আমি সমর্পণ করলাম সকল সৃষ্টির প্রভুর প্রতি — আল-বাক্বারাহ ১৩১

সুধীবৃন্দদেরকে যখন বলা হয় ধর্মে বিশ্বাস করতে, তখন তারা প্রশ্ন করেন: কেন? কীজন্য আমাদের আল্লাহকে تعالى মানতে হবে? আল্লাহ تعالى আছে প্রমাণ কী? তোমরা নিজেদের ইচ্ছামত নিয়মকানুন বানিয়ে আমাদেরকে মানানোর চেষ্টা করছ, যাতে করে আমরা তোমাদের কথা মতো চলি। আর তখন আমাদেরকে তোমরা ইচ্ছেমত ব্যবহার করতে পারো। শুধু তোমাদের কথার উপর ভরসা করে আমরা আমাদের জীবন পালটিয়ে ফেলতে পারবো না। আমাদেরকে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দেখাতে হবে। একদম নিজের চোখে কিছু একটা দেখাতে হবে, যা আমাদের সব সন্দেহ দূর করে দেবে।

নবী ইব্রাহিমকে عليه السلام যখন বলা হয়েছিল আল্লাহর تعالى প্রতি সমর্পণ করতে, তখন তিনি কী বলেছিলেন দেখা যাক—

2_131_title

2_131

যখন তাকে তার প্রভু বললেন, “সমর্পণ করো”, তিনি সাথে সাথে বললেন, “আমি সমর্পণ করলাম সকল সৃষ্টির প্রভুর প্রতি।” [আল-বাক্বারাহ ১৩১]

একজন নবী হচ্ছেন সেই যুগের সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষদের একজন। একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমান, সুযোগ্য মানুষ ছাড়া আর কারো পক্ষে কোনো দেশের দাগী আসামী, রাজনীতিবিদ, জমিদার, মাতব্বরদেরকে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। সুধীবৃন্দরা অনেকে দাবি করেন: নবীরা ছিলেন মানসিক রোগী, তাদের মতিবিভ্রম হতো, তাই তারা গায়েবী বাণী শুনতেন। আবার অনেকে দাবি করেন: নবীরা ছিলেন আসলে অত্যন্ত চালাক ক্ষমতা লোভী প্রতারক, যারা ক্ষমতার জন্য মানুষকে ধোঁকা দিয়ে গেছেন। দেখা যাক এই দাবিগুলো কতখানি যুক্তিযুক্ত—

একজন নবী মানসিক রোগী হতে পারেন না, কারণ সমাজের শত শত বুদ্ধিমান, সন্মানিত, জ্ঞানী মানুষদেরকে একজন মানসিক রোগী কখনো নেতৃত্ব দিতে পারে না। সে বড় জোর কিছু অল্পশিক্ষিত, সরলমনা মানুষকে রাজি করাতে পারবে তাকে অনুসরণ করতে। অনেকগুলো বুদ্ধিমান মানুষ ঠিকই ধরে ফেলবে যে, সে আসলে মানসিক বিকারগ্রস্থ, তার কথাবার্তায় অনেক ফাঁকফোকর আছে। একসাথে অনেকগুলো বুদ্ধিমান মানুষ কখনো একজন মানসিক রোগীর কথায় নিশ্চিত হয়ে নিজেদের জীবন দিয়ে দেবে না।

একজন নবী কোনো ভণ্ড পির নন, কারণ ভণ্ড পিররা সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় না। তাদের লক্ষ মুরিদ নিয়ে দেশের সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে না। গরিবদের পাশে দাঁড়ায় না। এরা নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যস্ত থাকে। এরা কখনো এমন কিছু করবে না, এমন কারো বিরুদ্ধে কিছু বলবে না, যা তাদের আয়ের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে।

একজন নবী কোনো ধূর্ত জিনিয়াস নন, কারণ ধূর্ত জিনিয়াসরা কোনো এক বিষয়ে বিরাট প্রতিভা দেখালেও, তারা একই সাথে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজবিদ্যা, যুদ্ধবিদ্যা, মানুষের সাইকোলজিতে এত দক্ষ হয় না। তারা সমাজের উঁচু স্তরের বিত্তবান, জ্ঞানী মানুষদের থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, এতিম, দাস —সব ধরনের মানুষের সাথে একসাথে কাজ করতে পারে না।

একসাথে এত গুণ খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখা গেছে। একারণেই অমুসলিমদের বইয়েও ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষদের তালিকায় নবীদেরকে সবার উপরে দেখা যায়। এই অমুসলিম গবেষকরা বোকা নন। তারা ভালো করে জানেন: তাদের তালিকায় বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, লেখকদের ডিঙ্গিয়ে কোনো ধর্ম প্রচারকের নাম সবার উপরে দিলে কী ঘটবে। কিন্তু তারপরেও তারা আমাদের নবীকেই তাদের তালিকায় শীর্ষ স্থান দিয়েছেন।

“আমি সমর্পণ করলাম বিশ্ব জগতের প্রতিপালকের প্রতি”
নবী ইব্রাহিম عليه السلام বলতে পারতেন, “আমি আপনার প্রতি সমর্পণ করলাম।” কিন্তু তিনি সেটা না বলে বলেছেন, “আমি সমর্পণ করলাম সকল সৃষ্টির প্রভুর প্রতি।” এই কথার মধ্য দিয়ে তিনি শুধু যে সমর্পণ করছেন, সেটাই বলছেন না, একইসাথে বলছেন: কেন তিনি সমর্পণ করছেন।[১১]

রাব্বুল আলামিন শব্দটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। রাব্ব শব্দটির সাধারণত বাংলা অনুবাদ করা হয় ‘প্রভু’। কিন্তু আল্লাহ অন্য সব প্রভুর মত নন। তাঁর সাথে কোনো কিছুরই কোনো তুলনা চলে না। প্রভু-দাস এই শব্দগুলো সম্পর্কে আমাদের কোনো ভালো ধারণা নেই, কারণ প্রভু হিসেবে মানুষ সাধারণত সবসময়ই নিষ্ঠুর, স্বেচ্ছাচারী, অত্যাচারী হয়। আর দাস বলতে আমরা সবসময় বুঝি অত্যাচারিত, অধিকার বঞ্চিত, গরিব মানুষ। কিন্তু আল্লাহ তাঁর নিজের সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন সুরা ফাতিহাতে—

আল্লাহর নামে, পরম করুণাময়, নিরন্তর করুণাময়। সমস্ত প্রশংসা-মহিমা-ধন্যবাদ আল্লাহর, যিনি সৃষ্টি জগতের প্রভু। পরম করুণাময়, নিরন্তর করুণাময়। [সূরা ফাতিহা ১:১-৩]

এখানে আল্লাহ বার বার বলেছেন, তিনি হচ্ছেন পরম করুণাময়, নিরন্তর করুণাময় প্রভু। তিনি মানুষের মতো অল্প করুণাময়, মাঝে মাঝে করুণাময় নন। তিনি কিন্তু শুধুই বলতে পারতেন, “তিনি পরম করুণাময়”, ব্যাস। কিন্তু একজন পরম করুণাময় কিন্তু সবসময় করুণা না-ও দেখাতে পারেন। তিনি সকালে করুণা দেখালেন, রাতে আর দেখালেন না। কিন্তু না, তিনি নিরন্তর করুণাময়, তিনি প্রতি মুহূর্তে আমাদেরকে করুণা করছেন।

আমরা যখন ভোরে উঠে ফজরের এলার্ম বন্ধ করে নামাজ পড়ব কি না, তা কিছুক্ষন চিন্তা ভাবনা করে আবার ঘুম দেই, তখন আমাদের একটা হাত খুলে পড়ে যায় না। আমরা যখন একজন অন্ধ ফকিরের পাশ দিয়ে না দেখার ভান করে হেটে চলে যাই, তখন আমাদের চোখ দুটো নষ্ট হয়ে যায় না। আমরা যখন নিজের দোষ ঢাকার জন্য বানিয়ে একটা মিথ্যা ঘটনা বলি, তখন আমাদের চোয়াল ভেঙ্গে যায় না। কারণ আল্লাহ নিরন্তর করুণাময়। আমরা তাঁর এক মামুলি দাস হয়ে দিনের বেশিরভাগ সময় তাঁর আদেশ অমান্য করে, তাঁকে আমাদের পরিবারের সদস্যদের চাহিদা থেকেও কম গুরুত্ব দিয়ে, ‘লোকে কী বলবে’ এই ভয়ে ক্রমাগত তাঁর আদেশ উপেক্ষা করার পরেও, তিনি আমাদেরকে প্রতিদিন ছেড়ে দেন। কারণ তিনি নিরন্তর করুণাময়, চরম ধৈর্যশীল।

এছাড়াও তিনি বলেছেন—সমস্ত প্রশংসা, মহিমা, ধন্যবাদ তাঁর। তিনি যাই করেন, সেটাই প্রশংসনীয়। সেটা আমরা আমাদের নগণ্য বুদ্ধি দিয়ে বুঝি, আর নাই বুঝি। একটা সামান্য পিঁপড়া যেভাবে হাজার হাজার পিঁপড়ার সাথে ক্রমাগত যোগাযোগ করে, যার সমকক্ষ কোনো কিছু মানুষ এখনও তৈরি করতে পারেনি; যেভাবে মৌমাছিরা ভূমিকম্প প্রতিরোধক বাসা তৈরি করে, যা মানুষ এখনও বানাতে পারেনি, যেভাবে এক মামুলি ঘাস নাইট্রোজেন জমা করে হাজার ধরণের ছোট বড় প্রাণীকে প্রোটিন সরবরাহ করে, যার ধারে কাছে কোনো কিছু মানুষ বানাতে পারেনি—এসব কিছুর মধ্যে আল্লাহর বিরাট প্রশংসা এবং মহিমা রয়েছে। আমরা মানুষেরা যদি আল্লাহর এই মহিমা উপলব্ধি করে তাঁর প্রশংসা না করি, আল্লাহর তাতে কিছুই যায় আসে না। আমরা শুধুই নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবো।

কেন আমরা আল্লাহর تعالى প্রতি সমর্পণ করবো?

আমরা অনেকে মনে করি: ধর্ম মানেই হচ্ছে সবসময় আল্লাহর تعالى ভয়ে ভয়ে থাকা। জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তির কথা সবসময় মনে রেখে মুখ গোমড়া করে ভালো কাজ করে চলা। কোনো কারণে আমাদের অনেকের ভিতরে “ধর্ম মানেই ভয়”, এই ধারণাটি ঢুকে গেছে। আমাদের অনেকে তাদের ছেলে মেয়েদেরকে ছোট বেলা থেকেই ‘আল্লাহ’ নামের এক ভয়ংকর কোনো কিছুর ভয় দেখিয়ে বড় করি। বাচ্চারা আমাদের কথা না শুনলে, দুষ্টামি করলে, আল্লাহর تعالى ভয় দেখাই। কোনো ভালো কাজ না করলে, আল্লাহর تعالى শাস্তির ভয় দেখাই। একারণে তারা ছোটবেলা থেকে বড় হয় আল্লাহর تعالى সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা নিয়ে। তারা মনে করে: আল্লাহ تعالى মানেই হচ্ছে হেডমাস্টারদের মতো বদরাগী, কথায় কথায় শাস্তি দেয় এমন এক ভয়ংকর সত্ত্বা, যাকে আমাদের সারাজীবন ভয় করে চলতে হবে। একারণে তারা যখন বড় হয়ে ইসলাম মানার চেষ্টা করে, তখন সেই চেষ্টার মধ্যে না থাকে কোনো আন্তরিকতা, না থাকে কোনো ভালবাসা, থাকে শুধুই কিছু আনুষ্ঠানিকতা।

ছোটবেলায় বাবা-মাকে খুশি করার জন্য, তাদেরকে গর্ব করার মতো কিছু দেওয়ার জন্য ছেলেমেয়েরা নিজেদের জান দিয়ে দেয়। কিন্তু আল্লাহকে تعالى খুশি করার জন্য কিছু করার মধ্যে তাদের কোনো আন্তরিক আগ্রহ থাকে না। বরং কোনোভাবে আল্লাহর تعالى হাত থেকে বাঁচার জন্য কমপক্ষে যেটুকু করে পার পাওয়া যায়, সেটুকুই করার চেষ্টা করে।

সুরা ফাতিহা পড়ে দেখুন। কোথাও বলা আছে আল্লাহকে تعالى ভয় পেতে? বরং প্রথম আয়াতটিই হচ্ছে: “সমস্ত প্রশংসা-ধন্যবাদ আল্লাহর, যিনি পরম দয়ালু, নিরন্তর দয়ালু।” সেখানে কিন্তু বলা নেই, “সমস্ত আতঙ্ক আল্লাহর প্রতি, যিনি রাগী, নিষ্ঠুর।” সুরা ইখলাস পড়ে দেখুন –কোনো ভয়ের চিহ্ন নেই। সুরা ফালাক, নাস এরকম যত কমন সুরা আমরা সবাই ছোটবেলা থেকে শিখে এসেছি, কোথাও আপনি পাবেন না যে, আল্লাহ تعالى একজন ভয়ঙ্কর কঠিন, বদরাগী সত্ত্বা। বরং তাঁর অসীম করুণা, নিরন্তর দয়া, মানুষের প্রতি তাঁর অপরিসীম ধৈর্য, চরম সহনশীলতা, অসীম ক্ষমা –এই সব আশার বাণী দিয়ে কু’রআন ভরে আছে।

আমরা কোনো কারণে সেই ইতিবাচক বাণীগুলোর উপর মনোযোগ না দিয়ে, খালি শাস্তির বাণীগুলোর উপর মনোযোগ দেই। কু’রআনে কতগুলো জাহান্নামের আয়াত আছে, কত জায়গায় আল্লাহ تعالى শাস্তির কথা বলেছেন, শুধু সেগুলোকে নিয়ে ডিপ্রেশনে ভুগি। যার ফলে আমাদের অনেকেরই আল্লাহর تعالى সাথে সম্পর্ক হয়ে যায় খুব আনুষ্ঠানিক একটা সম্পর্ক। আমরা তাঁকে মনে প্রাণে ভালবাসতে পারি না। তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা থাকে একধরণের তিক্ততা মিশ্রিত। তাঁর ইবাদত করি অনেকটা ঠেকায় পড়ে।

অথচ উলটোটা হওয়ার কথা ছিল। আপনার চারপাশে তাকিয়ে দেখুন। আল্লাহ تعالى কোন জিনিসটা আপনাকে ভয় দেখানোর জন্য দিয়েছেন? আপনি কি সকালে ঘুম থেকে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভয়ে লাফ দিয়ে উঠেন? আপনি শ্বাস নেওয়ার সময় আপনার ভিতরে কী ঢুকে গেল এই নিয়ে ভয়ে থাকেন? খাবার খাওয়ার সময় ভয়ে ভয়ে খান? একটা কলার খোসা ছিলে আতংকে চিৎকার দিয়ে উঠেন? চারপাশে সবুজ গাছপালা, হাজারো রঙের ফুল, আকাশে শত শত পাখি, মাঠে সবুজ ঘাস, পাহাড়, নদী, সমুদ্র, সূর্য, চাঁদ, তারা – কোনটা দিয়ে আল্লাহ تعالى আপনাকে প্রতি মুহূর্তে ভয় দেখাচ্ছেন? কোনটা দেখে আপনার মনে হয় আল্লাহ تعالى একজন ভয়ংকর রাগী কেউ?

আপনি শুধু এক আকাশের দিকে তাকিয়ে একটু চিন্তা করুন—

তারা কি উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে না? আমি কীভাবে সেটাকে বানিয়েছি এবং কীভাবে সেটাকে সুন্দর করেছি, যাতে কোনো ফাটল নেই? [সূরা ক্বাফ:৬]।

দেখুন, আল্লাহ تعالى আকাশে সবচেয়ে প্রশান্তিকর দুটো রঙ: সাদা এবং হালকা নীল ব্যবহার করেছেন এবং আকাশে মেঘগুলো কত শান্তভাবে ধীরে ধীরে চলে। কোটি কোটি টন পানি প্রতিদিন আমাদের মাথার উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে শৃঙ্খলভাবে, কোনো ট্রাফিক জ্যাম নেই, কোনো শব্দ হচ্ছে না, কোনো মেঘ পড়ে যাচ্ছে না, আমরা কেউ আতংকে থাকছি না। তিনি যদি আকাশটিকে মঙ্গল গ্রহের আকাশের মতো লাল এবং ভয়ংকর অশান্ত করতেন, তাহলে আমরা সারা দিনরাত আতংকে থাকতাম এবং আমাদের বাসাগুলোকে হয় অত্যন্ত মজবুত এবং বড় জোর এক-দুই তলার মধ্যে রাখতে হতো, না হয় মাটির নিচে বাসা বানাতে হতো। কিন্তু না, আমরা খোলা নীল আকাশের নীচে, সবুজ মাঠে, হলুদ সরিষা ক্ষেতে কত আনন্দ নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারি!

আপনি যখন জন্ম হয়েছিলেন, বাথরুম করে গা মাখামাখি করে ফেলতেন, তখন আল্লাহ تعالى আপনাকে দুজন মানুষ আপনার সেবায় ২৪ ঘণ্টা নিবেদিত করে দিয়েছিলেন, যাতে আপনার মৌলিক প্রয়োজনগুলো মেটাতে আপনাকে কিছুই করতে না হয়। তারা কোনো এক অদ্ভুত কারণে নিজেদের খাওয়া, ঘুম, আরাম সব ত্যাগ করে, চরম মানসিক এবং শারীরিক কষ্ট সহ্য করে, নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, আপনার জন্য যখন যা করা দরকার তাই করেছিলেন। তারপর আপনি একটু বড় হলেন, আপনার খাবার, জামাকাপড়, পড়ালেখা সব কিছুই আপনার হয়ে কেউ না কেউ ব্যবস্থা করে দিল। আপনার সঙ্গী দরকার, আল্লাহ تعالى আপনাকে বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে একদিন আপনার জীবন সঙ্গী দিয়ে দিলেন। আপনি পৃথিবীতে আপনার নাম রেখে যেতে চান, আল্লাহ تعالى আপনাকে বংশধরের ব্যবস্থা করে দিলেন। শুধুমাত্র মানুষের তৈরি বিকৃত সমাজ, দেশ, সরকার ছাড়া, আল্লাহ تعالى কোন প্রাকৃতিক জিনিসটা দিয়ে আপনাকে সবসময় ভয়ের মধ্যে রাখছেন?

তিনি যদি সত্যি একজন রাগী সত্ত্বা হতেন এবং তিনি চাইতেন আমরা সবসময় তাঁর ভয়ে থাকি, তাহলে আমাদের চারপাশের জগতটা প্রাকৃতিকভাবেই হতো নিষ্ঠুর। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমাদের দুশ্চিন্তায় হাত-পা কাঁপা শুরু হয়ে যেত যে, রাত পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারবো কি না। কিন্তু তা হয়নি। কারণ আল্লাহ تعالى পরম করুণাময়, নিরন্তর করুণাময়। তিনি অল্প করুণাময়, মাঝে মাঝে করুণাময় নন। আমরা সারাদিন নামাজে ফাঁকি দিয়ে ঘুমাতে যাই, কিন্তু পরদিন ঠিকই সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠতে পারি। আমরা কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি আত্মসাৎ করি, গরীবের হক মেরে দেই, কিন্তু তারপরেও শ্বাস নেওয়ার জন্য বাতাসের অভাব হয় না, তৃষ্ণা মেটাবার জন্য পানির অভাব হয় না। আমরা বনজঙ্গল উজার করে দেই, প্রকৃতিকে ধ্বংস করি, কিন্তু তারপরেও বনের সব পশু পাখি, পোকামাকড় একসাথে সংঘবদ্ধ হয়ে আমাদেরকে আক্রমণ করে শেষ করে দেয় না। কারণ আল্লাহ تعالى প্রচণ্ড ক্ষমাশীল।

আপনি, আমি তাঁর মহা পরিকল্পনার কিছুই না-ও বুঝতে পারি। আমাদের জীবনে কেন সমস্যাগুলো হল, সেগুলোর আসল কারণ কী —সেটা চিন্তা করে না-ও বের করতে পারি। কিন্তু তাই বলে আল্লাহকে تعالى ছোট করে, তাকে না বুঝে, ঠিকমতো চিন্তাভাবনা না করে, তাকে একটা ভয়ংকর কিছুতে পরিণত করার মতো অন্যায় করতে পারি না।

আসুন আমরা আল্লাহর تعالى দয়াকে উপলব্ধি করার মানসিকতা তৈরি করি। আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে শেখাই যে, এই যে আমাদের কম্পিউটারটা, এটা বানানোর জন্য সবকিছু আল্লাহ تعالى আমাদেরকে প্রকৃতিতে দিয়ে রেখেছেন। আজকে আমরা যে মজার ভাত, মাছ, ডাল খাচ্ছি, এগুলো সবই আল্লাহর تعالى তৈরি করা —আল্লাহই تعالى এগুলোকে এত সুস্বাদু করে বানিয়েছেন। কালকে যে নতুন জামাটা কিনে দিলাম, সেটাও আল্লাহর تعالى দেওয়া, কারণ আল্লাহই تعالى আমাকে উপার্জনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, যা না থাকলে এই জামাটা কিনতে পারতাম না। অসুখ হলে সেটা ভালো করার জন্য ওষুধ বানানোর সব উপাদান আল্লাহই প্রকৃতিতে দিয়ে রেখেছেন।

এভাবে প্রতিদিনের সব ভালো ব্যাপারগুলো যে আল্লাহর تعالى কৃতিত্ব, সেগুলো আমরা নিজেরা বুঝি এবং আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে বোঝাই। তাহলে তারা বড় হবে আল্লাহর تعالى সম্পর্কে একটা সুন্দর ধারণা নিয়ে। তাদের জীবনে আল্লাহর تعالى এত চমৎকার সব অনুগ্রহের বিনিময়ে তাঁকে খুশি করার জন্য তারা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কাজ করবে। নামাজে দাঁড়াবে কৃতজ্ঞতা, ভালবাসা নিয়ে। সিজদায় মাথা নত করবে বুক ভরা শ্রদ্ধা নিয়ে। এভাবেই আমরা নিজেদেরকে এবং তাদেরকে আল্লাহর تعالى আরও কাছে নিয়ে যেতে পারবো, তাঁর সাথে একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করতে পারবো। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠবো হাঁসি মুখে, “আজকে আল্লাহ تعالى আমাকে আরেকটা চমৎকার দিন দিয়েছেন!” –এই আগ্রহ নিয়ে, এবং রাতের বেলা চোখ বন্ধ করবো বুক ভরা শান্তি নিয়ে, আল্লাহকে تعالى অনেক ধন্যবাদ দিয়ে।

আসুন আমরাও বলি—

“আমি সমর্পণ করলাম সকল সৃষ্টির প্রভুর প্রতি।”

[পুনশ্চ: এই আর্টিকেলের উদ্দেশ্য নয় যে, আপনি আল্লাহকে ভয় করা বন্ধ করে যা খুশি তাই করা শুরু করেন এবং নিজের পাপগুলোকে ভুলে যান। মনে রাখবেন, আল্লাহ تعالى হচ্ছেন পরম বিচারক, তিনি আপনার প্রতিটি কাজের বিচার করবেনই। একই সাথে তিনি প্রচণ্ড ক্ষমাশীল এবং অসীম দয়ালু —এটাও সবসময় মনে রাখবেন।]

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *