কু’রআনে কিছু আয়াত রয়েছে যেগুলো অমুসলিম সমালোচকরা এবং ইসলামকে যারা আক্রমণ করার জন্য সবসময় ওতপেতে থাকেন, তারা পড়লে বড়ই খুশি হন, কারণ তারা ইসলামকে একটি “মধ্যযুগীয় বর্বর ধর্ম” হিসেবে প্রচার করার জন্য এই আয়াতগুলো থেকে অস্ত্র পেয়ে যান। আবার এই একই আয়াতগুলো একদল চরমপন্থী মুসলিমরা পড়লে বড়ই খুশি হন, কারণ তারা এই আয়াতগুলো থেকে অমসুলিমদের বিরুদ্ধে মারামারি, খুনাখুনি করার জন্য অনুপ্রেরণা এবং আদেশ খুঁজে পান। এই দুই ধরনের মানুষরা গত হাজার বছর ধরে ইসলামের একই ক্ষতি করে গেছেন: ইসলামকে সাধারণ মানুষের মাঝে একটি অসহনশীল, কট্টর, আগ্রাসী ধর্ম হিসেবে কুখ্যাত করে দিয়ে গেছেন। এরকম একটি আয়াত হলো—
আল্লাহর সাথে যারা শিরক করে এবং আহলে কিতাবের (ইহুদি এবং খ্রিস্টান) মধ্যে থেকে যারা সত্যকে অস্বীকার (কুফরি) করেছে, তারা কখনই চায় না যে, তোমাদের প্রভুর কাছ থেকে একটুও ভালো কিছু আসুক তোমাদের উপর। কিন্তু আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাঁর অনুগ্রহের জন্য মনোনীত করেন। আল্লাহ অপরিসীম অনুগ্রহের অধিকারী। [আল-বাক্বারাহ ২:১০৫]
এই আয়াত পড়ে অমুসলিমরা বলে, “তোমাদের কাছে আমরা সবাই কাফির? তোমরা না বল ইসলাম হচ্ছে শান্তি, সহমর্মিতার ধর্ম? এই হচ্ছে তার নমুনা?” আর অন্যদিকে একদল মুসলিমরা, যারা রক্তের গন্ধের জন্য পাগল হয়ে আছেন, তারা এইধরনের আয়াত পড়ে চোখ লাল করে চিৎকার দিয়ে ওঠেন, “ওরা সব কাফির! ওরা কেউ চায় না আমাদের ভালো কিছু হোক। ভাই সব, অস্ত্র হাতে নিয়ে ইহুদি, খ্রিস্টান, মুশরিকদেরদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। আল্লাহু আকবার!”
সব আহলে কিতাব কি কাফির?
এর উত্তর এই আয়াতেই রয়েছে। আল্লাহ تعالى এখানে বলছেন—
আহলে কিতাবের (ইহুদি এবং খ্রিস্টান) মধ্যে থেকে যারা সত্যকে অস্বীকার (কুফরি) করেছে…
এখানে বলা হয়েছে “আহলে কিতাবের মধ্যে থেকে”, বলা হয়নি “সব আহলে কিতাবরা কাফির” বা “আহলে কিতাবের বেশিরভাগ কাফির।” কাফির তারাই যারা জেনে শুনে আল্লাহর تعالى বাণীকে অস্বীকার করে। যারা ইসলামের শিক্ষা পায়নি, বা যাদের কাছে ইসলামের বাণী সঠিকভাবে পৌঁছেনি, তারা হচ্ছে আহলুল ফাতরাহ এবং তাদের পরীক্ষা হবে কিয়ামতের দিন।[২০৪]
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো: কু’রআনের ভাষায় ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ অর্থাৎ “যারা অস্বীকার (কুফরি) করেছে” এবং ফিকহের পরিভাষায় ‘কাফির’ — দুটো আলাদা ব্যাপার।[১] ফিকহের ভাষায় সব অমুসলিমদের কাফির বলা হয়, কারণ ফিকহের পরিভাষা অনুসারে যারাই ইসলাম মানছে না, তারাই ইসলাম অস্বীকার (কুফরি) করছে, সুতরাং তারাই কাফির; কিন্তু কু’রআনে কিছু বিশেষ ধরনের মানুষের বেলায় ‘কাফির’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়।[১] কু’রআনের যে সব আয়াতে ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এমন কিছু মানুষের কথা বলা হয়েছে, যাদের কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, তারা জানে যে ইসলামের বাণী সত্য, মুহাম্মাদ عليه السلام শেষ নবি, কু’রআন সত্যিই আল্লাহর تعالى বাণী, কিন্তু তারপরেও তারা সত্য মানবে না। তাদের ইসলাম না মানার পেছনে কোনো ভিত্তি নেই। শুধুই নিজেদের অহংকার, বংশ পরম্পরায় চলে আসা ধর্মকে মানার অন্ধ ইচ্ছা, আর নিজেদের স্বার্থ যাতে নষ্ট না হয়, সে কারণে নিজেদের ধর্ম, সংস্কৃতি আঁকড়ে থাকা। কু’রআনে আরেক ধরনের মানুষকে কাফির বলা হয়েছে, যারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে, বা মুসলিমদের ক্ষতি করার জন্য প্রকাশ্যে বা গোপনে কাজ করতে থাকে। কু’রআনের এই দুই ধরনের বিশেষ প্রজাতির মানুষদেরকে কাফির বলা হয়েছে।[১]
আল্লাহর সাথে যারা শিরক করে তারা আমাদের ভালো চায় না
এখানে আল্লাহ تعالى মুশরিকদের (অর্থাৎ যারা এক সর্বোচ্চ স্রষ্টার সাথে অন্য কিছু বা কারো উপাসনা করে, যেমন মূর্তিপূজারি, প্রকৃতিপূজারি ধর্মগুলোর অনুসারীরা, মাজারের রমরমা ব্যবসা যারা করে) এবং ইহুদি, খ্রিস্টানদের কিছু দলের মানসিকতা প্রকাশ করে দিয়েছেন। তারা চায় না মুসলিমদের ভালো কিছু হোক। মুসলিমরা কোনো দিক থেকে এগিয়ে গেলে, সেটা ক্রিকেট খেলায়ই হোক, নোবেল পুরষ্কার বিজয়েই হোক, বা বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে অগ্রসর হোক না কেন —তাদের গা জ্বলে যায়। তারা ভেতরে ভেতরে জ্বলেপুড়ে মরে, আর চেষ্টা করতে থাকে কীভাবে মুসলিমদের বারোটা বাজানো যায়।
আমরা অনেক সময় মুসলিম দেশগুলোর বিরুদ্ধে ইহুদী, খ্রিস্টান দেশগুলোর আক্রমণ দেখে ভুলে যাই যে, মুশরিকরা, অর্থাৎ যারা মূর্তিপূজারি, তারা মুসলিমদের আরও বড় শত্রু। আমরা অনেকে ইসরাইল-গাজার সাম্প্রতিক ঘটনা দেখে অনেক কষ্ট পাই। কয়েক বছর আগে কিছু খ্রিস্টান পাদ্রী কু’রআন পুড়িয়ে, প্রতিবছর কু’রআন পোড়ানোর আয়োজন করছে দেখে মর্মাহত হই, এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করি। অথচ এগুলো মুশরিকদের জন্য পুরনো খবর। আমাদের পাশের দেশ ভারত সব খ্রিস্টান দেশগুলো এবং ইসরাইলকে বহু আগে হার মানিয়ে দিয়েছে। সেখানে শুধু কু’রআন পোড়ানোই হয় না, শত শত মুসলিমদেরও পোড়ানো হয়, মসজিদ পোড়ানো এবং ভাঙ্গা হয়।
কাশ্মীর, আসাম, গুজরাটকে গাজার মত করুণ অবস্থায় ফেলে রাখা — এগুলো আজকে পুরনো ঘটনা।[১৯৯] ১৯৮৯ সাল থেকে এই পর্যন্ত কাশ্মীরে ৫০,০০০ এর বেশি মানুষ মারা গেছে ভারত-পাকিস্থানের কাশ্মীর দখলের সংঘর্ষে।[২০১] ৩০০ বারের বেশি মানুষ গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। ২৭৩০ জন মানুষের দেহ পাওয়া গেছে নানা কবরে, যারা সবাই কাশ্মীরের এলাকার নিরীহ মানুষ। ২০০২ সালে গুজরাটে মসুলিমদের উপর সেই সময়কার স্থানীয় সরকার, পুলিশ এবং হিন্দু জঙ্গিদের উদ্যোগে এক জঘন্য হত্যাযজ্ঞ চলে, যেখানে দুই হাজার মুসলিম মারা যায়, প্রায় দুই লক্ষ মুসলিম উদ্বাস্তু হয়ে যায়, হাজারো মুসলিম বোনদের ধর্ষণ করা হয়। এই ঘটনার সময় মুসলিমদেরকে কুপিয়ে হত্যা করতে দেখা গেছে। এমনকি গায়ে তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে।[১৯৯] ১৯৯২ সালে সরকারের গোপন পরিকল্পনায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ফলে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষের মধ্যে মারামারি শুরু হয় এবং দুই হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়।[২০০]
মুসলিমদের প্রতি এই শ্রেণীর হিন্দুদের প্রকাশ্য ঘৃণার আসল কারণ একটি — তাদের শিরকের প্রতি অন্ধ ভালোবাসা। শিরক মানুষের মধ্যে এমন জঘন্য মানসিকতা তৈরি করে যে, তা তাকে সত্য থেকে পুরোপুরি অন্ধ করে দেয় এবং ইসলামের ‘এক স্রষ্টার দাসত্ব’-এর শিক্ষার প্রতি এক ভয়ংকর আক্রোশ তৈরি করে। এটি ইসলামের শিক্ষা থেকে এতটাই বিপরিত মেরুর শিক্ষা যে, একজন মুসলিমের ধ্যান-ধারণার সাথে একজন মুশরিকের ধ্যান-ধারণার কিছুই আর সমর্থন করানো যায় না। একারণেই আল্লাহ মুশরিকদের ব্যাপারে আমাদেরকে বিশেষভাবে সাবধান করে দিয়েছেন, এবং তাদের থেকে আহলে কিতাবের অনুসারীদের অপেক্ষাকৃত বেশি সন্মান দিয়েছেন।
অমুসলিমরা আমাদের ভালো চায় না, তাহলে আমরা কেন তাদের ভালো চাইব?
এই আয়াতে ঢালাও ভাবে বলা হয়নি যে, সব অমুসলিমরা মুসলিমদের জন্য ভালো কিছু চায় না। বরং বলা হয়েছে যে, মুশরিকরা এবং আহলে কিতাবের ‘একদল’ চায় না মুসলিমদের কাছে আল্লাহর تعالى কাছ থেকে ভালো কিছু আসুক। তাই সব ইহুদি, খ্রিস্টানদেরকে আমরা আমাদের শত্রু মনে করবো, এটা ভুল ধারণা। বরং অনেক ইহুদি, খ্রিস্টান রয়েছে, যারা মুসলিমদের ভালোর জন্য নিজেরা ত্যাগ স্বীকার করে আন্দোলন করে যাচ্ছে। যেমন, অনেক ইহুদি গোত্র রাস্তায় নেমে[১৯৬], ইসরাইলি এম্বেসির সামনে ভিড় করে, পুলিশের হাতে মার খেয়েও ফিলিস্তিনের মুসলিমদের পক্ষে আন্দোলন করছে, যেখানে কিনা বাংলাদেশের বেশিরভাগ মুসলিম ফেইসবুকে দুই-চারটা জ্বালাময়ী পোস্ট দিয়ে জিহাদ করে ফেলেছে, এমন ভাব দেখাচ্ছে।
একইভাবে অনেক খ্রিস্টান সাংবাদিক নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাজায় এবং তার আশেপাশের এলাকায় গিয়ে মুসলিমদের সমর্থনে সাংবাদিকতা করছে। মুসলিমদের পক্ষ নিয়ে কথা বলে নিজের চাকরি হারাচ্ছে।[১৯৭] এমনকি ইহুদি আর্মির সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে জীবন পর্যন্ত দিয়েছে।[১৯৫] এখন পর্যন্ত বাঙালি সাচ্চা মুসলিমদের আমেরিকান এমব্যাসি ঘেরাও করতে দেখা গেল না, অথচ ভারতে আমাদের হিন্দু ভাই-বোনেরা এই প্রচণ্ড গ্রীষ্মের রোদে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ইসরাইলি এম্বেসির সামনে ঘেরাও করে, ইসরাইলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন।[২০৩]
এখন আমরা তাদেরকে কাফির বলে দূরে সরিয়ে দেব, না বন্ধুর মতো কাছে টেনে দাওয়াহ দেব?
বেশিরভাগ সাহাবীই এক সময় কাফির ছিলেন। তাই বলে রাসূল عليه السلام তাদেরকে কাফির বলে ঘৃণা ভরে পরিত্যাগ করেননি, তাদের বিরুদ্ধে মারামারিও করেননি। বরং রাসূলের عليه السلام ব্যবহার, দাওয়াহ তাঁদের মুগ্ধ করেছে। আমরা কখনোই দাওয়াহর সময় তাদেরকে ঘৃণাভরে সম্বোধন করব না। ‘কাফির’ কোনো গালি বা ঘৃণা বোঝানোর শব্দ নয়। আমাদের কাজ হলো পৃথিবীর মানুষকে সত্যের কথা জানানো, আল্লাহর পথে আহ্বান করা। এরপর তাদের অন্তর পরিবর্তন করা সম্পূর্ণ আল্লাহর تعالى ইচ্ছা। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক কাফির একজন সম্ভাব্য মুসলিম এবং তারা বরং আমাদের নিজেদের সওয়াব অর্জন করে জান্নাতে যাওয়ার একটি সুযোগ।
অমুসলিমদের সাথে মুসলিমদের কী ধরনের সম্পর্ক থাকতে হবে
মুসলিমদেরকে কিছু মূলনীতি[১৯৮] অনুসরণ করতে হবে, যখন তারা অমুসলিমদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে—
১) ইসলাম একটি শান্তি এবং ন্যায়ের ধর্ম। মনে রাখতে হবে—
ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। সত্য পথ মিথ্যা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে।… [আল-বাক্বারাহ ২:২৫৬]
আমাদেরকে এটা সবসময় মনে রাখতে হবে যে, ইহুদি এবং খ্রিষ্টানরা যা-ই করছে সেটাই ভুল না। তাদের বিশ্বাস ভুল হতে পারে, তারা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস না করতে পারেন, বা মুহাম্মাদকে عليه السلام রাসূল হিসেবে বিশ্বাস না করতে পারেন। তবে তাদের পার্থিব সকল কাজই ভুল নয়। তাই আমরা তাদের প্রতি কোনো ঘৃণা দেখাব না। মনে করব না যে, তারা সব ভুল পথে আছে এবং তারা যা করে তার কোনো কিছুই ঠিক নয়। আমরা মুসলিম। আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান জাতি। পৃথিবীতে আরও ৫০০ কোটি মানুষ আছে যাদেরকে আল্লাহ تعالى ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার সৌভাগ্য দেননি। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, আমাদের খ্রিষ্টান এবং ইহুদি ভাই বোনেরা কিছু প্রতারকের পাল্লায় পড়ে ভুল রাস্তায় চলে গেছে। আমাদের দায়িত্ব তাদেরকে ডাক দিয়ে এনে, ভালো করে বুঝিয়ে শুনিয়ে সঠিক পথে নিয়ে আসা। ভালো করে বোঝানোর পরেও তারা যদি না আসে, তাহলে সেটা তাদের ব্যাপার। আমরা কোনোভাবেই তাদের উপর জবরদস্তি করতে পারব না। আল্লাহই তাদের বিচার করবেন।
যদি তোমার প্রভু চাইতেন, তাহলে পৃথিবীতে সবাই অবশ্যই বিশ্বাস করত। তাহলে তুমি কি মানুষকে জোর জবরদস্তি করবে বিশ্বাস না করা পর্যন্ত? [ইউনুস ১০:৯৯]
২) মুসলিমদেরকে আল্লাহ تعالى আদেশ করেছেন যেন, আমরা আহলে কিতাবদের (ইহুদি এবং খ্রিস্টান) প্রজ্ঞার সাথে সুন্দর মার্জিত ভাবে ইসলামের পথে ডাকি, এবং তাদের সাথে ভদ্রভাবে যুক্তিতর্ক করি—
আহলে কিতাবের মানুষদের সাথে সুন্দরভাবে ছাড়া যুক্তিতর্ক করবে না। তবে যারা অন্যায় করে, তাদের কথা আলাদা। বল, “আমরা বিশ্বাস করি যা আমাদের উপর অবতীর্ণ হয়েছে, এবং যা তোমাদের উপর অবতীর্ণ হয়েছে; আমাদের এবং তোমাদের উপাস্য প্রভু একই সত্তা, আমরা তাঁরই প্রতি নিজেদেরকে সমর্পণ করি।” [আল-আনকাবুত ২৯:৪৬]
৩) তাদেরকে সুন্দরভাবে বোঝাতে হবে যে, আল্লাহ تعالى ইসলাম ছাড়া আর অন্য কোনো ধর্মকে গ্রহণ করবেন না। আমরা তাদেরকে যথাসাধ্য সাবধান করবো। তাদের হেদায়েত সম্পূর্ণ আল্লাহর تعالى হাতে—
যদি কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কিছুকে ধর্ম হিসেবে নেওয়ার চেষ্টা করে, সেটা তার কাছ থেকে কোনোভাবেই গ্রহণ করা হবে না। সে আখিরাতে সর্বহারাদের একজন হয়ে যাবে। [আলে-ইমরান ৩:৮৫]
৪) কাফিরদেরকে সুযোগ দিতে হবে মুসলিমদের কাছ থেকে আল্লাহর تعالى বাণী শোনার এবং বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। আজকে কিছু ইসলামি জঙ্গি দল কু’রআনের এই আয়াত ভেঙ্গে অমুসলিমদের এবং ভিন্ন সম্প্রদায়ের মুসলিমদের কোনো সুযোগ না দিয়েই হত্যা করছে, যা একটি বিরাট ভুল—
কোনো মুশরিক (মূর্তি পূজারি, যারা শিরক করে) যদি তোমাদের কাছ নিরাপত্তা চায়, তাহলে তাকে তা দেবে, যেন সে আল্লাহর বাণী শোনার সুযোগ পায়। তারপর তাকে একটা নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাবে। আসলে তারা এমন একটা জাতি, যাদের জ্ঞান নেই। [আত-তাওবাহ ৯:৬]
৫) কাফির কোনো সাদা-কালো ব্যাপার নয়, বরং কাফিরদের নানা স্তর রয়েছে। একজন নামাজ-রোযা অস্বীকারকারী কাফির এমন কোনো কাফির নয়, যার বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদ করতে হবে। তাই যে সব কাফির শান্তিতে আমাদের সাথে থাকতে চায়, তাদেরকে শান্তিতে থাকতে দিতে হবে। আর যারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাজ করে, যুদ্ধ ঘোষণা করে, তাদের সাথে সশস্ত্র জিহাদ করতে হবে, যদি জিহাদের অন্যান্য পূর্বশর্তগুলো পূরণ হয়।
ধর্মের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি এবং তোমাদেরকে দেশ থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি সুন্দর আচরণ ও ন্যায় বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেননি । নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়বানদের ভালবাসেন। [আল-মুমতাহানাহ ৬০:৮]
৬) একজন কাফির যদি আল্লাহতে تعالى বিশ্বাস করে, এবং শিরক না করে, তাহলে তাকে ঘৃণা করা যাবে না। কিন্তু একজন কাফির যদি শিরক করে, মুসলিমদের শত্রু হয়ে যায়, তাহলে তাকে ঘৃণা করতে হবে।[১৯৮] মুসলিমরা অপরাধকে সবসময় ঘৃণা করে। আর শিরক করা হচ্ছে স্রষ্টাকে চরম অপমান করে তাকে ছোটো করে ফেলা। এটা অনেক বড় অপরাধ।
৭) কিন্তু সেই ঘৃণা থেকে কোনো মুসলিম কখনই অন্য কোনো অমুসলিমের বিরুদ্ধে খারাপ আচরণ, বা আক্রমণ করতে পারবে না, যদি না সেই অমুসলিম তাকে আক্রমণ না করে। মুসলিমরা কখনই শান্তি প্রিয় অমুসলিমদেরকে ভয় দেখানো, সম্পদ লুট করা, ন্যায্য অধিকার না দেওয়া, আমানতের খিয়ানত করা, অন্যায় ভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতি করা, হত্যা করা ইত্যাদি কোনো ধরনের অন্যায় করার অধিকার রাখে না।[১৯৮]
খুনের প্রতিশোধ বা সমাজে চরম দুর্নীতি-ক্ষয়ক্ষতি-বিশৃঙ্খলা ছড়ানোর প্রতিফল ছাড়া অন্য কোনো কারণে কেউ যদি একজনকেও হত্যা করে, তাহলে সে যেন মানবজাতির সবাইকে হত্যা করল। [আল-মায়িদাহ ৫:৩২]
৮) একজন মুসলিম যে কোনো ধরনের চুক্তি মানতে বাধ্য—
হে বিশ্বাসীরা, তোমরা সকল অঙ্গীকার পূর্ণ কর। … [৫:১]
… তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ কর। নিশ্চয়ই তোমাদেরকে অঙ্গীকারের ব্যপারে জিজ্ঞেস করা হবে। [১৭:৩৪]
… নিশ্চিত করার পরে কোনো অঙ্গীকার ভাঙবে না, কারণ তোমরা আল্লাহকে সাক্ষি করেছ। তোমরা যা কিছু করো, আল্লাহ তা জানেন। … [১৬:৯১]
কোনো মুসলিম যদি অন্য কোনো অমুসলিমদের দেশে ভিসা নিয়ে প্রবেশ করে, তাহলে সে ভিসা গ্রহণ করার সময় অঙ্গিকার করেছে যে, সে সেই দেশের আইন মেনে চলবে। তখন সেই আইন ভেঙ্গে বোমাবাজি, সন্ত্রাসী করার কোনো অধিকার তার নেই।[১৯৮] করলে সেটা কু’রআনের তিনটি আয়াত ভাঙার অপরাধ হবে।
কিন্তু কু’রআন না বলে সব কাফিরদেরকে মারতে?
কু’রআনের এত আয়াতের পরেও একদল মুসলিম এবং অমুসলিম ঠিকই ঘেঁটে ঘেঁটে এমন কিছু আয়াত খুঁজে বের করবে, যেগুলো তাদেরকে অমুসলিমদের সম্পদ লুটতে, মারামারি, খুনাখুনি করতে সমর্থন করে। তখন তাদেরকে প্রশ্ন করতে হবে, উপরের এই আয়াতগুলো কি তাহলে ভুল? আপনারা যেই আয়াতগুলো খুঁজে বের করছেন, সেই আয়াতগুলো এবং উপরের এই আয়াতগুলো তো একই সাথে সত্যিই হতে পারে না? যদি দাবি করেন আপনাদের আয়াতগুলো সত্যি, তাহলে উপরের এই আয়াতগুলো ভুল। যদি উপরের এই আয়াতগুলো সত্যি হয়, তাহলে আপনাদের আয়াতগুলো ভুল। তারমানে কি আপনারা দাবি করছেন কু’রআনে অসঙ্গতি রয়েছে? তাহলে তো আর সেটা সত্যি ধর্ম হলো না?
আর যদি দাবি করেন কু’রআনে কোনো অসঙ্গতি নেই, তাহলে উপরের এই আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা আপনাদেরকে দিতে হবেই। এই আয়াতগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাবেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত না এই আয়াতগুলোর অন্য কোনো অর্থ যথাযথ দলিল দিয়ে প্রমাণ করতে না পারছেন, অন্য কোনো আয়াত দেখাতে আসবেন না। বরং বোঝার চেষ্টা করুণ আপনার আয়াতগুলোর অর্থ আপনি ভুল বুঝেছেন কিনা। সেই আয়াতগুলো কী পরিপ্রেক্ষিতে নাজিল হয়েছে, তা আপনি ঠিকমত বুঝেছেন কিনা। সেগুলো কি যুদ্ধের সময় নাজিল হওয়া আয়াত, নাকি যুদ্ধের বাইরে যে কোনো সময় প্রযোজ্য আয়াত? সেগুলো কি শান্তিপ্রিয় কাফির প্রতিবেশীদের সম্পর্কে দেওয়া আয়াত, নাকি সহিংস কাফিরদের বিরুদ্ধে দেওয়া আয়াত?
কিন্তু আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাঁর অনুগ্রহের জন্য মনোনীত করেন
আয়াতের এই অংশটি মুসলিমদের জন্যও প্রযোজ্য। আমরা কখনও কাউকে যেন তার মেধা, জ্ঞান, সম্পত্তি, স্বাস্থ্যর জন্য হিংসা বা ঘৃণা না করি। আল্লাহ تعالى কাকে ভালো স্বাস্থ্য দেবেন, কাকে সুন্দর করে বানাবেন, কাকে অঢেল সম্পত্তি দেবেন, সেটা সম্পূর্ণ তাঁর ব্যাপার। আমার স্বাস্থ্য খারাপ, আমি দেখতে কালো, আমার কোনো টাকা পয়সা নেই, এই সব চিন্তা করে আমি যেন কখনও হতাশায় না ভুগি, এবং অন্য কাউকে হিংসা না করি। সে যদি আমার নিজের ভাই-বোনও হয়। হিংসা একটি ভয়ংকর ব্যাপার। মানবজাতির ইতিহাসে প্রথম খুন হয়েছিল আদমের (আ) দুই সন্তানের মধ্যে হিংসার কারণে। ভাইয়ে ভাইয়ে হিংসা, বোনে বোনে হিংসার ফলে খুন অহরহ ঘটছে। হিংসার ফলে স্বামীস্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ, হত্যা একটি সাধারণ ঘটনা। কানাডায় একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে পরিবারের মধ্যে খুন হওয়ার প্রথম কারণ রাগ, দ্বিতীয় কারণ হিংসা।[২০২]
হিংসার সমাধান কু’রআনেই দেওয়া আছে। যাদের মনে হিংসা আছে, তাদেরকে এই দুটি ব্যাপার লক্ষ্য রাখতে হবে: ১) আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাঁর অনুগ্রহের জন্য মনোনীত করেন এবং ২) আল্লাহ অপরিসীম অনুগ্রহের অধিকারী। তিনি ইচ্ছা করলেই যে কাউকে অনুগ্রহ করতে পারেন। তাই আমরা যদি এখন কিছু পেয়ে না থাকি, তাহলে হতাশ হওয়ার কারণ নেই। আল্লাহর تعالى অনুগ্রহের ভাণ্ডার বিশাল। তিনি আমাদেরকে অন্য কোনোদিক থেকে ঠিকই দেবেন, বা হয়ত ইতিমধ্যে দিয়েছেন, যা হিংসায় অন্ধ হয়ে থাকার কারণে লক্ষ্য করা হয়নি। তবে একই সাথে আমাদের এটাও লক্ষ্য রাখা দরকার: আমরা তাঁর অনুগ্রহ না পাওয়ার জন্য কিছু করছি কিনা।
আল্লাহ অপরিসীম অনুগ্রহের অধিকারী
আল্লাহ تعالى আমাদেরকে প্রকৃতিতে হাজার রকমের পানীয় দিয়েছেন—ডাবের পানি, তালের রস, আখের রস; আপেল-কমলা-আঙ্গুরসহ শত ফলের জুস; গ্রিন-টি, হারবাল-টিসহ শত ধরণের স্বাদের চা, কফি—কিন্তু তারপরেও ক্ষতিকর কোক, পেপসি, বিয়ার, হুইস্কি পান করার জন্য আমাদের অন্তর খাঁ খাঁ করতে থাকে। প্রকৃতিতে কয়েক হাজার রকমের স্বাস্থ্যকর, সুস্বাদু পানীয় পেয়েও আমাদের মন ভরে না। প্রকৃতির দেওয়া স্বাস্থ্যকর ফলগুলোকে বিকৃত করে, গাঁজিয়ে, বেশি করে চিনি এবং কেমিক্যাল দিয়ে বিষাক্ত কক্টেইল বানিয়ে পান করে আমাদের মন ভরাতে হয়।
আল্লাহ تعالى আমাদেরকে প্রকৃতিতে স্বাস্থ্যকর শস্য, যেমন আলু, গম, চাল দিয়েছেন। আমরা সেগুলোকে রুটি, ভাত বানিয়ে খেতে পারি। কিন্তু না, আমাদের দরকার তিন দিনের বাসি তেলে ভাজা, ফ্যাট ভর্তি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, পুড়িয়ে শেষ করে ফেলা তেলতেলে চিকেন ব্রোস্ট, গলগলে পনিরভর্তি পিঁৎজা — যেগুলো খেয়ে আমাদের পেটের মধ্যে থলথলে চর্বি জমে, লিভার নষ্ট হয়ে যায়, রক্ত চাপ বেড়ে যায়। তারপর অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে বছরের পর বছর কোঁকাতে হয়। নিকৃষ্ট জিনিসের প্রতি কেন জানি আমাদের আজন্ম আগ্রহ।
সূত্র:
- [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
- [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
- [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
- [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
- [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
- [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
- [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
- [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
- [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
- [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
- [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
- [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
- [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
- [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
- [১৫] তাফসির আল জালালাইন।
- [১৯৫] ইসরাইলি সৈন্যদের বুলডোজারে চাপা দিয়ে মেরে ফেলা খ্রিস্টান আন্দোলনকারী — http://en.wikipedia.org/wiki/Rachel_Corrie
- [১৯৬] ইহুদীদের আন্দোলন ইসরাইলের বিরুদ্ধে — http://www.youtube.com/watch?v=qlW_UFSQpzw, http://www.haaretz.com/news/world/.premium-1.605977, http://electronicintifada.net/content/jews-ny-san-francisco-philadelphia-stage-coordinated-protest/6395
- [১৯৭] সিএনএন রিপোর্টারকে প্রতিবাদ করার জন্য চাকরীচ্যুত — http://www.huffingtonpost.com/2014/07/18/cnn-diana-magnay-israel-gaza_n_5598866.html
- [১৪৬] মুসনাদ আহমাদ: ১৬৩৪৪ http://dorar.net/enc/aqadia/3437
- [১৯৮] অমুসলিমদের সাথে মুসলিমরা কীভাবে থাকবে, তার উপর ফাতওয়া — http://islamqa.info/en/26721
- [১৯৯] ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে আক্রমণের ইতিহাস — http://en.wikipedia.org/wiki/Violence_against_Muslims_in_India
- [২০০] বাবরি মসজিদের ঘটনা — http://en.wikipedia.org/wiki/Babri_Masjid
- [২০১] কাশ্মীরের ঘটনা — http://en.wikipedia.org/wiki/Kashmir
- [২০২] হিংসার ফলে খুনের পরিসংখ্যান — http://www.statcan.gc.ca/pub/85-002-x/2013001/article/11805/11805-2-eng.htm
- [২০৩] ভারতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্দোলন — http://www.thehindu.com/news/cities/Delhi/gaza-unrest-triggers-protest-outside-israel-embassy/article6207229.ece
- [২০৪] আহলুল ফাতরাহ — http://www.fatwa-online.com/fataawa/creed/faith/0020113_1.htm, শেখ আল বাণী — তাকফির এর উপর বিস্তারিত আলোচনা: http://www.spubs.com/sps/downloads/pdf/MSC060006.pdf, http://sunnahonline.com/library/beliefs-and-methodology/106-ruling-about-ahlul-fartah-the, শেখ আজিজ বিন বাজ: http://www.fatwaislam.com/fis/index.cfm?scn=fd&ID=775, শেখ আল-জাবিরি (শেষ প্রশ্নটি দেখুন): http://abdurrahmanorg.files.wordpress.com/2013/10/the-excuse-of-ignorance-e28093-shaykh-ubayd-al-jaabiree.pdf
“৭) কিন্তু সেই ঘৃণা থেকে কোনো মুসলিম কখনই অন্য কোনো অমুসলিমের বিরুদ্ধে খারাপ আচরণ, বা আক্রমণ করতে পারবে না, যদি না সেই অমুসলিম তাকে আক্রমণ না করে।”
I think the last part of the above sentence (after the second comma) has been double negated (as a typo, i believe) and is therefore has totally changed the meaning of the sentence. I hope you would correct it as required.
sorry, now i am confused. I think its OK.