ধরুন আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, আপনি কাজের পাশাপাশি সন্ধ্যায় ইউনিভারসিটি গিয়ে পার্টটাইম মাস্টার্স বা পিএইচডি করবেন। আপনার পরিবার আপনার এই সিদ্ধান্ত শুনে বড়ই খুশি হবে। বংশে একজন মাস্টার্স/পিএইচডি করা ছেলে/মেয়ে থাকবে, কী সৌভাগ্যের ব্যাপার! ক্লাসে যাওয়ার আগে আপনার জন্য নাস্তা টেবিলে রাখা থাকবে। ক্লাস করে এসে আপনি যেন শান্তিতে ঘুমোতে পারেন, সেজন্য বাচ্চাদেরকে আগেই ঘুম পাড়িয়ে রাখা হবে। মেহমানরা বেড়াতে এসে যেন আপনার পড়াশুনায় ক্ষতি না করে, সেজন্য চৌদ্দগুষ্টিতে সাবধান নোটিস চলে যাবে। কেউ যদি এসেও পড়ে, আপনি দেখা করতে না আসলে কোনো সমস্যা নেই, কারণ আপনার পরীক্ষা চলছে। আপনার পরীক্ষার সময় বাড়িতে কারফিউ পড়ে যাবে। কেউ জোরে টিভি ছাড়বে না, ফোনে গল্প করবে না, আপনাকে যথাসাধ্য সবরকম শান্তির ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। কিছুক্ষণ পর পর নাস্তা এবং চা আসতে থাকবে। একসময় আপনি গ্রাজুয়েট করবেন, আপনার স্বামী-স্ত্রী-বাবা-মা গর্ব করে সবার কাছে আপনার অর্জনের কথা বলবে।
কিন্তু ধরুন আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, কাজের পাশাপাশি আপনি একটা ইসলামিক ডিগ্রির জন্য পড়াশুনা করবেন, বা এলাকার মুসলিম ভাইবোনদের সাথে নিয়মিত ইসলামি আলোচনায় অংশ নেবেন। আপনার পরিবারের সদস্যরা এই কথা শোনার পর আপনার উপর শুরু হবে তাদের যাবতীয় দাবি এবং অভিযোগের বৃষ্টি। এমনিতেই কাজের বাইরে আপনাকে কম পাওয়া যায়, এখন কেন আরও কম পাওয়া যাবে? যেই কাজ করতে আপনি বাধ্য নন, কেন আপনি সেই কাজের পিছনে এত সময় দেবেন? এগুলো না করে শুধু নামাজ-রোজা করলে ক্ষতি কী হবে? আমরা কী মুসলিম না? এগুলো না করলে কী জান্নাতে যাওয়া যায় না? —এরকম হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যে আপনি কোনোমতে সবাইকে দিনের পর দিন ম্যানেজ করে, নিয়মিত তাদের কটু কথা শুনে হয়তো সপ্তাহে একদিন, দু’দিন করে ইসলামের জন্য পড়াশুনা করবেন, কোনো ইসলামি আলোচনা, সেচ্ছাসেবী কাজে মাসে এক-দুইবার অংশ নেবেন। কিন্তু আপনার এই কাজে সাহায্য করার জন্য কেউ টিভি দেখা কমিয়ে দেবে না, ফোনে গল্প করা বন্ধ করবে না, আপনার পড়ার সময় বাচ্চাগুলোকে অন্য ঘরে খেলতে নিয়ে যাবে না। আপনার পরীক্ষাই চলুক, কোনো জরুরি প্রোগ্রামই থাকুক, বা রংপুরে কম্বল বিতরণের দায়িত্বই থাকুক না কেন, বাসায় কোনো মুরব্বি আত্মীয় আসলে, শ্বশুর-শাশুড়ি আসলে, বাচ্চাদের পরীক্ষা চললে কেউ আপনাকে একটুও ছাড় দেবে না। আপনাকে তখন সব বাদ দিয়ে সামাজিকতা করতে হবে। বরং যখন আপনার পড়াশুনার বেশি চাপ যাবে, বা ইসলামি কাজে একটু বেশি সময় দিতে হবে, তখনি আপনার কাছের জনের মাথা বেশি গরম হয়ে যাবে, নিয়মিত ঝগড়া শুরু হবে। আত্মীয়স্বজন নিয়মিত আপনাকে ফোন করে আবার ‘সাধারণ মুসলিম’ হয়ে যাওয়ার জন্য বার বার আপনাকে বোঝাবে। কবে কোন মুসলিমকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল, জেলে নিয়ে কীভাবে পায়ের নখ তুলে নির্যাতন করেছিল, কোন ইসলামি দল কবে কোন নিরীহ মুসলিমকে ঘোল খাইয়েছিল —এই সব বলে আপনাকে নিয়মিত ভয় দেখাবে।
এইসব হাজারো ঝড়-ঝাপটা, প্রতিকূলতার মধ্যেও আপনি দাঁতে দাঁত চেপে ধৈর্য ধরে প্রতিদিন হাসিমুখে চেষ্টা করে যান। কারণ আপনার মতো মানুষদের কথাই আল্লাহ تعالى গর্ব করে কু’রআনে বলেছেন—
এমন মানুষও আছে, যে আল্লাহকে تعالى অনেক খুশি করার চেষ্টায় নিজেকে পুরোপুরি নিবেদিত করে দেবে। আল্লাহ تعالى তার বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত মমতাবান। [আল-বাক্বারাহ ২০৭]
এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বলছেন যে, এমন মানুষ আছে, যারা يَشْرِى ইয়াশরি অর্থাৎ নিজেকে বিক্রি করে দেবে। সে নিজের সময়, মেধা, সম্পদকে বিক্রি করবে। আমরা প্রতিদিন জীবনের ১০-১২ ঘণ্টা বিক্রি করে দেই অফিসে, ব্যবসায়, পড়াশুনায়, যেন একসময় গিয়ে ব্যাংকে কিছু টাকা পেতে পারি। এভাবে আমরা প্রতিনিয়ত নিজের সত্তাকে বিক্রি করি, যেন এর বিনিময়ে কিছু না কিছু দুনিয়াতে পেতে পারি। এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এমন একজনের কথা বলছেন, যে তার নিজের সময়, সম্পদ, মেধা, এমনকি দরকার পড়লে নিজের দেহকেও বিক্রি করে দেবে আল্লাহর مَرْضَات মারদাত অর্থাৎ সন্তুষ্টি পাওয়ার আশায়। তবে শুধুই সন্তুষ্টি বা رضا পাওয়ার আশায় নয়, বরং مَرْضَات মারদা-ত, অত্যন্ত সন্তুষ্টি পাওয়ার আশায়। সে মনে প্রাণে চায় যেন আল্লাহ تعالى তার উপর অনেক খুশি হন। এর জন্য সে যে কোনো ত্যাগ করতে রাজি। (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)