আকাশকে খুলে দেওয়া হবে — আন-নাবা ১৭-৩০

চৌধুরী সাহেব স্বপরিবারে সমুদ্রের পাড়ে বেড়াতে এসেছেন। পাড়ে বসে তারা সমুদ্র উপভোগ করছিলেন, কিন্তু তার শিশু বাচ্চাটি এখন ক্ষুধায় কান্না শুরু করেছে। স্ত্রীকে নিয়ে উঠলেন নিরিবিলি একটা জায়গা খুঁজে বের করতে। তারা হেঁটে যাচ্ছিলেন, আর তখন এক ভীষণ শব্দে কানে তালা লেগে গেলো। তারপর পায়ের নিচে মাটি ভীষণ জোরে ঝাঁকুনি দিলো। তিনি দূরে ছিটকে পড়ে গেলেন। 

উপরে তাকিয়ে দেখলেন আকাশটা যেন গোলাপের মত লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে, আকাশটাকে পৃথিবীর উপর থেকে ছিঁড়ে তুলে ফেলা হয়েছে। মহাকাশ খালি চোখে দেখা যাচ্ছে। আর পুরো মহাকাশে অজস্র ফাটল তৈরি হচ্ছে। তারাগুলো একে একে ঝরে যাচ্ছে। সূর্যকে কালো একটা কী যেন ঘিরে ফেলছে। দিনের বেলাতেও রাতের মত অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। চাঁদের শেষ আলোটুকুও একসময় নিভে গেলো। 

সৈকতে যারা ছিল সবাই দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে একেক দিকে দৌড়াচ্ছে। এমনকি তার স্ত্রীও বাচ্চা ফেলে আতংকে দৌড়াচ্ছেন। তিনি হতবিহ্বল হয়ে ছুটছেন। কোন দিকে যাবেন কিছুই জানেন না। 

সামনে একটা পাহাড় দেখে সেদিকে দৌড় দিলেন, যদি উঁচু জায়গায় আশ্রয় নেওয়া যায়। কিন্তু তিনি পৌঁছানোর আগেই এক ভীষণ ঝাপটা এসে পাহাড়টাকে গুড়ো-গুড়ো করে ধুলোর মতো উড়িয়ে নিয়ে গেলো। পেছনে সমুদ্রে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়ে পানি আকাশে ছিটকে উঠলো। তারপর সমুদ্রের পানিতেই আগুন ধরে গেল। এই অস্বাভাবিক ঘটনা দেখে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না কী হচ্ছে চারপাশে! এটা তো কোনো স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়! 

একের পর এক ঝাপটায় আশেপাশের সবকিছু ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। তিনি হতবিহব্বল হয়ে তাকিয়ে দেখছেন। তার দৌড়ে পালানোর কোনো জায়গা নেই। হঠাৎ করে তার গায়ে এসে একটা বাড়ি লাগলো…

সবকিছু অন্ধকার, নিশ্চুপ হয়ে গেলো। 

এরপর অনন্ত কাল যেন পার হয়ে গেলো।

চৌধুরী সাহেব চোখ খুলে তাকালেন। তার কানে এখন আরেকটি শব্দ বাজছে। তার মনে হলো, তিনি যেন এখনি মাটির ভেতর থেকে ছিটকে বেড়িয়ে এলেন। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেন অজস্র মানুষের সমুদ্র। সবাই হতবিহব্বল হয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখছে। কেউ কেউ বিস্ফোরিত চোখে উপরে তাকিয়ে আছে। উপরে তাকিয়ে তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। এটা তো পরিচিত কোনো আকাশ নয়। অন্য কোনো জগতের আকাশ মনে হচ্ছে! আকাশের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত ছিঁড়ে ফাঁক করা। সেই ফাঁক দিয়ে উপরে দেখা যাচ্ছে প্রকাণ্ড কারা যেন এক ভীষণ আকৃতির কিছুকে তুলে ধরে রেখেছে।

নিচে তাকিয়ে তিনি অদ্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলেন। পায়ের নিচে একদম মসৃণ সমতল মাটি। একটুও দাগ বা ভাঁজ নেই। যেদিকেই তাকান, সেদিকেই মসৃণ সমতল ভূমি, কোথাও উঁচু-নিচু কিছুই নেই। এটা তো সেই চিরচেনা পৃথিবীর মাটি নয়। মনে হচ্ছে ভিনগ্রহে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি! 

তিনি সামনে থেকে কারো ডাক শুনলেন। সাথে সাথে তার দেহ নিজে থেকেই সেদিকে দৌড়ানো শুরু করল। তার আশেপাশের মানুষগুলোও দলে দলে সবাই পঙ্গপালের মতো সামনে দৌড়ে যাচ্ছে সেই ডাক শুনে। কী যেন ঘটতে যাচ্ছে সামনে! 

হঠাৎ করে তিনি এক ভীষণ আতংক অনুভব করলেন। কিছু একটা আসছে। অনেক দূর থেকে গর্জন করতে করতে বিশাল এক ভয়ংকর দানব যেন আসছে। দূরে দিগন্তে তাকিয়ে যা দেখলেন তাতে তিনি ভয়ে জমে গেলেন। এক বিশাল আগুনের জগতকে প্রকাণ্ড আকৃতির কারা যেন টেনে নিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে পুরো জগতটাই একটা হিংস্র দানব। হঠাৎ করে সেটি যেন ছাড়া পেয়ে ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে তার শিকারকে খুঁজছে। তিনি দেখেই বুঝতে পারলেন সেটা কী। হায় হায়! এই জিনিসের কথাই তো তাকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল! 

নিঃসন্দেহে সবকিছু ফয়সালার দিনটির সময় ঠিক করা আছে। সেদিন শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, তখন তোমরা দলে দলে আসবে। আর আকাশকে খুলে দেওয়া হবে এবং সেটা অনেকগুলো দরজার মতো হয়ে যাবে। পাহাড়গুলোকে চালিয়ে দেওয়া হবে, যেন তারা মরীচিকা—আন-নাবা ১৭-২০

নিঃসন্দেহে জাহান্নাম ওঁত পেতে অপেক্ষা করছিল সীমালঙ্ঘকারীদের জন্য, এক স্থায়ী আবাস হয়ে। যুগ যুগ ধরে সেখানে থাকবে তারা। সেখানে কোনো ধরনের শীতলতার স্বাদ পাবে না, পাবে না কোনো পানীয়, শুধুই ফুটন্ত পানি এবং পুঁজ —উপযুক্ত প্রতিদান। —আন-নাবা ২১-২৬

জাহান্নাম ওঁত পেতে অপেক্ষা করছে طاغين ত্বাগিনদের জন্য। এরা হচ্ছে চরম সীমালঙ্ঘনকারী। এরা কোনো সাধারণ অপরাধী নয়। এদের জীবনটাই ছিল অবাধ্যতায় ভরা। যেমন—

চৌধুরী সাহেব বিশাল পরিমাণের ঘুষ খাইয়ে একটা সরকারি প্রজেক্টের কন্ট্রাক্ট হাতালেন। এর জন্য তিনি মন্ত্রীকে গুলশানে দুইটা ফ্ল্যাট কিনে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিলেন। তারপর ব্যাংকের ঋণ নিয়ে জোগাড় করা সেই বিশাল অংকের ঘুষ, সুদসহ শোধ করতে গিয়ে, এবং মন্ত্রীকে কথা দেওয়া দুইটা ফ্ল্যাটের টাকা উঠানোর জন্য শেষ পর্যন্ত তাকে প্রজেক্টের অনেক টাকা এদিক ওদিক সরিয়ে ফেলতে হলো। দুই নম্বর সস্তা কাঁচামাল সরবরাহ করতে হলো। যোগ্য কনট্রাক্টরদের কাজ না দিয়ে অযোগ্য, সস্তা কনট্রাক্টরদের কাজ দিতে হলো, যারা কিনা তাকে প্রচুর ঘুষ খাওয়ালো। 

এরপর একদিন তার প্রজেক্ট ধ্বসে পড়ল। তার নামে ব্যাপক কেলেঙ্কারি হয়ে মামলা হয়ে গেলো। মামলায় উকিলের টাকা জোগাড় করতে তাকে আরও বিভিন্ন উপায়ে টাকা মারা শুরু করতে হলো। তারপর কয়েকদিন পর পর পুলিশ তাকে ধরতে আসে, আর তিনি উপরের তলার লোকদের ঘুষ খাইয়ে পুলিশকে হাত করে ফেলেন। 

প্রজেক্টে দুর্নীতির কারণে ভুক্তভোগী মানুষদের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাকে একসময় অনেক টাকা খরচ করে কিছু ‘সোনার ছেলে’ পালতে হয়। তারা মাঝে মাঝেই খুন, ধর্ষণ করে, হোটেলে থেকে … করে এসে বিরাট বিল ধরিয়ে দেয়। তারপর তাদেরকে যখন পুলিশ ধরতে আসে, তিনি পুলিশকে টাকা খাইয়ে তাদেরকে রক্ষা করেন। এত দুশ্চিন্তার মধ্যে তিনি রাতে কোনোভাবেই ঘুমাতে পারেন না। দুশ্চিন্তা ভুলে থাকার জন্য তাকে নিয়মিত মদ খাওয়া ধরতে হয়। এভাবে একটার পর একটা পাপে তিনি জড়িয়ে পড়তে থাকেন। অবাধ্যতা এবং সীমালঙ্ঘন তার জীবনটাকে ঘিরে ফেলে। কিন্তু, তিনি কোনো ভ্রুক্ষেপ করেন না, কারণ—

তারা ভাবতোই না যে, তাদের কাজের হিসেব কখনো দিতে হবে। আমার নিদর্শনগুলোকে সব মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করত —আমি সব গুনে গুনে হিসেব করে রেকর্ড করে রেখেছি। এবার তার প্রতিদান ভোগ করো। আমি তোমাদের শাস্তি কেবল বাড়াতেই থাকবো। —আন-নাবা ২৭-৩০ 

কোনোরকম জবাবদিহিতার ভয় যখন মানুষের মন থেকে চলে যায়, তখন সে পশুর থেকেও অধম হয়ে যায়। এরা তখন সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণীতে পরিণত হয়। এদের দিয়ে এমন কোনো অন্যায় নেই, যা হয় না। 

আল্লাহ تعالى এদেরকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি সব হিসেব করে রেখেছেন। শুধুই হিসেব করে রাখেননি, সেই হিসেবকে তিনি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করেও রেখেছেন । أحصى আহ্‌সা অর্থাৎ গুণে গুণে হিসেব করে রাখা, সংরক্ষণ করে রাখা। দুনিয়াতে এরা পুলিশ, উকিল, বিচারপতিকে টাকা খাইয়ে সাক্ষী-প্রমাণ নষ্ট করে দিতে পারে। কিন্তু আল্লাহর تعالى হিসেব সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। 

শেষ অংশটি ভয়ঙ্কর — “আমি তোমাদের শাস্তি কেবল বাড়াতেই থাকবো।” আমরা যখন পৃথিবীতে কষ্টে থাকি, আমাদের মনে একটা সান্ত্বনা থাকে যে, আর মাত্র কয়েকটা দিন, তারপরই কষ্ট শেষ। যেমন, ধরুন আপনার গায়ে একদিন ফুটন্ত গরম পানি পড়ে গা ঝলসে চামড়া উঠে গেলো। আপনি এক মুহূর্তের জন্য না ঘুমিয়ে বিছানায় ছটফট করে ব্যথায় চিৎকার করছেন। প্রতিটা সেকেন্ড আপনার কাছে মিনিট মনে হচ্ছে। প্রত্যেকটা হৃদস্পন্দনের সাথে সাথে আপনার চামড়া জ্বলে যাচ্ছে। এরই মধ্যে আপনি নিজেকে বোঝাচ্ছেন: “আর একটু। আর কয়েকটা দিন। তারপরেই ব্যথা কমে যাবে, ঘুমিয়ে যাবো, কষ্ট কমে যাবে…”

—এভাবে পৃথিবীতে আমরা প্রচণ্ড কষ্টের অভিজ্ঞতা ধৈর্য ধরে পার করি, কারণ আমরা জানি একদিন সেই কষ্ট শেষ হবে। এই আশা আমাদেরকে কষ্ট সহ্য করার শক্তি দেয়, ধৈর্য ধরার অনুপ্রেরণা দেয়। কিন্তু এই ধরনের মানুষরা, যারা জাহান্নামে চিরকাল থাকবে, তাদের কোনো আশা নেই। তাদের ধৈর্য ধরার কোনো অনুপ্রেরণা নেই। তারা জানে যে, তাদের এই প্রচণ্ড কষ্ট কখনো শেষ হবে না। এই বিকট দুর্গন্ধ, প্রচণ্ড গরম, অমানুষিক অত্যাচার — চলতেই থাকবে। কখনো তারা একটুও ঘুমাতে পারবে না। কোনোদিন তারা আগের সুস্থ জীবনে ফিরে যেতে পারবে না। —এই ভয়ঙ্কর উপলব্ধি তাদের কষ্টকে হাজার গুনে বাড়িয়ে দেবে। জাহান্নামের প্রচণ্ড শারীরিক যন্ত্রণার সাথে যোগ হবে এক বুক ফাটা আতঙ্ক: এখানে তাদের কষ্ট বাড়তেই থাকবে।

যুগ যুগ ধরে সেখানে থাকবে তারা

জাহান্নামে মানুষ যুগ যুগ ধরে থাকবে। এর কোনো শেষ নেই। কত যুগ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি, বরং حقب হুকব অর্থ যুগ এবং أحقاب আহকাব অর্থ বহু যুগ। অত্যন্ত দীর্ঘ সময় বোঝানোর জন্য যুগ যুগ বলা হয়েছে। পরকালের দিন, মাস, বছরের দৈর্ঘ্য অনেক বড় হবে বলে বেশ কিছু সহিহ হাদিস পাওয়া যায়। আর কুরআনের অন্যান্য জায়গায় আমরা দেখেছি ‘চিরকাল’ শব্দটা বিশেষভাবে ব্যবহার হতে। 

অনেকে প্রশ্ন করেন: অনন্তকাল শাস্তি কীভাবে ন্যায় বিচার হতে পারে? কেউ একজন যদি সারাজীবন অপরাধ করেও এবং সেজন্য যদি পুরো মানবজাতিরও ক্ষতি হয়, তারপরেও তাকে বহু কোটি বছর শাস্তি দিলে একসময় সেটা গিয়ে মোট পাপের সমান শাস্তি হবে। কিন্তু অনন্তকাল ধরে কাউকে শাস্তি দিতে থাকলে তো একসময় না একসময় গিয়ে তার শাস্তি যথাযথ প্রতিদানের থেকে বেশি হয়ে যাবেই? তখন সেটা কীভাবে ন্যায়বিচার হবে? 

আহলুস সুন্নাহ ওয়া আল জামাআহ-এর বিশ্বাস হলো যে, জাহান্নাম চিরকাল থাকবে এবং সেখানে অনেকেই থাকবে, যাদের শাস্তি কখনোই শেষ হবে না। এটাই হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মত। মূল ধারার প্রায় সব বড় ইমামের একই মত যে, জাহান্নামে কিছু মানুষ চিরকাল শাস্তি পেতে থাকবে এবং জাহান্নাম অবিনশ্বর। যেমন, ফিরাউনের শাস্তির কোনো শেষ নেই। 

যারা প্রশ্ন করেন যে, কেন মানুষের সাময়িক জীবনের শাস্তি অনন্ত কাল হবে? —তাদের সমস্যা হলো যে, তারা মানুষের অন্যায়কে তার আয়ুকাল অনুসারে পরিমাপ করছেন, অন্যায়ের প্রভাব অনুসারে নয়। একজন মানুষ ৭০-৮০ বছর ধরে যে অন্যায় করতে পারে, তার থেকে অনেক বড় অন্যায় অন্য কেউ করতে পারে এক ঘণ্টায়, যার প্রভাব যুগ যুগ ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম থেকে যেতে পারে। এছাড়াও কুরআনের একটি আয়াত থেকে আমরা জানতে পারি যে, কিছু মানুষ আছে, যাদেরকে যদি অনন্ত জীবন দেওয়া হয়, তাহলে তারা অনন্তকাল ধরে অন্যায় করতে থাকবে। কারণ, এরা নিজেদেরকে এতটাই নষ্ট করে ফেলেছে যে, এরা সংশোধনের ঊর্ধ্বে চলে গেছে। এই ধরনের মানুষদেরকে পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে অনন্তকাল শাস্তি দেওয়া হয়, কারণ সে পৃথিবীতে ৭০-৮০ বছর থাকুক, আর অনন্তকাল থাকুক, এরা পাপ করেই যাবে।

তুমি যদি তাদেরকে দেখতে, যাদেরকে আগুনের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হবে, তারা বলবে, “হায়! আমাদেরকে যদি ফিরিয়ে নেওয়া হতো, তাহলে আমরা আমাদের রবের নিদর্শনগুলোকে মিথ্যা বলতাম না এবং মুমিনদের একজন হয়ে যেতাম।” বরং তারা আগে যা গোপন করেছিল, সেটা এখন তাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর যদিও বা তাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া হতো, তারা আবার তাই করত যা তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল। নিশ্চিতভাবে এরা মিথ্যাবাদী। —আল-আনআম ২৭-২৮

এই আয়াতের অর্থ এই যে, এদেরকে যদি মৃত্যুর পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং তাদের পরকালের স্মৃতি মুছে দেওয়া হয়, তাহলে এরা এতই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, এরা অন্যায় করতেই থাকতো। এদের জন্য পৃথিবীতে চিরকাল বেঁচে থেকে চিরকাল অন্যায় করা আর একসময় পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া একই কথা। এদের জন্য চিরকাল শাস্তিই যথার্থ।

তবে প্রাচীন তাফসিরবিদ আত-তাবারি বেশ কয়েকটি আছার সংগ্রহ করেছেন, যেখানে সাহাবিদের মন্তব্য আছে যে, জাহান্নাম একসময় খালি হয়ে যাবে বা একসময় এটিও ধ্বংস হয়ে যাবে এর ভেতরের অপরাধীদের নিয়ে, যখন তাদের উপযুক্ত শাস্তির মেয়াদ শেষ হবে। ইবন আল-কাইয়ুম-এর হাদি আল-আরওয়াহ বইয়ের এক লম্বা অধ্যায়ে যে সমস্ত আলিমরা জাহান্নামের অনন্ত শাস্তি সমর্থন করেন না, তাদের সেই দাবির পেছনে কারণগুলো দেখিয়েছেন। তার সারমর্ম হচ্ছে যে, জাহান্নাম-এর একাধিক পরিণতি হতে পারে এবং আল্লাহর রহমত এবং ক্ষমা সবকিছুর উপরে। তার বক্তব্য, “সর্বোচ্চ প্রজ্ঞাবান বিচারকের প্রজ্ঞার এটা সাজে না যে, তিনি কাউকে সৃষ্টি করবেন চিরকাল শাস্তি দেওয়ার জন্য, অনন্ত শাস্তি যা শেষ হয় না এবং যার কোনো বিরতি নেই।” তবে তিনি নিজে কোনো একটি মতকে সমর্থন করে অন্য মতকে বাতিল বলেননি। বরং তিনি বলেছেন যে, “আল্লাহ ভালো জানেন।”

একইভাবে তার শিক্ষক ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ দুটো মতকেই তার লেখা শেষ বইতে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছেন। যদিও তিনি বলেননি যে, তিনি নিজে কোন মতকে সমর্থন করেন, কিন্তু তার লেখা পড়লে বোঝা যায় যে, জাহান্নাম চিরজীবন হতে পারে এবং নাও হতে পারে— এই দুটো মতকেই তিনি সমানভাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি কোনোটাকেই বাতিল বলেননি।

যাহোক, জাহান্নাম চিরকাল থাকবে, নাকি কোটি কোটি কোটি বছর থাকবে তাতে খুব একটা পার্থক্য হয় না। জাহান্নামে এক মুহূর্ত থাকার অভিজ্ঞতা দুনিয়াতে যাবতীয় ফুর্তির আনন্দ বাতিল করে দেবে। এর শাস্তি এতটাই কুৎসিত যে, সেখানে একদিন থাকাটাও পৃথিবীতে আজীবন শাস্তি পাওয়া থেকে অনেক বেশি কষ্টের। তাহলে কোটি কোটি বছর ধরে প্রতিটি মুহূর্ত অমানুষিক শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন সহ্য করার কথা চিন্তাও করা যায় না। 

কিয়ামতের বর্ণনার জন্য যে আয়াতগুলো ব্যবহার করা হয়েছে—
  •  فَإِذَا نُفِخَ فِي الصُّورِ نَفْخَةٌ وَاحِدَةٌ ﴿١٣﴾ وَحُمِلَتِ الْأَرْضُ وَالْجِبَالُ فَدُكَّتَا دَكَّةً وَاحِدَةً ﴿١٤﴾
  •  إِذَا زُلْزِلَتِ الْأَرْضُ زِلْزَالَهَا ﴿١﴾ وَأَخْرَجَتِ الْأَرْضُ أَثْقَالَهَا ﴿٢﴾
  • فَإِذَا انشَقَّتِ السَّمَاءُ فَكَانَتْ وَرْدَةً كَالدِّهَانِ ﴿٣٧
  • إِذَا السَّمَاءُ انفَطَرَتْ ﴿١﴾ وَإِذَا الْكَوَاكِبُ انتَثَرَتْ ﴿٢﴾
  • إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ وَإِذَا النُّجُومُ انكَدَرَتْ وَإِذَا الْجِبَالُ سُيِّرَتْ وَإِذَا الْعِشَارُ عُطِّلَتْوَإِذَا الْوُحُوشُ حُشِرَتْ وَإِذَا الْبِحَارُ سُجِّرَتْ… عَلِمَتْ نَفْسٌ مَا أَحْضَرَتْ)
  • فَإِذَا بَرِقَ الْبَصَرُ ﴿٧﴾ وَخَسَفَ الْقَمَرُ ﴿٨﴾ وَجُمِعَ الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ ﴿٩﴾
  •  يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ ۚ إِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيمٌ ﴿١﴾ يَوْمَ تَرَوْنَهَا تَذْهَلُ كُلُّ مُرْضِعَةٍ عَمَّا أَرْضَعَتْ وَتَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَتَرَى النَّاسَ سُكَارَىٰ وَمَا هُم بِسُكَارَىٰ وَلَـٰكِنَّ عَذَابَ اللَّـهِ شَدِيدٌ ﴿٢﴾
  •  يَوْمَ تَرْجُفُ الْأَرْضُ وَالْجِبَالُ وَكَانَتِ الْجِبَالُ كَثِيبًا مَّهِيلًا ﴿١٤﴾
  •  وَإِذَا الْبِحَارُ فُجِّرَتْ ﴿٣﴾
  •  يَوْمَ تَشَقَّقُ الْأَرْضُ عَنْهُمْ سِرَاعًا ۚ ذَٰلِكَ حَشْرٌ عَلَيْنَا يَسِيرٌ ﴿٤٤﴾
  • ثُمَّ نُفِخَ فِيهِ أُخْرَى فَإِذَا هُم قِيَامٌ يَنظُرُونَ
  •  وَانشَقَّتِ السَّمَاءُ فَهِيَ يَوْمَئِذٍ وَاهِيَةٌ ﴿١٦﴾ وَالْمَلَكُ عَلَىٰ أَرْجَائِهَا ۚ وَيَحْمِلُ عَرْشَ رَبِّكَ فَوْقَهُمْ يَوْمَئِذٍ ثَمَانِيَةٌ ﴿١٧﴾
  •  فَيَذَرُهَا قَاعًا صَفْصَفًا ﴿١٠٦﴾ لَّا تَرَىٰ فِيهَا عِوَجًا وَلَا أَمْتًا ﴿١٠٧﴾
  •  يَوْمَ تُبَدَّلُ الْأَرْضُ غَيْرَ الْأَرْضِ وَالسَّمَاوَاتُ ۖ وَبَرَزُوا لِلَّـهِ الْوَاحِدِ الْقَهَّارِ ﴿٤٨﴾
  •  خُشَّعًا أَبْصَارُهُمْ يَخْرُجُونَ مِنَ الْأَجْدَاثِ كَأَنَّهُمْ جَرَادٌ مُّنتَشِرٌ ﴿٧﴾ مُّهْطِعِينَ إِلَى الدَّاعِ ۖ يَقُولُ الْكَافِرُونَ هَـٰذَا يَوْمٌ عَسِرٌ ﴿٨﴾
  •  وَبُرِّزَتِ الْجَحِيمُ لِمَن يَرَىٰ ﴿٣٦﴾

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

5 thoughts on “আকাশকে খুলে দেওয়া হবে — আন-নাবা ১৭-৩০”

  1. আপনি নতুন কিছু লিখছেন না কেন?

Leave a Reply to আকিবুল হাসান Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *