তোমাদের উপরে আমি যে অনুগ্রহ করেছি, তা মনে করো — আল-বাক্বারাহ ১২২

মুসলিমরা যারা মনে করেন: ইসলামে প্রবেশ করার কারণে তাদের এক পা ইতিমধ্যে জান্নাতে চলে গেছে, আর একটু হলেই অন্য পা-টাও জান্নাতে চলে যাবে, তাদের জন্য আল-বাক্বারাহ’র এই আয়াতগুলো চিন্তার ব্যাপার, কারণ বনি ইসরাইল ঠিক একইভাবে চিন্তা করতো—

2_122

ইসরাইলের বংশধরেরা, তোমাদের উপরে আমি যে অনুগ্রহ করেছি, তা মনে করো। আমি অবশ্যই তোমাদেরকে সব জাতির থেকে বেশি অনুগ্রহ করেছি। [আল-বাক্বারাহ ১২২]

2_122_v2

কু’রআন পড়ার সময় আমরা যখন বনী ইসরাইল বা ইসরাইলের বংশধরদের কথা পড়ি, তখন ভাবি, “আরে, ওই ইহুদিরা কি খারাপটাই না ছিল। আল্লাহ কতবার ওদেরকে বাঁচিয়েছিলেন, তারপরেও ওরা কত খারাপ কাজ করতো। মুসা عليه السلام নবীকে কী কষ্টটাই না দিয়েছিল। ওদের থেকে আমরা কত ভালো জাতি।”

আসলেই কি তাই?

তারা তাদের নবীর عليه السلام অপমান করেছিল, অনেক মুসলিমরাও তাদের নবী মুহাম্মাদের عليه السلام অপমান করেছে: তাঁর নামে কয়েক লক্ষ জাল হাদিস প্রচার করে স্বল্প শিক্ষিত  মুসলিমদেরকে চরম ভুল পথে নিয়ে গেছে, বিদ’আত দিয়ে মুসলিম জাতির একটা বড় অংশকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছে।

বনী ইসরাইলেরা অহংকারী ছিল, তারা মনে করত: তারা হচ্ছে এক বিশেষ জাতি, যাদেরকে আল্লাহ تعالى বিশেষ সন্মান দিয়েছেন এবং তাদের মতো সন্মানিত জাতিকে আল্লাহ تعالى বিশেষ ভাবে রক্ষা করবেন।[২] এই গৌরব নিয়ে নাক উঁচু করে চলে শেষ পর্যন্ত তারা চরম অপমানিত হয়েছিল। তাদের উপরে আল্লাহর تعالى বিশেষ অনুগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। এক হিটলারই ৫৯ লক্ষ ইহুদিকে মেরে ফেলেছিল।

অনেক মুসলিম একই কাজ করেছে: তারা মনে করেছে তারা হচ্ছে সবচেয়ে সন্মানিত উম্মাহ, তারা যেভাবেই জীবনযাপন করুক না কেন, আল্লাহর تعالى বিশেষ অনুগ্রহ তারা পাবেই। যার ফলাফল: আজকে তারা এক চরম অপমানিত জাতি। সবসময় ভয়ে থাকে কবে তাদেরকে অন্য ‘কাফির’ দেশগুলো আক্রমণ করে শেষ করে দিবে। অন্য দেশতো দূরের কথা, নিজের দেশের সেক্যুলার সরকার কবে ধরে নিয়ে যাবে, এই আতংকে দিন পার করে।

বনী ইসরাইলরা তাদের ধর্ম গ্রন্থের বিকৃত অনুবাদ করত, নিজেদের সুবিধামতো কিছু নির্দেশ মানত, অসুবিধাজনক নির্দেশগুলো কৌশলে পরিবর্তন করে দিত—অনেক মুসলিম কু’রআনকে নিয়ে একই কাজ করেছে গত হাজার বছরে। এবং এখন সেটা আরও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। ইহুদিরা তাদের রাবাইদেরকে (আমাদের যেমন মাওলানা, শায়খ) অতিমানব পর্যায়ের মনে করে তাদের অন্ধ অনুসরণ করত। নিজেরা ধর্মীয় বই না পড়ে তাদের রাবাইরা যা বলত, সেটাকেই তারা ধর্মের অংশ মনে করত। আজকে অনেক মুসলিম নিজেরা কু’রআন না পড়ে মাওলানা-শায়খ-পীররা যা বলে, সেটাই অন্ধভাবে অনুসরণ করছে। অনেকে আবার তাদেরকে ঐশ্বরিক-মানব পর্যায়ের সন্মান দিয়ে মাজারে তাদের পূজা করছে।

কু’রআনে যেখানেই দেখবেন ইসরাইলের বংশধরদেরকে কিছু বলা হচ্ছে, মনে রাখবেন, এই কথাগুলো আসলে মুসলিমদেরকেই শেখানোর জন্য বলা হচ্ছে। কু’রআন শুধুই একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ নয় যে, এর মাধ্যমে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে শুধু ইতিহাস শেখাবেন, বরং কু’রআনের প্রতিটি আয়াত হচ্ছে মুসলিমদের জন্য পথ নির্দেশ। আল্লাহ تعالى ওদের মাধ্যমে আমাদেরকে–মুসলিমদেরকে দেখিয়ে দিচ্ছেন কী কী ভুল করা যাবে না; করলে কী ধরনের অপমান-দুঃখ-কষ্ট দুনিয়াতে ভোগ করতে হবে। মুসলিমদের ইতিহাস দেখলে দেখবেন বনী ইসরাইলদের সাথে আমাদের খুব একটা পার্থক্য নেই। তারা যে ভুলগুলো করেছিল, মুসলিমরাও সেগুলো করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে।[৩] যখনি বনী ইসরাইলদেরকে নিয়ে কোনো আয়াত পড়বেন, নিজেকে জিজ্ঞেস করবেন, “আমরাও একই ভুল করছি না তো?”

এই আয়াতে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো: আল্লাহ تعالى দুইবার ‘আমি’ বলেছেন, যেখানে কু’রআনে তিনি বেশিরভাগ আয়াতে ‘আমরা ‘ বা ‘রাজকীয়-আমি’ ব্যবহার করেন। সাধারণত ‘আমরা’ বা ‘রাজকীয়-আমি’ ব্যবহার করা হয় সম্মান, মর্যাদার সাথে দূরত্ব বোঝাতে। কু’রআনে খুব অল্প কিছু আয়াতে আল্লাহ تعالى এই দূরত্ব দূর করে তাঁর تعالى বান্দাদের কাছে এসে ‘আমি’ ব্যবহার করেন। এই আয়াতে তিনি দুই-দুইবার ‘আমি’ ব্যবহার করে বনি ইসরাইলকে এবং আমাদেরকে শেখাচ্ছেন: তিনি নিজে থেকে বনি ইসরাইলকে কতই না অনুগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু কী দুঃখের ব্যাপার সে জন্য তারা আল্লাহর تعالى প্রতি আরও নিবেদিত, কৃতজ্ঞ না হয়ে উলটো তাদের ধর্মীয় গুরুদের কাছে নিজেদেরকে সঁপে দিয়েছে।

ইসরাইল কী?

‘ইসরাইল’ একটি হিব্রু শব্দ, যার অর্থ–আল্লাহর বান্দা। নবী ইয়াকুব عليه السلام এর আরেকটি নাম হলো ইসরাইল। কু’রআনে ইহুদিদেরকে ‘ইয়াকুবের বংশধর’ না বলে ‘ইসরাইলের বংশধর’ বলা হয়েছে, যেন ইহুদিরা এটা ভুলে না যায় যে, তারা ‘আল্লাহর বান্দার’ বংশধর। তাদেরকে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে: তারা যেন তাদের রাবাইদের উপাসনা না করে, শুধুমাত্র আল্লাহরই উপাসনা করে।[৪]

আরেকটি ব্যাপার হলো: বনী ইসরাইল বলতে আজকের  ‘ইসরাইল’ নামক দেশে যারা থাকে, তাদেরকে বোঝায় না। বর্তমান ইসরাইল মূলত একটি সেক্যুলার দেশ। সেই দেশে সেক্যুলার-নাস্তিক বাসিন্দাদের সাথে তাদের ধর্মপ্রাণ ইহুদি বাসিন্দাদের মধ্যে ব্যাপক পরিমাণে সংঘর্ষ চলছে, যেমন  কিনা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেও  চলছে।[২৬৮] মুসলিম দেশগুলোতে যেমন শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে সবসময় মারামারি লেগেই আছে, সেক্যুলার সরকার ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের কোণঠাসা করে রেখেছে, অনুরূপ একই ঘটনা ঘটছে ইহুদিদের দুটি চরমপন্থি সম্প্রদায়ের মধ্যে এবং ইসরাইলের সেক্যুলার সরকার এবং ধর্মপ্রাণ ইহুদিদের মধ্যে।[২৬৯]

ইসরাইলের সংবাদ মাধ্যমগুলো কিছুদিন দেখলে এবং বিবিসির ডকুমেন্টারি দেখলে বুঝতে পারবেন: ইসরাইলে আজকে কী ভয়াবহ অবস্থা চলছে। অনেক মুসলিম দেশের মতো ইসরাইলেও অল্প কিছু এলাকা ছাড়া বাকি সব জেলাগুলো একেকটা যুদ্ধ ক্ষেত্রের মতো এবং পুরো দেশটি একটি গৃহ যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।[২৬৭] যারা বলে: মুসলিম জাতি হচ্ছে একটা খারাপ জাতি, অন্যদের সাথে ঝামেলা তো করেই, নিজেদের ভেতরেও মারামারি করে নিজেদেরকে শেষ করে দিচ্ছে— তাদেরকে ইসরাইলের খবরের কাগজগুলো কয়েকদিন পড়তে বলেন।

বনি ইসরাইল টাইপের মুসলিমরা

হাজার বছর আগে বনি ইসরাইলকে আল্লাহ تعالى অনেক সন্মান দিয়েছেন, কারণ তারা বড় বড় নবীদের عليه السلام বংশধর।[৬] এছাড়াও তাদের জন্য আল্লাহ تعالى মহাবিশ্ব পরিচালনার স্বাভাবিক নিয়ম ভেঙে, এমন সব অসাধারণ অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়েছেন, যেটা তিনি খুব কম করেছেন। শুধু তাই না, তারা মনে করত: তারা যতই কুকর্ম করুক, তাদের নবীদের عليه السلام উসিলায় ঠিকই তারা কিয়ামাতের দিন পার পেয়ে যাবে—হাজার হলেও নবী মুসা عليه السلام আছেন না? খোদ আল্লাহর تعالى সাথে কথা বলেছেন এমন একজন নবী! তার মতো এত বড় নবী عليه السلام  সুপারিশ করলে তাদের জান্নাতে যাওয়া আর ঠেকায় কে?[৬]

এই একই ধারণা আজকাল অনেক বনী ইসরাইল টাইপের মুসলিমদের মধ্যেও আছে, যারা মনে করে: তাদের বিরাট সব গুনাহ রাসুল মুহাম্মাদ عليه السلام এর অনুরোধ শুনেই আল্লাহ تعالى মাফ করে দেবেন। আবার অনেকে মনে করে: একজন পীর ধরলে, বা কোনো মাজারে মুরিদ হলে, বা কোনো শেখের-মাওলানার বায়াত নিলে, কিয়ামাতের দিন সেই পীর-শেখ-মাওলানা তাদের হয়ে আল্লাহর تعالى কাছে তদবির করে জান্নাতে যাবার জন্য ভিসা করে দিবেন।

এভাবে একমাত্র আল্লাহর تعالى যে ক্ষমতা আছে, সেই ক্ষমতা কোনো মানুষকে দিয়ে দেওয়া —এগুলো সবই একধরনের শির্‌ক এবং এই সব শাফাআতের ধারণা যে ভুল[২৬৫], তা আল্লাহ تعالى কু’রআনে একবার দুইবার নয়, বহু বার, বহু ভাবে, বহু উদাহরণ দিয়ে আমাদের সাবধান করেছেন। শুধুমাত্র বিশেষ কিছু প্রেক্ষিতে শাফাআত করা  হবে, তা পরে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

মানুষ কেন শাফাআত পাওয়ার চেষ্টা করে?

আসুন বোঝার চেষ্টা করি মানুষ কেন এই ধরনের শির্‌ক করে: শাফাআত পাওয়ার চেষ্টা করে। ধরুন, আপনি একটা কোম্পানিতে চাকরি করেন, যার চেয়ারম্যান খুবই ন্যায়পরায়ণ মানুষ। তিনি কাউকে কোনো ছাড় দেন না। প্রত্যেকের সাথে সমান আচরণ করেন এবং প্রত্যেকের কাজের খুঁটিনাটি হিসাব রাখেন। এখন তার অধীনে যে ডিরেকটররা আছে, তার মধ্যে একজন হচ্ছে আপনার মামা। আপনি জানেন যে আপনি যদি অফিসে একটু দেরি করে আসেন, মাঝে মধ্যে না বলে ছুটি নেন, হাজার খানেক টাকা এদিক ওদিক করে ফেলেন, তাতে কোনো সমস্যা নেই। চেয়ারম্যানের কাছে যদি একদিন ধরা পড়েও যান, আপনার মামা ঠিকই আপনাকে বাঁচিয়ে দেবে। হাজার হোক, মামা তো। সেজন্য মামাকে খুশি রাখার জন্য আপনি প্রতি মাসে তার বাসায় উপহার নিয়ে যান, অফিসে তাকে শুনিয়ে সবার কাছে তার নামে প্রশংসা করেন, তার জন্মদিনে বিপুল আয়োজন করে অনুষ্ঠান করেন। যেভাবেই হোক মামাকে হাতে রাখতেই হবে। মামা না থাকলে সর্বনাশ।

এই হচ্ছে শির্‌কের সমস্যা। মুসলিমরা জানে যে, আল্লাহ تعالى হচ্ছেন Absolute Just – পরম বিচারক, পরম ন্যায়পরায়ণ। তিনি মানুষের সব অপকর্ম খুঁটিনাটি কিয়ামতে দেখাবেন। এখন মানুষ যে প্রতিদিন ইসলামের বড় বড় নিয়ম ভাঙছে, নিজের সুবিধার জন্য ঘুষ দিচ্ছে, সুদ নিচ্ছে– এগুলোর প্রত্যেকটা যদি গুণে গুণে হিসাব করা হয় এবং প্রতিটা অপকর্মের বিচার করা হয়, তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে! বেহেশত পাওয়ার কোনো আশাই থাকবে না! তাহলে কী করা যায়? দেখি আল্লাহর تعالى অধীনে কাউকে হাত করা যায় কি না। তাহলে তাকে দিয়ে কিয়ামতের দিন আল্লাহকে تعالى বলালে হয়ত আল্লাহ تعالى কিছু বড় দোষ মাফ করে দিবেন।

অনেকে মনে করেন: কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহ تعالى তার বিচার করবেন, এবং বিচারের পরে দেখা যাবে তার অবস্থা খুবই খারাপ, তখন সে কিয়ামতের মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে তার পির-দরবেশ-শেখ-মাওলানাদেরকে খুঁজে বের করতে পারবে এবং তাদেরকে গিয়ে অনুরোধ করতে পারবে: যদি তারা সুপারিশ করে তাকে বাঁচাতে পারে। আবার অনেকে মনে করে: আল্লাহ تعالى যখন কিয়ামতে তার বিচার করে তার উপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হবেন, তখন সে যদি মরিয়া হয়ে আল্লাহকে تعالى অনুরোধ করে, “ও আল্লাহ, আমি লক্ষ লক্ষ টাকার ঘুষ খেয়েছি জানি—আমি খুবই দুঃখিত। কিন্তু আপনি আমার অমুক-বাগ শরীফের হুজুরকে একবার ডাকেন। আমি বিশ বছর তার বায়াতে ছিলাম। তাকে লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়েছি, তাকে কতবার হাজির বিরিয়ানি খাইয়েছি। উনি আমার জন্য কিছু বলবেন।”

আবার অনেকে ধরে নেয় যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ تعالى যখন তার বিচার করে তার উপরে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে থাকবেন, তখন সে যদি আল্লাহকে تعالى অনুরোধ করে, “ও আল্লাহ, আমি পর্দা না করে সারা জীবন নির্লজ্জের মতো ঘুরে বেড়িয়েছি, বান্ধবীদের কাছে ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গিবত করেছি, হিন্দি সিরিয়াল দেখে শাশুড়ির সাথে অনেক কুটনামি করেছি—আমি অনেক অপরাধ করে ফেলেছি। কিন্তু আপনি একটু নবীকে عليه السلام ডাকেন। আমি ওনার জন্য অনেক দুরুদ পড়েছি, তাঁর জন্য কত মিলাদ দিয়েছি, তাঁর জন্য সুন্নত নামাজ পড়েছি। উনাকে একটু ডাকেন, উনি আমার জন্য আপনাকে কিছু বলবেন, প্লিজ।”

বাকারাহ-এর ৪৮, ১২৩, ২৪৫ আয়াতে স্পষ্ট করে একই কথা বার বার বলা হয়েছে: কেউ অন্য কারও সাহায্যে নিজে থেকে এগিয়ে আসবে না। আপনার পির, দরবেশ, মাওলানা, শেখ—কেউ নিজে থেকে এগিয়ে আসবে না আপনার অপকর্মের জন্য সুপারিশ করতে, এমনকি তারা করলেও তা গ্রহণ করা হবে না। তারা সবাই, এমনকি আল্লাহর تعالى সবচেয়ে কাছের নবী, রাসুলরাও সেদিন আল্লাহর تعالى ভয়ে থাকবেন, নিজেদেরকে নিয়ে চিন্তিত থাকবেন—

أُو۟لَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إِلَىٰ رَبِّهِمُ ٱلْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُۥ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُۥٓ ۚ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحْذُورًا
ওরা যাদেরকে সাহায্যের জন্য ডাকে, তারা নিজেরাই তো তাদের প্রভুর অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে—যদিও তারা তাঁর সবচেয়ে কাছের। তারা সবাই তাঁর করুণার আশা করে, তাঁর শাস্তিকে প্রচণ্ড ভয় পায়। নিঃসন্দেহে, তোমার প্রভুর শাস্তি অত্যন্ত ভয় পাওয়ার মতো। [আল-ইসরা ১৭:৫৭]

أَفَمَنْ حَقَّ عَلَيْهِ كَلِمَةُ ٱلْعَذَابِ أَفَأَنتَ تُنقِذُ مَن فِى ٱلنَّارِ
তার কী হবে যার জন্য শাস্তির হুকুম অবধারিত হয়ে গেছে? তুমি (মুহাম্মাদ) কি তাদেরকে বাঁচাতে পারবে যারা ইতিমধ্যেই আগুনে নিমজ্জিত?[আজ-জুমার ৩৯:১৯]

কী ধরনের শাফাআত হবে?

তবে কিয়ামতের দিন একেবারেই যে কোনো ধরনের শাফাআত হবে না—সেটা ভুল ধারণা। আল্লাহ تعالى যখন বিশেষ কিছু কারণে কাউকে অনুমতি দিবেন, তখন শুধু তারাই শাফাআত করতে পারবে। কু’রআনের অন্যান্য আয়াতে এই ধরনের সুপারিশের ঘটনা বলা আছে—

يَوْمَئِذٍ لَّا تَنفَعُ ٱلشَّفَٰعَةُ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ ٱلرَّحْمَٰنُ وَرَضِىَ لَهُۥ قَوْلًا
সেদিন কোনো সুপারিশ কাজে লাগবে না, তবে তার সুপারিশ ছাড়া, যাকে পরম করুণাময়  অনুমতি দিবেন, যার কথায় তিনি সন্তুষ্ট। [সূরা তাহা ২০:১০৯]

শাফাআত পাবার জন্য তিনটি শর্ত[২৬৫] জরুরি—

১) আল্লাহ تعالى যার শাফাআত গ্রহণ করবেন, তাকে প্রথমে তিনি অনুমতি দিবেন। আল্লাহর تعالى অনুমতি ছাড়া কেউ শাফাআত করতে পারবে না।[২০:১০৯, ২:২৫৫, ৫৩:২৬]
২) যিনি শাফাআত করবেন, তার প্রতি আল্লাহ تعالى সন্তুষ্ট থাকতে হবেন।[২১:২৮, ৫৩:২৬]
৩) যার জন্য শাফাআত করা হবে, তার ঈমান থাকতে হবে—নামাজ, যাকাত, গরিবদের হক আদায় ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে পাশ করতে হবে।[৭৪:৩৮-৪৮]

যদি আল্লাহ تعالى কারও প্রতি সন্তুষ্ট না হন, সে যদি নিজেই ঘোরতর অপরাধী হয়ে আল্লাহর تعالى ক্রোধের কারণ হয়ে থাকে, তাহলে সে আর শাফাআত পাবে না।[২৬৬] শাফাআত পাবার পূর্বশর্ত হচ্ছে ঈমান থাকা।[৪] আর ঈমান একটি হাই স্ট্যান্ডার্ড, যা ‘ইসলাম’ থেকে আরও উপরের একটি অবস্থা। বাকারাহ-এর প্রথম কয়েকটি আয়াতে ঈমানের হাই স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে বলা হয়েছে। প্রথমে একজন ইসলামে প্রবেশ করে ‘মুসলিম’ হন, তারপরে ‘ঈমান’ অর্জন করে অনেকে ‘মুমিন’ পর্যায়ে যেতে পারেন, এবং কিছু সৌভাগ্যবান মানুষ একসময় ‘ইহসান’ অর্জন করে সর্বোচ্চ পর্যায় ‘মুহসিন’ পর্যন্ত যেতে পারেন।

قَالَتِ ٱلْأَعْرَابُ ءَامَنَّا ۖ قُل لَّمْ تُؤْمِنُوا۟ وَلَٰكِن قُولُوٓا۟ أَسْلَمْنَا وَلَمَّا يَدْخُلِ ٱلْإِيمَٰنُ فِى قُلُوبِكُمْ
মরুবাসি আরবরা বলে, “আমরা ঈমান এনেছি।” তাদেরকে বলো, “তোমরা ঈমান আনোনি, বরং তোমরা কেবল সমর্পণ (আসলাম) করেছ। তোমাদের অন্তরে ঈমান এখনো প্রবেশ করেনি।” [আল-হুজুরাত ৪৯:১৪]

সুতরাং কেউ যদি ধরে নেয়: সে নামাজ না পড়ে, রোজা না রেখে, সামর্থ্য থাকতে যাকাত না দিয়ে, হজ্জ না করে, বড় বড় কবিরা গুনাহ করে, শুধুমাত্র কোনো নবী-পীর-দরবেশের সুপারিশ পেয়ে জান্নাতে চলে যাবে, তাহলে শাফাআত সম্পর্কে তার একেবারেই ভুল ধারণা আছে। শাফাআত শুধু তারাই পাবে যারা মূলত ঈমানদার। ইসলামের মূল পাঁচটি ভিত্তি সম্পর্কে সে যথেষ্ট নিষ্ঠাবান ছিল, কিন্তু তার দুর্বলতার কারণে সে কিছু পাপ করে ফেলেছে, বা অল্প কিছু ভালো কাজের অভাবে জান্নাত হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছে, তখন তাদের শাফাআত পাওয়ার সুযোগ হতে পারে।[২৬৬][৯]

মানুষ একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারে যে, শাফাআতের পেছনে ছোটাছুটি করাটা কতটা বোকামি। কারও যদি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রাফিক জ্যামে বসে কোনো হুজুরের কাছে যাবার সময় থাকে, তাহলে তার সেই সময়টা নফল নামাজ পড়ে, অথবা কু’রআন পড়ে বিরাট সওয়াব অর্জন করে, স্বয়ং আল্লাহকে تعالى আরও বেশি খুশি করাটা কি বেশি যুক্তিযুক্ত নয়? কারও যদি পকেটে যথেষ্ট টাকা থাকে হুজুরের সেবা করার জন্য, তাহলে কি তার সেই টাকাটা গরিব, ইয়াতিম মানুষদেরকে সাদাকা দিয়ে বিশাল সওয়াব অর্জন করে, আল্লাহকে تعالى আরও খুশি করাটা বেশি যুক্তিযুক্ত নয়? সরাসরি আল্লাহকে تعالى আরও বেশি খুশি করার চেষ্টা না করে, তার অধীনে অন্য কারও জন্য আমাদের সীমিত জীবনের মূল্যবান সময় ব্যায় করাটা কি কোনো যৌক্তিক কাজ?

সূত্র:

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
  • [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
  • [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
  • [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
  • [১৫] তাফসির আল জালালাইন।
  • [২৬৫] শাফাআ’তের শর্তগুলো — http://www.islam-qa.com/en/21672
  • [২৬৬] শেখ ইয়াসির কাজির শাফাআতের উপর লেকচার— http://www.youtube.com/watch?v=X5OQ8HSchYE
  • [২৬৭] ইসরাইলে গৃহ যুদ্ধ — http://www.globalresearch.ca/israels-coming-civil-war-the-haredi-jews-versus-secular-zionist-militarism/5323834
  • [২৬৮] ইসরাইলে ইহুদি ধর্মাবলম্বী এবং সেক্যুলারদের মধ্যে সঙ্ঘাত — http://hrsbstaff.ednet.ns.ca/morrison/50%20Extended%20Essays/p&cs_anon_essay.pdf
  • [২৬৯] ইহুদিদের সাথে গণতন্ত্রের সঙ্ঘাত — http://forward.com/articles/175013/is-rise-of-jewish-fundamentalism-endangering-israe/?p=all

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

7 thoughts on “তোমাদের উপরে আমি যে অনুগ্রহ করেছি, তা মনে করো — আল-বাক্বারাহ ১২২”

  1. একমত। আমার যুক্তি থেকে একটা প্রশ্ন ছিলো, আশাকরি একটা জবাব পাব। যদি আমি সাহাবা হতাম, হয়ত এই প্রশ্নটা আমি নবিজিকেও করতাম। প্রশ্নটা হলো, যদি আমার হাতে ২ সেকেন্ড সময় থাকে তাহলে আমার উচিত পুরো ২ সেকেন্ডই আমার আল্লাহ্‌কে স্মরন করা। এই কনসেপ্ট-টা শেখানোর জন্যই নবিজি আমৃত্যু চেষ্টা করে গেছেন। যদি তাই হয় তবে কলেমা তৈয়বা কোথা থেকে আসলো? ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ তো নবিই শিখিয়ে গেছেন এবং এটাই ঈমান। ‘মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ একটি ঐতিহাসিক সত্য, এর সাথে ঈমান/কালেমার সম্পর্ক কি? যদি আমার হাতে ২ সেকেন্ড সময় থাকে তাহলে কি আমি ২ বার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” স্মরন করবো নাকি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ বলবো? আমার বিশ্বাস, আল্লাহ্‌র নবি আমাকে আল্লাহ্‌র স্মরন করাকেই প্রাধান্য দিতে বলতেন, যা আপনি এই লেখায়ও বুঝাতে চেয়েছেন। আপনার মতামত পেলে উপকৃত হতাম।

    1. ধন্যবাদ আপনাকে প্রশ্নটা করার জন্য। আপনি যে জানতে চেয়ে প্রশ্ন করেছেন সে জন্য আপনাকে স্বাগত জানাই। চেষ্টা করি আপনার যুক্তিগুলোর উত্তর দেওয়ার। তবে আপনাকে একটা ব্যাপার প্রথমেই বলতে চাই, অনেক সময় অনেক কথা যুক্তিযুক্ত মনে হলেও আপনি যদি যুক্তির ফর্মাল মেথড অনুসরণ করে সেই যুক্তিগুলোকে এনালাইজ করেন, তাহলে দেখবেন সেই কথাগুলো আসলে যুক্তিযুক্ত নয়। সঠিকভাবে আর্গুমেন্ট তৈরি করার সবচেয়ে সফল পদ্ধতি হলো Toulmin method। আপনাকে অনুরোধ করবো সেটা নিয়ে কিছু পড়াশুনা করে আমার উত্তরগুলো বোঝার চেষ্টা করতে।

      Claim 1: যদি আমার হাতে ২ সেকেন্ড সময় থাকে তাহলে আমার উচিত পুরো ২ সেকেন্ডই আমার আল্লাহ্‌কে স্মরন করা।

      আপনার এই আর্গুমেন্টে প্রথম warrant হচ্ছে (Toulmin method দেখুন): আল্লাহ ﷻকে স্মরণ করার একমাত্র/সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে শুধুমাত্র আল্লাহর ﷻ নাম আছে এরকম কিছু উচ্চারণ করা, বা ভাবা। আরেকটি warrant হচ্ছে: মুহাম্মাদ ﷺ এর নাম আছে এমন কিছু বললে, বা ভাবলে সেটা আল্লাহর ﷻ দৃষ্টিতে কম গ্রহণযোগ্য কাজ।
      এই দুটি warrant-এর ভিত্তি নেই এবং এই warrant দুটোর পক্ষে কোনো data, evidence বা fact নেই।

      Claim 2: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ তো নবিই শিখিয়ে গেছেন এবং এটাই ঈমান।

      আপনার এই ক্লেইমের পেছনে কোনো data, evidence, fact নেই। যেমন: কোনো data নেই যেখানে রাসুল বলে গেছেন ঈমান হচ্ছে শুধুমাত্র – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, এবং আর কিছু না।

      ঈমানের ছয়টি অংশ রয়েছে, যার মধ্যে একটি হচ্ছে রাসুলে বিশ্বাস।

      কু’রআনে একটি আয়াতে বলা আছে কারা ঈমান এনেছে:
      The true believers are the ones who have faith in God and His Messenger and leave all doubt behind, the ones who have struggled with their possessions and their persons in God’s way: they are the ones who are true. [49:15]

      Claim 3: ‘মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ একটি ঐতিহাসিক সত্য, এর সাথে ঈমান/কালেমার সম্পর্ক কি?

      The true believers are the ones who have faith in God and His Messenger and leave all doubt behind, the ones who have struggled with their possessions and their persons in God’s way: they are the ones who are true. [49:15]

      And the believers, men and women, are protecting (and allied) friends of one another; they enjoin the right and forbid the wrong, and they establish worship and they pay the poor-due, and they obey God and His Messenger. [9:71-72]

      আপনাকে একটা প্রশ্ন করি: কালেমা কী? কালেমার মাধ্যমে আমারা কী ঘোষণা দেই?

      ইহুদিরাও বলে – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আপনার সাথে ইহুদির পার্থক্য কোথায়?

      Claim 3: যদি আমার হাতে ২ সেকেন্ড সময় থাকে তাহলে কি আমি ২ বার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” স্মরন করবো নাকি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ বলবো?

      এখানে অনেকগুলো hidden warrant রয়েছে, তবে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, এটি একটি absurd assumption এর উপর ভিত্তি করে তৈরি করা যুক্তি। আপনার হাতে কয় সেকেন্ড সময় আছে, সেটা আপনি কোনোদিনও জানতে পারবেন না। এই ধরনের hypothetical scenario তৈরি করাই যেতে পারে, যদি সেই scenario ঘটার কোনো প্রবাবিলিটি থাকে। যেহেতু এটি একটি absurd scenario তাই এর উপর ভিত্তি করে তৈরি করা যুক্তি absurd। যেমন আপনাকে কিছু উদাহরণ দেই—
      * আমার সাথে যদি আল্লাহ ﷻ কথা বলতেন, তাহলে আমি আদর্শ মুসলিম হতাম।
      * আমি যদি জানতাম আমি কালকে মারা যাবো, তাহলে আমি কোনোদিন কোনো অন্যায় করতাম না।

      ইত্যাদি।

      1. Assalamu walaykum ওমর আল জাবির vai,
        Alhamdulillah , khubi valo answer diasen. Asa korsi Tanveer vai k allah Hedait korber. Ai sob question sadharon Muslim k korle nirsondhehe Talgul pakia felto. Tai Study korte hobe Joto ta para jai.

        Amar apnar proti bises onorod apni lekha chalia jaben karon apnar lekhar moddhe onek besi power ase manus ke Hedaet Koranur Moto.

        Assalamu walaykum

  2. আপনি মনে হয় শামসুত তাবরিজ (রঃ) ও জ্বালালুদ্দিন রুমি (রঃ) সম্পর্কে নেহায়েত অজ্ঞ। যার কারনে আপনার কিছু কিছু দলিল কুরআন এবং সুন্নাহ্ এর বহির্ভূত।

    1. কুরআন এবং সাহিহ হাদিসের বিরুদ্ধে যায় এমন কিছু থাকলে কুরআনের সেই আয়াত এবং সাহিহ হাদিসগুলোর রেফারেন্স দেবেন।
      কোন বইয়ে কী লেখা আছে বা কোন আলিম কী বলেছেন, এমন রেফারেন্স দেবেন না।

Leave a Reply to ওমর আল জাবির Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *