষ খোঁজার আগে নিজে ভেবে দেখবেন, “আল্লাহ تعالى আমাকে এই মুসিবাহ দিলেন, নিশ্চয়ই আমার কোনো গুনাহের কারণে, বা আমি কোনো ভুল করে যাচ্ছি, যা আমার জলদি ঠিক করা দরকার? আমি কী ভুল করছি?”

আপনার কোনো জটিল অসুখ হলো? আপনি ভাবছেন আপনি দুর্ভাগা? পোড়াকপালে? না। ঠিক যেই দিন, যেভাবে আপনার জটিল অসুখ শুরু হওয়ার নির্দেশ আল্লাহ تعالى দিয়েছিলেন, ঠিক সেদিন থেকে সেভাবেই তা শুরু হয়েছে। আপনার অসুখটা আল্লাহ تعالى আপনাকে ঠিক সেভাবেই দেবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন। এখানে কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নেই, কোনো ভাগ্য জড়িত নেই। কোনো বংশগত বা জেনেটিক ব্যাপার নেই, কারণ আপনাকে সেই জিন দিয়ে আল্লাহই تعالى ডিজাইন করেছেন। সব কিছুই আল্লাহর تعالى পরিকল্পনা।

—এসব কথা বলা সহজ, কিন্তু দুঃখ, দুর্দশার সময় এগুলো মনে রাখা এবং এই আয়াত অনুসারে আমল করা খুবই কঠিন। এর জন্য অনেক মানসিক ট্রেনিং দরকার। হঠাৎ করে কেউ তা অর্জন করে না। যথেষ্ট পূর্বপ্রস্তুতি নিতে হয়। প্রতিবার বিপদে পড়ার সময় নিজেকে সংশোধন করতে হয়। কোনো কষ্টের সময় পার হয়ে গেলে, কঠিন দিনগুলোর কথা মনে করে, কী কী ভুল হয়েছিল, আল্লাহর সম্পর্কে কী কী বাজে কথা ভেবেছিলাম, যা ভবিষ্যতে আর করা যাবে না, তা নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করতে হয়। একারণেই যারা এই মানসিক অবস্থায় যেতে পেরেছেন, আল্লাহ تعالى তাদের এই অর্জনকে এত সম্মান করেছেন।

এরাই হচ্ছে তারা, যাদের জন্য তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে অভিবাদন এবং অনুগ্রহ

আল্লাহ تعالى বলছেন, أُو۟لَٰٓئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَٰتٌ مِّن رَّبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ — এরাই হচ্ছে তারা, যাদের উপর বিশেষভাবে তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে ‘সালাওয়াত’ এবং ‘রাহমাহ’। সবাই এই সালাওয়াত পাবে না। বরং যারা বিপদে পড়ে ঈমান বজায় রেখে বলতে পেরেছে, “আমরা তো আল্লাহরই تعالى সম্পত্তি, আর অবশ্যই আমরা আল্লাহর تعالى কাছেই ফিরে যাচ্ছি” —এবং সেই অনুসারে নিজেদের কথা, কাজ, চিন্তাভাবনাকে পরিমার্জন করেছে, আল্লাহ تعالى তাদেরকেই বিশেষভাবে সালাওয়াত এবং রাহমাহ দেবেন।

আল্লাহর تعالى কাছ থেকে কোনো বান্দার সালাওয়াত বা অভিবাদন, ক্ষমা, সম্মান, প্রশংসা[১৪] পাওয়া একটা বিরাট ব্যাপার। আল্লাহ تعالى নবী, রাসূলদের উপর সালাওয়াত পাঠান, কারণ তারা মহাসম্মানিত। যদিও তাদের ত্যাগ ও অর্জিত যোগ্যতার সাথে আমাদের ত্যাগ ও অর্জিত যোগ্যতার কোনো তুলনাই হয় না। তারপরেও এই আয়াতে আমরা দেখতে পারছি যে, যে সব বিশ্বাসীরা নিজেদেরকে কঠিন ট্রেনিং দিয়ে এই অবস্থায় নিয়ে যেতে পেরেছেন, তাদের উপরও আল্লাহ تعالى সালাওয়াত দেন। স্বয়ং স্রষ্টার কাছ থেকে সালাওয়াত পাওয়ার মতো বড় সম্মান আর কিছু হতে পারে না।

প্রশ্ন আসতে পারে: যারা কষ্টে আছে তাদের উপর আবার রাহমাহ বা অনুগ্রহ কীভাবে? আল্লাহ تعالى এদেরকে মুসিবাহ দিয়েছেন, কারণ তিনি এদের সম্মানকে আরও উপরে তুলে দিতে যান। জান্নাতে যাওয়ার পথ অনেক সহজ করে দিতে চান।[১] বিরাট এক সাফল্য তারা অর্জন করতে যাচ্ছে। এটা আল্লাহর تعالى পক্ষ থেকে একটা অনুগ্রহ। কারণ কেউ যদি প্রতিবছর মুসিবাহ-তে না পড়ে, তাহলে বরং সেটা দুশ্চিন্তার বিষয়! নিশ্চয়ই আমরা মহামানব নই যে, আমাদের জীবনে যথেষ্ট পাপ নেই, যার জন্য আমাদের ক্ষমা অর্জন করা দরকার? নিশ্চয়ই আমরা অতিমানব নই যে, আমরা প্রতিদিন কোনো না কোনো ভুল করছি না, বা কোনো অন্যায় করছি না? তাহলে আমার জীবনে মুসিবাহ আসছে না কেন? সর্বনাশ, আল্লাহ تعالى আমার জন্য জাহান্নাম অবধারিত করে দেননি তো?

মুসিবাহ’র মাধ্যমে আল্লাহ تعالى মানুষের গুনাহ মাফ করার ব্যবস্থা করে দেন।[১৪] যে যত কঠিন মুসিবাহ’র মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তার তত গুনাহ মাফ হয়ে যাচ্ছে, মুসলিমদের মধ্যে তার সম্মান তত উপরে উঠছে, তার জন্য জান্নাত পাওয়া তত সহজ হয়ে যাচ্ছে। একারণে বিপদে পড়লে দিশেহারা, হতাশ না হয়ে বরং নিজেকে বোঝানো উচিত যে, এই বিপদের মাধ্যমে আমার গুনাহ মাফ হচ্ছে এবং আমার জন্য জান্নাত পাওয়া আরও সহজ হয়ে যাচ্ছে। আমার প্রভু কোনো কারণে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, এভাবে তিনি আমার গুনাহ মাফ করার ব্যবস্থা করে দেবেন। হতে পারে আমি নিজের গুনাহ মাফ করার জন্য যথেষ্ট করিনি। হতে পারে আমি জীবনে অনেক গুনাহ করেছি, অনেক মানুষের ক্ষতি করেছি, যা আমি ভুলে গেছি। তাই তিনি আমার ভালোর জন্যই আমার গুনাহ মাফের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন।

অনেক সময় আমরা নিজেদেরকে অনেক সাধু মনে করি। ভাবি যে, আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, যাকাত দেই, পরিবারের জন্য খাটতে খাটতে জীবন শেষ, আমার আবার গুনাহ কীসের? কিন্তু ভালো করে খোঁজ নিলে দেখা যাবে: আমরা জীবনে এত অন্যায় করেছি যে, আমাদের আমলনামা দেখে ইবলিসও অনেক সময় লজ্জা পেয়ে যাবে। এক গীবতের হিসেব যদি করা হয়: শত শত ফোনে করা গীবত, পার্টিতে আত্মীয়দের সাথে করা গীবত, অফিসে নিজের প্রমোশনের জন্য কলিগদের বিরুদ্ধে করা গীবত, এক বন্ধুর কাছে অন্য বন্ধুর নামে কথা লাগিয়ে দেওয়া, স্বামী, স্ত্রী, সন্তান, শ্বশুর, শাশুড়ির, দেবর, জা, ননদের নামে গীবত, গল্পচ্ছলে করা গীবত  —এক গীবতের হিসেবেই আমাদের দফারফা হয়ে যাবে।

তারপরে যদি আমাদের সম্পত্তির হিসেব নেওয়া হয়, তাহলে অনেকেরই সর্বনাশ হয়ে যাবে। লক্ষ টাকার ট্যাক্স ফাঁকি। লক্ষ টাকার ব্যাংকের সুদ। ঘুষ দিয়ে হাতানো চাকরি, প্রমোশন। মামা-চাচা-খালুর অন্যায় তদবির করে নেওয়া চাকরি, প্রমোশন। অধীনস্থ কর্মচারীদের গ্রামে ট্রান্সফার করে তাদের জীবন বরবাদ করে দিয়ে, নিজের আত্মীয়স্বজনদের শহরে ট্রান্সফার। উপর লেভেলের সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখতে গিয়ে প্রজেক্ট যাকে দেওয়ার কথা, তাকে না দিয়ে, অন্য কোনো অযোগ্যকে দেওয়া। যাকে সহ্য করি না, তাকে নানা ধরনের ফাঁদে ফেলে চাকরি থেকে বের করে দেওয়া। আর যে আমাকে নিয়মিত তেল দেয়, তার জন্য নিত্যনতুন সুযোগের ব্যবস্থা করে প্রমোশন দেওয়া। —এরকম অনেক বড় বড় অন্যায় আমরা প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছি এই ভেবে যে, “সবাই তো করছে, তাহলে আমি না করলে আর কী বা যায় আসে? আজকাল এগুলো না করলে টেকা যায় না।”

আল্লাহ تعالى আমাদেরকে মুসিবাহ দেন হয় আমাদের শাস্তি হিসেবে, না হয় মুসিবাহ আসে আমাদের ভুলের কারণে। যে কারণেই মুসিবাহ আসুক না কেন, আমাদের কাজ হচ্ছে নিজেকে সংশোধন করা, ঈমান বজায় রেখে সবরের সাথে মুসিবাহ পার করা। যারা তা করবে—

আর এরাই তারা, যারা সঠিক পথ পেয়ে গেছে

এরা সঠিক পথ পেয়ে গেছে। এদের আর কোনো চিন্তা নেই। কারণ তারা ٱلْمُهْتَدُونَ আল-মুহতাদুন — স্থায়ীভাবে হুদা অর্থাৎ সঠিক পথনির্দেশ পেয়ে গেছে। কী সৌভাগ্যবান তারা! আল্লাহ تعالى তাদেরকে অভিবাদন, সম্মান, কল্যাণ, অনুগ্রহ দিয়েছেন, স্থায়ীভাবে সঠিক পথে চলার সম্মান দিয়েছেন। একজন মুসলিমের জন্য এরচেয়ে বেশি চাওয়ার আর কী থাকতে পারে?

সুত্র:

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
  • [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
  • [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
  • [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
  • [১৫] তাফসির আল জালালাইন।

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *