যদি পারো তো এর মতো একটা সূরা বানাও – বাকারাহ ২১-২৪

2-21

মানব জাতি! তোমাদের সেই প্রভুর প্রতি পূর্ণ দাসত্ব ও উপাসনা করো, যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের আগে যারা ছিল তাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে করে তোমরা তাঁর প্রতি সবসময় পূর্ণ সচেতন থাকতে পারো। [বাকারাহ ২১]

বেশিরভাগ অনুবাদে উ’বুদুকে ٱعْبُدُوا۟ ‘ই’বাদত করো’ বা ‘উপাসনা করো’ অনুবাদ করা হয়, যা মোটেও উ’বুদুর প্রকৃত অর্থকে প্রকাশ করে না। উ’বুদু এসেছে আবাদা  عبد থেকে যার অর্থ দাসত্ব করা। আমরা শুধুই আল্লাহর تعالى উপাসনা করি না, আমরা আল্লাহর تعالى দাসত্ব করি।[১] এমনটি নয় যে, আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়লাম, রোযা রাখলাম, যাকাত দিলাম—ব্যাস, আল্লাহর تعالى সাথে আমাদের সম্পর্ক শেষ, এরপর আমি যা খুশি তাই করতে পারি। বরং আমরা সবসময় আল্লাহর দাস। ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত প্রতিটা কাজে, প্রতিটা কথায় আমাদের মনে রাখতে হবে—আমরা আল্লাহর تعالى দাস এবং আমরা যে কাজটা করছি, যে কথাগুলো বলছি, তাতে আমাদের প্রভু সম্মতি দেবেন কি না এবং প্রভুর কাছে আমি জবাব দিতে পারব কি না।

এরকম মানুষ দেখেছেন কি যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে গিয়ে পড়ে, কিন্তু ব্যাংকের একাউন্ট থেকে সুদ খায়, সুদের লোন নিয়ে বাড়ি কেনে, কাউকে ভিক্ষা দেবার সময় বা মসজিদে দান করার সময় মানিব্যাগের সবচেয়ে ছোট যে নোটটা আছে সেটা খোঁজে? বা এরকম মানুষ কি দেখেছেন হাজ্জ করেছে, বিরাট দাড়ি রেখেছে কিন্তু বাসায় তার স্ত্রী, সন্তানদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করে? অথবা টাখনুর উপর প্যান্ট পড়ে সালাত আদায় করতে করতে কপালে দাগ পড়ে গেছে এবং ২-৩ বার হাজ্জও করে এসেছেন কিন্তু তার হাজ্জসহ সকল স্থাবর সম্পত্তি ঘুষের টাকায় করা! এরা আল্লাহর تعالى আবদ্‌ নয় এবং এরা আল্লাহর تعالى ই’বাদত করছে না। এরা শুধুই উপাসনা করছে। উপাসনার বাইরে আল্লাহর تعالى প্রতি নিজেকে সমর্পণ করে দিয়ে আবদ্‌ হয়ে আল্লাহর تعالى ইবাদত করতে এখনও বাকি আছে।

আরেক ধরনের মানুষ আছে, যারা এখনও আল্লাহর تعالى ইবাদত করা শুরু করতে পারেনি তারা হলো সেই সব মানুষ যারা ঠিকই নামায পড়ে, রোযা রাখে, যাকাত দেয়, কিন্তু ছেলে মেয়ের বিয়ে দেয় হিন্দুদের বিয়েরীতি অনুসরণ করে গায়ে-হলুদ ও বউ-ভাত করে। আরেক ধরনের মানুষ হলো যারা মাসজিদে বা ইসলামিক অনুষ্ঠানে যায় একদম মুসলিম পোশাক পড়ে, হিজাব করে, কিন্তু বন্ধু বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীর বাসায় বা বিয়ের অনুষ্ঠানে যায় একেবারে সার্কাসের মেয়েদের মতো রঙ-বেরঙের সাজসজ্জা করে। আরেক ধরনের আজব বান্দা দেখেছি যারা হাজ্জ করতে যায় হিজাব পড়ে, কিন্তু প্লেন সউদি আরবের সীমানা থেকে বের হয়ে অন্য এয়ারপোর্টে নামার সাথে সাথে বাথরুমে গিয়ে হিজাব খুলে ফেলে আপত্তিকর পশ্চিমা কাপড় পড়ে নেয়। এদের সবার সমস্যা একটি, এরা এখনও আল্লাহকে تعالى একমাত্র প্রভু হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। এদের কাছে “লোকে কী বলবে” বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু “আমার প্রভু কী বলবেন” তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।

আমরা যখন নিজেদের আল্লাহর تعالى দাস হিসেবে ঘোষণা দেব, তখনই আমরা আমাদেরকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন করতে পারব। যতদিন সেটা করতে না পারছি, ততদিন আমরা “লোকে কী বলবে”-এর দাস হয়ে থাকব। ফ্যাশনের দাস হয়ে থাকব। বিনোদন, সংস্কৃতি, সামাজিকতার দাস হয়ে থাকব। একমাত্র আল্লাহর প্রতি একান্তভাবে দাসত্ব করতে পারলেই আমরা এই সব মিথ্যা “প্রভু”দের দাসত্ব থেকে নিজেদেরকে বের করে আনতে পারব। যারা সেটা করতে পেরেছেন, তারা জানেন এই পৃথিবীতে সত্যিকার স্বাধীনতার স্বাদ কত মধুর।

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বিশেষভাবে আমাদের আগে যারা এসেছিল, তাদের কথা বলেছেন, যেন আমরা তাদের অন্ধ অনুসরণ করা শুরু না করি। আমাদের অনেকের ভিতরেই আমাদের প্রসিদ্ধ পূর্ব পুরুষদের, বিখ্যাত বুজুর্গদের প্রতি অন্ধ ভক্তি থাকে। আমরা অনেক সময় তাদেরকে এমন ক্ষমতা দেওয়া শুরু করি, যেটা শুধুমাত্র আল্লাহর تعالى জন্যই প্রযোজ্য। যেমন, আমরা অনেকে অনেক সময় মনে করি, আমার মরহুম আল্লামা-হাফেজ-মুফতি দাদাজানের পবিত্রতার কারণে আমাদের পরিবারে কোনো বিপদ আসবে না। আবার অনেকে মনে করি, আমাদের বংশ হচ্ছে আধ্যাত্মিক বংশ। আমাদের পীর নানার সুপারিশে আমরা সবাই জান্নাতে চলে যাব। এই ধরনের ধারণা শুধু ভুলই না, এগুলো শির্‌ক।[৬] এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, আমাদের আগে যারা এসেছিল, তারা যতই ভালো কাজ করে যাক না কেন, তারা আল্লাহর تعالى সৃষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা যেন এটা ভুলে না যাই যে, আল্লাহ تعالى তাদেরও প্রভু। এর পরের আয়াতে আল্লাহ تعالى বিশেষভাবে এই ব্যাপারটি আমাদেরকে আবারও মনে করিয়ে দেবেন—

2_22

তিনিই তো পৃথিবীকে তোমাদের জন্য আরামদায়ক এবং আকাশকে একধরনের ছাদ হিসেবে গঠন করেছেন এবং আকাশ থেকে পানি পাঠিয়েছেন, তারপর ফল-ফসল উৎপাদন করেন তোমাদের খাদ্য হিসেবে। অতএব, এসব জানার পরেও, কোনোদিন কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ করো না। [বাকারাহ ২২]

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে বলছেন যে, তিনি পৃথিবী এবং আকাশ-মহাকাশকে আমাদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করেছেন, যেন আমরা আরামে, নিরাপদে থাকতে পারি। প্রথমে পৃথিবীর কথা চিন্তা করুন। আল্লাহ تعالى পৃথিবীর উপরের স্তরকে আমাদের জন্য নরম করে দিয়েছেন, যেন আমরা বাসা বানাতে পারি। পৃথিবীর পৃষ্ঠ যদি পাথরের মতো কঠিন হতো, তাহলে আমরা মাটি খুড়ে বাসা বানানো তো দূরের কথা, ঠিকমতো হাটতেও পারতাম না। আবার পৃথিবী যদি শুক্র, বৃহস্পতি, নেপচুন ইত্যাদি গ্রহের মতো পুরোটাই নরম, গলিত হতো, তাহলে আমাদের পক্ষে বহুতল ভবন বানানোও সম্ভব হতো না। আল্লাহ تعالى পৃথিবীর উপরের স্তরে যথেষ্ট জায়গা— একদম শক্তও নয়, আবার একদম নরমও নয়—এমন ভাবে বানিয়ে দিয়েছেন, যেন আমরা বাসা বানিয়ে, ক্ষেত-খামার করে, পরিবার-পরিজন নিয়ে আরামে থাকতে পারি।[৪] একারণেই আল্লাহ تعالى বলছেন—তিনি পৃথিবীকে করেছেন  فِرَٰشًا (ফিরাশ), যার অর্থ যা বিস্তৃত, বসবাস যোগ্য, কার্পেট।[৫]

OLYMPUS DIGITAL CAMERA

আমরা অনেকে মনে করি যে, পৃথিবীতে বসবাসযোগ্য জায়গার অভাব। পৃথিবীর জনসংখ্যা এত বেশি হয়ে গেছে যে, মানুষ আর যথেষ্ট খাবার, বাসস্থান পেয়ে সচ্ছল জীবন যাপন করতে পারবে না। এটা একটা ভুল ধারণা। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ সমস্যাটি শুধুমাত্র অতিরিক্ত ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোতে, গ্রামেগঞ্জে নয়। পুরো পৃথিবীর ৬ বিলিয়ন মানুষের প্রত্যেককে যদি একটা নিজস্ব বাড়ি এবং বাড়ির সামনে সুন্দর বাগানও দেওয়া হয়, তাহলেও সেই ৬ বিলিয়ন মানুষ এবং তাদের বাড়িগুলোকে আমেরিকার এক টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের মধ্যেই ধারণ করা যাবে, বাকি পুরো পৃথিবী খালি পড়ে থাকবে। অপরিকল্পিত শহর তৈরি, গ্রামগুলোকে উপেক্ষা করা, শহরের জনবসতিকে নিয়ন্ত্রণ না করার কারণেই আজকে শহরগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত ঘনবসতি, দারিদ্রতা, ট্রাফিক জ্যাম, পরিবেশ দূষণসহ হাজারো সমস্যা।[১৩৭]

এরপরে আকাশের দিকে দেখুন। আকাশে সাতটি স্তর রয়েছে যেগুলো বিভিন্নভাবে আমাদের রক্ষা করে। প্রথম স্তরে আছে মেঘ। মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়, যা থেকে মাটিতে  ফল, ফসল হয়, এবং সেগুলো থেকে আমাদের খাবার আসে। মেঘে পানি বিশুদ্ধরূপে জমা থাকে, যেটা বৃষ্টির মাধ্যমে নদী, খাল-বিলে এসে আমাদের খাবার পানির সরবরাহ দেয়। যদি মেঘ না থাকত, তাহলে গরমকালে সূর্যের তাপে এবং শীতকালে জলীয়বাষ্প হারিয়ে গিয়ে পৃথিবীর বেশিরভাগ জায়গা মরুভূমি হয়ে যেত। আকাশের দ্বিতীয় স্তরে আছে ওজোন স্তর, যা আমাদেরকে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি থেকে রক্ষা করে। যদি তা না থাকত, তাহলে পৃথিবীতে কোনো প্রাণী বেঁচে থাকতে পারত না। একইভাবে আকাশের উপরের স্তরগুলো আমাদেরকে প্রতিদিন শত শত উল্কা, মহাজাগতিক ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষা করে।[১৩৬] শুধু আকাশই নয়, মহাকাশে, বিশেষ করে আমাদের সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহের অবদান রয়েছে পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশে। যদি বৃহস্পতির মতো একটা বিশাল গ্রহ না থাকতো, যেটা বেশিরভাগ ধূমকেতু এবং গ্রহাণুকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে গিয়ে শেষ করে দেয়, তাহলে পৃথিবী আজকে বহুগুণ বেশি গ্রহাণু এবং ধূমকেতুর সংঘর্ষের শিকার হতো এবং ডাইনোসরদের মতো বহু বার পৃথিবী থেকে প্রাণ বিলুপ্ত হয়ে যেত।[১৩৫]

এরকম অসংখ্য ব্যাপার রয়েছে প্রকৃতিতে, যেগুলো নিয়ে চিন্তা করলে মানুষ বুঝতে পারবে যে, পৃথিবীটা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে মানুষের বসবাসের যোগ্য করে বানানো হয়েছে।

Signs

এখানে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, আল্লাহ تعالى বলেছেন  وَأَنزَلَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءً অর্থাৎ “তিনি আকাশ থেকে পানি পাঠিয়েছেন”। এখানে َأَنزَل হচ্ছে অতীতকালে সম্পন্ন হওয়া একটি ঘটনা। যার মানে হলো, আকাশ থেকে পানি পাঠানো সম্পন্ন হয়ে গেছে। অর্থাৎ, আল্লাহ এখানে বৃষ্টির কথা বলছেন না। বরং তিনি বলছেন, পৃথিবীতে যত পানি আছে, তার সব পৃথিবীর বাইরে থেকে এসেছে। السماء আস-সামা’ অর্থ হচ্ছে আমাদের মাথার উপরে যা আছে, তার সব। অর্থাৎ আকাশ এবং মহাকাশ, সবকিছুই السماء এর মধ্যে পড়ে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে, পৃথিবী যখন প্রথম সৃষ্টি হয়েছিল, তখন তা ছিল অত্যন্ত গরম, গলিত পদার্থের মিশ্রণ। তারপর তা ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে উপরের স্তরটি শক্ত হয়। এরপর ধূমকেতু এবং বরফ মিশ্রিত গ্রহাণু, উল্কা পৃথিবীর উপর পড়ে পৃথিবীতে সব পানি নিয়ে আসে।[১৪০]

… অতএব তোমরা জেনে শুনে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ করো না। [বাকারাহ ২২]

এরপর আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এই আয়াতে শেখাচ্ছেন যে, যেখানে আল্লাহ تعالى একাই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন মানুষের জন্য—কারও কাছ থেকে কোনো ধরনের সাহায্য না নিয়ে—সবকিছুকে তিনি একাই প্রতিমুহূর্তে নিয়ন্ত্রণ করছেন, সেখানে কীভাবে আমরা জেনে শুনে পীর-দরবেশ-গুরুদের উপাসনা, অন্ধ-অনুসরণ, তাদের কাছে তদবির করতে পারি?[৬] তারা মানুষের জন্য কী সৃষ্টি করেছেন যে, তাদেরকে আমাদের এত বেশি  গুরুত্ব দিতে হবে? তারা কী করতে পারেন, যেটা আল্লাহ تعالى করতে পারেন না? পৃথিবী সৃষ্টির সময় তারা কি ছিল আল্লাহকে تعالى সাহায্য করার জন্য? মানুষ সৃষ্টির সময় তারা কি আল্লাহকে تعالى সাজেশন দিয়েছিল কীভাবে মানুষকে বানাতে হবে? মানুষকে পথপ্রদর্শন করানোর জন্য যে বাণী আল্লাহ تعالى পাঠিয়েছেন, তার কোন অংশটা তারা লিখেছেন? কীভাবে আমরা তাদের কাছে গিয়ে বিপদ-আপদ দূর করার জন্য তাবিজ চাইতে পারি? কীভাবে আমরা তাদের কাছে গিয়ে জান্নাতের জন্য সুপারিশ চাইতে পারি? কোন যুক্তিতে আমরা তাদের মাজার বানিয়ে, তাদের কবরের সামনে ‘পবিত্র’ মাটিতে গড়াগড়ি খাই?

এগুলো সবই শির্‌ক। কেন আল্লাহ تعالى শির্‌কের ব্যাপারে এত সাবধান করেছেন এবং শির্‌কের গুনাহ কখনও ক্ষমা করবেন না, অথচ অনেক বড় ধরনের গুনাহগুলোও ক্ষমা করার জন্য বিবেচনা করবেন, তা জানতে এই আর্টিকেলটি পড়ে দেখুন – “শির্‌ক করলে কি হয়? আমি তো কারও ক্ষতি করছি না?”

এর পরের আয়াতটিতে আল্লাহ تعالى বলছেন—

2_23

যদি তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকে এটা নিয়ে, যা আমি আমার বান্দার উপর ধাপে ধাপে অবতীর্ণ করেছি, তাহলে এর ধারে কাছে একটি সুরা তৈরী করো এবং আল্লাহ ছাড়া যে কোনো সাক্ষীকে ডাকো, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো। [বাকারাহ ২২]

এখানে আল্লাহ تعالى অবিশ্বাসীদের চ্যালেঞ্জ করছেন যে, যদি তাদের কোনো সন্দেহ থাকে কু’রআন আল্লাহর تعالى কাছ থেকে আসা সত্য বাণী কি না তা নিয়ে, তাহলে তারা এর মতো একটা সূরা তৈরি করে দেখাক দেখি?

প্রথমত, আমাদেরকে একটা ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে যে, আল্লাহ تعالى এই চ্যালেন্‌জটি দিয়েছেন অনেক বোঝানোর পরে। প্রথমে তিনি মানুষের অন্তরের সমস্যাগুলো বলেছেন। তিনি মানুষকে বুঝিয়েছেন, কেন তাঁকে একমাত্র প্রভু মানতে হবে এবং তার পক্ষে তিনি যুক্তিও দেখিয়েছেন। এত কিছুর পরেও যদি মানুষ আল্লাহর تعالى বাণী না মানে, মনে করে যে, এই আয়াতগুলো সব মানুষের বানানো, শুধুমাত্র তখনি তিনি তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করেছেন যে, যদি পারো তো এরকম একটি সূরা বানিয়ে দেখাও। সুতরাং আমাদের মনে রাখতে হবে যে, যখন আমরা মানুষের কাছে ইসলাম প্রচার করছি, আমাদেরকে প্রথমে তাদেরকে বোঝাতে হবে—ইসলাম বলতে আমরা কি মূল্যবোধ, নীতিগুলো বোঝাচ্ছি (যেমন এক সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস, নামায পড়া, দান করা, সত্য বলা, চুরি না করা ইত্যাদি) এবং কেন আমরা মনে করি মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা একজন মহান সত্ত্বা—যার কাছে সরাসরি যে কোনো সময় চাওয়া যায় এবং তাঁর কাছে চাইবার জন্য অন্য কিছু বা কারও সাহায্যের দরকার হয় না। এসব যুক্তি বোঝানোর পরেও যদি তারা না বোঝে, এবং তারা দাবি করতে থাকে যে, আমাদের শিক্ষা ভুল, তাদের শিক্ষাই সঠিক, শুধুমাত্র তখনি তাদেরকে চ্যালেন্‌জ করা যাবে। চ্যালেন্‌জ করাটা প্রথম ধাপ নয়, এটি শেষ ধাপ।[১] আপনি কোনো খ্রিস্টানকে গিয়ে প্রথমেই বলতে পারেন না, “কি! ইসলাম সত্যিকার ধর্ম এটা তুমি বিশ্বাস করো না? তাহলে কু’রআনের কোনো একটা সূরার মতো একটা সূরা বানাও তো দেখি?” যদি এরকম করেন, তাহলে আপনি উত্তর পাবেন, “ভ্রাতা, সূরা কি জিনিস?”

এই আয়াত পড়ে অনেকে প্রশ্ন করেন, এখানে ‘সাক্ষি’দেরকে ডাকতে বলা হলো কেন? কিসের সাক্ষি? شُهَدَاء প্রচলিত অর্থ ‘সাক্ষি’ (বহুবচন) হলেও, কোনো বিষয়ে যে অত্যন্ত অভিজ্ঞ, যার মতের উপরে কোনো সন্দেহ নেই, তাদেরকে আরবিতে شُهَدَاء (সাক্ষি) বলা হয়। এখানে আল্লাহ تعالى বলছেন যে, তাদের সবচেয়ে অভিজ্ঞ কবি, সাহিত্যিক, পণ্ডিতরা যারা আছে, তাদেরকে ডেকে আনতে—দেখি তারা পারে কি না এরকম একটা সূরা তৈরি করতে।[১]

2_24

কিন্তু যদি তোমরা না পারো—আর তোমরা কখনই তা পারবেনা—তাহলে সেই আগুন থেকে সাবধান, যার জ্বালানি হবে মানুষ এবং পাথর, যা অবিশ্বাসীদের [অস্বীকারকারি, অকৃতজ্ঞ, গোপনকারী] জন্য তৈরি করে রাখা হয়েছে। [বাকারাহ ২৩]

কু’রআন যে সৃষ্টিকর্তার বাণী, সেটার আরেকবার প্রমাণ মেলে এই ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখে। এটা যদি মানুষের বানানো কিছু হতো, তাহলে এরকম জোর গলায়, প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ পাওয়া যেত না। কোনো কবি-সাহিত্যিক কখনও কোনো অসাধারণ সাহিত্য তৈরি করে মানুষকে চ্যালেঞ্জ করবে না যে, তার কবিতার ধারে কাছে কিছু, কেউ কোনোদিন তৈরি করতে পারবে না—যদি তার মাথা ঠিক থাকে। কোনো বিজ্ঞানী এক নতুন কিছু আবিস্কার করে, তার উপর একটা পেপার লিখে কখনও প্রকাশ্যে বলার সাহস করবে না যে, কোনো মানুষের পক্ষে এর ধারে কাছে কোনো পেপার লেখা সম্ভব নয়। এই ধরনের কঠিন দাবি শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার পক্ষেই করা সম্ভব।

অনেক অমুসলিম চেষ্টা করেছে কু’রআনের সূরার মতো সূরা তৈরি করার। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কুরআনের সূরার মতো নকল সূরা তৈরি করার। ইন্টারনেটে এরকম বানানো সূরা আপনি অনেক পাবেন। যেকোনো অভিজ্ঞ আরব ভাষাবিদকে দিয়ে আপনি সেগুলো দেখালেই সে আপনাকে বলে দিতে পারবে সেগুলো কতখানি হাস্যকর। কু’রআন হচ্ছে একমাত্র বই যেখানে একজন সমাজবিদ, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসাবিদ, পদার্থবিদ, রসায়নবিদ, ইতিহাসবিদ, আবহাওয়া-বিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, গৃহিণী, চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ভিক্ষুক, দাগি আসামী, মানসিক রোগী সবার জন্য বিশেষ ভাবে উপকার হবে, এমন কোনো না কোনো বাণী রয়েছে। এটি মানব জাতির ইতিহাসে একমাত্র বই, যা একটি বিশাল ভূখণ্ডে একই সাথে নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিপ্লব নিয়ে এসেছিল। এটি হচ্ছে একমাত্র বই, যেটা পড়ে মানুষ তার ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে, একটা পুরো জাতি অন্ধকার থেকে আলোতে আসতে পেরেছিল। মানুষের ইতিহাসে কোনো একটি বই, কখনও একই সাথে এতগুলো প্রেক্ষাপটে, এত বড় অবদান রাখতে পারেনি। একারণেই মানুষ এবং জ্বিন জাতি—যাদের সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা আছে—তাদের উভয়কেই, এই বইয়ের স্রস্টা মহান সৃষ্টিকর্তা নিজে চ্যালেঞ্জ করেছেন যে, তারা কখনই এর ধারে কাছে কিছু কোনোদিন তৈরি করতে পারবে না।

এখানে জ্বালানি হিসেবে পাথরের বলা হয়েছে, কারণ মানুষ পাথরের মূর্তি বানিয়ে পূজা করে। এখানে আল্লাহ تعالى সাবধান করে দিচ্ছেন যে, যেই সব মূর্তিকে মানুষ আল্লাহর تعالى সমান মনে করছে, আল্লাহর تعالى কৃতিত্ব দিয়ে দিচ্ছে, সেই পাথরের মূর্তিগুলোই হবে তাদের জাহান্নামের আগুনের জ্বালানি।

lake-of-fire

এই আয়াতে লক্ষ্য করার মতো দুটো বৈজ্ঞানিক ইঙ্গিত রয়েছে। কীভাবে মানুষ আগুনের জ্বালানি হতে পারে? মানুষের দেহে প্রচুর পরিমাণে চর্বি আছে,যা আগুনের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০০টি Spontaneous Human Combustion এর ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যেখানে মানুষ নিজে থেকেই জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, বাইরে থেকে কোনো ধরনের আগুন লাগানো ছাড়াই।[১৩৯]

এরপর এই আয়াতে পাথরকে জ্বালানি হিসেবে বলা হয়েছে। পাথর আগুনের তাপকে ছড়িয়ে যেতে বাধা দেয়. যে কারণে আমরা যখন মাঠে আগুন জ্বালাই তখন তা পাথর দিয়ে ঘিরে রাখি, যাতে করে আগুন বেশি সময় ধরে জ্বলে এবং জ্বালানি কম খরচ হয়। পাথরে ঘিরে রাখলে একই জ্বালানিতে আগুন বেশি সময় ধরে জ্বলে।[১৩৮] আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো—পাথর গলার জন্য ৭০০-১৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা দরকার হয়।[১৪১] অর্থাৎ জাহান্নামের আগুনের তাপমাত্রা হয়তো হবে এরচেয়েও বেশি, যেন পাথর গলে যায়। মাত্র ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি ফুটে বাস্প হয়ে যায়। তাহলে ১৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাথা কি ভয়ংকর হতে পারে, চিন্তা করে দেখুন।

যেই পাথরের মূর্তি মানুষ পুজা করে, একদিন সেই পাথরগুলোই জাহান্নামের আগুনকে তাদের জন্য আরও বেশি যন্ত্রণাদায়ক করে দিবে। এখানে পাথর বলতে শুধুই পাথরের মূর্তি নয়, বরং প্রাণহীন সব ধরনের পূজার বস্তুকেই বোঝানো হয়েছে।[২] একই সাথে কু’রআনে বিভিন্ন জায়গায় কাফির, মুনাফিকদের অন্তরকে পাথরের সাথে তুলনা করা হয়েছে, যাদের অন্তরে আল্লাহর تعالى বাণী প্রভাব ফেলে না এবং যাদেরকে হাজার বুঝিয়েও তাদের অন্তর নরম করা যায় না।[৬]

সুত্র:

 

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

One thought on “যদি পারো তো এর মতো একটা সূরা বানাও – বাকারাহ ২১-২৪”

  1. Allahu Akbar…. চালিয়ে যান ভাই ! নতুন নতুন এরকম অসংখ্য আর্টিকেল চাই 🙂

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *