“ভাই, দাড়িওয়ালা দেখে নিশ্চিন্ত মনে ধার দিয়েছিলাম। এক বছর পার হয়ে গেছে, টাকা ফেরত তো দেয়ই না, ফোন করলেও এখন আর ধরে না। ইসলাম কি এই শেখায়?” — আমাদের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে, যদি কাউকে টাকা ধার দেই, তাহলে সেটা লিখে রাখার দরকার নেই। পরিচিতদের মধ্যে ধার দিচ্ছি, লিখিত চুক্তি করতে গেলে কেমন যেন দেখায়। আর তাছাড়া ধর্মপ্রাণ মানুষ কি আর টাকা নিয়ে ফেরত দেবে না? আমরা অনেকেই জানি না যে, কাউকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধার দিলে সেটা লিখিত চুক্তি করে রাখাটা ফরজ। কুর‘আনে আল্লাহ এই নিয়ে এক বিরাট আয়াত দিয়েছেন, যেন মুসলিমদের মধ্যে ধার দেওয়া নিয়ে ঝামেলা কমানো যায়। মুসলিম মানেই এই না যে, তারা ধার নিলে সময় মতো ফেরত দেবে। বরং সময় মতো ধার ফেরত দেওয়া নিয়ে মুসলিমদের মধ্যেই প্রচুর ঝামেলা হয় দেখেই কুর‘আনের সবচেয়ে বড় আয়াতে বলা আছে কীভাবে ধার দেওয়ার সময় লিখিত চুক্তি করে রাখতে হবে। এই আয়াতটিতে খুব পরিষ্কারভাবে ধার দেওয়ার নিয়ম, বাধ্যতা, সাক্ষীর দায়িত্ব ইত্যাদি বর্ণনা করা আছে—
বিশ্বাসীরা শোনো! যখন কাউকে নির্দিষ্ট মেয়াদ শর্তে ঋণ দেবে, তখন তা লিখে রাখবে। চুক্তিলেখক চুক্তির শর্তগুলো ঠিকঠাকমতো লিখে দেবে। আল্লাহ যেহেতু তাকে লেখা শিখিয়েছেন, কাজেই সে যেন লিখতে অস্বীকার না-করে। দেনাদার লোক চুক্তির যা যা শর্ত বলবে সে তা লিখবে। বলার সময় সে যেন তার প্রভু আল্লাহকে মনে রাখে—কোনো ঊনিশ-বিশ না-করে। সে যদি কম বুঝে, দুর্বল হয় বা ঠিকমতো বলতে না-পারে, তাহলে তার অভিভাবক যেন ঠিকঠাকভাবে সব বলে দেয়।
চুক্তির সময় তোমাদের মধ্যে থেকে দুজন পুরুষকে সাক্ষী রাখবে। দুজন পুরুষ পাওয়া না-গেলে তোমাদের সম্মতিতে সাক্ষীদের মধ্যে একজন পুরুষ ও দুজন নারীকে সাক্ষী রাখতে পারো; যাতে একজন নারী ভুল করলে অন্যজন মনে করিয়ে দিতে পারে।
সাক্ষ্য দিতে ডাকা হলে সাক্ষীরা যেন অস্বীকার না-করে। ঋণ যদি নির্দিষ্ট মেয়াদের ভিত্তিতে হয়, তাহলে তা ছোট-বড় যা-ই হোক, লিখে রাখার ব্যাপারে হেলাফেলা করবে না। কারণ, আল্লাহর কাছে এটা বেশি সুবিচারপূর্ণ, প্রমাণ হিসেবে বেশি নির্ভরযোগ্য এবং তোমাদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কম।
তবে তাৎক্ষণিক লেনদেন হলে না-লিখলে সমস্যা নেই। আর যখন পরস্পর বেচাকেনা করো, তখন সাক্ষী রাখো। চুক্তিলেখক বা সাক্ষীর কাউকেই কোনো ক্ষতি করা যাবে না। করলেই তোমাদের অপরাধ হবে। আল্লাহর প্রতি সাবধান!
আল্লাহই তোমাদের শেখান। আর আল্লাহ সবকিছুই ভালোভাবে জানেন। [আল-বাকারাহ ২৮২]
এই আয়াতটি হচ্ছে ঋণের উপর একটি সম্পূর্ণ আইন সঙ্কলন। আল্লাহ تعالى একটি আয়াতের মধ্যেই ঋণ সংক্রান্ত যাবতীয় নিয়ম আমাদেরকে বলে দিয়েছেন। এই আয়াতে বিশটিরও বেশি আইন রয়েছে। কোনো আইনজীবীকে যদি বলা হতো ঋণের যাবতীয় আইন নিয়ে লিখতে, তাহলে সে পঞ্চাশ পৃষ্ঠার এক বই লিখে নিয়ে আসতো, যা পড়তে গেলে মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেত। তারপর সেই বইয়ে কথার মধ্যে বহু ফাঁকফোকর পাওয়া যেত। কয়েকবার তার সংশোধনী বের হতো। অথচ আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এমন সুন্দর একটি আয়াত দিয়েছেন, যা কবিতার ছন্দের মতো পড়তে পারি, সুমধুর তিলাওয়াতে শুনতে পারি এবং শোনার সময় সংবিধান শোনার মতো একঘেয়ে মনে হয় না। একইসাথে এটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম, কোনো ফাঁকফোকর নেই। কেউ দাবি করতে পারবে না যে, এই আয়াতে আইনগুলোর মধ্যে অমুক ফাঁক পাওয়া গেছে। আর ইসলাম যে বাস্তবতা বিমুখ, শুধুই ধর্ম-কর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ কোনো ধর্ম নয়, তার প্রমাণ এই আয়াত।[১১] (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)