তোমরা কী করে যাচ্ছ, সেটা আল্লাহর অজানা নয় — আল-বাক্বারাহ ৮৪-৮৬

এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে রাজনীতি কত নোংরা হতে পারে, তা শেখাবেন। মানুষ কীভাবে নিজের স্বার্থের কারণে নিজের ভাইকে খুন করতে পারে, নিজের ভাইকে ঘর থেকে বের করে দিতে পারে এবং দরকারের সময় রাতারাতি ভোল পাল্টে দুমুখো সাপ হয়ে যেতে পারে, তা এই আয়াত দ্বারা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আজকের মুসলিমরা যে সাচ্চা বনী ইসরাইল হয়ে গেছে, সেটা আপনি নিজেই দেখতে পাবেন—

মনে করে দেখ, যখন আমি তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম, “তোমরা তোমাদের রক্ত ঝরাবে না এবং নিজেরদেকে তোমাদের ঘর থেকে বের করে দিবে না।” তোমরাই তো  তখন কথা দিয়েছিলে, আর তোমরাই ছিলে তার সাক্ষী!  [আল-বাক্বারাহ ৮৪]

“তোমরা তোমাদের রক্ত ঝরাবে না” 

একজন মুসলিম যখন অন্য একজন মুসলিমের রক্ত ঝরায়, তখন সে প্রকৃতপক্ষে  নিজেরই রক্ত ঝরায়।  বাংলাদেশ, মিশরে মুসলিমদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সময় সেই আন্দোলনে আসা নিরীহ মুসলিমদের রক্ত যাদের হাতে লেগেছে, তাদেরকে আল্লাহ تعالى বলছেন, “তোমার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখ। এই রক্ত অন্য কোনো মানুষের রক্ত নয়, এটা তোমার নিজের রক্ত।” মুসলিম ভাই-বোনদের হত্যা করা মানে হচ্ছে ধীরে ধীরে নিজেকে মেরে ফেলা।[১] যাদের সাথে হাত মেলাবার জন্য একদল মুসলিম অন্য মুসলিমদেরকে হত্যা করছে, সেই কাফির শক্তিগুলো কি সেই হত্যাকারী মুসলিম দলকে কাজ শেষ হলে বিরাট পুরস্কার দিয়ে মাথায় তুলে রাখবে? বনী ইসরাইলের মতো চরম বোকামি মুসলিমরা কীভাবে হাজার বছর পরেও করে যাচ্ছে, যেখানে তাদের সামনে এত পরিষ্কার একটি কেস স্টাডি রয়েছে?

এই আয়াতটি একটি মানুষের নিজের জীবনের বেলায়ও প্রযোজ্য। এখানে আল্লাহ تعالى বলছেন, আমরা যেন নিজেদের রক্ত না ঝরাই, নিজেদেরকে কষ্ট না দেই,  আত্মহত্যার পথ বেছে না নেই। মানুষের দেহ একটি আমানত। আল্লাহ تعالى আমাদেরকে অসাধারণ ইঞ্জিনিয়ারিং করে তৈরি করা মানব দেহ দিয়েছেন, যেন আমরা তা ব্যবহার করে আল্লাহর تعالى আনুগত্য করি, মানুষের উপকার করি, পৃথিবীতে যার যতটুকু সামর্থ্য আছে তা দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করি। আমাদের জীবনটা যতই কঠিন হোক না কেন, আমাদেরকে ধৈর্য্য ধরে আল্লাহর تعالى দেওয়া পরীক্ষাগুলো পার করতে হবে, কারণ প্রতিটি মুহূর্ত ধৈর্য্য ধরার জন্য আল্লাহ تعالى আমাদেরকে পুরস্কার দেবেন। ধৈর্য্যের বিনিময়ে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে অনেক বড় বড় পুরস্কারের অঙ্গীকার দিয়েছেন। তাই আমাদের জীবনটা যখনই কঠিন হয়ে যাবে, আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, আমরা ধৈর্য্য ধরে যত কষ্ট সহ্য করছি, তত বেশি পুরস্কার অর্জন করছি।[১১]

“নিজেদেরকে তোমাদের ঘর থেকে বের করে দিবে না”

এখানে আল্লাহ تعالى এটা বলছেন না যে, আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেই। বরং তিনি تعالى বলছেন যে, আমরা যখন কোনো মুসলিমকে তার ঘর থেকে বের করে দেই, তার মানে হলো আমরা আসলে নিজেরাই নিজেদেরকে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেই। আমাদের কারণে যদি অন্য মুসলিমরা তাদের ঘর হারিয়ে ফেলে, আমরা প্রকৃতপক্ষে সেই ব্যবস্থাই  কায়েম করছি, যেন একসময় কাফিররা ধাক্কা দিয়ে আমাদেরকেই ঘর থেকে বের করে দিতে পারে।[১]

Syria-Child

ধর্ম মানুষের মাধ্যমে ছড়ায় এবং প্রতিষ্ঠিত হয়। মানুষ একসাথে হয়ে পরিবার, গোত্র এবং জাতি তৈরি করে। একটি জাতির শক্তি তার লোকবলের মধ্যে। যে জাতির মানুষের মাঝে যত সুন্দর পারস্পারিক  সম্পর্ক থাকে, সেই জাতির শক্তি তত বেশি হয়। একারণেই একটি জাতির টিকে থাকার জন্য সেই জাতির মানুষদের মাঝে সুন্দর সম্পর্ক, সহযোগিতার মনোভাব, এবং তাদের মধ্যে ন্যায়বিচার থাকাটা খুব প্রয়োজন। একটি জাতি যেন নিজেদের মধ্যে মারামারি না করে, একে অন্যকে কষ্ট না দেয়, একে অন্যের সাথে অন্যায় না করে। যদি একজনেরও কোনো ক্ষতি হয়, পুরো জাতি যেন তার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে। যখন এগুলো হয় না, সেই জাতির মধ্যে ভাঙ্গন শুরু হয়। একারণেই আল্লাহ تعالى বার বার আমাদেরকে কু’রআনে বলেছেন যেন, আমরা মুসলিম জাতি নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখি, একে অন্যের সাথে অন্যায় না করি, একে অন্যের বিপদে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে যাই।[১১]

আজকে অমুসলিমরা আল্লাহর تعالى দেওয়া পৃথিবীকে ‘দেশ’ নামের প্রায় ২০০টি ভাগে ভাগ করেছে। ‘জাতীয়তাবাদ’ নামে যে ধারণাটি আজকে প্রচলিত, সেটার সারমর্ম হলো— “একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিসীমার বাইরে আপনার-আমার কোনো মুসলিম ভাই যদি হত্যা হয়, কোনো বোনের যদি সম্ভ্রমহানি হয়, তাহলে সেটা আপনার-আমার কোনো মাথাব্যাথা না, সেটা সেই ‘দেশের’ মানুষদের দায়িত্ব।” অমুসলিমদের তৈরি এইসব কৃত্রিম সীমা এবং স্বার্থপর আদর্শের কারণে আজকে কেউ এসে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বললেও আমরা তাকে বলি, “তুমি এদেশের না। যাও, তোমার দেশে ফেরত চলে যাও।”

অথচ একজন মুসলিমের কখনই এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কথা নয়। এই পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে, যে কোনো দেশে, যে কোনো সমাজে একজন মুসলিম ভাইয়ের কষ্ট, একজন মুসলিম বোনের দুঃখের সাথে আমার পাশের বাড়ির মুসলিম ভাই-বোনের দুঃখ-কষ্টের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতে আল্লাহ تعالى বলেননি। তারা সবাই আপনার-আমার কাছে সমান দাবি রাখে। অথচ আজকে অমুসলিমরা এই সব ‘আমার দেশ, তোমার দেশ’, ‘জাতীয়তাবাদ’, ‘দেশপ্রেম’ কৃত্রিম ধারণাগুলো আমাদের মাথায় ছোটবেলা থেকে পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে ঢুকিয়ে দিয়ে পৃথিবীতে মুসলিম জাতিগুলোকে আলাদা করে ফেলেছে। তারা সুকৌশলে এমন ব্যবস্থা করে দিয়েছে, যেন আমরা একটা নির্দিষ্ট এলাকার (দেশের) বাইরের মুসলিমদের সমস্যাকে আর নিজেদের সমস্যা বলে মনে না করি। একটি উম্মাহ এবং একটি খিলাফা প্রতিষ্ঠা করা যেন মুসলিমদের জন্য অসম্ভব হয়ে যায়।

বার্মার অত্যাচারিত রোহিঙ্গা মুসলিমরা যখন বাড়িঘর, মান-সন্মান হারিয়ে, পাশবিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে নৌকায় করে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল একটু আশ্রয়ের জন্য, আমরা তখন তাদেরকে ‘বাংলাদেশের’ পাসপোর্ট ছিল না দেখে আবার সমুদ্রে ঠেলে দিয়েছিলাম। এটা যদি বনী ইসরাইলের মতো কাজ না হয়, তাহলে আর কী এটা?[১৭৪]

আল্লাহ تعالى আমাদের আগের প্রজন্মের মুসলিমদের: অর্থাৎ বনী ইসরাইলিদের বলেছিলেন, “তোমরা তোমাদের রক্ত ঝরাবে না এবং নিজেরদেরকে তোমাদের ঘর থেকে বের করে দিবে না।” — কিন্তু তারপর তারা কী করল?

অথচ দেখ, তোমরা একে অন্যকে হত্যা করছ, তোমাদের লোকদেরকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছ, তোমাদেরই লোকদের বিরুদ্ধে নিজেরা হাত মেলাচ্ছ পাপ এবং অন্যায় আগ্রাসনে। যখন তারাই তোমাদের কাছে যুদ্ধবন্দী হয়ে আসে, তোমরাই তাদের মুক্তিপণ দাও, যেখানে কিনা তাদেরকে তাড়িয়ে দেওয়ার কোনো অধিকার তোমাদের ছিল না। তার মানে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস করো, আর কিছু অংশ অবিশ্বাস করো? তোমরা যারা এরকম করো, তাদের প্রতিদান হবে এই দুনিয়াতে চরম অপমান-দুর্দশা, আর কিয়ামতের দিনে তাদেরকে সবচেয়ে কঠিন শাস্তির দিকে তাড়িয়ে নেওয়া হবে। তোমরা কী করে যাচ্ছ, সেটা আল্লাহর تعالى অজানা নয়। [আল -বাক্বারাহ ৮৫]

এই ধরনের আয়াতগুলো পড়ার সময় আমাদেরকে একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে যে, এই আয়াতগুলো আমাদের বেলায়ও প্রযোজ্য।[৯] শয়তান যেন আমাদেরকে এই ভেবে বোকা বানাতে না পারে যে, “এই আয়াতগুলো তো বনী ইসরাইলিদের জন্য, এখানে আমাদের জন্য কিছু করার নেই, আল্লাহ تعالى শুধুই আমাদেরকে ইতিহাস শেখাচ্ছেন।”[১১] কু’রআন কোনো ঐতিহাসিক বই নয় যে, আমাদের মনোরঞ্জন করার জন্য হাজার খানেক আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদের গল্প শোনান। বরং কু’রআন নাযিল করা হয়েছে আমাদেরকে পথ দেখানোর জন্য। এর প্রতিটি আয়াতে আমাদের জন্য কোনো না কোনো নির্দেশ, উপদেশ বা উপলব্ধির বিষয়  রয়েছে। আমাদেরকে প্রতিটা আয়াত পড়ার সময় নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে, “এই আয়াতে আল্লাহ আমাকে কী শেখাচ্ছেন? তিনি আমার কাছ থেকে কী পরিবর্তন আশা করেন? আমি এই আয়াত থেকে আমার নিজের সম্পর্কে নতুন কী উপলব্ধি করলাম?”

আজকে আমাদের চারপাশে এমন মুসলিমদের কি দেখতে পান, যারা এই অঙ্গীকারগুলো অহরহ ভাঙছে? হাজারো মুসলিম রয়েছে যারা তাদের দেহটাকে শেষ করছে সিগারেট, মদ, মাদক, অনৈতিক সম্পর্ক থেকে নানা ধরনের অসুখ বাঁধিয়ে। কত মুসলিম আছে যারা ফালতু কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে মানুষের হাসির খোরাক হচ্ছে। কত মুসলিম আছে যারা আল্লাহর تعالى দেওয়া এত মূল্যবান জীবনটা ভিডিও গেম খেলে, হিন্দি সিরিয়াল দেখে, শপিং মলে ঘুরে বেড়িয়ে শেষ করছে। আমরা মুসলিমরা যদি শীঘ্রই জেগে উঠে নিজেদের জীবনের মূল্য না দেই, এই অঙ্গীকারগুলো পূরণ না করি, তাহলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। জাতি হিসেবে আমরা মুসলিমরা এমনিতেই পর্যদুস্থ, অবহেলিত, অপমানিত। আমরা যদি আল্লাহর تعالى সাথে করা এই অঙ্গীকারগুলো পূরণ না করি, বনী ইসরাইলের মতো একসময় আমরাও ইতিহাস হয়ে যাব।

মুসলিমরা আজকে শুধু নিজেদেরকেই শেষ করছে না, বরং তারা অন্য মুসলিমদেরকেও হত্যা করছে। আজকে আমরা এর নিদর্শন দেখতে পাই ফিলিস্তিন, আফগানিস্থান, ইরাক, বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর আরও অনেক দেশে। আজকে মুসলিমদেরকে দেখা যায় অন্য মুসলিমদের ঘর থেকে তাড়িয়ে দিতে। যেমন দারফুর-এর ঘটনা, যেখানে সুদানের মুসলিম সরকার জঙ্গিদের ভাড়া করে আরব মুসলিমদের তোষামোদের জন্য আফ্রিকার কালো মুসলিমদের গনহত্যা, ধর্ষণ, ভিটেমাটি কেড়ে নিয়েছে।[১৭৫]

এই ধরনের মুসলিমদের কি জ্ঞানের অভাব যে, তারা বুঝতে পারছে না তারা কী করছে? পৃথিবীতে এমন কোনো মুসলিম আছে কি, যে পড়ালেখার অভাবে বুঝতে পারে না: নিরীহ মানুষকে হত্যা করা অপরাধ? কোনো মুসলিম আছে কি, যে ফিকহের জ্ঞানের অভাবে বুঝতে পারে না:  গরিব মানুষকে তার ভিটেমাটি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া অপরাধ? কোনো মুসলিম আছে কি, যে শারিয়াহ এর জ্ঞানের অভাবে বোঝে না: মদ, গাঁজা খেয়ে নিজের দেহটাকে নষ্ট করে, আত্মহত্যা করা অপরাধ?

এদের সমস্যা জ্ঞানের অভাব নয়। এদের সমস্যা তাদের দূষিত হৃদয়। এরা নিজেদেরকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এরা পৃথিবীতে আল্লাহর تعالى আনুগত্য করতে আসেনি। এরা এসেছে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো যা খুশি তাই করতে। নিজেদের চাওয়াগুলো যেভাবেই হোক, যে কোনো অন্যায় কাজ করেই হোক, জোর করে আদায় করে নিতে।

“তার মানে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস করো, আর কিছু অংশ অবিশ্বাস করো?”

এরকম মানুষ দেখেছেন কি, যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে গিয়ে পড়ে, কিন্তু ব্যাংকের একাউন্ট থেকে সুদ খায়, সুদের উপর লোন নিয়ে বাড়ি কেনে, কাউকে ভিক্ষা দেবার সময় বা মসজিদে দান করার সময় মানিব্যাগের সবচেয়ে ছোট যে নোটটা আছে সেটা খোঁজে? বা এরকম মানুষ কি দেখেছেন যে হাজ্জ করেছে, বিরাট দাড়ি রেখেছে, কিন্তু বাসায় তার স্ত্রী, সন্তানদের রুটিন করে পেটায়? অথবা টাখনুর উপর প্যান্ট পরে সালাত আদায় করতে করতে কপালে দাগ পড়ে গেছে এবং ২-৩ বার হাজ্জও করে এসেছেন, কিন্তু তার হাজ্জসহ সকল স্থাবর সম্পত্তি ঘুষের টাকায় করা!

আরেক ধরনের মানুষ আছে যারা ঠিকই নামায পড়ে, রোযা রাখে, যাকাত দেয়, কিন্তু ছেলেমেয়ের বিয়ে দেয় বিধর্মীদের বিয়েরীতি অনুসরণ করে গায়ে-হলুদ, বউ-ভাত, পান-চিনি করে। আরেক ধরনের মানুষ হলো যারা মাসজিদে বা ইসলামিক অনুষ্ঠানে যায় একদম মুসলিম পোশাক পড়ে, হিজাব করে, কিন্তু বন্ধু বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীর বাসায় বা বিয়ের অনুষ্ঠানে যায় উগ্র সাজসজ্জা করে। এরা ঠিক করেছে কু’রআনের যেই অংশগুলো তাদের জন্য মানা সহজ, সমাজের সাথে, সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে চলে —সেগুলো তারা অনুসরণ করবে। কিন্তু যেই কাজগুলো করতে কষ্ট হয়, যেগুলো করলে সমাজে নাক উঁচু করে চলা যায় না, সেগুলো তারা ছেড়ে দিবে।

আল্লাহ কু’রআনে খুব কঠিনভাবে সুদ, লটারি, জুয়া, মদ, অনৈতিক সম্পর্ক করতে মানা করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজকে মুসলিমদেরকে এগুলো অহরহ করতে দেখা যায়। একদিকে তারা কু’রআন পড়ে, নামায পড়ে, যাকাত দেয়, অন্যদিকে তারাই এই পাপগুলো একই সাথে চালিয়ে যায়। যেভাবে কিনা বনী ইসরাইল এবং পরে ইহুদিরা তাদের ধর্মকে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো মানত এবং খেয়াল খুশি মতো ছেড়ে দিত, ঠিক একই ভাবে আজকে মুসলিমরাও ইসলামকে তাদের খেয়াল খুশিমতো বাছবিচার করে মানা শুরু করেছে। এই ধরনের বনী ইসরাইল টাইপের মুসলিমদের জন্য আল্লাহর تعالى ভয়ঙ্কর সাবধান বাণী—

“তোমরা যারা এরকম করো, তাদের প্রতিদান হবে এই দুনিয়াতে চরম অপমান-দুর্দশা, আর কিয়ামতের দিনে তাদেরকে সবচেয়ে কঠিন শাস্তির দিকে তাড়িয়ে নেওয়া হবে।”

আজকে মুসলিম জাতির দিকে তাকালে কী দেখা যায়? এক দেশে তাদেরকে মেরে, কেটে, জ্বালিয়ে শেষ করে ফেলা হচ্ছে। আরেক দেশে তাদেরই মুসলিম ভাইয়েরা তাদেরকে ঘর থেকে বের করে দিচ্ছে। আরেক দেশে মুসলিমদেরকে তাদের পাশের দেশ লুটেপুটে খাচ্ছে। আরেক দেশের মুসলিমরা প্রায় প্রতিদিন সুসাইড বম্বিং করে অন্য মুসলিমদের মারছে। আরেক দেশের মুসলিমদেরকে কেউ দেখলে বলতে পারবে না, তারা মুসলিম না পাশ্চাত্যের কোনো অমুসলিম জাতি, যারা মদ, জুয়া, পরিবার ভাঙ্গন, যৌন অসুখের মহামারি —এমন কিছু বাকি নেই যাতে তারা ডুবে নেই। আজকে বেশিরভাগ মুসলিম জাতির চরম অপমান-দুর্দশার পেছনে কারণ কী?

কারণ খুব সহজ, এই মুসলিম জাতিগুলো কু’রআনের কিছু অংশ ধরে রেখেছে, বাকি অংশ ছেড়ে দিয়েছে। যেই অংশগুলো তাদের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যায়, পাশ্চাত্যের গোলামি, সূদ ভিত্তিক অর্থনীতি, আমোদ প্রমোদে গা ভাসিয়ে দেওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সমাজে সাম্য এবং নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করতে বলে, গরিব, এতিমদের হক আদায় করতে বলে—সেগুলো তারা সুকৌশলে ছেড়ে দিয়েছিল। তার পরিণাম হয়েছে ভয়ঙ্কর।

কেন মানুষ এমন করে? সেটা আল্লাহ تعالى এর পরের আয়াতে বলেছেন—

এই লোকগুলো আখিরাতের জীবনকে বেচে দিয়েছে দুনিয়ার জীবনকে পাওয়ার জন্য। তাই এদের শাস্তি একটুও কমানো হবে না, এরা কোনো সাহায্যও পাবে না। [আল-বাক্বারাহ ৮৬]

দুনিয়ার জীবন এদের কাছে সবকিছু। এখানে তারা কোনো ছাড় দেবে না। তারা যা চায় সেটা পাওয়ার জন্য দরকার হলে তারা তাদের মুসলিম ভাইবোনদের ঘর ছাড়া করবে, তাদেরকে খুন করবে। কু’রআনের কিছু অংশ ভালো লাগলে মানবে, বাকি অংশ ইচ্ছে মতো ছেড়ে দেবে। এরা নিজেদেরকে খুব বেশি ভালোবাসে। নিজেদের সব চাওয়া পাওয়া যেভাবেই হোক তারা আদায় করবেই।

কয়েক দিন পরে তারা মারা যাবে। তারপর তাদেরকে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। শাস্তির মাঝখানে গিয়ে তারা হাত জোড় করে কাঁদতে পারবে না, “আমাকে একটা মিনিট রেস্ট দেন, আপনার পায়ে পড়ি।” এদের সাগরেদরা, ভাড়া করা ‘সোনার ছেলেরা’, পয়সা খাওয়া উকিলরা, যাদেরকে তারা মোবাইলে ফোন করলেই দৌড়ে আসে, তারা কেউ এদেরকে একটুও সাহায্য করতে পারবে না।

Dubai

“তোমরা কী করে যাচ্ছ, সেটা আল্লাহর تعالى অজানা নয়”

আমরা অনেকে মনে করি: ইসলামের কিছু নিয়ম ছেড়ে দিলে কোনো সমস্যা নেই, আজকের যুগে সবকিছু মানা যায় না। ইসলামের অমুক নিয়মগুলো বেশি কঠিন, অমুক নিয়ম মানলে জীবন উপভোগ করা যায় না। —তাহলে আমাদেরকে মনে রাখতে হবে আল্লাহ تعالى এখানে কী বলেছেন — “তোমরা কী করে যাচ্ছ, সেটা আল্লাহর تعالى অজানা নয়।” আল্লাহকে تعالى বোকা বানানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। আমরা নিজেদেরকে যতই চালাক মনে করি, আমাদের মনের ভেতরে কী চলছে, সেটা আল্লাহ تعالى খুব ভালো করে জানেন। আমরা রাতের বেলা জেগে কম্পিউটারে বসে কী করি —সেটা আল্লাহর تعالى অজানা নয়। আমরা বন্ধু বান্ধবের সাথে পহেলা বৈশাখ, ডিজে পার্টিতে গিয়ে কী করি —সেটা আল্লাহর تعالى অজানা নয়। আমরা বড় কোনো কন্ট্রাক্ট পেলে কী পান করে সেলিব্রেট করি —সেটা আল্লাহর تعالى অজানা নয়। আমরা ফোনে সারাদিন খোশ গল্প করার সময় কার সম্পর্কে কী বলি —সেটা আল্লাহর تعالى অজানা নয়।

আমাদের প্রতিটা চিন্তা, কথা, কাজকে সিকিউরিটি ক্যামেরার থেকেও হাজার গুন বেশি অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে প্রতি মুহূর্তে সব এঙ্গেল থেকে রেকর্ড করা হচ্ছে। একদিন আমাদেরকে এগুলো সবকিছু থ্রিডি সিনেমার থেকে আরো ভালোভাবে দেখানো হবে। সেদিন আমাদের লজ্জায়, অপমানে মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করবে, কিন্তু কোনো লাভ হবে না।

আল্লাহ تعالى আমাদেরকে কথা দিয়েছেন, তিনি আমাদেরকে আমাদের সাধ্যের অতিরিক্ত কোনো বোঝা দেন না — لَا يُكَلِّفُ ٱللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا [আল-বাক্বারাহ ২:২৮৬]। আমাদের এটা ভালো করে উপলব্ধি করতে হবে যে, আল্লাহ تعالى আমাদেরকে যা কিছু করতে বলেন এবং যা কিছু করতে মানা করেন, তার সবকিছুই আমাদের সামর্থ্যের মধ্যে। আমরা যদি সত্যি সত্যি আল্লাহকে تعالى একমাত্র প্রভু এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্তা মেনে নেই, এবং তারপর সমাজ, সংস্কৃতি, ‘লোকে কী বলবে’ —এগুলোকে উপেক্ষা করি, তাহলে আমাদের জন্য ইসলাম মেনে চলাটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। আমাদের জন্য তখন কোনো কিছুই কঠিন, অসম্ভব মনে হবে না। যতদিন পর্যন্ত ইসলামের কোনো নিয়ম, কোনো উপদেশ শোনার সময় আমরা ভাববো, “কিন্তু এটা করলে পাশের বাড়ির ভাবি কী বলবে”, “ওটা না করলে অফিসের বস রাগ করবে”, “এটা না খেলে পার্টিতে বন্ধুদের মুখ দেখাব কী করে” —এইসব চিন্তা চলতে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত আমাদেরকে কাছে ইসলাম হবে একটা “জীবনকে খামোখা জটিল করার ব্যবস্থা।”

ইসলামের জন্য আমরা যেটুকুই চেষ্টা করব, যেটুকুই সময় দিবো নিজেকে পরিবর্তন করার জন্য —তার সবটুকু আল্লাহ লক্ষ্য করবেন। কোনো কিছুই তিনি ছেড়ে দেবেন না। ইসলামের পথে আমাদের এক পা, এক পা করে এগিয়ে যাওয়া, তারপর হোঁচট খাওয়া, আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ানো, মানুষের কটু কথা, বাঁধা সহ্য করে এগিয়ে যাওয়া —এগুলো সব কিছু আল্লাহ تعالى গভীর ভালবাসায় লক্ষ্য করেন এবং আমাদেরকে এই সবকিছুর জন্য কমপক্ষে ১০ গুন বেশি প্রতিদান সাথে সাথে লিখে দেন। আমাদেরকে সবসময় খুশি মনে এটা মনে রাখতে হবে যে —“তোমরা কী করো, সেটা আল্লাহর تعالى অজানা নয়।”

সূত্র:

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা বাকারাহ এর উপর লেকচার।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন — আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি।
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি।
  • [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
  • [১৭৪] রোহিঙ্গা মুসলিমদের তাড়িয়ে দেওয়া — http://www.alkawsar.com/article/717/print
  • [১৭৫] দারফুরের জঙ্গিদের স্বীকারোক্তি — http://bn.globalvoicesonline.org/2009/02/17/1621/?gv_hidebutton_used=header-banner&gv_hidebutton_expiration=30

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

One thought on “তোমরা কী করে যাচ্ছ, সেটা আল্লাহর অজানা নয় — আল-বাক্বারাহ ৮৪-৮৬”

  1. আল্লাহ্‌ আমাদের সবাইকে আমল করার তাওফিক দান করুন , আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *