তারপর তাকে তার অবাধ্যতা এবং বাধ্যতার বোধ দেওয়া হয়েছে — আশ-শামস

শপথ সূর্যের, তার উজ্জ্বল আলোর; চাঁদের, যখন তাকে অনুসরণ করে; দিনের, যখন তাকে প্রকাশ করে; এবং রাতের, যখন তাকে ঢেকে ফেলে। শপথ আকাশের এবং তার অসাধারণ নির্মাণের। শপথ পৃথিবীর এবং যেভাবে তা বিস্তৃত করা হয়েছে। শপথ মানবাত্নার এবং তার যথাযথ বিন্যাসের। তারপর তাকে তার অবাধ্যতা এবং বাধ্যতার বোধ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং যে একে পরিশুদ্ধ করেছে, সে সফল হয়েছে। আর যে একে নষ্ট করে ফেলেছে, সে ব্যর্থ হয়েছে।

ছামুদ তাদের বিদ্রোহী মনোভাবের জন্য পুরোপুরি অবাধ্য হয়ে গিয়েছিল, যখন তাদের নিষ্ঠুরতমজন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। তখন আল্লাহর রাসুল তাকে বললেন, “এটা আল্লাহর উট, একে পানি পান করানোর ব্যাপারে সাবধান!” কিন্তু তারা তার বিরুদ্ধে মিথ্যা বলা শুরু করলো এবং নিষ্ঠুরভাবে উটটিকে হত্যা করলো। তখন তাদের প্রতিপালক তাদের সবাইকে ভীষণভাবে মেরে একেবারে মাটিতে মিশিয়ে দিলেন। তিনি পরোয়া করেন না এর পরিণতির। [আশ-শামস]

সৃষ্টিজগত-এর শপথ

কুর‘আনে আল্লাহ تعالى বহুবার সৃষ্টিজগতের নানা দিক নিয়ে শপথ করেছেন। এই শপথগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষ যেন ভালো করে সেই ব্যাপারগুলো লক্ষ্য করে। যেমন, “শপথ সূর্যের এবং তার উজ্জ্বল আলোর…” — এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে যেন বলছেন: সূর্যের দিকে লক্ষ্য করেছ? সেটা কীভাবে উজ্জ্বল আলো দেয়? কী প্রচণ্ড শক্তির উৎস এই সূর্য, যার আলো যতদূর চোখ যায় সব আলোকিত করে দেয়? কত বড় আগুনের গোলা হলে এটা এত উত্তাপ দেয় যে, বিশাল এলাকার মাটি শুকিয়ে ফেটে মরুভূমি হয়ে যায়? নদী নালার পানি বাষ্প হয়ে উবে যায়? তোমাদের বানানো কোনো আগুন পারে এর ধারে কাছে কিছু করতে?

“… চাঁদের, যখন তাকে অনুসরণ করে” — দেখেছো, কীভাবে চাঁদ সূর্যকে অনুসরণ করে? চাঁদের আলোর উপর ছায়া পড়ে কীভাবে? কীসের ছায়া সেটা? সূর্য সবসময় একই আকৃতির থাকে, কিন্তু চাঁদ কেন ছোট-বড় হয়? চাঁদ শুধু রাতেই না, দিনের বেলাতেও অনেক সময় সূর্যের পাশে থাকে। খেয়াল করে দেখেছো কীভাবে তা সম্ভব হয়?

“… দিনের, যখন তাকে প্রকাশ করে; এবং রাতের, যখন তাকে ঢেকে ফেলে” —দিন কীভাবে সূর্যকে প্রকাশ করে, দেখেছো? সূর্য দিনকে প্রকাশ করে না, বরং দিন সূর্যকে প্রকাশ করে। পার্থক্যটা বুঝেছো? রাত কীভাবে সূর্যকে ঢেকে ফেলে লক্ষ্য করেছো? সূর্য চলে যায় না, বরং রাত এসে সূর্যকে ঢেকে ফেলে। পার্থক্যটা বুঝেছো?

“… শপথ আকাশের এবং তার অসাধারণ নির্মাণের” —মাথার উপরে বিশাল আকাশ কীভাবে নির্মাণ করা হয়েছে লক্ষ্য করেছো? মাথার উপর দিয়ে কোটি টন পানি মেঘ হয়ে কীভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে, তা খেয়াল করেছো? একটা মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়ে এত পানি পড়ে যে, খাল-বিল ভেসে যায়। এত ভারি একটা মেঘ কীভাবে আকাশে ভেসে থাকে, তা লক্ষ্য করেছো? রাতের আকাশে এত কোটি কোটি তারা বানাতে কি বিশাল পরিমাণের ক্ষমতা দরকার, তা চিন্তা করে দেখেছো?

“… শপথ পৃথিবীর এবং যেভাবে তা বিস্তৃত করা হয়েছে” —পৃথিবীর দিকে তাকাও। দেখেছো, কীভাবে তা সমতল করা হয়েছে, যেন তোমরা বাস করতে পারো, চাষবাস করতে পারো? পুরো পৃথিবীটা পাথরে ভরা রুক্ষ ভূমি হতে পারত। অথবা পৃথিবীতে অল্প পরিমাণ ভূমি এবং বাকিটা পুরোটা পানি থাকতে পারত। তা না করে, বিশাল স্থলভূমি এবং সমতল ভূমি দেওয়া হয়েছে। কীভাবে তা তৈরি হয়েছে ভেবে দেখেছো? না থাকলে কী হতো চিন্তা করে দেখেছো?

কুর‘আন পড়লে বিজ্ঞানের প্রতি কৌতূহলি না হয়ে উপায় নেই। শত শত আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে বিজ্ঞানের প্রতি অনুপ্রাণিত করেছেন। তাগাদা দিয়েছেন যেন আমরা বিশ্বজগতের রহস্য নিয়ে চিন্তা করি। সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করি। আমরা যদি ব্যক্তি পর্যায়ে প্রত্যেকে সৃষ্টিজগতের রহস্যের প্রতি কৌতূহলী না হই, তাহলে জাতিগতভাবে আমরা জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিতে পিছিয়ে পড়বো। কুর‘আনে এত তাগাদা দেওয়ার পরও মুসলিম জাতি যদি জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে অন্য জাতিগুলোর থেকে পিছিয়ে যায়, তাহলে এরচেয়ে বড় আফসোস আর কিছু হতে পারে না।

শপথ মানবাত্নার এবং তার যথাযথ বিন্যাসের

শপথ মানবাত্নার এবং তার যথাযথ বিন্যাসের। তারপর তাকে তার অবাধ্যতা এবং বাধ্যতার বোধ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং যে একে পরিশুদ্ধ করেছে, সে সফল হয়েছে। আর যে একে নষ্ট করে ফেলেছে, সে ব্যর্থ হয়েছে।

আল্লাহ تعالى মানুষকে এমন নফ্স বা মানবাত্না দিয়েছেন, যা তিনি অন্য প্রাণীকে দেননি। এই নফ্স এতই গুরুত্বপূর্ণ এক সৃষ্টি যে, আল্লাহ تعالى কুর‘আনে এর উপর শপথ করেছেন। মানুষ যেন ভেবে দেখে নফ্স কত জটিল এক ব্যাপার।

যদিও নফ্স-কে ‘মানবাত্মা’ বা শুধুই ‘আত্মা’ অনুবাদ করা হয়, তবে এতে ‘আত্মা’ শব্দটির সাথে জড়িত নানা ধরণের বিজাতীয়, বিধর্মী ধারনা চলে আসতে পারে। আজকাল বাজারে প্রচলিত নানা ধরণের মতবাদে আত্মা, পরমাত্মা, মহাজাগতিক আত্মা, উচ্চতর প্রাণ ইত্যাদি ধারনার প্রচলন রয়েছে। এগুলো থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে। ইসলামে নফ্স বা আত্মার বিশেষ সংজ্ঞা আছে। একারণে বিভ্রান্তি এড়াতে আত্মা শব্দটি ব্যবহার না করে নফ্স ব্যবহার করা হলো। কুর‘আনে আমরা নফ্স শব্দটির নানা ব্যবহার দেখতে পাই। তাই নফ্স বলতে ঠিক কী বোঝানো হয়, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে।

বিজ্ঞানীরা বোঝার চেষ্টা করেছেন, মানুষ কি জন্ম হয় বিবেক নিয়ে, নাকি বাবা-মা এবং পরিবেশ থেকে বিবেক তৈরি হয়? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য তারা তিন মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত বাচ্চাদের উপর গবেষণা করে দেখেছেন যে, শিশুদের ভেতরে বিবেক আছে কিনা। যেহেতু শিশুরা বেশিদিন মানুষের সংস্পর্শে থাকেনি, তাই সংস্কৃতি, ধর্ম দিয়ে তাদের প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম এবং বাবা-মার বিবেক তাদের মধ্যে চলে আসার সম্ভাবনা কম। তাই শিশুদের মধ্যে যদি বিবেকের উপস্থিতি পাওয়া যায়, তাহলে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে, মানুষ বিবেকহীন অবস্থায় জন্মায় না, বরং মানুষকে বিবেক দিয়েই সৃষ্টি করা হয়।

গবেষণার ফলাফল থেকে দেখা গেছে, ৩ মাসের বাচ্চার ভেতরেও ভালো-মন্দ বোঝার কিছু ক্ষমতা রয়েছে। তারা বিভিন্ন ঘটনা দেখে বুঝতে পারে, সেই ঘটনায় কে ভালো কাজ করেছে, আর কে খারাপ কাজ করেছে। আর একটু বড় শিশুদের মধ্যে অন্যদেরকে সাহায্য করার প্রবণতা স্বাভাবিকভাবেই থাকে। কেউ সাহায্য না করলে, স্বার্থপরের মতো আচরণ করলে, সেটা যে মন্দ কাজ, তা বোঝার ক্ষমতাও তাদের আছে।[৪০৭]

শিশুদের উপর করা এই পরীক্ষা দেখিয়ে দেয়: আল্লাহ تعالى মানুষকে বিবেকহীন প্রাণী হিসেবে তৈরি করেন না। বরং মানুষের নফ্স একটি অত্যন্ত জটিল ব্যাপার, যার ভেতরে ভালো, মন্দ বোঝার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এটা মানুষের ভেতরে জন্ম থেকেই থাকে।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এটা আর এমন কী বড় ব্যাপার হলো? আল্লাহ تعالى নফ্সকে এত গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন?

যারা রোবট তৈরি করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করেন, তারা জানেন যে, কোনো পরিস্থিতিতে কোনটা ভালো এবং কোনটা খারাপ কাজ, ভালো-মন্দের তীব্রতা কতখানি—এসব যাচাই করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। ‘কৃত্রিম বিবেক’ সৃষ্টি করা এখন বিজ্ঞানীদের জন্য অন্যতম কঠিন চ্যালেঞ্জ। রোবটকে ব্যাপকভাবে বাজারজাত করার আগে রোবটকে আগে কৃত্রিম নফ্স দিতে হবে। সেই নফ্স তৈরি করার জন্য গত কয়েকযুগ ধরে সারা পৃথিবীতে কোটি কোটি টাকার গবেষণা চলছে।

আল্লাহ تعالى এই আয়াতে বলছেন যে, তিনি নফ্সে‌র মধ্যে ফুজুর অর্থাৎ অবাধ্যতা, বিবেকহীন কাজ করার প্রবণতা দিয়েছেন, এবং একইসাথে তাকওয়া দিয়েছেন। তাকওয়া শব্দটির অর্থ সাধারণত করা হয়—আল্লাহকে ভয় করা। এটি পুরোপুরি সঠিক অনুবাদ নয়, কারণ ‘ভয়’ এর জন্য আরবিতে ভিন্ন শব্দ রয়েছে—যেমন খাওফ خوف, খাশিয়া خشي, হিযর حذر—শুধু কু’রআনেই ১২টি আলাদা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন গভীরতার ভয়, সতর্কতা, আতঙ্ক ইত্যাদি তুলে ধরার জন্য। এর মধ্যে ‘তাক্বওয়া’ হচ্ছে সচেতন থাকা, যেন পাপ হয়ে না যায়।

আল্লাহ تعالى মানুষের নফ্সে‌র মধ্যে পাপকে সনাক্ত করার জ্ঞান দিয়েছেন। একইসাথে নফ্সকে তিনি تعالى এমনভাবে প্রোগ্রাম করে দিয়েছেন যেন, এটি প্রতিটি পরিস্থিতিকে যাচাই করে দেখতে পারে: এতে ভালো কী আছে, আর খারাপ কী আছে। খারাপগুলো থেকে দূরে থাকার এবং ভালোগুলো গ্রহণ করার সহজাত প্রবৃত্তি নফ্সে‌র মধ্যে তিনি تعالى প্রোগ্রাম করে দিয়েছেন।[4][১৮]

তাহলে আমার কী দোষ?

এই আয়াত পড়ে অনেকে প্রশ্ন করেন: আল্লাহই تعالى যদি নফ্‌সে অবাধ্যতা দিয়ে দেন, তাহলে আমার কী দোষ? আমি তো ইচ্ছে করে খারাপ কাজ করি না? যত দোষ আমার নফ্সে‌র।

নফ্‌সে যেমন অবাধ্যতা দেওয়া হয়েছে, তেমনি বাধ্যতাও দেওয়া হয়েছে। এই দুটো যদি একসাথে দেওয়া না হতো, তাহলে চিন্তার স্বাধীনতা থাকতো না। মানুষ ফেরেশতাদের মতো আরেকটা সৃষ্টি হয়ে যেত। আর যারা বলে যে, নফ্‌সে অবাধ্যতা আছে দেখেই তো আল্লাহর تعالى অবাধ্য হই —তারা আসলে তাদের অবাধ্যতার পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য এটা বলে। তাদেরকে কিন্তু নফ্‌সের বাধ্যতার কথা বলতে শোনা যায় না। এরা মুখ ফুটে বলে না যে, তারা যখন দুর্নীতি করে, অন্যায় ফুর্তি করে, নোংরা কাজ করে, তাদের ভেতরে ভেতরে ঠিকই খারাপ লাগে। প্রথম দিকে তারা যখন অন্যায় করা শুরু করেছিল, তখন তাদের বেশ খারাপ লাগতো। তারপর দিনের পর দিন বিবেককে গলা টিপে মেরে ফেলার কারণে এখন পশু হয়ে গেছে। এখন আর অন্যায় করতে খারাপ লাগে না। তারপরেও মাঝে মধ্যে কিছু একটা হয়। হঠাৎ করে অনুশোচনা চেপে ধরে। তখন সে জলদি বিনোদনে নিজেকে বুঁদ করে অনুশোচনাকে ভুলে থাকে। নফ্‌সের বাধ্যতা তাকে ভালো হওয়ার জন্য অনেক বলেছে, কিন্তু সে শুধু অবাধ্যতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। এর জন্য তাকে জবাব দিতে হবেই—

প্রত্যেক নফ্স দায়বদ্ধ হবে সে যা করেছে তার জন্য। [আল-মুদ্দাচ্ছির ৭৪:৩৮]

আর আমরা ভালো এবং মন্দ উভয় পথ তার জন্য পরিষ্কার করে দিয়েছি। [আল-বালাদ:১০]

আমি তাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়েছি। চাইলে তারা কৃতজ্ঞ হতে পারে, অথবা অকৃতজ্ঞ।  [আল-ইনসান:৩]

আল্লাহ মানুষের প্রতি কখনোই বিন্দুমাত্র অন্যায় করেন না, বরং মানুষই নিজের প্রতি অন্যায় করে।”  [ইউনুস ১০:৪৪]

আবার, আমাদের মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে যে, আমরা যত খারাপ কাজ করি, তা শুধু শয়তানের কারণেই করি। শয়তান না থাকলে আমরা কোনো খারাপ কাজ করতাম না। আমাদের চরিত্র হত ফুলের মত পবিত্র। ভুল ধারণা।—

(আল্লাহ বলেন) আমার অনুসারীদের উপরে তোমার (শয়তান) কোনো ক্ষমতা থাকবে না , কিন্তু ওই সব পথভ্রষ্টরা ছাড়া, যারা তোমাকে অনুসরণ করে।  [১৫:৪২]

যখন সব ফয়সালা হয়ে যাবে (কিয়ামতের দিন), তখন শয়তান বলবে, “আল্লাহ তোমাদেরকে সত্যিকারের কথা দিয়েছিলেন। আমিও তোমাদেরকে কথা দিয়েছিলাম, কিন্তু সেগুলো ছিল সব মিথ্যা। তোমাদেরকে শুধু ডাকা ছাড়া আমার আর কোনো ক্ষমতা ছিল না তোমাদের উপরে। তোমরাই আমার ডাকে সাড়া দিয়েছিলে। তাই আমাকে দোষ দিয়ো না, বরং নিজেদেরকেই দোষ দাও।”… [১৪:২২]

সুতরাং অন্যায় করে বলব না যে, সব শয়তানের দোষ। শয়তান না থাকলে আমরা সেই অন্যায়গুলো করতাম না। শয়তান শুধুই আমাদের কুমন্ত্রণা দেয়। আমরা নিজেরা জেনে শুনে অন্যায়গুলো করি। আমাদের সিদ্ধান্তের স্বাধীনতার অপব্যবহারের জন্য আমরা দায়ী, শয়তান নয়। আমাদের নফ্স ঠিকই আমাদেরকে জানান দেয়: কোন কাজটা আল্লাহর تعالى অবাধ্যতা হয়ে যাচ্ছে। এমনকি নাস্তিক, অমুসলিমরাও যখন খারাপ কাজ করে, তারাও বুঝতে পারে যে, কাজটা ভালো হচ্ছে না। তাদের ভেতরে থেকে কে যেন বলতে থাকে যে, কাজটা করাটা উচিত হচ্ছে না। এটা কোনোভাবেই ভালো কাজ হতে পারে না। কিন্তু তারপর তারা তাদের বিবেকের গলা চেপে ধরে চুপ করিয়ে দিয়ে অন্যায়ে ডুবে যায়।

নফ্সকে পরিশুদ্ধ করতে হয়। না হলে তা নষ্ট হয়ে যায়। মানুষ যতবার বিবেকের গলা চেপে ধরে অন্যায় করে, ততবার তার নফ্স একটু একটু করে নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। একবার যখন নফ্স নষ্ট হয়ে যায়, তখন খারাপ কাজ করতে আর খারাপ লাগে না। সে তখন পাপের চক্রে আটকা পরে যায়। আস্তে আস্তে তার পাপের তীব্রতা বাড়তেই থাকে। একারণে যে তার নফ্সে‌র পরিশুদ্ধতা ধরে রাখতে পারে না, সে একজন ব্যর্থ মানুষ। দুনিয়াতে সে বিফল, আখিরাতে তার পরিণতি ভয়ংকর।

যেমন, চৌধুরী সাহেব বিশাল পরিমাণের ঘুষ খাইয়ে একটা সরকারি প্রজেক্টের কন্ট্রাক্ট হাতালেন। এর জন্য তিনি মন্ত্রীকে গুলশানে দুইটা ফ্ল্যাট কিনে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিলেন। তারপর ব্যাংকের লোণ নিয়ে জোগাড় করা সেই বিশাল অংকের ঘুষ, সুদ সহ শোধ করতে গিয়ে, এবং মন্ত্রীকে কথা দেওয়া দুইটা ফ্ল্যাটের টাকা উঠানোর জন্য শেষ পর্যন্ত তাকে প্রজেক্টের অনেক টাকা এদিক ওদিক সরিয়ে ফেলতে হলো। দুই নম্বর সস্তা কাঁচামাল সরবরাহ করতে হলো। যোগ্য কনট্রাক্টরদের কাজ না দিয়ে অযোগ্য, সস্তা কনট্রাক্টরদের কাজ দিতে হলো। এরপর একদিন তার প্রজেক্ট ধ্বসে পড়ল। তার নামে ব্যাপক কেলেঙ্কারি হয়ে মামলা হয়ে গেলো। মামলায় উকিলের টাকা জোগাড় করতে তাকে আরও বিভিন্ন উপায়ে টাকা মারা শুরু করতে হলো। তারপর কয়েকদিন পর পর তাকে পুলিশ ধরতে আসে, আর তিনি পুলিশের উপরের তলার লোকদের ঘুষ খাইয়ে পুলিশকে হাত করে ফেলেন। প্রজেক্টে দুর্নীতির কারণে ভুক্তভুগি মানুষদের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাকে অনেক টাকা খরচ করে কিছু ‘সোনার ছেলে’ পালতে হয়। তারা মাঝে মাঝেই খুন, ধর্ষণ করে। হোটেলে থেকে … করে এসে বিরাট বিল ধরিয়ে দেয়। তারপর তাদেরকে যখন পুলিশ ধরতে আসে, তিনি পুলিশকে টাকা খাইয়ে তাদেরকে রক্ষা করেন। এত দুশ্চিন্তার মধ্যে তিনি রাতে ঘুমাতে পারেন না। দুশ্চিন্তা ভুলে থাকার জন্য তাকে নিয়মিত মদ খাওয়া ধরতে হয়। এভাবে একটার পর একটা পাপে জড়িয়ে পড়তে থাকেন। নিজের নফ্সকে নষ্ট করে দুনিয়াতে ব্যর্থ তিনি। আখিরাতে তার জন্য অপেক্ষা করছে প্রচণ্ড শাস্তি।

ছামুদ তাদের বিদ্রোহী মনোভাবের জন্য পুরোপুরি অবাধ্য হয়ে গিয়েছিল

ছামুদ তাদের বিদ্রোহী মনোভাবের জন্য পুরোপুরি অবাধ্য হয়ে গিয়েছিল, যখন তাদের নিষ্ঠুরতমজন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। তখন তাকে আল্লাহর রাসুল বললেন, “এটা আল্লাহর উট, একে পানি পান করানোর ব্যাপারে সাবধান!” কিন্তু তারা তার বিরুদ্ধে মিথ্যা বলা শুরু করলো এবং নিষ্ঠুরভাবে উটটিকে হত্যা করলো। তখন তাদের প্রতিপালক তাদের সবাইকে ভীষণভাবে মেরে একেবারে মাটিতে মিশিয়ে দিলেন। এর পরিণতি কি হবে, তার পরোয়া করেন না তিনি।

নফসের অবাধ্যতার চরম উদাহরণ হচ্ছে ছামুদ জাতি। এই জাতি প্রত্নতত্ত্ববিদদের জন্য এক বিস্ময়, কারণ হাজার বছর আগে মানুষ কীভাবে এতটা উন্নত ছিল, তারা তার হিসেব মেলাতে পারছেন না। ছামুদ জাতির কাছে এমন প্রযুক্তি ছিল যে, তারা ভীষণ শক্ত পাথরের পাহাড় কেটে তার ভেতরে প্রাসাদ, বাড়ি, বিশাল হল ইত্যাদি তৈরি করেছিল। আজকের যুগে অত্যাধুনিক ড্রিল দিয়ে যে কাজ মানুষ প্রথমবারের মতো করতে পারছে, সেই কাজ ছামুদ জাতি কীভাবে হাজার বছর আগে করে গেছে, তা এক বিরাট রহস্য। তারচেয়ে বড় রহস্য হচ্ছে কীভাবে এই শক্তিশালী জাতি রাতারাতি ধ্বংস হয়ে গেলো।

এই অত্যন্ত শক্তিশালী জাতিকে তাদের অবাধ্যতার জন্য আল্লাহ تعالى ধ্বংস করে দিয়েছেন এক ভীষণ আঘাত দিয়ে। তিনি تعالى কিছু ভগ্নাবশেষ রেখে দিয়েছেন, যেন ভবিষ্যতে মানুষ দেখতে পারে যে, তাদের থেকেও শক্তিশালী জাতিকে কীভাবে তিনি تعالى রাতারাতি নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারেন। যারা মনে করেন:

আল্লাহ تعالى নিশ্চয়ই মানবজাতিকে আর ধ্বংস করবেন না? আমরা আজকে কত উন্নত হয়েছি, কত নতুন নতুন প্রযুক্তি তৈরি করেছি, বিজ্ঞানে অগ্রসর হয়েছি, শিক্ষিত হয়েছি। মানবজাতির এত অবদানকে আল্লাহ تعالى নিশ্চয়ই অপচয় করবেন না?

—তাদেরকে আদ, ছামুদ জাতির ঘটনা দেখিয়ে দেবে যে, আল্লাহ تعالى কোনো পরিণতির পরোয়া করেন না। মানবজাতি এমন কোনো মহান কিছু নয় যে, আল্লাহ تعالى তাদেরকে সমীহ করে চলবেন। তিনিই تعالى মানুষকে বানিয়েছেন, তিনিই জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি দিয়েছেন, এবং তিনিই যে কোনো সময় তা কেড়ে নিতে পারেন।

আর যারা ছামুদের মতো অবাধ্য হবে, নিজেদেরকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে মনে করবে, টাকা-ক্ষমতার জোর খাটিয়ে যা খুশি তাই করার আস্পর্ধা দেখাবে, তারা যেন কুর‘আনে ধ্বংস হয়ে যাওয়া জাতিগুলোর ইতিহাস পড়ে দেখে। তাদেরই মতো মানুষদেরকে আল্লাহ تعالى এর আগে কী ভীষণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছেন, তা পড়ে যেন শিক্ষা নেয়। একইসাথে তারা যেন মনে না করে যে,

আমাকে ধ্বংস করলে তো আমার সাথে অন্যরাও ধ্বংস হয়ে যাবে? আল্লাহ تعالى নিশ্চয়ই আমার আশেপাশের ভালো মানুষগুলোর নিরাপত্তার জন্য আমার উপর কোনো আযাব দেবেন না?

—ভুল ধারনা, কারণ আল্লাহ تعالى বহুবার ভালো মানুষদেরকে রক্ষা করে শুধু খারাপ মানুষদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। তাঁর تعالى আযাব যখন আসে, তখন তা গাইডেড মিসাইলের মতো শুধু পাপীদের খুঁজে বের করে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। ভালো মানুষেরা নিরাপদে আযাব পার করে, তারপর আবার নতুন করে সভ্যতা গড়ে তোলে। তাছাড়া আল্লাহ تعالى পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে, তিনি تعالى পরিণতির পরোয়া করেন না। যদি একটা নষ্ট হয়ে যাওয়া জাতিকে মানবজাতির বৃহত্তর কল্যাণের জন্য ধ্বংস করে দিতে হয়, তিনি تعالى দেবেন। সেখানে কিছু ভালো মানুষ থাকুক আর না থাকুক, কিছু যায় আসে না।

[১] বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর। [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ। [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি। [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী। [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি। [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী। [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ। [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ। [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস। [১৪] তাফসির আল কুরতুবি। [১৫] তাফসির আল জালালাইন। [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ। [১৭] তাফসীর আহসানুল বায়ান — ইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সউদি আরব [১৮] কু’রআনুল কারীম – বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর — বাদশাহ ফাহাদ কু’রআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স। [১৯] তাফসির আল-কাবির। [২০] তাফসির আল-কাশ্‌শাফ। [৪০৭] Chun, Susan. “Are we born with a moral core? The Baby Lab says ‘yes’.” CNN, Cable News Network, 14 Feb. 2014, edition.cnn.com/2014/02/12/us/baby-lab-morals-ac360/index.html.

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

3 thoughts on “তারপর তাকে তার অবাধ্যতা এবং বাধ্যতার বোধ দেওয়া হয়েছে — আশ-শামস”

  1. “দিনের, যখন তাকে প্রকাশ করে; এবং রাতের, যখন তাকে ঢেকে ফেলে” —দিন কীভাবে সূর্যকে প্রকাশ করে, দেখেছো? সূর্য দিনকে প্রকাশ করে না, বরং দিন সূর্যকে প্রকাশ করে। পার্থক্যটা বুঝেছো? রাত কীভাবে সূর্যকে ঢেকে ফেলে লক্ষ্য করেছো? সূর্য চলে যায় না, বরং রাত এসে সূর্যকে ঢেকে ফেলে। পার্থক্যটা বুঝেছো?”

    ভাইয়া আমি আসলে এইখানে পার্থক্যটা বুঝতে পারলাম না। সূর্য উদিয়মান হলেই তো দিন প্রকাশ পায় এবং অস্তমিত যাওয়ার মাধ্যমেই রাতের প্রকাশ ঘটে তাই না? ব্যাপারটা তো এমন না যে দিনের প্রকাশ ঘটে অথবা শুরু হয় দেখেই আমরা সূর্যকে দেখতে পাই।

    1. সূর্য উদয় হয় কথাটা আসলে ভুল। সূর্যের কিছুই হয় না। সূর্য যেখানে আছে সেখানেই থাকে। সূর্য উদয় হয় কথাটা সঠিক হতো যদি সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরত।
      তাই দিন সূর্যকে প্রকাশ করে কথাটা বেশি সঠিক কারণ পৃথিবী ঘুরে দেখেই দিন আসে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *