মানুষকে ইসলামের দাওয়াহ দেওয়ার সময় যারা দাওয়াহ দেন, তাদেরকে তিনটি বাঁধা পার করতে হয়—
১) তুমি কে? তোমার কথা আমি কেন শুনবো?
২) তোমার ধর্ম কি আমার ধর্মের থেকে বেশি সঠিক? তুমি কি মনে করো: তুমি সঠিক পথে আছে, আর আমরা সবাই ভুল পথে আছি?
৩) আমাদেরকে কেন তোমাদের মতই হতে হবে?
নবি, রাসুলদেরকে এই বাঁধাগুলো পার করতে হয়েছে। তাদেরকে এমন সব সময়ে, এমন সব মানুষের কাছে পাঠানো হয়েছিল, যারা একেবারেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। একশ্রেণীর মানুষের চরম অন্যায়ের কারণে আরেক শ্রেণীর মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে গিয়েছিল। তারপরও নবি, রাসুলরা অত্যাচারিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে এই কঠিন বাঁধাগুলো অতিক্রম করে অত্যাচারী মানুষগুলোকে পথ দেখিয়ে গেছেন।
এখন, আমাদের কাছে যদি বাইরের দেশ থেকে কেউ এসে ধর্ম প্রচার করা শুরু করে, তাহলে প্রথমেই আমাদের মনে হবে: সে কোথাকার কে যে, আমাদেরকে ধর্ম শেখাতে এসেছে? সে কীভাবে বুঝবে আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের মানসিকতা, আমাদের সীমাবদ্ধতা? তার দেশে অনেক কিছু চলতে পারে, যেটা আমাদের দেশে চলবে না। আবার আমাদের অনেক কিছুই তার সংস্কৃতি অনুসারে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। আমাদেরকে কি সবদিক থেকে তার মতো, তার দেশের মানুষের মতো হতে হবে নাকি?
একারণে যখন কোনো নবি বা রাসুল, তাদের এলাকার মানুষের মাঝে বড় হয়ে, তাদেরই মাঝে ধর্ম প্রচার করতেন, তখন তাদেরকে এই সমস্যাটার সম্মুখীন হতে হতো না। তারা তাদের আশেপাশের মানুষের সংস্কৃতি, রীতিনীতি, মানসিকতা ভালো করে বুঝতেন এবং সে অনুসারে তাদেরকে ধর্ম শেখাতে পারতেন। একারণে একজন বাঙালি দাঈ যতটা না ভালোভাবে বাঙালীদের মাঝে ইসলামের শিক্ষা প্রচার করতে পারবেন, মানুষকে বোঝাতে পারবেন, মানুষের ভেতরে পরিবর্তন আনতে পারবেন, একজন আরব বা ইংরেজ দাঈ সেভাবে পারবেন না। ভাষা, সংস্কৃতি, রীতিনীতি, আদব-কায়দা একটা বিরাট বাঁধা হয়ে থাকবে সাধারণ মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতার পথে।
নবি ইব্রাহিম عليه السلام এই ব্যাপারটি বুঝেছিলেন, একারণেই তিনি আল্লাহর تعالى কাছে দুআ করেছিলেন, যেন আল্লাহ تعالى তার বংশধরদের মধ্যে থেকে একজনকে রাসুল হিসেবে গড়ে তোলেন, যাকে ভাষা, সংস্কৃতি, রীতিনীতির বিরাট বাঁধা অতিক্রম করতে হবে না—
ও আমাদের প্রভু, ওদের মধ্যে থেকে একজনকে রাসুল হিসেবে গড়ে তুলুন, যে ওদেরকে আপানার আয়াত শোনাবে, তাদেরকে আপনার বিধি-বিধান এবং প্রজ্ঞা শেখাবে এবং তাদেরকে পবিত্র করবে। নিঃসন্দেহে আপনি সর্বোচ্চ ক্ষমতা-কর্তৃত্বের অধিকারী, পরম প্রজ্ঞাবান। [আল-বাক্বারাহ ১২৯]
এই আয়াতে নবি ইব্রাহিম عليه السلام দুআ করেছেন: ٱبْعَثْ অর্থাৎ ‘গড়ে তুলতে’। রাসুল যেন তার বংশধরদের মাঝে থেকে বড় হয়ে একজন রাসুল হন। তিনি যেন অন্য কোনো জায়গা থেকে না আসেন। এলাকার মানুষ যেন তাকে তাদেরই একজন হিসেবে গ্রহণ করে নেয়।
“যে ওদেরকে আপানার আয়াত শোনাবে”
রাসুল মানুষকে আল্লাহর عليه السلام বাণী তিলাওয়াত করে শোনাবে, সে নিজে থেকে কিছু বানিয়ে বলবে না। তিলাওয়াহ تلاوة এসেছে ت ل و থেকে, যার অর্থ: পেছনে পেছনে অনুসরণ করা, সারিবদ্ধভাবে চলা, কোনো কিছু অর্জনের জন্য চলা, কাউকে পথপ্রদর্শক হিসেবে নেওয়া, কারো কর্তৃত্ব মেনে নেওয়া, কোনো জীবনধারা অনুসরণ করা, কারো চিন্তার ধারা অনুসরণ করা ইত্যাদি।[২৬৩] রাসুল তিলাওয়াহ করবেন: তিনি নিজে আগে আল্লাহ تعالى বাণী ঠিকমতো অনুসরণ করবেন, তারপর তিনি তা মানুষকে শেখাবেন। রাসুল হবেন জীবন্ত বাণী।
তিলাওয়াহ মানে শুধু আয়াত যেভাবে আরবিতে উচ্চারণ করার কথা, শুধু সেভাবেই উচ্চারণ করা নয়, একইসাথে সঠিকভাবে আয়াত বুঝে নিজের জীবনে অনুসরণ করা। বুঝে, চিন্তা করে, সঠিকভাবে আল্লাহর تعالى বাণী মেনে চলাটা হচ্ছে: তিলাওয়াহ।[১৪] আল্লাহর تعالى বাণীকে আমাদের জীবনে পথপ্রদর্শক হিসেবে নেওয়া হচ্ছে তিলাওয়াহ। আল্লাহ تعالى আমাদেরকে কু’রআন দিয়েছেন শুধুই ‘ইক্বরা’ পড়ার জন্য নয়, তিনি আমাদেরকে কু’রআন সঠিকভাবে ‘তিলাওয়াহ’ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
“তাদেরকে আপনার বিধি-বিধান এবং প্রজ্ঞা শেখাবে”
يُعَلِّمُهُمُ ٱلْكِتَٰبَ — ‘তাদেরকে কিতাব শেখাবে’। কিতাব শব্দটির দুটো মূল অর্থ রয়েছে: ১) যাতে কিছু লেখা আছে, অর্থাৎ বই বা ফলক, ২) বিধিবিধান। এখানে কিতাব বলতে দুটো অর্থই প্রযোজ্য হয়, কারণ রাসুল এসে মানুষকে আল্লাহর تعالى কিতাব শেখান, এবং একই সাথে আল্লাহর تعالى বিধিবিধান শেখান।[১]
এখানে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে يُعَلِّمُهُمُ, যার অর্থ: শেখানো। এটা أخبر ‘জানানো’ নয়। রাসুল এসে শুধু আল্লাহর تعالى বাণী আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েই চলে যান না, বরং তারা আমাদেরকে শিখিয়ে যান। শেখানো মানে হচ্ছে: প্রথমে কাউকে বিষয়টা বলা, তারপর সেটা যাচাই করা, পরীক্ষা নেওয়া, ভুল হলে সংশোধন করা, বোঝার জন্য সময় দেওয়া। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে: আমরা যখন ইসলামের বাণী প্রচার করছি, একবার বলেই যেন ধরে না নেই: আমাদের দায়িত্ব শেষ। “কুর’আনের আয়াত ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েছি। অমুককে রমজানে একটা কুর’আন কিনে দিয়েছি। ব্যাস, আমার কাজ শেষ।” — এতটুকুই আমাদের দায়িত্ব নয়। আমাদের মানুষকে শেখাতে হবে, রাসুলের উত্তরসূরি হিসেবে এটা আমাদের দায়িত্ব।
“প্রজ্ঞা শেখাবে” — রাসুল শুধু আমাদেরকে জ্ঞান দেন না, একই সাথে প্রজ্ঞা শেখান। প্রজ্ঞা হচ্ছে জ্ঞানকে সঠিকভাবে ব্যবহার। আমাদের অনেক জ্ঞান থাকতে পারে, কিন্তু প্রজ্ঞা যদি না থাকে, তাহলে সেই জ্ঞান ঠিকভাবে ব্যবহার হবে না। যেমন: আমরা অনেকেই জানি, আল্লাহ আমাদের ক্বদর-ভাগ্যের মালিক, তিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। এই ব্যাপারে কুর’আনের আয়াতগুলো আমরা পড়েছি, আমাদের জ্ঞান ঠিকই আছে। কিন্তু তারপরও আমরা গাড়িতে আয়াতুল কুরসি ঝুলিয়ে রেখে ভাবি: তা আমাদেরকে বিপদ থেকে রক্ষা করে। বাচ্চার কপালে কালো টিপ দেই, যেন অশুভ চোখ না লাগে। স্বামীর নাম নেওয়া যাবে না, তাতে অমঙ্গল হয়। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় পেছনে তাকানো যাবে না, তাতে যাত্রা অশুভ হয়। —এরকম শত শত ভুল ধারণায় আমরা বিশ্বাস করি, কারণ আমাদের জ্ঞান থাকলেও প্রজ্ঞা আসেনি। আমরা শিখিনি আমাদের জ্ঞান কীভাবে কাজে লাগাতে হয়।
অনেকে মনে করেন: নিজে কুর’আন পড়ে বুঝে চললেই হবে। কুর’আন কারও কাছ থেকে শেখার কিছু নেই। সাহাবীরা, তাদের অনুসারীরা কীভাবে কুর’আন বুঝে গেছেন, কীভাবে অনুসরণ করে গেছেন —এগুলো আমাদের জানার কোনো দরকার নেই। আজকের যুগ পাল্টে গেছে। আজকে আমাদেরকে নিজেদের কুর’আন পড়ে, বুঝে, নিজেদের সিদ্ধান্ত মতো জীবনযাপন করতে হবে।
ধরুন একজন সিদ্ধান্ত নিল: সে বাজার থেকে সার্জারির উপর বেশ কিছু বই পড়ে নিজেই প্র্যাকটিস করে একজন সার্জন হয়ে যাবে। তার কোনো বড় সার্জনের কাছ থেকে শেখার কোনো দরকার নেই। সে নিজেই পারবে বই পড়ে অপারেশন করতে। সার্জারির উপর যথেষ্ট ভালো বই আছে, বিস্তারিত ছবি দেওয়া আছে, ইউটিউবে আজকাল সার্জারির ভিডিও পর্যন্ত পাওয়া যায়। এত কিছু থাকতে কেন আমাদেরকে কোনো সার্জনের কাছ থেকে সার্জারি করা শিখতে হবে?
একজন বড় সার্জন আমাদেরকে প্রজ্ঞা শেখাবেন। তিনি শেখাবেন কখন কোন পরিস্থিতিতে কী সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কখন বইয়ের নিয়ম মানা যাবে, কখন যাবে না। বইয়ের গদবাধা নিয়মের বাইরেও যে অনেক কিছু বিবেচনার আছে, সেগুলো তিনি তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শেখাবেন। সার্জারির আগে রোগীকে কী জানালে, কী না জানালে সার্জারি সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে, তা শেখাবেন। সার্জারির পরে কী কী সতর্কতা নিলে ইনফেকশন কম হবে, তা শেখাবেন। এই প্রজ্ঞা বই পড়ে আসে না। এগুলো কারও কাছ থেকে শিখতে হয়, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে অর্জন করতে হয়।
একইভাবে ইসলামের শিক্ষা শুধু কিছু আয়াতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিটি আয়াতের পেছনে প্রজ্ঞা রয়েছে। কখন কোন প্রেক্ষাপটে কুর’আনের কোন আয়াত প্রযোজ্য, কখন কোন প্রেক্ষাপটে তা প্রযোজ্য নয় —এগুলো আমাদেরকে রাসুলের, তার অনুসারীদের এবং ফিকহ-এ অভিজ্ঞদের কাছ থেকে শিখতে হবে। না হলে আমরা কুর’আনের আয়াতের আক্ষরিক অনুবাদ করে, পরিস্থিতি বিবেচনা না করে, প্রজ্ঞা ব্যবহার না করে ঝাপিয়ে পড়ব নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে। যার ফলাফল হবে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, এখানে ওখানে বোমাবাজি, খুনাখুনি ইত্যাদি করে ধরে নেওয়া: কুর’আনের আয়াত অনুসারে ইসলামের রাষ্ট্র বাস্তবায়নে জিহাদ করা হয়ে গেল। অথচ দেখা যাবে, কুর’আনের অন্য আয়াত অনুসারে সেগুলো জিহাদ হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো ফাসাদ হয়ে গেল এবং যারা তা করলেন তারা জিহাদির সন্মানের বদলে ফাসিক হয়ে গেলেন।
যদি কুর’আনের আয়াত শুধু পড়াটাই যথেষ্ট হতো, তাহলে নবি ইব্রাহিম عليه السلام শুধু يَتْلُوا۟ ‘তিলাওয়াত করে’ বলেই শেষ করে দিতেন। তিনি এরপর يُعَلِّمُ ‘শেখাবে’ যোগ করতেন না, এবং ٱلْحِكْمَة ‘প্রজ্ঞা’ উল্লেখ করতেন না। তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে, মানুষকে ঠিকমতো না শেখালে, বিশেষ করে তাদেরকে প্রজ্ঞা না শেখালে সর্বনাশ হয়ে যাবে। একারণে তিনি বিশেষভাবে প্রজ্ঞা শেখানোর কথা বলেছেন। তার প্রজ্ঞা থেকে করা এই দুআ এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, আল্লাহ কুর’আনে তা রেকর্ড করে কোটি কোটি মানুষকে শেখানোর জন্য দিয়ে দিয়েছেন।
“তাদেরকে পবিত্র করবে”
তাজকিয়া বা পরিশুদ্ধতা দুই ধরনের— ১) বুদ্ধিবৃত্তিক পরিশুদ্ধতা, ২) চারিত্রিক পরিশুদ্ধতা। এই দুটোই আমাদের জন্য খুবই জরুরি। যদি আমাদের যথেষ্ট জ্ঞান থাকে, প্রজ্ঞাও থাকে, কিন্তু চারিত্রিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক পরিশুদ্ধতা না থাকে, তাহলে আমরা হয়ে যাবো একজন জ্ঞানী এবং চালাক শয়তান। কারণ ইবলিশের যথেষ্ট জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা ছিল। কিন্তু তার ভেতরে পরিশুদ্ধতা ছিল না।
বুদ্ধিবৃত্তিক পরিশুদ্ধতা হলো নানা ধরনের ভুল ধারণা, কুসংস্কার, নিজের মতো কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, কোনটা মানবো, কোনটা মানবো না —এগুলো থেকে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা। যেমন: আমরা হয়ত নিয়মিত কুর’আন পড়ি, হাদিসের বই পড়ি, টিভিতে দিনরাত লেকচার শুনি, কিন্তু ওদিকে সোমবারে মাজারে গিয়ে ব্যবসা বাড়ানোর জন্য মৃত পীর সাহেবের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করে আসি।
অথবা, হতে পারে আমরা অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত এবং অনেক চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়াটা আসলে অইসব অর্ধ শিক্ষিত রাস্তাঘাটের গরীব লোক, মাদ্রাসার লোকদের জন্য, কারণ তারা আমাদের মতো উচ্চ পর্যায়ের চিন্তা করতে পারে না, আল্লাহকে تعالى গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারে না। যারা বিজ্ঞান, ফিলসফি নিয়ে অনেক পড়াশুনা করেছে, তারা আল্লাহকে تعالى অনেক ভালোভাবে বুঝতে পারে। তাদের জন্য দিনে পাঁচবার নামাজে উঠবস করার কোনো দরকার নেই।
—এইসব ভয়ংকর ধারণা এবং বিশ্বাস থেকে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। এটা তাজকিয়ার একটি অংশ।
আর চারিত্রিক পরিশুদ্ধতা হলো: কীভাবে আমরা কথা বলি, মানুষের সাথে ব্যবহার করি, চলাফেরা করি, মেলামেশা করি, অবসর কাটাই, বিনোদন করি ইত্যাদিকে পরিশুদ্ধ করা। যেমন, আমরা হয়ত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, যাকাত দেই, ফেইসবুকে সারাদিন ইসলামের উপর পোস্ট পড়ি, পোস্ট করি, কিন্তু ওদিকে বাসায় ফিরে স্ত্রীর সাথে চরম দুর্ব্যবহার করি। স্বামী আর ড্রাইভারের সাথে একই ভাষায় কথা বলি। কে কবে কোথায় কাকে নিয়ে কী বলল — এই নিয়ে ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টার প্যাঁচাতে থাকি। একশ টাকার জিনিস কিনে অফিসে দুইশ টাকার বিল জমা দেই। পিয়নকে বছরে একটাকাও বখশিশ দেই না, কিন্তু পার্টনারকে ঠিকই অফিসের খরচে কক্সবাজারে বেড়াতে যেতে দেই।
—এই সব নোংরামি থেকে নিজেকে পরিশুদ্ধ করাটা হবে চারিত্রিক পরিশুদ্ধতা।
যদি আমরা নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ না করি, তাহলে অমুসলিমরা আমাদেরকে দেখবে, আর ভাববে, “ছিঃ! এই হচ্ছে ইসলাম? এরা মনে করে এরা সঠিক পথে আছে, আর আমরা সবাই ভুল পথে আছি? এরা চায় যে, আমরা এদের মতো হই? এরাই আবার বড় গলায় বলে যে, এরা সারা পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করবে?”
“নিঃসন্দেহে আপনি সর্বোচ্চ ক্ষমতা-কর্তৃত্বের অধিকারী, পরম প্রজ্ঞাবান”
এখানে আমরা আল্লাহর تعالى দুটো সুন্দর গুণের কথা জানবো— ১) ٱلْعَزِيز আল-আজিজ, ২) ٱلْحَكِيم আল-হাকিম।
ٱلْعَزِيز আল-আজিজ হচ্ছে যার ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব দুটোই রয়েছে। কারও অনেক ক্ষমতা থাকতে পারে, কিন্তু তার যদি কোনো কর্তৃত্ব না থাকে, তাহলে সে তার ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারবে না। যেমন, পুলিশ বাহিনী। তাদের যথেষ্ট ক্ষমতা। কিন্তু তাদের কর্তৃত্ব খুবই কম। একারণে ক্যাডাররা তাদের নাকের ডগা দিয়ে যা খুশি করে যেতে পারে, কিন্তু তারা কিছুই করতে পারে না।
আবার কারও অনেক কর্তৃত্ব থাকতে পারে, কিন্তু যদি ক্ষমতা না থাকে, তাহলে সে তার কর্তৃত্ব খাঁটাতে পারবে না। যেমন, কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট। তার যথেষ্ট কর্তৃত্ব। কিন্তু তার ক্ষমতা খুবই কম। তাই কর্তৃত্ব থাকা সত্ত্বেও সে কিছুই করতে পারছে না। সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী তার বিশাল ক্ষমতা নিয়ে যা করার করে যাচ্ছে।
আল্লাহ تعالى হচ্ছেন আল-আজিজ: সমস্ত ক্ষমতা তাঁর এবং সেই ক্ষমতা যখন, যেভাবে খুশি ব্যবহার করার সমস্ত কর্তৃত্ব তাঁর হাতে। কেউ তাঁকে কিছুই বলতে পারে না।
ٱلْحَكِيم হাকিম: অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান। আল্লাহ যখন আমাদের জীবনে কিছু করেন, তিনি তাঁর অসীম প্রজ্ঞা দিয়ে সেটা করেন। সেটা আমরা বুঝতে পারি, আর নাই পারি। তিনি যখন কাউকে কাউকে পথে বসিয়ে দেন, তিনি সেটা করেন কারণ তিনি জানেন: যখন সে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে, তখন সে সম্পদের মূল্য বুঝবে, গরিবদের কষ্ট বুঝবে, অহংকার কম করবে, সবসময় শুধু নিজের এবং নিজের পরিবারের কথা না ভেবে আত্মীয়স্বজন, পাড়ার গরিবদের জন্য কিছু করবে।
একইসাথে তিনি যখন কারও আপনজনকে নিয়ে যান, তিনি জানেন সেই আপনজনকে হারিয়ে সে মানসিকভাবে আরও শক্ত হবে, জীবনযুদ্ধ শক্ত হাতে মোকাবেলা করবে, নিজে জয়ী হবে, অন্যকে জয়ী হতে সাহায্য করবে।
আবার তিনি যখন কাউকে কঠিন অসুখ দিয়ে বিছানায় ফেলে রাখেন, তিনি জানেন তার এই অসুখ তার পরিবারের মানুষগুলোকে একসাথে করে দেবে। পরিবারের সদস্যরা যে যার মতো দূরে সরে না গিয়ে, আরও কাছাকাছি হবে। একে অন্যকে সান্ত্বনা দেবে। একে অন্যের বিপদে পাশে থাকবে। তাদের বংশধরদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন আরও শক্ত হবে। অসুস্থ মানুষটাকে কেন্দ্র করে পরিবারের দুই-তিন প্রজন্ম একসাথে থাকবে। অসুস্থ মানুষটাকে দেখে তারা নিজেরা নিজেদের সুস্থতার মূল্য বুঝবে, আল্লাহর تعالى প্রতি আরও কৃতজ্ঞ হবে। এই কৃতজ্ঞতা তাদেরকে নানা ধরনের মানসিক সমস্যা থেকে মুক্ত রাখবে।
আমরা আল্লাহর تعالى এই গভীর প্রজ্ঞা এবং পরিকল্পনা না বুঝে, অনেক সময় রেগে গিয়ে তাঁকে দোষ দিয়ে দেই। মনে করি, তিনি আমাদের বিরুদ্ধে চলে গেছেন। আমাদেরকে ভুলে গেছেন। আমাদেরকে কোনো কারণ ছাড়া কষ্টে রাখছেন। আমরা ভুলে যাই: তিনি আল-হাকিম, অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান। তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনে বিরাট কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। তিনি আমাদের জীবনে যা কিছুই করেন, তার সবকিছুই তাঁর মহাপরিকল্পনার অংশ।
যে নিজেই নিজেকে বোকা বানায়, সে ছাড়া আর কে ইব্রাহিমের ধর্ম থেকে মুখ ফেরাবে? আমি অবশ্যই ইব্রাহিমকে এই দুনিয়াতে বিশেষভাবে বেছে নিয়েছি। আর নিঃসন্দেহে সে পরকালে শান্তি-ন্যায় প্রতিষ্ঠাকারীদের সারিতে থাকবে। [আল-বাক্বারাহ ১৩০]
নবি ইব্রাহিম عليه السلام-এর কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। তিনি আমাদেরকে যে ধর্ম দিয়ে গেছেন, শুধু সেটাই নয়, তার জীবনের ঘটনাগুলো, সে সব ঘটনায় তার প্রতিক্রিয়া, তার কথা, কাজ, আচরণ থেকে আমাদের বিরাট সব শিক্ষা নেওয়ার আছে। আমরা যদি তার কাছ থেকে না শিখি, তাহলে আমরা অনেক বড় বোকামি করব। ভুল চিন্তা, ভুল বিশ্বাসে ডুবে থেকে অশান্তি, হতাশার জীবন পার করব। আল্লাহ নবি ইব্রাহিমকে عليه السلام বিশেষভাবে বেছে নিয়েছিলেন, কারণ তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ মানুষ, অসাধারণ চরিত্র, অত্যন্ত বুদ্ধিমান একজন পুরুষ, একজন পিতা, একজন স্বামী। তিনি শুধু তার পরের নবিদের জন্যই আদর্শ ছিলেন না, তিনি আমাদের প্রত্যেকের জন্যও এক বিরাট আদর্শ।
সূত্র:
- [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
- [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
- [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
- [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
- [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
- [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
- [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
- [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
- [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
- [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
- [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
- [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
- [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
- [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
- [১৫] তাফসির আল জালালাইন।
- [২৬৩] তিলাওয়াত শব্দের বিস্তারিত অর্থ: http://ejtaal.net/aa/img/br/1/br-0160.png, http://www.onislam.net/english/shariah/quran/recite-a-memorize/455998-tilawah-quran-recitation-revisited.html
Alhamdulillah , Khub valo laglu.