অনেকে আছে যারা শুধুই চায়, “ও রব্ব, আমাদেরকে দুনিয়াতে দিন” — আল-বাক্বারাহ ২০০-২০২

আমরা যখন হাজ্জ করতে যাই, আমাদের উদ্দেশ্য থাকে কীভাবে আমরা আল্লাহকে تعالى খুশি করতে পারি, যেন তিনি আমাদেরকে জান্নাত দেন। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, অনেকে হাজ্জে যান, কারণ তার দুনিয়াতে অনেক কিছু দরকার, এবং তিনি শুনেছেন হাজ্জে গিয়ে চাইলে নাকি সব পাওয়া যায়। যার ফলে তার হাজ্জে যাওয়াটা হয়ে যায়, মন্ত্রীর কাছে গিয়ে তদবির করার মতো একধরনের তদবির অনুষ্ঠান। হাজ্জে গিয়ে তার দু’আ হয়, “ও আল্লাহ, تعالى আমার ব্যবসাটা ভালো করে দিন, আমাকে চাকরিতে প্রমোশন দিন। আমাকে একটা বাড়ি কিনতে দিন। আমার ছেলেমেয়েকে বিদেশে পাঠাতে দিন। আমার জমিগুলোকে নিরাপদ রাখুন। আমার স্ত্রীর অত্যাচার দূর করে দিন। আমার ডায়াবেটিস ঠিক করে দিন।…” —অবশ্যই এগুলো চাওয়াটা দোষের নয়, কিন্তু আমাদেরকে বুঝতে হবে: এই মহাবিশ্বে আমাদের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য কী। কেন আমাদেরকে সৃষ্টি করে এই পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। আমরা যদি দুনিয়ার পেছনে দৌড়াতে গিয়ে এই বিরাট ব্যাপারটাকে বেশি গুরুত্ব না দেই, ভুলে যাই, হাজ্জের মতো এত বড় একটা সুযোগ পেয়েও উপলব্ধি না করি, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, কারণ আল্লাহ تعالى বলেছেন—

2_200

হাজ্জের অনুষ্ঠানগুলো শেষ করার পর, আল্লাহকে تعالى বেশি করে মনে করবে, যেভাবে তোমাদের বাপদাদাদের মনে করো। না, বরং তারচেয়ে বেশি করে! কারণ অনেকে আছে যারা শুধুই চায়, “ও রব্ব, আমাদেরকে দুনিয়াতে দিন” —এদের জন্য পরকালে বিন্দুমাত্র কোনো ভাগ থাকবে না। [আল-বাক্বারাহ ২০০]

আগেকার আমলে হাজ্জ শেষ হওয়ার পর হাজ্জিরা একসাথে বসে তাদের বাপ-দাদাদের কৃতিত্ব নিয়ে গল্প করতো —কে কবে কাকে কত খাইয়েছে, কত সাহায্য করেছে, কত জমিজমা করেছে, কত যুদ্ধ করেছে, কত বীর পদক পেয়েছে ইত্যাদি।[১২][১৪][৬] আজকের দিনে আমরা বাপ-দাদাদের নিয়ে এভাবে গর্ব করি না। আমাদের গল্পগুলো হয়ে গেছে: কার বাবা মন্ত্রী, কার দাদা জমিদার ছিলেন, কে সৈয়দ বংশের, কার চাচা হাজ্জ কাফেলার চেয়ারম্যান ইত্যাদি। হাজ্জের মতো এত মূল্যবান সময়গুলো আমরা পার করি এসব খোশ গল্প করে।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

আমাকে মনে করো, আমিও তোমাদেরকে মনে করবো — আল-বাক্বারাহ ১৫২

2_152_title

2_152তাই আমাকে মনে করো, আমিও তোমাদেরকে মনে করবো। আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, আর আমার প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ো না। [আল-বাক্বারাহ ১৫২]

কু’রআনে একটি ব্যাপার বার বার ঘুরে ফিরে আসে: আল্লাহর تعالى প্রতি আমাদেরকে কৃতজ্ঞতা দেখাতে হবে। প্রশ্ন আসে: আল্লাহর تعالى প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানোর জন্য এত জোর দেওয়া হয়েছে কেন? আল্লাহর تعالى তো কোনো কিছুর দরকার নেই? তাহলে কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে কার কী লাভ হচ্ছে?

টাইম ম্যাগাজিনে একটি আর্টিকেল[২৮৫] বের হয়েছে কৃতজ্ঞতার উপকারিতার উপরে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০০৩ সালে ২,৬১৬ জন বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষের উপরে গবেষণা করে দেখা গেছে: যারা অপেক্ষাকৃত বেশি কৃতজ্ঞ, তাদের মধ্যে মানসিক অবসাদ, দুশ্চিন্তা, অমূলক ভয়-ভীতি, অতিরিক্ত খাবার অভ্যাস এবং মদ, সিগারেট ও ড্রাগের প্রতি আসক্তির ঝুঁকি অনেক কম। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে: মানুষকে নিয়মিত আরও বেশি কৃতজ্ঞ হতে অনুপ্রাণিত করলে, মানুষের নিজের সম্পর্কে যে হীনমন্যতা আছে, নিজেকে ঘৃণা করা, নিজেকে সবসময় অসুন্দর, দুর্বল, উপেক্ষিত মনে করা, ইত্যাদি নানা ধরণের সমস্যা ৭৬% পর্যন্ত দূর করা যায়।

২০০৯ সালে ৪০১ জন মানুষের উপর গবেষণা করা হয়, যাদের মধ্যে ৪০%-এর ক্লিনিকাল স্লিপ ডিসঅর্ডার, অর্থাৎ জটিল ঘুমের সমস্যা আছে। তাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ, তারা একনাগাড়ে বেশি ঘুমাতে পারেন, তাদের ঘুম নিয়মিত হয়, রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন এবং দিনের বেলা ক্লান্ত-অবসাদ কম থাকেন।

নিউইয়র্কের Hofstra University সাইকোলজির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ড: জেফ্রি ফ্রহ ১০৩৫ জন ১৪-১৯ বছর বয়সি শিক্ষার্থীর উপর গবেষণা করে দেখেছেন: যারা বেশি কৃতজ্ঞতা দেখায়, তাদের পরীক্ষায় ফলাফল অপেক্ষাকৃত বেশি ভালো, সামাজিক ভাবে বেশি মেলামেশা করে এবং হিংসা ও মানসিক অবসাদে কম ভোগে। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এই মানসিক সমস্যাগুলো মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তাদের মধ্যে বাবা-মার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ আশংকাজনকভাবে কম।

Wall Street Journal একটি আর্টিকেলে[২৮৬] বলা হয়েছে

যেসব বয়ঃস্থ মানুষ প্রতিনিয়ত কৃতজ্ঞতা অনুভব করেন: তাদের কর্মস্পৃহা, জীবনসম্বন্ধে তাদের আস্থা, তাদের সামাজিক মেলামেশা, এবং তাদের সুখানুভূতি কৃতজ্ঞতাবোধহীনদের তুলনায় অনেক অনেক বেশি হয়ে থাকে –প্রায় এক যুগ গবেষণার ফল থেকে এটি জানা গেছে। এদের মধ্যে হতাশা, ঈর্ষা, লোভ অথবা মদ্যপানে আসক্তি আসার সম্ভাবনা কম। এরা অপেক্ষাকৃত বেশি আয় করে থাকে, এরা গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়ে, এরা নিয়মিত ব্যায়াম করার সুযোগ পায় এবং ভাইরাসজনিত রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাও এদের বেশি।

এবার বুঝতে পারছেন, কেন আমাদের প্রতিদিন ৫ ওয়াক্তে, কমপক্ষে ১৭ বার সুরা ফাতিহায় বলা উচিত—

আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামিন
সমস্ত প্রশংসা এবং ধন্যবাদ আল্লাহর, যিনি সৃষ্টিজগতের প্রভু। [ফাতিহা ১:২]

“আমাকে মনে করো”

ٱذْكُرُوا۟ এসেছে ذكر থেকে, যা কু’রআনে অনেকগুলো অর্থে এবং উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে: ১) উল্লেখ করা, ২) মুখস্থ করা, ৩) পুনরায় মনে করা, ৪) মনে রাখা, ৫) কিছু নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা, ৬) উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা, ৭) উপলব্ধি করে অনুতপ্ত হওয়া, ৮) কোনো শিক্ষাকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা ইত্যাদি।[১৪২] আল্লাহ تعالى আমাদেরকে বলছেন: তিনি আমাদের যা কিছু দিয়েছেন, তার সব আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, মানুষকে মনে করিয়ে দিতে হবে, নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে। যদি আমরা তা করি, তাহলেই আমরা তাক্বওয়া অর্থাৎ আল্লাহর تعالى প্রতি সবসময় গভীরভাবে সচেতন থাকতে পারবো।

অনেক সময় আমরা যিকর বলতে শুধু নিজেকেই মনে করানো বুঝি। কিন্তু যিকরের একটি অর্থ হলো: কাউকে মনে করানো, উল্লেখ করা। ধরুন, আপনার পরিবারের এক সদস্য গত কয়েক ঘণ্টা ধরে সোফায় বসে একটার পর একটা চ্যানেল পাল্টাচ্ছে, আর হাতে চিপস নিয়ে যাবর কাটছে। আপনি তাকে গিয়ে তাগাদা দিলেন: সে কী চরম অর্থহীন একটা কাজ করে জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করছে — সেটা ভালো করে বোঝালেন। তাকে আল্লাহর تعالى কথা মনে করিয়ে দিলেন — তখন এটা যিকর হয়ে যাবে। যিকর মানে শুধুই নিজে নিজে দু’আ পড়া নয়।[১]

এছাড়াও, আল্লাহকে تعالى মনে করা মানে শুধু মুখে যিকর করাই নয়, বরংতাঁর আদেশ অনুসারে কাজ করা, এবং নিষেধ অনুসারে খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকাই হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে তাঁকে মনে করা।[৪] [১৪] কারণ আমরা যখন আল্লাহর تعالى নির্দেশকে অমান্য করতে থাকি, তখন আমরা তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ে যাই। যখন আমরা অফিসের কাজ, বাচ্চাকে স্কুলে আনা-নেওয়া, সপ্তাহের বাজার, মেহমানদারী করতে গিয়ে ওয়াক্তের পর ওয়াক্ত নামাজ ছেড়ে দেই, আমরা শুধু তাঁর অবাধ্যই হই না, তাঁর প্রতি আমরা অকৃতজ্ঞও হয়ে যাই। যদি আমরা সত্যিই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হতাম, তাহলে কখনই অফিসের বস-সন্তান-ঘরের কাজ থেকে তাঁকে কম গুরুত্ব দিতাম না।

যিনি আমাদের স্বাস্থ্য, সম্পত্তি, সংসার, সন্তান, সঙ্গ, সম্মান, সম্ভ্রম —সবকিছুর মালিক, তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে বা কিছুকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া, সেগুলোর পেছনে দৌড়াতে গিয়ে তাঁকেই ভুলে যাওয়া এবং ‘লোকে কী বলবে’ এই ভয়ে তাঁর নিষেধ অমান্য করা—এধরনের কাজগুলো তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন ছাড়া আর কিছু নয়।

“আমিও তোমাকে মনে করবো”

আল্লাহ تعالى আমাদের কথা মনে করবেন! সৃষ্টিজগতের মহান সম্রাট আমাদের কথা বলবেন! এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে?

একটা উদাহরণ দেই। ধরুন, চৌধুরী সাহেব একজন মন্ত্রীর কাছে মাসের পর মাস ধরে তদবির করছেন তার একটা পদোন্নতির ব্যাপারে। একদিন তাকে মন্ত্রী ফোন করে বলল, “চৌধুরী সাহেব, খুশির খবর। আজকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে আপনার কথা বললাম। প্রধানমন্ত্রী নিজে আপনার কাগজ-পত্র দেখতে চাইলেন, আপনার ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন।” —এই কথা শুনে চৌধুরী সাহেব আনন্দে গদগদ হয়ে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী নিজে তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছেন? কী সৌভাগ্যের কথা!

এবার চিন্তা করে দেখুন, আপনি যখন আল্লাহ ﷻ কে স্মরণ করছেন, এই যে আর্টিকেলটা পড়ছেন, হতে পারে এই মুহূর্তে এক ঐশ্বরিক সমাবেশে উচু-পর্যায়ের সৃষ্টিদের সাথে, মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ-ক্ষমতাবান নিজে আপনার ব্যাপারে কথা বলছেন। আপনি যে তাঁকে মনে করছেন, সেটা তিনি নিজে লক্ষ্য করছেন। তিনি এই মুহূর্তে আপনাকে পুরস্কার লিখে দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন, হয়তো বা আপনার ভাগ্য পরিবর্তনেরও নির্দেশ দিচ্ছেন। আপনার এই মুহূর্তটি কত বড় সম্মানের একটি মুহূর্ত!

“আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, আর আমার প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ো না”

এই অংশে আল্লাহ تعالى বলছেন: তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে এবং তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞ না হতে। কেন তিনি শুধুই কৃতজ্ঞ হতে বলে আয়াত শেষ করে দিলেন না? আলাদা করে অকৃতজ্ঞ হতে না বলার প্রয়োজন কী ছিল?

আল্লাহ تعالى জানেন: আমরা তাঁর প্রতি যথাযথ কৃতজ্ঞতা দেখাতে পারবো না। তিনি যে প্রতিদিন আমাদেরকে কত কিছু দেন, আমাদের অগোচরে কত বিপদ থেকে বাঁচান, আমাদের না জানিয়ে কত দিক থেকে সমস্যাগুলোকে সহজ করে দেন —সেটা আমরা উপলব্ধি করতে পারবো না, তাঁকে যথাযথ সম্মানও করতে পারবো না। তাই আমরা তাঁর প্রতি ঠিকমতো কৃতজ্ঞতা না দেখালেও, অন্তত যেন অকৃতজ্ঞতা না দেখাই। অকৃতজ্ঞতা দেখালে তিনি তা ছেড়ে দেবেন না।

আমরা কীভাবে আল্লাহর تعالى প্রতি অকৃতজ্ঞতা দেখাই, তার কিছু উদাহরণ দেই—

বিশ বছর পড়াশুনা করে বের হওয়ার পর দেখা যায় আর চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যবসার সুযোগ নেই। মাসের পর মাস ইন্টার্ভিউ দিতে দিতে অবস্থা কাহিল। বাসায় এসে রাতে খেতে বসলে বাবা-মা ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’ দিয়ে বলেন, “এভাবে আর কতদিন চলবে? একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে?” বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি, মাথার উপরে ছাদ, শোয়ার বিছানা, কল ছাড়লেই পরিষ্কার পানি, চুলায় গ্যাস, ইলেক্ট্রিসিটি, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, তিনবেলা খাওয়ার ব্যবস্থা, ফ্রিজ ভর্তি খাবার —এতসব থাকতেও প্রতিদিন নিজের ভেতরে হাহাকার চলে, “ও আল্লাহ تعالى, এভাবে আর কত দিন? কেন আপনি আমার সাথেই এরকম করছেন? আমার বন্ধুদের চাকরি হয়, আমার কেন হয় না? চাচাতো ভাইয়েরা বাড়ি-গাড়ি করে ফেলেছে, আর আমি বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি? কেন আপনি আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছেন?”

একদিন চাকরি-ব্যবসা হয়। সম্পত্তির মালিক হয়। বিয়ে হয়। তারপর দেখা যায় সন্তান হচ্ছে না। বছরের পর বছর পার হয়ে যাচ্ছে। অনেক ডাক্তার দেখিয়ে লাভ হচ্ছে না। কত গরিবদের খাওয়ানো, মাজারে দান, পানি-পড়া, ডাব-পড়া, তেল-ম্যাসাজ, কালো জিরা চলে। অথচ হিসেব করলে দেখা যাবে: ভালো বেতনের চাকরি, যথেষ্ট সম্পত্তি, গুণবতী স্ত্রী, সুস্থ বাবা-মা, নিজের বাড়ি, গাড়ি, বাসায় চাকর —সব আছে। এতসবকিছু থাকতেও সে মনের দুঃখে নামাজ পড়া ছেড়ে দিয়েছে, আর প্রতি দিন আক্ষেপ করছে, “ও আল্লাহ تعالى, আপনি আমাদের সাথে এরকম কেন করছেন? আমরা কি খুব বেশি কিছু চাই আপনার কাছে? সবার সন্তান আছে। আমাদেরকে কেন দেবেন না? আমরা কী অন্যায় করেছি?”

আমাদের অনেকেরই বেলায় দেখা যায়: স্বাস্থ্য, সম্পত্তি, সংসার, সন্তান, সঙ্গ, সম্মান, সম্ভ্রম—এগুলোর কোনো একটা বা দুটা যদি না থাকে, বা কম থাকে, শুরু হয় হতাশা, আক্ষেপ, দুঃখ, আল্লাহকে تعالى নিয়ে অভিযোগ। যেমন ধরুন, কারো স্বাস্থ্য, সম্পত্তি, সন্তান, সঙ্গ, সম্মান, সম্ভ্রম —এই সবই আছে, শুধু সংসারে ঝামেলা। শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে প্রায়ই সমস্যা, কটু কথা থেকে ঝগড়া। ব্যাস, তার জীবন যেন বরবাদ হয়ে যায়। যখনি তার সাথে দেখা হয়, আধাঘণ্টা ধরে তার জীবনের করুণ কাহিনীর বর্ণনা। দুই-একদিন পরপর কাউকে ফোন করে এক ঘণ্টা ধরে তার শোকগাঁথা না শোনালে তার বুকের পাথর নামে না। নামাজে আল্লাহর تعالى কাছে কত অভিযোগ, “ও আল্লাহ تعالى, শেষ পর্যন্ত এই রেখেছিলেন আমার কপালে? আমাকে কেন এত শয়তান স্বামী/স্ত্রী দিলেন? আমার বন্ধুরা কত ভালো পরিবার পেয়েছে। আমি কি একটু শান্তির জীবন পেতে পারতাম না?”

যখন আমাদের জীবনে কোনো দিক থেকে কিছু কম থাকে এবং আমরা আশেপাশের মানুষের দিকে তাকিয়ে দেখি: তাদের তো সেটা ঠিকই আছে, তখন প্রশ্ন করা শুরু করি, “তাহলে আমার নেই কেন? আমি কী দোষ করেছি?” কিন্তু আমরা কখনো খুঁজে দেখি না যে, যাদেরকে দেখে আক্ষেপ করছি, তাদর স্বাস্থ্য, সম্পত্তি, সংসার, সন্তান, সঙ্গ, সম্মান, সম্ভ্রম —এই সবগুলোর মধ্যে কোনোদিকে কিছু একটা কম আছে কিনা। আমরা শুধু দেখি: আমার যা নেই বা যা কম আছে, সেটা আর কার কার আছে। যাদের আছে, “ওরা কতই না সুখী। শুধু আমি হচ্ছি পোড়া কপাল।” খোঁজ নিলে দেখা যায়, তারাও একই কথা ভাবছে। তাদের যা নেই, সেটা আমার কেন আছে, তা নিয়ে তাদের কত না হা-হুতাশ।

অনেক বছর আগে আল্লাহ যখন ইবলিসকে তাঁর সান্নিধ্য থেকে বের করে দিচ্ছিলেন, তখন ইবলিস একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ শপথ করেছিল, যা থেকে তার মানুষকে ধ্বংস করার অন্যতম একটি প্রধান পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়—

(ইবলিস বলল) “আমি মানুষের কাছে আসব: ওদের সামনে থেকে, ওদের পেছন থেকে, ওদের ডান দিক থেকে এবং ওদের বাম দিক থেকে। আপনি দেখবেন ওরা বেশিরভাগই কৃতজ্ঞ না।” [আ’রাফ ৭:১৭]

ইবলিস অনেক আগেই বলে গিয়েছিল যে, আমরা বেশিরভাগই আল্লাহর تعالى প্রতি কৃতজ্ঞ হবো না, যার কারণে আমরা দুনিয়া এবং আখিরাতে পস্তাবো। আজকে আমরা ওরই কথা প্রতিনিয়ত সত্যি প্রমাণ করে দিচ্ছি।

এখন, আমাদের কারো জীবনে যদি দশটা দিকের মধ্যে তিনটা দিকে সমস্যা থাকে, তাহলে আমরা সেই তিনটা দিকও কেন ভালো হলো না, তা নিয়ে প্রতিনিয়ত আক্ষেপ করতে পারি, অথবা বাকি সাতটা দিকে আল্লাহ যে আমাদের যথেষ্ট ভালো রেখেছেন, তা নিয়ে প্রতিদিন তাঁকে কৃতজ্ঞতা দেখাতে পারি। কোনটা করবো, তা ঠিক করতে এই আয়াতটি কিছুটা অনুপ্রেরণা দেবে—

মনে করে দেখো, তোমাদের প্রভু কথা দিয়েছিলেন, “যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তাহলে আমি তোমাদেরকে আরও দিতেই থাকবো। কিন্তু তোমরা যদি অকৃতজ্ঞ হও… আমার শাস্তি প্রচণ্ড কষ্টের।” [ইব্রাহিম ১৪:৭]

আল্লাহর تعالى উপরে যারা পুরোপুরি নির্ভর করতে পারেন, তারা গাজার বোনদের মত নিশ্চিন্তে হিজাব পরে রাতে ঘুমাতে যান। কারণ তারা মেনে নিয়েছেন: আল্লাহ تعالى যদি চান, তাহলে আজকে রাতেই তিনি শহিদ হবেন। তখন উদ্ধারকারীরা যেন তাকে বেপর্দা অবস্থায় দেখে না ফেলে। তারা তাদের ছেলেমেয়েদেরকে বাইরের পোশাক পরিয়ে, পকেটে খাবার গুঁজে দিয়ে বিছানায় শোয়ান। হয়ত আজকে রাতেই তার সন্তানরা একা একা রাস্তায় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পড়ে থাকবে। আগামীকাল থেকে বাবা-মা ছাড়া জীবন পার করতে হবে —তাই তারা প্রস্তুত। ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই, সবই আল্লাহর تعالى ইচ্ছে। আল্লাহ تعالى যখন চাইবেন, তখন তা হবেই।

এই ধরনের মুমিনদের চাকরি নিয়ে অস্থিরতা থেকে মানসিক চাপ (স্ট্রেস), প্রেমে বিফলতার কারণে হতাশা, অপারেশনের আতঙ্কে রাতে ঘুম না হওয়া, ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে উচ্চ রক্তচাপ বাঁধিয়ে ফেলা —এই সব সমস্যায় জীবন জর্জরিত হয়ে যায় না। এই সমস্যাগুলো আমাদের মত নড়বড়ে ঈমানের মানুষদের সমস্যা, যারা আল্লাহর تعالى প্রতি কৃতজ্ঞ হয় না, এবং প্রতিনিয়ত আল্লাহর تعالى প্রতি অকৃতজ্ঞতা দেখায়।

আসুন আমরা কু’রআনের আয়াতগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করি। আল্লাহ تعالى আমাদেরকে কু’রআন দিয়েছেন এক আত্মিক নিরাময় হিসেবে। আমাদের অনেক মানসিক সমস্যার সমাধান রয়েছে কু’রআনে। নিয়মিত বুঝে কু’রআন পড়লে আমরা খুব সহজেই ওষুধের উপর আমাদের নির্ভরতা কমিয়ে আনতে পারব। স্ট্রেস-ডিপ্রেশন থেকে মুক্ত হয়ে শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ জীবন যাপন করতে পারব — ইন শাআ আল্লাহ।

সূত্র:

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
  • [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
  • [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
  • [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
  • [১৫] তাফসির আল জালালাইন।
  • [১৪২] ذكر যিকর শব্দের বিস্তারিত অর্থ।
  • [২৮৫] Szalavitz, M. and Szalavitz, M. (2015). Why Gratitude Isn’t Just for Thanksgiving | TIME.com. [online] TIME.com. Available at: http://healthland.time.com/2012/11/22/why-gratitude-isnt-just-for-thanksgiving/ [Accessed 28 Apr. 2015].
  • [২৮৬] Beck, M. (2015). Thank You. No, Thank You. [online] WSJ. Available at: http://www.wsj.com/articles/SB10001424052748704243904575630541486290052 [Accessed 28 Apr. 2015].