তোমরাও কি সেভাবেই তোমাদের নবীকে প্রশ্ন করতে চাও? — আল-বাক্বারাহ ১০৮

হাজার বছর আগে মুসা عليه السلام নবীকে বনি ইসরাইলিরা নানা ধরনের প্রশ্ন করত: “আল্লাহ تعالى কোথায়? দেখাও আমাদেরকে। আল্লাহকে تعالى নিজের চোখে না দেখলে, নিজের কানে তাঁর আদেশ না শুনলে বিশ্বাস করব না।” তার শত বছর পরে নবী মুহাম্মাদ-কেও عليه السلام একই ধরনের প্রশ্ন করা হত: “সাফা পাহাড়কে সোনার পাহাড় বানিয়ে দেখাও দেখি? আকাশ থেকে একটা বই এনে দেখাও দেখি?”[১৪] হাজার বছর পরে আজ বিংশ শতাব্দীতে এসে এখনও আল্লাহর تعالى সম্পর্কে একই ধরনের প্রশ্ন করতে দেখা যায়। শুধু প্রশ্নগুলো আগের থেকে আরও ‘আধুনিক’ এবং ‘বৈজ্ঞানিক’ হয়েছে, এবং কথা ও যুক্তির মারপ্যাঁচে একটু বেশি গম্ভীর শোনায় —এই যা।

2_108

যেভাবে মুসাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তোমরাও কি সেভাবেই তোমাদের নবীকে প্রশ্ন করতে চাও? যে ঈমানকে কুফরি দিয়ে বদল করে, সে সঠিক পথ থেকে একেবারেই হারিয়ে গেছে। [আল-বাক্বারাহ ১০৮]

আজকের যুগে আল্লাহর تعالى অস্তিত্বকে অস্বীকার করে বিভিন্ন ধরনের নাস্তিকদের কিছু প্রশ্ন এবং দাবি দেখা যাক—

universe man

মহাকাশ বিজ্ঞানী: মহাবিশ্ব শূন্য থেকে নিজে থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে কিছু ছিল না। মহাবিশ্বের কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই। Quantum Vaccum কোয়ান্টাম শূন্যতা থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। মহাবিশ্ব কোনো স্রস্টা বানিয়েছে, তার প্রমাণ কী?

পদার্থবিজ্ঞানী: মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে এক অতি-মহাবিশ্ব থেকে। একে কোনো সৃষ্টি কর্তা বানায়নি। এক অতি-মহাবিশ্ব, যাকে মাল্টিভার্স বলা হয়, সেখানে প্রতিনিয়ত সকল ধরনের সৃষ্টি জগত তৈরি হয়। সকল সম্ভাবনা সেখানে বিদ্যমান। এরকম অসীম সংখ্যক মহাবিশ্বের একটিতে আমরা রয়েছি। আরেকটি মহাবিশ্বে হয়ত আমারই মত একজন রয়েছে, যে আমার থেকে একটু লম্বা। আরেকটিতে আমার থেকে একটু খাটো। মোট কথা যতকিছুই ঘটা সম্ভব, তার সবই ঘটেছে, ঘটছে এবং ঘটবে। এই মহাবিশ্বই একমাত্র মহাবিশ্ব, যাকে কোনো একক সত্তা সৃষ্টি করেছে, এর প্রমাণ কী?
দার্শনিক: মহাবিশ্ব অনন্তকাল থেকে রয়েছে। পদার্থ এবং শক্তি অবিনশ্বর। এদের সৃষ্টি বা ধ্বংস হয় না। এদের শুধু রূপান্তর হয়। সময় অসীম। মহাবিশ্ব যে একদিন ছিল না, সময় যে একসময় শুরু হয়েছে, এবং একে যে কোনো এক অতিসত্তা সৃষ্টি করেছে, তার প্রমাণ কী?

জীববিজ্ঞানী: কোনো অতিবুদ্ধিমান সত্তা মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদ সৃষ্টি করেনি। এগুলো সবই প্রাকৃতিক নিয়মের ফলাফল। বিবর্তনের ফলে এক কোষী প্রাণী থেকে বহুকোষী প্রাণী তৈরি হয়েছে এবং কোটি কোটি বছর ধরে তা উন্নত হতে হতে একসময় বানর বা শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষের মতো বুদ্ধিমান প্রাণী তৈরি হয়েছে। মানুষ কোনো বিশেষ প্রাণী নয়, শুধুই বানর থেকে বিবর্তনের ফলে একটু উন্নত প্রাণী। প্রমাণ কী যে, কোনো অতিবুদ্ধিমান সত্তা নিজের ইচ্ছামত ডিজাইন করে সমস্ত প্রাণী এবং উদ্ভিদ তৈরি করেছে?

ঐতিহাসিক: যদি কোনো বুদ্ধিমান সত্তা মহাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতই, তাহলে ইতিহাসে অনেক ঘটনা থাকতো, যা থেকে বোঝা যেত: কোনো বুদ্ধিমান সত্তা সেগুলো ঘটিয়েছে, যা কোনোভাবেই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ঘটা সম্ভব নয়। এরকম ঘটনা ঘটতে তো দেখা যাচ্ছে না। তাহলে প্রমাণ কী যে, আল্লাহ বলে সত্যিই কেউ আছে?

উঠতি নাস্তিক: আল্লাহ تعالى যদি সবকিছু সৃষ্টি করে থাকে, তাহলে তাকে সৃষ্টি করলো কে?

হতাশাগ্রস্থ নাস্তিক: সত্যিই যদি আল্লাহ تعالى থাকে, তাহলে পৃথিবীতে এত দুঃখ, কষ্ট, মুসলিমদের উপর এত অত্যাচার, এত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি হয় কেন? আল্লাহ تعالى এগুলো হতে দেয় কেন?

আঁতেল নাস্তিক: আল্লাহ تعالى ধারণাটা আসলে মানুষের কল্পনা প্রসূত। মানুষ যখন কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পারত না, তখন তারা মনে করত: নিশ্চয়ই কোনো অতিপ্রাকৃত সত্তা রয়েছে, যে এসব ঘটাচ্ছে। একারণে মানুষ এমন কোনো সত্তাকে কল্পনা করে নেয়, যার কোনো দুর্বলতা নেই। যেমন: তার ক্ষুধা, ঘুম পায় না; সে মারা যায় না; কেউ তাকে জন্ম দেয় না; তার কোনো শরীর নেই যেখানে সে আবদ্ধ; তার কোনো আকার নেই, যা তাকে দুর্বল করে দেবে। এরকম নিরাকার, অবিনশ্বর, অসীম ক্ষমতা ইত্যাদি যত সব কল্পনাতীত গুণ মানুষচিন্তা করে বের করতে পেরেছে, তার সবকিছু ব্যবহার করে সে এক স্রস্টাকে সৃষ্টি করেছে। এর মানে তো এই না যে, স্রস্টা বলে আসলেই কেউ আছে?

ঘৃণাস্তিক: ধর্মের নামে যে পরিমাণ মানুষ হত্যা হয়েছে, আর অন্য কোনোভাবে এত মানুষ মারা যায়নি। ধর্মের কারণে মানুষে মানুষে ঝগড়া, ঘৃণা, মারামারি, দলাদলি, এক জাতি আরেক জাতিকে মেরে শেষ করে ফেলা —এমন কোনো খারাপ কাজ নেই যা হয় না। পৃথিবীতে যদি কোনো ধর্ম না থাকতো, তাহলে মানুষে-মানুষে এত ভেদাভেদ, এত রক্তারক্তি কিছুই হতো না। যদি আল্লাহ বলে আসলেই কেউ থাকে, তাহলে ধর্মের নামে এত হত্যা কেন হয়? ধার্মিকরা এত অসাধু হয় কেন? যতসব চোর, লম্পট, প্রতারকরা দেখা যায় টুপি-দাঁড়ি পড়ে মসজিদে নামাজ ঠিকই পড়ে।

এই প্রশ্নগুলোর কিছু উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি—

মহাকাশ বিজ্ঞানী: মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে শূন্য থেকে

সবচেয়ে অবৈজ্ঞানিক এবং ফিলসফির দিক থেকে অবাস্তব দাবি হলো: মহাবিশ্ব নিজে থেকেই, শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে, এর কোনো কারণ/উৎপাদক নেই। এর মানে দাঁড়ায়: কোনো জিনিস একই সাথে অস্তিত্ব থাকতে পারে, আবার অস্তিত্ব নাও থাকতে পারে। একে সহজ ভাষায় বললে, আপনার মা নিজেই নিজেকে জন্ম দিয়েছেন, কেউ তাকে জন্ম দেয়নি। একদিন তিনি ছিলেন না। তারপর হঠাৎ করে তিনি নিজেই নিজেকে জন্ম দিলেন।

P. J. Zwart তার বইয়ে দেখিয়েছেন, এটা কত অবাস্তব একটা দাবি—

“If there is anything we find inconceivable it is that something could arise from nothing.”
যদি অবিশ্বাস্য বলে কিছু থাকে, তাহলে সেটা হলো যে, কোনো কিছু শূন্য থেকে উৎপত্তি হতে পারে।[২১৬]

এরপর বিজ্ঞানীরা তাদের খেলা পালটিয়ে ফেলেন। প্রফেসর স্টিফেন হকিন্স, লরেন্স ক্রাউস-এর মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা বলেন, শূন্য বলতে আসলে Quantum Vaccum বা কোয়ান্টাম শূন্যতা বোঝানো হচ্ছে। কোয়ান্টাম শূন্যতা হলো ভৌত কোনো কিছুর অনুপস্থিতি। এটি সব জায়গায় বিরাজমান একটি স্পন্দিত শক্তির ক্ষেত্র।

“…is not ‘nothing’; it is a structured and highly active entity.”
“এটা ঠিক ‘শূন্য’ নয়; এটি বিশেষ গঠনের অত্যন্ত সক্রিয় অস্তিত্ব”[২১৭]

তাহলে প্রশ্ন হলো, এই কোয়ান্টাম শূন্যতা আসলো কোথা থেকে? কে একে সৃষ্টি করলো? কীভাবে এটি এমন সব গুণ পেল, যা থেকে এটি এক বিশাল মহাবিশ্ব বিশেষ ভাবে ডিজাইন করে তৈরি করতে পারে? কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের সেই নিয়মগুলো আসলো কোথা থেকে?

এগুলো সবই হচ্ছে স্রস্টাকে অস্বীকার করার জন্য নানা অজুহাত। মহাবিশ্বের যে সৃষ্টি হয়েছে, সেটার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীরা দিতে পারছে না। আবার একইসাথে মানতে পারছে না যে, স্রস্টা বলে কেউ আছে। তাহলে কী করা যায়? ‘কোয়ান্টাম ভ্যাকুয়ম’ নামের এক মহাজটিল অস্তিত্ব জন্ম দেই। তাহলে বেশ কিছুদিন এটা নিয়ে মানুষকে ঘোল খাওয়ানো যাবে।

পদার্থবিজ্ঞানী: মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে এক অতি-মহাবিশ্ব Multiverse (মাল্টিভার্স) থেকে

আজকাল মিডিয়াতে ব্যাপক ভাবে নতুন এক ধারণার প্রচারণা শুরু হয়েছে – মাল্টিভার্স থিওরি। বিজ্ঞানীরা দাবি করছে এই মহাবিশ্বের কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই। আমাদের মহাবিশ্বটি এক মহা-মহা-মহাবিশ্বের বা মাল্টিভার্স-এর মধ্যে থাকা ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন মহাবিশ্বের মধ্যে একটি।

multiverse
বিজ্ঞানীরা কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারছেন না: কীভাবে আমাদের এই মহাবিশ্বটি এত নিখুঁত ভাবে, এত পরিকল্পিতভাবে প্রাণের সৃষ্টির জন্য অত্যন্ত সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করে তৈরি করা হয়েছে। মহাকর্ষ বল যদি ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ বেশি বা কম হতো, তাহলে কোনো গ্রহ সৃষ্টি হতো না, প্রাণের সৃষ্টির কোনো সম্ভাবনাই থাকতো না। বিগ ব্যাংগের সময় যে শক্তির প্রয়োজন ছিল, সেটা যদি ১০৬০ ভাগের এক ভাগ এদিক ওদিক হতো, তাহলে মহাকর্ষ বলের সাথে অসামঞ্জস্য এত বেশি হতো যে, এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়ে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারতো না। ১০৬০ হচ্ছে  ১ এর পরে ৬০টি শূন্য বসালে যে বিশাল সংখ্যা হয়, সেটি। বিগ ব্যাংগের মুহূর্তে প্ল্যাঙ্ক সময়ের পর মোট পদার্থের যে ঘনত্ব ছিল, সেটা যদি ১০৫০ ভাগের এক ভাগও এদিক ওদিক হতো, তাহলে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হতো না, যাতে আজকের মতো নক্ষত্র, গ্রহ এবং প্রাণ সৃষ্টি হতো।[১০২] — এরকম শত শত ভারসাম্য কীভাবে কাকতালীয় ভাবে মিলে গেলো? কীভাবে এগুলো সব অত্যন্ত নিখুঁতভাবে নির্ধারণ করা হল, যেন নক্ষত্র, গ্রহ, পানি, ভারী মৌলিক পদার্থ সৃষ্টি হয়ে একদিন প্রাণের সৃষ্টি হয়, যেই প্রাণ বিশেষ ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে একদিন মানুষের মতো বুদ্ধিমান প্রাণীর জন্ম দিবে? — এর পক্ষে তারা কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারছে না।

এতগুলো সূক্ষ্ম ভারসাম্য এক সাথে মিলে যাওয়া যে কোনোভাবেই গাণিতিক সম্ভাবনার মধ্যে পড়ে না —এটা তারা বুঝে গেছে। তারা এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এক নতুন থিওরি নিয়ে এসেছে: আমাদের মহাবিশ্ব আসলে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন মহাবিশ্বের মধ্যে একটি। একেক মহাবিশ্বে পদার্থ বিজ্ঞানের ধ্রুবকগুলোর একেক মান রয়েছে। কিছু মহাবিশ্ব বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না, কারণ সেই মহাবিশ্বে পদার্থবিজ্ঞানের ধ্রুবকগুলোর মানগুলোর মধ্যে ভারসাম্য থাকে না।  আর কিছু মহাবিশ্বে পদার্থবিজ্ঞানের ধ্রুবকগুলোর মান এমন হয় যে, সেখানে কোনোদিন সূর্যের মতো একটি তারা এবং পৃথিবীর মতো একটি গ্রহ তৈরি হতে পারে না। যার ফলে সেই সব মহাবিশ্বে কোনো প্রাণ সৃষ্টি হয় না। পদার্থবিজ্ঞানের সুত্রগুলোর যতগুলো সম্ভাব্য সম্ভাবনা হওয়া সম্ভব, সেটা যতই কল্পনাতীত, অবাস্তব একটা ব্যাপার হোক না কেন, যা কিছু হওয়া সম্ভব তার সবকিছুই সেই মাল্টিভারসের ‘ল্যান্ডস্কেপ’-এ কোথাও না কোথাও হয়েছে এবং হয়ে যাচ্ছে। আমরা মানুষেরা, সেই অসীম সংখ্যক সম্ভাবনাগুলোর একটি, যেখানে পদার্থবিজ্ঞানের হাজার হাজার নিয়ম কাকতালীয়ভাবে, কল্পনাতীত সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করে কোনোভাবে মিলে গেছে এবং যার কারণে আজকে আমরা এই মহাবিশ্বে দাঁড়িয়ে নিজেদেরকে উপলব্ধি করতে পারছি।[১০৩]

তাদের দাবিটা হচ্ছে এরকম: ধরুন কোনো এক সমুদ্রের তীরে বালুতে আপনি একটি মোবাইল ফোন পড়ে থাকতে দেখে তাদেরকে জিগ্যেস করলেন, এই মোবাইল ফোনটা নিশ্চয়ই কোনো বুদ্ধিমান সত্ত্বা বানিয়েছে। তারা বলবে, “না, কোটি কোটি বছর ধরে সমুদ্রের পানি বালুতে আছড়িয়ে পড়তে পড়তে এবং ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাতের ফলে বালুতে রায়ায়নিক বিক্রিয়া হয়ে একসময় এই মোবাইল ফোনটি তৈরি হয়েছে। এটি কোনো বুদ্ধিমান সত্ত্বা বানায়নি, এটি পদার্থ বিজ্ঞানের সুত্রগুলোর অসীম সব সম্ভাবনাগুলোর একটি। এরকম কোটি কোটি সমুদ্রের তীর আছে যেগুলোর একটিতে হয়তো শুধুই একটা প্লাস্টিকের বাক্স তৈরি হয়েছে, পুরো মোবাইল ফোন তৈরি হতে পারেনি। কিছু তীর আছে যেখানে হয়তো একটা স্ক্রিন পর্যন্ত তৈরি হয়েছে, কিন্তু কোনো বাটন তৈরি হয়নি। আপনি, আমি আসলে সেই অসীম সব সমুদ্রের তীরগুলোর বিশেষ একটিতে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে পদার্থ বিজ্ঞানের সব সম্ভাবনা কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে, যে কারণে এই তীরে একটি সম্পূর্ণ মোবাইল ফোন সৃষ্টি হয়েছে।” এই হচ্ছে মাল্টিভার্স থিওরি।

মাল্টিভার্স থিওরির পক্ষে বিন্দুমাত্র প্রমাণ নেই। কিন্তু এনিয়ে শত শত বই, ডিসকভারি চ্যানেলে শত শত প্রোগ্রাম, হাজার হাজার লেকচার এমন ভাবে দেওয়া হচ্ছে যে, এটা বিগ ব্যাং থিওরির এর মতই একটা ফ্যাক্ট। বিজ্ঞানীদের এক বিশেষ দল, যাদের মধ্যে সবাই নাস্তিক, এবং শুধু নাস্তিকই নয়, এদেরকে বিশেষ ভাবে Militant Atheist বলা হয়, এরা উঠে পড়ে লেগেছে ডারউইনের বিবর্তনবাদের মতো মাল্টিভার্স থিওরিকেও মানুষের মধ্যে গলার জোরে ফ্যাক্ট বলে চালিয়ে দেওয়ার। কারণ একমাত্র মাল্টিভার্স থিওরিই পারে – “মহাবিশ্বের কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই” – সেটার পক্ষে কোনো ধরণের ‘বিশ্বাসযোগ্য’ চমকপ্রদ ব্যাখ্যা দিতে, যেটা পড়ে সাধারণ মানুষ, যার মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে ভালো জ্ঞান নেই, অবাক হয়ে ভাবে, “আরে! এতো দেখি চমৎকার এক ব্যাখ্যা! মহাবিশ্বের দেখি সত্যিই কোনো সৃষ্টিকর্তার দরকার নেই!”

একারণেই আল্লাহ تعالى আমাদেরকে মু’মিন হবার জন্য প্রথম শর্ত দিয়েছেন –

যারা মানুষের চিন্তার ক্ষমতার বাইরে এমন সব বিষয়ে বিশ্বাস করে। [আল-বাক্বারাহ ৩]

আমাদেরকে মানতে হবে যে, আমরা কোনোদিন প্রমাণ করতে পারবো না: কীভাবে, কী কারণে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। আমরা কোনোদিন কোনো রেডিও এন্টেনা দিয়ে জান্নাত, জাহান্নাম খুঁজে পাবো না। আমরা কোনোদিন এক্সরে করে ফেরেশতাদেরকে দেখতে পারবো না। আমরা কোনোদিন পদার্থ বিজ্ঞানের কোনো সুত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারবো না: কীভাবে আমরা মরে, ধ্বংস হয়ে, মহাবিশ্বে ছড়িয়ে যাওয়া আমাদের দেহের অণু পরমাণুগুলো থেকে একদিন আমাদেরকে আবার একই অবস্থায় ফেরত আনা হবে। আমাদেরকে এই সব কিছু বিশ্বাস করতে হবে, কোনোই বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ছাড়া, শুধুই কু’রআনের প্রমানের উপর ভিত্তি করে এই শর্তে যে কু’রআন সন্দেহাতীত ভাবে আল্লাহর تعالى বাণী। যদি কোনো প্রমাণ না থাকার পরেও বিবর্তনবাদ, ডার্ক ম্যাটার, ডার্ক এনার্জি, স্ট্রিং-থিওরিতে ঠিকই বিশ্বাস করতে পারি, তাহলে কু’রআনের বাণীর উপর বিশ্বাস না করার পেছনে কোনো যুক্তি থাকতে পারে না, যেখানে কি না কু’রআন যে মানুষের পক্ষে তৈরি করা সম্ভব না, এর পক্ষে শত শত প্রমাণ আছে। একারণে আমরা যদি অদেখায় বিশ্বাস করতে না পারি, তাহলে আমরা কোনোদিন মু’মিন হতে পারবো না।

দার্শনিক: মহাবিশ্ব অনন্তকাল থেকে রয়েছে

Bertrand Russell এর মতো কিছু বিখ্যাত ফিলসফার এই ধারণাটিকে বেশ জনপ্রিয় করার চেষ্টা করেছেন। তাদের দাবি হচ্ছে, মহাবিশ্ব আদি এবং অনন্ত। এটি অসীম সময় ধরে চলবে, এবং চলছে।

‘অসীম’ ধারণাটি আসলে একটি ধারণা মাত্র। বাস্তব জীবনে কোনো ‘অসীম’ বলে কিছু নেই, কারণ অসীম ধারণাটি নানা সমস্যার জন্ম দেয়—
১) ধরুন আপনার অসীম সংখ্যক বল রয়েছে। যদি সেখান থেকে দুটি বল নিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে কী দাঁড়ায়? “অসিম – ২ = ?” সংখ্যক বল রয়েছে? যদি তাই হয়, তাহলে আমাদের গুণতে পারা উচিত কয়টা বল বাকি থাকলো। যদি গুণতে পারি, তার মানে দাঁড়ায় সেটা এমন একটা সংখ্যা, যার সাথে ২ যোগ করলে হঠাৎ করে সেটা অসীম সংখ্যা হয়ে যায় —যা অবাস্তব। আর যদি গুণতে না পারি, তাহলে অসীম ধারণাটাই অবাস্তব। সুতরাং, অসীম ধারণাটা একটি ধারণা মাত্র, প্রকৃতিতে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। বিখ্যাত জার্মান গণিতবিদ David Hilbert বলেছেন—

“The infinite is nowhere to be found in reality. It neither exists in nature nor provides a legitimate basis for rational thought…the role that remains for the infinite to play is solely that of an idea.”
বাস্তবতায় অসীমের কোনো অস্তিত্ব নেই। এর প্রকৃতিতে কোনো অস্তিত্ব নেই, এটা কোনো যুক্তিযুক্ত চিন্তাভাবনার গ্রহণযোগ্য ভিত্তিও দেয় না… অসীমের একমাত্র ভূমিকা হলো এটি একটি ধারণা মাত্র।[২১৮]

২) ধরুন আপনি একজন সৈনিক। আপনাকে গুলি করার আগে আপনার পেছনের একজন সৈনিকের অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু তাকেও তার পেছনের সৈনিকের অনুমতি নিতে হবে, আপনাকে অনুমতি দেওয়ার আগে। এভাবে পেছনের দিকে অসীম সময় পর্যন্ত অনুমতি নেওয়া চলতে থাকবে। যদি তাই হয়, তাহলে আপনি কি কোনোদিন গুলি করতে পারবেন? পারবেন না। এটা প্রমাণ করে যে, এরকম পেছনের দিকে অসীম পর্যন্ত চলতে থাকা — এটি একটি অবাস্তব ধারণা। এরকম হলে কোনোদিন কোনো ঘটনা ঘটতো না। সুতরাং, কখনই অসীম পর্যন্ত কোনো ঘটনার পেছন দিকে যাওয়া যায় না।

৩) আপনাকে এক মিটার লম্বা একটা লাঠি দেওয়া হলো। এখন আপনাকে বলা হলো, তাকে সমান দুই ভাগ করতে। তার একটি ভাগকে আবার সমান দুই ভাগ করতে। তার একটি ভাগ নিয়ে আবার সেটাকে সমান দুই ভাগ করতে।  এভাবে অসীম সময় পর্যন্ত ভাগ করে যেতে হবে। আপনি কি কোনোদিন অসীম-ক্ষুদ্রতম ভাগটি পর্যন্ত যেতে পারবেন? সুতরাং দেখা যায়, অসীম একটি অবাস্তব ধারণা। এর কোনো বাস্তবতা নেই। এরিস্টটল বলেছেন—

“…the infinite is potential, never actual”
“অসীম একটি সম্ভাবনা মাত্র, এর কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই”[২১৯]

সুতরাং আমরা দেখতে পাই, কোনো ঘটনার পেছন দিকে অসীম সময় পর্যন্ত যাওয়া যায় না। সুতরাং মহাবিশ্ব কখনই অসীম সময় পর্যন্ত ছিল না, মহাবিশ্ব সসীম। সুতরাং মহাবিশ্বের একটি সূচনা রয়েছে।

সত্য অস্বীকারকারীরা কি দেখে না যে, সবগুলো আকাশ এবং পৃথিবী একসময় একসাথে একটি সত্তা ছিল, তারপর আমি তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করেছি? তারা কি দেখে না: আমি প্রতিটি প্রাণ সৃষ্টি করেছি পানি থেকে? এরপরও কি তারা বিশ্বাস করবে না? [আল-আনবিয়া ২১:৩০]

জীববিজ্ঞানী: সকল প্রাণী বিবর্তনের ফসল

প্রথমে ভেবে দেখুন, আপনি কীভাবে জন্ম নিলেন? আপনি এসেছেন আপনার বাবা-মা’র কাছ থেকে। আপনার বাবা-মা এসেছেন তাদের বাবা-মা’র কাছ থেকে। এভাবে যদি পেছন দিকে যেতে থাকেন, একসময় আপনি পৃথিবীর সর্বপ্রথম বাবা এবং মা পর্যন্ত পৌঁছে যাবেন, যাদেরকে কেউ জন্ম দেয়নি। এখন প্রশ্ন হলো, তারা কোথা থেকে এলেন?

এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে গত দুশো বছরে পৃথিবীতে তোলপাড় হয়ে গেছে। একদল মানুষ বিশ্বাস করে: সৃষ্টিকর্তা সেই প্রথম মানব এবং মানবীকে অন্য কোথাও বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, অথবা তিনি পৃথিবীতেই তাদেরকে কোনো অতিপ্রাকৃত প্রক্রিয়ায় বানিয়েছেন। আরেকদল মানুষ মনে করে, সেই প্রথম আধুনিক মানব-মানবী এসেছেন কোনো গরিলা/শিম্পাঞ্জীর মতো দেখতে আদি পিতা-মাতা থেকে, যারা ঠিক আজকের মানুষের মতো ছিলেন না। কোনো কারণে প্রথমবারের মতো সেই আদি পিতা-মাতা একটি আধুনিক মানব এবং মানবী শিশুর জন্ম দেন এবং তাদের থেকে পৃথিবীতে আজকের যত মানুষ রয়েছে সবার জন্ম হয়েছে। শুধু তাই নয়, সেই আদি পিতা-মাতারা এসেছেন আরেকটু বেশি বানরের কাছাকাছি দেখতে আদিমানব, আদিমানবী থেকে, যারা নাকি এসেছেন আরও বেশি বানরের মতো দেখতে আরও আদিমানব এবং আদিমানবী থেকে—এই হচ্ছে ডারউইনের বিখ্যাত বিবর্তনবাদ, যা পৃথিবীর মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছে—আস্তিক ও নাস্তিক।

ডারউইনের বিবর্তনবাদ

ডারউইনের বিবর্তনবাদ অনুসারে একজন আদি পিতা ও মাতা—যারা ঠিক আজকের মানুষের মতো মানুষ ছিলেন না—বিশেষ কোনো জেনেটিক মিউটেশনের কারণে তারা প্রথম একজন আধুনিক মানব শিশুর জন্ম দেন। এটি দৈব চক্রে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা মাত্র: এর পেছনে কোনো উদ্দেশ্য নেই, কোনো সৃষ্টিকর্তার হাত নেই। প্রকৃতির হাজার খেলার মধ্যে এটি ছিল একটি খেলা। এই একই প্রক্রিয়ায় পৃথিবীতে সকল প্রাণের উদ্ভব হয়েছে।

বিবর্তনবাদ অনুসারে প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে দৈব চক্রে। কোনো কারণে ৩.৬ বিলিয়ন বছর আগের আদি পৃথিবীতে, কোনো এক জায়গার কাদা মাটিতে কিছু অজৈব পদার্থ কাকতালীয়ভাবে একসাথে মিশে প্রথম অ্যামাইনো অ্যাসিড তৈরি করে। এরকম অনেকগুলো অ্যামাইনো অ্যাসিড কোনো কাকতালীয় কারণে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে একসাথে হয়ে প্রোটিন তৈরি হয়। তারপর কয়েকটি বিশেষ প্রোটিন কোনো কাকতালীয় কারণে একসাথে হয়ে ডিএনএ তৈরি হয় এবং তারপর সেখান থেকে আরও বিরাট কোনো কাকতালীয় কারণে প্রথম এককোষী প্রাণীর সৃষ্টি হয়। সেই এককোষী প্রাণীরা বহু বছর ধরে বিবর্তিত হয়ে একসময় কোনো কাকতালীয় কারণে বহুকোষী প্রাণীতে পরিণত হয়। তার বহু বছর পরে সেই বহুকোষী প্রাণীরা বিবর্তিত হয়ে আরও জটিল জলচর প্রাণীতে পরিণত হয়। তারপর সেই জলচর প্রাণীগুলো একসময় হাত-পা গজিয়ে ডাঙায় উঠে এসে নানা ধরনের স্থলচর প্রাণীতে পরিণত হয়। এরপর সেই স্থলচর প্রাণীগুলো কোটি কোটি বছর ধরে বিবর্তিত হয়ে একসময় গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগির মতো প্রাণীতে পরিণত হয়। এবং সবশেষে একই প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে বানরররূপী আদিমানব থেকে উদ্ভব হয়েছে আধুনিক মানুষের।

এখানে লক্ষ্য করুন: এই গোটা প্রক্রিয়ায় কতগুলো কাকতালীয় ব্যাপার রয়েছে। এই প্রতিটি কাকতালীয় ঘটনা ঘটার সম্ভাব্যতা হচ্ছে কমপক্ষে কোটি কোটি কোটি সম্ভাবনার মধ্যে একটি। যেমন ৩০০ অণু দিয়ে গঠিত একটি প্রোটিন তৈরি হবার সম্ভাবনা হচ্ছে ১০৩৯০ এর মধ্যে একটি। ১০ এর পরে ৩৯০টি শূন্য দিলে যে বিরাট সংখ্যা হয় ততগুলো সম্ভাবনার মধ্যে একটি। যার অর্থ হচ্ছে— এটা গাণিতিক ভাবে দেখলে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

বিবর্তনবাদ কি আসলেই কোনো প্রমাণিত বিজ্ঞান?

বিবর্তনবাদ যদি সত্যি হতো তাহলে—

১) আমরা এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে বিবর্তিত হওয়ার সময়, তার মাঝামাঝি অবস্থার অনেক নিদর্শন প্রকৃতিতে দেখতে পারতাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা যে লক্ষ লক্ষ ফসিল পেয়েছি, তার কোথাও কোনোদিনও এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে বিবর্তিত হওয়ার সময় মাঝামাঝি অবস্থার কোনো প্রাণী দেখা যায়নি।[২২০] যেমন, এখনও পর্যন্ত এমন কোনো বানর বা গরিলার ফসিল পাওয়া যায়নি—যেটার মাথা ছিল মানুষের মতো, বা যেটার গায়ের লোম মানুষের মতো একদম ছোট, বা যেটার হাত মানুষের হাতের মতো—যেগুলো দেখে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, গরিলা বা বানর থেকে ধীরে ধীরে বিবর্তন হয়ে মানুষ এসেছে।

২) প্রাণীদের মধ্যে সূক্ষ্ম বিবর্তনের (Microevolution) নিদর্শন মিললেও বড় ধরনের বিবর্তনের কোনো প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি, যেখানে এক প্রজাতির প্রাণী বিবর্তিত হয়ে আরেক প্রজাতির প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। Macroevolution বা স্থূল বিবর্তনের পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। বিজ্ঞানিরা গবেষণাগারে মাছির বিবর্তন করার চেষ্টা করেছিলেন। অনেক চেষ্টার পরে দেখা গেল তিন ধরনের মাছি তৈরি হলো—১) আগে যেরকম ছিল সেরকমই, ২) মিউটেটেড বা বিকৃত, অথবা ৩) মৃত।[২২১] ২০১০ সালে একটি গবেষণায় মাছির ৬০০ প্রজন্ম পরীক্ষা করেও কোনো বিবর্তনের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।[২২২] একইভাবে ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার ৪০,০০০ প্রজন্মের উপর বিবর্তনের চেষ্টা করেও বিবর্তনবাদের পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।[২২৩] সুতরাং অতীতেও বিবর্তন হয়ে একটি প্রজাতির প্রাণী অন্য প্রজাতির প্রাণীতে রূপান্তরের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, বর্তমানেও না।

৩) বিবর্তনবাদ দাবি করে যে, জেনেটিক মিউটেশনের মাধ্যমে প্রাণীদের মধ্যে বিবর্তন হয়ে উন্নততর এবং বেশি টেকসই প্রাণীর সৃষ্টি হয় এবং এইভাবেই আদি-মানুষ থেকে আধুনিক মানুষ এসেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় উলটো প্রমাণ পাওয়া গেছে। উদ্ভিদ এবং মানুষ উভয়েরই উপর গবেষণায় দেখা গেছে বেশিরভাগ মিউটেশনের ফলে দেহে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয় না। কিন্তু খারাপ মিউটেশন হয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে এবং এগুলো কোষের বংশপরম্পরায় টিকে থাকে। একে বলা হয় জেনেটিক এনট্রপি। প্রত্যেক মানুষ তার নিজের মিউটেশন এবং তার পূর্ব পুরুষদের মিউটেশন বহন করে এবং তারপর তার বংশধরের মধ্যে দিয়ে দেয়।[২২৪]

সাম্প্রতিক কালে হিউমেন জিনোম গবেষণার উন্নতির ফলে বিজ্ঞানীরা ২১৯ জন মানুষ এবং ৭৮ জন বাবা-মা এবং তাদের সন্তানদের মধ্যে গবেষণা করে দেখেছেন, প্রতি বংশ পরম্পরায় ৬০টি নতুন মিউটেশন যোগ হয়![২২৫]

বিবর্তনবাদীরা দাবি করে: ২.৪ মিলিয়ন বছর আগে, এক বানর/গরিলার কাছাকাছি দেখতে আদি মানুষ থেকে আধুনিক মানুষের উদ্ভব হয়েছে। যার অর্থ দাঁড়ায় এই পর্যন্ত মানুষের প্রায় ১২০,০০০ প্রজন্ম এসেছে। এখন প্রতি প্রজন্ম যদি ৬০টি মিউটেশন যোগ করে, তাহলে ১২০,০০০ প্রজন্মে আজকে মানুষের মধ্যে ৭,২০০,০০০ মিউটেশন থাকার কথা। এতো মিউটেশন হলে মানুষ আর মানুষ থাকত না, এবং অনেক আগেই মানব জাতি পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।

৪) এক প্রজাতির প্রাণীর থেকে অন্য প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে ধাপে ধাপে বিবর্তন কখনও সম্ভব নয়। যেমন, সরীসৃপের দ্বিমুখী ফুসফুস কখনই পাখির একমুখী ফুসফুসে বিবর্তিত হতে পারে না। সেটা হতে হলে বিবর্তন শেষ না হওয়া পর্যন্ত সরীসৃপকে শ্বাস নেওয়া বন্ধ করে দিতে হবে—যেটা কেবল হাস্যকরই নয়, বরং অযৌক্তিক। সুতরাং বিবর্তনবাদীরা যে-দাবি করে সরীসৃপ থেকে পাখির বিবর্তন হয়েছে, সেটা ভুল।[২২৬] একইভাবে উভচর প্রাণীর তিন-কক্ষ-বিশিষ্ট হৃদপিণ্ড থেকে স্তন্যপায়ী প্রাণীর চার-কক্ষ-বিশিষ্ট হৃদপিণ্ডের বিবর্তন হওয়া কখনও সম্ভব নয়, কারণ সেটা হতে হলে প্রথমে উভচর প্রাণীর হৃদপিণ্ডের মধ্যে নতুন দেওয়াল সৃষ্টি হতে হবে, যা রক্ত চলাচল ব্যহত করবে, না হয় নতুন রক্তনালীর সৃষ্টি হতে হবে, যা রক্ত চলাচলকে ব্যহত করবে।

এরকম অনেক প্রমাণ রয়েছে, যা থেকে সহজেই দেখানো যায় যে, এক প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে ধীরে ধীরে বিবর্তন হয়ে অন্য প্রজাতির প্রাণী সৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয়। কারণ বিবর্তনের সময় মাঝামাঝি যেই অবস্থাগুলো হতে হবে, সেগুলো প্রাণীর জন্য কোনোভাবেই কল্যাণকর নয়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে এইধরনের অর্ধেক বিবর্তন সেই প্রাণীর জন্য মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং বিবর্তনবাদ শুধুই একটি থিওরি। এর পক্ষে কোনো গ্রহণযোগ্য ও যৌক্তিক প্রমাণ নেই।

প্রকৃতিতে কী ধরনের বিবর্তন হয়?

একটি ব্যাপার পরিষ্কার করা দরকার: Microevolution বা সূক্ষ্ম-বিবর্তন অবশ্যই প্রকৃতিতে হয়। এবং সেটা হয় একই প্রজাতির মধ্যে, অল্প কিছু জেনেটিক পরিবর্তন থেকে। আর এভাবেই একসময় উপ-প্রজাতির সৃষ্টি হয়।[২২৭] কিন্তু এই সূক্ষ্ম বিবর্তন হতে হতে একসময় Macroevolution বা স্থুল-বিবর্তন হয়ে এক প্রজাতির প্রাণী সম্পূর্ণ অন্য প্রজাতির প্রাণীতে পরিণত হয় না—যেটা বিবর্তনবাদীরা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে এটা নিয়ে বিবর্তনবাদীদের মধ্যেই দ্বিমত রয়েছে।[২২৮] কাজেই বলা যায়, বানরের মধ্যে সূক্ষ্ম বিবর্তন হয়ে বিভিন্ন প্রজাতির বানর তৈরি হয়, কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত বানরই থাকে; মানুষ হয়ে যায় না।

বিবর্তনের টেক্সট বইগুলোতে বিবর্তনবাদের পক্ষে যে সব উদাহরণ দেখানো হয়— যেমন ডারউইনের পাখির ঠোটের ‘বিবর্তন’, ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার ‘বিবর্তন’ হয়ে এন্টিবায়োটিকের প্রতি রেজিস্টেন্স, এইচআইভি ভাইরাসের ‘বিবর্তন’—এগুলো সবই হয় একই প্রজাতির মধ্যে। পাখি বিবর্তনের পরে পাখিই থাকে, ডাইনোসর হয়ে যায় না। একইভাবে ব্যাকটেরিয়া শেষ পর্যন্ত ব্যাকটেরিয়াই থাকে, ফাঙ্গাস হয়ে যায় না।[২২৯]

ঐতিহাসিক: প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ঘটা ঘটনার বাইরে কোনো ঘটনা নেই

ফিরাউন যখন মুসা عليه السلام নবীর দাবি অস্বীকার করলো এবং বনি ইসরাইলকে মুক্ত করে দিতে অস্বীকার জানালো, তখন আল্লাহ تعالى মিশরে একের পর এক অতিপ্রাকৃত দুর্যোগ পাঠালেন, যা কোনো স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা ছিল না। কু’রআনের কিছু আয়াতে এই ঘটনাগুলো বর্ণনা করা হয়েছে—

আমি ফিরাউনের লোকদের উপর বছরের পর বছর খরা, ফসলহানি দিলাম, যাতে করে তারা নির্দেশ শোনে। … কিন্তু তারা বলল, “তুমি আমাদের উপর জাদু করার জন্য যতই অলৌকিক ঘটনা দেখাও, আমরা তোমাকে বিশ্বাস করব না।” তাই আমি ওদের উপর বন্যা, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ, রক্ত পাঠালাম — একদম পরিষ্কার নিদর্শন। কিন্তু ওরা ছিল এক অহংকারী সম্প্রদায় এবং দুর্নীতিবাজ।  [আল-আরাফ ৭:১৩০-১৩৩]

১৯ শতকের শুরুর দিকে মিশরে একটি প্রাচীন ফলক আবিষ্কার হয়, যা হল্যান্ডের মিউজিয়ামে অনুবাদ করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। এই প্রাচীন ফলকের নাম ‘ইপুয়ের-এর ফলক’ যেখানে মিশরের প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর ঘটনা বর্ণনা করা আছে। ফলকটি ইপুয়ের নামের একজন প্রাচীন মিশরীয় লিখেছেন, এবং ধারণা করা হয় তিনি এই ঘটনাগুলো নিজের চোখে দেখেছেন। তিনি কী লিখেছেন দেখা যাক—

সারাদেশে মহামারি, চারিদিকে রক্ত… পুরো নদীতে রক্ত… সবগুলো শহর ধ্বংস হয়ে গেছে… চারিদিকে চিৎকার, হাহাকার… সব গাছপালা ধ্বংস হয়ে গেছে… কোথাও কোনো ফল, শাকসবজি নেই… কোথাও কোনো আলো নেই…  দেখ! এক বিশাল আগুন… [২৩০]

এধরনের ঘটনা প্রকৃতির কোনো স্বাভাবিক নিয়মে ঘটে না।

থামুদ নামে কু’রআনে এক জাতির কথা বলা আছে, যারা আল-হিজর নামে একটি জায়গায়  পাহাড় কেটে বিশাল সব প্রাসাদ, বাড়ি বানিয়েছে। তাদের এই বিশেষ ক্ষমতা অন্য কোনো জাতির দেখা যায়নি। শক্ত পাহাড়ের পাথর কেটে বানানো তাদের বিশাল সব প্রাসাদ, স্তম্ভ, বাড়িঘর আজও অটুট রয়েছে। কিন্তু সেই থামুদ জাতির মানুষরা কোনো কারণে ধ্বংস হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তাদের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। এরকম প্রযুক্তিতে অগ্রসর, বিত্তশালী, শক্তিশালী জাতি কীভাবে রাতারাতি বিলুপ্ত হয়ে গেল, অথচ তাদের বানানো বাড়িঘরগুলো ঠিকই থাকলো — সেটা আজও একটা বিস্ময়।

thamud

কু’রআনে বলা আছে সেদিন কী ঘটেছিল—

আল-হিজরের বাসিন্দারা আমার রাসুলদের অস্বীকার করেছিল। আমি ওদেরকে আমার নিদর্শন দেখিয়েছিলাম, কিন্তু ওরা মানল না। ওরা পাহাড় কেটে বাড়িঘর বানাত, নিরাপদে বসবাস করত। সকাল বেলা এক প্রচণ্ড আঘাত ওদেরকে শেষ করে দিল। ওরা কতকিছু অর্জন করেছিল, যার কিছুই ওদের কোনো কাজে আসলো না। [আল-হিজর ১৫:৮০-৮৫]

এই সব রহস্য প্রমাণ করে যে, পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক ঘটনা রয়েছে, যার কোনো স্বাভাবিক প্রাকৃতিক কারণ নেই, যা কোনো প্রচলিত প্রাকৃতিক নিয়মে ব্যাখ্যা করা যায় না। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো,  যে সব জাতিগুলো এরকম রহস্যময়ভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে, তাদের প্রত্যেকের ধ্বংসাবশেষ ঘাঁটলে দেখা যায় যে, এরা সবাই সম্পদে, প্রাচুর্যে অন্ধ হয়ে নৈতিকভাবে একেবারেই নিচে নেমে গিয়েছিল এবং জঘন্য সব কাজ করত তারা। এদের শহরগুলো ভর্তি মদের পাত্রের ছড়াছড়ি। রাস্তার মোড়ে মোড়ে পতিতালয়। দেওয়ালে দেওয়ালে সমকামিতার ছবি। উদ্ধার করা প্রাচীন লিপিগুলোতে বর্ণনার যোগ্য নয় এমন নোংরা সব ঘটনার বর্ণনা। তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, এই সব অতিপ্রাকৃত ঘটনাগুলো ঘটেছে পরিকল্পিতভাবে। এগুলো কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। কেউ একজন আছেন, যিনি চরমভাবে দুর্নীতিগ্রস্থ, নৈতিকভাবে একেবারেই নষ্ট হয়ে যাওয়া এই ধরনের জাতিগুলোকে বার বার ধ্বংস করে দেন।

পরের পর্বে উঠতি নাস্তিক, হতাশা গ্রস্থ নাস্তিক এবং আঁতেল নাস্তিকদের প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে, ইন শাআ আল্লাহ تعالى

সূত্র:

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
  • [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
  • [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
  • [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
  • [১৫] তাফসির আল জালালাইন।
  • [২১৬] P. J. Zwart, About Time (Amsterdam and Oxford: North Holland Publishing Co., 1976), pages 117-19
  • [২১৭] John Polkinghorne and Nicholas Beale. Questions of Truth. 2009, page 41
  • [২১৮] David Hilbert. On the Infinite, in Philosophy of Mathematics, ed. with an Intro. by P. Benacerraf and H. Putnam. Prentice-Hall. 1964, page151.
  • [২১৯] Aristotle, “Physics 207b8” http://classics.mit.edu/Aristotle/physics.html
  • [২২০] Appendix in Morris, J. and F. Sherwin. 2009. The Fossil Record. Dallas, TX: Institute for Creation Research.
  • [২২১] Nüsslein-Volhard, C. and E. Wieschaus. 1980. Mutations affecting segment number and polarity in Drosophila. Nature. 287 (5785): 795-801.
  • [২২২] Burke, M. K. et al. 2010. Genome-wide analysis of a long-term evolution experiment with Drosophila. Nature. 467 (7315): 587-590.
  • [২২৩] Barrick, J. E. et al. 2009. Genome evolution and adaptation in a long-term experiment with Escherichia coli. Nature. 461 (7268): 1243- 1247.
  • [২২৪] Sanford, J. 2008. Genetic Entropy & the Mystery of the Genome. Waterloo, NY: FMS Publications.
  • [২২৫] Kong, A. et al. 2012. Rate of de novo mutations and the importance of father’s age to disease risk. Nature. 488 (7412): 471-475.
  • [২২৬] Thomas, B. Do New Dinosaur Finger Bones Solve a Bird Wing Problem? ICR News. Posted on icr.org July 9, 2009, accessed March 9, 2012.
  • [২২৭] Leonard, B. Critical Analysis of Evolution — Grade 10. Draft Reflecting Changes Made at March 2004 State Board of Education Meeting, page 314. Ohio Department of Education. www.texscience.org.
  • [২২৮] Allaby, M. (ed.) 1992. The Concise Oxford Dictionary of Zoology. New York: Oxford University Press.
  • [২২৯] Nathaniel T. Jeanson, Ph.D. “Is Evolution an Observable Fact?” http://www.icr.org/article/7165/
  • [২৩০] Henry, Roger “Synchronized Chronology: Rethinking Middle East Antiquity” http://goo.gl/kDfpHK, page 24.

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

4 thoughts on “তোমরাও কি সেভাবেই তোমাদের নবীকে প্রশ্ন করতে চাও? — আল-বাক্বারাহ ১০৮”

  1. Brother, mashallah i knew little bit about my Lord. I want to know my Allah more and more. Please keep going to write.

    Zazak Allah kayer

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *