তাদের পুরস্কার তাদের প্রভুর কাছে রয়েছে — আল-বাক্বারাহ ৬২

সূরা বাক্বারাহ’র এই আয়াতটি নিয়ে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক হয়েছে এবং এক শ্রেণীর ‘আধুনিক মুসলিম’ এই ধরনের আয়াতকে অপ্রাসঙ্গিকভাবে অপব্যবহার করেছে পাশ্চাত্যের সমাজের সাথে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে, সেখানকার মুসলিম-অমুসলিম উভয়ের কাছেই তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য—

2_62

কোনো সন্দেহ নেই, যারা বিশ্বাস করেছে এবং যারা ইহুদী, খ্রিস্টান, সাবিইন — এদের মধ্যে যারা আল্লাহকে এবং শেষ দিনে বিশ্বাস করে এবং ভালো কাজ করে, তাদের পুরস্কার তাদের প্রভুর কাছে রয়েছে। তাদের কোনো ভয় নেই, তারা দুঃখও করবে না। [আল-বাক্বারাহ ৬২]

heaven-on-mountain

এই আয়াতের অর্থ কি এই যে, আজকে যারা ভালো ইহুদী, ভালো খ্রিস্টান, তারা সবাই জান্নাতে যাবে? তাহলে এত কষ্ট করে ইসলাম মানার কি দরকার? কারো যদি কু’রআনের সালাত, হিজাব, রোযা রাখার আইন পছন্দ না হয়, তাহলে সে কালকে থেকে খ্রিস্টান হয়ে গেলেই তো পারে? সে তখনো আল্লাহকে বিশ্বাস করবে, শেষ দিনেও বিশ্বাস করবে, এমনকি ভালো কাজও করবে। তখন এই আয়াত অনুসারে “তাদের কোনো ভয় নেই, তারা দুঃখ করবে না।” কী দরকার এত কষ্ট করে, এত নিয়ম মেনে মুসলিম হয়ে থাকার?

প্রথমে কিছু ইতিহাস বলে নেওয়া দরকার—

সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে, ইসলাম একটি নতুন ধর্ম, যা মুহাম্মাদ عليه السلام -ই প্রথম প্রচার করে গেছেন। এটি একটি অসম্পূর্ণ ধারণা। ইসলাম হচ্ছে লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ বা আল্লাহর একত্ববাদের বিশ্বাস; মহান আল্লাহর تعالى নির্ধারিত সকল মানবজাতির জন্য একমাত্র ধর্ম, যার পুরো বাণী ও বিস্তারিত আইন মহান আল্লাহর تعالى কাছে পূর্ব হতেই সংরক্ষিত। সেই আইন ও বাণীর বিভিন্ন সংস্করণ তিনি যুগে যুগে বিভিন্ন প্রজন্মের কাছে বিভিন্ন রাসূলের عليه السلام মাধ্যমে, প্রয়োজন অনুসারে যেটুকু দরকার, সেটুকু পাঠিয়েছেন। সেই বাণী ও সংগ্রহের বিভিন্ন সংস্করণকে কুরআনে সহীফা ও কিতাব বলা হয়েছে। কু’রআন হচ্ছে সেই বাণী বা আইনের সর্বশেষ ও চূড়ান্ত সংস্করণ, বা সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থ, যা রাসূল মুহাম্মাদ عليه السلام -এর মাধ্যমে আমরা পেয়েছি।[১]

এছাড়াও আরেকটি প্রচলিত ভুল ধারণা হলো: যারা মুহাম্মাদ عليه السلام এর অনুসারী, শুধুমাত্র তারাই মুসলমান। নবী ইব্রাহিম عليه السلام কা’বা বানানো শেষ করার পরে আল্লাহর تعالى কাছে দু’আ করেছিলেন যেন তার সন্তান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মরা মুসলিম হয়।[২:১২৭] নবী ইয়াকুব عليه السلام মৃত্যুর সময় তাঁর সন্তানদেরকে বলে গিয়েছিলেন: তারা যেন কেউ অমুসলিম অবস্থায় মৃত্যু বরণ না করে। ‘মুসলিম’ কোনো বিশেষ গোত্র, বংশ, বা বিশেষ নবীর উম্মত নয়। যুগে যুগে যারাই মহান আল্লাহকে تعالى এক ও একক উপাস্য মেনে নিয়ে, নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য না দিয়ে, তাঁর ইচ্ছার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন, তাঁর প্রেরিত নবী-রাসূলের عليه السلام অনুসরণ করেছেন, তাঁর নাজিলকৃত কিতাব মেনে চলেছেন— তারাই মুসলিম।।

একই সাথে আমাদেরকে এটাও মনে রাখতে হবে যে, রাসূল মুহাম্মাদ عليه السلام -এর জন্মের অনেক আগে থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যে তাওরাত এবং ইঞ্জিল পাওয়া যায়, সেগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন এবং বিকৃতি করা হয়েছে, যার কারণে সেগুলো আর মৌলিক, অবিকৃত অবস্থায় থাকেনি। ফলে আমরা কেবল সেগুলোর ব্যাপারে মৌলিকভাবে ঐশী গ্রন্থ হওয়ায় বিশ্বাস করব, তবে সেগুলো পড়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না। কু’রআনের ভাষা এবং আজকালকার তাওরাত, ইঞ্জিলের ভাষার মধ্যে এতই আকাশ পাতাল পার্থক্য যে, সেগুলো পড়লেই বোঝা যায়: প্রচলিত এই তিন ধর্মগ্রন্থের উৎস একই মহান সত্তা নন।

আজকের তাওরাত এবং ইঞ্জিলে আল্লাহর تعالى সম্পর্কে অনেক বিকৃত ধারণা রয়েছে। যেমন, মানুষকে সৃষ্টি করে তাঁর ‘অন্তরে’ বেদনা হওয়ার কথা[১২০], তাঁর নবী ইয়াকুবের عليه السلام সাথে কুস্তি লড়ে হেরে যাওয়ার ঘটনা[১১৯] ইত্যাদি — اَللّٰهُ أَكْبَر! এমনকি নবীদের عليه السلام সম্পর্কে নানা ধরনের অশ্লীল, যৌনতার রগরগে ঘটনা রয়েছে।[১২১] পুরুষদের মাথায় যত নোংরা ফ্যান্টাসি আছে, তার সব আপনি বাইবেলে পাবেন, কিছুই বাকি নেই। বাইবেলের গ্রন্থগুলো পুরো মাত্রায় পর্ণগ্রাফি। আপনি কখনই বাইবেলের বইগুলো আপনার ছোট বাচ্চাদের সাথে বা কিশোর বয়সের ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে একসাথে বসে পড়তে পারবেন না। একারণে মুসলিমরা কোনো ভাবেই বিশ্বাস করে না যে, তাওরাত এবং ইঞ্জিল কোনোভাবেই অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে। এনিয়ে বাকারাহ ৪-৫ আয়াতের বর্ণনায় বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।

বাইবেলের বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা পড়ে অনেক খ্রিস্টান মিনিস্টার, পাদ্রী, বিশপরাও খ্রিস্টান ধর্ম ছেড়ে অন্য কোনো সত্য ধর্ম খুঁজতে গিয়ে ইসলামকে খুঁজে পেয়ে মুসলিম হয়ে গেছেন।[১১৬] এমনকি একজন আর্চ-বিশপ খ্রিস্টান ধর্মীয় শিক্ষায় ব্যাচেলর্স এবং মাস্টার্স শেষ করে ডক্টরেট করতে গিয়ে মুসলিম হয়ে গেছেন![১১৮] তার মুসলিম হওয়ার ঘটনাটা অদ্ভুত[১১৮]

তিনি খ্রিস্টান ধর্মে ব্যাচেলর্স এবং মাস্টার্স করার সময় পর্যন্ত খ্রিস্টান ধর্মের কোনো শিক্ষা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতেন না। কিন্তু তিনি যখন ডক্টরেট করা শুরু করলেন, তখন কিছু একটা হলো। তিনি খ্রিস্টান ধর্মের শিক্ষার মধ্যে অনেক আপত্তিকর ব্যাপার আবিষ্কার করেন, ধর্ম নিয়ে নানা প্রশ্ন করা শুরু করলেন। এভাবে গবেষণার এক পর্যায়ে তিনি একদিন কু’রআন নিয়ে বসলেন দেখার জন্য যে, ইসলাম যে নিজেকে সত্য ধর্ম বলে দাবি করে, সেই দাবির ভিত্তি কী? তিনি কু’রআন খুলে এই আয়াতগুলো পড়ে বিরাট ধাক্কা খেলেন—

বল, তিনিই আল্লাহ্‌, অদ্বিতীয়! অমুখাপেক্ষী, সবকিছু তাঁর উপর নির্ভরশীল। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি। তাঁর সমকক্ষ আর কিছুই নেই! [সুরা ইখলাস]

তার পুরো জগত পাল্টে গেল। এরপর তিনি অনেক গবেষণা করে আবিষ্কার করলেন যে, কু’রআন হচ্ছে একমাত্র ধর্মীয় গ্রন্থ যেটাতে কোনো বিকৃতি হয়নি। তিনি তার ডক্টরাল থিসিস শেষ করার সময় ভাবলেন, “ওরা আমাকে ডক্টরেট ডিগ্রি দিক বা না দিক, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি সত্য খুঁজছিলাম এবং এটাই হচ্ছে প্রকৃত সত্য।” তারপর তিনি তার খ্রিস্টান প্রফেসর ভ্যান বার্গার-এর সাথে দেখা করতে গেলেন। তিনি দরজা বন্ধ করে তাকে জিজ্ঞেস করলেন:

“পৃথিবীতে যে এত ধর্ম আছে, এর মধ্যে কোনটা সত্য ধর্ম?”

প্রফেসর উত্তর দিলেন, “ইসলাম।”

“তাহলে আপনি মুসলিম হচ্ছেন না কেন?”

প্রফেসর বললেন, “প্রথমত, আমি আরবদের ঘৃণা করি। দ্বিতীয়ত, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না আমি কত আরেম, আয়েস, সম্মানের মধ্যে আছি? ইসলামের জন্য আমি এগুলো সব ছেড়ে দিব?”[১১৮]

আজকের যুগে যারা ইহুদী এবং খ্রিস্টান, যারা এই ধরনের বিকৃত ধর্মীয় গ্রন্থের অনুসারী, তাদেরকে আল্লাহ تعالى জান্নাতের নিশ্চয়তা দেননি। এই আয়াতের বাণী সঠিকভাবে বুঝতে হলে এই আয়াতকে ভাসা ভাসা ভাবে, প্রেক্ষাপট ছাড়া, কু’রআনের অন্যান্য আয়াতকে বাদ দিয়ে পড়লে হবে না। যারা তা করে, তারা ভুল সিদ্ধান্তে চলে যায়।

তবে আমাদেরকে তিনটি ব্যাপার অবশ্যই মনে রাখতে হবে, যেন আমরা ইহুদী, খ্রিস্টানদের সাথে এমন দুর্ব্যবহার না করি, এমন কটু সম্পর্ক না রাখি, যেটা ইসলাম সমর্থন করে না—

১) প্রথমত, এটা মানা যে: আজকে যে তাওরাত এবং ইঞ্জিল বাজারে পাওয়া যায়, সেগুলোর মধ্যে কিছুটা হলেও আল্লাহর تعالى  বাণী রয়েছে এবং আমাদেরকে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। আমেরিকার কোনো এক পাদ্রী তার দলবল নিয়ে প্রতি বছর কু’রআন পোড়ায় দেখে[১১৭], আমরাও তার মতো বাইবেল পুড়িয়ে দেখিয়ে দেব না যে, আমরাও মুসলিমের বাচ্চা। আমরা সকল ধর্মের বইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা রাখি। কিছু পথভ্রষ্ট খ্রিষ্টান কু’রআন পুড়িয়ে নিচে নামতে পারে, কিন্তু তাই বলে আমরা বাইবেল পুড়িয়ে তাদের মতো নিচে নামব না।

২) আমাদেরকে এটা সবসময় মনে রাখতে হবে যে, ইহুদি এবং খ্রিষ্টানরা যা-ই করছে সেটাই ভুল না। তাদের বিশ্বাস ভুল হতে পারে, তারা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস না করতে পারেন, বা মুহাম্মাদকে عليه السلام রাসূল হিসেবে বিশ্বাস না করতে পারেন। তবে তাদের পার্থিব সকল কাজই ভুল নয়। তাই আমরা তাদের প্রতি কোনো ঘৃণা দেখাব না। মনে করব না যে, তারা সব ভুল পথে আছে এবং তারা যা করে তার কোনো কিছুই ঠিক নয়। আমরা মুসলিম। আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান জাতি। পৃথিবীতে আরও ৫০০ কোটি মানুষ আছে যাদেরকে আল্লাহ تعالى ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার সৌভাগ্য দেননি। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, আমাদের খ্রিষ্টান এবং ইহুদি ভাই বোনেরা কিছু প্রতারকের পাল্লায় পড়ে ভুল রাস্তায় চলে গেছে। আমাদের দায়িত্ব তাদেরকে ডাক দিয়ে এনে, ভালো করে বুঝিয়ে শুনিয়ে সঠিক পথে নিয়ে আসা। ভালো করে বোঝানোর পরেও তারা যদি না আসে, তাহলে সেটা তাদের ব্যাপার। আমরা কোনোভাবেই তাদের উপর জবরদস্তি করতে পারব না। আল্লাহই তাদের বিচার করবেন।

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বলছেন, “এদের মধ্যে যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে …।” এখন প্রশ্ন হলো, আল্লাহর تعالى সংজ্ঞা কি?

খ্রিস্টানরা তাদের ‘আল্লাহর’ যে সংজ্ঞা দিয়েছে তা হলো: তিনি তিন রূপে থাকেন: পিতা ঈশ্বর, পবিত্র আত্মা এবং প্রভু যিশু — তিনি কি কু’রআনের বাণী অনুসারে আল্লাহ تعالى?

5_73

যে সব লোক বলে, “আল্লাহ হচ্ছেন তিনটি সত্তার তৃতীয়টি” — তারা অবিশ্বাস করে। প্রভু শুধুমাত্র একজনই। তারা যদি একথা বলতেই থাকে, তাহলে তাদের উপরে এক অত্যন্ত যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি আঘাত করবে। [আল-মায়িদাহ ৭৩]

আপনি যদি একজন খ্রিস্টান পাদ্রীকে জিজ্ঞেস করেন, “ভাই, আপনি আল্লাহতে বিশ্বাস করেন?” সে বলবে, “অবশ্যই, তিনি মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা, সর্বোচ্চ প্রভু। তিনি নিরাকার, সর্বশক্তিমান।” কিন্তু তারপরেই সে বলবে, “তার সন্তান যিশু আমাদের প্রভু। তিনি ক্রসে প্রাণ দিয়ে আমাদের সকল পাপ মোচন করে গেছেন। আমরা এখন নিষ্পাপ।”

5_72

যে সব লোক বলে যে, “আল্লাহ হচ্ছেন ঈসা মাসিহ, মরিয়মের পুত্র” — তারা আল্লাহতে অবিশ্বাস করেছে।… [আল-মায়িদাহ ৭২, আংশিক]

তাদের সেই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ تعالى নন। সেই সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করলে আল্লাহতে تعالى বিশ্বাস করা হয় না। আল্লাহর تعالى একমাত্র গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দেওয়া আছে কু’রআনে।

Bible-007 চিত্র: বাইবেল

একইভাবে, আপনি যদি একজন ইহুদীকে জিজ্ঞেস করেন, “ভাই, আপনি কি শেষ বিচার দিনে বিশ্বাস করেন?” সে বলবে, “অবশ্যই। শেষ বিচার দিনে ইহুদীরা সবাই স্বর্গে যাবে, নবী নূহ عليه السلام এর ৭টি আইন যারা মানবে, তারা স্বর্গ পেতে পারে। আর বাকি সবাই নরকে যাবে।”[১১৫] তাদের সেই শেষ দিন, এবং আমাদের শেষ দিনের ঘটনার মধ্যে বিরাট পার্থক্য আছে।

Torah_Scroll_from_123rf.175212641

চিত্রঃ তাওরাত

এই আয়াতে একটি বিশেষ গোত্র ‘সাবিইন’দের কথা বলা হয়েছে। এরা হলো আরবে ছড়িয়ে থাকা অন্যান্য গোত্র যারা ওই সব আরব মুশরিক ছিল না, যাদের মূর্তি পুজার কথা কু’রআনে বিস্তারিত বলা আছে।[১][২] তারা এক পরম সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করত, আবার একই সাথে নক্ষত্র পূজা করত। তাদের ধর্ম ইসলাম ছিল না। ধারণা করা হয় তারা নবী নুহ عليه السلام এর শিক্ষা ধরে রেখেছিল। তাদের সঠিক প্রকৃতি নিয়ে এখনো দ্বন্দ্ব রয়েছে।[৪][১০][১১] তবে এই সাবিইন, আর বাইবেলের সাবিনরা এক নয়।

তাহলে প্রশ্ন আসে, এই আয়াত যদি ইহুদী, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য একেশ্বরবাদীদের আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কারের নিশ্চয়তা না দেয়, তাহলে এই আয়াতের বাণীটা আসলে কী?

ইহুদীরা মনে করে: তারা বেহেশতে যাবেই, আল্লাহর সাথে তাদের এক বিশেষ চুক্তি আছে, কারণ তারা হচ্ছে আল্লাহর নির্ধারিত একমাত্র সঠিক ধর্মের বাহক।[৩][২][৮] তাদের এই ধারণাকে এই আয়াতে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই আয়াতটি বনী ইসরাইলকে নিয়ে বলা কয়েকটি ধারাবাহিক আয়াতের মধ্যে একটি। প্রেক্ষাপট অনুসারে এই আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে: ইহুদীদের নিজেদেরকে ভিআইপি দাবি করাটা যে হাস্যকর, সেটা তুলে ধরা।[৩][২][৮] এখানে আল্লাহ تعالى তাদের এই অহংকারের জবাবে যেন বলছেন, “তোমরা মনে করো তোমরা হচ্ছ ভিআইপি? যে-ই আমাকে বিশ্বাস করবে, সে ইহুদী হোক, খ্রিস্টান হোক আর সাবিইন হোক, তাকেই আমি পুরস্কার দিব। তাদের কোনো ভয় নেই, তারা কোনো দুখও করেবে না।”

এছাড়াও এই আয়াতটি রাসূল মুহাম্মাদের عليه السلام সময়ে যারা ইহুদী, খ্রিস্টান, সাবিইন ছিল, তাদেরকে নিশ্চয়তা দিচ্ছে যে, তারা এ পর্যন্ত যত ভালো কাজ করেছে আল্লাহ এবং শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রেখে, সেগুলো সব আল্লাহ গুনে রেখেছেন। সেগুলোর পুরস্কার তারা পাবে, কোনো দুশ্চিন্তা নেই — যদি এবার মুসলিম হন। একই সাথে অতীতে যারা চলে গেছেন, নিজ নিজ যুগে যারা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস উপস্থাপন করেছেন, তারাও পুরস্কার পাবেন, তাদেরও দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।[২][৪] এবার আল্লাহর تعالى কাছ থেকে নতুন বাণী এসেছে। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে এই নতুন বাণী গ্রহণ করে মুসলিম হয়ে যাওয়া।[৪]

এই আয়াতে তৃতীয় শর্ত হলো: “যারা ভালো কাজ করে।” প্রশ্ন হলো, কে নির্ধারণ করছে কোন কাজটা ভালো, আর কোন কাজটা খারাপ?

আপনি যদি কোনো অফিসের একজন কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করেন, “ভাই, আপনি কি একজন ভালো কর্মচারী?” সে বলবে, “অবশ্যই! আমার চেয়ে নিষ্ঠার সাথে এই অফিসে আর কে কাজ করে? এই বছর আমার প্রমোশন না হলে আর কার হবে ভাই?” কিন্তু আপনি যদি তার বস্‌কে জিজ্ঞেস করেন তার ব্যাপারে, সে বলবে, “আরে ওই ফাঁকিবাজটাকে আমি আগামী মাসেই বের করে দেব। যথেষ্ট সহ্য করেছি।”

কোন কাজটা ভালো আর কোনটা খারাপ — সেটার মানদণ্ড হচ্ছে কু’রআন। যে কু’রআনের সংজ্ঞা অনুসারে ভালো কাজ করবে, তার কোনো ভয় নেই। তার পুরস্কার আছে আল্লাহর কাছে। আর যে অন্য কোনো ধর্মীয় বই অনুসারে ভালো কাজ করবে, সেটা যদি কু’রআনের ভালো কাজের সংজ্ঞার বিরুদ্ধে যায়, তাহলে সেটা আর আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য ভালো কাজ নয়।

এখানে একটি প্রশ্ন আসে: এই আয়াত বলছে শুধু আল্লাহ এবং শেষ দিনে বিশ্বাস করলেই হবে। তাহলে কি আমাদের রাসূল মুহাম্মাদের عليه السلام উপর বিশ্বাস করার কোনো প্রয়োজন নেই?

উত্তর সোজা: “এই আয়াতটা আমাদেরকে কে দিয়েছে?” কু’রআন তো বই আকারে আকাশ থেকে পৃথিবীতে এসে পড়েনি। মানুষ কার মুখ থেকে এই আয়াত শুনেছে? যার মুখ থেকে শুনেছে, তাকে যদি তারা রাসূল না মানে, তাহলে তারা এই আয়াতকে আল্লাহর تعالى বাণী হিসেবে মানবে কেন? যদি কেউ এই আয়াতকে আল্লাহর تعالى বাণী হিসেবে মেনেই নেয়, তাহলে তো সে এই আয়াতের বাহককে আল্লাহর تعالى রাসূল হিসেবেই মেনে নিল! সে তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাসূল মুহাম্মাদের عليه السلام উপর বিশ্বাস করে ফেলল।

ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি বিশ্বাসের (আল্লাহ تعالى, ফিরিশতাগণ, কিতাবসমূহ, নবী-রাসূলবৃন্দ عليه السلام, শেষ দিন, তাকদীর) মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো: শেষ দিনের উপর বিশ্বাস। প্রাচীন আরব মুশরিকসহ বর্তমানকালের অন্য ধর্মের অনুসারীদের অনেকেই শেষ দিন ছাড়া বাকীগুলোর ব্যাপারে কোনো না কোনোভাবে বিশ্বাস করেন। কিন্তু শেষ দিনকে বিশ্বাস করেন না। শেষ দিন মৃত্যু দিয়ে শুরু। এরপর কবর, কবরের শাস্তি বা শান্তি, পুনরুত্থান, হাশর বা জমায়েত, হিসাব, ফলাফল প্রদান, সীরাত, জান্নাত ও জাহান্নাম — এসব বিশ্বাসই ইয়াওমুল আখির বা শেষ দিন শিরোনামে বুঝানো হয়। এই বিশ্বাসটি কঠিন হওয়ায়, আল্লাহ عليه السلام কু’রআনে সবচেয়ে বেশি বার এই বিশ্বাসের কথা বলেছেন, এর সপক্ষে যুক্তি, দলীল ইত্যাদি উপস্থাপন করেছেন, বিরোধীদের জবাব দিয়েছেন। এই আয়াতে ‘আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস’ — এভাবে উল্লেখ করার মাধ্যমে বুঝা যায়, যারা আল্লাহকে تعالى বিশ্বাস করেন, তবে শেষ দিনকে বিশ্বাস করেন না, তারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকেই تعالى বিশ্বাস করেন না।

আল-বাক্বারাহ’র এবং আয়াত আমাদেরকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে আমাদেরকে কী কী ব্যাপারে বিশ্বাস করতে হবে, যদি আমরা নিজেদেরকে ‘বিশ্বাসী’ বলে দাবি করতে চাই। এই আয়াতের উদ্দেশ্য নয় ‘বিশ্বাসী’ হবার শর্তগুলো পুনরায় নির্ধারণ করে দেওয়া বা শর্তগুলোতে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া।[৪][৩]

এর পরেও যদি কারো সন্দেহ থাকে, তাহলে তার জন্য এই আয়াতটি যথেষ্ট—

3_85

যদি কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কিছুকে ধর্ম হিসেবে নেওয়ার চেষ্টা করে, সেটা তার কাছ থেকে কোনোভাবেই গ্রহণ করা হবে না। সে আখিরাতে সর্বহারাদের একজন হয়ে যাবে। [আল-ইমরান ৩:৮৫]

সবশেষে, আল-বাক্বারাহ’র এই আয়াতে একটি অসাধারণ প্রজ্ঞার ব্যাপার রয়েছে। “যারা আল্লাহকে এবং শেষ দিনে বিশ্বাস করে” — কেউ যদি আল্লাহতে تعالى বিশ্বাস রাখে, তাহলে তাকে শেষ দিনে বিশ্বাস করতেই হবে।[১] আপনি যখন মানুষকে জিজ্ঞেস করতে দেখেন, “আল্লাহ কেন আমাকে এত কষ্টের জীবন দিল, যেখানে অন্যরা কত শান্তিতে আছে? আমি কি বলেছিলাম আমাকে এত কষ্ট দিতে? আল্লাহ আমাকে মেয়ে বানাল কেন, আমিতো মেয়ে হতে চাইনি? আল্লাহ আমাকে কালো কিন্তু অন্যদেরকে ফর্সা বানাল কেন, এটা তো ঠিক হলো না? আমি খাট কেন, লম্বা না কেন? আমার কপালে এরকম খারাপ স্বামী পড়ল কেন? আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, কোনোদিন ঘুষ খাইনি, কিন্তু তারপরেও আমার ক্যান্সার হলো কেন? সত্যিই যদি আল্লাহ থাকে তাহলে পৃথিবীতে এত দুঃখ-কষ্ট কেন? মুসলিমরা কেন আজকে সবচেয়ে দুর্বল, পশ্চাদপদ, নিপীড়িত জাতি?”

এই ধরনের প্রশ্ন যারা করে, তারা আসলে শেষ দিনে পুরোপুরি বিশ্বাস করে না। কেউ যদি শেষ দিনে গভীরভাবে বিশ্বাস করত, তাহলে তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্বাস করত: আল্লাহ تعالى হচ্ছেন পরম ন্যায় বিচারক এবং শেষ বিচার দিনে তিনি এইসবের বিচার করবেন।[১] প্রতিটি মানুষ তার শারিরিক, মানসিক দুর্বলতা এবং জীবনে নানা সমস্যা, ক্ষতির জন্য আল্লাহর কাছ থেকে যথাযথ প্রতিদান পাবে। যাদেরকে আল্লাহ تعالى ভালো রেখেছেন, অনেক দিয়েছেন, এবং যারা দুনিয়াতে অনেক অন্যায় করেছে: কিয়ামতের দিন তাদের হিসাব হবে ভয়ংকর। এভাবে কু’রআনে দেওয়া আল্লাহর تعالى সংজ্ঞা অনুসারে তাঁর ন্যায়বিচারে সঠিকভাবে, গভীরভাবে বিশ্বাস করলে একজন মুসলিম শেষ দিনে বিশ্বাস করবেই।

একইভাবে আয়াতের পরের অংশটুকু: “শেষ দিনে বিশ্বাস করে এবং ভালো কাজ করে” — কেউ যদি শেষ দিনে বিশ্বাস করে, তাহলে সে নিজের দুনিয়ার স্বার্থ ত্যাগ করে অন্যের জন্য ভালো কাজ করবে। যদি বিশ্বাস না করে, তাহলে আর ভালো কাজ করে লাভ কী? আমি যদি শেষ দিনে বিশ্বাস না করি, তাহলে আমি কেন খামোখা কোনো গরিবকে আমার কষ্টের টাকা দান করতে যাব, বা আমার মূল্যবান সময় খরচ করে এই আর্টিকেলগুলো লিখতে যাব, যেখানে আমি সারাদিন ঘরে বসে বিনোদন করতে পারতাম, আমার সব সম্পদ আমি নিজেই ভোগ করতে পারতাম? অন্যের উপকার করে হয়ত আমি কিছু আনন্দ পেতে পারি, কিন্তু শেষ বিচার দিন বলে যদি কিছু না থাকে, তাহলে নিজের সময় এবং সম্পদ এভাবে উড়িয়ে দেওয়াটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। বরং এই দুনিয়ার জীবনটাই যেহেতু শেষ, তাই যত পারি আনন্দ-ফুর্তি করে নিব।

কেউ যদি শেষ দিনে বিশ্বাস না করে, তার মানে সে বিশ্বাস করে না যে, তার ভালো কাজের কোনো প্রতিদান সে কখনো পাবে। যদি ভালো কাজের প্রতিদান কোনোদিন না-ই পাই, তাহলে ভালো কাজ করার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? একারণেই কেউ যদি ভালো কাজ না করে, সে আসলে শেষ বিচার দিনে বিশ্বাস করে না। আর যে শেষ বিচার দিনে বিশ্বাস করে না, সে আসলে আল্লাহকে تعالى বিশ্বাস করে না। সে হয়তো কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি অনুসারে মেনে নিতে পারে যে, এই মহাবিশ্বের একজন সৃষ্টিকর্তা আছে, কিন্তু তার বিশ্বাস এই পর্যন্তই। সেই সৃষ্টিকর্তা যে তার প্রভু, তিনি যে তার কাজের হিসাব নেবেন: তার অপকর্মের বিচার করবেন, তার ভালো কাজের পুরস্কার দেবেন — এটা সে বিশ্বাস করবে না।

আজকাল অনেক আধুনিক মুসলিমের মনে প্রশ্ন আসে, “আজকে পৃথিবীতে যে আরও ৫ বিলিয়ন অন্য ধর্মের মানুষ আছে, তাদের কী হবে? তারা কি সব জাহান্নামে যাবে? এটা কোনো কথা হলো? আল্লাহ تعالى কোটি কোটি মানুষ বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠাবে জাহান্নামে ভরার জন্য? এ কেমন পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার ধারণা হলো!” অনেকে এ নিয়ে এমন বিভ্রান্তিতে পড়ে যান যে, শেষ পর্যন্ত ইসলাম ধর্ম মানাই ছেড়ে দেন।

প্রথমত, যারা অন্যের জান্নাত-জাহান্নামে যাওয়ার নিয়ে এতটাই চিন্তিত, তারা কি নিশ্চিত যে, তারা জান্নাতে যাওয়ার জন্য আল্লাহর تعالى কাছ থেকে ভিআইপি পাস পেয়ে গেছে? পৃথিবীর অন্যান্য মানুষ জান্নাতে যাবে কিনা — এ নিয়ে চিন্তা করার সময় যদি তার থাকে, তাহলে কি সেই সময়টা নিজের জান্নাতে যাওয়ার সম্ভাবনা আরও বাড়াতে খরচ করাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়?

দ্বিতীয়ত, আল্লাহ تعالى কাকে জান্নাতে পাঠাবেন আর কাকে জাহান্নামে, সেটা পুরোপুরি তাঁর ইচ্ছা। তিনি কখনো তাঁর কোনো কাজের ব্যাপারে প্রশ্নের সম্মুখীন হন না।[সূরা আম্বিয়া: ২৩] কাজেই তাঁর ইচ্ছাকে কোনো প্রশ্ন না করে মেনে নেওয়াটাই একজন মু’মিনের প্রকৃত পরীক্ষা।

তৃতীয়ত, কু’রআনে কমপক্ষে তিনটি আয়াতে: আল-মূলক ৮-৯, আয-যুমার ৭১, ফাতির ৩৭ — আল্লাহ تعالى আমাদেরকে বলেছেন যে, যতক্ষণ না কাউকে তিনি তাঁর বাণী পৌঁছিয়ে দিয়ে সাবধান করে না দিচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে না।[১০] যদি কেউ আল্লাহর تعالى সত্য বাণী বোঝার পরেও অস্বীকার করে, তখন সে কাফির হয়ে যায়, এবং তখনই শুধুমাত্র সে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য হয়।[১৪৫]

কিন্তু কাউকে যদি ইসলামের বাণী পৌঁছে দেওয়া না হয়, ইসলাম কী — সেটা সে কখনো উপলব্ধি করে না থাকে, তাহলে তার উপর حجة (হুজ্জা) বা দলিল-যুক্তি উপস্থাপিত হয়নি। কিয়ামতের দিন আল্লাহ تعالى তাদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটা সম্পূর্ণ তাঁর ব্যাপার। তাদের ব্যাপারে ফুকাহাদের মধ্যে বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ বলেছেন, তারা সবাই কাফির এবং জাহান্নামেই যাবে। কেউ বলেছেন তারা আহলুল ফাতরাহ বা সে সময়কালীন মানুষের মতো, যাদের কাছে কোনো নবী-রাসূল আসেননি। তাদের ব্যাপারে হাদীসের বক্তব্য হলো, কিয়ামতের দিন তাদেরকে আল্লাহ পরীক্ষা করবেন। এবং সে পরীক্ষার ফল অনুসারে তাদের জন্য জান্নাত বা জাহান্নাম নির্ধারিত হবে। [১৪৬]

বাকি থাকল: আমরা তাদেরকে কাফির বলে দূরে সরিয়ে দেব, না বন্ধুর মতো কাছে টেনে দাওয়াহ দেব? সব সাহাবীই এক সময় কাফির ছিলেন, পরে মু’মিন হয়েছেন। রাসূলের عليه السلام ব্যবহার, দাওয়াহ তাঁদের মুগ্ধ করেছে। আমরা কখনোই দাওয়াহর সময় তাদেরকে ঘৃণাভরে সম্বোধন করব না। কাফির কোনো গালি বা ঘৃণা বোঝানোর শব্দ নয়। আমাদের কাজ হলো পৃথিবীর মানুষকে মহাসত্যের কথা জানানো, আল্লাহর পথে আহ্বান করা। এরপর তাদের অন্তর পরিবর্তন করা সম্পূর্ণ আল্লাহর تعالى ইচ্ছা।

আমাদেরকে এটা সবসময় মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ تعالى হচ্ছেন আর-রাহমান (পরম দয়ালু) এবং আর-রাহিম (নিরন্তর দয়ালু); তাঁর এই দুটি গুণের যে কত সুন্দর পটভূমি এবং ব্যাখ্যা রয়েছে, তা জানতে সূরা ফাতিহার উপর আলোচনা পড়ে দেখুন।

এই আয়াতে আল্লাহর تعالى শব্দ চয়ন খুব সুন্দর। তিনি বলেননি مَعَ رَبِّهِمْ বরং তিনি বলেছেন عِندَ رَبِّهِمْ। আরবিতে ‘কাছে রয়েছে’ বোঝানোর জন্য দুটো শব্দ রয়েছে مَعَ মা’আ এবং عِندَ ই’ন্দা। মা’আ ব্যবহার করা হয় বোঝানোর জন্য যে, কোনো কিছু অন্য কিছুর সাথে কোথাও রয়েছে।[১১] কিন্তু ই’ন্দা ব্যবহার করা হয় বোঝানোর জন্য যে, কোনো কিছু অন্য কিছুর সাথে যেখানে থাকা যথাযথ, ঠিক সেখানেই রয়েছে।[১১] যেমন, আমরা যদি বলি: ছাত্রটি প্রধান শিক্ষকের সাথে কোথাও রয়েছে — সেক্ষেত্রে মা’আ ব্যবহার করব, কারণ ছাত্রটি হয়ত প্রধান শিক্ষকের সাথে রেস্টুরেন্টে আড্ডা দিচ্ছে।[১১] কিন্তু যদি বলি: ছাত্রটি প্রধান শিক্ষকের সাথে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে রয়েছে — তাহলে ই’ন্দা, কারণ সেখানে প্রধান শিক্ষক তার যথাযথরূপে রয়েছেন। এই আয়াতে আল্লাহ تعالى সুন্দর করে বলেছেন: তাদের জন্য যে শুধু পুরস্কার রয়েছে তা-ই নয়, সেই পুরস্কার রয়েছে একদম যথাযথ জায়গায়: আল্লাহর تعالى নিজের কাছে।[১১] এছাড়াও এই আয়াতে তিনি বিশেষভাবে বলেছেন, “তাদের প্রভুর কাছে রয়েছে।” তিনি বলেননি “আল্লাহর কাছে রয়েছে” বা “তোমার প্রভুর কাছে রয়েছে।” তিনি বিশেষভাবে জোর দিয়ে বলেছেন যে, তিনি তাদেরও প্রভু।

এখন প্রশ্ন আসে, “যাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছে নি, যদি তাদের জাহান্নামে যাওয়াটা অনিশ্চিতই হয়, তাহলে আমাদের কষ্ট করে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার কী দরকার? কী দরকার এত সময়-সম্পদ খরচ করে তাদেরকে মুসলিম বানানোর চেষ্টা করার?”

মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার কাজে আমাদের সামান্যও ঢিলে দেওয়া যাবে না, কারণ মুসলিম হিসেবে আমাদের উপরে একটা গুরুদায়িত্ব আল্লাহ تعالى দিয়েছেন: তাঁর সত্য বাণীকে অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়া। সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করলে আমাদের ভবিষ্যৎ হবে ভয়ংকর। আমরা দুনিয়াতেও পর্যুদস্ত হবো, আখিরাতেও ভয়ংকর শাস্তি পাবো। এর জন্য আমাদেরকে সংঘবদ্ধ হয়ে যথাযথ ইসলামিক দাওয়াহ প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে, এবং তাদের মাধ্যমে ইসলামের বাণীকে সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে দিতে হবে।[১১] একইসাথে মনে-প্রাণে চেষ্টার পাশাপাশি সবসময় তাদের হেদায়াতের জন্য দোয়া করতে হবে। কারণ হেদায়াত দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ تعالى। আমাদের কাজ কেবল চেষ্টা করে যাওয়া।

সুত্র:

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

3 thoughts on “তাদের পুরস্কার তাদের প্রভুর কাছে রয়েছে — আল-বাক্বারাহ ৬২”

  1. apni Bible er poriborton & bikrito korer kotha bolsen…kintu kono reference dan nai….ami boltase..apni ai books ta poren…apner sob uttor paye jaben…
    [Deleted link]

    1. বাইবেলে যে বিকৃতি আছে, তার কথা খোদ কুরআনেই দেওয়া আছে। এর উপরে আর কোনো রেফারেন্সের দরকার নেই। এছাড়াও আপনি এই আর্টিকেলেই বহু উদাহরণ পাবেন বাইবেলে কী ধরনের বিকৃতি আছে। বাইবেলের ভার্সগুলো পড়লেই বোঝা যায়। এর জন্য কোনো জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণের দরকার হয় না। আপনাকে অনুরোধ করব এই আর্টিকেলটি আরেকবার পড়ে দেখার।
      আপনি যেই সাইটের লিংকটা দিলেন, তার বহু আর্টিকেল আমি পড়েছি। সেগুলোর বিরুদ্ধে বহু আর্টিকেলও আমি পড়েছি যেখানে তাদের দেওয়া রেফারেন্স, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনুবাদ, যুক্তির মারপ্যাঁচগুলো সুন্দর করে ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। আপনি ওদের কথার মারপ্যাঁচে পড়ে বিভ্রান্ত হবেন না। আমি নিজেই ওদের অনেক যুক্তি খণ্ডন করতে পারি শুধুমাত্র কু’রআন ব্যবহার করেই, যেখানে আমার ইসলামের জ্ঞান শিশুতুল্য। আপনি এই আর্টিকেলটা পড়তে পারেন এরকম একটি উদাহরণের জন্য:
      http://quranerkotha.com/baqarah-76-79/

  2. স্যার, সালাম নিবেন। আমার একটা প্রশ্ন ছিল।কালেমা বিষয়ে-
    উকিপিডিয়ায় যে কলমা আছে আর অন্য সাইটগুলোতে যা আছে তা ভিন্ন কেন?
    আমি কোনটা অনুসরন করবো?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *