যারা মানুষের চিন্তার ক্ষমতার বাইরে এমন সব ব্যাপারে বিশ্বাস করে – বাকারাহ ৩

এর আগের আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে বলেছেন যে, কুর’আন পড়ে যদি আমরা কোনো লাভ পেতে চাই, তাহলে আমাদের প্রথম যেটা দরকার সেটা হচ্ছে তাকওয়া: আল্লাহর تعالى প্রতি পূর্ণ সচেতনতা—এটা বিশ্বাস করা যে আমার দিকে সবসময় ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোন তাক করে রাখা হয়েছে। আমি যা বলছি, যা করছি, যেদিকে তাকাচ্ছি, যেসব বদ চিন্তা করছি, তার সবগুলোই রেকর্ড করা হচ্ছে এবং একদিন আল্লাহর تعالى সামনে আমার সব কুকর্ম রিপ্লে করে দেখানো হবে। যতক্ষণ আমাদের ভিতরে এই তাকওয়া না আসছে, ততক্ষণ কুর’আন পড়ে আমরা সঠিক পথনির্দেশ পাব না। আমরা এক লাইন কুর’আন পড়ব, আর দশটা প্রশ্ন করব: “এরকম কেন হলো? ওরকম কেন হলো না? না, এটা তো ঠিক হলো না? ”

এর পরের আয়াতে আল্লাহ‌ تعالى আমাদেরকে মুত্তাকী (আল্লাহর تعالى প্রতি পূর্ণ সচেতন) হওয়ার জন্য শর্তগুলো সম্পর্কে বলছেন—

2_3

যারা মানুষের চিন্তার ক্ষমতার বাইরে এমন বিষয়ে বিশ্বাস করে, নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং তাদেরকে আমি যা দিয়েছি তা থেকে খরচ করে;

يُؤْمِنُونَ অর্থ যারা পূর্ণ বিশ্বাস করে। ঈমান একটি বড় ব্যাপার। শুধু ধর্মীয় ব্যাপারে জ্ঞান থাকলেই ঈমান আনা যায় না। ঈমান অর্থ পূর্ণ নিশ্চয়তার সাথে বিশ্বাস করা।[৪] ইবলিসের বিশাল জ্ঞান ছিল। সে তার জ্ঞান, তার ইবাদাত দিয়ে এতই উপরে উঠে গিয়েছিল যে, সে স্বয়ং আল্লাহর تعالى সাথে সরাসরি কথা পর্যন্ত বলতে পারতো। কিন্তু এতো কিছুর পড়েও তার ঈমান ছিল না, সে আল্লাহর تعالى প্রতি পুরোপুরি অনুগত হতে পারেনি।

الغيب (আল-গাইব) অর্থ এমন কিছু যেটা মানুষের পক্ষে পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়, কোনো পদার্থ বিজ্ঞানের সুত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, অদেখা, অজানা, মানুষের চিন্তার ক্ষমতার বাইরে এমন সব ব্যাপার।[৪] এই অদেখা বিষয়  নিয়েই হচ্ছে আজকের যুগের ‘আধুনিক’ মানুষের যত সমস্যা। আধুনিক মানুষ কোনোভাবেই আত্মা, ফেরেশতা, জ্বিন, জান্নাত, জাহান্নাম, পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য —এই সব অদেখা জিনিসের উপর বিশ্বাস করতে পারছে না। তারা অনেকে হয়তো মুখে বলে যে, তারা মুসলমান। জান্নাত, জাহান্নাম, কিয়ামত —এইসব ব্যাপারে তারা ঠিকই বিশ্বাস করে, কিন্তু আসলে সেটা শুধুই মুখের কথা। মুসলিম নাম নিয়ে থাকতে হলে যেহেতু এইসব ব্যাপারে সবার সামনে উল্টোপাল্টা কিছু বলা যায় না, সেহেতু তাদেরকে সাধারণত এই সব অদেখা, অজানা জিনিসের বিরুদ্ধে মুখ খুলে কিছু বলতে দেখা যায় না। কিন্তু তাদের মনের ভেতরে মোটেও এই সবের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস নেই।

এর কারণ হলো, বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান এবং মিডিয়া মানুষের মধ্যে একটা ধারণা বদ্ধমূল করে দিয়েছে যে, যেটা মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করা যায়, কোনো যন্ত্র দিয়ে পরিমাপ করা যায়, শুধু সেটাই বাস্তবতা, বাকি সব অবাস্তব। যেহেতু আত্মাকে কোনো যন্ত্র দিয়ে সনাক্ত করা যায় না, তাই আত্মা বলে কিছু নেই। যেহেতু ফেরেশতাদেরকে কোনো রাডার দিয়ে ধরা যায় না, ফেরেশতা বলে কিছু নেই, এগুলো সব ‘গাঁজাখুরি’ কথা বার্তা। এই মহাবিশ্ব একদিন পুরোটা ধ্বংস হয়ে যাবে, মানুষের শরীরের প্রতিটা অণু পরমাণু নষ্ট হয়ে যাবে, কিন্তু তারপর ঠিকই সব মানুষ আবার একদম আগের অবস্থায় ফেরত যাবে এবং তাদেরকে তাদের পুরো জীবনটা রিপ্লে করে দেখানো হবে —এই সব ‘অবাস্তব’ কথাবার্তা তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। মানুষের প্রত্যেকটা চিন্তা, কথা, কাজ কোনো অদৃশ্য পদ্ধতিতে রেকর্ড হচ্ছে, যেটা একদিন তাদেরকে দেখানো হবে তাদের বিচার করার জন্য, প্রযুক্তিগত দিক থেকে এই অসম্ভব ব্যাপারটিতে তারা কোনো ভাবেই মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে পারে না। তাদের মনের ভেতরে সবসময় একটা প্রশ্ন থেকে যায় যে, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি দিয়ে যেটা কোনোভাবেই সম্ভব না, সেটা নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তার পক্ষেও অসম্ভব।

Cosmos-Wallpaper-HD

অথচ মানুষ ডার্ক ম্যাটার দেখেনি বা কোনো ধরণের যন্ত্রে তাদের উপস্থিতি সনাক্ত করতে পারেনি, কিন্তু ডার্ক ম্যাটার নিয়ে তার ‘তাকওয়ার’ কোনো অভাব নেই। স্থূল বিবর্তনের (macroevolution) পক্ষে কোনোই প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, কিন্তু বিজ্ঞানিদের বিবর্তন নিয়ে এতই দৃঢ় ঈমান যে, ডারউইনের বিবর্তনবাদ ‘থিওরি’কে তারা  স্কুলের কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছে। কোটি কোটি ছেলে মেয়ে স্কুলে শিখছে যে, ডারউইনের বিবর্তনবাদ একটি ফ্যাক্ট — প্রতিষ্ঠিত সত্য, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পৃথিবীতে হাজার হাজার শিক্ষিত উচ্চ ডিগ্রিধারী বিজ্ঞানীদের ‘গাইবে’ এতই বিশ্বাস যে, তারা প্রতি বছর ৭ মিলিয়ন ডলার খরচ করে মহাবিশ্বে কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর রেডিও সিগন্যাল খুঁজে পাওয়া যায় কি না, তার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই সব বিজ্ঞানীরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে মহাবিশ্বে এলিয়েন আছেই, থাকতে বাধ্য। অথচ গত পঞ্চাশ বছরে তারা কোনো ধরণের ইংগিত খুঁজে পায়নি।[১০১] অনেকে তাদের পুরো জীবন ব্যায় করেছে তাদের এইসব ‘গাইবের’ উপর বিশ্বাস রেখে। তারা এগুলো সবই পারে, কিন্তু মহান আল্লাহর تعالى অসীম ক্ষমতার উপর, তাঁর অদৃশ্য সৃষ্টির উপর, তাঁর বিচার দিনের উপর কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারে না। ডাবল স্ট্যান্ডার্ড কাকে বলে!

আজকাল মিডিয়াগুলোতে ব্যাপকভাবে নতুন এক ‘গাইবের’ প্রচারণা শুরু হয়েছে: মাল্টিভার্স থিওরি। বিজ্ঞানীরা দাবি করছে এই মহাবিশ্বের কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই। আমাদের মহাবিশ্বটি এক মহা-মহা-মহাবিশ্বের বা মাল্টিভার্স-এর মধ্যে থাকা ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন মহাবিশ্বের মধ্যে একটি। বিজ্ঞানীরা কোনো ভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারছে না: কীভাবে আমাদের এই মহাবিশ্বটি এত নিখুঁত ভাবে, এত পরিকল্পিত ভাবে প্রাণের সৃষ্টির জন্য অত্যন্ত সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করে তৈরি করা হয়েছে। ইলেকট্রনের ভর, পরমাণুর মধ্যে ইলেক্ট্রো উইক ফোর্স,  ম্যাটার এবং এন্টি ম্যাটার-এর পরিমাণের মধ্যে থাকা অচিন্তনীয় সূক্ষ্ম পার্থক্য, পদার্থ বিজ্ঞানের ধ্রুবকগুলোর মানের মধ্যে কল্পনাতীত সূক্ষ্ম ভারসাম্য —এরকম শত শত ভারসাম্য কীভাবে কাকতালীয় ভাবে মিলে গেলো, কীভাবে এগুলো সব অত্যন্ত নিখুঁতভাবে নির্ধারণ করা হলো, যাতে করে নক্ষত্র, গ্রহ, পানি, ভারী মৌলিক পদার্থ সৃষ্টি হয়ে একদিন প্রাণের সৃষ্টি হয়, যেই প্রাণ বিশেষভাবে বিবর্তিত হয়ে একদিন মানুষের মতো বুদ্ধিমান প্রাণীর জন্য প্রকৃতিকে উপযুক্ত করে দেবে —এর পক্ষে তারা কোনোই ব্যাখ্যা দিতে পারছে না।

যেমন: অভিকর্ষ বল যদি ১ বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ বেশি বা কম হতো, তাহলে কোনো গ্রহ সৃষ্টি হতো না, প্রাণের সৃষ্টির কোনো সম্ভাবনাই থাকতো না। বিগ ব্যাংগের সময় যে শক্তির প্রয়োজন ছিল সেটা যদি ১০৬০ ভাগের এক ভাগ এদিক ওদিক হতো, তাহলে অভিকর্ষ বলের সাথে অসামঞ্জস্য এত বেশি হতো যে, এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়ে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারতো না। ১০৬০ হচ্ছে  ১ এর পরে ৬০টি শূন্য বসালে যে বিশাল সংখ্যা হয়, সেটি। বিগ ব্যাংগের মুহূর্তে প্ল্যাঙ্ক সময়ের পর মোট পদার্থের যে ঘনত্ব ছিল, সেটা যদি ১০৫০ ভাগের এক ভাগও এদিক ওদিক হতো, তাহলে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হতো না, যাতে আজকের মতো নক্ষত্র, গ্রহ এবং প্রাণ সৃষ্টি হতো।[১০২]

looking-for-life-in-the-multiverse_1

এত গুলো সূক্ষ্ম ভারসাম্য এক সাথে মিলে যাওয়া যে, কোনো ভাবেই গাণিতিক সম্ভাবনার মধ্যে পড়ে না, এটা তারা বুঝে গেছে। তারা এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এক নতুন থিওরি নিয়ে এসেছে —আমাদের মহাবিশ্ব আসলে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন মহাবিশ্বের মধ্যে একটি। একেক মহাবিশ্বে পদার্থ বিজ্ঞানের ধ্রুবকগুলোর একেক মান রয়েছে। কিছু মহাবিশ্ব বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না, কারণ সেই মহাবিশ্বে পদার্থ বিজ্ঞানের ধ্রুবকগুলোর মানগুলো এমন হয় যে, তা মহাবিশ্ব ধ্বংস করে দেয়। আর কিছু মহাবিশ্বে পদার্থ বিজ্ঞানের ধ্রুবকগুলোর মান এমন হয় যে, সেখানে কোনোদিন সূর্যের মতো একটি তারা এবং পৃথিবীর মতো একটি গ্রহ তৈরি হতে পারে না। যার ফলে সেই সব মহাবিশ্বে কোনো প্রাণ সৃষ্টি হয় না। পদার্থ বিজ্ঞানের সুত্রগুলোর যতগুলো সম্ভাব্য সম্ভাবনা হওয়া সম্ভব, সেটা যতই কল্পনাতীত, অবাস্তব একটা ব্যাপার হোক না কেন, যা কিছু হওয়া সম্ভব তার সবকিছুই সেই মাল্টিভারসের ল্যান্ডস্কেপে কোথাও না কোথাও হয়েছে এবং হয়ে যাচ্ছে। আমরা মানুষেরা, সেই অসীম সংখ্যক সম্ভাবনাগুলোর একটি, যেখানে পদার্থ বিজ্ঞানের হাজার হাজার নিয়ম কাকতালীয়ভাবে, কল্পনাতীত সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করে কোনোভাবে মিলে গেছে এবং যার কারণে আজকে আমরা এই মহাবিশ্বে দাঁড়িয়ে নিজেদেরকে উপলব্ধি করতে পারছি।[১০৩]

তাদের দাবিটা হচ্ছে এরকম— ধরুন, কোনো এক সমুদ্রের তীরে বালুতে আপনি একটি মোবাইল ফোন পড়ে থাকতে দেখে তাদেরকে জিগ্যেস করলেন, এই মোবাইল ফোনটা নিশ্চয়ই কোনো বুদ্ধিমান সত্ত্বা বানিয়েছে। তারা বলবে, “না, কোটি কোটি বছর ধরে সমুদ্রের পানি বালুতে আছড়িয়ে পড়তে পড়তে এবং ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাতের ফলে বালুতে রায়ায়নিক বিক্রিয়া হয়ে একসময় এই মোবাইল ফোনটি তৈরি হয়েছে। এটি কোনো বুদ্ধিমান সত্ত্বা বানায় নি, এটি পদার্থ বিজ্ঞানের সুত্রগুলোর অসীম সব সম্ভাবনাগুলোর একটি। এরকম কোটি কোটি সমুদ্রের তীর আছে যেগুলোর একটিতে হয়তো শুধুই একটা প্লাস্টিকের বাক্স তৈরি হয়েছে, পুরো মোবাইল ফোন তৈরি হতে পারেনি। কিছু তীর আছে যেখানে হয়তো একটা ডিসপ্লে পর্যন্ত তৈরি হয়েছে, কিন্তু কোনো বাটন তৈরি হয়নি। আপনি, আমি আসলে সেই অসীম সব সমুদ্রের তীরগুলোর বিশেষ একটিতে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে পদার্থ বিজ্ঞানের সব সম্ভাবনা কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে, যে কারণে এই তীরে একটি সম্পূর্ণ মোবাইল ফোন সৃষ্টি হয়েছে।” এই হচ্ছে মাল্টিভার্স থিওরি!

মাল্টিভার্স থিওরির পক্ষে বিন্দুমাত্র প্রমাণ নেই। কিন্তু এনিয়ে শত শত বই, ডিসকভারি চ্যানেলে শত শত প্রোগ্রাম, হাজার হাজার লেকচার এমন ভাবে দেওয়া হচ্ছে যে, এটা বিগ ব্যাং এর মতই একটা ফ্যাক্ট। বিজ্ঞানীদের এক বিশেষ দল, যাদের মধ্যে সবাই নাস্তিক, এবং শুধু নাস্তিকই নয়, এদেরকে বিশেষ ভাবে Militant Atheist বলা হয়, এরা উঠে পড়ে লেগেছে ডারউইনের বিবর্তনবাদের মতো মাল্টিভার্স থিওরিকেও মানুষের মধ্যে গলার জোরে ফ্যাক্ট বলে চালিয়ে দেওয়ার। কারণ একমাত্র মাল্টিভার্স থিওরিই পারে “মহাবিশ্বের কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই” সেটার পক্ষে কোনো ধরণের ‘বিশ্বাসযোগ্য’ চমকপ্রদ ব্যাখ্যা দিতে, যেটা পড়ে সাধারণ মানুষ, যাদের কসমোলজি নিয়ে ভালো জ্ঞান নেই, অবাক হয়ে ভাবে – ‘আরে! এতো দেখি চমৎকার এক ব্যাখ্যা! মহাবিশ্বের দেখি সত্যিই কোনো সৃষ্টিকর্তার দরকার নেই!’

একারণেই আল্লাহ‌ تعالى আমাদেরকে মু’মিন হবার জন্য প্রথম শর্ত দিয়েছেন: “যারা মানুষের চিন্তার ক্ষমতার বাইরে এমন সব বিষয়ে বিশ্বাস করে।” আমাদেরকে মানতে হবে যে, আমরা কোনোদিন প্রমাণ করতে পারবো না কীভাবে, কী কারণে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। আমরা কোনোদিন কোনো রেডিও এন্টেনা দিয়ে জান্নাত, জাহান্নাম খুঁজে পাবো না। আমরা কোনোদিন এক্সরে করে ফেরেশতাদেরকে দেখতে পারবো না। আমরা কোনোদিন পদার্থ বিজ্ঞানের কোনো সুত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারবো না: কিভাবে আমরা মরে, ধ্বংস হয়ে, মহাবিশ্বে ছড়িয়ে যাওয়া আমাদের দেহের অণু পরমাণুগুলো থেকে একদিন আমাদেরকে আবার একই অবস্থায় ফেরত আনা হবে। আমাদেরকে এই সব কিছু বিশ্বাস করতে হবে, কোনোই বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ছাড়া, শুধুই কু’রআনের প্রমানের উপর ভিত্তি করে, এই শর্তে যে কু’রআন সন্দেহাতীত ভাবে আল্লাহর تعالى বাণী। যদি কোনো প্রমাণ না থাকার পরেও বিবর্তনবাদ, ডার্ক ম্যাটার, ডার্ক এনার্জি, স্ট্রিং থিওরিতে ঠিকই বিশ্বাস করতে পারি, তাহলে কু’রআনের বাণীর উপর বিশ্বাস না করার পেছনে কোনো যুক্তি থাকতে পারে না, যেখানে কি না কু’রআন যে মানুষের পক্ষে তৈরি করা সম্ভব না, এর পক্ষে শত শত প্রমাণ আছে। একারণে আমরা যদি অদেখায় বিশ্বাস করতে না পারি, তাহলে আমরা কোনোদিন মু’মিন হতে পারবো না।

এরপরে আল্লাহ‌ تعالى বলেছেন—

যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে

মু’মিন হবার দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে নামাজ প্রতিষ্ঠা করা। দেখুন আল্লাহ‌ تعالى কিন্তু এখানে বলেননি, “যারা নামাজ পড়ে।” তিনি বলেছেন, “যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে।” يُقِيمُونَ এসেছে قوم (কু’মু) থেকে যার অর্থ দাঁড়ানো, প্রতিষ্ঠা করা। প্রাচীন আরবরা যখন কোনো শক্ত পিলার স্থাপন করতো, বা শক্ত দেওয়াল তৈরি করতো, তার জন্য তারা কু’মু শব্দটি ব্যবহার করতো। এখানে কু’মু ব্যবহার করে আল্লাহ‌ تعالى আমাদেরকে বলছেন যে, আমাদের প্রতিদিনের রুটিনের মধ্যে পাঁচটি শক্ত পিলার দাঁড় করাতে হবে। সেই পিলারগুলো কোনোভাবেই নড়ানো যাবে না। আমাদের পড়ালেখা, কাজ, খাওয়া, বিনোদন, ঘুম সবকিছু এই পিলারগুলোর আশেপাশে দিয়ে যাবে। আমাদের দৈনন্দিন রুটিনে নামাজ তার জায়গায় ঠিক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে, কোনোভাবেই তাদেরকে নড়ানো যাবে না।[১]

একজন মু’মিন কখনও মেহমান আসলে ভাবে না, “আহ্‌, মাগরিবের সময় দেখি পার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন মেহমান রেখে উঠে গেলে তারা আবার কী বলবে। থাক, একবারে ঈশার সাথে পড়ে নিবো।” একজন মু’মিন কাজ করতে করতে কখনও ভাবে না, “আহ্‌হা, সূর্য দেখি ডুবে যাচ্ছে। আর মাত্র দশটা মিনিট দরকার। কাজটা শেষ করে আসরের নামায পড়ে নিবো। এখন কাজ ছেড়ে উঠে গেলে সব তালগোল পাকিয়ে যাবে। নামাজ পড়ে এসে ভুলে যাবো কী করছিলাম। আল্লাহ‌ تعالى মাফ করেন।”

একজন মু’মিন ফজরের নামাযের জন্য রাতে উঠবে কিনা এনিয়ে চিন্তা করার সময় কখনও ভাবে না, “আমাকে সারাদিন অনেক ব্রেইনের কাজ করতে হয়। আমার রাতে টানা ৮ ঘণ্টা ঘুমানো দরকার। রাতে ফজরের নামাযের জন্য উঠলে ঠিক মতো ঘুম হয় না। সারাদিন ক্লান্ত, বিরক্ত লাগে। তারচেয়ে একবারে সকালে উঠে নাস্তার আগে ফজরের নামাজ পড়ে নিলেই হবে।”

একজন মু’মিন দরকার হলে ঘড়িতে পাঁচটা এলার্ম দেয়। রাতে ফজরের নামাযে উঠার জন্য একটা নয়, তিনটা ঘড়িতে ৫ মিনিট পর পর এলার্ম দিয়ে রাখে। তার ব্যস্ত ক্যালেন্ডারে প্রতিদিন কমপক্ষে চারটা এপয়েন্টমেন্ট দেওয়া থাকে, যেগুলোর টাইটেল হয়, “Meeting with the Lord of the Worlds”

সালাহ্‌ (নামাজ) শব্দটির একটি অর্থ হলো ‘সংযোগ।’ সালাতের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর تعالى সাথে আমাদের সম্পর্ক স্থাপন করি, সবসময় তাঁকে মনে রাখি। আল্লাহ‌ تعالى আমাদেরকে দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ একারণেই দিয়েছেন যেন আমরা কাজের চাপে পড়ে, হিন্দি সিরিয়াল এবং খেলা দেখতে দেখতে বা রাতভর ভিডিও গেম খেলতে খেলতে তাঁকে ভুলে না যাই। কারণ তাঁকে ভুলে যাওয়াটাই হচ্ছে আমাদের নষ্ট হয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপ। যখনি আমরা আল্লাহ‌কে تعالى একটু একটু করে ভুলে যাওয়া শুরু করি, তখনি আমরা আসতে আসতে কোনো অনুশোচনা অনুভব না করে খারাপ কাজ করা শুরু করি। এখান থেকেই শুরু হয় আমাদের পতন।

এরপরে আল্লাহ‌ تعالى আমাদেরকে বলছেন—

তাদেরকে আমি যা দিয়েছি তা থেকে খরচ করে

প্রথমত এখানে ‘আমি’ অনুবাদ করেছি। প্রচলিত অনুবাদগুলোতে ‘আমরা’ অনুবাদ করা হয়। আল্লাহ কু’রআনে নিজেকে ‘আমি’ এবং ‘আমরা’ দুভাবে সম্বোধন করেছেন। ‘আমরা’ ব্যবহার করলে অনেকে ভুলে মনে করেন একাধিক আল্লাহ রয়েছে বা আল্লাহর সাথে আরও কাউকে সাথে নিয়ে সম্বোধন করা হয়েছে। ব্যপারটি তা নয়। ‘আমরা’ হচ্ছে আরবিতে রাজকীয়-আমি, যেমন হিন্দিতে “হাম” হচ্ছে “ম্যায়” এর রাজকীয় রূপ। হিন্দিতে ‘হাম’ বললেও ‘আমি’ বোঝানো হয়। তাই সন্দেহ বা ভুল ধারণা এড়ানোর জন্য ‘আমরা’র বদলে ‘আমি’ ব্যবহার করা হয়েছে।

এই আয়াতে আল্লাহ‌ تعالى আমাদেরকে একটা বিরাট উপলব্ধি করার মতো বিষয় দিয়েছেন, যেটা আমরা সবসময় ভুলে যাই। আমাদের যা কিছু আছে: বাড়ি, গাড়ি, টাকাপয়সা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, শারীরিক ক্ষমতা, মানসিক ক্ষমতা, প্রতিভা —এই সব কিছু হচ্ছে রিজক رزق এবং এগুলো সবই আল্লাহর تعالى দেওয়া।[১] রিজক অর্থ যে সমস্ত জিনিস ধরা ছোঁয়া যায়, যেমন টাকাপয়সা, বাড়ি, গাড়ি, জমি, সন্তান এবং একই সাথে যে সমস্ত জিনিস ধরা ছোঁয়া যায় না, যেমন জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, মেধা।[২] এগুলোর কোনটাই আমরা শুধুই নিজেদের যোগ্যতায় অর্জন করিনি। আল্লাহ‌ تعالى আমাদেরকে এই সবকিছু দিয়েছেন।

এখন আপনার মনে হতে পারে, “কোথায়? আমি নিজে চাকরি করে, দিনের পর দিন গাধার মতো খেঁটে বাড়ি, গাড়ি করেছি। আমি যদি দিনরাত কাজ না করতাম, তাহলে কি এগুলো এমনি এমনি হয়ে যেত?”

ভুল ধারণা। আপনার থেকে অনেক বেশি যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ পৃথিবীতে আছে, যারা আপনার মতই দিনে ১৮ ঘণ্টা কাজ করেছে, কিন্তু তারা বাড়ি, গাড়ি করতে পারেনি। আল্লাহ‌ تعالى কোনো বিশেষ কারণে আপনাকে বাড়ি, গাড়ি করার অনুমতি দিয়েছেন দেখেই আপনি এসব করতে পেরেছেন। তিনি যদি অনুমতি না দিতেন, তিনি যদি মহাবিশ্বের ঘটনাগুলোকে আপনার সুবিধামত না সাজাতেন, আপনি কিছুই করতে পারতেন না। সবকিছুরই cause-effect রয়েছে। আল্লাহর تعالى ইচ্ছা primary cause, আপনার ইচ্ছা হচ্ছে secondary cause. আপনার জীবনে যা কিছু হয়েছে, যত effect, তার primary cause হচ্ছেন আল্লাহ‌, secondary cause আপনি।

একারণেই আল্লাহ‌ تعالى আমাদেরকে বলছেন যে, তিনি আমাদেরকে যা দিয়েছেন, সেটা থেকে যেন আমরা খরচ করি। আল্লাহর تعالى রাস্তায় খরচ করতে গিয়ে যেন আমরা মনে না করি যে, “এগুলো সব আমার, দিবো না কাউকে! My Precious!” বরং এগুলো সবই আল্লাহর تعالى । তিনি আপনাকে কিছুদিন ব্যবহার করার জন্য দিয়েছেন। একদিন তিনি সবকিছু নিয়ে যাবেন। তখন আপনার পরিবারের সদস্যরা আপনাকে উলঙ্গ করে, একটা সস্তা সাদা কাপড়ে পেঁচিয়ে, নাকে তুলা গুঁজে মাটির গর্তে পুঁতে দিয়ে আসবে।

Kabr

আমাদের অনেকেরই দান করতে গেলে অনেক কষ্ট হয়। কোনো এতিম খানায় দান করলে, বা কোনো গরিব আত্মীয়কে হাজার খানেক টাকা দিলে, মনে হয় কেউ যেন বুকের একটা অংশ ছিঁড়ে নিয়ে গেল। আপনি ব্যাপারটাকে এভাবে চিন্তা করতে পারেন: দুনিয়াতে আপনার একটি একাউন্ট রয়েছে, আখিরাতে আপনার আরেকটি একাউন্ট রয়েছে। আপনি আল্লাহর تعالى রাস্তায় যখন খরচ করছেন, আপনি আসলে আপনার দুনিয়ার একাউন্ট থেকে আখিরাতের একাউন্টে ট্রান্সফার করছেন মাত্র। এর বেশি কিছু না। আপনার সম্পত্তি কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে না। আপনারই থাকছে। একদিন আপনি দেখবেন আপনার ওই একাউন্টে কত জমেছে এবং আল্লাহ‌ تعالى আপনাকে কত পার্সেন্ট বেশি মুনাফা দিয়েছেন। সেদিন শুধুই আপনি আফসোস করবেন, “হায়, আর একটু যদি এই একাউন্টে ট্রান্সফার করতাম, তাহলে আজকে এই ভয়ংকর আগুন থেকে বেঁচে যেতাম!”

এখানে লক্ষ্য করার মতো একটি ব্যাপার হল যে, আল্লাহ‌ تعالى বলছেন: মু’মিন হবার প্রথম তিনটি শর্ত হল গাইবে বিশ্বাস, নামাজ এবং তার পরেই আল্লাহর تعالى দেওয়া রিজিক থেকে দান করা। দান করার সাথে ঈমানের কি সম্পর্ক? কীভাবে দান করার মাধ্যমে একজন মানুষের ঈমানের পরীক্ষা হয়?

আপনি দেখবেন কিছু মানুষ আছে যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে, রমযানে ত্রিশটা রোযা রাখে, কিন্তু গত এক বছরেও কোনোদিন কোনো এতিম খানায় একটা টাকাও দিতে পারেনি। ড্রাইভার, কাজের বুয়া, বাড়ির দারোয়ান তার কাছে বার বার টাকা চাইতে এসে, “দিবো, দিবো, রমযান আসুক” —এই শুনে খালি হাতে ফিরে গেছে। গরিব আত্মীয়স্বজন সাহায্য চাইতে এসে, কয়েকদিন অপেক্ষা করে, শুধু কয়েক বেলা ভাত খেয়ে ফিরে গেছে, কিন্তু কোনো টাকা নিয়ে যেতে পারেনি। মসজিদে বহুবার সে বিভিন্ন উদ্যোগের জন্য টাকার আবেদন শুনেছে, কিন্তু কোনোদিন পকেটে হাত দিয়ে একটা একশ টাকার নোট বের করে দিতে পারেনি।

এই ধরনের মানুষদের আল্লাহর تعالى সাথে সম্পর্ক কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান পর্যন্তই। এরা এখনো মুসল্লি থেকে উপরে উঠে মু’মিন হতে পারেনি। আল্লাহর تعالى প্রতি তাদের বিশ্বাস এখনও এতটা মজবুত হয়নি যে, তারা আল্লাহ‌কে تعالى বিশ্বাস করে হাজার খানেক টাকা নির্দ্বিধায় একটা এতিম খানায় দিয়ে দিতে পারে। কিয়ামতের দিনের প্রতিদান নিয়ে এখনও তাদের সন্দেহ যথেষ্ট দূর করতে পারেনি যে, তারা নির্দ্বিধায় গরিব আত্মীয়দের চিকিৎসায় এক লাখ টাকা লাগলেও, সেটা হাসিমুখে দিয়ে দিতে পারে। তারা যদি সত্যিই মু’মিন হতো, তাহলে তারা প্রতিদিন সকালে উঠে চিন্তা করতো, “আজকে আমি কাকে আল্লাহর تعالى সম্পদ ফিরিয়ে দিতে পারি? আল্লাহর تعالى কোন মেহমানকে আজকে আমি খাওয়াতে পারি? কার কাছে গিয়ে আজকে আমি জান্নাতের জন্য সিকিউরিটি ডিপোজিট করতে পারি?”

সুত্র:

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

11 thoughts on “যারা মানুষের চিন্তার ক্ষমতার বাইরে এমন সব ব্যাপারে বিশ্বাস করে – বাকারাহ ৩”

  1. ভাই মাশাল্লাহ, লিখাটি খুবই ভাল হয়েছে। অনেক কিছু জানা গেছে এইখান থেকে। আশা করি যারা পড়বে কিছুটা হলেও উপকৃত হবে। কিছুটা আমাদের ঈমানের লেভেলের রূপরেখা বুঝতে সহায়তা করবে এই লিখাটা। আল্লাহ আপনাকে দুনিয়া ও আখিরাতে এর উত্তম প্রতিদান দিন।আমিন।

  2. bhaia ….kichu kichu kotha ebhabe amader janate thaken …Allah apnake aro tawfiq dan korun …ameen …

  3. vaia, amader nijeder jibone salat protistha korar pasapasi amader charpasher poribeshe, society te salat protisthar bapartao ki ei ayat thekei ase?

    1. The phrase ‘aqimus salat’ means establishing salat. It does not just mean perform salat, but means establishing salat. In order to establish salat, you need to do it collaboratively, within family, within community, within society. It is very difficult to stick to the path of Islam alone.

  4. আল্লাহ্‌ আপনার মাধ্যমে আমাদেরকে অনেক অনেক জানা ও বুঝার রাস্তা খুলে দিয়েছেন। যাযাকাল্লাহু খাইর।

  5. মাশাল্লাহ্ প্রিয় ভাই… অনেক অনেক সুন্দর জ্ঞানগর্ভ ব্যাখ্যা ?

  6. সুবহানাল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহু আকবার।৷ ৷৷ এত সুন্দর জ্ঞান গর্ভ আলচনা কিভাবে সম্ভব অবাক করা বিষয়, মাশাআল্লাহ। ৷

    নিয়মিত চাই ভাইয়া।।

Leave a Reply to Md saiful islam Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *