শপথ তাদের যারা নির্মমভাবে ছিনিয়ে নেয়, যারা আলতোভাবে বাঁধন ছেড়ে দেয়, যারা তীব্র গতিতে ছুটে চলে, যারা সবার সামনে চলে গিয়ে ফয়সালা করে ফেলে।
আরবরা কান খাড়া করে এক রোমহর্ষক ঘটনা শুনছে। তারা কল্পনা করছে: একদল যুদ্ধের ঘোড়া ছুটে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে মাটিতে পা ঠুকছে। তাদের বাঁধন ছেড়ে দেয়া হল, আর অমনি তারা তীব্র বেগে ছুটে যাওয়া শুরু করল। ছুটতে ছুটতে সবাইকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেল। শত্রুপক্ষকে শেষ করে যুদ্ধের ফয়সালা করে ফেলতে যাচ্ছে। তারপর…
সেদিন এক ভীষণ কম্পন প্রকম্পিত করবে। তারপর আসবে আরেকটা। অনেক অন্তর সেদিন ভয়ে কাঁপতে থাকবে। তাদের দৃষ্টি হবে ভয়ে নত।
মানে? কোথা থেকে কী আসলো? সেই ঘোড়ার উপর সওয়ারী যোদ্ধাদের কী হলো? কে জিতলো শেষ পর্যন্ত?
যখন আল্লাহর সহযোগিতা এবং সেই বিজয় আসবে, আর তুমি দেখবে মানুষ দলে দলে আল্লাহর দীনে প্রবেশ করছে, তখন তুমি প্রশংসা এবং কৃতজ্ঞতা ভরে তোমার রবের পবিত্রতা ঘোষণা করবে, আর তাঁর কাছে ক্ষমা চাইবে। তিনি অবশ্যই বার বার ক্ষমা করেন। [আন-নসর]
একটি সামরিক বাহিনী যখন কোনো যুদ্ধে বিজয়ী হয়, তাদের প্রথম কাজ হয় বিজয় উল্লাস। এই উল্লাসে তারা নানা ধরনের অশ্লীল কাজ করে। মদ, বিনোদনে গা ভাসিয়ে দেয়। অন্যায়ভাবে জমি দখল শুরু হয়। পরাজিত মানুষগুলোর সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তাদের পথে বসিয়ে দেয়, হয় দাস বানিয়ে ফেলে, না হয় খুন করে ফেলে। বিশেষ করে পরাজিত পক্ষের নেতাদের এবং তাদের পরিবারগুলোর পরিণতি হয় ভয়ংকর। কিন্তু ইতিহাসে এমন এক বিজয়ের ঘটনা আছে, যেদিন জয়ী হওয়া সামরিক বাহিনী কোনো ধরনের উল্লাস করা তো দূরের কথা, কোনো বিনোদন, বিজয় অনুষ্ঠান, মদের আসর কিছুই করেনি এবং তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও সেই দিনটির স্মরণে প্রতিবছর বিজয় দিবস পালন করে না। সেই বিজয়ী বাহিনী সেদিন বিনীতভাবে এলাকায় প্রবেশ করেছে, নামাজ পড়েছে, তারপর পরাজিত মানুষগুলোকে ডেকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। কোনো ধরনের আগ্রাসী আচরণ, জমি দখল, বা নারীদের সাথে অন্যায়ের তো প্রশ্নই আসেনা। ইতিহাসে এরকম বিজয়ের ঘটনা আর নেই। এই বিজয় ছিল মক্কা বিজয়। সুরা আন-নসর এই বিজয়ের আগাম ভবিষ্যৎ বাণী। (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)
মুসলিমদের উপর যখন অমুসলিমরা নির্যাতন করে, তাদের সম্পত্তি লুট করে নিয়ে যায়, কর্তৃত্ব দখল করে নেয়, বাড়িঘর থেকে বের করে দেয়, তখন মুসলিমরা কীভাবে যুদ্ধ করে তাদের অধিকার আদায় করবে, তা আল্লাহ تعالى আল-বাক্বারাহ’তে তালুত এবং দাউদ عليه السلام-এর ঘটনার মাধ্যমে আমাদেরকে শিখিয়েছেন। এই আয়াতগুলো থেকে আমরা জানতে পারি: তারা কোন প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ করেছিলেন এবং কোন প্রেক্ষাপটে একটি মুসলিম সম্প্রদায় হাতে অস্ত্র তুলে যুদ্ধ করতে পারে। মাত্র ছয়টি আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে ইতিহাসের সেই অসাধারণ ঘটনার পরিষ্কার বর্ণনা দেবেন, যেই ঘটনা নিয়ে বাইবেলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বিভ্রান্তিকর বর্ণনা আছে। এই আয়াতগুলো থেকে একজন নেতা অনেক উপলব্ধির বিষয় পাবেন। একই সাথে অনুসারীরাও বিভিন্ন প্রকারের নেতাদের সম্পর্কে সাবধান হতে পারবেন—
বনি ইসরাইলের ওই গোত্র প্রধানদের কথা ভেবে দেখেছ, যারা তাদের নবীকে বলেছিল, “আমাদের জন্য এক রাজা নির্ধারণ করে দিন, যেন আমরা আল্লাহর تعالى পথে যুদ্ধ করতে পারি।” তিনি বলেন, “যদি এমন হয় যে, তোমাদের উপর যুদ্ধ করার আদেশ আসলো, কিন্তু তারপরেও তোমরা যুদ্ধ করলে না, তখন?” তারা বলল, “কেন আমরা আল্লাহর تعالى পথে যুদ্ধ করবো না, যখন কিনা আমাদের ঘরবাড়ি থেকে আমাদেরকে এবং আমাদের সন্তানদেরকে বের করে দেওয়া হয়েছে?” তারপর যখন তাদের উপর যুদ্ধ করার আদেশ আসলো, কয়েকজন বাদে বেশিরভাগই পিঠটান দিলো। আল্লাহ تعالى অন্যায়কারীদের ভালো করে চেনেন। [আল-বাক্বারাহ ২৪৬]
এই আয়াতে বেশ কিছু শেখার ব্যাপার রয়েছে। কখন আল্লাহ تعالى যুদ্ধ করার অধিকার দেন? যখন মুসলিমদের উপর আক্রমণ হয়, তাদের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে দখল হয়ে যায়, তখন তারা নিজেদের প্রতিরক্ষায় যুদ্ধ করতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ করার জন্য পরিষ্কার প্রমাণ কু’রআনে রয়েছে। এথেকেই দেখা যায়, ক্বিতাল বা যুদ্ধ হচ্ছে মূলত আত্মরক্ষামূলক। (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)
আমাদের সন্তানদের কেউ যদি মেধাবী হয়, তাহলে তাকে ডাক্তার বানাই। তারচেয়ে কম মেধাবীটা হয় ইঞ্জিনিয়ার। আরেকটু কম হলে বাংলা বা ইংলিশে পড়ে। আর যেটার অবস্থা একেবারেই খারাপ, সেটাকে আমরা মাদ্রাসায় দেই, ইমাম সাব বানাই। আমাদের মধ্যে কোনো এক অদ্ভুত কারণে একটা ধারণা আছে যে, সম্পূর্ণ ইসলাম বিবর্জিত সেকুলার শিক্ষায় ছেলেমেয়েরা বড় হলে নিজেরাই সৎ, আদর্শ মানুষ হবে, দুনিয়ায় শান্তিতে থাকবে। দুনিয়ায় শান্তিতে থাকাটাই আসল কথা। পরে কী হবে তা নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। ছেলেমেয়েদেরকে অত ইসলাম শেখানোর প্রয়োজন নেই। ইসলাম শিখে হবেটা কী? ইসলাম কী ছেলেমেয়েকে বাড়ি, গাড়ি, সম্পদ, সন্মান, উচ্চশিক্ষা —এসব কিছু দেবে?
তারপর তারা বড় হয়। ডাক্তারটা একসময় গিয়ে ১ লাখ টাকার অপারেশন করে ৫ লাখ টাকায়। বছর খানেকের মধ্যে কোটিপতি হয়ে বিদেশে চলে যায়। ওদিকে সেই ৫ লাখ টাকার বিল দিতে গিয়ে রোগীর পরিবার লোণে জর্জরিত হয়ে, পারিবারিক সম্পত্তি বিক্রি করে, অভাবে, কষ্টে, দুশ্চিন্তায় বছরের পর বছর পার করে। ইঞ্জিনিয়ারটা বড় হয়ে বিরাট অঙ্কের ঘুষ খেয়ে প্রজেক্ট করে। সেই ঘুষের টাকা দিয়ে সে বাড়ি-গাড়ি করে, আর তার ছেলেমেয়েরা ফাইভ স্টার হোটেলে গিয়ে থার্টি-ফার্স্ট নাইটে ড্রিঙ্ক করে মাতলামি করে। বাংলা, ইংরেজিতে পড়াগুলো রাজনৈতিক দলের ক্যাডার হয়ে মারামারি, খুনাখুনি, ধর্ষণ করে। সম্পূর্ণ ইসলাম বিবর্জিত সেকুলার শিক্ষার কুফল হাড়ে হাড়ে টের পাই।
এদিকে ইমাম সাহেব মাসে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বেতন পেয়ে তার পরিবারকে নিয়ে কোনোমতে দিন পার করে হলেও তার ছেলেমেয়েকে নৈতিকতা শেখান, হাফেজ বানান। বাবা-মা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়লে তিনি এবং তার স্ত্রী নিষ্ঠার সাথে বছরের পর বছর তাদের সেবা করেন। যেদিন বাবা-মা মারা যায়, সেদিন তিনি তার ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ভাইদেরকে ফোন করে আর পান না। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তিনি নিজেই হাজার হাজার মুসল্লিকে সাথে নিয়ে বাবা-মার জানাজা পড়েন। ইমাম সাহেবের বাবা-মা’র জানাজা, কত বিরাট সন্মানের জানাজা!
এর মানে এই নয় যে, আমরা সব সন্তানদের মাদ্রাসায় পড়াবো, ইমাম, মুয়াজ্জিন বানাবো। তাহলে মানব জাতি বিজ্ঞান, প্রযুক্তিতে আদিম যুগে বসে থাকবে। এটা ইসলামের শিক্ষা নয়। কুরআনে ২০০ এর বেশি আয়াত রয়েছে বিজ্ঞান নিয়ে। সেগুলোর বাস্তবায়ন করবে কে? আমাদেরকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, সেকুলার শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি ইসলামের শিক্ষা যেন তারা পায়, তা নিশ্চিত করা। না হলে, ফলাফল হবে প্রতিভাবান, বুদ্ধিমান শয়তান প্রজন্ম।
আজকের প্রজন্মের একটা বড় অংশ ভয়াবহ রকমের নৈতিক অবক্ষয়ে ডুবে গেছে: তাদের বাবা-মা’দের দুনিয়ায় সম্পদ, সন্মান, আরাম-আয়েশের লোভের জন্য। সেই সব বাবা-মা’দের কাছে তাদের সন্তানরা হচ্ছে পেনশন। সেই পেনশনের মূল্য বাড়ানোর জন্য তারা যতভাবে সম্ভব চেষ্টা করেন সন্তানদেরকে দুনিয়াতে বড়লোক বানাবার। ইসলাম হচ্ছে তাদের পেনশনের মূল্য বৃদ্ধিতে একটি বাঁধা মাত্র। ছেলে ইসলাম নিয়ে পড়াশুনা শুরু করলে, দাঁড়িওলা বন্ধুদের সাথে মেলামেশা শুরু করলে, তারা আতঙ্কিত হয়ে যান: এই বুঝি আমাদের পেনশন গেল!
এই ধরনের বাবা-মাদের ভেতরে এই ভয়ঙ্কর লোভ জন্ম হতে দিয়েছে তাদেরই বাবা-মা, যারা অনেকে নিজেরা ইসলাম মানলেও, তাদের সন্তানদেরকে ইসলামের পথে রাখার জন্য কোনো জোর দেননি। যার ফলে তারা তাদের বংশধরদের মধ্যে ইসলাম হারিয়ে যাওয়ার একটা চেইন রিয়াকশন শুরু করে দিয়ে গেছেন, যার ফলাফল আজকের ইসলাম ভুলে যাওয়া, নৈতিকভাবে ধ্বসে যাওয়া প্রজন্ম।
এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে এই প্রজন্ম এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করার জন্য একটাই উপায়— তাদেরকে আল্লাহর تعالى প্রতি অনুগত করা। তাদেরকে উপলব্ধি করানো যে, সামনে এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা আসছে। আজকে তাদেরকে ‘বাস্তবতা’ বলতে যা শেখানো হচ্ছে, সেটা কয়েক বছরের মায়া মাত্র। আসল বাস্তবতা আসছে সামনে, যেখানে সময় কখনো শেষ হবে না, যেই মহাবিশ্ব কখনো ধ্বংস হবে না। নবী ইব্রাহিম عليه السلام তা উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তিনি তার সন্তান এবং বংশধরদের জন্য দু’আ করেছিলেন—
ও আমাদের প্রভু! আমাদের দুজনকে আপনার প্রতি অনুগত করে রাখুন এবং আমাদের বংশধর থেকে আপনার প্রতি অনুগত একটি জাতি তৈরি করে দিন। আমাদেরকে দেখিয়ে দিন কীভাবে ইবাদত করতে হয় এবং আমাদের ক্ষমা প্রার্থনা গ্রহণ করুন। নিঃসন্দেহে আপনি বার বার ক্ষমা করেন, নিরন্তর দয়াময়। [আল-বাক্বারাহ ১২৮]
কু’রআনে কিছু আয়াত রয়েছে যেগুলো অমুসলিম সমালোচকরা এবং ইসলামকে যারা আক্রমণ করার জন্য সবসময় ওতপেতে থাকেন, তারা পড়লে বড়ই খুশি হন, কারণ তারা ইসলামকে একটি “মধ্যযুগীয় বর্বর ধর্ম” হিসেবে প্রচার করার জন্য এই আয়াতগুলো থেকে অস্ত্র পেয়ে যান। আবার এই একই আয়াতগুলো একদল চরমপন্থী মুসলিমরা পড়লে বড়ই খুশি হন, কারণ তারা এই আয়াতগুলো থেকে অমসুলিমদের বিরুদ্ধে মারামারি, খুনাখুনি করার জন্য অনুপ্রেরণা এবং আদেশ খুঁজে পান। এই দুই ধরনের মানুষরা গত হাজার বছর ধরে ইসলামের একই ক্ষতি করে গেছেন: ইসলামকে সাধারণ মানুষের মাঝে একটি অসহনশীল, কট্টর, আগ্রাসী ধর্ম হিসেবে কুখ্যাত করে দিয়ে গেছেন। এরকম একটি আয়াত হলো—
আল্লাহর সাথে যারা শিরক করে এবং আহলে কিতাবের (ইহুদি এবং খ্রিস্টান) মধ্যে থেকে যারা সত্যকে অস্বীকার (কুফরি) করেছে, তারা কখনই চায় না যে, তোমাদের প্রভুর কাছ থেকে একটুও ভালো কিছু আসুক তোমাদের উপর। কিন্তু আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাঁর অনুগ্রহের জন্য মনোনীত করেন। আল্লাহ অপরিসীম অনুগ্রহের অধিকারী। [আল-বাক্বারাহ ২:১০৫]
এই আয়াত পড়ে অমুসলিমরা বলে, “তোমাদের কাছে আমরা সবাই কাফির? তোমরা না বল ইসলাম হচ্ছে শান্তি, সহমর্মিতার ধর্ম? এই হচ্ছে তার নমুনা?” আর অন্যদিকে একদল মুসলিমরা, যারা রক্তের গন্ধের জন্য পাগল হয়ে আছেন, তারা এইধরনের আয়াত পড়ে চোখ লাল করে চিৎকার দিয়ে ওঠেন, “ওরা সব কাফির! ওরা কেউ চায় না আমাদের ভালো কিছু হোক। ভাই সব, অস্ত্র হাতে নিয়ে ইহুদি, খ্রিস্টান, মুশরিকদেরদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। আল্লাহু আকবার!”