আল্লাহর تعالى বাণী নিয়ে মানুষের তামাশা করার প্রবণতার আরেকটি উদাহরণ আমরা এই আয়াতে পাব। বনী ইসরাইলিরা দেখল যে, নবী মূসা عليه السلام আল্লাহর تعالى কাছ থেকে যে তাওরাতের বাণী নিয়ে এসেছেন, সেই বাণী মেনে চলাটা বেশ কঠিন। তখন তারা সেটা থেকে বাঁচার জন্য অজুহাত খোঁজা শুরু করল। প্রথমে তারা নবী মূসাকে عليه السلام বলল: তার মুখের কথা তারা বিশ্বাস করবে না, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর تعالى কাছ থেকে নিজের কানে না শুনছে।[৪][৮]
তখন নবী মূসা عليه السلام তাদের মধ্য থেকে ৭০ জন প্রতিনিধিকে বাছাই করে তূর পাহাড়ে নিয়ে গেলেন। সেখানে আল্লাহ تعالى তাদেরকে সরাসরি তাওরাত মেনে চলার হুকুম দিলেন। তারপর সেই প্রতিনিধিরা ফিরে এসে নিজ নিজ গোত্রের সামনে স্বীকার করল যে, আল্লাহ تعالى সত্যিই তাদেরকে তাওরাত মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এর সাথে তারা আর একটি কথা যোগ করে দিল: “আল্লাহ বলেছেন যে, তোমাদের পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব, ততটুকু মেনে চলবে। যা মেনে চলতে পারবে না, তা তিনি ক্ষমা করে দিবেন।”
এরপর থেকে তাওরাতের যেই নির্দেশই তাদের কাছে কঠিন মনে হতো, সেটাকেই তারা ছেড়ে দিত — এই মনে করে যে, আল্লাহ তা ক্ষমা করে দিবেন।[৪][৮] তাদের এই ভণ্ডামিতে আল্লাহ تعالى রেগে গিয়ে এক অসাধারণ ঘটনা ঘটালেন —
মনে করে দেখো, যখন আমি তোমাদের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়েছিলাম (তাওরাত অনুসরণ করার জন্য), এবং তূর পর্বতকে তোমাদের মাথার উপর তুলে ধরেছিলাম, “শক্ত করে ধর, যা আমি তোমাদেরকে দিয়েছি এবং এতে যা আছে তা মনে রাখো — যাতে করে তোমরা (আল্লাহর প্রতি) সচেতন হতে পারো।” [আল-বাক্বারাহ ৬৩]
আল্লাহ تعالى তূর পাহাড়কে তাদের মাথার উপরে তুলে বললেন যে, তাওরাতের সব বিধান মেনে চলতে হবে। তারা এই ভয়ংকর ঘটনা দেখে ভয় পেয়ে গেল, এবং কথা দিলো যে, তারা এখন থেকে তাওরাতের সব বিধান মেনে চলবে।[৪][৮]
আজকের যুগের অনেক মুসলিমকে দেখবেন যে, তারা ঠিক একই কাজ করছে। ইসলামের যেই নিয়মটা মানতে তাদের কষ্ট হয়, তারা সেটা ছেড়ে দেয়। তারপর তারা আল্লাহর تعالى সম্পর্কে তাদের সুগভীর উপলব্ধির উপরে একটা বক্তৃতা দিয়ে, কেন তারা সেই নিয়মটা ঠিকমতো অনুসরণ করে না, তার পক্ষে উচ্চমার্গের দার্শনিক যুক্তি উপস্থাপন করে।
যেমন, আপনি যখন এদের কাউকে বলেন, “ভাই, আপনাকে তো পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তে দেখি না। দিনে দুই-এক ওয়াক্ত পড়েন, তাও আবার যখন শুধু বাসায় থাকেন।” সে বলবে, “আরে ভাই, প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায সবসময় পড়া যায় নাকি? আমি যতটুকু পারি পড়ার চেষ্টা করি। আমাকে কোনোদিন দেখেছেন জুম্মার নামায, ঈশার নামায ছেড়ে দিতে? আল্লাহ এত কঠিন না ভাই। আপনারাই ইসলামকে বেশি কঠিন করে ফেলেন।”
আবার আপনি যদি এদের কাউকে বলেন, “আপা, আপনি তো দেখি প্রায়ই নামায পড়েন, কু’রআনও পড়েন। কিন্তু এরকম আপত্তিকর কাপড় পড়ে ঘোরাফেরা করাটা কি ঠিক? নামাজ যেমন ফরজ, হিজাব করাও তো ফরজ, তাই না?” সে বলবে, “আপত্তিকর কাপড় কোথায় দেখলেন! আমি তো আজকের ফ্যাশন অনুসারেই জামাকাপড় পরছি। এখন টাইট ড্রেসের ফ্যাশন। যখন লুজ পোশাকের ফ্যাশন ছিলো তখন সেটাও পড়েছি। আপনারা সব তালেবান হয়ে যাচ্ছেন। আপনাদের এই সব মান্ধাতা আমলের চিন্তা-ভাবনা আজকের যুগে চলে না। আমাদের অন্তরে কী আছে, সেটা আল্লাহ দেখেন। যাদের অন্তর পরিষ্কার, তাদের হিজাব করা লাগে না।”
আজকাল এদের উপরে আল্লাহ تعالى তূর পর্বত তুলে ধরেন না। কিন্তু মাঝে মাঝে দেখা যায়, এদের অনেকের পরিবারের সদস্যদের একটার পর একটা ভয়ংকর অসুখ হয়, যার চিকিৎসার খরচ দিতে গিয়ে বাড়ি, গাড়ি, জমি সব বিক্রি করে ফেলতে হয়। আবার এদের অনেকে ঘুষ খেয়ে কোটি কোটি টাকা বানিয়ে, লিভার সিরোসিসে ভুগে, একসময় কিডনি নষ্টের কারণে ডায়ালাইসিস করতে করতে, সব সম্পদ শেষ করে মারা যায়। এদের অনেকের ছেলে একদিন মাদকাসক্ত হয়ে জেলে যায়। আবার অনেকের মেয়েকে নিয়ে লুকিয়ে ক্লিনিকে যেতে হয়। তখন তাদেরকে যদি জিজ্ঞেস করেন, “আহারে, আপনাদের খুব কঠিন দিন যাচ্ছে না?” তারা বলবে, “মাথার উপর পাহাড় ভেঙ্গে পড়েছে ভাই! জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে!”
বনী ইসরাইলের উপর এরকম একটা পর্বত তুলে ধরে, ভয় দেখিয়ে তাওরাত মানানোর ঘটনায় কিছু সুধীবৃন্দ তর্ক দেখিয়েছেন, “এখানে কি মানুষকে ভয় দেখিয়ে ধর্ম গ্রহণ করানো হলো না? তোমাদের কু’রআনেই না বলা আছে: لَآ إِكْرَاهَ فِى ٱلدِّينِ ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই? [আল-বাক্বারাহ ২৫৬] কিন্তু এই আয়াতেই তো একটা জবরদস্থি করা হচ্ছে। দেখেছ? তোমাদের কু’রআনে অসঙ্গতি আছে!”
উত্তর: এখানে বনী ইসরাইলকে জোর করে ইসলাম গ্রহণ করানো হয়নি। তারা ইতিমধ্যেই মুসলিম ছিল। তাদের মাঝে একজন বিখ্যাত নবী عليه السلام ছিলেন, যিনি তাদেরকে আল্লাহর تعالى সাহায্য নিয়ে ফিরাউনের বীভৎস অত্যাচার থেকে তাদেরকে মুক্ত করেছেন। তিনি তাদেরকে আল্লাহর تعالى ইচ্ছায় অসাধারণ কিছু অলৌকিক নিদর্শন দেখিয়েছেন—সমুদ্র দুই ভাগ করা, মরুভূমিতে পাথর ফেটে পানির ঝর্ণা বের করা, আকাশ থেকে অলৌকিক খাবার মানন এবং সালওয়া পাওয়া। এমনকি তারা আল্লাহকে تعالى নিজের চোখে দেখতে চেয়েছিল। তখন এক বজ্রপাত তাদেরকে প্রাণহীন করে ফেলে। তারপর আল্লাহ تعالى তাদেরকে আবার বাঁচিয়ে তোলেন।
এতকিছু দেখেও তারা শারিয়াহ মানতে ফাঁকিবাজি করেছে, আল্লাহর تعالى বাণী নিয়ে তামাশা করেছে। তাদের বেঈমানির কারণে আল্লাহ تعالى তাদেরকে ভয় দেখিয়েছেন, যেন তারা সাবধান হয়ে যায়। আজকে কোনো ইসলামিক রাষ্ট্রে যদি কোনো মুসলিম লোক ইসলামিক আইন ভেঙ্গে প্রতারণা শুরু করে, আল্লাহর تعالى বাণীকে বিকৃত করতে থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধেও কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সুতরাং, এখানে জোর করে ধর্ম মানানো হচ্ছে না, বরং কিছু ঘোরতর অপরাধীকে সাবধান করা হচ্ছে, যেন তারা ভালো হয়ে যায়।[৮][১১]
আবার অনেক সুধীবৃন্দ প্রশ্ন করেন, “দেখেছ? মানুষকে অলৌকিক ঘটনা দেখালে তারা ঠিকই ধর্ম মানে। আল্লাহ ওদেরকে অলৌকিক ঘটনা দেখিয়ে পাক্কা বিশ্বাসী করে দিয়েছেন। আমাদেরকে এরকম অলৌকিক ঘটনা দেখালে, আমরাও আদর্শ মুসলিম হয়ে যেতাম।”
মাথার উপরে একটা পাহাড় ভাসতে থাকাটা নিঃসন্দেহে একটা সাংঘাতিক অলৌকিক ঘটনা। কিন্তু এই ধরনের অলৌকিক ঘটনা দেখানোর একটি সমস্যা হলো: ঘটনাটি যারা নিজের চোখে দেখে, তাদের উপরে ঠিকই বিরাট প্রভাব পড়ে, কিন্তু তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরেরা—যারা শুধু তাদের পূর্বপুরুষের মুখে ঘটনাটার বর্ণনা শুনে—তাদের খুব একটা গায়ে লাগে না।
ধরুন, আপনি একদিন কক্সবাজারে সমুদ্রের তীরে হাঁটছেন। এমন সময় প্রচণ্ড বাতাস শুরু হলো, আর দেখলেন বঙ্গোপসাগরের পানি দুইভাগ হয়ে গিয়ে সাগরের মধ্য দিয়ে একটা রাস্তা হয়ে গেল। তারপর সেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে পার হয়ে এল বার্মার অত্যাচারিত মুসলিমরা। এটা দেখে আপনার ওপর একটা বিরাট প্রভাব পড়বে। আপনি হয়তো পরের মাসেই উমরাহ করতে চলে যাবেন। কিন্তু আপনি যদি একদিন আপনার ছেলেমেয়েদের চোখ বড় বড় করে গল্পটা বলেন, “জানো? একদিন আমি দেখলাম: বঙ্গোপসাগরের পানি সরে গিয়ে সাগরের মধ্যে দিয়ে একটা শুকনা রাস্তা তৈরি হয়ে গেল, আর বার্মার অত্যাচারিত মুসলিমরা হেঁটে বাংলাদেশে চলে এল!”—তাদের উপরে কাহিনীটার সেরকম কোনো প্রভাব পড়বে না, কারণ তাদের কাছে সেটা একটা গল্প ছাড়া আর কিছু নয়। তারা সেই ঘটনা শোনার পর দিন থেকেই প্রতিদিনের নিষিদ্ধ কাজগুলো করা বন্ধ করে দিয়ে আদর্শ মুসলিম হয়ে যাবে না।
কিন্তু আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এমন একটি অলৌকিক ব্যাপার দিয়েছেন, যেটা সকল যুগের, সকল প্রজন্ম নিজের চোখে দেখে, যাচাই করে বুঝতে পারে যে, কত বড় একটা অলৌকিক ব্যাপার তাদের চোখের সামনেই রয়েছে। এটা বুঝতে গেলে একটা উপমা দিতে হবে —
একদিন ডিসকভারি চ্যানেলে একটা জরুরী ঘোষণা দেওয়া হলো: “আরকিওলজিস্টরা মাটি খুঁড়ে হাজার বছর পুরনো একটা প্রাচীন বই বের করেছেন। সেটাতে কিছু ভবিষ্যৎ বাণী লেখা আছে, যেগুলোর অনেকগুলো ইতিমধ্যে হুবহু মিলে গেছে। শুধু তাই না, সেখানে মাটির নিচে থাকা ‘ইরাম’ নামে একটা শহরের কথা বলা হয়েছে, যেটা সম্প্রতি মানুষ চ্যলেঞ্জার মহাকাশযান থেকে পৃথিবী পর্যবেক্ষণ করার সময় প্রথমবারের মতো খুঁজে পেয়েছে। আরও অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সেই লিপিতে মহাবিশ্ব সম্পর্কে এমন সব অদ্ভুত তথ্য দেওয়া আছে, যা কয়েক যুগ আগে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, গ্যালিলিও প্রথম আবিষ্কার করেছেন এবং সেগুলো আমরা একবিংশ শতাব্দীতে এসে হাবল টেলিস্কোপের কারণে প্রথম প্রমাণ করতে পেরেছি। লিপিটির ভাষা অদ্ভুত। এরকম ভাষায় কোনো মানুষকে কোনোদিন কোনো সাহিত্য লিখতে দেখা যায়নি। ভাষাবিদরা দাবি করছেন এত উচু পর্যায়ের সূক্ষ্ম ভাষায়, এত বড় একটা বই লেখা মানুষের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এমনকি অনেক পদার্থ, রসায়ন, জীব, চিকিৎসা বিজ্ঞানী এই বইটির তথ্য পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিতভাবে দাবি করছেন যে, এই তথ্যগুলো কোনোভাবেই হাজার বছর আগে মানুষের পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই এটি কোনো মহাজাগতিক বুদ্ধিমান প্রাণী রেখে গেছে! আমরা এত দিন থেকে গবেষণা করছিলাম পৃথিবীর বাইরে কোনো বুদ্ধিমান সত্তা আছে কিনা জানার জন্য। শেষ পর্যন্ত আমরা খুঁজে পেয়েছি!”
এরকম একটা বই যদি সত্যিই আবিষ্কার হয়, তাহলে পরদিনই মানুষ সেটা দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়বে। যেই মিউজিয়ামে সেই বইটার প্রদর্শনী হবে, সেখানে যাওয়ার জন্য হাজার হাজার মানুষ প্লেন-ট্রেন-বাসের টিকেট কিনে ফেলবে। সারা দুনিয়ার মানুষ হাঁ করে টিভিতে সেই বইটার উপরে করা ডকুমেন্টারি দেখতে থাকবে। এরকম একটা ‘এলিয়েন’ বই নিজের চোখে দেখা কী সৌভাগ্যের ব্যাপার!
অথচ, ঠিক এরকম একটি বই, যা কোনো মহাজাগতিক বুদ্ধিমান প্রাণী নয়, বরং পুরো মহাবিশ্বের স্রষ্টা, এক অকল্পনীয় শক্তিশালী সত্তা, হাজার বছর আগে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন — যা আজকে আমাদের আলমারির উপরে ধুলায় ঢাকা পড়ে আছে। মহাজাগতিক তথ্য সমৃদ্ধ এই ‘এলিয়েন’ বইটির বাণী সত্যি সত্যিই এসেছে পৃথিবীর বাইরের কোনো জগত থেকে। এত বড় একটা অলৌকিক নিদর্শন আমাদের চোখের সামনে পড়ে আছে, কিন্তু তার মূল্য আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না।
অনেক অমুসলিম চেষ্টা করেছে কু’রআনের সূরার মতো সূরা তৈরি করার। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কুরআনের সূরার মতো নকল সূরা তৈরি করার। ইন্টারনেটে এরকম বানানো সূরা আপনি অনেক পাবেন। যেকোনো অভিজ্ঞ আরব ভাষাবিদকে দিয়ে আপনি সেগুলো দেখালেই সে আপনাকে বলে দিতে পারবে সেগুলো কতখানি হাস্যকর। কু’রআন হচ্ছে একমাত্র কিতাব, যেখানে একজন সমাজবিদ, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসাবিদ, পদার্থ-রসায়ন-জীব বিজ্ঞানী, মনোবিশেষজ্ঞ, গৃহিণী, চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ভিক্ষুক, মানসিক রোগী, চোর, দাগি আসামী, রাজনৈতিক নেতা — সবার জন্য বিশেষ ভাবে উপকার হয়, এমন কোনো না কোনো বাণী রয়েছে।
এটি মানব জাতির ইতিহাসে একমাত্র কিতাব, যা একটি বিশাল ভূখণ্ডে একই সাথে নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক — এই সবগুলো বিপ্লব নিয়ে এসেছিল[১], যা অনুসরণ করে একদল মানুষ তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে, একটা পুরো জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসতে পেরেছিল। মানুষের ইতিহাসে অন্য কোনো কিতাব, কখনও একই সাথে এতগুলো প্রেক্ষাপটে, এত বড় অবদান রাখতে পারেনি।[১]
আল-বাক্বারাহ’র এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বলছেন যে, তিনি বনী ইসরাইলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন। এর জন্য তিনি مِيثاق (মিছাক) ব্যবহার করেছেন, যা এমন একটি অঙ্গীকার, যেটা দুই পক্ষই খুব ভালো করে জানে যে, তারা কী ধরনের অঙ্গীকারে আবদ্ধ হচ্ছে। যার সাথে অঙ্গীকার করা হচ্ছে, সে জানে: সে একটা গুরু দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে।[১] মিছাক কোনো সাধারণ অঙ্গীকার নয়, যেমন عَهْد আ’হদ হচ্ছে সাধারণ অঙ্গীকার বা কথা দেওয়া।[১] আমরা যখন চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় কন্ট্রাক্টে সই করি, আমাদেরকে তখন যদি বার বার বোঝানো হয়: আমরা কী ধরণের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছি, কত বেতন এবং সুযোগ-সুবিধা পাব, এবং দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন না করলে পরিণতি কী হবে — তখন সেটা মিছাক। কিন্তু আপনি যখন ব্যাংক থেকে লোন নেন, যেই লোনের ফর্মে খুব ছোট করে শত শত লাইনের হিজিবিজি কথাবার্তা লেখা থাকে, যা পড়ে আপনি কিছুই বুঝতে পারেন না যে, কত বড় ফাঁদে পা দিচ্ছেন — সেটা মিছাক নয়।
বনী ইসরাইলের কাছ থেকে আল্লাহ تعالى মিছাক নিয়েছিলেন, তারা খুব ভালো করে জানতো: তারা কী অঙ্গীকার দিচ্ছে এবং তাদের দায়িত্ব কী। তারপরেও তারা বার বার বেঈমানি করেছিল। একারণেই আল্লাহ تعالى তাদের উপরে একটা পর্বত তুলে ধরে, তাদেরকে শেষ বারের মতো সাবধান করে দেন।
এই আয়াত নিয়ে দুটি মত রয়েছে — ১) তূর পর্বত তাদের মাথার উপরে তুলে ধরা হয়েছিল, ২) তূর পর্বত এমন ভাবে কাঁপানো হয়েছিল যে বনী ইসরাইল, যারা তূর পর্বতের পাদদেশে থাকত, তারা মনে করেছিল পর্বতটা তাদের মাথার উপর ভেঙ্গে পড়বে।[৩][৮] যেটাই হোক না কেন, আয়াতের উদ্দেশ্য আমাদেরকে ইতিহাস শেখানো নয়। আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে: বনী ইসরাইল কী ভুল করেছিল, তা থেকে শিক্ষা নেওয়া।
অনেকে এই সব আয়াত নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহ দেখান: একটা পর্বত কীভাবে মাথার উপরে তুলে ধরা সম্ভব? সে জন্য কী পরিমাণের শক্তি দরকার? কীভাবে মধ্যাকর্ষণ শক্তিকে অতিক্রম করা হলো? সেই পর্বতে এরকম কোনো চিহ্ন এখনও আছে কিনা? — এসব নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করে ২০০ পাতার থিসিস লেখেন। এগুলো শয়তানের ফাঁদ। শয়তান চায় আমরা এই সব অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপারে চরম কৌতূহলী হয়ে, এগুলো নিয়ে গবেষণা করে আমাদের জীবনের মূল্যবান সময় শেষ করি। যেই সময়টা আমরা কু’রআন থেকে জীবনের ভুল শোধরানোর শিক্ষা নিয়ে, সঠিকভাবে ধর্ম মেনে জান্নাতে যেতে পারতাম, সেই সময়টা আমরা এই সব গবেষণা করে সময় নষ্ট করে, নিজেদের ধ্বংস করে জাহান্নামে যাওয়ার পথ সহজ করি।
বনী ইসরাইলকে আল্লাহ تعالى বলেছিলেন: خُذُوا۟ مَآ ءَاتَيْنَٰكُم بِقُوَّةٍ অর্থাৎ: যা কিছু দিয়েছি, তার সব কিছু শক্ত করে ধর।خُذُوا۟ এসেছে أخذ থেকে যার অর্থ: কোনো কিছু দৃঢ়তার সাথে গ্রহণ করে, নিষ্ঠার সাথে পালন করা।[৫] এরপর তিনি বলেছেন: مَآ ءَاتَيْنَٰكُم অর্থাৎ: যা কিছু দিয়েছি, তার সব কিছু; কোনো ফাঁকিবাজি করা যাবে না।بِقُوَّةٍ অর্থ: একদম শক্ত করে, শক্তি দিয়ে।[৫] এখানে আল্লাহ আমাদেরকে সাবধান করে দিচ্ছেন যে, ধর্মীয় নির্দেশ কোনো হেলাফেলার জিনিস নয় যে, আমরা যখন ইচ্ছা মানবো, যখন একটু ঝামেলার মনে হবে, তখন মানবো না, ছেড়ে দেব — এইসব চলবে না।
আমরা যখন কালেমা পড়ে ঘোষণা দেই – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ – তখন আমরা শপথ করি, “আমার জীবনে আল্লাহর থেকে বড় আর কেউ নেই। আজ থেকে আমার প্রতিটা সিদ্ধান্ত এবং কাজে আল্লাহ تعالى থাকবেন সবার আগে, তারপরে অন্য কিছু। আমি আর কোনোদিন, অন্য কোনো কিছুকে আল্লাহর থেকে বেশি গুরুত্ব দিবো না। আজ থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমি আল্লাহর تعالى আদেশ-নিষেধ মেনে চলব, কখনো অবাধ্য হবো না।” কিন্তু তারপর যা ঘটে তা হচ্ছে অনেকটা এরকম:
-
মেহমান এসেছে, তুমুল আড্ডা চলছে দেশের নির্বাচন নিয়ে, ওদিকে মাগরিবের সময় পার হয়ে যাচ্ছে, “আহ্ হা, মাগরিবের সময় দেখি শেষ হয়ে গেল। কিন্তু এখন উঠে গেলে ওরা আবার কী মনে করে। তারচেয়ে রাতে একবারে ঈশার সাথে পড়ে নিবো। আল্লাহ মাফ করুন।”
-
বিয়ের দাওয়াতে যাওয়ার আগে রঙবেরঙের সাজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে- “মাথায় ঘোমটা দিলে কেমন খ্যাঁত মনে হচ্ছে। থাক, ঘোমটা ছাড়াই যাই, আত্মীয় স্বজনরা আবার কী সব বলাবলি করে। ফুল হাতা ব্লাউজটাও একদম মানাচ্ছে না। দেখি হাফ হাতা পড়ি, স্মার্ট লাগবে। মাত্র এক রাতের ব্যাপার। বিয়েতে যারা আসছে, তারা তো নিজেদের লোকজন, কিছু হবে না, আল্লাহ মাফ করবেন।”
-
অনেক দিন চেষ্টার পর শেষ পর্যন্ত হিজাব ধরে ফেললেন। কিন্তু লুকিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় শাশুড়ির হাতে ধরা পড়ে গেলেন। সাথে সাথে শাশুড়ির চিৎকার, “বউমা! হোয়াট ইজ দিস? আমাদের ফ্যামিলিতে কেউ এইসব আন-স্মার্ট হিজাব পড়ে না। খুলো বলছি! আমার ফ্রেন্ডরা দেখলে আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না। তুমি কি চাও আমি আজকের কিটি পার্টি ক্যান্সেল করে দেই?”
-
এক বিশেষ নায়কের ছবি লাগানো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, একটা লম্বা ফুল-হাতা শার্ট আর একটা স্লিম-ফিট টি-শার্ট হাতে নিয়ে: “এই লম্বা শার্টটা আজকাল আর চলে না, লোকজন খ্যাঁত বলে। তারচেয়ে এই টি-শার্টটাতে আমাকে অনেক স্মার্ট দেখায়। কিন্তু এটা পড়ে উপুড় হলে তো আবার … বের হয়ে যায়। যাক্গে কিছু হবে না।”
-
বন্ধুর নতুন গাড়ির পাশে নিজের পুরনো গাড়িটার দিকে তাকিয়ে, “নাহ্, এই ভাঙ্গা গাড়িটা ফেলে ব্যাংক থেকে গাড়ির লোন নিয়ে এবার একটা নতুন গাড়ি কিনতেই হবে। এই গাড়ি নিয়ে বের হলে মানুষকে মুখ দেখাতে পারি না। প্রতিবেশীরা কেমন-কেমন করে তাকায়, নিজেকে গরিব-গরিব মনে হয়। একটু সুদ দিলে কিছু হবে না। আল্লাহ নিশ্চয়ই আমার কষ্টের কথা বুঝবেন।”
-
মাসের ভাড়া দিয়ে বাড়িওলার বাসা থেকে মুখ কালো করে ফেরত আসার পথে, “আর না! অনেক অপমান সহ্য করেছি। বন্ধু বান্ধবকে মুখ দেখাতে পারি না। মানুষকে বলতে হয়: আমি ভাঁড়াটিয়া। এইবার ডিবিএইচের লোণটা নিয়ে একটা বাড়ি কিনবোই। পরে একসময় হজ্জ্ব করে আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে নিবো।”
-
রাস্তায় সার্জেন্টকে পাঁচশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিতে দিতে, “ছি, ঘুষ দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু না দিলে তো আবার গাড়ি নিয়ে যাবে। কি লজ্জার ব্যপার হবে যদি প্রতিবেশীরা জেনে ফেলে গাড়িটা দুই নম্বরি করে কেনা। থাক না, মাত্র পাঁচশ টাকা। আল্লাহ মাফ করেন।”
আল-বাক্বারাহ’র ৮৫ আয়াতে এই ধরনের মানুষদেরকে নিয়ে একটা কঠিন সাবধান বাণী এসেছে—
أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ ٱلْكِتَٰبِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ ۚ فَمَا جَزَآءُ مَن يَفْعَلُ ذَٰلِكَ مِنكُمْ إِلَّا خِزْىٌ فِى ٱلْحَيَوٰةِ ٱلدُّنْيَا ۖ وَيَوْمَ ٱلْقِيَٰمَةِ يُرَدُّونَ إِلَىٰٓ أَشَدِّ ٱلْعَذَابِ ۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ ﴿البقرة: ٨٥﴾
… তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস কর, আর কিছু অংশে অবিশ্বাস কর? যারা এরকম করে, এই দুনিয়ার জীবনে দূগর্তি ছাড়া তাদের আর কোনো পথ নেই। কিয়ামতের দিন তাদের অত্যন্ত কঠিন শাস্তির দিকে পৌঁছে দেওয়া হবে। তোমরা কী করো, তা আল্লাহর অজানা নয়। [আল-বাক্বারাহ: ৮৫, আংশিক]
আলোচ্য ৬৩ আয়াতে আল্লাহ تعالى বনী ইসরাইলের উদাহরণ দিয়ে, আমাদেরকে এই ধরণের ভণ্ডামি না করতে সাবধান করে দিয়েছেন। এবং এর সমাধানও তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন:
وَٱذْكُرُوا۟ مَا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
এবং এতে যা আছে তা মনে রাখো — যাতে করে তোমরা (আল্লাহর প্রতি) সচেতন হতে পারো।
ٱذْكُرُوا۟ এসেছে ذكر থেকে, যা কু’রআনে অনেকগুলো অর্থে এবং উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে: ১) উল্লেখ করা, ২) মুখস্থ করা, ৩) পুনরায় মনে করা, ৪) মনে রাখা, ৫) কিছু নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা, ৬) উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা, ৭) উপলব্ধি করে অনুতপ্ত হওয়া, ৮) কোনো শিক্ষাকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা ইত্যাদি।[১৪২] আল্লাহ تعالى আমাদেরকে বলছেন, তিনি আমাদের যা কিছু দিয়েছেন, তার সব আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, মানুষকে মনে করিয়ে দিতে হবে, নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে। যদি আমরা তা করি, তাহলেই আমরা তাক্বওয়া অর্থাৎ আল্লাহর تعالى প্রতি সবসময় গভীরভাবে সচেতন থাকতে পারবো।
অনেক সময় আমরা যিকর বলতে শুধু নিজেকেই মনে করানো বুঝি। কিন্তু যিকরের একটি অর্থ হলো: মনে করানো, উল্লেখ করা। ধরুন, আপনার পরিবারের এক সদস্য গত কয়েক ঘণ্টা ধরে সোফায় বসে একটার পর একটা চ্যানেল পাল্টাচ্ছে, আর হাতে চিপস নিয়ে যাবর কাটছে। আপনি তাকে গিয়ে তাগাদা দিলেন। সে কী চরম অর্থহীন একটা কাজ করে জীবণের মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করছে — সেটা বোঝালেন। তাকে আল্লাহর تعالى কথা মনে করিয়ে দিলেন — তখন এটা যিকর। যিকর মানে শুধুই নিজে নিজে দু’আ পড়া নয়।
যদি আমরা আল্লাহর تعالى বাণী শক্ত করে ধরি, নিষ্ঠার সাথে পালন করি, সবসময় নিজেরা মনে রাখি এবং অন্যদেরকে মনে করিয়ে দেই, তাহলে কী লাভ? لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ “যাতে করে তোমরা (আল্লাহর প্রতি) সচেতন হতে পারো।” তাকওয়া অর্জন করতে হলে আমাদেরকে সবসময় আল্লাহর تعالى বাণী শুধু নিজে মনে রাখলেই হবে না, অন্যদেরকেও মনে করিয়ে দিতে হবে। প্রতিনিয়ত যিকরের মধ্যে থাকতে হবে। না থাকলেই সর্বনাশ। শয়তান এসে সুড়সুড়ি দিয়ে আজে বাজে কাজে ডুবিয়ে দেবে।
আমরা যখন আরবি শিখি, আমাদেরকে لَعَلَّ -এর অর্থ শেখানো হয়: ১) হতে পারে যে, ২) আশা করা যায় যে। কিন্তু কু’রআনে আল্লাহ تعالى যখন লা’আল্লা ব্যবহার করেন, তখন তাঁর জন্য কোনো কিছুই অনিশ্চিত নয়, বা তাঁর ‘আশা করার’ কিছুই নেই। তিনি ভবিষ্যৎ জানেন, সব কিছুই হয় তাঁর ইচ্ছায়। বরং এখানে যাকে উদ্দেশ্য করে তিনি কিছু বলছেন, তার জন্য লা’আল্লা একটি আশার বাণী। সে যদি আল্লাহর تعالى কথা শুনে, তাহলে সে ফল পাওয়ার আশা করতে পারে। কিন্তু এখানে তাকে কোনো গ্যরান্টি দেওয়া হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত কী হবে, সেটা পুরোপুরি আল্লাহর تعالى ব্যাপার।[১][১০]
সুত্র:
- [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
- [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
- [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
- [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
- [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
- [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
- [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
- [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
- [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
- [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
- [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
- [১৪২] ذكر যিকর শব্দের বিস্তারিত অর্থ।
ei lekhagulo jodi pdf file a petham tahole valo hoto……
পেইজের একদম নিচে গেলে পিডিএফ করার একটা অপশন পাবেন।