অনেকে আছে যারা শুধুই চায়, “ও রব্ব, আমাদেরকে দুনিয়াতে দিন” — আল-বাক্বারাহ ২০০-২০২

আমরা যখন হাজ্জ করতে যাই, আমাদের উদ্দেশ্য থাকে কীভাবে আমরা আল্লাহকে تعالى খুশি করতে পারি, যেন তিনি আমাদেরকে জান্নাত দেন। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, অনেকে হাজ্জে যান, কারণ তার দুনিয়াতে অনেক কিছু দরকার, এবং তিনি শুনেছেন হাজ্জে গিয়ে চাইলে নাকি সব পাওয়া যায়। যার ফলে তার হাজ্জে যাওয়াটা হয়ে যায়, মন্ত্রীর কাছে গিয়ে তদবির করার মতো একধরনের তদবির অনুষ্ঠান। হাজ্জে গিয়ে তার দু’আ হয়, “ও আল্লাহ, تعالى আমার ব্যবসাটা ভালো করে দিন, আমাকে চাকরিতে প্রমোশন দিন। আমাকে একটা বাড়ি কিনতে দিন। আমার ছেলেমেয়েকে বিদেশে পাঠাতে দিন। আমার জমিগুলোকে নিরাপদ রাখুন। আমার স্ত্রীর অত্যাচার দূর করে দিন। আমার ডায়াবেটিস ঠিক করে দিন।…” —অবশ্যই এগুলো চাওয়াটা দোষের নয়, কিন্তু আমাদেরকে বুঝতে হবে: এই মহাবিশ্বে আমাদের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য কী। কেন আমাদেরকে সৃষ্টি করে এই পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। আমরা যদি দুনিয়ার পেছনে দৌড়াতে গিয়ে এই বিরাট ব্যাপারটাকে বেশি গুরুত্ব না দেই, ভুলে যাই, হাজ্জের মতো এত বড় একটা সুযোগ পেয়েও উপলব্ধি না করি, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, কারণ আল্লাহ تعالى বলেছেন—

2_200

হাজ্জের অনুষ্ঠানগুলো শেষ করার পর, আল্লাহকে تعالى বেশি করে মনে করবে, যেভাবে তোমাদের বাপদাদাদের মনে করো। না, বরং তারচেয়ে বেশি করে! কারণ অনেকে আছে যারা শুধুই চায়, “ও রব্ব, আমাদেরকে দুনিয়াতে দিন” —এদের জন্য পরকালে বিন্দুমাত্র কোনো ভাগ থাকবে না। [আল-বাক্বারাহ ২০০]

আগেকার আমলে হাজ্জ শেষ হওয়ার পর হাজ্জিরা একসাথে বসে তাদের বাপ-দাদাদের কৃতিত্ব নিয়ে গল্প করতো —কে কবে কাকে কত খাইয়েছে, কত সাহায্য করেছে, কত জমিজমা করেছে, কত যুদ্ধ করেছে, কত বীর পদক পেয়েছে ইত্যাদি।[১২][১৪][৬] আজকের দিনে আমরা বাপ-দাদাদের নিয়ে এভাবে গর্ব করি না। আমাদের গল্পগুলো হয়ে গেছে: কার বাবা মন্ত্রী, কার দাদা জমিদার ছিলেন, কে সৈয়দ বংশের, কার চাচা হাজ্জ কাফেলার চেয়ারম্যান ইত্যাদি। হাজ্জের মতো এত মূল্যবান সময়গুলো আমরা পার করি এসব খোশ গল্প করে।

শুধু তাই না, হাজ্জে গিয়ে আমরা খোঁজ খবর নেই: আমাদের সাথে যেই হাজ্জিরা এসেছেন, তারা দেশে কী করছেন, কার কত বড় ব্যবসা, কে কত বড় পজিশনে আছেন। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে প্রশ্ন করে বের করার চেষ্টা করি: কে কত বড়লোক, কার উপরের লেভেল কত কানেকশন আছে। তারপর সুযোগে থাকি কার সাথে বেশি করে খাতির করে দেশে ফিরে গিয়ে ব্যবসা করা যায়, চাকরির প্রমোশনের জন্য তদবির করা যায় ইত্যাদি। আমাদের আলাপ আলোচনার একটা বড় অংশ হয়ে যায়: দুনিয়া। অথচ হাজ্জে গিয়ে আমাদের প্রথমেই যা ভুলে যাওয়ার কথা ছিল, তা হলো: দুনিয়া।

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এমন মানুষদের কথা বলছেন, যাদের অন্তরে শুধুই দুনিয়া। এরা দুনিয়াতে এতটাই ডুবে গেছে যে, এত কাঠখড় পুড়িয়ে হাজ্জে এসেও তাদের দু’আর সিংহভাগই থাকে দুনিয়া — “ও রব্ব, আমাদেরকে দুনিয়াতে দিন”। যারা এভাবে শুধুই দুনিয়ায় পাওয়ার চেষ্টা করেন, তাদের জন্য পরকালে কোনোই ভাগ থাকবে না।

আল্লাহকে تعالى বেশি করে মনে করবে

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বলছেন, “আল্লাহর تعالى যিকর করো”। ٱذْكُرُوا۟ এসেছে ذكر যিকর থেকে, যা কু’রআনে অনেকগুলো অর্থে এবং উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে: ১) উল্লেখ করা, ২) মুখস্থ করা, ৩) পুনরায় মনে করা, ৪) মনে রাখা, ৫) কিছু নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা, ৬) উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা, ৭) উপলব্ধি করে অনুতপ্ত হওয়া, ৮) কোনো শিক্ষাকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা ইত্যাদি। অনেক সময় আমরা যিকর বলতে শুধু নিজের মনে কোনো আরবি দু’আ বার বার পড়া মনে করি। কিন্তু যিকরের একটি অর্থ হলো: কাউকে মনে করানো, উল্লেখ করা। ধরুন, আপনার পরিবারের এক সদস্য গত কয়েক ঘণ্টা ধরে সোফায় বসে একটার পর একটা চ্যানেল পাল্টাচ্ছে, আর হাতে চিপস নিয়ে যাবর কাটছে। আপনি গিয়ে তাগাদা দিলেন: সে কী চরম অর্থহীন একটা কাজ করে জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করছে —সেটা ভালো করে বোঝালেন। তাকে আল্লাহর تعالى কথা মনে করিয়ে দিলেন —তখন এটা যিকর হয়ে যাবে। যিকর মানে শুধুই নিজে নিজে দু’আ পড়া নয়।[১]

এছাড়াও, আল্লাহকে تعالى মনে করা মানে শুধু মুখে যিকর করাই নয়, বরং তাঁর আদেশ অনুসারে কাজ করা, এবং নিষেধ অনুসারে খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকাই হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে তাঁকে تعالى মনে করা।[৪][১৪] কারণ আমরা যখন আল্লাহর تعالى নির্দেশকে অমান্য করতে থাকি, তখন আমরা তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ে যাই। যখন আমরা অফিসের কাজ, বাচ্চাকে স্কুলে আনা-নেওয়া, সপ্তাহের বাজার, মেহমানদারী করতে গিয়ে ওয়াক্তের পর ওয়াক্ত নামাজ ছেড়ে দেই, আমরা শুধু তাঁর অবাধ্যই হই না, তাঁর প্রতি আমরা অকৃতজ্ঞও হয়ে যাই।

হাজ্জ হচ্ছে যিকর করার একটা বিরাট সুযোগ। লক্ষ লক্ষ হাজ্জি এসে দিনরাত আল্লাহর تعالى যিকর করছেন, এত বড় একটা ব্যাপার চোখের সামনে থাকার পর কারো কোনোভাবেই মোবাইলে ফেইসবুকে তাকানোর কথা নয় বা বিভিন্ন এংগেলে ছবি তোলার কথা নয়। নিজের চোখের সামনে হাজার হাজার হাজ্জির আল্লাহর تعالى কাছে হাত তুলে আকুল কান্না দেখে, কখনো বসে পাশের জনের সাথে খোশ গল্প করার মতো চিন্তা মাথায় আসার কথা নয়। আরাফাতের দিনে লক্ষ হাজ্জির সাথে এক হয়ে, এমন পবিত্র, আবেগঘন পরিবেশে এসে কারো শুধুই দুনিয়ার জন্য চাওয়ার কথা নয়। হাজ্জের মতো এত বড় একটা সুযোগ হাতে পেয়ে আমাদের কী চাওয়ার কথা, তা এসেছে এর পরের আয়াতে—

2_200-201

2_2012_202

আবার অনেকে আছে, যারা বলে, “ও রব্ব, আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন, পরকালেও কল্যাণ দিন এবং আগুনের শাস্তি থেকে বাঁচিয়ে রাখুন।” —এরাই হচ্ছে তারা, যারা তাদের অর্জনের ভাগ পাবে। আল্লাহ تعالى দ্রুত হিসাব নেন। [আল-বাক্বারাহ ২০১-২০২]

এই সেই বিখ্যাত দু’আ, “রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাতাও, ওয়া ক্বিনা আযাবান নার”। এই দু’আতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে ভারসাম্য শেখাচ্ছেন: আখিরাত ভুলে গিয়ে শুধুই দুনিয়ার জন্য চাইলে হবে না, আবার “দুনিয়া বিশ্বাসীদের জন্য কারাগার, অবিশ্বাসীদের জন্য স্বর্গ” — এই ভেবে দুনিয়ার উপর সব আশা ছেড়ে দিয়ে শুধুই আখিরাতের জন্য চাইলে হবে না। বরং আমাদের চাওয়ার মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হবে। কারণ দুনিয়াতে ভালো থাকলে আখিরাতের জন্য কাজ করাটা অনেক সহজ হয়ে যায়।

যে মানুষ ভোরবেলা বের হয়ে সারাদিন অমানুষিক পরিশ্রম করে রাতে ঘরে ফেরে: শুধুই তার বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য, তার জন্য সময় বের করে মসজিদে ইসলামি আলোচনায় অংশ নেওয়াটা বড়ই কঠিন হয়ে যায়। সারাদিন অমানুষিক পরিশ্রমে ব্যস্ত থেকে, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা ধরে রেখে, নিত্যদিনের তিক্ততা পার করে, তারপর নিজেকে নিয়ে চিন্তা করা, নিজের আখিরাতের কল্যাণের জন্য কাজ করার তাগিদ সে অনুভব করতে পারে না। একারণে দুনিয়ার জীবন সহজ হয়ে গেলে আখিরাতের জন্য কাজ করাটাও সহজ হয়ে যায়। আর এজন্যই আল্লাহ تعالى এই দু’আতে প্রথমেই আমাদেরকে দুনিয়ার কল্যাণ চাইতে বলেছেন।

এই দু’আতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে কী শেখাচ্ছেন, সেটা যদি আমরা ভালো করে বুঝি, তাহলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যাবে। বোঝার আগের মুনাজাতগুলো, আর বোঝার পরের  মুনাজাতগুলোতে বিরাট পার্থক্য আসবে। আল্লাহ تعالى এই আয়াতে আমাদেরকে শেখাচ্ছেন যে, আমরা যেন তার কাছে দুনিয়াতে حَسَنَةً‘হাসানাহ’ চাই, এবং আখিরাতেও حَسَنَةً ‘হাসানাহ’ চাই। কেন আল্লাহ تعالى ঈমান, সম্পদ, নিয়ামত, বরকত —এই সব কিছুর কথা না বলে হাসানাহ বললেন, তা বুঝতে হলে আমাদের হাসানাহ শব্দের অর্থ বুঝতে হবে।

হাসানাহ অর্থ হচ্ছে মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে, পছন্দনীয় এমন সবকিছু। যেকোনো উপভোগ্য নিয়ামত হাসানাহ’র মধ্যে পড়ে, যা মানুষ তার দেহ, মন, আত্মার জন্য অর্জন করতে পারে।[৩৩৮] হাসানাহ কারো জন্য সুস্বাস্থ্য, কারো জন্য জ্ঞান, কারো জন্য সম্পদ, কারো জন্য পরিবার, কারো জন্য ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, কারো জন্য ইবাদতে মনোযোগ, বেশি তাকওয়া, লোভ সংবরণ। আল্লাহ تعالى জানেন দুনিয়াতে কখন কার জন্য কোনটা কল্যাণকর হবে, কোনটা ‘হাসানাহ’ হবে।[৪] আর পরকালে গিয়ে হাসানাহ কী হবে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না, কারণ সবাই জানেন যে, সেটা হচ্ছে জান্নাত।[৪][১৪][৬][১২]

একজন মানুষ তার জীবনে যা কিছু পেতে পারে: ১) দুনিয়াতে ভালো থাকা, ২) আখিরাতে জান্নাত পাওয়া, ৩) জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা —তার সবই আমরা এই এক দু’আ থেকেই চাচ্ছি। এই এক দু’আতেই আল্লাহ تعالى আমাদের যাবতীয় চাওয়াকে এক কথায় শিখিয়ে দিয়েছেন। একইসাথে এই দু’আতে আমরা বলে দিচ্ছি, “ও আল্লাহ تعالى, আমি আপনার কাছে বাড়ি, গাড়ি, টাকা চাইবো না, আপনিই আমার থেকে ভালো জানেন আমার জন্য সবচেয়ে ভালো কী হবে। আমি শুধু আপনার কাছে আমার জন্য কল্যাণ চাইচ্ছি। আমার জন্য যা কিছুই ভালো হবে, সেটাই আমাকে দিন।” —এর আগের আয়াতেই আমরা দেখেছি, যারা দুনিয়া নিয়ে মজে থাকে, তারা শুধু চায়, “ও রব্ব, আমাদেরকে দুনিয়াতে দিন”। দুনিয়াতে টাকা দিন, বাড়ি দিন, গাড়ি দিন, জমি দিন,… —এরা আল্লাহর تعالى কাছে দুনিয়াতে হাসানাহ-ও চায় না, খালি দুনিয়ার জিনিস চায়।

আমরা অনেকেই আল্লাহর تعالى কাছে শুধু দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জিনিসগুলো বেশি বেশি করে চাই। তারপর দুনিয়ার সেই জিনিসগুলো নিয়ে আমাদের কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকে না, শুধুই চিন্তা থাকে কীভাবে দুনিয়াতে আরাম-আয়েস করা যায়, সমস্যা থেকে দূরে থাকা যায়। কিন্তু আমরা একটু চেষ্টা করলেই, আমাদের দুনিয়ার চাওয়া-পাওয়াগুলোতে আখিরাতের জন্যও কাজে লাগাতে পারি। যেমন, আমরা আল্লাহর تعالى কাছে হাত তুলে, “ও আল্লাহ تعالى, আমাকে টাকা পয়সা দিন, এইভাবে আর কত দিন? বাচ্চাদেরকে ভালো স্কুলে দিতে পারি না, বাবা-মাকে চিকিৎসা করাতে পারি না। জীবনটা এত কষ্টের কেন?” —এভাবে না চেয়ে, আমরা এভাবে চাইতে পারি, “ও রাব্ব تعالى, আমি আমার সন্তানদের ইসলামিক স্কুলে দিয়ে, তাদেরকে যোগ্য মুমিন বানাতে চাই। আমাকে একটু সচ্ছল করে দিন, যেন আমি তাদেরকে ভালো স্কুলে পড়ানোর খরচ যোগাতে পারি। আমার বাবা-মার চিকিৎসা করে তাদের প্রতি আমার দায়িত্ব পালন করতে চাই, তাদেরকে ইসলাম শেখাতে চাই। আমাকে একটু সম্পদ দিন, আমার জীবিকা অর্জন সহজ করে একটু ফ্রি সময়ের ব্যবস্থা করে দিন। আমাদের একটা নিজেদের বাড়ি দিন, যেন আমি স্ত্রী, মেয়েদের নিয়ে যথাযথ পর্দার সাথে থাকতে পারি।” —এভাবে যদি আমরা আমাদের নিয়তগুলোকে পরিশুদ্ধ করে, দুনিয়ার প্রতিটি চাওয়াকে আখিরাতের অর্জনের জন্য পাথেয় হিসেবে চাইতে পারি, এবং পাওয়ার পর সেই ওয়াদা রাখতে পারি, তাহলে আমরা দুনিয়াতেও কল্যাণ পাবো, আখিরাতেও কল্যাণ পাবো, ইন শাআ আল্লাহ تعالى

আরেকটি ব্যাপার হলো, আল্লাহ تعالى কু’রআনেই আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছেন: কী করলে আমরা দুনিয়াতে সচ্ছল হবো—

তোমার রাব্বের কাছে পাপের জন্য ক্ষমা চাও। নিঃসন্দেহে তিনি বার বার ক্ষমা করেন। তাহলে তিনি তোমাদের জন্য আকাশ থেকে পর্যাপ্ত বৃষ্টি পাঠাবেন। তোমাদের সম্পদ এবং সন্তান বাড়িয়ে দেবেন। তিনি তোমাদেরকে বাগান দেবেন, নদী-নালা প্রবাহিত করে দেবেন। —তোমাদের সমস্যাটা কী? তোমরা আল্লাহর تعالى মহত্ত্ব আশা করো না কেন? যেখানে তিনি তোমাদেরকে ধাপে ধাপে সৃষ্টি করেছেন? কখনো চিন্তা করে দেখেছ কীভাবে আল্লাহ تعالى সাত আকাশ সৃষ্টি করেছেন, একটার উপরে আরেকটা? চাঁদকে এদের মধ্যে রেখেছেন আলো হিসেবে, সূর্যকে জ্বলন্ত প্রদীপ হিসেবে? কীভাবে তিনি তোমাদেরকে উদ্ভিদের মতো পৃথিবী থেকে বের করে এনেছেন? তারপর তিনি তোমাদেরকে আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেবেন, তারপর একদিন আবার এর থেকে বের করে আনবেন। আর কীভাবে তিনি পৃথিবীকে প্রশস্ত করে ছড়িয়ে দিয়েছেন, যেন তোমরা এর প্রশস্ত পথে চলতে পারো? [আন-নুর ১০-১৩]

আমরা জীবনে অনেক পাপ করেছি। যদি আমরা আল্লাহ تعالى কাছে দুনিয়াতে সম্পদ, সন্তান পাওয়ার আশা রাখি, তাহলে আমাদের প্রথম কাজ: আল্লাহর تعالى কাছে নিজের অন্যায়ের জন্য বার বার ক্ষমা চাওয়া, আর নিজেকে সংশোধন করা। একইসাথে আল্লাহর تعالى উদারতা, তাঁর تعالى মহত্ত্বের উপর আশা রাখতে হবে। তিনি যে এত সুন্দর একটা জগৎ আমাদের চারপাশে সৃষ্টি করেছেন, তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। তার সৃষ্টির রহস্য নিয়ে ভাবতে হবে। নিজের চিন্তাভাবনাকে সারাদিন শুধুই খাওয়া-পড়া-বিনোদনের গণ্ডির মধ্যে না রেখে, কৌতূহল নিয়ে আকাশ এবং পৃথিবীর বিশাল বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিজগৎ নিয়ে ভাবতে হবে। কীভাবে আমরা আসলাম, কোথায় আমরা যাবো, তারপর আমাদের কী হবে? —জীবনের এই বড় প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হবে। আমাদের প্রত্যেকের জীবনের মূল্য অনেক। আমরা এই পৃথিবীতে শুধুই পশুর মতো খাওয়া, মলত্যাগ, আর বাচ্চা জন্ম দিতে আসিনি।

কিছু মুসলিম সম্প্রদায় দুনিয়াকে ঘৃণা করে, দুনিয়ার সাথে যাবতীয় সম্পর্ক ছেদ করে, শুধুমাত্র আধ্যাত্মিকতায় ডুবে থাকার জন্য মানুষকে তাগাদা দেয়। কিন্তু সেটা কু’রআনের শিক্ষার পরিপন্থী।[৪] কু’রআনে আল্লাহ تعالى বহুবার বলেছেন যে, তাঁর تعالى এই সুন্দর পৃথিবীটা ঘুরে দেখতে, হালাল, সুন্দর খাবার উপভোগ করতে, দুনিয়াতে কল্যাণ পাওয়ার চেষ্টা করতে, আল্লাহর تعالى দেওয়া অনুগ্রহ অনুসন্ধান করতে। ইসলাম অন্য ধর্মের মতো সন্ন্যাসী হয়ে বনবাস সমর্থন করে না। একইসাথে ইসলাম সমর্থন করে না যে, কোনোভাবে নিম্নমানের একটা জীবন পার করে সারাদিন আধ্যাত্মিকতায় ডুবে থাকার। বরং কু’রআনে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে বার বার দুনিয়া এবং আখিরাতের মধ্যে ভারসাম্য করতে বলেছেন। আখিরাতকে পেতে গিয়ে দুনিয়ার দায়িত্বগুলো অবহেলা করতে বলেননি। বরং একজন মুসলিমের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা হচ্ছে: বাবা, মা, ভাই, বোন, প্রতিবেশী, নিকটাত্মীয়, স্বামী, স্ত্রী, সন্তান, সমাজের এতিম, গরিব, মুসাফির, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, অধিনস্ত কর্মচারী, চাকরি, ব্যবসা, সমাজ কল্যাণ, পরিবেশ রক্ষা, শান্তি রক্ষা, রাজনীতি, যুদ্ধ —এগুলোতে কোনোভাবে জড়িত হলে বা জড়িত হওয়ার দাবি থাকলে, তা নিষ্ঠার সাথে আদায় করা।

আয়াতের শেষের অংশটি চিন্তার ব্যাপার— “আগুনের শাস্তি থেকে নিরাপদ রাখুন।” প্রশ্ন আসে, যদি দুনিয়া এবং আখিরাতে কল্যাণ পেয়েই যাই, তাহলে আগুনের শাস্তি থেকে নিরাপদ রাখার কী দরকার?

কেউ জান্নাত পেয়ে যাবে মানে এই না যে, সে জাহান্নামে গিয়ে শাস্তি পাবে না। বরং অনেক মুসলিম জাহান্নামের আগুনে শাস্তি পেয়ে, তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে, শেষ পর্যন্ত জান্নাতে যাবে। আমরা যেন বনি ইসরাইলিদের মতো না বলি,

“আর ওরা বলে, ‘আগুন আমাদেরকে মাত্র কয়েকটা দিনই স্পর্শ করবে।’” [আল-বাক্বারাহ ৮০]

যারা শুধুই দুনিয়া এবং আখিরাতে কল্যাণ পাওয়ার চেষ্টা করবেন, কিন্তু জাহান্নামে গিয়ে শাস্তি পাওয়া থেকে বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবেন না, তাদের অবস্থা হবে এরকম—

আপনি চৌধুরী সাহেবকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করছেন তার হারাম ব্যবসাটা বন্ধ করার জন্য। কিন্তু সে পাত্তা দিচ্ছে না। তার কথা হচ্ছে, “ভাই, বুঝলাম এই ব্যবসার জন্য আমার শাস্তি হবে। কিন্তু একদিন না একদিন তো জান্নাতে যাবই। কত হাজার টাকা এতিম খানায় দিলাম, গরিব আত্মীয়স্বজনদের দিলাম। জীবনে কত নামাজ পড়েছি, রোজা রেখেছি। কয়েকটা দিন না হয় জাহান্নামে কষ্ট করলামই। কী যায় আসে?”

—ঠিক এই ধরনের মানুষদেরকে আল্লাহ تعالى সতর্ক করে দিচ্ছেন আগুনের শাস্তির কথা মনে করিয়ে দিয়ে। আমরা যেন বার বার এই দু’আ করে নিজেকে বোঝাই যে, শুধু ভালো কাজ করলেই হবে না, একই সাথে খারাপ কাজ করাটাও বন্ধ করতে হবে। জাহান্নামে একদিনও যেন শাস্তি পেতে না হয়, সে জন্য সতর্ক থাকতে হবে, আল্লাহর تعالى কাছে বার বার আগুনের হাত থেকে রক্ষা চাইতে হবে। হাতে এক কাপ ফুটন্ত চা পড়লে কেমন লাগে, সেটা আমরা অনেকেই জানি। আমরা নিশ্চয়ই চাইবো না যে, আমাদেরকে জাহান্নামে ধরে নিয়ে গিয়ে একটা সপ্তাহও সারা গায়ে ফুটন্ত পানি ঢেলে বার বার ঝলসে দেওয়া হোক।

সূত্র:

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
  • [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
  • [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
  • [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
  • [১৫] তাফসির আল জালালাইন।
  • [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ।
  • [১৪২] ذكر যিকর শব্দের বিস্তারিত অর্থ: http://ejtaal.net/aa/#q=ذكر
  • [৩৩৮] Seekershub.org,. (2009). What Is The Difference Between “Barakah”, “Hasanah”, and “Ni`mah”?. Retrieved 1 November 2015, from http://seekershub.org/ans-blog/2009/08/16/what-is-the-difference-between-barakah-hasanah-and-nimah/

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

2 thoughts on “অনেকে আছে যারা শুধুই চায়, “ও রব্ব, আমাদেরকে দুনিয়াতে দিন” — আল-বাক্বারাহ ২০০-২০২”

  1. আস সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ ।

    @ইসলামকে পূর্নাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করুন।
    @শুধু সুরা বাকারাহ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ কেন?
    @মুসলমানদের একতাবদ্ধ হতে লিখুন ।

Leave a Reply to Kazi Rafiqul Islam Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *