তোমাদেরকে ওদের কাজের জন্য জিজ্ঞেস করা হবে না — আল-বাক্বারাহ ১৩৪

আমাদের অনেকের একটি স্বভাব হলো: আমরা যেখানেই যাই, চেষ্টা করি আমাদের মামা-চাচা-খালুর গরম দেখানোর। সেটা স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে চাকরি, ব্যবসা, পাসপোর্টের লাইন, এমনকি বিয়ের পাত্র-পাত্রী দেখার সময়ও আমরা চেষ্টা করি জানিয়ে দেওয়ার: আমাদের চৌদ্দগুষ্টিতে বড় কারা আছে, আমাদের পূর্বপুরুষরা কত বিখ্যাত ছিলেন, আপনারা কোন কোন ব্যাপারে আমাদের থেকে পিছিয়ে আছেন। একইসাথে কোনো কাজে গেলে আমাদের মধ্যে একটা চেস্টা থাকে: কীভাবে সবার জন্য যে নিয়ম, সেটা পাশ কাটিয়ে অন্যের থেকে বেশি সুবিধা আদায় করা যায়।

কু’রআনে এই ধরনের বংশগৌরব, পূর্বপুরুষ নিয়ে বড়াইকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একইসাথে কু’রআনে পূর্বপুরুষদের অপকর্ম নিয়ে অনুশোচনা করতে মানা করা হয়েছে, কারণ আমরা প্রত্যেকে নিজের কাজের জন্য জবাব দেবো। আমাদের বাপদাদারা মানুষের কত বড় সর্বনাশ করে গেছেন, কত গরিব লোককে অত্যাচার করে গেছেন, তা নিয়ে নিজেদেরকে দোষী মনে করার কোনো কারণ নেই—

2_134_title

2_134ওই সম্প্রদায় চলে গেছে। ওরা যা অর্জন করেছে, তা ওদেরই থাকবে, আর তোমরা যা অর্জন করেছ, তা তোমাদের হবে। তোমাদেরকে ওদের কাজের জন্য জিজ্ঞেস করা হবে না। [আল-বাক্বারাহ ১৩৪]

যারা সৈয়দ বংশের হয়ে, বা কোনো সন্মানিত পিরববংশ হয়ে ভাবছেন যে, নবীর عليه السلام সাথে সম্পর্ক থাকার জন্য বা সন্মানিত পিরের কারণে কিয়ামতের দিন কোনো ধরনের অগ্রাধিকার বা সুবিধা পাবেন, বা তাদের কোনো পাপ মাফ করে দেওয়া হবে —তাদের জন্য এই আয়াত সাবধানবাণী। আমাদের পূর্বপুরুষরা যা করে গেছেন, তা তাদের অর্জন। যা আমরা নিজেরা অর্জন করবো, আমরা শুধু তারই ফল পাবো। এই আয়াতে আল্লাহ تعالى নবীদের প্রজন্মের কথা বলে আমাদেরকে জানাচ্ছেন যে, সেই অত্যন্ত সন্মানিত প্রজন্ম যা অর্জন করে গেছে, তা তাদেরই থাকবে, তাদের বংশধর কোনো সুবিধা  পাবে না। আমরাও তাদের কাজের জন্য কিয়ামতের দিন কোনো বিশেষ সুবিধা পাবো না। আমাদেরকে নিজেদের কাজের জবাব নিজে দিতে হবে।[৪]

এই আয়াতে ইসলাম ধর্মের সাথে ইহুদি এবং খ্রিস্টান ধর্মের একটি মূল পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে। ইহুদি ধর্ম অনুসারে ইহুদিরা হচ্ছে আল্লাহর تعالى বিশেষ পছন্দের জাতি। ইহুদি, খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থে, এবং কু’রআনে তাদের প্রতি আল্লাহর تعالى অনেক অলৌকিক সাহায্য, অনুগ্রহের উদাহরণ পাওয়া যায়। একারণে তারা নিজেদেরকে আল্লাহর تعالى পছন্দের বিশেষ জাতি মনে করে। তারা মনে করে জান্নাত শুধু তারাই পাবে, আর কেউ পাবে না।

একইভাবে খ্রিস্টানরা মনে করে তারা আদমের عليه السلام পাপের কারণে জন্ম হয়েছে এক মহাপাপ নিয়ে। যেই পাপ কাটাতে যীশু ক্রসে জীবন দিয়েছেন। —এইসব ফালতু যুক্তি ইসলামে নেই। আমরা প্রত্যেকে নিজের পরিণতির জন্য নিজেই দায়ী। কোনো ধরনের স্বজনপ্রীতি, বিশেষ খাতির ইসলামে নেই।[২] ইহুদিরা যেমন মনে করে ইহুদি হলেই স্বর্গে যাবে, খ্রিস্টানরা মনে করে যীশুকে বিশ্বাস করলেই স্বর্গে যাবে, ঠিক একইভাবে অনেক মুসলিম মনে করেন: মুসলিম হলেই জান্নাতে যাওয়া যাবে, কারণ আমরা শেষ নবীর عليه السلام উম্মত —এটি একটি ভুল ধারণা। প্রত্যেক মুসলিমকে তার নিজের কাজের জন্য জবাব দিতে হবে।

আমাদের অনেকেই নিজের অগোচরেই অনেক অন্যায় কাজ করি এই ভেবে যে, আমাদেরকে কেউ না কেউ এসে বাঁচাবেই। বাচ্চারা বাইরে গিয়ে প্রতিবেশীর বাসায় ঢিল মেরে পালিয়ে বাসায় ফিরে আসে, কারণ তারা মনে করে তাদের বাবা-মা তাদেরকে বাঁচাবে। একটু বড় হলে রাস্তায় অন্য ছেলেদের সাথে মারামারি করে দৌড়িয়ে পালিয়ে ‘বড় ভাইয়ের’ কাছে যায়। আরও বড় হলে চুরি, ডাকাতি, বিরোধী দলের মেম্বারকে খুন, ইউনিভারসিটির হোস্টেলে ধর্ষণ করে। কারণ তারা জানে, “স্যার আছেন না? আমার কোনো ভয় নেই।” আরও বড় গোছের কেউ হলে জনগণের কোটি টাকার সম্পত্তি মেরে দিয়ে ভাবে, “ম্যাডাম আছেন না? আমাকে ধরবে কার এত বড় সাহস?” —খারাপ মানুষদেরকে ভেতরে সবসময়ই একটা ধারণা থাকে যে, সে যতই অন্যায় করুক, তাকে বাঁচানোর জন্য উপরের লেভেলে কেউ না কেউ তো আছেই। এই ধরনের মানুষদের জন্য এই আয়াত একটি সাবধানবাণী: দুনিয়ায় যতই অন্যের গরম দেখাও, একবার শুধু কিয়ামতে আসো। তারপরে দেখবে তোমার কী হয়।

আমার কী দোষ? শয়তানই তো আমাকে দিয়ে খারাপ কাজ করায়?

আমাদের মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে যে, আমরা যত খারাপ কাজ করি, তা শুধু শয়তানের কারণেই করি। শয়তান না থাকলে আমরা কোনো খারাপ কাজ করতাম। আমাদের চরিত্র হত ফুলের মত পবিত্র। ভুল ধারণা—

আমার অনুসারীদের উপরে তোমার (শয়তান) কোনো ক্ষমতা থাকবে না , কিন্তু ওই সব পথভ্রষ্টরা ছাড়া, যারা তোমাকে অনুসরণ করে।  [১৫:৪২]

যখন সব ফয়সালা হয়ে যাবে (কিয়ামতের দিন), তখন শয়তান বলবে, “আল্লাহ তোমাদেরকে সত্যিকারের কথা দিয়েছিলেন। আমিও তোমাদেরকে কথা দিয়েছিলাম, কিন্তু সেগুলো ছিল সব মিথ্যা। তোমাদেরকে শুধু ডাকা ছাড়া আমার আর কোনো ক্ষমতা ছিল না তোমাদের উপরে। তোমরাই আমার ডাকে সাড়া দিয়েছিলে। তাই আমাকে দোষ দিয়ো না, বরং নিজেদেরকেই দোষ দাও।”… [১৪:২২]

সুতরাং অন্যায় করে বলব না যে, সব শয়তানের দোষ। শয়তান না থাকলে আমরা সেই অন্যায়গুলো করতাম না। শয়তান শুধুই আমাদের কুমন্ত্রণা দেয়। আমরা নিজে জেনে শুনে অন্যায়গুলো করি। আমাদের সিদ্ধান্তের স্বাধীনতার অপব্যবহারের জন্য আমরা দায়ী, শয়তান নয়।

যেমন, আমার টেবিলে একটা কম্পিউটারের ম্যাগাজিন পড়ে আছে, আর সামনে টিভিতে মিউজিক চ্যানেলে ব্রিটনী স্পিয়ার্স নামে একজন শিক্ষিত, বয়স্ক, দুই সন্তানের মা, নামমাত্র কাপড় পড়ে লাফালাফি করছে। টিভি বন্ধ করে দিয়ে ম্যাগাজিনটা না পড়ে , আমি যদি হা করে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেই, তাহলে সেটাতে শয়তানের দোষ নেই, পুরোটাই আমার দোষ। শয়তান আমাকে টিভি দিয়ে ডাকে। আমি ইচ্ছা করলেই ক্যাবল সংযোগ কেটে দিয়ে তাকে আটকে দিতে পারি। টিভিটা বিক্রি করে দিতে পারি। সেটা না করে, কিয়ামতের দিন জাহান্নামে যাওয়ার সময় শয়তানকে দোষ দিয়ে বিলাপ করে লাভ হবে না। তখন সে বরং আমাকে বলবে, “প্রতি মাসে ক্যাবল টিভির বিল কি আমি দিতাম? লাখ টাকা দিয়ে টিভিটা কি আমি কিনে দিয়েছিলাম?”

আল্লাহ কি জানেন না যে, কে জান্নাতে যাবে, আর কে জাহান্নামে যাবে? তাহলে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে পরীক্ষা করার দরকার কী?

যারা এই ধরণের প্রশ্ন করেন, তাদের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে: তারা জাহান্নামে যাওয়ার জন্য সব দোষ আল্লাহকে দিতে চান। তারা নিজেদের দোষের জন্য নিজে কোনো দায়িত্ব নেবেন না, পুরোটাই আল্লাহর দোষ। যদি কেউ নিজের দোষের দায়িত্ব নিজে নিতে চানই, তাহলে তার কখনো এই প্রশ্ন করার কথা না। বরং তার প্রশ্ন করার কথা: “আচ্ছা, আমি যে এত খারাপ কাজ করছি, এর জন্য কি আমার কোনো শাস্তি নেই? এই দুনিয়াতে তো আমাকে কেউ কিছু করতে পারছে না। আমাকে যদি কোনো অতিপ্রাকৃত পদ্ধতিতে কঠিন শাস্তি দেওয়া না হয়, তাহলে কি ব্যাপারটা ন্যায্য হলো? যারা আমার কারণে কষ্ট পেলো ওদের কী হবে?”

আল্লাহ যদি জানেনই আমি জাহান্নামে যাবো,  তাহলে আমার আর ভালো কাজ করে লাভ কী?
যারা এই প্রশ্ন করেন, তারা ধরে নিচ্ছেন যে, তারা জাহান্নামে যাবেনই। কে বলেছে তাদেরকে যে, তারা জাহান্নামে যাবেনই এবং তাদের আর ভালো কাজ করে লাভ নেই? বরং আল্লাহ বলেছেন—

… ও আমার বান্দারা, তোমরা যারা নিজেদের উপরে চরম অন্যায় করেছ, আল্লাহর অনুগ্রহের উপর কখনও আশা হারিয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করেন। কোনো সন্দেহ নেই: তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, নিরন্তর করুণাময়। (৩৯:৫৩)

তখন তারা প্রশ্ন করবেন—

আল্লাহ তো জানেনই আমি জান্নাতে না জাহান্নামে যাচ্ছি। তাহলে আমার স্বাধীনতা থাকলো কীভাবে?

এটা একটা জটিল প্রশ্ন, কারণ এর সাথে ‘কদর’ বা ‘পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্যের’ ধারণা জড়িত। এটি একটি ব্যাপক ব্যাপার যার জন্য বেশ কয়েকটি বই পড়া প্রয়োজন। যদি একটা সারমর্ম দেই, তাহলে দাঁড়ায়—

আল্লাহর تعالى কোনো কিছু জানার অর্থ এই না যে, মানুষের কোনো স্বাধীনতা নেই। আল্লাহ تعالى মানুষকে ‘সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা’ দিয়ে পাঠিয়েছেন। প্রতিটি মানুষকে আল্লাহ تعالى কিছু ব্যাপার পূর্ব নির্ধারিত করে দিয়েছেন, কিন্তু বাকি অনেক কিছু মানুষের সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দিয়েছেন। মানুষ কোনো পরিস্থিতে পড়ে যদি ভালো সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সে তার জন্য পুরস্কার পাবে। আর যদি খারাপ সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তার জন্য শাস্তি পাবে। পরিস্থিতিগুলো আল্লাহ تعالى তৈরি করেন। প্রতিটি পরিস্থিতে মানুষ কতগুলো সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিতে পারবে, সেটাও আল্লাহ تعالى নির্ধারণ করে দেন। প্রতিটি সম্ভাব্য পদক্ষেপের সবগুলো সম্ভাব্য ফলাফল আল্লাহ تعالى জানেন। মানুষের কাজ হচ্ছে ভাল সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া এবং নিজের রাগ, লোভ, কামনা, বাসনা, ইগো ইত্যাদির বশবর্তী হয়ে অন্যায় সিদ্ধান্তগুলো না নেওয়া।

যে-ই কি না সৎ কাজ করবে, সে তা নিজের উপকারেই  করবে; আর যে-ই কি না অসৎ কাজ করবে, তা সে নিজের বিরুদ্ধেই করবে। তোমার প্রভু তার বান্দাদের উপরে কখনই অবিচার করেন না। (৪১:৪৬)

কিন্তু এর মানে এই না যে, আল্লাহ تعالى জানেন না: আমরা কী সিদ্ধান্ত নেব। অথবা আল্লাহ تعالى যদি জানেনই আমরা কী সিদ্ধান্ত নেব, তার মানে এই না যে, আমাদের সমস্ত সিদ্ধান্ত পূর্ব নির্ধারিত। আমরা যখনি বলি—“আল্লাহ তো সব জানেন”—আমরা ধারণা করে নেই যে, আল্লাহর تعالى জানাটা হচ্ছে অতীত কালের ঘটনা এবং যেহেতু আল্লাহ تعالى ‘অতীতকালে’ জেনে গেছেন, তার মানে বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবই পূর্ব নির্ধারিত।

কোনো সত্তা যখন সময়ের বাইরে চলে যায়, তখন সে একই সাথে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছুই একই ‘সময়ে’, একই ‘মুহূর্তে’ জানতে পারে। এই মুহূর্তে আমি কী করছি, কী করবো এবং তার ফলে আমার পরিণতি কী হবে— আল্লাহ تعالى তা সব একই সাথে দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু তার মানে এই না যে, আমি কী করব, কী করব না, সেই সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা আল্লাহ  تعالى আমাকে দেননি।

সময়ের ঊর্ধ্বে

কীভাবে একই সাথে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ দেখা যায়, তার একটা উপমা দেই। ধরুন, আপনি সিনেমা হলে গিয়ে একটি চলচ্চিত্র দেখছেন। যেহেতু আপনি একটা একটা করে দৃশ্য দেখছেন, আপনি জানেন না সামনে কী হতে যাচ্ছে। আপনি শুধুই অতীতে কী হয়েছে জানেন এবং বর্তমানে কী দৃশ্য হচ্ছে, তা দেখতে পাচ্ছেন, ভবিষ্যৎ আপনার অজানা। কিন্তু ধরুন, চলচ্চিত্রটির পুরো ফিল্মের রোলটাকে যদি মাটিতে সমান করে বিছিয়ে রাখা হতো এবং আপনি দশ তলা বাড়ির ছাদ থেকে পুরো ফিল্মটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একবারে, এক পলকে দেখতে পেতেন: তাহলে আপনি একই সাথে, একই মুহূর্তে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছুই দেখতে পেতেন। আপনার কাছে তখন আর চলচ্চিত্রটি একটা, একটা দৃশ্য করে এগোতো না বরং পুরো চলচ্চিত্রটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক মুহূর্তে আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠত। আপনি তখন ‘সময়ের ঊর্ধ্বে’ চলে যেতেন।

এটা শুধুই একটা উপমা। এর মানে এই নয় যে, আল্লাহর تعالى কাছে সময় এভাবে কাজ করে। আল্লাহ تعالى হচ্ছেন সময়ের স্রষ্টা! তাঁর تعالى অস্তিত্ব সময়ের উর্ধে। তাঁর تعالى জন্য অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ প্রযোজ্য নয়। আমরা যখন আল্লাহকে تعالى নিয়ে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ চিন্তা করব, বলব তিনি ‘জানতেন’, ‘জানেন’, ‘করবেন’, ‘দেখবেন’, ‘বলবেন’ —এগুলো আসলে সঠিক ভাষা হবে না, কারণ আমরা তাঁকে আমাদের মত সময়ের ভেতরে কিছু করতে ভাবছি। তাঁর বেলায় এই ধরনের ভাষা ব্যবহার করলে আমরা বিভ্রান্ত হবই।

মানুষের ভাষায় সময়ের ঊর্ধ্বে কোনো ধারণা প্রকাশ করার জন্য শব্দ নেই, কারণ আমরা সময়ের ঊর্ধ্বে কিছু চিন্তা করতে পারি না। একারণে আমরা যখনি আল্লাহর تعالى সম্পর্কে কোনো কথা বলি, আমরা আসলে আমাদের সীমিত ভাষা দিয়ে তাঁর تعالى সম্পর্কে এমন কিছু বলি, যা থেকে তিনি تعالى অনেক উপরে — سبحان الله العظيم

পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্য

এবার পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্যের একটা উপমা দেই। ধরুন, আপনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে গাড়িতে করে যাচ্ছেন। আপনি একটা রাস্তার মোড়ে এসে দেখলেন: একটা রাস্তা বায়ে গেছে, আরেকটা ডানে গেছে। আপনি বায়ের রাস্তা নিলেন এবং চট্টগ্রামের বদলে সিলেটে গিয়ে পৌঁছালেন। এখন যারা রাস্তা বানিয়েছে—সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, তারা ভালো করেই জানে: কোন রাস্তায় গেলে মানুষ কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছাবে। প্রত্যেকটা রাস্তার মোড়ে গিয়ে কোন দিকে ঘুরলে মানুষ কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছাবে, তারা তা সবই জানে। তার মানে এই না যে, আপনি সিলেটে গিয়ে পৌঁছাবেন তা পূর্ব নির্ধারিত, আপনার কিছুই করার নেই, কারণ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ইতিমধ্যেই জানে ওই রাস্তাগুলো সিলেটে গেছে। শুধু তাই না, আপনার বর্তমান অবস্থান অনুসারে তারা জানে আপনি ঠিক কীভাবে, কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছাবেন। আপনি আপনার জীবনে যত মোড় নেবেন, তার প্রত্যেকটির পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ জানেন, কারণ জীবনের রাস্তার প্রতিটা মোড় তাঁরই সৃষ্টি।

যেমন, ধরুন আপনার যখন দশ বছর বয়স ছিল, আপনার স্কুলে দুজন বন্ধু ছিল। রহিম: যে একজন ভালো ছাত্র, সারাদিন পড়াশুনা করে, ভালো ঘরের ছেলে; আর রকি: যে বিরাট বড়লোকের ছেলে, তার ভিডিও গেমের অভাব নেই, সারারাত মুভি দেখে, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডা দিয়ে বেড়ায়। আল্লাহ আপনাকে দুটো সুযোগ দিয়েছিলেন—রহিম এবং রকি। আপনি রকির ভিডিও গেমের লোভকে সামলাতে না পেরে রকির পেছনে লেগে গেলেন। পড়ালেখা বাদ দিয়ে সারাদিন সময় নষ্ট করে বেড়ালেন। স্কুল শেষ করলেন একটা বাজে রেজাল্ট নিয়ে। জীবনটা দুর্বিষহ করে ফেললেন। সারাজীবন আল্লাহকে দোষ দিলেন আপনার দুরবস্থার জন্য। বাকি জীবনটা আল্লাহর নির্দেশ না মেনে, তার সাথে যুদ্ধ করে, তার নির্দেশগুলো অমান্য করে জাহান্নামে চলে গেলেন।

আপনি যদি রকির পেছনে না ঘুরে রহিমের সাথে থাকতেন, আপনার একটা সুন্দর চরিত্র তৈরি হত। আপনি সুন্দর চিন্তা করতে শিখতেন। ঠিকমত পড়ালেখা করতেন। ভাল রেজাল্ট করে ভালো কলেজে পড়তে পারতেন। আপনার জীবনটা সফল হতো। তখন আপনি সারাজীবন আল্লাহকে ধন্যবাদ দিয়ে, তাঁর আদেশ মেনে জীবন পার করে জান্নাতে চলে যেতেন।

আল্লাহ تعالى আপনাকে দুটো সুযোগ দিয়েছিলেন। আপনার সিদ্ধান্তের জন্য আপনি দায়ী।

আবার ধরুন আপনি রকির পেছনে লেগে ছিলেন। আপনার বাবা-মার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনরাত চেষ্টা করার পর, কোনো মতে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পেরেছেন। তারপর একদিন আপনার বন্ধু বল্টু আপনাকে এসে বলল, “দোস্ত, আমার এক বন্ধুর কাছে খবর পেলাম। ওদের এক দল আছে যারা সন্ধার পর ‘ইয়ে’ করতে যায়। সাংঘাতিক মজার ব্যাপার নাকি। চল্, আমরাও আজকে একবার ‘ইয়ে’ করে দেখি।” —এখন এতদিনে আপনার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে আজে বাজে বন্ধুর সাথে মিশলে জীবনে কত পস্তাতে হয়। কিন্তু তারপরেও আপনি লোভ সামলাতে পারলেন না, বন্ধুর সাথে চলে গেলেন। এর জন্য যদি আল্লাহ আপনাকে শাস্তি হিসেবে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেন, আপনি কি বলবেন: সেটা ন্যায় বিচার হয়নি?

কিন্তু ধরুন আপনি নিজে তো গেলেনই না, বরং আপনার বন্ধু বল্টুকেও আটকে রাখলেন। তাকে আপনার নিজের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে ভালো করে বোঝালেন, যেন সে আপনার মতো ভুল না করে। এর ফলে সে জীবনের একটা বড় ভুল করা থেকে বেঁচে গেল। নিজেকে সংশোধন করার জন্য এবং অন্য একজন মানুষের জীবনকে বাঁচানোর জন্য আল্লাহ আপনাকে পুরস্কার হিসেবে জান্নাত দিয়ে দিলেন।

এভাবে আল্লাহ আমাদেরকে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন রাস্তা নির্ধারণ করে দেন। আমাদেরকে সংশোধনের সুযোগ করে দেন। কিছু রাস্তা আপনাকে আরও খারাপ করে দেবে, আপনার এবং আপনার পরিবারের সদস্যদের জীবনে আরও কষ্ট এনে দেবে। কিছু রাস্তা আপনাকে আপনার দুরবস্থা থেকে বের করে এনে জীবনটা সহজ করে দেবে। আপনি যদি আপনার অতীত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা না পেয়ে, নিজের লোভ, ইগো, সন্মান, রাগ, অহংকারকে সংযত না করে, আবারো ভুল রাস্তায় চলে যান —তাহলে এর জন্য আপনি দায়ী, আল্লাহ تعالى কখনই দায়ী নন।

আমি নিশ্চিতভাবে মানুষকে সঠিক পথ দেখিয়েছি, সে কৃতজ্ঞ হোক আর অকৃতজ্ঞ হোক।  (৭৬:৩)

সাবধানতা

‘ক্বদর’ ব্যাপারটি মানুষের কল্পনাতীত একটি ব্যাপার, তাই এই ব্যাপারে চিন্তা করতে গেলে অনেকেই ভুল পথে চলে যান। সময়ের সমীকরণ মাথায় রেখে সবসময় সঠিকভাবে চিন্তা করতে পারেন না। স্থান এবং সময়ের ঊর্ধ্বে ঘটনা কীভাবে ঘটে, তা কল্পনায় ধরে রাখতে পারেন না। বিশেষ করে যারা পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে কম পড়াশুনা করেছেন, তারা এই সব ব্যাপার নিয়ে যথেষ্ট চিন্তা-অনুশীলন করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেননি। এই ব্যাপারে তাদের চিন্তা, যুক্তিগুলোকে কোনো শিক্ষকের মাধ্যমে যাচাই করে, প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে ধারালো করেননি। যার ফলে তারা সহজেই চিন্তার জটিলতায় হারিয়ে গিয়ে ভুল উপসংহারে পৌঁছান।

তাই এই ব্যাপারে বেশি চিন্তা না করাই ভালো। যত চিন্তা করবো, শয়তানের সাহায্যে তত আমরা ভুল উপসংহারে পৌঁছে যাবো। শয়তান আমাদেরকে সবসময় চেষ্টা করবে: ক্বদর নিয়ে চিন্তা করার সময় যুক্তির গোলকধাঁধায় হারিয়ে দিতে, যার ফলে আমাদের পুরো চিন্তাটাই ভুল দিকে চলে গিয়ে, আমাদেরকে ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেবে। তারপর আমরা আল্লাহর تعالى প্রতি মনে রোষ ধরে রেখে ক্রমাগত তাঁর সাথে অন্যায় করে যাবো। মানুষের নড়বড়ে ঈমানকে ভেঙ্গে দিতে শয়তানের একটি মোক্ষম অস্ত্র হচ্ছে: ক্বদর নিয়ে চিন্তা করে মানুষের মাথা খারাপ করিয়ে দেওয়া। তারপর ঈমান যা-ও বা বাকি থাকে, সেটাও শেষ যায়।

ক্বদর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে:

সূত্র:

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
  • [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
  • [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
  • [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
  • [১৫] তাফসির আল জালালাইন।

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *