এমন মানুষও আছে, যে আল্লাহকে ﷻ অনেক খুশি করার চেষ্টায় নিজেকে পুরোপুরি নিবেদিত করে দেবে — আল-বাক্বারাহ ২০৭-২০৯

ধরুন আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, আপনি কাজের পাশাপাশি সন্ধ্যায় ইউনিভারসিটি গিয়ে পার্টটাইম মাস্টার্স বা পিএইচডি করবেন। আপনার পরিবার আপনার এই সিদ্ধান্ত শুনে বড়ই খুশি হবে। বংশে একজন মাস্টার্স/পিএইচডি করা ছেলে/মেয়ে থাকবে, কী সৌভাগ্যের ব্যাপার! ক্লাসে যাওয়ার আগে আপনার জন্য নাস্তা টেবিলে রাখা থাকবে। ক্লাস করে এসে আপনি যেন শান্তিতে ঘুমোতে পারেন, সেজন্য বাচ্চাদেরকে আগেই ঘুম পাড়িয়ে রাখা হবে। মেহমানরা বেড়াতে এসে যেন আপনার পড়াশুনায় ক্ষতি না করে, সেজন্য চৌদ্দগুষ্টিতে সাবধান নোটিস চলে যাবে। কেউ যদি এসেও পড়ে, আপনি দেখা করতে না আসলে কোনো সমস্যা নেই, কারণ আপনার পরীক্ষা চলছে। আপনার পরীক্ষার সময় বাড়িতে কারফিউ পড়ে যাবে। কেউ জোরে টিভি ছাড়বে না, ফোনে গল্প করবে না, আপনাকে যথাসাধ্য সবরকম শান্তির ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। কিছুক্ষণ পর পর নাস্তা এবং চা আসতে থাকবে। একসময় আপনি গ্রাজুয়েট করবেন, আপনার স্বামী-স্ত্রী-বাবা-মা গর্ব করে সবার কাছে আপনার অর্জনের কথা বলবে।

কিন্তু ধরুন আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, কাজের পাশাপাশি আপনি একটা ইসলামিক ডিগ্রির জন্য পড়াশুনা করবেন, বা এলাকার মুসলিম ভাইবোনদের সাথে নিয়মিত ইসলামি আলোচনায় অংশ নেবেন। আপনার পরিবারের সদস্যরা এই কথা শোনার পর আপনার উপর শুরু হবে তাদের যাবতীয় দাবি এবং অভিযোগের বৃষ্টি। এমনিতেই কাজের বাইরে আপনাকে কম পাওয়া যায়, এখন কেন আরও কম পাওয়া যাবে? যেই কাজ করতে আপনি বাধ্য নন, কেন আপনি সেই কাজের পিছনে এত সময় দেবেন? এগুলো না করে শুধু নামাজ-রোজা করলে ক্ষতি কী হবে? আমরা কী মুসলিম না? এগুলো না করলে কী জান্নাতে যাওয়া যায় না? —এরকম হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যে আপনি কোনোমতে সবাইকে দিনের পর দিন ম্যানেজ করে, নিয়মিত তাদের কটু কথা শুনে হয়তো সপ্তাহে একদিন, দু’দিন করে ইসলামের জন্য পড়াশুনা করবেন, কোনো ইসলামি আলোচনা, সেচ্ছাসেবী কাজে মাসে এক-দুইবার অংশ নেবেন। কিন্তু আপনার এই কাজে সাহায্য করার জন্য কেউ টিভি দেখা কমিয়ে দেবে না, ফোনে গল্প করা বন্ধ করবে না, আপনার পড়ার সময় বাচ্চাগুলোকে অন্য ঘরে খেলতে নিয়ে যাবে না। আপনার পরীক্ষাই চলুক, কোনো জরুরি প্রোগ্রামই থাকুক, বা রংপুরে কম্বল বিতরণের দায়িত্বই থাকুক না কেন, বাসায় কোনো মুরব্বি আত্মীয় আসলে, শ্বশুর-শাশুড়ি আসলে, বাচ্চাদের পরীক্ষা চললে কেউ আপনাকে একটুও ছাড় দেবে না। আপনাকে তখন সব বাদ দিয়ে সামাজিকতা করতে হবে। বরং যখন আপনার পড়াশুনার বেশি চাপ যাবে, বা ইসলামি কাজে একটু বেশি সময় দিতে হবে, তখনি আপনার কাছের জনের মাথা বেশি গরম হয়ে যাবে, নিয়মিত ঝগড়া শুরু হবে। আত্মীয়স্বজন নিয়মিত আপনাকে ফোন করে আবার ‘সাধারণ মুসলিম’ হয়ে যাওয়ার জন্য বার বার আপনাকে বোঝাবে। কবে কোন মুসলিমকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল, জেলে নিয়ে কীভাবে পায়ের নখ তুলে নির্যাতন করেছিল, কোন ইসলামি দল কবে কোন নিরীহ মুসলিমকে ঘোল খাইয়েছিল —এই সব বলে আপনাকে নিয়মিত ভয় দেখাবে।

এইসব হাজারো ঝড়-ঝাপটা, প্রতিকূলতার মধ্যেও আপনি দাঁতে দাঁত চেপে ধৈর্য ধরে প্রতিদিন হাসিমুখে চেষ্টা করে যান। কারণ আপনার মতো মানুষদের কথাই আল্লাহ تعالى গর্ব করে কু’রআনে বলেছেন—

2_207

এমন মানুষও আছে, যে আল্লাহকে تعالى অনেক খুশি করার চেষ্টায় নিজেকে পুরোপুরি নিবেদিত করে দেবে। আল্লাহ تعالى তার বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত মমতাবান। [আল-বাক্বারাহ ২০৭]

2_207_title

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বলছেন যে, এমন মানুষ আছে, যারা يَشْرِى ইয়াশরি অর্থাৎ নিজেকে বিক্রি করে দেবে। সে নিজের সময়, মেধা, সম্পদকে বিক্রি করবে। আমরা প্রতিদিন জীবনের ১০-১২ ঘণ্টা বিক্রি করে দেই অফিসে, ব্যবসায়, পড়াশুনায়, যেন একসময় গিয়ে ব্যাংকে কিছু টাকা পেতে পারি। এভাবে আমরা প্রতিনিয়ত নিজের সত্তাকে বিক্রি করি, যেন এর বিনিময়ে কিছু না কিছু দুনিয়াতে পেতে পারি। এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এমন একজনের কথা বলছেন, যে তার নিজের সময়, সম্পদ, মেধা, এমনকি দরকার পড়লে নিজের দেহকেও বিক্রি করে দেবে আল্লাহর مَرْضَات মারদাত অর্থাৎ সন্তুষ্টি পাওয়ার আশায়। তবে শুধুই সন্তুষ্টি বা رضا পাওয়ার আশায় নয়, বরং مَرْضَات মারদা-ত, অত্যন্ত সন্তুষ্টি পাওয়ার আশায়। সে মনে প্রাণে চায় যেন আল্লাহ تعالى তার উপর অনেক খুশি হন। এর জন্য সে যে কোনো ত্যাগ করতে রাজি।

দুনিয়াতে আমরা আমাদের আশেপাশের মানুষদের খুশি করার অনেক চেষ্টা করি। অফিসের বসকে খুশি করার চেষ্টা করি, যেন প্রমোশন পাই। কিন্তু বছরের পর বছর পার হয়ে যায়, প্রমোশন আর হয় না। বাসায় স্বামীকে বা স্ত্রীকে খুশি রাখার কত চেষ্টা করি। জীবন পার হয়ে যায়, কিন্তু অপরপক্ষ একটা সপ্তাহও খুশি থাকতে পারে না। শ্বশুর বাড়িকে খুশি করার আপ্রাণ চেষ্টা করি, কিন্তু তাদের অভিযোগ কোনোদিন শেষ হয় না। বাচ্চাদেরকে খুশি করার কত চেষ্টা করি। একটা দিলে আরেকটা চায়, চাইতেই থাকে, কোনোদিন তৃপ্ত হয় না। এভাবে দুনিয়াতে মানুষকে খুশি করতে গিয়ে নিজের সবকিছু বিক্রি করে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে যাই। তারপর মধ্য বয়সে গিয়ে নিজের ভেতরে গভীর হতাশা চলে আসে। আস্তে আস্তে সম্পর্কগুলো দুর্বল হয়ে যেতে থাকে। পরিবারের প্রতি টান ছুটে যায়। প্রতিদিনের একই গণ্ডির ভেতর থেকে বের হয়ে আসার জন্য প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে।

একারণে একজন মুসলিম জানে যে, দুনিয়াতে কখনোই আমরা মানুষকে স্থায়ীভাবে খুশি করতে পারবো না। তাই মানুষের জন্য নিজেকে পুরোপুরি বিক্রি করে শেষ করে না দিয়ে, বরং তারচেয়ে লাভজনক বিনিয়োগ হচ্ছে আল্লাহকে تعالى খুশি করার চেষ্টা করা। কারণ আল্লাহকে تعالى খুশি করার জন্য নিজের যা কিছুই বিনিয়োগ করবো, তার হাজারগুণ মুনাফা একদিন ফেরত পাবো। একারণে একজন মুসলিম যত কষ্ট করেই হোক না কেন, দুনিয়ার হাজারো দায়িত্ব পালন করে ঠিকই সময় বের করার চেষ্টা করে, যেন আল্লাহকে تعالى খুশি করতে পারে। এরজন্য যত কটুকথা, ঠাট্টা-বিদ্রূপ, অভিযোগ, হুশিয়ারি, ব্ল্যাকমেইল, এমনকি আক্রমণও সে সহ্য করতে রাজি আছে।

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে আশা দিচ্ছেন যে, তিনি رَءُوف রাউফ অর্থাৎ মমতাবান, সমব্যাথি। রাউফ হচ্ছেন আপনার জীবনে সেই মানুষটি, যার কাছে আপনি আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ-কষ্টগুলোর সময় ছুটে যান। কারো বেলায় রাউফ হচ্ছেন তার ভাই বা বোন। কারো বেলায় সে একজন বন্ধু। কারো বেলায় সে অফিসের একজন কলিগ। সেই রাউফ আপনার জীবনে এমন একজন, যে আপনাকে সবার চেয়ে ভালোভাবে বুঝতে পারেন, আপনাকে সবার থেকে সুন্দর সান্ত্বনা দিতে পারেন। তার কাছে গিয়ে আপনি যে কোনো সময় বুক হাল্কা করে আসতে পারেন। তিনি কখনোই আপনাকে হতাশ করেন না।[১]

আল্লাহ تعالى হচ্ছেন আর-রাউফ অর্থাৎ সবচেয়ে বড় মমতাময়, সমব্যাথি। তিনি تعالى আমাদের কষ্ট সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝেন। আমাদের মন খারাপের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি تعالى উপলব্ধি করেন। প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস, চোখের কোনে গড়িয়ে পড়া অশ্রু তিনি تعالى লক্ষ্য করেন। বুকের ভেতরে জমে থাকা কষ্ট সবচেয়ে তীব্রভাবে তিনি تعالى অনুভব করেন। তাকে تعالى কখনো মুখ ফুটে কিছু বলতে হয় না আমার মন কত খারাপ, আমি কীসে কষ্ট পেয়েছি। কারণ তিনি تعالى সব দেখেছেন, সব শুনেছেন। আমার মনের ভেতরে যে ঝড় চলছে, সেটা তিনি تعالى সবচেয়ে গভীরভাবে বুঝতে পারেন। দুনিয়াতে আর কেউ নেই, কোনো বন্ধু, কোনো আত্মীয় নেই, যে কিনা তাঁর تعالى মতো করে আমাকে বুঝতে পারে। আমার জীবনে তার تعالى চেয়ে আপন আর কেউ নেই। সুতরাং তাকে تعالى খুশি করার চেষ্টা করতে গিয়ে আমি যত দুঃখ, কষ্ট সহ্য করছি, তার সবকিছু তিনি تعالى গভীর মমতা নিয়ে লক্ষ্য করছেন। সবকিছু তিনি تعالى লিখে রাখছেন। একদিন এই সবকিছুর পুরষ্কার তিনি تعالى আমাকে দেবেন।

তবে এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বলছেন: وَٱللَّهُ رَءُوفٌۢ بِٱلْعِبَادِ — আল্লাহর تعالى তার বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত মমতাবান। আল্লাহ تعالى সবার প্রতি একই রকম গভীর মমতা দেখান না। তার تعالى এই গভীর মমতা শুধু তার تعالى বান্দাদের জন্য। তাই প্রেমে বিফল হয়ে কেঁদে বুক ভাসিয়ে আল্লাহর تعالى কাছে মমতা আশা করে কোনো লাভ নেই। সম্পত্তি বিক্রি করে ঘুষ দিয়ে ব্যবসা ধরার চেষ্টা করে, শেষ পর্যন্ত বিফল হয়ে সব হারিয়ে নামাজে কান্নাকাটি করে আল্লাহর تعالى মমতা চাইলে হবে না। অবশ্যই আল্লাহ تعالى এতটাই ক্ষমাশীল এবং মমতাবান, যে তিনি تعالى মানুষকে বার বার ক্ষমা করে ফিরে আসার সুযোগ দেন। কিন্তু আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, তিনি تعالى কু’রআনে নিজেই বলেছেন: তিনি تعالى রাউফ তার বান্দাদের প্রতি।

এই আয়াত পড়ে আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, এখন আমাদের কাজ হচ্ছে পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজন, পড়ালেখা, চাকরি, ব্যবসা সব ছেড়ে দিয়ে মসজিদে গিয়ে বসবাস শুরু করা, দিনরাত নামাজ পড়া, কু’রআন তিলাওয়াত করা, এবং ইসলামের দাওয়াহ দেওয়া —ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়। কু’রআনেই আল্লাহ تعالى আমাদেরকে বলেছেন—

“আল্লাহ ছাড়া আর কোনো কিছুরই ইবাদত করবে না; বাবা-মার জন্য সবকিছু সবচেয়ে ভালোভাবে করবে; নিকটাত্মীয়, অসহায়-এতিম আর গরিব-সামর্থ্যহীনদের সাথেও; মানুষের সাথে খুব সুন্দর ভাবে কথা বলবে; সালাত প্রতিষ্ঠা করবে এবং যাকাত দিবে।” [আল-বাক্বারাহ ৮৩]

আমাদের দুনিয়ার প্রতি যাবতীয় দায়িত্ব ইসলামের নিয়ম অনুসারে পালন করার মধ্য দিয়েই আল্লাহকে تعالى খুশি করার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ تعالى শুধু নামাজ পড়লে বা কু’রআন তিলাওয়াত করলেই খুশি হন না, তিনি تعالى অত্যন্ত খুশি হন, যখন আমাদের বাবা-মা আমাদের প্রতি খুশি হয়ে প্রাণ খুলে দু’আ করেন। তিনি تعالى খুশি হন যখন স্ত্রী স্বামীর সাথে সুন্দর ব্যবহার করে, স্বামী স্ত্রীর ঠিকভাবে যত্ন নেয়। তিনি تعالى খুশি হন যখন সন্তানদেরকে আমরা ঠিকভাবে ইসলামের শিক্ষা দিয়ে বড় করে তুলি, এবং তারপর আমাদের মৃত্যুর পরেও তারা আমাদের জন্য সওয়াব অর্জন করতে থাকে। তিনি تعالى অত্যন্ত খুশি হন যখন আমরা এতিমদেরকে মুখে হাসি ফোঁটাই, গরিবদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই, অসহায় মানুষের জীবনের কষ্ট দূর করি।

দুঃখজনকভাবে, আজকাল মুসলিমদের মধ্যে একটা ধারণা জন্মে গেছে যে, আমরা যদি দিনে তিন-চার ওয়াক্ত নামাজ সময়মত পড়ি, ফজরের নামাজটা সপ্তাহে দুই একদিন যখনি পারি পড়ে নেই, রমজানে ত্রিশ দিন না খেয়ে থেকে হিন্দি সিরিয়াল, মুভি দেখি, আর ইফতারে গিয়ে পেট ঠেসে খেয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাই, বছরে এক-দুইবার গরিবদের কিছু টাকা দিয়ে আসি —তাহলে আমাদের জন্য জান্নাতের গ্যারান্টি দেওয়া আছে। এর বেশি কিছু করার কোনোই দরকার নেই। এর বেশি যাকে করতে দেখি, তাকেই আমরা বাড়াবাড়ি করছে বলে মনে করি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে পড়াটা আমাদের কাছে একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। দাঁড়ি রাখা, ঠিকমতো হিজাব করাটা তালেবান হয়ে যাওয়ার লক্ষণ। সিরিয়াল দেখা বন্ধ করা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারা ছেড়ে দেওয়া, সিনেমা হলে মুভি দেখতে না যাওয়া, দিনে ৪-৫ ঘণ্টা ভিডিও গেম না খেলা —এগুলো হচ্ছে ‘জিহাদি’ হয়ে যাওয়ার লক্ষণ। কোনো এক অদ্ভুত কারণে দিনে দিনে মুসলিমদের স্ট্যান্ডার্ড নামতে নামতে এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, আজকাল আম-জনতা মুসলিমদেরকে দেখে ঠিক বোঝা যায় না তারা আসলে কোন ধর্ম অনুসরণ করছে। তারা যে ধর্ম অনুসরণ করছে সেটা অন্তত কু’রআনে বলা নেই। কে এই ধর্ম প্রচার করেছে, সেটা বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার।

পরের আয়াতটি আমাদেরকে ইঙ্গিত দেবে এই অবস্থা কীভাবে হলো—

2_208

তোমরা যারা বিশ্বাস করেছো: পুরোপুরিভাবে আল্লাহর تعالى সামনে নিজেকে সমর্পণ করো। আর শয়তানের পথ অনুসরণ করবে না। সে তোমাদের এক প্রকাশ্য শত্রু। [আল-বাক্বারাহ ২০৮]

পুরোপুরিভাবে আল্লাহর تعالى সামনে নিজেকে সমর্পণ করো

আল্লাহ تعالى আমাদেরকে পার্ট-টাইম মুসলিম হতে বলেননি। ইসলাম কোনো ফ্যাশন নয় যে, আমাদের ইচ্ছামত অনুসরণ করবো, কয়েকদিন পর পর সুবিধামত পালটিয়ে নেবো।  যদি আমরা নিজেদেরকে মুসলিম বলে সত্যিই দাবি করি, তাহলে আমাদেরকে ফুল-টাইম মুসলিম হতে হবে। আমাদের কথা, কাজ, চিন্তা-ভাবনা, অভ্যাস, সংস্কৃতি, ফ্যাশন —সবকিছু ইসলাম সম্মত হতে হবে। সারাদিন অফিসে-স্কুল-কলেজে হাজারো গীবত করে, মিথ্যা বলে তারপর দুপুরে দশ মিনিট যুহরের নামাজ পড়লে, সেটা আল্লাহর تعالى কাছে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করা হলো না। ঘুষ দিয়ে-নিয়ে, অন্যায়ভাবে কাউকে প্রমোশন দিয়ে, কাউকে পছন্দ না হলে  দূরে গ্রামে ট্রান্সফার করে দিয়ে, মন্ত্রীর কাছে তদবির করে বিপুল সম্পত্তি কামিয়ে, তারপর সেই টাকায় হাজ্জ করে আসলে, সেটা আল্লাহর تعالى কাছে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করা তো বহু দূরের কথা, বরং এগুলো হবে শয়তানের পথ অনুসরণ করা।

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে সাবধান করে দিচ্ছেন যে, শয়তান আমাদেরকে নানারকম অন্যায়ের পথ দেখাবে। শয়তান সবসময় আমাদেরকে আরও চাওয়ার, আরও পাওয়ার জন্য উৎসাহ দিবে। আমাদের জীবনে যতই থাকুক, আমরা আরও চাইব। আমাদের ভেতরে সবসময় আরও কিছু পাওয়ার একটা জেদ থাকবে। কারণ আমরা যখন আমাদের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে যাবো, তখন আমরা ধীরস্থির, কৃতজ্ঞ হয়ে যাবো এবং আল্লাহর تعالى কথা ভাবা শুরু করবো। যার ফলে আমাদের ভেতরে প্রশান্তি আসবে এবং তা আমাদের পরিবারের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের ছেলেমেয়েগুলো সুস্থ পরিবারে বড় হয়ে আদর্শ মানুষ হবে। তখন তারা সমাজের মধ্যে সুখ, শান্তি ছড়িয়ে দিবে।

শয়তান কোনোভাবেই চায় না যে, এর কোনোটাই হোক। তাই যেভাবেই হোক শয়তান কখনও আমাদেরকে জীবনে ধিরস্থির হয়ে, নিজেকে নিয়ে ভাবার, আল্লাহকে تعالى নিয়ে ভাবার, পরিবারকে নিয়ে ভাবার সুযোগ হতে দিবে না। এর জন্য মোক্ষম উপায় হলো: আমাদেরকে নতুন মডেলের গাড়ি কেনার জন্য পাগল করে দেওয়া। নতুন মডেলের মোবাইল ফোন কিনে লোকজনকে দেখানোর জন্য অস্থির করে দেওয়া। ২০ ইঞ্চি টিভিটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফেলে দিয়ে একটা ৪০ ইঞ্চি টিভি কেনার জন্য তাগাদা দেওয়া, যেন আমরা প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবের সামনে মুখ দেখাতে পারি। এই সব করতে গিয়ে আমরা خُطُوَٰتِ ٱلشَّيْطَٰنِ অর্থাৎ শয়তানের পায়ে পায়ে পথ চলব। শয়তান আমাদের জন্য চলার পথ আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছে, এমনকি পায়ের ছাপও রেখে গেছে। আমরা সেই ছাপে পা দিয়ে হেঁটে হেঁটে শয়তানের পথে চলে যাবো।

সে তোমাদের এক প্রকাশ্য শত্রু

শয়তান তার অপকর্মগুলো আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখেনি। তার পদ্ধতিগুলো এমন কোনো গভীর ষড়যন্ত্র নয় যে, উচ্চপর্যায়ের দার্শনিক না হলে আমাদের পক্ষে তা বোঝা সম্ভব নয়। সে একেবারে আমাদের চোখের সামনে সব শয়তানি করে বেড়াচ্ছে। শয়তান আমাদের চোখের সামনে রাস্তায় বিলবোর্ডে সাবান মেখে, শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে হাসি দিচ্ছে। সে আমাদের পাশের টেবিলে বসে ফোনে প্রেমালাপ করছে। শয়তান আমাদেরকে মোবাইল ফোনে কল করে ডাকছে ‘ইয়ে’ করতে যাওয়ার জন্য। আমরা বোকা মানুষ তাকে চোখের সামনে দেখেও বুঝতে পারছি না। আজকাল আমরা নিজেদেরকে এতটাই নিচু পর্যায়ের বুদ্ধিহীন প্রাণীতে পরিণত করেছি যে, শয়তান আমাদের চোখের সামনে এসে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেও আমরা বুঝি না যে, সেটা শয়তান ছিল।

এখনো সময় আছে আমাদের সাবধান হয়ে যাওয়ার জন্য। আল্লাহ تعالى আমাদেরকে আবারো সতর্ক করে দিচ্ছেন—

2_209

তোমাদের কাছে পরিষ্কার প্রমাণ আসার পরেও তোমরা যদি নিজেদের অধঃপতন ঘটাও, তাহলে জেনে রেখো: সমস্ত ক্ষমতা, কর্তৃত্ব আল্লাহর تعالى, তিনি মহাপ্রজ্ঞাবান। [আল-বাক্বারাহ ২০৯]

সূত্র:

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
  • [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
  • [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
  • [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
  • [১৫] তাফসির আল জালালাইন।
  • [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ।

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

6 thoughts on “এমন মানুষও আছে, যে আল্লাহকে ﷻ অনেক খুশি করার চেষ্টায় নিজেকে পুরোপুরি নিবেদিত করে দেবে — আল-বাক্বারাহ ২০৭-২০৯”

  1. Assalamu Alaikum.Vaia, apnar lekha gulo ami motamuti shobi poresi Alhamdulillah.Sura Al-Baqarah nie apnar lekha gulo khub valo legese.kintu 207-209 Ayater por ki r apni likhen nai?vaia Dhakai kono valo Islamic institution er nam bolte parben jeikhan theke ami Arabic language shikhte parbo Quran bujhar jonno?

  2. Assalamu Alaikum Wa Rahmatullah.Allah apnar kollan korun.ami comment post korbar porei baki Ayatgulo peyesi.apnar Poro boitar por onno kono boi ki prokashito hoyese?Quraner khub valo kono bangla tafsirer nam bolte parben pls?

  3. মাস-আল্লাহ।।
    আসাধারন লিখা।।
    আল্লাহ আপনাকে সুস্ত রাখুক!

Leave a Reply to Maria Sultana Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *