পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে এক ঝুলন্ত গঠন থেকে সৃষ্টি করেছেন। পড়ো! তোমার প্রতিপালক বড়ই মহানুভব। তিনি কলমের মাধ্যমে শিখিয়েছেন। তিনি মানবজাতিকে শিখিয়েছেন, যা তারা জানত না।
অথচ মানুষ এমনভাবে প্রকাশ্যে অবাধ্যতা করে, যেন সে নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। যেখানে কিনা সে তোমার প্রভুর কাছে একদিন ফিরে যাবেই।
তুমি কি তাকে দেখেছ, যে আমার বান্দাকে নামাজ পড়তে মানা করে? সে কি নিজে সঠিক পথে আছে? সে কি আল্লাহর প্রতি সাবধান হতে বলে? সে কি নিজে অস্বীকার করে না? মুখ ফিরিয়ে নেয় না? সে কি জানে না যে, আল্লাহ সব দেখেন?
খবরদার! সে যদি এসব বন্ধ না করে, তাহলে আমরা তার মাথার সামনের চুলের ঝুঁটি ধরে তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবো। মিথ্যাবাদী, পাপী মাথার সামনের ঝুঁটি। ডাকুক সে তার সাঙ্গপাঙ্গদের। আমি জাহান্নামের পাহারাদারদের ডাকবো।
না! ওর কথামত চলবে না। আমাকে সিজদা করো। আমার আরও কাছে এসো। —আল-আলাক্ব
পড়ো
কুর‘আনের প্রথম যেই শব্দটি মানবজাতির কাছে পাঠানো হয়েছে, তা হলো ‘পড়ো’। সৃষ্টিকর্তা মানবজাতিকে শেষবারের মতো তাঁর বাণী পাঠানোর সময় কেন ‘পড়ো’ শব্দটি দিয়ে শুরু করলেন, তা আমাদের বোঝা দরকার। নিশ্চয়ই এর মধ্যে এক বিরাট শিক্ষার বিষয় রয়েছে।
আল্লাহ تعالى শুরু করতে পারতেন তাঁর تعالى পরিচয় দিয়ে, যেমন “তিনি আল্লাহ, এক অদ্বিতীয়”। অথবা ‘নামাজ পড়ো’, ‘সিজদা করো’ এধরনের ধর্মীয় নির্দেশ দিয়ে। কিন্তু তা না করে তিনি تعالى শুরু করেছেন ‘পড়ো’ দিয়ে। আজকে মুসলিম জাতির দুরবস্থার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, একটি মূল কারণ হচ্ছে না পড়া। আমরা বেশিরভাগই ইসলাম শিখি শুনে। পড়ে নয়। লোকমুখে প্রচলিত নানা বিশ্বাস, ধারনা আজকে আমাদের কাছে ইসলাম হয়ে গেছে। “অমুকে বলেছে তমুক সুরা লিখে ঝুলিয়ে রাখলে নাকি দুর্ঘটনা হয় না। শুনেছি অমুক সময়ে তমুক নামাজ পড়লে নাকি ব্যবসা ভালো যায়, স্বাস্থ্য ভালো হয়। শুনেছি তমুক মাজারের মাটিতে নাকি বরকত আছে। ওখানে গিয়ে দুআ করলে দুআ কবুল হয়। আমার বাপ-দাদাকে দেখেছি অমুক করতে, নিশ্চয়ই সেটা সঠিক। তারা কি সারাজীবন ভুল করেছেন নাকি?” —এই হচ্ছে আজকে মুসলিম জাতির একটা বিরাট অংশের মানসিকতা। প্রচলিত ধ্যান-ধারনা বিশ্বাসকে পড়ে যাচাই করে দেখার মানসিকতা ও প্রয়োজনীয়তার বড়ই অভাব। (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)
কু’রআনে কিছু আয়াত রয়েছে, যেখানে আল্লাহ تعالى আমাদের অনেক মানসিক সমস্যা এবং প্রশ্নের সমাধান দিয়ে দিয়েছেন। এই আয়াতগুলো আমরা যখন মনোযোগ দিয়ে পড়ি, তখন ধাক্কা খাই। যখন সময় নিয়ে ভেবে দেখি, তখন আমাদের হতাশা, অবসাদ, ডিপ্রেশন, কিছু না পাওয়ার দুঃখ, নিজের উপরে রাগ, অন্যের উপরে হিংসা, প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা —এই সবকিছু কাটিয়ে ওঠার শক্তি খুঁজে পাই। আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করি যে, আমরা এতদিন থেকে যেসব সমস্যায় ভুগছিলাম, তার সমাধান তো এই আয়াতেই ছিল! এরকম একটি আয়াত হচ্ছে আয়াতুল কুরসি। এই আয়াতের প্রতিটি বাক্যে শিরক থেকে দূরে থাকার শিক্ষা রয়েছে এবং একই সাথে আমরা দুনিয়াতে যে নানা ধরনের শিকলের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে গেছি, তা থেকে বেড়িয়ে আসার উপায় শেখানো হয়েছে—
আল্লাহ, তিনি ছাড়া আর কোনো উপাসনার যোগ্য কেউ নেই, তিনি অনন্ত বিদ্যমান, সব কিছুর ধারক। তাঁকে তন্দ্রা বা নিদ্রা স্পর্শ করে না। আকাশগুলো এবং পৃথিবীতে যা কিছুই আছে, সবকিছু শুধুমাত্র তাঁর। কে আছে যে তার অনুমতি ছাড়া সুপারিশ করবে? তাদের দৃষ্টির সামনে এবং দৃষ্টির অগোচরে যা কিছুই আছে, তিনি তাঁর সব জানেন। তাঁর ইচ্ছা ছাড়া তাঁর জ্ঞানের কোনো কিছুই তারা আয়ত্ত করতে পারে না। তাঁর কুরসী আকাশগুলো এবং পৃথিবীকে ঘিরে রেখেছে। সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ তাঁকে কখনো ক্লান্ত করে না। তিনি সবার ঊর্ধ্বে, সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান। [আল-বাক্বারাহ ২৫৫]
সম্পাদনা: ডঃ আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া, শাইখ সানাউল্লাহ নজির আহমদ, শরিফ আবু হায়াত অপু
রাসুল মুহাম্মাদ عليه السلام যখন ১৪০০ বছর আগে অমুসলিম আরবদেরকে কু’রআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন, তখন তা শুনে আরবদের দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া হতো—
কি অসাধারণ কথা! এভাবে তো আমরা কখনও আরবি ব্যবহার করার কথা ভেবে দেখিনি! এত অসাধারণ বাক্য গঠন, শব্দ নির্বাচন তো আমাদের সবচেয়ে বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকরাও করতে পারে না! এমন কঠিন বাণী, এমন হৃদয় স্পর্শী করে কেউ তো কোনো দিন বলতে পারেনি! এই জিনিস তো মানুষের পক্ষে তৈরি করা সম্ভব নয়! এটা নিশ্চয়ই আল্লাহর تعالى বাণী! আমি সাক্ষি দিচ্ছি – লা ইলাহা ইল্লালাহ…
আজকাল সুধীবৃন্দ প্রশ্ন করেন, “সত্যিই যদি আল্লাহ বলে কেউ থাকে, তাহলে তিনি আমাদের সাথে কথা বলেন না কেন? আমি তো কোনোদিন কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটতে দেখলাম না? প্রমান কী যে, আল্লাহ বলে আসলেই কেউ আছেন?” প্রথমত, তাদেরকে অভিনন্দন! তারা এমন একটি জটিল, আধুনিক, যুগোপযোগী প্রশ্ন আবিষ্কার করেছেন, যা ১৪০০ বছর আগে আরবের মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ানো যাযাবর, অশিক্ষিত, অসামাজিক বেদুইনরা রাসুলকে عليه السلام করেছিল। শুধু তাই না, তাদের আগেও নবীদেরকে একই প্রশ্ন করা হয়েছিল। এর উত্তর আল্লাহ تعالى কু’রআনেই দিয়ে দিয়েছেন—
ওরা কি অপেক্ষা করছে যে, ফেরেশতাদেরকে নিয়ে আল্লাহ تعالى নিজেই মেঘের ছায়ায় ওদের সামনে চলে আসবেন? —ততক্ষণে সব শেষ হয়ে যাবে। সবকিছু আল্লাহরই تعالى কাছে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। [আল-বাক্বারাহ ২১০]
যারা ঠিক করে রেখেছে যে, কোনো অলৌকিক কিছু দেখলে তবেই ইসলাম ধর্মকে সত্যি ধর্ম বলে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করবে, ঠিকমতো ধর্ম মানা শুরু করবে, তারা সাবধান! একইসাথে যারা ভাবছেন, এই শেষবারের মতো ঘুষ দিয়ে প্রমোশনটা নিয়ে নেই, তারপরে সব বন্ধ করে একদম ভালো মুসলিম হয়ে যাবো। শুধু এই বাড়িটা সুদের লোণ নিয়ে কিনে নেই, এরপরে আর কখনো কোনো খারাপ কাজ করবো না, আগামি বছরই হাজ্জ করে নেব… —এরা সাবধান! সত্যিই যেদিন ভয়ঙ্কর সব অলৌকিক ঘটনা ঘটা শুরু হবে, সেদিন অনেক দেরি হয়ে যাবে। তখন তাড়াতাড়ি করে সত্যিকারের মুসলিম হওয়ার চেষ্টা করে কোনো লাভ হবে। ঘণ্টা বেজে গেছে, পরীক্ষা শেষ। আরেকটু লেখার জন্য হাজার কাকুতি মিনতি করে কাগজ টানাটানি করে লাভ হবে না।
এই দুনিয়াটা হচ্ছে আমাদের জন্য একটা পরীক্ষা: আমরা আল্লাহকে تعالى নিজের চোখে না দেখে, তাঁর تعالى কথা নিজের কানে না শুনে, শুধুই নিজের বিবেক-বুদ্ধি খাঁটিয়ে, কুর’আন পড়ে, ইসলামকে সত্য ধর্ম হিসেবে মেনে নিতে পারি কিনা, এবং সে অনুযায়ী নিজের জীবনকে পরিবর্তন করতে পারি কিনা —সেটার পরীক্ষা। আমাদেরকে কোনো ম্যাজিক দেখানো হবে না, কোনো অলৌকিক কিছু এসে বলবে না মুসলিম হতে। কুর’আন দেওয়া হয়েছে, মাথা ভর্তি নিউরন দেওয়া হয়েছে, এগুলোই যথেষ্ট বোঝার জন্য যে, ইসলাম একটি সত্য ধর্ম, আল্লাহ تعالى সত্যিই আছেন। কেউ যদি এরপরেও প্রশ্ন করতে থাকে, “না দেখে কোনো কিছু বিশ্বাস করবো কেন? প্রমাণ কি যে ইসলাম সত্যি ধর্ম?” —তাহলে তাদের সমস্যা আসলে প্রমাণ বা কারণের অভাব নয়, সমস্যা হচ্ছে তারা নিজেদেরকে কত বড় মনে করে এবং তারা দুনিয়া কতখানি উপভোগ করতে চায়, সেখানে। (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)
কু’রআনের সবচেয়ে সুন্দর আয়াতগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে সুরাহ আল-বাক্বারাহ’র ১৮৬ আয়াতটি। এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে বলবেন তিনি আমাদের কত কাছের, আমাদের কাছ থেকে তিনি কত আশা করেন যে আমরা শুধুই তাঁকেই تعالى ডাকি—
আমার বান্দারা যখন তোমাকে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে: অবশ্যই আমি তো সবসময় কাছেই আছি। আমাকে যে ডাকে, আমি তার ডাকেই সাড়া দেই, যখনি সে ডাকে। তাহলে তারাও যেন আমার ডাকে সাড়া দিতে চেষ্টা করে, আমার উপর বিশ্বাস রাখে, যেন তারা সঠিক পথে চলতে পারে। [আল-বাক্বারাহ ১৮৬]
এখানে আল্লাহ تعالى শুরু করছেন, “যখন আমার বান্দারা আমাকে ডাকে।” তিনি বলেননি ‘যদি’ আমার বান্দারা আমাকে ডাকে। বরং তিনি تعالى বলেছেন ‘যখন’ আমার বান্দারা আমাকে ডাকে। আল্লাহ تعالى যেন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন: কখন আমরা তাঁকে ডাকবো? তিনি تعالى তো আমাদের ডাকে সারা দেওয়ার জন্য সবসময়ই আছেন। আমরাই বরং তাঁর تعالى সাথে কথা বলছি না।[১] আমরা গিয়ে অফিসের বসের কাছে অন্যায় তদবির করছি প্রমোশনের জন্য। আত্মীয়ের কাছে গিয়ে অন্যায় সুপারিশ চাচ্ছি চাকরির জন্য। পিরের কাছে গিয়ে হাজার টাকার দক্ষিণা দিয়ে সন্তান চাচ্ছি। মন্ত্রীর কাছে গিয়ে সরকারি প্রজেক্টের কন্ট্রাক্টের জন্য দরাদরি করছি। ডাক্তারের কাছে আর্তনাদ করছি, “ও ডাক্তার! ওকে বাঁচান! আপনি ছাড়া আর কেউ ওকে বাঁচাতে পারবে না।” —আমরা এদেরকে যেই ক্ষমতা দিচ্ছি, সেই ক্ষমতা তাদের নেই। তারপরেও তাদের কাছে আমরা কত অনুনয় বিনয় করছি। অথচ যিনি একমাত্র দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন, তাঁকেই تعالى আমরা ডাকছি না।
না! বরং তোমরা শুধুমাত্র তাঁকেই ডাকো। তাহলে তিনি তোমাদেরকে সেই পরিস্থিতি থেকে বের করে আনবেন, যা তোমাদেরকে তাঁকে ডাকতে বাধ্য করেছে, যদি তিনি তা ইচ্ছা করেন। আর তখনি তোমরা ওদেরকে ভুলে যাবে, যাদেরকে তোমরা তাঁর জায়গা দিয়ে দিয়েছিলে। [আল-আনআম ৬:৪১]
অবশ্যই, আমি তো সময় কাছেই আছি
আল্লাহ تعالى সবসময় আমাদের কাছেই আছেন, কিন্তু আমরা তাঁর এবং আমাদের মধ্যে নানা ধরনের দেওয়াল তৈরি করেছি। আমরা মনে করি সরাসরি আল্লাহর تعالى কাছে চাইলে হবে না, একটা তাবিজ পড়তে হবে, গলায় সূরার ফলক ঝুলাতে হবে। ইমাম ভাড়া করে এনে তিনদিনে ভর ভর করে কু’রআন খতম দিয়ে তারপরে চাইতে হবে, এর আগে চাইলে হবে না। মাওলানার দরবারে গিয়ে আর্জি পেশ করতে হবে, শুধু নামাজে দু’আ করলে হবে না। মসজিদের ইমামকে দিয়ে বলাতে হবে, আমি নিজে বললে হবে না, কারণ আমার অনেক পাপ। —এভাবে আমরা নিজেরাই আল্লাহকে تعالى ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। আমাদের জীবনে আল্লাহ تعالى আর প্রতি মুহূর্তের সাথী নন। বরং বছরে একদিন সারা রাত নফল নামাজেই শুধুমাত্র তাঁকে কাছে মনে হয়। সপ্তাহে একদিন মসজিদে দশ মিনিটের জন্য তাঁকে আমরা কাছে মনে করি, আর বাকি দিনগুলো তাঁকে এড়িয়ে চলি।
এভাবে আল্লাহর تعالى সাথে আমরা নিজেরাই একধরনের কৃত্রিম সম্পর্ক তৈরি করেছি। এই কৃত্রিম সম্পর্কের কারণে আল্লাহ تعالى আর আমাদের সুখ-দুঃখের সাথী নন। বরং বড় ধরনের বিপদে পড়লেই শুধুমাত্র তাঁর কথা মনে হয়। অথচ আল্লাহ تعالى এই আয়াতে আমাদেরকে বলছেন, “অবশ্যই” তিনি সবসময় আমাদের কাছেই আছেন। তিনি কখনোই আমাদের থেকে দূরে চলে যান না। আমরা যেন বিনম্র হয়ে একান্ত গোপনে আল্লাহর تعالى কাছে চাই।
আয়াতটি কিন্তু এমন নয় যে, “আমার বান্দারা যখন তোমাকে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে, ‘তাদেরকে বলে দাও যে’, আমি সবসময়ই কাছেই আছি।” এখানে বান্দারা জিজ্ঞেস করছেন রাসুলকে عليه السلام। কিন্তু আল্লাহ تعالى রাসুলকে عليه السلام উত্তর দিতে না বলে, নিজে থেকেই তাঁর বান্দাদেরকে উত্তর দিচ্ছেন। শুধু তাই না, এই আয়াতে তিনি বার ‘আমি’ বলছেন— “আমার বান্দারা”, “আমার ব্যাপারে”, “আমি কাছেই”। কু’রআনে এটা বিরল। কু’রআনে সাধারণত আল্লাহ تعالى তাঁর সম্মান বজায় রেখে আরবিতে “আমরা” (হিন্দি বা উর্দুতে ‘হাম’) ব্যবহার করেন। এটি তাঁর সম্মান এবং দূরত্ব দুটোই নির্দেশ করে। কিন্তু এই আয়াতে তিনি তাঁর বান্দাদের নিজে থেকে উত্তর দিচ্ছেন। বিরল ‘আমি’ শব্দটি বার বার ব্যবহার করছেন, যেন আমরা উপলব্ধি করি যে, আমাদেরকে তিনি تعالى কত কাছের মনে করেন, তিনি تعالى আমাদেরকে কত ভালবাসেন, তিনি تعالى কত আশা করেন যে, আমরা যেন সরাসরি তাঁর কাছেই চাই।
আমাকে যে ডাকে আমি তার ডাকেই সাড়া দেই, যখনি সে ডাকে
অনেক সময় আমরা ভাবি: আল্লাহ تعالى কি আর আমার মতো পাপী বান্দার দু’আ শুনবেন? তিনি শুনবেন হাজি সাহেবের দু’আ, মসজিদের ইমামের দু’আ, মাওলানা, মুফতি সাহেবদের দু’আ। আমার মতো মামুলি বান্দার দু’আ তিনি কি শুনবেন? এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বলছেন, যে-ই তাঁকে ডাকে, তিনি তার ডাকেই সাড়া দেন।
এখানে তিনি বিশেষভাবে বলছেন, ٱلدَّاعِ – অর্থাৎ যে তাঁকে ডাকছে, তাকে তিনি বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছেন আদ-দাঈ অর্থাৎ আহ্বানকারী হিসেবে। তাঁর কাছে সে লক্ষ কোটি মানুষের ভিড়ে মামুলি কেউ একজন নয়। বরং সে বিশেষ একজন দাঈ। আমরা যখন আল্লাহকে تعالى ডাকি, তাঁর কাছে প্রার্থনা করি, তখন আল্লাহ تعالى লক্ষ কোটি মানুষের ভিড়েও আমাদের প্রত্যেককে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেন। আমরা প্রত্যেকে তাঁর تعالى পুরো মনোযোগ পাই। তিনি تعالى একনিষ্ঠ হয়ে আমাদের প্রত্যেকের ডাক শোনেন।
আমরা অনেক সময় মনে করি, আল্লাহ تعالى এত বড় মহাবিশ্ব চালাচ্ছেন, কত কোটি কোটি সৃষ্টি তাঁর, তাঁর কি আর আমার কথা শোনার মতো সময় আছে? এধরনের চিন্তা মানুষের নির্বুদ্ধিতা বা সীমাবদ্ধতা ছাড়া কিছু নয়। আমরা মনে করছি যে, আল্লাহর تعالى মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতার একটা সীমা আছে। তিনি প্রতিটি মানুষকে ঠিক মতো ‘খেয়াল’ করতে পারেন না, বা তাঁর মনোযোগ কম-বেশি হয়। মুখে না বললেও, আমরা অনেকেই আমাদের চিন্তা, কাজের মধ্যে দিয়ে অনেক সময় দেখিয়ে দেই যে, আল্লাহ تعالى বোধহয় আমাকে এখন খেয়াল করছেন না, বা আমার দু’আ ঠিকমতো শুনছেন না। তখন আমরা তাঁকে ‘ঠিকমতো’ শোনানোর জন্য তাবিজ পড়ি, ঘরের দেওয়ালে সুরাহ ঝুলাই, হাজি, ইমাম, মাওলানা সাহেবের কাছে গিয়ে দু’আ করতে বলি। আল্লাহর تعالى সম্পর্কে কতই না অপমানজনক ধারণা আমাদের!
এই আয়াতে আরেকটি লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার হলো, তিনি تعالى বলেননি, তিনি ‘মুসলিমদের’ ডাকে সাড়া দেন। বরং তিনি تعالى বলেছেন, যে-ই তাঁকে ডাকে, তিনি তারই ডাকে সাড়া দেন। তিনি تعالى মুসলিম, অমুসলিম সবার রাব্ব। সবাইকে তিনি تعالى ভালবাসেন, সবার যত্ন নেন, সবার প্রভু তিনি। সবার ডাকে তিনি تعالى সাড়া দেন।[১] আমরা অনেক সময় প্রশ্ন করি, আল্লাহ تعالى কেন অমুসলিমদের এত কিছু দেন? কেন তিনি অমুসলিমদের সমস্যার সমাধান করে দেন? অমুসলিমরা প্রার্থনা করে যা চায়, সেটা পেয়ে যায় কীভাবে, যদি তারা আল্লাহরই تعالى ইবাদত না করে? —এর উত্তর রয়েছে এই আয়াতে। যে-ই তাঁকে تعالى ডাকে, যখনি ডাকে, তিনি تعالى তারই ডাকে সাড়া দেন।
যখনি সে ডাকে
এখানে আল্লাহ تعالى বিশেষভাবে বলছেন, তাঁকে ডাকার জন্য কোনো উপলক্ষ দরকার নেই। তিনি تعالى মানুষের ডাকে সবসময় সাড়া দেন। শুক্রবারে জুমুআহ’য় তাঁকে تعالى ডাকলে তিনি সাড়া দেন, শনিবারে রাতে ডাকলেও তিনি সাড়া দেন। অন্যান্য ধর্মের মতো তিনি تعالى আমাদের কাছে শুধু বিশেষ কিছু মুহূর্তে উপস্থিত থাকেন না। আমাদের জন্য তাঁর দরজা সবসময় খোলা। আমরা যেন কখনোই এমনটা না ভাবি যে, আমার একটা জরুরি দরকারে আল্লাহর تعالى কাছে দু’আ করা দরকার, শবে বরাত আসুক, তখন করবো, এর আগে করলে খুব একটা লাভ হবে না। সেদিন পর্যন্ত আমরা বাঁচবো তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। একারণেই যে কোনো সময় দু’আ করতে আল্লাহ تعالى বলেছেন। তিনি تعالى আয়াতটি “যে-ই আমাকে ডাকে, তার ডাকেই আমি সাড়া দেই” বলেই শেষ করে দিতে পারতেন। তা না করে তিনি تعالى বিশেষভাবে যোগ করেছেন, “যখনি সে ডাকে”।[১]
তাহলে তারাও যেন আমার ডাকে সাড়া দিতে চেষ্টা করে
আল্লাহ تعالى আমাদের ডাকে সাড়া দেবেন কিনা, তাঁর জন্য তিনি আমাদেরকে একটা শর্ত দিয়ে দিয়েছেন: আমাদেরকে তাঁর কথা শুনতে হবে। কোটি টাকার ঘুষ খেয়ে, হারাম টাকায় হাজ্জে গিয়ে চোখের পানি নাকের পানি একাকার করে আল্লাহ تعالى কাছে চাইলে, সেটা তাঁর ডাকে সাড়া দেওয়া হলো না। দিনে পাঁচ ওয়াক্তের মধ্যে এক ওয়াক্ত নামাজ না পড়ে, শুধু শুক্রবার জুমুআহ’য় গিয়ে হাত তুললে, তাঁর ডাকে সাড়া দেওয়া হলো না। গরিব আত্মীয়স্বজনদের কোনো খবর না রেখে, এলাকার এতিমদের জন্য কিছু না করে, সারাদিন নিজের ব্যবসার জন্য দু’আ করলে, তাঁর ডাকে সাড়া দেওয়া হলো না। আমাদেরকে তাঁর تعالى ডাকে সাড়া দিতে হবে। তবেই তিনি تعالى আমাদের ডাকে সাড়া দেবেন বলে কথা দিয়েছেন। তাঁর تعالى ডাকে সাড়া দেওয়া মানে হচ্ছে তাঁর আদেশ-নিষেধ মানা, ইসলাম অনুসারে জীবন পার করা।[১২][১৪]
তোমাদের প্রভু বলেন, “আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো। সাবধান! যারা তাদের অহংকারের কারণে আমাকে ডাকে না, তারা অবশ্যই জাহান্নামে অপমানিত হয়ে প্রবেশ করবে।” [গাফির ৪০:৬০]
আল-বাক্বারাহ’র আলোচ্য এই আয়াতে আল্লাহ تعالى যদি বলতেন, “তাহলে তারা যেন আমার ডাকে সাড়া দেয়” — তাহলে সর্বনাশ হয়ে যেত। আমরা তখন আর তাঁর কাছে কিছু চেয়ে পাওয়ার আশা আর করতে পারতাম না, কারণ আমরা প্রত্যেকেই আমাদের জীবনে বহুবার তাঁর কথা শুনিনি। বহুবার তাঁর অবাধ্য হয়েছি। আমাদের কথা, কাজ, চিন্তার মাধ্যমে বহুবার তাঁর অপমান করেছি। — বরং তিনি এই আয়াতে বলেছেন, فَلْيَسْتَجِيبُوا۟ لِى অর্থাৎ সাড়া দিতে ‘চেষ্টা’ যেন করে। আমরা যেন অন্তত আন্তরিক চেষ্টাটা করি তাঁর কথা শোনার। আমাদের চেষ্টাটাই যথেষ্ট তাঁর কাছে। তাহলেই তিনি تعالى আমাদের ডাকে সাড়া দেবেন।[১] আর কোনো শর্ত তিনি আমাদেরকে দেননি। তাঁর কাছে চাওয়াটা তিনি আমাদের জন্য কত সহজ করে দিয়েছেন। তারপরেও আমরা কোনো কিছু দরকার হলে তাঁর কাছে হাত তুলে দু’আ করি না, বরং অন্য কারো বা কিছুর কাছে ধর্না দেই।
আমার উপর বিশ্বাস রাখে
এই অংশটুকু গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ تعالى বলছেন, যদি আমরা তাঁর تعالى সাড়া পাওয়ার আশা রাখি, তাহলে আমরা যেন তাঁর প্রতি বিশ্বাস রাখি যে, তিনি অবশ্যই আমাদের জন্য যা ভালো, সেটাই তিনি আমদেরকে দেবেন। অনেকেই কয়েকদিন দু’আ করে হতাশ হয়ে অভিযোগ করেন, “আল্লাহর تعالى কাছে কতই তো চাইলাম। কই? কিছুই তো পেলাম না?” অনেকে চাকরির জন্য কয়েক বছর দু’আ করে হতাশ হয়ে দু’আ করা ছেড়ে দেন। অনেকে বিয়ের জন্য সুযোগ্য পাত্র-পাত্রীর জন্য দু’আ করতে করতে হতাশ হয়ে যান। অনেকে ব্যবসা ভালো হওয়ার জন্য দু’আ করে ফল না পেয়ে আশা ছেড়ে দেন। —এগুলো হচ্ছে ঈমানের পরীক্ষা। যেদিন আমরা আল্লাহর تعالى কাছে দু’আ করে আশা ছেড়ে দেই, অভিযোগ করি, সেই দিন আমরা ঈমানের পরীক্ষায় হেরে যাই। আমাদের আল্লাহর تعالى উপর আসলে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল না যে, তিনি সত্যিই আমাদেরকে দেবেন, বা আমার জন্য যেটা সবচেয়ে ভালো, সেটাই তিনি تعالى দেবেন। সত্যিই যদি বিশ্বাস থাকতো, তাহলে আমরা কোনোদিন অভিযোগ করতাম না। আমাদের অভিযোগই আমাদের ঈমানের শূন্যতা প্রকাশ করে দেয়।
অনেক সময় আমরা ঠিক যা চাই, সেটাই না পেলে মনে করি যে, আল্লাহ تعالى আমাদের দু’আ শুনছেন না। আল্লাহ تعالى তিনভাবে আমাদের দু’আর উত্তর দেন[১২][১৪]—
১) আমরা যা চাই ঠিক সেটা দুনিয়াতে দিয়ে।
২) আমরা যা চাই সেটাতে আমাদের কল্যাণ না থাকলে, তার থেকে ভালো কিছু দিয়ে।
৩) দুনিয়াতে না দিয়ে আখিরাতে প্রতিদান দিয়ে, সেটা সমপরিমাণ গুনাহ মাফ করে দিয়ে হলেও।
সুতরাং আমরা যখন কোনো কিছু চেয়েও পাই না, আমাদের এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ تعالى ঠিকই শুনেছেন আমাদের চাওয়া। কিন্তু তিনি অন্য কিছু দিয়ে আমাদের চাওয়ার উত্তর দিয়েছেন। সেটা হয়তো দুনিয়ার জীবনেই দিয়েছেন, যা আমি ভালো করে ভেবে দেখিনি দেখে এখনো উপলব্ধি করিনি। অথবা তিনি এর প্রতিদান আমাকে আখিরাতে দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি যা চেয়েছি, তার বিনিময়ে আমি কিছু না কিছু পাবোই, যদি তিনি ইচ্ছা করেন।
যেমন, কেউ একজন অনেক দু’আ করছে: তার যেন চাকরিতে প্রমোশন হয়। এর জন্য সে সবরকম চেষ্টাও করেছে। ঠিকমতো নামাজ, রোজা, যাকাত আদায় করেছে। চেষ্টা করেছে কু’রআন অনুসারে নিজের জীবন চালানোর। একইসাথে চাকরিতে যথাসাধ্য নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছে, যেন তার পারফরমেন্স নিয়ে কোনো অভিযোগ না থাকে। কিন্তু তারপরেও তার প্রমোশন না হয়ে, তার এক শত্রু কলিগের প্রমোশন হলো। তার উপর দেখা গেল তার স্ত্রী গর্ভবতী হয়ে গেলেন। এত বড় বাড়তি খরচ কীভাবে চালাবেন, সেই দুশ্চিন্তায় তার রাতে ঘুম হয় না।
এই ধরনের পরিস্থিতে পড়ে অনেকেই আল্লাহর تعالى উপর আশা হারিয়ে ফেলেন। তখন তারা ভেবে দেখেন না যে, সেই প্রমোশনটা হলে তাকে প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত অফিসের পেছনে ছুটতে হতো। অতিরিক্ত দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে প্রায়ই নামাজ ছুটে যেত। পরিবারের সাথে সময় দিতে পারতেন না। তার ছেলে মেয়েগুলো উচ্ছন্নে যেত। উপরের পদে নানা ধরনের অন্যায় সিদ্ধান্ত নিতে হতো। যার কারণে তার আয় হারাম হয়ে যেত। বিশাল পরিমাণের হারাম সম্পত্তি নিয়ে চাকুরী জীবন শেষ করতে হতো।
এই সব ক্ষতি থেকে আল্লাহ تعالى তাকে বাঁচালেন তার দু’আর উত্তরে চাকরিতে প্রমোশন না দিয়ে। দেখা গেল তার সন্তানদের সে বছর কোনো অসুখই হলো না। তার স্ত্রীর ডেলিভারিতে কোনো বাড়তি খরচ হলো না। বাড়ির দেওয়ালের আস্তর খসে পড়ে মেরামতে হাজার হাজার টাকার খরচ করতে হলো না। শুধু তাই না, তার যেই সন্তানটি হলো, সেই সন্তান বড় হয়ে বিপুল হালাল সম্পত্তির মালিক হয়ে বাবা-মাকে নিয়ে সুখে শান্তিতে বাস করতে লাগল। সেই সন্তানকে নিয়ে বাবা-মার সে কী গর্ব! এই সব কিছু সে পেল তার দু’আর উত্তর হিসেবে। সে আসলে যা চেয়েছিল: জীবনে সচ্ছলতা, সম্মান, শান্তি —সেই আসল চাওয়া আল্লাহ تعالى তাকে ঠিকই দিলেন, কিন্তু অন্যভাবে। এমন ভাবে দিলেন, যেটা তার জন্য সবচেয়ে ভালো হলো। চাকরিতে প্রমোশন তাকে এগুলো এনে দিত না।
কিন্তু আফসোস, চাকরিতে প্রমোশনের দু’আ কবুল না হওয়ায় সে এসবের কিছুই বুঝলো না, বোঝার চেষ্টাও করলো না।
যেন তারা সঠিক পথে চলতে পারে
এই হচ্ছে আসল পাওয়া। আল্লাহর تعالى কাছে আমাদের যত চাওয়া আছে, তার সবচেয়ে বড় পাওয়া হচ্ছে সঠিক পথে চলতে পারা। কারণ সঠিক পথের গন্তব্য হচ্ছে জান্নাত। যারা দুনিয়াতে সঠিক পথ খুঁজে পেয়েছে, তারা আল্লাহর تعالى অনুগ্রহে শেষ পর্যন্ত জান্নাতে গিয়ে পৌঁছুবে। জান্নাতে গিয়ে পৌঁছুলে সারাজীবনের যত চাওয়া, পাওয়া, ইচ্ছে ছিল, সব সেখানে মনে করা মাত্র এসে হাজির হবে। আর সবচেয়ে বড় পাওয়া হবে যে, সেখানে গিয়ে আমরা আল্লাহকে تعالى দেখতে পাবো। সারাজীবন যাকে না দেখে ডেকেছি, তাঁকে নিজের চোখে দেখতে পাবো। এরচেয়ে বড় পাওয়া আর কিছু হতে পারে না।
সুত্র:
[১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
[২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
[৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
[৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
[৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
চারিদিকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে এত ষড়যন্ত্র, ইসলামের বিরুদ্ধে লেখালেখি, টিভিতেও মুসলিমদের অবমাননা, সরকারগুলোর ইসলামী দলগুলোকে মেরে শেষ করে ফেলা, ইন্টারনেটে নবী, রাসুল (তাঁদের সকলের উপর শান্তি বর্ষিত হোক) কে অপমান করে হাজারো ওয়েবসাইট, মাযহাবে-মাযহাবে ষড়যন্ত্র, ঝগড়াঝাটি, মারামারি, ইলিউমিনাটি, সিক্রেট সোসাইটি, কন্সপিরেসি থিওরি —এত সব ব্যাপার দেখে মুসলিমরা অনেক সময় ঘাবড়ে যায়। দিনরাত চিন্তা করতে থাকে- এত বিরাট সংঘবদ্ধ শত্রুর বিরুদ্ধে কীভাবে মোকাবেলা করবে? কীভাবে সবাইকে প্রতিহত করে নিজেদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করবে? কীভাবে ‘খিলাফত’ নিয়ে আসবে?
দিনরাত দুশ্চিন্তায় তাদের ঘুম হয় না। সারাদিন ইন্টারনেট ঘেঁটে এইসব নিয়ে পড়তে পড়তে তাদের চোখ গর্তে ঢুকে যায়। চারিদিকে এত মিথ্যা, প্রতারণা, বিরোধ, ষড়যন্ত্র দেখে তারা আশা হারিয়ে ক্যান্সার রুগীর মত শুকিয়ে যায়। নেতিবাচক কথা, চিন্তার ভারে ন্যুব্জ হয়ে যায়। এদেরকে আল্লাহ পরামর্শ দিচ্ছেন—
প্রত্যেকের আপন লক্ষ্য রয়েছে, যেদিকে সে ঘুরে দাঁড়ায়। তাই ভালো কাজে এগিয়ে থাকার জন্য একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করো। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, আল্লাহ تعالى তোমাদেরকে এক জায়গায় করবেন। অবশ্যই আল্লাহর تعالى যেকোনো কিছু করার ক্ষমতা আছে। [আল-বাক্বারাহ ১৪৮]
ইসলামের বিরুদ্ধে কে, কী করছে, এই সব নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে, আমাদেরকে প্রতিযোগিতা করতে হবে- আমরা কে, কত বেশি ভালো কাজ করতে পারি। আল্লাহ প্রত্যেককে বিশেষ লক্ষ্য দিয়েছেন। আমাদেরকে সেই লক্ষ্য উপলব্ধি করে চেষ্টা করে যেতে হবে সেই লক্ষ্য অর্জনে কাজ করার।[৬][২] এর জন্য দিনের পর দিন বসে থাকলে হবে না, প্রতি মুহূর্তে প্রতিযোগিতা করতে হবে। আল্লাহ تعالى আমাদেরকে ভালো কাজে দ্রুত চেষ্টা করার জন্য তাগাদা দিয়েছেন। বসে বসে সময় নষ্ট করলে আল্লাহর تعالى প্রতি অবাধ্যতা দেখানো হবে। আমাদের উপর থেকে আল্লাহর تعالى দেওয়া সময়ের বরকত চলে যাবে।[৪]
আমাদের সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। দুনিয়াতে আমাদের সেই প্রতিযোগিতার সময়সীমা প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই শেষ ঘণ্টা বাজল বলে… (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)
হাজার বছর ধরে মানুষের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে নানা রঙের নানা ধরনের মাহাত্ম্য বের হয়েছে। হিন্দু ধর্মে লাল পবিত্রতার প্রতীক, তাই বিভিন্ন উৎসবে লাল রঙের ব্যবহার দেখা যায়, যেমন বিয়ে, শিশু জন্ম। হলুদ হচ্ছে জ্ঞান এবং শিক্ষার রঙ, তাই বিষ্ণু এবং গণেশ হলুদ রঙের কাপড় পড়ে। নীল স্থিরতা, সাহসিকতা, একনিষ্ঠতার রঙ, তাই রাম, কৃষ্ণর রঙ নীল।[২৭২]
খ্রিস্টানরা কোনো ব্যক্তিকে খ্রিস্ট ধর্মের দীক্ষা দেওয়ার সময় হলুদ রঙের পানিতে গোসল করায়। একইভাবে নবজাতক শিশুকেও, যে কিনা জন্ম হয়েছে পাপী হয়ে, তাকে হলুদ রঙের পানি দিয়ে ‘বাপটাইজ’ করানো হয়। তখন সে যীশুর জীবন দানের ফলে মানুষের সব পাপ কেটে যাওয়ার দাবীদার হয়ে যায়।[৮]
এভাবে যুগে যুগে নানা ধর্মে, বিভিন্ন রঙের বিভিন্ন মাহাত্ম্য বের হয়েছে। ধর্মীয় উৎসবগুলোতে নানা রঙের ছড়াছড়ি দেখা যায়।[৮] একইসাথে মুসলিমদের মধ্যে নানা রঙ নিয়ে নানা ধরনের কুসংস্কার চলে এসেছে। কু’রআনে এই সব ফালতু ধারণাকে ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে—
আমরা আল্লাহর تعالى রঙে রঞ্জিত। আল্লাহর تعالى চেয়ে সুন্দর রঙ আর কে দিতে পারে? আমরা শুধুমাত্র তাঁরই দাস। [আল-বাক্বারাহ ১৩৮]
অনেকে এই আয়াতের অনুবাদ পড়ে ভাবেন, “আল্লাহর تعالى আবার রঙ আছে নাকি? আস্তাগফিরুল্লাহ! কী সব কুফরি কথাবার্তা!” এই আয়াতে ‘আল্লাহর تعالى রঙ’ বলতে একধরনের প্রতীকী অর্থে বোঝানো হয়েছে। আমরা যেমন বলি “তার হৃদয়ে বসন্তের হাওয়া লেগেছে” তখন কিন্তু আমরা ধরে নেই না যে, তার হৃদপিণ্ডে বসন্তের বাতাস ঢুকেছে। এই কথাটা কেউ গ্রীষ্মকালেও বলতে পারে, আবার শীতকালেও বলতে পারে, এর সাথে বসন্ত ঋতুর কোনো সম্পর্ক নেই। একইভাবে এই আয়াতে আক্ষরিক অর্থে কোনো রঙ বোঝানো হয়নি, এটি একটি আরবি প্রবাদ বাক্য। এমনকি যারা কু’রআনে আল্লাহর تعالى সিফাত-এর আক্ষরিক অর্থ করেন, যেমন আল্লাহর تعالى হাত বলতে আক্ষরিক অর্থে হাতই বোঝান, তারাও এই আয়াতে রঙ বলতে আক্ষরিক অর্থে রঙ দাবি করেননি।
এই আয়াতে صِبْغَة বা রঙ-এর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। রঙ যেমন দেখলেই সনাক্ত করা যায়, ঠিক একইভাবে যাদের খাঁটি ঈমান রয়েছে, তাদের কথাবার্তা, কাজ, আচরণ দেখলেই তাকে সনাক্ত করা যায়। একজন প্রকৃত মুসলিমকে দেখলেই বোঝা যায় যে, সে আল্লাহর تعالى রঙে রঞ্জিত।[৪] যদি কোনো মুসলিম-এর কথা-কাজ-আচরণ দেখে কোনোভাবেই বোঝা না যায় যে, সে একজন মুসলিম, তাহলে তার ভেতরে তাওহীদের অভাব রয়েছে। সে এখনো আল্লাহর تعالى রঙে রঞ্জিত হতে পারেনি। (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)
আজকাল সুধীবৃন্দ প্রশ্ন করেন, “সত্যিই যদি আল্লাহ বলে কেউ থাকে, তাহলে তিনি আমাদের সাথে কথা বলেন না কেন? আমি তো কোনোদিন কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটতে দেখলাম না? প্রমান কী যে আল্লাহ বলে আসলেই কেউ আছেন?” প্রথমত, তাদেরকে অভিনন্দন! তারা এমন একটি জটিল, আধুনিক, যুগোপযোগী প্রশ্ন আবিষ্কার করেছেন, যা ১৪০০ বছর আগে আরবের মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ানো যাযাবর, অশিক্ষিত, অসামাজিক বেদুইনরা রাসুলকে عليه السلام করেছিল। শুধু তাই না, তাদের আগেও নবীদেরকে একই প্রশ্ন করা হয়েছিল। এর উত্তর আল্লাহ تعالى কু’রআনেই দিয়ে দিয়েছেন—
যারা বোঝে না, তারা বলে, “কেন আল্লাহ تعالى আমাদের সাথে কথা বলে না?” বা “আমাদের কাছে কোনো অলৌকিক নিদর্শন আসে না কেন?” ওদের আগের প্রজন্মও একই কথা বলে গেছে। ওদের সবার অন্তর আসলে একই রকম। আমি অবশ্যই আমার নিদর্শনগুলো যথেষ্ট পরিষ্কার করে দিয়েছি সেই সব মানুষের কাছে, যারা নিশ্চিত হতে চায়। [আল-বাক্বারাহ ১১৮]
যারা এই ধরনের প্রশ্ন করে, তাদের আসল সমস্যা হচ্ছে: তারা মনে করে না যে, ইসলাম এমন কোনো অসাধারণ ধর্ম, যা তাদের মানতে হবে। অথবা তারা মনে করে না যে, ইসলাম তাদেরকে এমন কিছু দিতে পারে, যা তারা নিজেরাই চিন্তা ভাবনা করে বের করতে পারে না। তাই তাদের দাবি হচ্ছে: আল্লাহ تعالى যেন তাদের সাথে সরাসরি কথা বলে তাদেরকে বোঝান, কেন তারা ইসলাম মানবে? ইসলামে এমন কী আহামরি কিছু আছে যে, তা মানতে হবে?
আপনাকে যখন কোনো গাড়ির সেলসম্যান একটা সাধারণ গাড়ি বিক্রি করার চেষ্টা করে, সে আপনাকে অনেক বোঝাবে: কেন আপনার গাড়িটা কেনা উচিত, এই গাড়ির চমৎকার বৈশিষ্ট্য কী যা অন্য গাড়ির নেই, কীভাবে এই গাড়িটা সমাজে আপনার স্ট্যাটাস বাড়িয়ে দেবে ইত্যাদি। সে নানা ভাবে চেষ্টা করবে আপনাকে গাড়িটা গছিয়ে দেওয়ার, কারণ গাড়িটা এমন কোনো অসাধারণ কোনো গাড়ি নয়, যা কেনার জন্য মানুষ গভীর আগ্রহে কয়েক মাস আগে থেকে এপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার জন্য লাইন ধরে থাকে।
ধরুন আপনি একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন: আপনি একটা বিশেষ দামী ব্র্যান্ডের গাড়ি কিনবেন। আপনার বন্ধুরা আপনাকে অনেক বুঝিয়েছে যে, এর চেয়ে ভালো, নিরাপদ গাড়ি আর নেই। আপনি নিজেও অনেক পড়াশুনা করে দেখলেন যে, আসলেই এর চেয়ে শক্তসামর্থ্য, নিরাপদ গাড়ি এখন পর্যন্ত কোনো কোম্পানি বানায়নি। কিন্তু কেনার আগে আপনি দাবি করলেন: সেই গাড়ির কোম্পানির সিইও-র সাথে আপনি নিজে কথা বলবেন, তারপরেই সেই গাড়ি কিনবেন, নাহলে কিনবেন না। সিইও যেন নিজে আপনাকে ফোন করে তার গাড়ি কিনতে অনুরোধ করে। (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)
কীভাবে কোনো কিছুর সৃষ্টি হয়, এনিয়ে নানা ধর্মে নানা মতবাদ রয়েছে। কিছু ধর্ম মতে: বস্তু এবং শক্তি সবসময়ই ছিল, সেগুলোর শুধুই রূপান্তর হয়। এর বিরুদ্ধে খুব সহজ কিছু যুক্তি এবং পর্যবেক্ষণ দিয়ে তা ভুল প্রমাণ করা যায় (দেখুন আল-বাক্বারাহ ১০৮)। আবার কিছু ধর্ম (এমনকি বৈজ্ঞানিক মতবাদও) প্রচার করে: মহাবিশ্ব সৃষ্টির আগে এক মহা-মহাবিশ্ব ছিল, যেখানে যা কিছু সৃষ্টি হওয়া সম্ভব, তার সবকিছু সৃষ্টি হচ্ছে, এবং আমাদের মহাবিশ্বের মত আরও অসংখ্য মহাবিশ্ব রয়েছে।
আবার কিছু ধর্ম এবং বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রচার করে: বস্তু এবং শক্তির আগে ‘কিছু’ একটা ছিল, যা থেকে সবকিছু এমনিতেই সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের চারপাশে যে বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিজগৎ আমরা দেখছি, তার জন্য কোনো বুদ্ধিমান বা ব্যক্তিত্ববান স্রষ্টার কোনো প্রয়োজন নেই। এগুলো সব কিছুই সেই ‘কিছু’ একটা থেকে এমনিতেই সৃষ্টি হয়েছে। —এর বিরুদ্ধেও খুব সহজ যুক্তি দিয়ে তা সহজেই ভুল প্রমাণ করা যায়।
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত ধারণা, যার বিরুদ্ধে কোনো ফিলসফিকাল যুক্তি ধোপে টিকতে পারেনি, তা পাওয়া যায় কু’রআনে—
সবগুলো আকাশ এবং পৃথিবীর অস্তিত্বদানকারী তিনি। যখন তিনি কিছুর অস্তিত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তিনি সেটাকে শুধু বলেন: ‘হও’, আর তা হয়ে যায়। [আল-বাক্বারাহ ১১৭]
ইসলাম ছাড়া বাকি প্রায় সবগুলো ধর্ম কোনো না কোনো ভাবে চেষ্টা করে: পরম স্রষ্টার পাশাপাশি এক বা একাধিক ‘স্রষ্টার হেল্পার’ বা পাতি-ঈশ্বর-এর ধারণা নিয়ে আসতে, যারা মানুষের ‘অনেক কাছের’, যেখানে পরম স্রষ্টা হন অনেক দূরের। যারা মানুষের দুঃখ, কষ্ট বোঝে, যা পরম স্রষ্টা বোঝার ঊর্ধ্বে। যারা মানুষের নানা ভাবে উপকার করার চেষ্টা করে, যা পরম স্রষ্টা তাদের জন্য করার প্রয়োজন মনে করেন না। যাদের মানুষের মতই দোষ-ত্রুটি আছে, যেখানে পরম স্রষ্টা খুব বেশি পবিত্র, তিনি মানুষের দোষগুলো বোঝেন না।
এভাবে মানুষ এই ধরনের পাতি-ঈশ্বরদেরকে জন্ম দিয়ে পরম স্রষ্টাকে দূরে সরিয়ে দেয়। একইসাথে তারা নিজেদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, যেহেতু তাদের সেই সব পাতি-ঈশ্বরদের রাগ, অভিমান, কামনা-বাসনা, ভুলে যাওয়া, আইন অমান্য করা ইত্যাদি নানা ধরনের ‘গুণ’ আছে, তাই মানুষের এসব ‘গুণ’ থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। সুতরাং, মানুষের ধর্ম নিয়ে এত কড়াকড়ি করার দরকার নেই। এই সব পাতি-ঈশ্বররা মানুষের দোষত্রুটিকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে। পরম স্রষ্টার কঠিন শাস্তি থেকে তাদেরকে বাঁচাবে।
আল্লাহ تعالى এই ধরনের ফাঁকিবাজি মানসিকতাকে কু’রআনে বহুবার গুড়িয়ে দিয়েছেন—
ওরা বলে, “আল্লাহ تعالى একজন সন্তান নিয়েছেন।” তিনি এসব থেকে পবিত্র! কখনই না! সবগুলো আকাশ এবং পৃথিবীতে যা কিছু আছে সব তাঁর। সবকিছুই তাঁর একান্ত অনুগত। [আল-বাক্বারাহ ১১৬]