কিয়ামতের দিন আল্লাহ ওদের সাথে কথা বলবেন না — আল-বাক্বারাহ ১৭৪-১৭৬

গত কয়েক শতকে উপমহাদেশের মানুষদেরকে কৌশলে কুরআন থেকে দূরে রেখে কয়েকটা প্রজন্ম তৈরী করা হয়েছে, যারা কুরআন সম্পর্কে নুন্যতম জ্ঞানও রাখে না। এরা জানে না কুরআনে পরিষ্কারভাবে কী হালাল, কী  হারাম বলা আছে, তাওহীদের শিক্ষা কী? তারা শুধু পড়েছে কিছু গৎবাঁধা বই, যেই বইগুলোর অনেকগুলোতেই নানা ধরনের জাল হাদিস, বিদআতের ছড়াছড়ি।[১১] এভাবে একটি পুরো জাতিকে কুরআনে নিরক্ষর করে রেখে গেছে কিছু ইসলামী নামধারি দল এবং কথিত আলেম নিজেদের ইচ্ছামত ধর্ম ব্যবসা করার জন্য। এদের পরিণাম ভয়ঙ্কর—

2_174_title

2_174আল্লাহ যা পাঠিয়েছেন সেটা যারা গোপন রাখে, আর দুনিয়ায় সামান্য লাভের বিনিময়ে তা বেচে দেয়, ওরা নিজেদের পেটে জাহান্নামের আগুন ছাড়া আর কিছু ভরে না। কিয়ামতের দিন আল্লাহ ওদের সাথে কথা বলবেন না, ওদেরকে পবিত্রও করবেন না। ওদের জন্য রয়েছে প্রচণ্ড কষ্টের শাস্তি। [আল-বাক্বারাহ ১৭৪]

আজকাল অনেক ‘আধুনিক মুসলিম’ কু’রআনের আয়াতগুলোর পরিষ্কার বাণীকে ধামাচাপা দিয়ে, অনেকসময় বিশেষভাবে অনুবাদ করে, ইসলামকে একটি ‘সহজ জীবন ব্যবস্থা’ হিসেবে মানুষের কাছে প্রচার করার চেষ্টা করছেন। তারা দেখছেন যে, পাশ্চাত্যের ‘উন্নত’ জাতিগুলো ধর্ম থেকে দূরে সরে গিয়ে কত আনন্দের জীবন যাপন করছে, জীবনে কত স্বাধীনতা উপভোগ করছে: প্রতিদিন রংবেরঙের মদ পান করছে, বিশাল সব আভিজাত্যের হোটেলে গিয়ে জুয়া খেলছে, সুইমিং পুলে সাঁতার কাটছে; ইচ্ছামত সুন্দর কাপড় পড়ছে, বন্ধু বান্ধব নিয়ে নাচগান করছে—জীবনে কতই না ফুর্তি ওদের।

ওদের এত সুখ, এত আনন্দ দেখে তারা ভিতরে ভিতরে ঈর্ষায় জ্বলে যাচ্ছে। কেন তারা ওদের মতো ফুর্তি করতে পারবে না? কেন তাদেরকে এতটা নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করতে হবে?— এটা তারা কোনোভাবেই নিজেদেরকে বোঝাতে না পেরে, চেষ্টা করছে কোনোভাবে যদি ইসলামকে একটি ‘আধুনিক’, ‘সহজ’ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে মানুষের কাছে প্রচার করা যায়। তখন তারা পশ্চিমাদের মতো ফুর্তি করতে পারবে, আবার মুসলিমদের কাছ থেকে একদম দূরেও সরে যেতে হবে না, সমাজে অপরাধীর মতো লুকিয়ে চলতে হবে না। ‘মুহাম্মাদ’ ‘আব্দুল্লাহ’ নাম নিয়ে একদিকে তারা সপ্তাহে একদিন জুম্মার নামায পড়তে যেতে পারবে, অন্যদিকে বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে মেয়েদের সাথে নাচতে পারবে, রবিবারে পার্টিতে বন্ধুদের সাথে একটু রঙিন পানিও টানতে পারবে। এভাবে তারা ‘আল্লাহ যা পাঠিয়েছেন সেটা গোপন রাখে, আর দুনিয়ায় সামান্য লাভের বিনিময়ে তা বেচে দেয়,’—কু’রআনের শিক্ষার পরিপন্থী একটি জীবন যাত্রাকে নিজেদের ফুর্তির জন্য মুসলিমদের কাছে গ্রহণযোগ্য করানোর চেষ্টা করছে।

অথচ তারা একটু চিন্তা করলেই দেখতে পেত যে, এই সব চাকচিক্য, আমোদ-ফুর্তির পরিণতি হলো ডিপ্রেশন, অপুষ্টি জনিত শারীরিক সমস্যা, পরকীয়া থেকে তালাক, অ্যালকোহল জনিত অসুস্থতা, মারামারি, খুনাখুনি, ছেলেমেয়েদের ইয়াবা আসক্তি, নানা ধরনের যৌন অসুখ থেকে শেষ পর্যন্ত এইডস। দুনিয়ার কোনো হারাম আনন্দ মানুষকে কখনই সুখী করতে পারে না। কিছু সময়ের জন্য মানুষ হয়তো আমোদ-ফুর্তি করে, কিন্তু তারপরেই শুরু হয় জীবনে নানা সমস্যা এবং অসুখ। আসলেই, ‘ওরা নিজেদের পেটে জাহান্নামের আগুন ছাড়া আর কিছু ভরে না।’

মানুষের জন্য যা কিছুই সত্যিকারের ভালো, যা কিছুই কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া নির্মল আনন্দের—সেটা আল্লাহ تعالى ইতিমধ্যেই হালাল করে দিয়েছেন। তিনি যা কিছুই হারাম করেছেন, তার প্রত্যেকটির পিছনেই কোনো না কোনো বিরাট ক্ষতি রয়েছে। একটু সময় নিয়ে চিন্তা করলে, পরিসংখ্যানগুলো দেখলেই বোঝা যায়: আল্লাহ تعالى  সেগুলোকে হারাম করে দিয়ে আমাদের কত বড় উপকার করেছেন।

কিয়ামতের দিন আল্লাহ ওদের সাথে কথা বলবেন না, ওদেরকে পবিত্রও করবেন না।

কিয়ামতের বিচার শুরু হওয়ার পর যখন আমাদের ডাক পড়বে, তখন প্রতিটি মানুষকে নিয়ে একা আল্লাহর تعالى সামনে দাঁড় করানো হবে। সেদিন আল্লাহ تعالى প্রত্যেকের সাথে সরাসরি কথা বলবেন। তাঁর تعالى এবং আমাদের মাঝে কোনো অনুবাদক, পির, নবি, ওলি —কেউ থাকবে না।

তারপর তিনি تعالى আমাদের বিচার শুরু করবেন। সারাজীবন আমরা যত খারাপ কাজ করেছি, সেগুলোর জন্য জবাব চাইবেন, তাঁর تعالى  অসীম অনুগ্রহে হয়ত ক্ষমা করে দেবেন। আর যত ভালো কাজ করেছি, সেগুলো তিনি تعالى  আমাদেরকে দেখাবেন।[৩১৯] কিয়ামত হচ্ছে আমাদের সব পাপের ফয়সালা করে, আমাদেরকে পবিত্র করে জান্নাতের জন্য তৈরি করার জায়গা। জান্নাত পবিত্র মানুষদের জায়গা। সেখানে অপবিত্রদের প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। যারা কিয়ামতের বিচারে পাশ করে আল্লাহর تعالى অনুগ্রহে পবিত্র হয়ে জান্নাতে যেতে পারবেন, তাদের জন্য বিরাট সুখবর। আর যাদের এত পাপ জমে থাকবে যে, বিচার শেষেও তাদের পাপের পাল্লা ভারি থাকবে, তাদের পরিণতি হবে জাহান্নাম।[সূরা আল-ক্বারিয়াহ]

কিন্তু কিয়ামতের দিন একদল লোক থাকবেন, যাদের সাথে আল্লাহ تعالى সেদিনও কোনো কথা বলবেন না। তারা যতই অনুনয়, বিনয় করুক না কেন, আল্লাহ تعالى কোনো উত্তর দেবেন না। তারা কিয়ামতের এই পবিত্র করার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবে না। এই চরম অপরাধীরা হচ্ছে—

2_175এরা হচ্ছে সেই সব লোক, যারা সঠিক পথের বিনিময়ে ভুল পথ এবং ক্ষমার বিনিময়ে শাস্তি বদলে নিয়েছে। জাহান্নামের আগুন সহ্য করতে এদের কতই না ধৈর্য! [আল-বাক্বারাহ ১৭৫]

2_176তা এজন্য যে, আল্লাহ সত্য দিয়ে কিতাব নাজিল করেছেন। যারা কিতাব নিয়ে মতবিভেদ তৈরি করে, তারা ধর্মে বিভেদ তৈরিতে বহু দূর চলে গেছে। [আল-বাক্বারাহ ১৭৬]

ধর্ম হচ্ছে একমাত্র হাতিয়ার: যা ব্যবহার করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে দিয়ে কোনো প্রশ্ন না করিয়ে বড় কোনো উদ্দেশ্যে কাজ করানো যায়। কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন করা দরকার? কিছু খ্যাতনামা আলেমকে হাত করে, তাদেরকে দিয়ে কিছু ভুয়া হাদিস বানিয়ে, ফতোয়া জারি করে দিন। লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রেমী বান্দা ঝাঁপিয়ে পড়বে উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে। কোনো অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করা দরকার? একটি মাজার খুলে মোটাসোটা নূরানি চেহারার দেখতে একটা লোককে ভাড়া করে এনে, তার নামে গ্রামে-গঞ্জে নানা অলৌকিক কাহিনী প্রচার করে দিন। তারপর একজন রসায়নবিদ ভাড়া করে কিছু কেমিক্যাল ব্যবহার করে সবার সামনে কিছু চমৎকার ‘জাদু’ দেখিয়ে দিন। হাজার হাজার মানুষ সরল মনে সেই মাজারের মুরিদ হয়ে, নিয়মিত এসে লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে যাবে।

ধর্ম ব্যবহার করে একদম প্রথম ‘ইসলামিক’ রাজবংশ উমাইয়া[১৬৫] থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর মুসলিম সম্রাটরা পর্যন্ত ব্যাপক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করে গেছেন[১৬৭]। আর নিরক্ষর, মূর্খ মুসলিমরা কু’রআন-হাদিস নিজেরা না পড়ে, আল্লাহ تعالى প্রদত্ত মস্তিস্কটা ব্যবহার না করে, সেই রাজনৈতিক নেতাদের হাতের পুতুল হয়ে এমন সব কাজ করে গেছেন, যা ধর্ম হিসেবে ইসলামের ব্যাপক বদনাম করে দিয়েছে। আজকের যুগেও রাজনীতি এবং ফিকহ শাস্ত্রে অনভিজ্ঞ ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনতার একটা বিরাট অংশকে একদল ঝানু, দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদ-আলেম হাত করে রেখেছে কু’রআন এবং হাদিসের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যাখ্যা করে। অনেক সৎ, সাহসী আলেম কলম তুলে ধরেছিলেন তাদের বিরুদ্ধে। তারপর সেই আলেমদের অনেকেই হয় জেলে গেছেন, চরম অত্যাচারের শিকার হয়েছেন (যেমন, ইবন তাইমিয়া[১৬৬], প্রধান চার মাযহাবের ইমামরা), না হয় তাদেরকে গুম করে ফেলা হয়েছে।

এই ধরনের মানুষরা সাধারণত দল বেঁধে থাকে, কারণ তারা জানে একা একা এরকম অন্যায় করে টিকে থাকা মুশকিল। অনেক সময় এদের দলের কেউ ভুল করে কোনো সত্য কথা ফাঁস করে দেয়। তখন শুরু হয় তার উপর আক্রমণ। তাকে হয় দল ছাড়া করা হয়, না হয় গুম করে ফেলা হয়।

এই ধরনের মাফিয়া মানসিকতা কিছু কিছু আলেমের মধ্যেও রয়েছে। ধরুন, কোনো বিশেষ মতবাদের অনুসারী কয়েকজন আলেমের একটা দল, অন্য কোনো মতবাদের অনুসারী একজন আলেমকে ভুল প্রমাণ করে বইয়ের উপর বই লিখে, মসজিদে খুতবার পর খুতবা দিয়ে এসেছে। কিন্তু একদিন তাদের একজন উপলব্ধি করল যে, কাজটা ঠিক হচ্ছে না, কারণ তাদের যুক্তি এবং দলিলে কিছু ভুল আছে। এখন তার সামনে দুইটা পথ খোলা: ১) সত্য কথা বলে দল থেকে বহিস্কার হয়ে যাওয়া। যার ফলাফল: তার দলের বাকিরা তখন তাকে নিয়েই বই লিখতে বসবে। তার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করবে। মসজিদের খুতবায় তাকে বদনাম করে তার ক্যারিয়ার শেষ করে দিবে। যদি দলের বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে হয়ত তাকে গুম করে ফেলা হবে। অথবা, ২) ‘বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে ক্ষুদ্র ত্যাগ করে’ দলের খ্যাতি, অগাধ ফান্ড, সুসজ্জিত অফিস, লাইব্রেরী ইত্যাদি না হারিয়ে, দলের বাকিদের সাথে মিলমিশ করে খারাপ কাজটা মুখ বুজে চালিয়ে যাওয়া — এই আশা থেকে যে, বাকি অনেক ভালো কাজের বিনিময়ে এই খারাপ কাজটা আল্লাহ تعالى মাফ করে দেবেন।

এদেরকে নিয়ে আল্লাহ تعالى বলছেন যে, এরা ধর্ম বিভেদ তৈরি করতে করতে কত দূরই না চলে গেছে। একের পর এক দলে বিভক্ত হয়ে দিন রাত একে অন্যকে আক্রমণ। একে অন্যের দোষ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করা। সাধারণ মুসলিমদেরকে একের পর এক পরস্পর বিরোধী ফাতয়া দিয়ে বিভ্রান্ত করতে করতে এরা ইসলামকে জটিল থেকে জটিলতর করে ফেলেছে। জাহান্নামের আগুন সহ্য করতে এদের কতই না ধৈর্য! কতই না মোটা চামড়া এদের!

সুত্র:

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
  • [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
  • [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
  • [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
  • [১৫] তাফসির আল জালালাইন।
  • [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ।
  • [৩১৯] Onislam.net (2015). Accountability and the Day of Judgment. Retrieved 25 July 2015, from http://www.onislam.net/english/ask-about-islam/faith-and-worship/islamic-creed/167025-accountability-and-the-day-of-judgment.html

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *