অচিরেই আমি তোমাকে দিয়ে পড়াবো, তারপর তুমি আর ভুলবে না। তবে আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ছাড়া। তিনি প্রকাশ্য এবং যা গোপন করা হয়,তা অবশ্যই জানেন। আর আমি তোমার জন্য সহজকে পাওয়া সহজ করে দেবো। তাই তুমি উপদেশ দিতে থাকো, এতে লাভ হোক আর না হোক। যার অন্তরে ভয় আছে সে তা গ্রহণ করবে। আর চরম হতভাগা তা পাশ কাটিয়ে যাবে। সে ভয়ংকর আগুনে পুড়বে। তারপর সেখানে সে না মরবে, না বাঁচবে। যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে, সে-ই তো সাফল্য লাভ করে। আর যে তার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করে নামাজ পড়ে।
অচিরেই আমি তোমাকে দিয়ে পড়াবো, তারপর তুমি আর ভুলবে না। তবে আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ছাড়া। তিনি প্রকাশ্য এবং যা গোপন করা হয় তা অবশ্যই জানেন।
ধরুন, একদিন এক অতি উন্নত মহাজাগতিক প্রাণী, একজন মানুষের সাথে যোগাযোগ করে বলল যে, পুরো মানবজাতির
অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। তোমাকে আমি এমন কিছু তথ্য দেব, যার মধ্যে মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচার উপায় দেওয়া আছে। তুমি প্রথমে নিজে মুখস্ত করবে, তারপর মানুষের কাছে তা পৌঁছে দেবে। আর সাবধান, এই তথ্য এসেছে আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, স্বয়ং মহাবিশ্বের স্রস্টার কাছ থেকে। মানুষ যদি তার কথা না শোনে, তাহলে তিনি তোমার জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন।
—এরকম ভয়ংকর দায়িত্ব কাউকে দিলে স্বাভাবিকভাবেই তার ভেতরে আতংক তৈরি হবে। যদি সে ভুলে যায়? যদি সে নিজে ভুল বুঝে অন্যকে ভুল শেখায়? যদি সে ঠিকমত পুরো তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে না পারে? তখন কী হবে? মানবজাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব তার একার ঘাড়ে এখন? কি সর্বনাশ!
রাসুলকে عليه السلام আল্লাহ تعالى এমনই এক বিশাল দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তাকে শুধু মানবজাতির অল্প কিছু দিনের দুনিয়ার জীবনই নয়, বরং পরকালের অনন্ত জীবনে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচার উপায় শিখিয়ে দিয়ে, তারপর তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এরকম ভয়ংকর দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই তিনি দুশ্চিন্তায় থাকতেন যে, সত্যিই পুরো কুরআন তিনি মনে রাখতে পারবেন? তিনি পারবেন মানুষের কাছে তা সঠিকভাবে পৌঁছে দিতে? তিনি যদি কুরআনের কিছু অংশ ভুলে যান, তখন কী হবে? তিনি লক্ষ্য করছেন যে, মাঝে মধ্যে তিনি কুরআনের দুই-একটি আয়াত মনে করতে পারছেন না। এই ভুলের ফলাফল কী হতে যাচ্ছে? তিনি কি মানবজাতির কোনো বিরাট ক্ষতি করে ফেলছেন?
উপরের এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ تعالى রাসুলকে عليه السلام নিশ্চয়তা দিচ্ছেন যে, মানবজাতির কাছে সঠিকভাবে কুরাআনের বাণী পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আল্লাহ تعالى নিজে নিয়েছেন। রাসুলকে عليه السلام কখনই কুরআন ভুলতে দেওয়া হবে না। মাঝে মধ্যে তার হয়ত কিছু আয়াত মনে না-ও আসতে পারে। তাতে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কারণ সেটা আল্লাহরই ইচ্ছা। আল্লাহ تعالى বিশেষ পরিস্থিতিতে তাকে عليه السلام বিশেষ কিছু আয়াত ভুলিয়ে দেবেন। কারণ আল্লাহ تعالى প্রকাশ্য এবং গোপন সবকিছু জানেন। তাই রাসুলের عليه السلام দুশ্চিন্তা করার কোনোই কারণ নেই। শুধু তাই না, আল্লাহ تعالى তার জন্য কল্যাণের পথ সহজ করে দেবেন। তিনি কখনই কল্যাণের পথ থেকে দূরে সরে যাবেন না।[৭][১৭][১৮]
আর আমি তোমার জন্য সহজকে পাওয়া সহজ করে দেবো।
এই আয়াতের অর্থ ব্যাপক। আল্লাহ বলছেন যে, যে কাজ মানুষকে জান্নাতে নিয়ে যায়, তা এমনিতেই সহজ। একে তিনি আরও সহজ করে দেবেন। আল্লাহ تعالى যখন কারও পথ সহজ করে দেন, তখন সে তার জীবনের সব ক্ষেত্রেই সহজ-স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পান। তিনি তখন এক বিরাট উদ্দেশ্যকে লক্ষ্য ঠিক করে জীবনের উঁচু-নিচু পথে সাচ্ছন্দের সাথে এগিয়ে যান, যেভাবে পুরো মহাবিশ্ব সাচ্ছন্দের সাথে আল্লাহর تعالى নির্দেশ মেনে এগিয়ে যাচ্ছে। তখন আর তার সাথে অন্যদের সংঘর্ষ হয় না, কারণ এই বিশাল জগতের তুলনায় সেগুলো সব তুচ্ছ। সহজ, স্বাচ্ছন্দ্য তার জীবনকে ঘিরে ফেলে। তার কথা, কাজ, চিন্তাভাবনা, কীভাবে তিনি সমস্যার মোকাবেলা করেন, কীভাবে তিনি তার দায়িত্ব পালন করেন —এগুলো সব দেখলেই বোঝা যায় যে, তিনি সবকিছুই সহজ, সাচ্ছন্দের সাথে নেন। তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে যায় সহজভাবে সবকিছুকে নেওয়ার প্রবণতা।[৬]
অনেকে বলেন, “ইসলাম বড়ই কঠিন ধর্ম ভাই। এটা করা যাবে না। ওটা দেখা যাবে না। এটা খাওয়া যাবে না। ওটা বলা যাবে না। এত শত শত নিয়ম মেনে জীবন পার করা যায় না।” — এই ধরনের কথা দুই ধরনের মানুষকে বলতে শোনা যায়। এক ধরনের মানুষ যাদের চরিত্র দুর্বল। এরা অল্পতেই ফসকে যায়। এরা সহজে কোনো প্রলোভন থেকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, যেমন সিগারেট টানা, সফট ড্রিঙ্কস পান করা, আজেবাজে মুভি দেখা ইত্যাদি। এরা অনেকেই ফাঁকিবাজ টাইপের হয়। এরা যে শুধু ধর্মের ব্যাপারেই এরকম করে তা নয়, জীবনের অনেক কাজেই এরা ফাঁকিবাজ, ঢিলে। সময়মত কাজকর্ম করতে এদেরকে কমই দেখা যায়। এছাড়া এদের ভিতরে বিনোদনের প্রতি আসক্তি দেখা যায়। ধর্ম যেহেতু তাদের খেয়াল খুশি মতো ঢিলেঢালা জীবন যাপনে এবং অঢেল বিনোদনে বুঁদ হয়ে থাকার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, তাই তারা ধর্মের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অজুহাত দাঁড় কড়ায়।
আরেক ধরনের মানুষ হচ্ছে যারা চারিত্রিকভাবে যথেষ্ট শক্ত, তাদের ভেতরে নীতিবোধও প্রবল, কিন্তু তাদের সমস্যা হচ্ছে তারা তাদের মাথার উপরে কোনো কর্তৃত্ব মেনে নেবে না। এরা চায় নিজেদের ইচ্ছেমত জীবন পার করবে। অন্য কারও কথায় এরা উঠবস করবে না। যদিও তারা চাকরি-ব্যবসার ক্ষেত্রে বসের, কাস্টোমারের কথায় ঠিকই উঠবস করে, কিন্তু ধর্মের কথা তারা শুনবে না। এরা নিজেদের ইচ্ছেমত জীবন উপভোগ করবে। নিজেদের কাছে যেটা ভালো মনে হবে সেটা করবে। যেটা খারাপ মনে হবে সেটা করবে না। পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া অন্য কেউ তাদের থেকে কোনো ব্যাপারে ভালো জানে, এটা তারা কখনই মেনে নেবে না। আর হাজার বছর আগের ‘অশিক্ষিত, মূর্খ’ আরবদের কথা শোনা তো বহু দূরের কথা। ধর্মকে নিয়ে চ্যালেঞ্জ করা, উপহাস করা হচ্ছে আসলে নিজেদের ভেতরের এই অহংকারকে ঢেকে রাখার একটি উপলক্ষ মাত্র। এদের ভেতরে ধর্মের প্রতি এক ধরনের গোপন বিতৃষ্ণা আছে। সেই বিতৃষ্ণাকে ঢেকে রাখার জন্য তারা নানা ধরনের আঁতেল অজুহাত দাঁড় কড়ায়।
দুনিয়ার হাজারো প্রলোভনকে উপেক্ষা করে, হাজারো অন্যায় করার সুযোগ পেয়েও তা ছেড়ে দিয়ে যারা ধর্মের আদেশ মেনে সততার সাথে জীবন পার করতে পারেন, তাদের চরিত্র ইস্পাত দৃঢ় হয়ে যায়। এরকম ইস্পাত দৃঢ় চরিত্রে অধিকারিরা কাজে-কর্মে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, আস্থাশীল হন। একজন সত্যিকারের মুসলিম একাউন্টেন্ট কোনোদিন বেশি টাকার ইনভয়েস করে তার ভাগ নেন না। একজন সত্যিকারের মুসলিম ডাক্তার কখনো বাড়তি জটিলতা তৈরি করে, বেশি টাকা নেওয়ার ধান্ধা বের করেন না। একজন সত্যিকারের মুসলিম চাকুরীজীবী কোনো একদিন অফিসে আধা ঘণ্টা পরে ঢুকলে, তারপর ছুটির পরে আধা ঘণ্টা বেশি কাজ করে পুষিয়ে না দিয়ে বের হয়ে যান না। তাদের ন্যায়বোধ তাদেরকে ছোটখাটো অন্যায় সুবিধা নেওয়া থেকেও আটকে দেয়। এটা কোনো সহজ অর্জন নয়। যারা এই অর্জন করতে পারেন, তারাই যথার্থ মুসলিম। তাদের জন্য বিরাট পুরস্কার রয়েছে।
তাই তুমি উপদেশ দিতে থাকো, এতে লাভ হোক আর না হোক।
অনেক সময় এই আয়াতের অনুবাদ করা হয়, “তাই তুমি উপদেশ দাও, যদি উপদেশ দিয়ে লাভ হয়।” এখন প্রশ্ন হলো, উপদেশ দিয়ে লাভ হবে, কি হবে না, এটা আমরা কীভাবে বুঝবো? বরং আমাদের উপর যদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় যে, উপদেশ দিয়ে লাভ না হলে আর দেওয়ারই দরকার নেই, তাহলে তো দেখা যাবে যে, যারা আমাদের কথা সহজে শোনে না, তাদেরকে আর উপদেশ দিচ্ছি না। বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, যেসব আত্মীয়ের সাথে ঝামেলা চলছে —সবার আগে তাদেরকে উপদেশ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি! কারণ আমাদের কাছে মনে হবে যে, তারা কি আর আমার কথা শুনবে নাকি? ফলাফল হবে, যাদেরকে সবার আগে উপদেশ দেওয়ার কথা, তাদেরকে না দিয়ে বরং আমরা বেশি করে বাইরের মানুষকে, ফেইসবুকে, ইউটিউবে গিয়ে উপদেশ দেওয়া শুরু করবো।
এখানে আল্লাহ تعالى আসলে বলেননি, “যদি লাভ হয় তাহলেই উপদেশ দাও, না হলে দিয়ো না”। আরবিতেإن “যদি অমুক হয় তাহলে করো, না হলে করো না” —এরকম ছাড়াও “যদি সম্ভাবনাও থাকে, তাহলেও করো” — এরকম বোঝাতেও ব্যবহার করা হয়। যেমন, কুরআনের অন্য জায়গায় আমরা দেখতে পাই—
فَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَن تَقْصُرُوا مِنَ الصَّلَاةِ إِنْ خِفْتُمْ
নামাজ সংক্ষিপ্ত করলে তোমাদের কোনো গুনাহ হবে না, যদি বিপদের ভয় পাও।
এমন নয় যে, মানুষকে বিপদের ভয় পেয়ে ভীত থাকতে হবে নামাজ সংক্ষিপ্ত করার জন্য। বিপদের সম্ভাবনা থাকলেও হবে।[১৯] একইভাবে—
وَإِن كُنتُمْ عَلَىٰ سَفَرٍ وَلَمْ تَجِدُوا كَاتِبًا فَرِهَانٌ مَّقْبُوضَةٌ
যদি সফরে থাকো এবং চুক্তিলেখক না-পাও, তাহলে হাতের কাছে বন্ধক রাখার মতো কিছু রাখতে হবে।
—এখানে চুক্তিলেখক পাওয়া গেলে আর বন্ধক রাখা যাবে না, ব্যাপারটা এমন নয়। পাওয়া গেলেও রাখা যাবে।[১৯]
অনেক সময় কোনো কথায় জোর দিতেও ‘যদি’ ব্যবহার করা হয়। যেমন, “তুমি যদি পুরুষ হও, তাহলে এটা করে দেখাও” —যাকে বলা হচ্ছে সে নিশ্চয়ই মহিলা নয়, সে একজন পুরুষই।[৪]
তাই আয়াতের ভাবার্থ আসলে হবে জোর দিয়ে বলা— “উপদেশ দাও, লাভ হোক আর না হোক। তোমার কাজ তুমি করো। যার শোনার সে শুনবে।”[৪][১৯]
ঘোরতর কাফিরদেরও উপদেশ দেব?
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, যারা ইসলাম বিদ্বেষী, দিন-রাত ইসলাম নিয়ে আজে বাজে কথা বলছে, লিখছে, এদেরকে উপদেশ দিয়ে লাভ কী? এরা তো মনস্থির করেই ফেলেছে যে, এরা কোনোদিন ইসলাম মানবে না? যারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, ঘোরতর কাফির, এদেরকে কেন আমরা ইসলামের দাওয়াত দিবো? কাফিরদের দেশের নেতাদেরকে আমরা কেন ইসলামের বাণী পৌঁছানোর চেষ্টা করবো? এদেরকে তো বরং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুন করে ফেলাই ভালো, তাই না?
উহুদের যুদ্ধে অমুসলিম পক্ষের প্রধান তিন সেনানায়ক ছিলেন আবু সুফিয়ান, খালিদ বিন আল-ওয়ালিদ এবং ইকরিমা বিন আবু জাহল। খালিদের সমর কুশলতায় মুসলিম শিবিরে সেদিন নেমে আসে মহা বিপর্যয়। গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, মুহাম্মাদ عليه السلام মারা গেছেন। এই গুজব পরবর্তীতে মিথ্যা প্রমাণিত হলেও প্রিয় নবীর দেহ সেদিন রক্তাক্ত হয়েছিল। সত্তরজন সাহাবী উহুদের ময়দানে শহীদ হয়েছিলেন।
কিন্তু আল্লাহর কী ইচ্ছা! তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া এই তিনজন কাফিরকেও আল্লাহ হিদায়াতের জন্য মনোনীত করে নিয়েছিলেন। এই ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর তাঁরা তিনজনই তাঁদের পূর্ব আদর্শ ত্যাগ করে একে একে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নবগঠিত ইসলামী সাম্রাজ্যের প্রাথমিক প্রসারের জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করে দেন।
ইকরিমা ইয়ারমুকের যুদ্ধে শহীদ হন। এই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার মাধ্যমেই বৃহত্তর সিরিয়া অঞ্চল মুসলিমদের দখলে আসে। খালিদ তখন রাসুলের কাছ থেকে ‘সাইফুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর তলোয়ার’ উপাধিপ্রাপ্ত হন। মুসলিমদের বৃহত্তর সিরিয়া ও পারস্য বিজয়ের পিছনে খালিদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, আবু সুফিয়ান তাঁর একটি চোখ হারান মুসলিম বাহিনীর হয়ে তায়েফ অবরোধের সময়ে। ইয়ারমুকের যুদ্ধে তিনি তাঁর দ্বিতীয় চোখটিও হারান।
আল্লাহর রাসুলের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার মতো দুঃসাহস দেখানো এই তিনজন ব্যক্তি যদি পরবর্তীতে নিবেদিত প্রাণ মুসলিম হয়ে থাকেন, তাহলে আজকের দিনের কট্টর কাফির ও ইসলামবিদ্বেষীদের মধ্যে কেউ কেউ কি আগামীতে নিবেদিত প্রাণ মুসলিম হয়ে যেতে পারেন না? হতেও তো পারে যে, এদের মধ্যেই লুকিয়ে আছেন আগামীর কোনো খালিদ, ইকরিমা বা আবু সুফিয়ান?
যার অন্তরে ভয় আছে সে ঠিকই তা গ্রহণ করবে। আর চরম হতভাগা তা পাশ কাটিয়ে যাবে। সে ভয়ংকর আগুনে পুড়বে। তারপর সেখানে সে না মরবে, না বাঁচবে।
এই আয়াতে আল্লাহ تعالى ভয়ের জন্য خشي (খাশিয়া) ব্যবহার করেছেন। কু’রআনে বিভিন্ন ধরনের ভয়ের জন্য বারোটি আলাদা শব্দ রয়েছে: خاف, خشي, خشع, اتقى, حذر, راع, اوجس, وجف, وجل, رهب, رعب, اشفق —যার মধ্যে এই আয়াতে বিশেষভাবে খাশিয়া ব্যবহার করা হয়েছে, যা একটি বিশেষ ধরনের ভয়— যখন আমরা কারো থেকে বা কোনো কিছু থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটার ভয়ে থাকি, মনের শান্তি হারিয়ে ফেলি, তখন তাকে খাশিয়া বলা হয়।[১৪]
এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বলছেন যে, উপদেশ তারাই শুনবে, যারা তাঁকে تعالى ভয় করে। আল্লাহকে تعالى ভয় করা আর অন্য কিছুকে ভয় পাওয়ার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যেমন, আমরা অনেকে মাকড়সা, তেলাপোকা, সাপ, বিছা ভয় পাই। সেটাও খাশিয়া। কিন্তু আল্লাহর تعالى প্রতি খাশিয়া অন্য ধরণের ভয়। আল্লাহ تعالى কত বড় একজন সত্তা। কী বিশাল তাঁর ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব। আমাদের মাথার উপরে বিশাল মহাবিশ্বে তাঁর দুর্দান্ত প্রতাপ। পায়ের নীচে পৃথিবী তাঁর নির্দেশে এক মুহূর্তের মধ্যে আমাদেরকে ধসিয়ে দিতে পারে। আমরা কী করি, তার সব তিনি تعالى দেখেন। কী বলি, তার সব শোনেন — এগুলো উপলব্ধি করে তাঁর মহত্বের প্রতি নত হয়ে, তাঁর প্রতি অবাধ্যতার পরিণাম কী ভয়ংকর হতে পারে —এই ভয়ে থাকাটাই হচ্ছে আল্লাহর تعالى প্রতি খাশিয়া।[৪]
কিন্তু যে মনে করে যে, তার উপরে কোনো সত্তা থাকতে পারে না, যার কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হবে, সে এই উপদেশ শুনবে না, বা শুনলেও পাশ কাটিয়ে যাবে। এরা হচ্ছে চরম হতভাগা। এদেরকে অনন্ত শাস্তি দেওয়া হবে। সেই ভয়ংকর শাস্তির মুখোমুখি হয়ে এরা বেঁচে থাকার চেয়ে বরং মরে যেতে চাইবে। কিন্তু মৃত্যুর শান্তিও তাদেরকে দেওয়া হবে না। এক নির্যাতন শেষ হতে না হতেই শুরু হবে আরেক নির্যাতন।
যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে, সে-ই তো সাফল্য লাভ করে। আর যে তার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করে নামাজ পড়ে।
যারা ধর্মের পথে ফিরে আসেন, তারা দেখেন যে, যেই কাজগুলো আগে তিনি অভ্যাসবশত প্রায়ই করতে, করে আনন্দ পেতেন, বা ‘লোকে কী বলবে’ এই ভয়ে করতেন, সেগুলো এখন আর করতে ভালো লাগে না। বরং মাঝে মাঝে তার মনে হয়, “এই কাজ কীভাবে আমি আগে করতাম? আমার কি বিবেক ছিল না? আমি এত খারাপ ছিলাম আগে?”
ইসলামের পথে ফিরে আসার পর অনেকেই উপলব্ধি করেন যে, আজকে আমজনতা যেসব অভ্যাস লালন করে, যে ধরনের বিনোদন হরহামেশা করে, যে ধরণের সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ করে, সেগুলো আসলে কতটা খারাপ। আল্লাহ تعالى যখন মানুষের অন্তরকে খুলে দেন, তখন সে পরিষ্কার চোখ দিয়ে তার চারপাশে তাকিয়ে দেখতে পায় যে, তার চারপাশটা আসলে কত নোংরা। সে বুঝতে পারে যে, আশেপাশের মানুষের চোখ ভীষণ ময়লা হয়ে গেছে। তারা যে কী নোংরা আবর্জনার মধ্যে ডুবে আছে, সেটা তারা দেখেও বুঝতেও পারছে না।
এরপরেও কিছু মানুষ আছেন যারা সমাজ, সংস্কৃতি, সম্মান, সম্পদ, ক্ষমতা, স্ট্যাটাস, ‘লোকে কী বলবে’ এসবের থেকে আল্লাহকে تعالى বেশি গুরুত্ব দিতে শিখেছেন। তাদের কথার ধরণ, পোশাকের ধরণ, বন্ধু-বান্ধবদের প্রকৃতি, ঘরের আসবাবপত্র, লাইব্রেরিতে সাজিয়ে রাখা বইগুলো, ফেইসবুকের স্ট্যাটাস, মোবাইল ফোনের অ্যাপসগুলো—এই সবকিছু দেখলে বোঝা যায় যে— এদের জীবনে কোনো একটা বিরাট উদ্দেশ্য আছে এবং এরা সেই ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস। এরা শপিং মলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেহুদা ঘুরে বেড়ান না, প্রতিদিন ফোনে দুই ঘণ্টা গল্প করেন না, দিনে তিনটা হিন্দি সিরিয়াল দেখেন না, ফেইসবুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন না, রাস্তা ঘাটে বসে পুরো সময়টা মোবাইল ফোনে গেম খেলেন না। এদের ভাবসাব পুরোই আলাদা। একদল মানুষ এদেরকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে, এদেরকে নানা ধরনের নাম দেয়: মোল্লা, নিনজা, তালেবান, হুজুর। কিন্তু এরা আসলে নিজেদেরকে চারপাশের ময়লা থেকে পরিশুদ্ধ করতে পেরেছেন। এরা তাদের রবের নাম স্মরণ করে একনিষ্ঠভাবে নামাজ পড়েন।
অথচ কিনা তোমরা দুনিয়ার জীবনকে এত গুরুত্ব দাও। যেখানে পরকাল বেশি ভালো এবং চিরস্থায়ী। আগের আসমানি গ্রন্থগুলোর মধ্যেও এই কথা অবশ্যই বলা ছিল। ইব্রাহিম এবং মুসা’র গ্রন্থে।
ইসলাম তাদেরই কাছে কঠিন মনে হয়, যাদের কাছে দুনিয়ার জীবনের সুখ-শান্তি, সম্মান, সম্পত্তি, ক্ষমতা পাওয়াটা পরকালে অনন্ত সুখে থাকার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। একজন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি যখন তার ভাড়া বাড়িতে থাকার অপমানের কষ্টে আফসোস করে, তখন তার সমস্যা ইসলাম নয়, তার সমস্যা দুনিয়ার জীবনকে আখিরাতের থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। একজন নিয়মিত রোজাদার যখন বিদেশ বেড়াতে যেতে না পেরে আফসোস করে, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের আনন্দ-ফুর্তি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তখন তার সমস্যা ইসলাম নয়, সমস্যা দুনিয়ার জীবনকে আখিরাতের থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। একজন ইসলামের পথে নিবেদিত বান্দা যখন নতুন মডেলের ফোন, গাড়ি, কম্পিউটার, হালের ফ্যাশনের জামা কাপড় কিনতে না পেরে মুখ শুকনো করে থাকে, তখন তার সমস্যা ইসলাম নয়, তার সমস্যা দুনিয়ার জীবনকে আখিরাতের থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া।
এমন নয় যে, এই সব কথা কুরআনেই প্রথম বলা হয়েছে। ইসলামের মূল বাণী সব যুগে, সব নবী-রাসুলের সময়ে একই ছিল। আল্লাহ تعالى মানুষকে মৌলিক কিছু জ্ঞান, নিয়ম-নীতি প্রথম থেকেই দিয়ে এসেছেন। শুধু যুগের পরিবর্তনে মানুষের জীবনযাত্রার জটিলতা, সভ্যতার বিকাশের কারণে নতুন নতুন যেসব সমস্যা তৈরি হয়েছে, সেগুলোর সমাধান নিয়ে আল্লাহ تعالى নতুন কিছু বাণী পাঠিয়েছেন। —এটাই শেষের আয়াতগুলোতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, মুহাম্মাদ (সা) এর উম্মতেকে আখিরাতের সফলতার জন্য কোনো নতুন পদ্ধতি শেখানো হয়নি। একই মূলনীতি ইব্রাহিম عليه السلام এবং মুসা عليه السلام এর গ্রন্থেও ছিল।
[১] বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর। [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ। [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি। [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী। [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি। [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী। [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ। [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ। [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস। [১৪] তাফসির আল কুরতুবি। [১৫] তাফসির আল জালালাইন। [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ। [১৭] তাফসীর আহসানুল বায়ান — ইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সউদি আরব [১৮] কু’রআনুল কারীম – বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর — বাদশাহ ফাহাদ কু’রআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স। [১৯] তাফসির আল-কাবির। [২০] তাফসির আল-কাশ্শাফ।
অনেকদিন পরে আবার কুরআনের কথায় নতুন একটা লেখা পেলাম, আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ সুবহানাওয়াতাআলা যেন আপনাকে আর কুরআনের কথা টিমের প্রত্যেক সদস্যের কাজগুলো কবুল করে নেন আর এর অনেক অনেকগুণ বেশি প্রতিদান দেন, এই দোয়া করি ওমর ভাই। সাথে এই প্রত্যাশাও করি, তিনি যেন পুরো কুরআনের ব্যাখ্যা লেখার তৌফিক আপনাদের দান করেন।
ভাই, কুরআনের কথা অ্যাপে এই লেখাটা আসছে না। আনইন্সটল করে ইন্সটল করার পরও না। কাইন্ডলি একটু চেক করে দেখবেন। সবসময় তো আর ওয়েবসাইটে ঢোকা হয় না, অ্যাপে নোটিফিকেশন না পেলে লেখা মিস হয়ে যায়।
জাযাকাল্লাহু খাইরান।
জাজাকাল্লাহ খায়ের ।
আমার মনে এই ভাবে একটা কোরআনের তাফসির লিখাটা জাতির জন্য ভালো হবে।
আল্লাহ্ লিখক এর জ্ঞান আরো বাড়িয়ে দিক।
তাকে উপকারি জ্ঞান দান করুক। আমিন।