অনেকে আছে যারা শুধুই চায়, “ও রব্ব, আমাদেরকে দুনিয়াতে দিন” — আল-বাক্বারাহ ২০০-২০২

আমরা যখন হাজ্জ করতে যাই, আমাদের উদ্দেশ্য থাকে কীভাবে আমরা আল্লাহকে تعالى খুশি করতে পারি, যেন তিনি আমাদেরকে জান্নাত দেন। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, অনেকে হাজ্জে যান, কারণ তার দুনিয়াতে অনেক কিছু দরকার, এবং তিনি শুনেছেন হাজ্জে গিয়ে চাইলে নাকি সব পাওয়া যায়। যার ফলে তার হাজ্জে যাওয়াটা হয়ে যায়, মন্ত্রীর কাছে গিয়ে তদবির করার মতো একধরনের তদবির অনুষ্ঠান। হাজ্জে গিয়ে তার দু’আ হয়, “ও আল্লাহ, تعالى আমার ব্যবসাটা ভালো করে দিন, আমাকে চাকরিতে প্রমোশন দিন। আমাকে একটা বাড়ি কিনতে দিন। আমার ছেলেমেয়েকে বিদেশে পাঠাতে দিন। আমার জমিগুলোকে নিরাপদ রাখুন। আমার স্ত্রীর অত্যাচার দূর করে দিন। আমার ডায়াবেটিস ঠিক করে দিন।…” —অবশ্যই এগুলো চাওয়াটা দোষের নয়, কিন্তু আমাদেরকে বুঝতে হবে: এই মহাবিশ্বে আমাদের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য কী। কেন আমাদেরকে সৃষ্টি করে এই পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। আমরা যদি দুনিয়ার পেছনে দৌড়াতে গিয়ে এই বিরাট ব্যাপারটাকে বেশি গুরুত্ব না দেই, ভুলে যাই, হাজ্জের মতো এত বড় একটা সুযোগ পেয়েও উপলব্ধি না করি, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, কারণ আল্লাহ تعالى বলেছেন—

2_200

হাজ্জের অনুষ্ঠানগুলো শেষ করার পর, আল্লাহকে تعالى বেশি করে মনে করবে, যেভাবে তোমাদের বাপদাদাদের মনে করো। না, বরং তারচেয়ে বেশি করে! কারণ অনেকে আছে যারা শুধুই চায়, “ও রব্ব, আমাদেরকে দুনিয়াতে দিন” —এদের জন্য পরকালে বিন্দুমাত্র কোনো ভাগ থাকবে না। [আল-বাক্বারাহ ২০০]

আগেকার আমলে হাজ্জ শেষ হওয়ার পর হাজ্জিরা একসাথে বসে তাদের বাপ-দাদাদের কৃতিত্ব নিয়ে গল্প করতো —কে কবে কাকে কত খাইয়েছে, কত সাহায্য করেছে, কত জমিজমা করেছে, কত যুদ্ধ করেছে, কত বীর পদক পেয়েছে ইত্যাদি।[১২][১৪][৬] আজকের দিনে আমরা বাপ-দাদাদের নিয়ে এভাবে গর্ব করি না। আমাদের গল্পগুলো হয়ে গেছে: কার বাবা মন্ত্রী, কার দাদা জমিদার ছিলেন, কে সৈয়দ বংশের, কার চাচা হাজ্জ কাফেলার চেয়ারম্যান ইত্যাদি। হাজ্জের মতো এত মূল্যবান সময়গুলো আমরা পার করি এসব খোশ গল্প করে।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

বুদ্ধিমানেরা: আমার প্রতি সাবধান! — আল-বাক্বারাহ ১৯৬-১৯৯

সূরা আল-বাক্বারাহ’র ধারাবাহিক এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ عز وجل আমাদেরকে হাজ্জের সম্পর্কে শিক্ষা দেবেন, যেগুলো শুধু হাজ্জেই নয়, বরং প্রতিটি মুসলিমের জন্য সারাজীবনের শিক্ষা—

2_196

তোমরা হাজ্জ এবং উমরা ঠিকভাবে সম্পন্ন করো আল্লাহর উদ্দেশ্যে । কিন্তু যদি তা করতে বাঁধা পাও, তাহলে তোমাদের জন্য যা সহজ, তা কুরবানি করো। আর যতক্ষণ না কুরবানি যথাস্থানে না পৌঁছায়, ততক্ষণ পর্যন্ত মাথা কামাবে না। তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ থাকলে, বা মাথার ত্বকে কষ্ট থাকলে, সে তার বদলে রোজা রাখবে, বা দান করবে, অথবা কুরবানি করবে। তারপর যখন তোমরা নিরাপদ অবস্থায় যাবে, তখন যদি কেউ একসাথে উমরা এবং হাজ্জ করে শেষ করতে চায়, তাহলে তার জন্য সহজ এমনকিছু সে কুরবানি করবে। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে সে হাজ্জের সময় তিন দিন রোজা রাখবে, এবং বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর সাতদিন রোজা রাখবে, এভাবে মোট দশদিন হবে। —এই নিয়মগুলো তাদের জন্য, যাদের নিকটজনেরা মাসজিদুল হারামের আশেপাশে বসবাস করে না। আল্লাহর প্রতি সাবধান থাকো, আর জেনে রেখো: আল্লাহ খুবই কঠিন শাস্তি দেন। [আল-বাক্বারাহ ১৯৬]

তোমরা হাজ্জ এবং উমরা ঠিকভাবে সম্পন্ন করো আল্লাহর عز وجل উদ্দেশ্যে

এখানে আল্লাহ عز وجل বিশেষভাবে বলছেন যে, হাজ্জ এবং উমরা করো আল্লাহর عز وجل উদ্দেশ্যে। আল্লাহ عز وجل শুধুই আমাদেরকে বলতে পারতেন, ‘হাজ্জ এবং উমরা ঠিকভাবে সম্পন্ন করো’। কিন্তু তিনি যোগ করেছেন, “আল্লাহর عز وجل উদ্দেশ্যে”। প্রশ্ন আসে, আল্লাহ عز وجل ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্যে কি হাজ্জ বা উমরা হয়?

চৌধুরী সাহেব বুঝতে পারলেন, এলাকার মানুষের কাছে তার জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য এবং আগামী ইলেকশনে জেতার জন্য তার নামের আগে ‘আলহাজ্ব’ লাগানোটা জরুরি হয়ে পড়েছে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী গতবার ইলেকশনের আগে হাজ্জ করে এসে, আলহাজ্ব টাইটেল লাগিয়ে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে গেছে। মানুষ কেন জানি তার আলহাজ্ব উপাধি দেখেই তার উপর বেশি ভরসা করা শুরু করে দিয়েছে। ইলেকশনের পোস্টারগুলোতে তার নামের আগে বড় করে আলহাজ্ব লেখা থাকে, আর চৌধুরী সাহেবের নামের আগে কিছু থাকে না, ব্যাপারটা বড়ই চোখে লাগে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, জলদি হাজ্জ করে এসে নতুন করে ইলেকশনের পোস্টার ছাপাবেন। তাহলে এইবার আলহাজ্ব টাইটেলের সুবাদে তার ইলেকশনে জেতা আর কেউ ঠেকাতে পারবে না।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

ওরা তোমাকে নতুন চাঁদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে — আল-বাক্বারাহ ১৮৯

2_189_title

ওরা তোমাকে নতুন চাঁদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। বলো, “এটি মানুষের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের হিসেব রাখা এবং হাজ্জের সময় নির্ধারণ করার জন্য।” আর পেছন দিক দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলে সেটা বেশ ধার্মিকতা হয়ে গেল না। বরং আল্লাহর تعالى প্রতি সাবধান থাকাটাই হচ্ছে আসল ধার্মিকতা। তাই দরজা দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করো, আর আল্লাহর تعالى প্রতি সাবধান থেকো, যেন তোমরা সফল হতে পারো। [আল-বাক্বারাহ ১৮৯]

চাঁদ – এক অসাধারণ সৃষ্টি

আল্লাহ تعالى চাঁদকে বিশেষভাবে সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের জন্য উপযোগী করার জন্য। পৃথিবীর উপরের পৃষ্ঠটি একটি পাতলা খোলসের মতো, যা অনেকগুলো টুকরোতে ভাগ করা। এই টুকরোগুলোকে বলা হয় ‘টেক্টনিক প্লেট’। এই প্লেটগুলো ক্রমাগত নড়াচড়া করে, সম্প্রসারিত হয়, একটা প্লেট অন্য প্লেটের নীচে আটকিয়ে যায় এবং একসময় হঠাৎ করে ছুটে যায়, আর তখন ভুমিকম্প হয়।

চাঁদের আকর্ষণের কারণে পৃথিবীর উপরের স্তর ক্রমাগত টান পড়ে। এর ফলে প্লেট টেকটনিক্স হয়। পৃথিবীতে প্রাণ টিকে থাকার জন্য হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং সালফারের ক্রমাগত সরবরাহ দরকার। পৃথিবীর ভেতর থেকে এই প্রয়োজনীয় পদার্থগুলো বেরিয়ে আসে এই প্লেটগুলোর নড়াচড়ার কারণে।[৩৩১] অনেক আগে আদি প্রাণীগুলোর বেঁচে থাকার জন্য যে পুষ্টির দরকার ছিল, তা সরবরাহ করেছিল এই প্লেট টেক্টনিক্স—প্লেটগুলোর ক্রমাগত সম্প্রসারণ, নড়াচড়া এবং ভুমিকম্প।

Convection

যদি চাঁদ না থাকতো, তাহলে প্লেট টেকটনিক্স হতো না, পৃথিবীতে জটিল প্রাণ টিকে থাকতো না, কোনোদিন মানুষ আসতে পারতো না। মানুষকে পাঠানোর জন্য দরকার ছিল চাঁদকে ঠিক এখন যে আকৃতি এবং দূরত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে, ঠিক সেভাবেই রাখা।[৩২৬]

চাঁদ হচ্ছে পৃথিবীর স্ট্যাবিলাইজার। এটি পৃথিবীকে নিজের অক্ষের উপর বেশি দোলা থেকে রক্ষা করে। এর টানের কারণে পৃথিবী ঘোরার সময় লাটিমের মতো হেলে দুলে না ঘুরে একই অক্ষের উপর ঘোরে। যদি এরকম না হতো, পৃথিবীতে ঋতুগুলো ভয়ঙ্কর হতো। পৃথিবীর আবহাওয়া খুব দ্রুত চরমভাবে পরিবর্তন হতো। জটিল প্রাণ থাকতে পারতো না। মানুষ তো দূরের ব্যাপার। যেরকম কিনা মঙ্গল গ্রহে হয়েছে। মঙ্গল গ্রহের পৃথিবীর মতো চাঁদ না থাকার কারণে সেখানে আবহাওয়া চরম হয়ে গেছে।[৩২৬]

শুধু তাই না, চাঁদ পৃথিবীর ঘোরার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। চাঁদের টানে সমুদ্র পৃষ্ঠের পানির ঘর্ষণের কারণে পৃথিবীর ঘোরার গতি নিয়ন্ত্রিত থাকে। চাঁদ না থাকলে এক দিনের দৈর্ঘ্য হতো মাত্র ৬ ঘণ্টা![৩২৭]

চাঁদের কারণে যে পূর্ণ সূর্য গ্রহণ হয়, সেটা একটা বিরাট ব্যাপার। সূর্যের ব্যাস চাঁদের থেকে প্রায় ৪০০গুণ বেশি। যদি সূর্য চাঁদের থেকে প্রায় ৪০০ গুণ দূরে না থাকতো, তাহলে আকাশে সূর্য এবং চাঁদের আকৃতি প্রায় সমান হতো না এবং কোনোদিন পূর্ণ সূর্য গ্রহণ হতো না। সূর্য এবং চাঁদের আকৃতি এবং দূরত্ব এত নিখুঁত অনুপাতে আল্লাহ تعالى রেখেছেন দেখেই পূর্ণ সূর্য গ্রহণের সময় চাঁদ সূর্যকে একদম সঠিক মাপে ঢেকে ফেলে।

TotalSolarEclipse  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

কী ওদের কিবলা পালটিয়ে দিলো? — আল-বাক্বারাহ ১৪২-১৪৪

সূরা আল-বাক্বারাহ’র এই আয়াতে কিবলা পরিবর্তনের ঘটনা নিয়ে সুধীবৃন্দরা অনেক তর্ক দাঁড় করিয়েছেন। তাদের দাবি: যেখানে নবী ইব্রাহিম عليه السلام কা’বা মুখি হয়ে সালাত পড়তেন, সেখানে কেন রাসুল মুহাম্মাদ عليه السلام আল-আক্বসা মুখি হয়ে সালাত পড়তেন? উনি কেন নবী ইব্রাহিমের عليه السلام বিরোধিতা করলেন? কেনই বা মুসলিমদেরকে কা’বা মুখি হয়ে সালাত পড়তে হবে, যেখানে কিনা আল্লাহ تعالى কোনো একটি দিকে নির্দিষ্ট নন? যেকোনো একদিকে মুখ করে সালাত পড়লেই তো হয়?

আবার অমুসলিমরা দাবি করেন: হিন্দুদের মতো মুসলিমরাও কা’বা পূজা করে। দেখো না সবাই কা’বা মুখি হয়ে সালাত পড়ে? হাজ্জ হচ্ছে গণপূজা, যেখানে লক্ষ লক্ষ মুসলিম গিয়ে একদম কা’বার সামনে মাথা নত করে। কা’বার সামনে এভাবে মাথা নত করাটা পূজা না তো কী?

অন্যদিকে ইহুদি, খ্রিস্টানরা দাবি করে: মুসলিমদের একসময় আল-আক্বসা মুখি হয়ে সালাত পড়াটা ঐতিহাসিকভাবে ভুল ঘটনা, কারণ রাসুল মুহাম্মাদ عليه السلام -এর মারা যাওয়ার প্রায় একশ বছর পরে আল-আক্বসা মসজিদ তৈরি হয়েছে। এমনকি উমার (রা) যখন জেরুজালেম দখল করেন, তখন আল-আক্বসার জায়গায় ছিল শুধুই কিছু ময়লার স্তূপ। উনিই তো আল-আক্বসার গম্বুজ তৈরি করেন। তাহলে আগে আল-আক্বসা ছিল কীভাবে? সুতরাং কু’রআনে ভুল আছে! —ইহুদি, খ্রিস্টানদের এই যুক্তি এবং ঐতিহাসিক দলিল অনেক ‘আধুনিক মুসলিম’ এবং নাস্তিকরা লুফে নিয়েছে।

আসুন এই ভুল ধারণাগুলোর অবসান করি—

2_142_title

2_142লোকদের মধ্যে বোকাগুলো বলবে, “কী ওদের প্রার্থনার দিক (কিবলা) পালটিয়ে দিলো, যেদিকে তারা মুখ করতো?” বলো, “পূর্ব, পশ্চিম সব আল্লাহর تعالى। তিনি যাকে চান তাকে সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করেন।” [আল-বাক্বারাহ ১৪২]

ঘটনার প্রেক্ষাপট
রাসুল মুহাম্মাদ عليه السلام যখন মক্কায় ছিলেন, তখন তিনি যখন সালাত পড়তেন, তার সামনে কা’বা এবং আক্বসা দুটোই থাকতো। কিন্তু তিনি যখন মদিনা হিজরত করলেন, তখন মক্কা পড়ে গেল একদিকে, আর আক্বসা পড়ে গেল আরেকদিকে। যার ফলে তিনি যখন আক্বসা মুখি হয়ে সালাত পড়তেন, তখন কা’বা থাকতো তার পেছন দিকে। নবী ইব্রাহিমের عليه السلام প্রতি ভালবাসা, এবং তার চেয়েও বেশি কা’বার প্রতি টানের কারণে তিনি মাঝে মাঝেই আকাশের দিকে নির্বাক হয়ে তাকাতেন। যদিও তিনি মুখে কিছু বলতেন না, কিন্তু তিনি মনে মনে চাইতেন আল্লাহ تعالى যেন কা’বাকে কিবলা করে দেন। আল্লাহ تعالى তার এই গোপন চাওয়া পূরণ করলেন। সূরা আল-বাক্বারাহ’র আয়াত নাজিল হলো। আক্বসা থেকে কিবলা ঘুরে গেল কা’বার দিকে।[১৪]

2_144

আমি অবশ্যই দেখেছি তোমাকে বার বার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে। তাই আমি তোমাকে সেই কিবলা দিলাম, যা তুমি পছন্দ করো। এখন তুমি মাসজিদুল-হারাম-এর (কা’বা) দিকে মুখ করো। তোমরা (বিশ্বাসীরা) যেখানেই থাকো না কেন, এর দিকে মুখ করো। যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে, তারা খুব ভালো করে বোঝে যে, এটি তাদের প্রভুর কাছ থেকে আসা সত্য। ওরা কী করে সে ব্যাপারে আল্লাহ تعالى বেখেয়াল নন। [আল-বাক্বারাহ ১৪৪]

কিন্তু আল-আক্বসা কেন কিবলা ছিল?
কা’বা থাকতে আল-আক্বসা কেন কিবলা হয়েছিল? এটা কি নবী ইব্রাহিমের عليه السلام বিরোধিতা হয়ে গেল না? এর উত্তর আছে পরের আয়াতে—  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

আমার প্রতিশ্রুতি অন্যায়কারীদের কাছে পৌঁছাবে না — আল-বাক্বারাহ ১২৪-১২৫

আপনি বহুবছর বিদেশে কাজ করে দেশে ফিরছেন। এর মধ্যে আপনার এক সন্তান হয়েছে, যাকে আপনি এর আগে কখনো দেখেননি। দেশে ফিরে আপনি তাকে প্রথম বারের মতো দেখবেন, এই খুশিতে আপনি আত্মহারা। কয়েকটা দিন সন্তানের সাথে হেসে-খেলে দিন পার করতে না করতেই, একরাতে স্বপ্ন দেখলেন: আপনি কুরবানি করছেন, আপনার হাতে রক্তাক্ত ছুড়ি, কিন্তু একি! কুরবানির পশুর জায়গায় পড়ে রয়েছে আপনার মৃত সন্তান! আপনি ঘুম ভেঙ্গে লাফ দিয়ে জেগে উঠলেন। এরকম একটা জঘন্য স্বপ্ন দেখে অস্থিরতায় ঘেমে গেলেন। স্বপ্নটা এতটা বাস্তব ছিল, মনে হচ্ছিল ভবিষ্যতের কোনো একটা ঘটনা আপনি নিজের চোখে ঘটতে দেখছেন। এত ভয়ঙ্কর বাস্তব স্বপ্ন আপনি এর আগে কখনো দেখেননি।

পরদিন আপনি ছেলের সাথে খেলছেন। কিন্তু আপনার মন বসছে না। বার বার রাতের দুঃস্বপ্নের কথাটা মনে হচ্ছে। সেদিন রাতে আবারো আপনি সেই স্বপ্নটা দেখলেন। চিৎকার দিয়ে লাফ দিয়ে জেগে উঠলেন। পরদিন আবারো একই স্বপ্ন। কয়েকদিন একই স্বপ্ন দেখার পর আপনি বুঝতে পারলেন, এটা কোনো সাধারণ স্বপ্ন নয়। আপনাকে এই ঘটনা ঘটাতে হবে। আপনাকে স্বপ্নের মাধ্যমে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে এই কাজ করার।

আপনি স্ত্রীকে বলতে গেলেন। আর দশজনের মতো যদি আপনার স্ত্রী হতো, তাহলে সে চিৎকার দিয়ে উঠত, “কী! তোমার কি মাথা খারাপ? জলদি ডাক্তার দেখাও। খবরদার যদি আর কখনো এই কথা শুনি, তাহলে আমি কালকেই আমার ছেলেমেয়ে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যাব।” কিন্তু না, আপনার পরহেজগার, একান্ত নিষ্ঠাবান স্ত্রী আপনাকে বোঝালেন, “আল্লাহর تعالى নির্দেশ আমাদেরকে মানতেই হবে।”

আপনি ভাবলেন: ছেলেকে ঘটনাটা খুলে বলি, তাহলে অন্তত ছেলেটা ভয় পেয়ে চিৎকার শুরু করবে, কিছু একটা ঘটাবে, আর আপনাকে এই কাজটা করতে হবে না। কিন্তু ছেলেকে বলার পর সে শান্ত ভাবে আপনাকে বোঝালো, “বাবা, আল্লাহই تعالى তোমাকে এই কাজ করতে বলছেন। তোমাকে তো অবশ্যই আল্লাহর تعالى নির্দেশ মানতে হবে। চিন্তা করো না বাবা, আমি একটুও কাঁদবো না। তুমি কুরবানি করার আগে আমার চোখটা ঢেকে দিও, যাতে আমি ভয় পেয়ে সরে না যাই।” আপনার বুক ভেঙ্গে গেল। আপনি বুঝতে পারলেন, আপনাকে এই কাজটা করতে হবেই।

বহুবছর আগে আপনাকে এরকম আরেকটা কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। আপনার কাছে নির্দেশ এসেছিল: আপনার স্ত্রী এবং শিশু বাচ্চাটাকে মরুভূমিতে রেখে আসতে হবে। আপনি স্ত্রীকে বললেন, “আমার কাছে নির্দেশ এসেছে, তোমাকে এবং বাচ্চাটাকে মরুভূমিতে রেখে আসতে হবে।” আপনার স্ত্রী কিছুক্ষণ পাথরের মতো দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নীরবে মেনে নিলেন। আপনি তাদেরকে নিয়ে উটের পিঠে চড়ে, শিশুকে বুকে নিয়ে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে মরুভূমিতে চলছেন। এই ভয়ঙ্কর যাত্রায় বাচ্চাটা যে কোনো সময় মারা যেতে পারে। কিন্তু তারপরেও আপনি যাচ্ছেন।

গহীন মরুভূমিতে বহুদূর যাওয়ার পর তাদেরকে একটা জায়গায় থামতে বললেন। সেখানে তাদেরকে দাঁড় করিয়ে রেখে আপনাকে বিদায় নিতে হবে। নিজের ভেতরের কান্না আটকে রেখে, শোকে পাথর হয়ে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। আপনার স্ত্রী বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আপনার চলে যাওয়া দেখলেন। আপনি চলে যাচ্ছেন, আর হাজারো দুশ্চিন্তা আপনার মাথায় আসছে, “ওদের কাছে যে খাবার রেখে এসেছি, সেটা তো কিছুক্ষণ পরেই শেষ হয়ে যাবে? ওরা পানি পাবে কোথা থেকে? পানি থাকা তো দূরের কথা, চারিদিকে যতদূর চোখ যায়, কোনো গাছপালাও নেই। এভাবে কতক্ষণ বেঁচে থাকবে ওরা?”

এরকম ভয়ঙ্কর কিছু পরীক্ষা, যেগুলো আমরা আমাদের জীবনে দেওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারি না, নবী ইব্রাহিম-এর عليه السلام জীবনে সত্যি সত্যিই ঘটেছিল, যার উল্লেখ এই আয়াতে এসেছে—

2_124

মনে কর দেখো, যখন ইব্রাহিমকে তার প্রভু কিছু নির্দেশ দিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন, এবং তিনি তার সব পূরণ করেছিলেন।
আল্লাহ تعالى বলেন, “আমি তোমাকে মানবজাতির ইমাম করবো।”
ইব্রাহিম বলেন, “আমার বংশধরেরাও কি?”
আল্লাহ تعالى বলেন, “আমার প্রতিশ্রুতি অন্যায়কারীদের কাছে পৌঁছাবে না।” [আল-বাক্বারাহ ১২৪]

2_124_title

আমাদের যখন বাচ্চাদেরকে স্কুলে আনতে যেতে দেরি হয়, জ্যামে আটকিয়ে থাকি, পুরো সময়টা আতংকে থাকি: বাচ্চাদের কিছু হলো কিনা; কোনো ছেলেধরা এসে ধরে নিয়ে গেল কিনা। সেখানে নবী ইব্রাহিম عليه السلام নিজের হাতে তার শিশু সন্তানকে, স্ত্রীকে মরুভূমিতে রেখে এসেছিলেন। তিনি জানতেন সেখানে তাদের বাঁচার কোনোই উপায় নেই। তারা পিপাসায় কাতরাতে কাতরাতে ভীষণ কষ্ট পেয়ে মারা যাবে। তারপরেও তিনি সেই কঠিন পরীক্ষা দিয়েছেন, কারণ আল্লাহর تعالى আদেশের উপর কোনো কথা নেই।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)