মায়েরা তাদের বাচ্চাদের পুরো দুই বছর পর্যন্ত বুকের দুধ পান করাবে — আল-বাক্বারাহ ২৩৩

উনিশ শতকের পর থেকে সারা পৃথিবীতে বাচ্চাদের এক ভয়ঙ্কর সমস্যায় পড়তে হয়েছে: তাদের মায়েরা আর তাদেরকে ঠিকমতো বুকের দুধ খাওয়ায় না। মানবজাতির একদম শুরু থেকে লক্ষ বছর ধরে বাচ্চারা মায়ের বুকের দুধ খেয়ে বড় হয়েছে। ১৪০০ বছর আগে আল্লাহ تعالى কু’রআনে আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন পুরো দুই বছর পর্যন্ত বাচ্চাকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। কিন্তু আজকের ‘আধুনিক সমাজের’ বাচ্চারা আর মায়ের বুকের দুধ না খেয়ে, ‘টিনের দুধ’ নামের কেমিক্যালের মিশ্রণে তৈরি একধরনের সাদা গুড়া ওষুধ খেয়ে বড় হচ্ছে। এই সাদা গুড়া কেমিক্যাল মিশ্রণকে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে ‘ফর্মুলা’ বলা হয়, ‘দুধ’ বলা হয় না, কারণ এটি মায়ের দুধের ধারে কাছেও কিছু নয় এবং এতে কয়েকটি ক্ষতিকর ক্যামিকেল রয়েছে। কিন্তু অল্প শিক্ষিত দেশগুলোতে মার্কেটিং-এর জোরে একে মায়ের দুধের কাছাকাছি দুধ বলে সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করা হয়। মায়ের দেহে দুধ যেভাবে তৈরি হয়, তার ধারে কাছে প্রযুক্তি এখনো মানুষ অবিস্কার করেনি। অথচ সেই ১৮৬৫ সালে প্রথম ফর্মুলা আবিষ্কারের পর থেকে চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন ব্যবহার করে মানুষকে বোঝানো হয়েছে যে, টিনের গুড়া দুধ হচ্ছে মায়ের বুকের দুধের কাছাকাছি দুধ।[৩৭২] পানি মেশানোর পর সেটা দেখতে দুধের মতো হয় দেখে সরল মানুষরা বুঝতে পারে না যে, এটা গরুর দুধের প্রোটিন মেশানো একধরনের সাদা গুড়া ওষুধ ছাড়া আর কিছু নয়। উনিশ শতকে এই ফর্মুলা দুধের ব্যাপক প্রচলনের পর থেকে শুরু হয়েছে বিপুল পরিমাণে বাচ্চার মৃত্যু এবং অসুস্থ বাচ্চার সংখ্যা বৃদ্ধি।[৩৭২]

বাংলাদেশে খাবার পানির সঙ্গে ফরমালিন, কাটিং ওয়েল, পার অক্সাইড, খাইসোডা ও দুধের ননী মিশিয়ে নকল ভেজাল দুধ তৈরি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা আমাদেরকে বহুদিন থেকে ‘দুধ’ খাওয়াচ্ছে। আমরা সেটা ধরতে পারিনি। এই বিষ আমরা বছরের পর বছর খেয়েছি। খবরের কাগজে আসার পর আমরা এই ভয়াবহ ঘটনা জানতে পেরেছি।[৩৭১] একইভাবে বাচ্চাদের ফর্মুলা তৈরির কোম্পানিগুলো সফলভাবে আমাদেরকে শত বছর ধরে ঘোল খাইয়ে এসেছে যে, তাদের দুধে পুষ্টি বেশি, সেটি মায়ের দুধের বিকল্প, সেটা খেয়ে বাচ্চাদের কোনো ক্ষতি হয় না, বাচ্চার পুষ্টির ঘাটতি মেটায়, বুকের দুধের পাশাপাশি সেটা খাওয়ানো ভালো ইত্যাদি।

অতিরিক্ত প্রোটিন এবং ফ্যাট দেওয়া ‘দুধ’ নামের এই ওষুধ খেয়ে বাচ্চারা অল্প সময়ে মোটাসোটা, আকৃতিতে বড় হয় দেখে বাবা-মায়েরা ধরে নেয় যে, এই গুড়া ওষুধে নিশ্চয়ই মায়ের বুকের দুধের থেকে পুষ্টি বেশি। একারণে তারা বুকের দুধের পাশাপাশি বাচ্চাদেরকে ফর্মুলা খাওয়ায়, যেন বাচ্চার স্বাস্থ্য বেশি ভালো হয়। স্বল্প শিক্ষিত বাবা-মা’র কাছে বাচ্চা মোটাসোটা হওয়াটাই স্বাস্থ্যের লক্ষণ। তারা বিশ্বাস করে ফেলেছে যে, আল্লাহর تعالى ডিজাইন করা বুকের দুধের থেকে মানুষের আবিষ্কার করা কৃত্রিম দুধ বেশি উন্নত। অথচ খোদ আমেরিকাতেই বুকের দুধের পাশাপাশি ফর্মুলা খাওয়ানোর কারণে দ্বিগুণ বাচ্চার মৃত্যু হয়।[৩৬৯] গরিব দেশগুলোতে যেমন, ঘানা, ভারত, পেরুতে কর্মজীবী মায়েদের বুকের দুধ কম খাইয়ে ফর্মুলা খাওয়ানোর কারণে সাড়ে দশগুণ বেশি বাচ্চা মারা যায়।[৩৭০] এছাড়া ফর্মুলা খাওয়ানোর কারণে বাচ্চাদের প্রায় তিনগুণ বেশি ডাইরিয়া হয়, পঞ্চাশভাগ বেশি কানের ইনফেকশন হয়, ১৬.৭ গুণ বেশি ফুসফুসের ইনফেকশন, নিউমোনিয়া হয়, একজিমা, র‍্যাশ, এল্যারজি হয়, সারাজীবনের জন্য হজমে দুর্বলতা হয়, দেড়গুণ বেশি  টাইপ ১ এবং ২ ডায়াবেটিস হয়, প্রায় দ্বিগুণ বেশি এজমা হয়, প্রায় দেড় গুণ বেশি লিউকেমিয়া হয়, এবং প্রায় দ্বিগুণ বেশি বাচ্চা কোনো পূর্ব লক্ষণ ছাড়াই হঠাৎ করে মারা যায়।[৩৭৩][৩৭৪] এই ফর্মুলার ক্ষতির সাথে যোগ হয় কলের পানির মধ্যে থাকা মাত্রাতিরিক্ত ক্লোরিন এবং নানা পানি পরিষ্কারের ক্যামিকাল। সুয়ারেজের ময়লা মিশ্রিত পুকুর, নদীর ময়লা-বিষাক্ত পানি বিপুল পরিমাণের ক্যামিকাল দিয়ে পরিষ্কার করে কলে সরবরাহ করা হয়, যা ব্যবহার করে আমরা বাচ্চার ফর্মুলা দুধ তৈরি করি। এই ভয়ঙ্কর ক্যামিক্যালের সুপ খেয়ে আমাদের প্রজন্ম এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মে জটিল অসুস্থতা এবং মৃত্যুর হার আকাশ ছোঁয়া হয়ে গেছে। হাসপাতালগুলোতে গেলে দেখা যায় আজকে বাচ্চারা কী পরিমাণে অসুস্থ হচ্ছে। ডায়াবেটিস, এজমা, একজিমা, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, কানের ইনফেকশন আজকে ঘরে ঘরে।

2_233_title

আল্লাহ تعالى আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন দুই বছর পূর্ণ করে বাচ্চাকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। এটা বাচ্চার হক। অথচ আমরা অনেকে ছয় মাস হলেই শুধুই বুকের দুধ ছেড়ে ফর্মুলা খাওয়ানো শুরু করে দিয়েছি। পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতিতে মগজ ধোলাই হওয়া ক্যারিয়ার সচেতন মা তাদের বাচ্চাদেরকে শুধুমাত্র বুকের দুধ না খাইয়ে এই সাদা গুড়া ওষুধ খাইয়ে বড় করেন। অনেকে নিজের ফিগার ঠিক রাখার জন্য ফর্মুলা খাইয়ে বাচ্চার শরীর সারাজীবনের জন্য নষ্ট করে দেন। অন্যদিকে স্বল্প শিক্ষিত বাবা-মা বুকের দুধের পাশাপাশি  বাচ্চাকে ‘গরু মোটাতাজাকরন পদ্ধতির’ মতো ফর্মুলা খাইয়ে মোটা ফার্মের মুরগি বানান, যেন বাচ্চার স্বাস্থ্য নিয়ে মানুষের কাছে কথা শুনতে না হয়। আরেকটা বড় অন্যায় হলো: কোনো সমস্যা ছাড়াই নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে বাচ্চাকে স্বাভাবিকভাবে জন্ম হতে না দিয়ে, মায়ের কষ্ট কমানোর জন্য অযথা সিজারিয়ান করে অস্বাভাবিকভাবে বাচ্চা বের করা। এভাবে বের করা বাচ্চা জরায়ু পথে বের হওয়ার সময় মায়ের দেহের মাইক্রব নিয়ে বের হয় না, যার কারণে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে দুর্বল এবং বাচ্চা বড় হওয়ার সময় বিভিন্ন ইনফেকশন হয়।[৩৭৭] একবিংশ শতাব্দীতে আধুনিক যুগে এসেও আজকে আমরা অজ্ঞানতা, স্বার্থপরতার কী গভীর অন্ধকার গর্তে ডুবে আছি!  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)