আমরা কি বোকাদের মতো বিশ্বাস করবো? বাকারাহ ১১-১৬

এবার আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এক অদ্ভুত প্রজাতির মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবেন, যারা মুনাফিকদের মতো একেবারে ভন্ড না, আবার কাফিরদের মতো একদম পরিষ্কার শত্রুও নাঃ

2_11

যখন তাদেরকে বলা হয়, “পৃথিবীতে দুর্নীতি সৃষ্টি করো না”,  তারা বলে, “অবশ্যই না! আমরা শুধুই সংস্কার [শান্তি প্রতিষ্ঠা, সংশোধন] করছি মাত্র!”

এই আয়াতে মানুষগুলো দাবি করছে যে, তারা হচ্ছে মুসলিহুন مُصْلِحُونَ – অর্থাৎ যারা ভুল জিনিসকে ঠিক করে, ভেঙ্গে পড়া কিছুকে আবার জোড়া লাগায়, দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। এখানে আল্লাহ্ ‌تعالى এমন এক ধরনের মানুষদের কথা বলছেন, যারা মনে করে যে, তারা সংস্কার করছে, সমাজের দোষ-ত্রুটিগুলো সংশোধন করছে, ইসলামের ‘সমস্যাগুলো’ তারা ঠিক করছে, কিন্তু আসলে তারা বোঝে না যে, তারা আসলে নিজেরাই দুর্নীতি ছড়াতে সাহায্য করছে।[১]

ধরুন আপনি যদি আপনার মসজিদের সভাপতিকে বলেন, “চৌধুরী সাহেব, একি করছেন? মসজিদে যদি এমপিকে ডেকে এনে প্রতি জুম্মায় লেকচার দিতে দেন, তাহলে তো শিঘ্রি সে তার দলবল নিয়ে  মসজিদেকে তার রাজনৈতিক দলের অফিস বানিয়ে ফেলবে!” কিন্তু সে বলবে, “না ভাই, মসজিদকে শুধুই নামায পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখলে হবে? এভাবে আস্তে আস্তে আমাদেরকে মসজিদগুলোকে আরও অনেক কাজে লাগাতে হবে। তাহলে মসজিদে অনেক মানুষের আনাগোনা হবে। এভাবেই আমরা সমাজের উন্নতি করবো। আর রাজনৈতিক দলের সমর্থন পেলে মসজিদের ফান্ডের কোনো অভাব হবে না।” এরপর সে গিয়ে এলাকার এমপির সাথে হাত মিলিয়ে মসজিদকে একটা পুরদস্তুর রাজনৈতিক কেন্দ্র বানিয়ে ফেলবে। এমপি তার ক্ষমতা ব্যবহার করে একদিন মসজিদের বোর্ডের মেম্বার হয়ে যাবে। তারপর প্রতি শুক্রবার জুম্মার খুতবায় ইমাম যতটা না আল্লাহ্‌র تعالى কথা বলবে, তার চেয়ে বেশি করে সেই এমপির গুণগান করবে। এতো সবের পরেও মসজিদ অল্প কিছু দান ছাড়া শেষ পর্যন্ত কোনো বড় ধরনের ফান্ড পাবে না। মাঝখান থেকে এমপির গুণগানে কোনো ভুল হলে, ইমামের চাকরি খেয়ে ফেলার জন্য উপর তলা থেকে নির্দেশ আসবে।

আপনার এলাকার স্কুলের প্রধান শিক্ষককে গিয়ে আপনি বললেন, “আহমেদ সাহেব! এসব কী শুনছি? আপনারা নাকি বিজ্ঞান বইয়ে বিবর্তনবাদ শেখানো বাধ্যতামূলক করেছেন, যেখানে বলা হয় মানুষ সম্ভবত অন্য প্রাণী থেকে রূপান্তরিত হয়েছে?[১০] সৃষ্টিকর্তা নেই, প্রকৃতি আপনা আপনি সৃষ্টি হয়েছে – এই সব বিতর্কিত ধারণা ছোট কালেই বাচ্চাদের মাঝে ঢুকিয়ে দিলে তারা কী শিক্ষা নিয়ে বড় হবে? কী করছেন আপনারা এসব!” সে বলবে, “ভাই, আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে যুগোপযোগী বিজ্ঞান শেখাতে হবে। আমেরিকা-ইংল্যান্ডের কারিকুলামের সাথে মিল রাখতে হবে, যাতে করে তারা বিদেশে গিয়ে ক্রেডিট ট্রান্সফার করতে পারে। তাছাড়া আমরা ছোট ছেলেমেয়েদেরকে ধর্ম শেখানো বাধ্যতামূলক করতে পারি না। তারা ইসলাম শিখবে কি শিখবে না – এটা তো তাদের নিজেদের ব্যাপার। এমন তো হতে পারে যে, অনেক ছেলেমেয়ে নাস্তিকের ঘরের, তারা ধর্ম শিখতে চায় না। তাদেরকে তো আমরা ইসলাম শিখতে বাধ্য করতে পারি না।” এভাবে সে একদল ‘উপদেষ্টার’ পাল্লায় পড়ে – “প্রগতিশীল স্কুল” হিসেবে স্কুলের নাম হবে – এই আশায় সে স্কুলের কারিকুলাম থেকে ইসলাম শিক্ষাকে বাদ দিয়ে “আধুনিক বিজ্ঞান”-এর ছদ্মবেশে ডারউইনিজমের ‘নাস্তিকতার বিজ্ঞান’ ঢুকিয়ে দিবে।

এই ধরণের অনেক মানুষ আছে যারা মনে করে যে, তারা আসলে সমাজের, দেশের উন্নতি করছে, কিন্তু আসলে তারা তাদের থেকেও চালাক কিছু মানুষদের পলিটিক্সের দাবার গুটি হয়ে সমাজে, দেশে দুর্নীতি ডেকে নিয়ে আসছে। এই সব ‘অল্পবিদ্যা ভয়ংকর’ টাইপের মানুষদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ্ تعالى বলছেনঃ

2_12

সাবধান, নিঃসন্দেহে তারা নিজেরাই দুর্নীতি ছড়ায়, কিন্তু তারা তা বুঝতে পারে না।

এধরণের মানুষরা মনে করে যে, ইসলাম কোনো যুগোপযোগী ধর্ম নয়। ইসলামের যে শিক্ষাগুলো রয়েছে, সেগুলো হয়তো ১৪০০ বছর আগে কাজে লাগতো, কিন্তু আজকালকার যুগের ‘আধুনিক’ জীবন ব্যবস্থায় ইসলামের অনেক শিক্ষাই অচল। একারণে তারা ‘আধুনিক’ আইন, শিক্ষাব্যবস্থা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি  – এমন কোনো নীতি নেই, যেটা তারা নিজেরা বানাবে না – এই অন্ধ বিশ্বাস থেকে যে, তারা ইসলামের থেকে ‘ভালো’ কিছু, ‘যুগোপযোগী’ কিছু মানুষকে দিতে পারবেই। তাদের মনের মধ্যে একটা ধারণা বদ্ধমূল যে, আল্লাহ্ ‌تعالى ১৪০০ বছর আগে যেই কু’রআন দিয়েছেন, সেটা দিয়ে আজকের যুগের সমাজ, দেশ, অর্থনীতি – এগুলো চালানো সম্ভব নয়।

অথচ চারিদিকে তাকিয়ে দেখুন, তারা কি চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের দেশে ‘আধুনিক’ শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত মানুষরা তাদের স্ত্রীর কাছ থেকে যৌতুক না পেয়ে এসিড মারে, গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়, পা কেটে দেয়, এমনকি কেটে চার টুকরো করে নদীতে ফেলে দিয়ে আসে![১২৬] যেই সব বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমাদের এতো গর্ব, যাদের শিক্ষাকে আমরা ইসলামের শিক্ষা থেকে বেশি আধুনিক এবং যুগোপযোগী মনে করি, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েরা ৩১ ডিসেম্বর রাতে পার্টি করে, মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ধর্ষণ করে। উন্নত দেশগুলোতে এতো আইন, এতো সিকিউরিটি ক্যামেরা, এতো শক্তিশালী পুলিশ বাহিনী থাকার পরেও আমেরিকায় ছোট ছোট ছেলেরা স্কুলে বন্দুক নিয়ে গিয়ে গুলি করে তাদের অপছন্দের সহপাঠীদেরকে মেরে ফেলে।[১২৭] প্রতিবছর আমেরিকার আর্মিতে ২৬০০০ মহিলা অফিসার, পুরুষ অফিসারদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হন, ৬০০০ এর বেশি ধর্ষিত হন। চিন্তা করুন আর্মিতে, তাও আবার যেই দেশে স্ত্রীদেরকে পুরুষদের সমান অধিকার এবং সন্মান দেওয়ার জন্য কত গলাবাজি করা হয়![১২৮] আপনার পছন্দের অ্যাপেল কোম্পানি ২০০৯ থেকে ২০১২ – পাঁচ বছরে ৩০ বিলিয়ন ডলার আয় করে, একটা টাকাও ট্যাক্স না দিয়ে পার পেয়ে গেছে। তারা গত চার বছরেই ৪৪ বিলিয়ন ডলার (৩০৮ হাজার কোটি টাকা) ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছে।[১২৯] পশ্চিমা দেশে কোম্পানিগুলোকে শক্ত আইন এবং ট্যাক্স এর ভেতর রাখার পরেও প্রতিবছর উন্নত দেশগুলোতে বড় বড় কোম্পানিগুলো ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি ট্যাক্স ফাঁকি দেয়। ১ ট্রিলিয়ন ডলার মানে হচ্ছে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্য বছরে ১০০০ ডলার, প্রায় ৭২,০০০ টাকা![১৩০] এই টাকা দিয়ে পুরো পৃথিবীতে দারিদ্রতা সম্পূর্ণ দূর করে ফেলা যায়। কোনোদিন কোনো মানুষকে না খেয়ে মরতে হবে না, পৃথিবীর প্রতিটি বাচ্চাকে স্কুলে দেওয়া যাবে!

চারিদিকে এতো অরাজকতা, এতো দুর্নীতি, এতো জঘন্য সব অপরাধ করে মানুষ পার পেয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এর পরেও মানুষ স্বীকার করে না যে, মানুষের বানানো আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, আইন, নীতি – সব সম্পূর্ণ বিফল হয়েছে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে, মানুষের অপরাধ করার প্রবণতা এবং অপরাধের হার কমাতে। বরং মানুষের পাশবিক আচরণ, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা দিনে দিনে বাড়ছেই এবং সেগুলো ঘরের ভেতর থেকে আজকাল স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে, রাস্তা ঘাটে, পার্কে, বাসে, মিডিয়াতে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে।

আমাদের ছেলে মেয়েদেরকে দিনে ৮-১০ ঘণ্টা স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে আটকে রেখে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, পদার্থ, রসায়ন, জীব বিজ্ঞান সহ শ’খানেক বই গিলিয়ে, তারপর আরও ৪-৫ ঘণ্টা কোচিং সেন্টারের রিমান্ডে দিয়ে আমরা তাদেরকে যা শেখাচ্ছি, তার মধ্যে কিছুই কি আছে, যেটা তাদেরকে তাদের ভেতরের পশুটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায়? তারপরে তারা যখন ১৮-২০ বছর পরে বড় হয়ে মানুষের মতো দেখতে পশুতে পরিণত হয়, আমরা তখন অবাক হই!

আমাদের সন্তানরা যখন মাস্টার্স, পিএইচডি উপাধি পায়, তখন গর্বে আমাদের বুক ফুলে যায়। অথচ এই ডিগ্রিগুলো আমাদেরকে কিভাবে, কম সময়ে, আরও বেশি টাকা কামানো যায় – এটা ছাড়া আর কিছুই শেখায় না। পাশ্চাত্যর কারিকুলাম অনুসরণ করে তৈরি করা ডিপ্লোমা, বিবিএ, বিএসসি, মাস্টার্স ডিগ্রিগুলোর একটাও কি আমাদেরকে শেখায় – কীভাবে একজন আদর্শ স্বামী বা স্ত্রী হতে হয়, কীভাবে একজন আদর্শ বাবা বা মা হতে হয়, কীভাবে একজন আদর্শ সন্তান হতে হয়?

যে সব মানুষ মনে করে তাদের বানানো আইন, নীতি, আল্লাহ্‌র تعالى দেওয়া আইন এবং নীতি থেকে বেশি কাজের, তাদের একটা সহজ যুক্তি বোঝা উচিত – যেই সত্ত্বা পুরো মহাবিশ্বের প্রতিটি প্রাণী সৃষ্টি করতে পারেন এবং তিনি পুরো প্রাণীজগৎ নিখুঁত ভাবে চালাতে পারেন, তাঁর থেকে ভালো ভাবে মানুষকে চালানোর আইন আর কে দিতে পারে? ইসলামের প্রথম কয়েক শ’ বছরের সাফল্যের ইতিহাস, যখন কীনা পুরো ইউরোপ অন্ধকারে ডুবে ছিল, তখন এক অশিক্ষিত, বর্বর আরব জাতি ইসলামের শিক্ষা পেয়ে শুধুই নৈতিক এবং সামাজিকভাবেই নয়, এমনকি জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত জাতি হয়ে গিয়েছিল। মানুষ যত খারাপ অবস্থায়ই থাকুক না কেন, মানুষকে নৈতিক এবং সামাজিক ভাবে সংশোধন করে, আইন শৃঙ্খলা এবং ন্যায়বিচার বাস্তবায়ন করতে যে ইসলামের আইন এবং নৈতিকতা কতখানি সফল, সেটা প্রথম প্রজন্মের আরব মুসলমানদের ইতিহাস দেখলেই পরিস্কার প্রমাণ পাওয়া যায়।[১৩১]

2_13

আর যখন তাদেরকে বলা হয়, “বিশ্বাস কর, যেভাবে অন্যরা বিশ্বাস করেছে”, তখন তারা বলে, “আমরা কি সেভাবে বিশ্বাস করবো, যেভাবে বোকারা বিশ্বাস করে?” অবশ্যই না! তারা নিজেরাই বোকা, কিন্তু তারা তা জানে না।

16c46_peer_pressure_postআপনি যদি আপনার প্রতিবেশীকে বলেন, “চৌধুরী সাহেব, আপনি নামায পড়ছেন না কেন? আপনাকে তো এবারের ঈদে কুরবানি করতেও দেখলাম না।” সে বলবে, “আরে ধুর ভাই, নামায-টামায পড়া লাগে না। নামায রোযা এইসব হচ্ছে ওই সব অর্ধ শিক্ষিত মোল্লা টাইপের মানুষদের জন্য, যারা আমাদের মতো আধুনিক শিক্ষা পেয়ে তাদের চিন্তা-ভাবনা, জ্ঞানকে প্রসারিত করতে পারেনি। তারা সৃষ্টিকর্তাকে আমাদের মতো ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারে না। আপনি যত বিজ্ঞান পড়বেন, যত পড়ালেখা করবেন, আপনি তত গভীরভাবে সৃষ্টিকর্তাকে উপলব্ধি করবেন। তখন আর আপনার প্রতিদিন নামায পড়ার দরকার হবে না। আর বছরে একদিন কুরবানি করে কী হয়। সারা বছর তো কত গরুর মাংস কিনলাম, কত গরীব লোককে টাকাপয়সা  দিলাম। এই সব গদ বাঁধা নিয়মের কোনো দরকার নেই। আপনারা বেশি বাড়াবাড়ি করেন।”

যারা ইসলামকে মেনে নিয়ে নিজেদের জীবনে যত ত্যাগ করা দরকার, তার সব করতে রাজি; যারা কখনও বন্ধুকে মুখ দেখাবো কিভাবে – এই চিন্তা করে সুদের লোণ নিয়ে গাড়ি কিনে না; যারা প্রতি মাসে মুখ কালো করে বাড়ি ভাড়া দিয়ে আসে, কিন্তু তারপরেও সুদের লোন নিয়ে বাড়ি কিনে না; ‘লোকে কী বলবে’ – তা ভয় না পেয়ে বরং ‘আমার প্রভু কী বলবেন’ – এই লজ্জায় হিজাব করে চলে; এধরণের সত্যিকারের মুসলমানদেরকে এই সব চৌধুরী সাহেব টাইপের মানুষরা বোকা মনে করে, আর তারা নিজেদেরকে মনে করে চালাক। এরা মনে করে যে, এরা দুনিয়াতেও অনেক ফুর্তি করে যাচ্ছে এবং আখিরাতে গিয়ে তারা কোনভাবে পার পেয়ে বেহেশতে চলে যাবে – এভাবে তারা দুই দিকেই জিতবে। ‘বোকা’ মুসলিমদের মতো এতো কষ্ট করে, দুনিয়ার এতো মজা ছেড়ে দিয়ে, মাওলানাদের মতো এতো ত্যাগ করে ইসলাম মানার কোনো দরকার নেই।

আরেক ধরণের মানুষ আছে যারা আপনার সাথে দেখা হলে বলবে, “আস-সালামু আলাইকুম ভাই সাহেব, কেমন আছেন? এবার ঈদে ইন-শাআ আল্লাহ تعالى আপনার কথা শুনে এতিম খানায় হাজার দশেক টাকা দিবো। আলহামদুলিল্লাহ, এবার আমার ব্যবসা ভালোই যাচ্ছে। এই ঈদে বেড়াতে আসবেন কিন্তু – ফি আমানিল্লাহ।” তারপর আপনি যখন চলে যাবেন, সে তার পাশের জনকে বলবে, “দোস্ত, এই লোকের সাথে দেখা হলেই খালি ইসলাম নিয়ে বুলি শুনতে হয়। আমি আসলে ওনাকে বিদায় করার জন্য এসব বললাম। কোনো চিন্তা করিস না। এবার ঈদে এক বিরাট পার্টি দিবো, কিছু লাল পানিও থাকবে। তোর গার্ল ফ্রেন্ডগুলোকে নিয়ে চলে আয়, সারারাত নাচ গান হবে। তারপর আমার ড্রাইভার তোদেরকে রাতে ফাইভ স্টার হোটেলে নামিয়ে দিয়ে আসবে।” এদের উদাহরণ দিয়েছেন আল্লাহ্ ‌تعالى পরের আয়াতেঃ

2_14

যখন তারা বিশ্বাসীদের সাথে দেখা করে, তখন বলে, “আমরা বিশ্বাসী।” কিন্তু যখন তারা তাদের শয়তানদের সাথে একা থাকে, তখন বলে, “কোনো সন্দেহ নেই, আমরা আসলে তোমাদেরই সাথী, আমরা তো ওদের উপহাস করি মাত্র!”

এখানে শায়াতিন شَيَٰطِين বলতে মানুষের শয়তানী কুপ্রবৃত্তিকে বলা হয়েছে। এখানে দু’ধরনের অবস্থার কথা বলা হয়েছে – ১) মানুষ নিজে যখন একা তার শয়তানী কুপ্রবৃত্তির মধ্যে ডুবে থাকে, ২) যখন সে তার মানুষরূপী শয়তান সঙ্গীদের সাথে থাকে।[২]

এধরণের মানুষদেরকে নিয়ে কষ্ট পাবেন না। এই ভেবে দুঃখ করবেন না, “ওরা তো কত আমোদ ফুর্তিতে দিন পার করছে। ওদের উপর আল্লাহ্‌র تعالى গজব পড়ে না কেন?” কারণ আল্লাহ্‌ বলেছেনঃ

2_15

আল্লাহ-ই আসলে তাদের সাথে উপহাস করছেন এবং তাদেরকে তিনি কিছু সময় পর্যন্ত সীমালঙ্ঘন করতে ছেড়ে দেন।

এই পৃথিবীতে কয়েকটা বছর তারা এই সব ভণ্ডামি করে বেড়াবে। তারপর একদিন গিয়ে তারা টের পাবে কী সর্বনাশ করেছে। এদের উদাহরণ হচ্ছে একটা বেয়াদব কুকুরের মতো, যাকে আপনি কোনোভাবেই বশ মানাতে পারছেন না। সে কোনোভাবেই চুপচাপ বসে থাকবে না, খালি গলার দড়ি ধরে টানাটানি করছে। তারপর আপনি তার গলায় একটা ১০০ ফুট লম্বা দড়ি বেঁধে ছেড়ে দিলেন। কুকুরটা যখন একবার-দুইবার টান দিয়ে দেখলো সে আর আটকে যাচ্ছে না, সাথে সাথে সে মহা আনন্দে দৌড়াতে শুরু করলো। সে দৌড়াচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে, এদিকে মাটিতে পড়ে থাকা দড়ির প্যাঁচ একটা একটা করে কমছে। কুকুরটা তার পুরো শক্তি দিয়ে ছুটে  যাচ্ছে, আর একসময় গিয়ে দড়ির সব প্যাঁচ শেষ হয়ে দড়ি টান টান হয়ে গেল, আর – খ্যাঁক![১]

2_16

তারা পথপ্রদর্শক হিসেবে সঠিক নির্দেশের বদলে ভুল নির্দেশ কিনেছে। তাই তাদের এই ব্যবসায় কোন লাভ হয়নি এবং তারা কোনোভাবেই সঠিক পথে নেই!

এখানে আল্লাহ্ ‌تعالى তাদেরই ভাষা ব্যবহার করে বলছেন যে, এই সব বোকা এবং ভণ্ডরা অল্প কিছু আনন্দ, সম্পত্তি, সন্মানের জন্য যে তারা কী অমূল্য জিনিস বিক্রি করে দিলো, সেটা তারা বোঝে না। পৃথিবীতে এখন ৫০০ কোটি মানুষ আছে, যাদেরকে আল্লাহ্ ‌تعالى ‘লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহ’ বলার সুযোগ এখনও দেন নি। যাদেরকে দিয়েছেন, তারা কত বড় বোকামি করে এতো বড় একটা সুযোগ পেয়েও ছেড়ে দিচ্ছে, যেটা তারা ঠিকমতো কাজে লাগালে শুধু পৃথিবীতেই নয়, অনন্ত কালের জন্য আখিরাতেও বিরাট সন্মান, অনন্ত শান্তি এবং বিশাল সম্পত্তি নিয়ে থাকতে পারতো। কিন্তু এই সব বোকারা তাদের জীবন নামের ব্যবসায় নেমে ঠিকমতো হিসাব না করেই শর্ট টার্ম প্রফিট করতে গিয়ে বিরাট অংকের লং টার্ম প্রফিট হারিয়ে ফেলেছে।

এই আয়াতগুলোতে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার রয়েছে – কীভাবে আল্লাহ্ ‌تعالى কু’রআনের মাধ্যমে আমাদেরকে শেখান। তিনি কিন্তু সমাজ বিজ্ঞান বইয়ের মতো চরম একঘেয়ে ভাবে বলতে পারতেন –

এক প্রজাতির মানুষ থাকিবে যাহারা ১) তোমাদের সাথে মিথ্যা কথা বলিবে, ২) তোমাদের পিছনে তাহাদের বন্ধুদের সাথে হাত মিলাইবে, ৩) তাহারা মনে করিবে তাহারা সমাজের, দেশের, ধর্মের সংস্কার করিতেছে, কিন্তু আসলে তাহারা বুঝিতে পারিবেনা যে, তাহারাই প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতি করিতেছে …

কিন্তু আল্লাহ্ ‌تعالى সেটা করেন নি। তিনি জানেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা তত্ত্ব কথা পড়ার ধৈর্য বেশিরভাগ মানুষের নেই, বিশেষ করে সেটা যদি নীতি কথা হয়। একারণে তিনি কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে, নানা ধরণের উপমা দিয়ে, গল্পের বইয়ের মতো কু’রআনকে আকর্ষণীয় করে দিয়েছেন, যেন আমরা আগ্রহ নিয়ে কু’রআন পড়ি। সেই কথোপকথনের মধ্যে তিনি যে শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন, সেটাও অদ্ভুত রকমের সূক্ষ্ম। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো যে, কু’রআনের প্রচলিত বাংলা অনুবাদগুলো কু’রআনের আয়াতগুলোর ভাব এবং মুড ঠিকমতো তুলে ধরতে পারে না। যার কারণে কু’রআনের বাংলা অনুবাদ পড়তে গেলে আমাদের কাছে সংবিধান পড়ার মতো প্রচণ্ড একঘেয়ে মনে হয়।

সুত্র:

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

One thought on “আমরা কি বোকাদের মতো বিশ্বাস করবো? বাকারাহ ১১-১৬”

Leave a Reply to MD. OMAR JAMAL Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *