যারা জ্বিন এবং মানুষ — আন-নাস

বলো, আমি আশ্রয় নেই মানুষের প্রতিপালক, মানুষের মালিক, মানুষের উপাস্যের কাছে। আত্মগোপনকারি প্ররোচকের প্ররোচনার অনিষ্ট থেকে। যে মানুষের ভেতরে প্রতিনিয়ত প্ররোচনা দেয়। যারা জ্বিন এবং মানুষ। [আন-নাস]

বলো, আমি আশ্রয় নেই মানুষের প্রতিপালক, মানুষের মালিক, মানুষের প্রভুর কাছে।

কেন বার বার ‘মানুষের’ বলা হলো?

এলাকার চেয়ারম্যান দাঁড়িয়ে যখন ভাষণ দেন, “ভাইসব, আমি আপনাদের শুভাকাঙ্ক্ষী। আমি আপনাদেরই প্রতিনিধি। আমি আপনাদেরই মনোনীত নেতা। …” —এই কাজটা তিনি করেন এলাকাবাসীকে বোঝানোর জন্য যে, এলাকাবাসীর প্রতি তার বিশেষ টান রয়েছে। তিনি সত্যিই চান এলাকার মানুষের জন্য ভালো কিছু করতে।

আল্লাহ تعالى যেন বার বার আমাদেরকে জানাচ্ছেন যে, মানুষের অবস্থার প্রতি তিনি উদ্বিগ্ন। তিনি تعالى মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য সবসময় রয়েছেন। তিনি تعالى মানুষকে সযত্নে পালন করেন, কারণ তিনি মানুষের রব। তাঁর ক্ষমতা দিয়ে প্রতিরক্ষা দেন, কারণ তিনি মানুষের মালিক। তিনি আমাদেরকে কোনোদিন ফিরিয়ে দেবেন না, কারণ তিনি تعالى যে আমাদের ইলাহ, আমাদের উপাস্য, আমাদের প্রভু, যাকে আমরা সবচেয়ে বেশি চাই।[১]  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

শয়তান তোমাদেরকে অভাবের ভয় দেখায় — আল-বাক্বারাহ ২৬৮

আমরা যখন যাকাত দেওয়ার সময় হিসেব করে দেখি কত যাকাত দিতে হবে, তখন ভাবি, “এত্ত গুলো টাকা দিয়ে দিতে হবে! এত টাকা যাকাত দিয়ে কী হবে? মানুষের অভাবের তো কোনো শেষ নেই। যত দিবো, তত চাইবে।” — যাকাতের পরিমাণ দেখে আমাদের আফসোস শুরু হয়ে যায়, অথচ ভেবে দেখি না যে, এটা হচ্ছে আমাদের সম্পত্তির মাত্র ২.৫%অংশ, খুবই নগণ্য পরিমাণ। বাকি বিশাল ৯৭.৫% অংশ সম্পত্তি আমাদের জমা হয়ে আছে। যাকাত দেওয়ার সময় আমাদের শুধু আফসোস হয় যে, কতগুলো টাকা বের হয়ে গেলো। সেই টাকা না দিলে কত কিছু কিনতে পারতাম, কত কিছু করতে পারতাম। অথচ চিন্তা করে দেখি না যে, আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এত সম্পত্তি দিয়েছেন যে, তার এক নগণ্য অংশও আমাদের কাছে এত বেশি মনে হচ্ছে —এই ধরনের চিন্তাগুলো আসে শয়তানের কাছ থেকে, কারণ আল্লাহ تعالى বলেছেন—

শয়তান তোমাদেরকে অভাবের ভয় দেখায়, আর তোমাদেরকে অশ্লীল কাজ করতে তাগাদা দেয়। কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং প্রাচুর্যের নিশ্চয়তা দেন। আল্লাহ তো সবকিছু ঘিরে আছেন, তিনি সব জানেন। [আল-বাক্বারাহ ২৬৮]

আমরা যখন আল্লাহর تعالى পথে দান করতে যাই, তখন আমাদের মনে নানা ধরনের চিন্তা আসা শুরু হয়ে যায়, “বাড়ি ভাড়া দেওয়ার টাকা থাকবে? ছেলে মেয়েদের পড়ার খরচ দিতে পারবো? ঈদের শপিং করতে পারবো?” অথচ যখন শপিং মল বা রেস্টুরেন্টে যাই, আমরাই তখন দেদারসে টাকা উড়াতে থাকি। তখন আমাদের মাথায় বাড়ি-ভাড়া, সন্তানের ভবিষ্যৎ-এর কথা মাথায় আসে না। যে লোক মসজিদের দান বাক্সে একশ টাকা দিবে না দশ টাকা দিবে এই নিয়ে নিজের মধ্যে যুদ্ধ করতে থাকে, সেই মানুষই সিনেমা, টিভি, রংবেরঙের পানীয়, দামি খাবার, ব্রান্ড কাপড়, বিদেশে বেড়াতে যাওয়া — এসবের জন্য দুহাতে টাকা খরচ করতে একটুও বাধে না।[১৭]    (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

এমন মানুষও আছে, যে আল্লাহকে ﷻ অনেক খুশি করার চেষ্টায় নিজেকে পুরোপুরি নিবেদিত করে দেবে — আল-বাক্বারাহ ২০৭-২০৯

ধরুন আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, আপনি কাজের পাশাপাশি সন্ধ্যায় ইউনিভারসিটি গিয়ে পার্টটাইম মাস্টার্স বা পিএইচডি করবেন। আপনার পরিবার আপনার এই সিদ্ধান্ত শুনে বড়ই খুশি হবে। বংশে একজন মাস্টার্স/পিএইচডি করা ছেলে/মেয়ে থাকবে, কী সৌভাগ্যের ব্যাপার! ক্লাসে যাওয়ার আগে আপনার জন্য নাস্তা টেবিলে রাখা থাকবে। ক্লাস করে এসে আপনি যেন শান্তিতে ঘুমোতে পারেন, সেজন্য বাচ্চাদেরকে আগেই ঘুম পাড়িয়ে রাখা হবে। মেহমানরা বেড়াতে এসে যেন আপনার পড়াশুনায় ক্ষতি না করে, সেজন্য চৌদ্দগুষ্টিতে সাবধান নোটিস চলে যাবে। কেউ যদি এসেও পড়ে, আপনি দেখা করতে না আসলে কোনো সমস্যা নেই, কারণ আপনার পরীক্ষা চলছে। আপনার পরীক্ষার সময় বাড়িতে কারফিউ পড়ে যাবে। কেউ জোরে টিভি ছাড়বে না, ফোনে গল্প করবে না, আপনাকে যথাসাধ্য সবরকম শান্তির ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। কিছুক্ষণ পর পর নাস্তা এবং চা আসতে থাকবে। একসময় আপনি গ্রাজুয়েট করবেন, আপনার স্বামী-স্ত্রী-বাবা-মা গর্ব করে সবার কাছে আপনার অর্জনের কথা বলবে।

কিন্তু ধরুন আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, কাজের পাশাপাশি আপনি একটা ইসলামিক ডিগ্রির জন্য পড়াশুনা করবেন, বা এলাকার মুসলিম ভাইবোনদের সাথে নিয়মিত ইসলামি আলোচনায় অংশ নেবেন। আপনার পরিবারের সদস্যরা এই কথা শোনার পর আপনার উপর শুরু হবে তাদের যাবতীয় দাবি এবং অভিযোগের বৃষ্টি। এমনিতেই কাজের বাইরে আপনাকে কম পাওয়া যায়, এখন কেন আরও কম পাওয়া যাবে? যেই কাজ করতে আপনি বাধ্য নন, কেন আপনি সেই কাজের পিছনে এত সময় দেবেন? এগুলো না করে শুধু নামাজ-রোজা করলে ক্ষতি কী হবে? আমরা কী মুসলিম না? এগুলো না করলে কী জান্নাতে যাওয়া যায় না? —এরকম হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যে আপনি কোনোমতে সবাইকে দিনের পর দিন ম্যানেজ করে, নিয়মিত তাদের কটু কথা শুনে হয়তো সপ্তাহে একদিন, দু’দিন করে ইসলামের জন্য পড়াশুনা করবেন, কোনো ইসলামি আলোচনা, সেচ্ছাসেবী কাজে মাসে এক-দুইবার অংশ নেবেন। কিন্তু আপনার এই কাজে সাহায্য করার জন্য কেউ টিভি দেখা কমিয়ে দেবে না, ফোনে গল্প করা বন্ধ করবে না, আপনার পড়ার সময় বাচ্চাগুলোকে অন্য ঘরে খেলতে নিয়ে যাবে না। আপনার পরীক্ষাই চলুক, কোনো জরুরি প্রোগ্রামই থাকুক, বা রংপুরে কম্বল বিতরণের দায়িত্বই থাকুক না কেন, বাসায় কোনো মুরব্বি আত্মীয় আসলে, শ্বশুর-শাশুড়ি আসলে, বাচ্চাদের পরীক্ষা চললে কেউ আপনাকে একটুও ছাড় দেবে না। আপনাকে তখন সব বাদ দিয়ে সামাজিকতা করতে হবে। বরং যখন আপনার পড়াশুনার বেশি চাপ যাবে, বা ইসলামি কাজে একটু বেশি সময় দিতে হবে, তখনি আপনার কাছের জনের মাথা বেশি গরম হয়ে যাবে, নিয়মিত ঝগড়া শুরু হবে। আত্মীয়স্বজন নিয়মিত আপনাকে ফোন করে আবার ‘সাধারণ মুসলিম’ হয়ে যাওয়ার জন্য বার বার আপনাকে বোঝাবে। কবে কোন মুসলিমকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল, জেলে নিয়ে কীভাবে পায়ের নখ তুলে নির্যাতন করেছিল, কোন ইসলামি দল কবে কোন নিরীহ মুসলিমকে ঘোল খাইয়েছিল —এই সব বলে আপনাকে নিয়মিত ভয় দেখাবে।

এইসব হাজারো ঝড়-ঝাপটা, প্রতিকূলতার মধ্যেও আপনি দাঁতে দাঁত চেপে ধৈর্য ধরে প্রতিদিন হাসিমুখে চেষ্টা করে যান। কারণ আপনার মতো মানুষদের কথাই আল্লাহ تعالى গর্ব করে কু’রআনে বলেছেন—

2_207

এমন মানুষও আছে, যে আল্লাহকে تعالى অনেক খুশি করার চেষ্টায় নিজেকে পুরোপুরি নিবেদিত করে দেবে। আল্লাহ تعالى তার বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত মমতাবান। [আল-বাক্বারাহ ২০৭]

2_207_title

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বলছেন যে, এমন মানুষ আছে, যারা يَشْرِى ইয়াশরি অর্থাৎ নিজেকে বিক্রি করে দেবে। সে নিজের সময়, মেধা, সম্পদকে বিক্রি করবে। আমরা প্রতিদিন জীবনের ১০-১২ ঘণ্টা বিক্রি করে দেই অফিসে, ব্যবসায়, পড়াশুনায়, যেন একসময় গিয়ে ব্যাংকে কিছু টাকা পেতে পারি। এভাবে আমরা প্রতিনিয়ত নিজের সত্তাকে বিক্রি করি, যেন এর বিনিময়ে কিছু না কিছু দুনিয়াতে পেতে পারি। এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এমন একজনের কথা বলছেন, যে তার নিজের সময়, সম্পদ, মেধা, এমনকি দরকার পড়লে নিজের দেহকেও বিক্রি করে দেবে আল্লাহর مَرْضَات মারদাত অর্থাৎ সন্তুষ্টি পাওয়ার আশায়। তবে শুধুই সন্তুষ্টি বা رضا পাওয়ার আশায় নয়, বরং مَرْضَات মারদা-ত, অত্যন্ত সন্তুষ্টি পাওয়ার আশায়। সে মনে প্রাণে চায় যেন আল্লাহ تعالى তার উপর অনেক খুশি হন। এর জন্য সে যে কোনো ত্যাগ করতে রাজি।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

সে শুধুই তোমাদেরকে জঘন্য এবং অনৈতিক কাজ করতে বলে — আল-বাক্বারাহ ১৬৯ পর্ব ২

2_160_part2_title

আল্লাহ যখন শয়তানকে তার সান্নিধ্য থেকে বের করে দিচ্ছিলেন, তখন শয়তান একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ শপথ করেছিল, যা থেকে তার মানুষকে ধ্বংস করার অন্যতম একটি প্রধান পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়—

(শয়তান বলল) “আমি মানুষের কাছে আসব ওদের সামনে থেকে, ওদের পেছন থেকে, ওদের ডান দিক থেকে এবং ওদের বাম দিক থেকে। আপনি দেখবেন ওরা বেশিরভাগই কৃতজ্ঞ না। [আল-আ’রাফ ৭:১৭]

কু’রআনে আল্লাহ প্রায় ৬০টি আয়াতে কৃতজ্ঞতার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন। এর মধ্যে একটি বিখ্যাত আয়াত হল—

মনে করে দেখো, তোমাদের প্রভু কথা দিয়েছিলেন, “যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে আরও দিতেই থাকবো। কিন্তু যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও…, আমার শাস্তি বড়ই কঠিন। [ইব্রাহিম ১৪:৭]

এখানে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে কথা দিয়েছেন যে, যদি আমরা কৃতজ্ঞ হই, তাহলে আল্লাহ আমাদেরকে দিতেই থাকবেন। তিনি আরবিতে তিনবার জোর দিয়ে একথা বলেছেন, “যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তাহলে আমি তোমাদেরকে আরও দিতেই থাকবো, দিতেই থাকবো, দিতেই থাকবো।”[১]

নিশ্চয়ই শয়তান চাইবে না আপনি জীবনে আরও বেশি পান, আরও ভালো থাকেন। একারণে শয়তানের সবসময় চেষ্টা থাকে: কীভাবে আপনাকে অসুস্থ বিনোদনে বুঁদ করে রাখা যায়, যেই বিনোদন আপনাকে কখনই পরিতৃপ্তি দেয় না। কীভাবে আপনাকে ভুলিয়ে দেওয়া যায় যে, আল্লাহর تعالى অনুগ্রহে আপনি জীবনে কত কিছুই না পেয়েছেন।

কেন আল্লাহ تعالى আমাদেরকে কৃতজ্ঞ হতে বলেন? তাঁর তো আমাদের কাছ থেকে কিছুই পাওয়ার নেই। আমরা কৃতজ্ঞ হই আর না হই, তাতে তো তাঁর কোনো লাভ নেই। তাহলে কৃতজ্ঞ হয়ে কী লাভ?  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

সে শুধুই তোমাদেরকে জঘন্য এবং অনৈতিক কাজ করতে বলে — আল-বাক্বারাহ ১৬৯

2_169_title

সে শুধুই তোমাদেরকে জঘন্য এবং অনৈতিক কাজ করতে বলে, আর যেন তোমরা আল্লাহর تعالى সম্পর্কে না জেনে কথা বলো। [আল-বাক্বারাহ ১৬৯]

শয়তান কখনও আপনাকে এসে বলবে না, “আমি শয়তান। আমি তোমাকে জাহান্নামে পুড়াতে চাই। আসো আমরা … করি।” ইবলিস এবং অন্যান্য জিন শয়তানরা মানুষের কাছে অদৃশ্য প্রাণী। তারা বিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে ‘প্যারালাল ইউনিভার্স’ বা ‘অন্য ডাইমেনশন’-এ থাকে, যেখান থেকে তারা ঠিকই আমাদেরকে দেখতে পায়, কিন্তু আমরা তাদেরকে দেখতে পাই না, বা কোনো বৈজ্ঞানিক যন্ত্র দিয়ে সনাক্ত করতে পারি না।

সে এবং তার অনুসারিরা তোমাদেরকে তাদের জায়গা থেকে দেখতে পায়, কিন্তু তোমরা তাদেরকে দেখতে পাওনা। [আল-আ’রাফ ৭:২৭]

শয়তান মানুষের অবচেতন মনে কুচিন্তা বা কুমন্ত্রণা ঢুকিয়ে দেয়। আমরা সাবধানে লক্ষ্য করলেও বুঝতে পারবো না: আমাদের মনের গভীরে যে চিন্তাগুলো চলছে, তার কোনটা আমি, আর কোনটা শয়তান। সূরা আন-নাস-এ আল্লাহ تعالى আমাদেরকে বলেছেন, কীভাবে শয়তান কাজ করে—

(আমি আশ্রয় চাই) তার অনিষ্ট থেকে, যে নিজেকে লুকিয়ে রেখে কুমন্ত্রণা দেয়। যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে। জ্বিনের মধ্য থেকে এবং মানুষের মধ্য থেকে। [আন-নাস  ১১৪:৪-৬]

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, শয়তান শুধুই জ্বিন নয়। একইসাথে যে সব মানুষ ইবলিস এবং তার উদ্দেশকে বাস্তবায়ন করতে সাহায্য করে, তারাও শয়তান।

শয়তান এমন কৌশলে আমাদের মনে কু-চিন্তা, অসুস্থ কামনা ঢুকিয়ে দেয় যে, আমরা মনে করবো: সেগুলো আসলে আমাদের নিজেদেরই চিন্তা-ভাবনা, আবেগ এবং অনুভুতি। যেহেতু আমরা সবসময় শয়তানের ব্যাপারে সাবধান থাকি না, তাই কখন যে শয়তান আমাদের মধ্যে তার কুমন্ত্রণা ঢুকিয়ে দিয়ে, আমাদেরকে দিয়ে তার কাজ করানো শুরু করে দেয়, তা আমরা ভুলে যাই। একারণেই আল্লাহ تعالى আমাদেরকে সাবধান করেছেন—  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

হে মানুষ, পৃথিবীতে যা কিছু হালাল এবং ভালো, পবিত্র আছে, তা খাও — আল-বাক্বারাহ ১৬৮

2_168_title

2_168হে মানুষ, পৃথিবীতে যা কিছু হালাল এবং ভালো, পবিত্র আছে, তা খাও। আর শয়তানের পথ অনুসরণ করো না। নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। [আল-বাক্বারাহ ১৬৮]

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বলছেন, “হে মানুষ”—এটি শুধু মুসলিমদের জন্যই নয়, বরং সকল যুগের, সকল মানুষের, সে মুসলিম হোক বা অমুসলিম—সবার জন্য নির্দেশ। এখানে আল্লাহ تعالى শুধুই বলেননি হালাল খাবার খেতে, একইসাথে সেটা তাইয়িবও হতে হবে। তাইয়িব طيب হচ্ছে যা ভালো এবং পবিত্র— দুটোই একসাথে।[১] যা কিছুই খেতে ভালো, দেখতে সুন্দর, শ্রুতিমধুর, সুন্দর ঘ্রাণ —সেগুলোই তাইয়িব।[১৬]

আল্লাহ تعالى আমাদেরকে যা দেন, সেটা আমাদের জন্য ভালো এবং পবিত্র। কিন্তু মানুষ অনেক সময় অনেক কিছু তৈরি করে যেটা খেতে ভালো হলেও, পবিত্র নয়। যেমন, আল্লাহ تعالى কলা দিয়েছেন, যা তাইয়িব— ভালো এবং পবিত্র। কিন্তু মানুষ যখন এই কলাকে পোকা মারার বিষ ডিডিটি এবং বিদেশ থেকে আনা কেমিক্যাল দিয়ে পাকিয়ে বিক্রি করে[৩১১], তখন সেটা খাওয়ার যোগ্য হলেও, সেটা আর পবিত্র থাকে না, তাইয়িব-এর দুটি শর্ত পূরণ করে না। সুতরাং, এই ধরনের কলা, ফরমালিন দিয়ে রাখা ফল, মাছ খাওয়ার ঝুঁকি নেওয়া যাবে না, কুর’আনের এই আয়াতের নিষেধের জন্য এবং নিজের স্বাস্থ্যের জন্য।

একইভাবে আল্লাহ تعالى প্রকৃতিতে পানি, চিনি দিয়েছেন। সেগুলো হালাল এবং তাইয়িব। কিন্তু এগুলোর সাথে ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ, এসিড, মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণের চিনি, রঙ ব্যবহার করে যখন নানাধরণের পানীয় তৈরি করে, তখন সেটা আর তাইয়িব থাকে না।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

যারা তা যেভাবে অনুসরণ করার কথা, ঠিক সেভাবে অনুসরণ করে — আল-বাক্বারাহ ১২১

চৌধুরী সাহেব একজন ভালো মানুষ। আত্মীয়স্বজনের উপকার করেন, গরিবকে দান-খয়রাত করেন, দেশের নিয়ম-কানুন মেনে চলেন। সামাজিকতা এবং সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যায় এমন কিছু তিনি করেন না। তাই তিনি মনে করেন: তার কু’রআন না পড়লেও চলবে, শুধু জুম্মার নামাজ পড়লেই হবে। সবগুলো রোজা না রাখলেও কোনো সমস্যা নেই, কারণ এগুলো নিছক কিছু আনুষ্ঠানিকতা। একজন সৎ, আদর্শ নাগরিক হয়ে মানুষের ভালো করাটাই আসল কথা। মানব ধর্মই আসল ধর্ম; “জীবে দয়া করিছে যে জন, সেজন সেবিছে ঈশ্বর।”

এদের জন্য এই আয়াতটি চিন্তার ব্যাপার—

2_121

যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে একমাত্র তারাই তাতে পূর্ণ বিশ্বাস রাখে, যারা তা যেভাবে অনুসরণ করার কথা, ঠিক সেভাবে অনুসরণ করে। আর যারা তা অস্বীকার করে, ওরা হচ্ছে সর্বহারা। [আল-বাক্বারাহ ১২১]

MasjidulHaram

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বলছেন, কু’রআনকে তারাই বিশ্বাস করে, যারা তা সঠিকভাবে ‘তিলাওয়াত’ করে। তিলাওয়াত শব্দটা নিয়ে আমাদের উপমহাদেশে ব্যাপক ভুল ধারণা আছে, যার কারণে আমরা আজকে কু’রআনকে আরবিতে গড়গড় করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছি, এবং আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে হাফিজ ভাড়া করে আরবিতে কু’রআন পড়িয়ে করিয়ে কু’রআন তিলাওয়াত করাচ্ছি বলে মনে করছি। অথচ তারা কু’রআনে আল্লাহ تعالى তাদেরকে কী শিখিয়েছেন তার কিছুই বুঝছে না, অনুসরণ করা তো দূরের কথা।

তিলাওয়াহ تلاوة এসেছে ت ل و থেকে, যার অর্থ: পেছনে পেছনে অনুসরণ করা, সারিবদ্ধভাবে চলা, কোনো কিছু অর্জনের জন্য চলা, কাউকে পথপ্রদর্শক হিসেবে নেওয়া, কারো কর্তৃত্ব মেনে নেওয়া, কোনো জীবনধারা অনুসরণ করা, কারো চিন্তার ধারা অনুসরণ করা ইত্যাদি।[২৬৩] কু’রআন তিলাওয়াহ মানে শুধু আয়াতগুলোকে যেভাবে আরবিতে উচ্চারণ করার কথা, শুধু সেভাবেই উচ্চারণ করা নয়, একইসাথে সঠিকভাবে কু’রআনের আয়াতগুলোকে বুঝে নিজের জীবনে অনুসরণ করা। বুঝে, চিন্তা করে, সঠিকভাবে কু’রআনের বাণী মেনে চলাটা হচ্ছে: তিলাওয়াহ।[১৪] কু’রআনকে আমাদের জীবনে পথপ্রদর্শক হিসেবে নেওয়া হচ্ছে তিলাওয়াহ। আল্লাহ تعالى আমাদেরকে কু’রআন দিয়েছেন শুধুই ‘ইক্বরা’ পড়ার জন্য নয়, তিনি আমাদেরকে কু’রআন সঠিকভাবে ‘তিলাওয়াহ’ করার জন্য কঠিন নির্দেশ দিয়েছেন। যারা সেটা করবে না, তারা ‘খাসিরিন’ হয়ে যাবে।

خَٰسِرِين (খাসিরিন) এসেছে خسر থেকে যার অর্থ: ১) ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, ২) হেরে যাওয়া, ৩) যা দেওয়া উচিত, তার কম দেওয়া, ৪) ওজনে কম দেওয়া।[১৫০] যারা কিয়ামতের দিন হেরে যাবে, যাদের ভালো কাজগুলোর ওজন খারাপ কাজের ওজন থেকে কম হয়ে যাবে, তারা হবে খাসিরিন। এরা সেদিন হবে সর্বহারা, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। দুনিয়ায় এদেরকে দেখে যতই সুখী, যতই জীবনটা উপভোগ করছে মনে হোক না কেন, কিয়ামতের দিন তারা সবকিছু হারিয়ে ফেলে হাহাকার করতে থাকবে।

আমি উচ্চ শিক্ষিত, আমার কু’রআন দরকার নেই

আজকাল সুধীবৃন্দরা মনে করেন যে, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং উন্নত বিচার-বুদ্ধির কারণে কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ —এটা তারা নিজেরাই যথেষ্ট বুঝতে পারেন এবং আল্লাহকে এবং তাঁর মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে তারা যথেষ্ট গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেন, যেটা অন্যেরা পারে না। কু’রআনের নির্দেশ অনুসরণ করে নামাজ, রোজা করা শুধু ওই সব অর্ধ-শিক্ষিত, অল্প-জ্ঞানী মানুষদের জন্য দরকার যারা এখনও তাদের মত চিন্তার গভীরতা এবং উপলব্ধির উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। কু’রআন পড়ার কোনো দরকার নেই, কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ —তা শিক্ষিত মানুষরা নিজেরাই চিন্তা করে বের করতে পারে।

এদের অনেকে আবার মনে করেন যে, নামাজ, রোজা না করে তাদের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না, তারা এমনিতেই যথেষ্ট ভালো আছেন। যেহেতু তাদের মতে তাদের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না, সুতরাং তাদের আল্লাহর বাণী শোনার কোনো প্রয়োজন নেই। কু’রআন মতো চলাটা যদি এত খারাপ কাজ হতোই, তাহলে এতদিনে তাদের অনেক ক্ষতি হতে থাকতো। কিন্তু সেরকম কিছু তো হতে দেখা যাচ্ছে না। সুতরাং, তারা যা করছে ঠিকই করছে।

যাদের অবস্থা এরকম, তাদেরকে অভিনন্দন! তারা শয়তানের মানুষকে ডোবানোর তিনটি মুল পদ্ধতির উৎকৃষ্ট নিদর্শন। শয়তান গত লক্ষ বছর ধরে একদম প্রথম মানুষ আদম عليه السلام থেকে শুরু করে আপনি-আমি পর্যন্ত বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষকে ডোবানোর জন্য যতগুলো পদ্ধতি সফল ভাবে প্রয়োগ করে এসেছে, তার মধ্যে তিনটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি হল—

১) শয়তান মানুষকে বিশ্বাস করায়: তারা আসলে ভালো মানুষ, তাদের থেকে কত খারাপ মানুষ পৃথিবীতে আছে! একজন ট্রাফিক পুলিশ রিকশাওয়ালার কাছ থেকে দশ-বিশ টাকা ঘুস নেবার সময় মনে করে যে, সে একজন যথেষ্ট ভালো মানুষ, কারণ সে তো সার্জেন্টের মত ট্রাক ড্রাইভারদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা ঘুষ খাচ্ছেনা। একজন সার্জেন্ট মনে করে যে, সে যথেষ্ট ভালো মানুষ, কারণ সে তো ডিসির মত লক্ষ লক্ষ টাকার পুলিশের বাজেয়াপ্ত জিনিসপত্র বিক্রি করে গুলশান-বনানীতে বাড়ি-গাড়ি করে ফেলছে না। একজন ডিসি মনে করে যে, সে মন্ত্রীদের থেকে অনেক ভালো মানুষ, কারণ সে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের হক মেরে দেশের কোটি টাকার ক্ষতি করছে না। —এদের প্রত্যেককে শয়তান অত্যন্ত সফলভাবে বুঝাতে পেরেছে যে, তারা যা করছে তা এত খারাপ কিছু না। তাদের থেকে কত খারাপ মানুষ পৃথিবীতে আছে। আর তারা অন্যায় না করলে কী হবে, তাদের পরে যারা আসবে, তারা তো ঠিকই একই কাজ করবে।

২) শয়তান মানুষকে বিশ্বাস করায়: ধর্ম শেখার কিছু না, এটি মানুষের নিজের এবং আল্লাহর ব্যাপার। ধর্মের মত একটা সাধারণ ব্যাপারে আবার পড়াশুনা করতে হবে নাকি? নিজের কাছে যেটা ভালো মনে হয়, সেটাই আল্লাহর কাছে ভালো, আর নিজের কাছে যেটা খারাপ মনে হয়, সেটাই আল্লাহর কাছে খারাপ। তাছাড়া ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্য যেই বই পুস্তকগুলো পড়ব, সেগুলো যে নির্ভেজাল তার প্রমাণ কী? ওই বইগুলো তো যত সব কাঠমোল্লাদের লেখা। এরচেয়ে নিজে যা ভাল-মন্দ মনে করি সেটা মেনে চললেই হল।

একারণেই অনেককে দেখবেন নাচ-গানের আয়োজন করে খ্রিস্টানদের মত ছেলে-মেয়েদের জন্মদিন, আকিকা করে; হিন্দুদের প্রথা অনুসারে গায়ে-হলুদ, বউ-ভাত করে ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দেয়। কিন্তু যখন নিজের বাবা-মা মারা যায়, তখন তাদের জন্য কু’রআন খতমের ব্যবস্থা করে, চল্লিশা করে, প্রতিবছর মৃত্যু বার্ষিকীতে মিলাদের আয়োজন করে। শয়তান এদেরকে সফলভাবে বুঝাতে পেরেছে: এগুলো সবই ভালো কাজ, ইসলাম সম্মত কাজ, চালিয়ে যাও, আল্লাহ তোমার উপর অনেক খুশি।

৩) শয়তান মানুষকে বিশ্বাস করায়: তোমার মত খারাপ মানুষ নামাজ পড়বে? রোজা রাখবে? তুমি নামাজে আল্লাহর কাছে মুখ দেখাবে কী করে? তোমার নামাজ পড়ার কথা ভাবতে লজ্জা লাগে না? এধরনের মানুষকে দেখবেন তারা কোনো মতে চক্ষু লজ্জায় পড়ে হয়তো সপ্তাহে একদিন জুম্মার নামাজটা পড়তে মসজিদে যায় এবং রাস্তায় ফকির দেখলে মানিব্যাগ খুলে সবচেয়ে ছোট নোটটা বের করে দেয়। কিন্তু তাদের দৌড় এই পর্যন্তই। শয়তান এদেরকে সফল ভাবে বোঝাতে পেরেছে: তাদের আর কোনো আশা নেই, আল্লাহর পক্ষেও তাদেরকে মাফ করা সম্ভব না। সুতরাং নামাজ পড়ে, রোজা রেখে কোনো লাভ নেই। শুধু শুধু সময় নষ্ট, অযথা না খেয়ে থাকার কষ্ট। এরচেয়ে কোটি কোটি টাকা ঘুষ খেয়ে সেখান থেকে লাখ খানেক টাকা গরিব আত্মীয়স্বজনকে দাও। কোটি টাকার সূদের লোণ নিয়ে বাড়ি কিনে হাজার খানেক টাকা গ্রামের বাড়িতে স্কুল-কলেজে দান করো। বছরের পর বছর লাখ লাখ টাকার যাকাত না দিয়ে কালে ভদ্রে গরিব মানুষদেরকে কম্বল, জামা কাপড় কিনে দাও। এতেই আল্লাহ তোমাকে অল্প কয়েকদিন জাহান্নামে শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দিবে।

কারো অবস্থা যদি এই তিনটির যে কোনো একটি হয়, তবে দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। শয়তান লক্ষ বছর ধরে মানুষের সাইকোলজি নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছে। মানুষের সাইকোলজিতে তার মত অভিজ্ঞ কোনো সত্তা পৃথিবীতে আর কেউ আছে বলে জানা নেই। লক্ষ বছর আগে প্রথম মানুষ আদমকে عليه السلام বানানোর পর শয়তানের সাথে আল্লাহর যে কথোপকথনগুলো কু’রআনে রেকর্ড করা আছে, তা থেকে শয়তানের বিশাল জ্ঞানের অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। তখনি সে জানতো: মানুষকে কীভাবে বোকা বানানো যায়, একদিন কিয়ামতে যে মানুষের বিচার হবে, সে যে মানব জাতির একটা বিরাট অংশকে বোকা বানাতে পারবে ইত্যাদি। আর লক্ষ বছর পরে তার জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা কোথায় পৌঁছেছে, সেটা চিন্তাও করা যায় না।

মানুষকে সঠিক সময়ে সবচেয়ে মোক্ষম কুবুদ্ধি দিতে সে এতটাই অভিজ্ঞ হয়ে গেছে যে বিংশ শতাব্দীতে সে মানুষকে দিয়ে যে পরিমাণের মানুষ মারতে অনুপ্রাণিত করতে পেরেছে, তার ধারে কাছে মানুষ পুরো মানবজাতির ইতিহাসে মারা যায়নি। প্রতি মিনিটে শয়তানের কুমন্ত্রণা শুনে মানুষ সারা পৃথিবীতে গড়ে ৭৮টা ধর্ষণ করে, প্রতিদিন শত শত মানুষকে খুন করে, হাজার হাজার মানুষকে নিঃস্ব করে পথে বসায়, কোটি কোটি মানুষ জঘন্য, অশ্লীল কাজে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে।

ইউটিউবে এক ‘গ্যাংগনাম স্টাইল’ ভিডিও দেখার পিছনে মানবজাতি জুলাই ২০১২ থেকে এই পর্যন্ত মোট ১৪০ মিলিয়ন ঘণ্টা ব্যায় করেছে, যা ১৬,০০০ বছরের সমান। এই একই সময় ব্যায় করে মানুষ ২০টা এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, বা চারটা লন্ডন অলিম্পিক পার্ক, বা ছয়টা দুবাইয়ের ‘বুর্জ আল-খালিফা’ বিল্ডিং তৈরি করতে পারতো। এই এক ভিডিও ২০০ কোটি বারের বেশি দেখে মানুষ তার সময় নষ্ট করেছে। ১০০ কোটি বারের বেশি মানুষ জাস্টিন বীবারের একটা মিউজিক ভিডিও দেখেছে[২৬৪] শয়তানকে আজকাল বেশি কষ্ট করতে হয় না। মানুষ নিজেই ইন্টারনেট, টিভি, মোবাইল ফোন ব্যবহার করে শয়তানের থেকেও বেশি সফল হয়েছে নিজেদেরকে ধ্বংস করতে।

Dubai

অথচ আল্লাহ تعالى শয়তানকে শুধুমাত্র মানুষের অবচেতন মনে কুমন্ত্রণা দেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন। আর তিনি মানুষকে ক্ষমতা দিয়েছেন: শয়তানের কুমন্ত্রণা না শুনে নিজের বিবেকবুদ্ধি ব্যবহার করে খারাপ পথে না যাওয়ার। শয়তানের কোনোই ক্ষমতা নেই মানুষকে কোনো কিছু করতে বাধ্য করানোর। এছাড়াও তিনি মানুষকে আরও সাহায্য করার জন্য ৬৩৪৬টি বাণী সহ কু’রআন দিয়েছেন। এরপরেও মানুষ শয়তানের চাকর হয়ে অল্প কিছু আরাম, সন্মান, নিরাপত্তা পাওয়ার লোভে দিনের বেশির ভাগ সময় আল্লাহর সাথে বেঈমানি করা থেকে নিজেদেরকে আটকায় না।

একারণেই আল্লাহ تعالى এই আয়াতে বলেছেন—

যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে একমাত্র তারাই তাতে পূর্ণ বিশ্বাস রাখে, যারা তা যেভাবে অনুসরণ করার কথা, ঠিক সেভাবে অনুসরণ করে। আর যারা তা অস্বীকার করে, তারাই তো সর্বহারা। [আল-বাক্বারাহ ১২১]

আমরা যদি সঠিকভাবে কু’রআন অনুসরণ না করি, তাহলে আমরা দুনিয়াতেও হারাবো, আখিরাতেও হারাবো। আমরা হয়ে যাবো সর্বহারা।

সাধু সাবধান!

অনেক মুসলিম আছেন, যারা খুব ভালো করে জানেন যে, কু’রআনে আল্লাহ تعالى অনেক বার নামাজ, যাকাত, গরিবদের দান, আত্মীয়ের হক আদায়, বাবা-মার সাথে সবচেয়ে ভালভাবে সবকিছু করার নির্দেশ দিয়েছেন। তারা খুব ভালো করে বোঝেন যে, এগুলো সব তার মহান প্রভুর বাণী, কিন্তু তারা নিজেদেরকে বুঝিয়েছেন: তারা আসলে অলস মানুষ এবং শুধু অলসতার জন্যই তারা নামাজ পড়েন না, এর বেশি কিছু না। “প্রত্যেকটা দিন নামাজ পড়তে হবে? দিনে পাঁচ বার! তাও আবার সপ্তাহে সাত দিন!! অসম্ভব। এতো কঠিন কাজ আমাকে দিয়ে হবে না। আমি আসলে একটু ফাঁকিবাজ টাইপের মানুষ।”

এরা নিজেদেরকে এক ধরনের বিভ্রমের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছেন এই ভেবে যে, তারা আসলে একটু অলস টাইপের দেখেই নামাজ পড়েন না, এর বেশি কিছু না। তারা রাত জেগে মুভি দেখতে পারেন, কিন্তু নামাজ পড়তে পারেন না। তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মার্কেটে বেহুদা ঘুরতে পারেন, কিন্তু দশ মিনিট দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে পারেন না। তারা প্রতিদিন কমপক্ষে এক ঘণ্টা বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজনের সাথে ফোনে কথা বলতে পারেন, কিন্তু আধা ঘণ্টা আল্লাহর تعالى  সাথে কথা বলার সময় করতে পারেন না। তারা দিনে কয়েক ঘণ্টা আপনার ছেলে-মেয়ের খাওয়া, গোসল, ঘুম, স্কুল, হোম ওয়ার্ক এসবের পিছনে ব্যায় করতে পারেন, কিন্তু আধা ঘণ্টা তার মালিক, তার একমাত্র প্রভুর জন্য ব্যায় করতে পারেন না। নিজের সাথে প্রতারণা করার এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কিছু হতে পারে না।

“The human brain is a complex organ with the wonderful power of enabling man to find reasons for continuing to believe whatever it is that he wants to believe.” – Voltaire

সাইকোলজির ভাষায় এই অবস্থাকে বলা হয় self-delusion – নিজেকেই নিজে ভুল বুঝিয়ে ধোঁকা দেওয়া, নিজেকে মতিবিভ্রমের মধ্যে ডুবিয়ে রাখা। মানুষকে কোনো অনুশোচনার সুযোগ না দিয়ে, দিনের পর দিন একই অন্যায় বারবার করানোর জন্য শয়তানের এক চমৎকার পদ্ধতি হচ্ছে: সেলফ ডিলিউসন।

আপনি মাঝে মাঝেই দেখবেন আপনার যখন নামাজ পড়ার কথা মনে হয়, হঠাৎ হঠাৎ অনুশোচনা হয় যে, এভাবে নামাজ ফাঁকি দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে না, তখনি দেখবেন আপনার ভেতরে একটা কণ্ঠস্বর আপনাকে বলছে, “কিন্তু আমি তো এর আগের ওয়াক্তের নামাজটা পড়িনি, এখন এই ওয়াক্ত পড়ে কী হবে?” ফজরের সময় ঘুম ভাঙলে: “রাতে ঘুমাতে দেরি হয়ে গেছে। ভালমতো ঘুমানো দরকার। নাহলে সারাদিন শরীর খারাপ লাগবে, মেজাজ গরম থাকবে। একবারে সকালে উঠে নাস্তা খেয়ে ফজরের নামাজ পড়ে নিলেই হবে।” আসরের ওয়াক্ত প্রায় শেষ হতে চলল: “এখনও তো অনেক সময় আছে ওয়াক্ত শেষ হবার। এই কাজটা শেষ না করে উঠে গেলে তাল হারিয়ে ফেলবো। মাগরিবের সময় একবারে পড়ে নেব।” মাগরিবের ওয়াক্ত প্রায় শেষ: “আমি এখন রান্না না করলে তো কেউ খেতে পারবে না, আল্লাহ নিশ্চয়ই আমার অবস্থা বুঝবেন?” মেহমান আসলে, “মেহমানকে বসিয়ে রেখে কীভাবে নামাজ পড়তে উঠে যাই? তারচেয়ে রাতে একবারে সবগুলো নামাজ একসাথে পড়ে নিব।”

এগুলো হচ্ছে শয়তানের কণ্ঠস্বর। যত তাড়াতাড়ি পারুন বোঝার চেষ্টা করুন আপনার ভেতরে যে চিন্তার এক কণ্ঠস্বর আছে, সেটা কখন আপনি, আর কখন সেটা শয়তান।

আমাকে ছাড়া দুনিয়া চলবে না

আরেক ধরনের মানুষ মনে করেন যে, তাদের কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তারা মানুষের অনেক বড় উপকার করছেন। তাদের কাজ ঠিকমত না হলে তাদের নিজেদের, তাদের পরিবারের, মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যাবে। আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদের গুরু দায়িত্বের কথা বুঝবেন। তাই কাজের ব্যস্ততার জন্য যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে না পারেন, তাহলে আল্লাহ তাদেরকে মাফ করে দিবেন।

যারা মানুষের সরাসরি উপকার করে – ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, সমাজসেবকরা হচ্ছেন এই অবস্থার সুন্দর উদাহরণ। যেমন, ডাক্তাররা মনে করেন: “আমি একজন ডাক্তার! আমি মানুষের জীবন বাঁচাই! মানুষের এত বড় একটা সেবার জন্য আল্লাহ আমাকে নামাজ, রোজার হিসাব থেকে মাফ করে দিবেন না? আল্লাহ কি এতই অবিবেচক?”

প্রথমত, যদি ডাক্তাররা এতই মহান হতেন, তাহলে তারা কখনও তাদের কাজের জন্য বেতন নিতেন না। বিনা খরচে মানুষের চিকিৎসা করতেন। তারা কখনও মামা-চাচা-খালু ধরে অন্যায়ভাবে ঢাকায় পোস্টিং নিয়ে পার্টটাইম প্রাইভেট ক্লিনিকে কাজ করতেন না। বরং দূরের কোনো গ্রামের অভাবী, অসুস্থ মানুষের চিকিৎসায় নিজেই পোস্টিং নিয়ে ছুটে যেতেন। ডাক্তাররা যখন তাদের কাজের জন্য বেতন নিচ্ছেন, তখন তারা একজন বেতন ভুক্ত কর্মচারী ছাড়া আর কিছুই নন। তারাও মানুষের উপকার করছেন, আবার একজন সুইপারও মানুষের উপকার করছেন। সুইপাররা না থাকলে লক্ষ লক্ষ মানুষ অসুস্থ হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতো।

কেউ যত বড় ডাক্তার হন, যত বড় দানশীল ব্যবসায়ী হন, যত বড় শিক্ষক হন, কেউ কোনো মানুষের জীবন বাঁচান না; আল্লাহ মানুষের জীবন বাঁচান। কেউ কোনো মানুষকে ইসলামের পথে আনেন না; আল্লাহ যাকে চান তাকে তিনি তাঁর ধর্ম মেনে চলার সন্মান দেন। পৃথিবীতে কেউ নেই যার কাজ এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, সে নামাজ না পড়লে বা রোজা না রাখলে আল্লাহ তাকে তার কাজের গুরুত্বর জন্য নামাজের হিসাব ছেড়ে দিবেন। যদি তাই হতো, তাহলে কোনো নবীর নামাজ পড়ার দরকার হতো না, রোজা রাখার প্রয়োজন হতো না এবং কাফিরদের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে সময় মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার দরকার হতো না।

তাদের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আমরা নিশ্চয়ই করছি না?

সূত্র:

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
  • [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
  • [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
  • [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
  • [১৫] তাফসির আল জালালাইন।
  • [২৬৩] তিলাওয়াত শব্দের বিস্তারিত অর্থ: http://ejtaal.net/aa/img/br/1/br-0160.png, http://www.onislam.net/english/shariah/quran/recite-a-memorize/455998-tilawah-quran-recitation-revisited.html
  • [২৬৪] গ্যাংগনাম স্টাইল —এর ক্ষতির পরিমাণ: http://www.economist.com/blogs/graphicdetail/2014/06/daily-chart-1