যখন কাউকে নির্দিষ্ট মেয়াদ শর্তে ঋণ দেবে, তখন তা লিখে রাখবে — আল-বাক্বারাহ ২৮২-২৮৩

“ভাই, দাড়িওয়ালা দেখে নিশ্চিন্ত মনে ধার দিয়েছিলাম। এক বছর পার হয়ে গেছে, টাকা ফেরত তো দেয়ই না, ফোন করলেও এখন আর ধরে না। ইসলাম কি এই শেখায়?” — আমাদের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে, যদি কাউকে টাকা ধার দেই, তাহলে সেটা লিখে রাখার দরকার নেই। পরিচিতদের মধ্যে ধার দিচ্ছি, লিখিত চুক্তি করতে গেলে কেমন যেন দেখায়। আর তাছাড়া ধর্মপ্রাণ মানুষ কি আর টাকা নিয়ে ফেরত দেবে না? আমরা অনেকেই জানি না যে, কাউকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধার দিলে সেটা লিখিত চুক্তি করে রাখাটা ফরজ। কুর‘আনে আল্লাহ এই নিয়ে এক বিরাট আয়াত দিয়েছেন, যেন মুসলিমদের মধ্যে ধার দেওয়া নিয়ে ঝামেলা কমানো যায়। মুসলিম মানেই এই না যে, তারা ধার নিলে সময় মতো ফেরত দেবে। বরং সময় মতো ধার ফেরত দেওয়া নিয়ে মুসলিমদের মধ্যেই প্রচুর ঝামেলা হয় দেখেই কুর‘আনের সবচেয়ে বড় আয়াতে বলা আছে কীভাবে ধার দেওয়ার সময় লিখিত চুক্তি করে রাখতে হবে। এই আয়াতটিতে খুব পরিষ্কারভাবে ধার দেওয়ার নিয়ম, বাধ্যতা, সাক্ষীর দায়িত্ব ইত্যাদি বর্ণনা করা আছে—

বিশ্বাসীরা শোনো! যখন কাউকে নির্দিষ্ট মেয়াদ শর্তে ঋণ দেবে, তখন তা লিখে রাখবে। চুক্তিলেখক চুক্তির শর্তগুলো ঠিকঠাকমতো লিখে দেবে। আল্লাহ যেহেতু তাকে লেখা শিখিয়েছেন, কাজেই সে যেন লিখতে অস্বীকার না-করে। দেনাদার লোক চুক্তির যা যা শর্ত বলবে সে তা লিখবে। বলার সময় সে যেন তার প্রভু আল্লাহকে মনে রাখে—কোনো ঊনিশ-বিশ না-করে। সে যদি কম বুঝে, দুর্বল হয় বা ঠিকমতো বলতে না-পারে, তাহলে তার অভিভাবক যেন ঠিকঠাকভাবে সব বলে দেয়।
চুক্তির সময় তোমাদের মধ্যে থেকে দুজন পুরুষকে সাক্ষী রাখবে। দুজন পুরুষ পাওয়া না-গেলে তোমাদের সম্মতিতে সাক্ষীদের মধ্যে একজন পুরুষ ও দুজন নারীকে সাক্ষী রাখতে পারো; যাতে একজন নারী ভুল করলে অন্যজন মনে করিয়ে দিতে পারে।
সাক্ষ্য দিতে ডাকা হলে সাক্ষীরা যেন অস্বীকার না-করে। ঋণ যদি নির্দিষ্ট মেয়াদের ভিত্তিতে হয়, তাহলে তা ছোট-বড় যা-ই হোক, লিখে রাখার ব্যাপারে হেলাফেলা করবে না। কারণ, আল্লাহর কাছে এটা বেশি সুবিচারপূর্ণ, প্রমাণ হিসেবে বেশি নির্ভরযোগ্য এবং তোমাদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কম।
তবে তাৎক্ষণিক লেনদেন হলে না-লিখলে সমস্যা নেই। আর যখন পরস্পর বেচাকেনা করো, তখন সাক্ষী রাখো। চুক্তিলেখক বা সাক্ষীর কাউকেই কোনো ক্ষতি করা যাবে না। করলেই তোমাদের অপরাধ হবে। আল্লাহর প্রতি সাবধান!
আল্লাহই তোমাদের শেখান। আর আল্লাহ সবকিছুই ভালোভাবে জানেন। [আল-বাকারাহ ২৮২]

এই আয়াতটি হচ্ছে ঋণের উপর একটি সম্পূর্ণ আইন সঙ্কলন। আল্লাহ تعالى একটি আয়াতের মধ্যেই ঋণ সংক্রান্ত যাবতীয় নিয়ম আমাদেরকে বলে দিয়েছেন। এই আয়াতে বিশটিরও বেশি আইন রয়েছে। কোনো আইনজীবীকে যদি বলা হতো ঋণের যাবতীয় আইন নিয়ে লিখতে, তাহলে সে পঞ্চাশ পৃষ্ঠার এক বই লিখে নিয়ে আসতো, যা পড়তে গেলে মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেত। তারপর সেই বইয়ে কথার মধ্যে বহু ফাঁকফোকর পাওয়া যেত। কয়েকবার তার সংশোধনী বের হতো। অথচ আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এমন সুন্দর একটি আয়াত দিয়েছেন, যা কবিতার ছন্দের মতো পড়তে পারি, সুমধুর তিলাওয়াতে শুনতে পারি এবং শোনার সময় সংবিধান শোনার মতো একঘেয়ে মনে হয় না। একইসাথে এটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম, কোনো ফাঁকফোকর নেই। কেউ দাবি করতে পারবে না যে, এই আয়াতে আইনগুলোর মধ্যে অমুক ফাঁক পাওয়া গেছে। আর ইসলাম যে বাস্তবতা বিমুখ, শুধুই ধর্ম-কর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ কোনো ধর্ম নয়, তার প্রমাণ এই আয়াত।[১১]  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

ওরা তোমাদেরকে আগুনের দিকে ডাকে — আল-বাক্বারাহ ২২১

চৌধুরী সাহেব তার বিদেশের বাড়িতে আরাম চেয়ারে বসে, কফি হাতে নিয়ে একটা বইয়ে ডুবে আছেন। তখন তার ছেলে এসে বলল, “বাবা, আমি জেনিফারকে বিয়ে করবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ওকে আমার অনেক ভালো লাগে। ও অন্যদের মতো খারাপ না। পার্টি করে না। আমি ওকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো না।”

“কী!”, চৌধুরী সাহেব রাগে লাল হয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলেন , “তুমি বিয়ে করবে এক খ্রিস্টান মেয়েকে? এই জন্য তোমাকে আমি বিদেশে বড় করেছি? আমরা চৌধুরী বংশ! আমি বেঁচে থাকতে তোমাকে আমি খ্রিস্টান মেয়ে বিয়ে করতে দেবো না….”, বলতে বলতে চৌধুরী সাহেব বুক চেপে ধরে মাটিতে পড়ে গেলেন।

এই ধরনের ঘটনা আজকে বিদেশে বসবাসকারী মুসলিম পরিবারগুলোতে নিত্যদিনের ঘটনা। চৌধুরী সাহেব টাইপের বাবা-মা তাদের সন্তানদের বড় করেন পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিতে। তাদের ছেলেমেয়েরা পশ্চিমা টিভি, মুভি, ম্যাগাজিন দেখে জীবন সম্পর্কে শেখে। পশ্চিমা স্কুল-কলেজ-ইউনিভারসিটিতে হাজারো অমুসলিম ছেলেমেয়ের সাথে ওঠাবসা করে বড় হয়। আর তাদের বাবা-মায়েরা  সপ্তাহে একদিন তাদেরকে জুমুআহ’র নামাজে মসজিদে নিয়ে, পহেলা বৈশাখে বাঙালি পোশাক পরিয়ে, পান্তা ভাত খাইয়ে ধরে নেন: তাদের ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে ‘বাঙালি মুসলিম আদর্শ’ ধরে রাখবে। তারপর দেশ থেকে আমদানি করে আনা কাউকে ধরিয়ে দিলেই তাকে বিয়ে করে সুখে সংসার পার করবে।

এই বাবা-মা’রা যদি তাদের সন্তানদেরকে কুর’আন শেখাতেন এবং নিজেরা শিখতেন, তাহলে তারা বিয়ে সম্পর্কে আজকাল প্রচলিত অনেক বিভ্রান্তির উত্তর পেয়ে যেতেন—

2_221

মুশরিক নারীদেরকে বিয়ে করবে না, যতক্ষণ না তারা ঈমান আনছে। একজন বিশ্বাসী দাসীও মুশরিক নারী থেকে ভালো, যদিও কিনা মুশরিক নারী তোমাদেরকে বিমোহিত করে। আর তোমাদের মেয়েদেরকে মুশরিক পুরুষদের সাথে বিয়ে দেবে না, কারণ একজন বিশ্বাসী দাসও মুশরিক পুরুষ থেকে ভালো, যদিও কিনা সে তোমাদেরকে মুগ্ধ করে। ওরা তোমাদেরকে আগুনের দিকে ডাকে। আর আল্লাহ তোমাদেরকে জান্নাত এবং তার নিজগুণে ক্ষমার দিকে ডাকেন। তিনি তাঁর নির্দেশগুলোকে মানুষের কাছে একদম পরিষ্কার করে দেন, যাতে করে তারা শিক্ষা নিতে পারে। [আল-বাক্বারাহ ২২১]

আজকাল প্রায়ই শোনা যায় এমন সব প্রশ্ন: “ভাই, আমি আমার হিন্দু বান্ধবীকে বিয়ে করতে চাই। তাকে আমি মুসলিম বানিয়ে ফেলবো। সে-ও বলেছে যে সে ইসলাম “ট্রাই” করে দেখতে চায়। এভাবে একজনকে মুসলিম বানানোর বিরাট সওয়াব আমি পাবো। তাছাড়া আজকালকার মুসলিম মেয়েদের কী অবস্থা দেখেন না? ইউনিভার্সিটি পার না হতেই কয় হাত বদল হয়। আমার এই বিয়েটা তো অবশ্যই হালাল হবে, তাই না ভাই?”  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

এই সব লোকেরা যেন প্রার্থনার জায়গাগুলোতে প্রবেশ না করে — আল-বাক্বারাহ ১১৪

মসজিদে বোর্ড মিটিং চলছে। চৌধুরী সাহেব সভাপতি। ইমাম সাহেব তাকে বললেন, “ভাইসাহেব, এলাকার একটি গ্রুপ আগামী শুক্রবার এই মসজিদে তাওহীদের উপর একটি কনফারেন্স করার জন্য আবেদন করছে। সৌদি আরব থেকে বিখ্যাত আলেম এসেছেন তাদের কনফারেন্সে বক্তব্য দেওয়ার জন্য। আমরা কি তাদেরকে ব্যবস্থা করে দিতে পারি?”

চৌধুরী সাহেব বললেন, “আপনি কি ওই সালাফি গ্রুপের কথা বলছেন? প্রশ্নই ওঠে না। এটা হানাফি মসজিদ। আমরা এখানে ওই সব সৌদি ওয়াহাবি, সালাফিদের প্রশ্রয় দেই না। ওদেরকে অন্য কোনো কনফারেন্স সেন্টার ভাড়া করতে বলেন।”

ইমাম সাহেব চুপসে গেলেন। তিনি বললেন, “আচ্ছা, তাহলে এই শুক্রবার এলাকার তরুণরা বিকেলে এসে রাসুলের জীবনী নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছিল। ওদেরকে আসতে বলি?”

চৌধুরী সাহেব বললেন, “না, মসজিদ হচ্ছে শান্তিতে নামাজ পড়ার জায়গা। এখানে কোনো আলোচনা, সভা, অনুষ্ঠান, কনফারেন্স করার জায়গা না। এমনিতেই মসজিদ পরিষ্কার রাখার জন্য পাঁচটা লোক রাখতে হয়। এই সব অনুষ্ঠান করলে মসজিদের মেরামত, পরিষ্কারের পেছনে কী পরিমাণের খরচ করতে হবে জানেন? আর এই সব তরুণদেরকে মসজিদে ঘন ঘন ঢুকতে দিলে ডিজিএফআই এর লোকজন আমাদের উপর নজর রাখা শুরু করবে। মনে করবে আমরা এদেরকে জিহাদের ট্রেইনিং দিচ্ছি। অযথা ঝামেলা বাড়াবেন না।”

এই ধরনের মানসিকতা এতটাই জঘন্য যে, কু’রআনে এক ভয়ঙ্কর আয়াত রয়েছে এই ব্যাপারে—

2_114

ওর চেয়ে বড় অন্যায়কারী আর কে হতে পারে, যে প্রার্থনার জায়গায় আল্লাহর تعالى নাম নিতে বাঁধা দেয়? সেগুলো বিরান করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে? এই সব লোকেরা প্রার্থনার জায়গাগুলোতে ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় ছাড়া প্রবেশ করার যোগ্য নয়। ওদের জন্য এই দুনিয়াতে রয়েছে অপমান-লাঞ্ছনা, এবং আখিরাতে রয়েছে কঠিন শাস্তি। [আল-বাক্বারাহ ১১৪]

beautiful_mosque_dome_at_sunset  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

এটা ছিল এক ভীষণ কঠিন পরীক্ষা—বাকারাহ ৪৯

চারিদিকে মুসলিমদের এত দুঃখ, কষ্ট। মুসলিম দেশগুলোতে এত অভাব, রক্তারক্তি, মা-বোনদের সম্ভ্রমহানি— এসব দেখে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে: কেন শুধু মুসলিমদেরই এত কষ্ট? ইসলাম মেনে আমরা কি ভুল করছি? কেন আজকে মুসলিম দেশগুলোতে মুসলিমদেরকে এভাবে মেরে শেষ করে ফেলা হচ্ছে? এত অভাব, অপমান, মারামারি দেখে আর থাকতে না পেরে অনেকেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। তাদের অন্তরে ঈমানের প্রদীপ নিভু নিভু হয়ে যেতে থাকে। এমনকি অনেকে শেষ পর্যন্ত ধর্ম ছেড়ে দেন। —তাদের জন্য বাকারাহ-এর এই আয়াতটি চিন্তার খোরাক দিবে, কারণ ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম অপমান এবং অত্যাচারের শিকার সিরিয়া, গাজা, ফিলিস্তিন, মায়ানমারের মুসলিমরা নয়, বরং তারা ছিল বনু ইসরাইল—

2_49

মনে পড়ে, আমি তোমাদেরকে ফিরাউনের লোকদের কবল থেকে বার বার বাঁচিয়েছিলাম, যারা তোমাদেরকে জঘন্য রকমের কষ্ট দিত: তোমাদের ছেলে সন্তানদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করত, আর তোমাদের নারীদেরকে ইচ্ছা করে বাঁচিয়ে রাখত—এটা ছিল তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে এক ভীষণ কঠিন পরীক্ষা। [বাকারাহ ৪৯]

syria

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى মুসলিমদেরকে মানসিকভাবে তৈরি করছেন যে, মুসলিমরা যদি মনে করে থাকে যে তারাই সবচেয়ে কষ্ট ও অপমানের জীবন পার করছে, তাদের আর কোনো আশা নেই, তাহলে তারা বনু ইসরাইলিদের ভয়াবহ ইতিহাসের কথা আরেকবার ভেবে দেখুক। কী অসম্ভব অবস্থার মধ্য থেকে তাদেরকে তিনি একসময় বের করে এনেছিলেন। কী ভয়ঙ্কর দুঃখ কষ্টের মধ্যেও সেই জাতিটি শেষ পর্যন্ত টিকে থেকেছিল এবং একসময় পৃথিবীতে অন্যতম সন্মানিত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বনু ইসরাইলিদের ইতিহাস থেকে মুসলিমদের জন্য আর কিছু না হোক, অন্তত কিছুটা হলেও শান্তি এবং মনোবল পাওয়া যায়: তাদেরকে যদি আল্লাহ تعالى সেই ভয়ঙ্কর জীবন থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন, তাহলে আমাদেরকেও নিশ্চয়ই একদিন মুক্তি দেবেন।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)