তোমাদের ধর্ম তোমাদেরই থাকুক, আমার ধর্ম আমার — আল-কাফিরুন

বলো, “কাফিরেরা শোনো! তোমরা যা উপাসনা করো, আমি তা করি না। আর আমি যা উপাসনা করি, তোমরা তার উপাসক নও। তোমরা যা উপাসনা করছ, আমি কখনই তা করবো না। আর আমি যা উপাসনা করি, তোমরা তার উপাসক নও। তোমাদের ধর্ম তোমাদেরই থাকুক, আমার ধর্ম আমার।” [আল-কাফিরুন]

বলো, “কাফিরেরা শোনো! তোমরা যা উপাসনা করো, আমি তা করি না।”

তাহলে কি আমরা প্রতিবেশী হিন্দু, খ্রিস্টানদের দরজায় কড়া নেড়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বলবো, “হে কাফির, শুনেন। আপনি যা উপাসনা করেন, আমি তা করি না। আর আমি যা উপাসনা করি, আপনি তার উপাসক নন…?” — রাসুল عليه السلام কি এভাবে ইসলাম প্রচার করেছেন? বরং রাসুল عليه السلام কুর‘আনের নির্দেশ অনুসারে সুন্দর মার্জিতভাবে বিধর্মীদের ইসলামের পথে ডেকেছেন। তাহলে এই সূরাহ’য় তাকে এই কঠিন ভাষায় বিধর্মীদের সম্বোধন করতে বলা হলো কেন? একদিকে কুর‘আন বলে যে, তাকে সবার জন্য রহমত রূপে পাঠানো হয়েছে (২১:১০৭)। মানুষকে প্রজ্ঞার সাথে এবং মার্জিতভাবে ইসলামের পথে ডাকতে, সুন্দরভাবে তাদের সাথে যুক্তিতর্ক করতে (১৬:১২৫)। আবার এই সূরাহ’য় দেখা যাচ্ছে বিধর্মীদেরকে ‘কাফির’ ডেকে তাদেরকে কঠিন ভাষায় বুঝিয়ে দিতে তারা কী ভুল করছে —কীভাবে একই কুর‘আনে দুই জায়গায়, দুইভাবে বিধর্মীদের সাথে কথা বলার নির্দেশ থাকতে পারে? এটা কি স্ববিরোধী নয়?  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

ধর্ম মানতে কোনো ধরনের জোর জবরদস্তি নেই — আল-বাক্বারাহ ২৫৬

2_256

ধর্ম মানতে কোনো ধরনের জোর জবরদস্তি নেই। সঠিক পথ ভুল পথ থেকে পরিষ্কারভাবে আলাদা হয়ে গেছে। তাই যে তাগুত (মিথ্যা প্রভুদের) অস্বীকার করবে, এবং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস আনবে, সে অবশ্যই এমন এক মজবুত হাতল ধরবে, যা ভাঙ্গার কোনো আশঙ্কা নেই। আল্লাহ সব শোনেন, সব জানেন। [আল-বাক্বারাহ ২৫৬]

আল্লাহ تعالى এখানে কঠিনভাবে বলেছেন لَا إِكْرَاهَ, কোনো ধরনের জোর জবরদস্থি করা যাবে না। এই আয়াতে শব্দটা হচ্ছে إِكْرَاه, যার অর্থ কোনো একটা ব্যাপার কেউ ঘৃণা করে, এবং তাকে সেটাই জোর করে করানো।[১][৫] একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, কেন জোর জবস্থি করে ধর্ম মানানো সম্ভব না। ধর্ম মানুষের অন্তরের ব্যাপার। মানুষকে জোর করে কোনো কিছু বিশ্বাস করানো যায় না। কারো সামনে তলোয়ার ধরে বললাম, “তিন দিন সময় দিলাম। এর মধ্যে মুসলিম হয়ে যাও। নাইলে…” — তাহলে সে মনে প্রাণে ইসলামে বিশ্বাস করে, তার যাবতীয় ভুল বিশ্বাস ভেঙ্গে ফেলবে না। সে বড়জোর একজন মুনাফিক হয়ে যাবে। একইসাথে কাউকে গিয়ে হুমকি দিলাম, “যদি কালকে থেকে পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে না দেখি, তাহলে তোমাকে ধরে… ” — এই হুমকিতে সে হয়তো মসজিদে যাবে। কিন্তু সেটা আল্লাহর تعالى জন্য হবে না, হবে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে।

জোর করে ইসলাম গ্রহণ করানো ‘ইসলাম’ এবং ‘মুসলিম’ এই দুটো শব্দের সংজ্ঞারই পরিপন্থী। ‘মুসলিম’ শব্দের অর্থ: যে নিজের ইচ্ছাকে আল্লাহর تعالى ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করেছে। কাউকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার ইচ্ছাকে আল্লাহর تعالى কাছে সমর্পণ করানো যায় না —এটা স্ববিরোধী, অযৌক্তিক কথা। আরও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, আল্লাহ تعالى এই আয়াতে বলেননি যে, ইসলামে কোনো জোর জবস্থি নেই। বরং তিনি বলেছে,ধর্মে কোনো জরজবরদস্থি নেই। তাই অন্য ধর্মের লোকেরা যেন তাদের ধ্যান, ধারণা, বিশ্বাস, সংস্কৃতি জোর করে মুসলিমদের উপর চাপিয়ে না দেয়। তারা যেন মুসলিমদের শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম প্রচারে বাঁধা না দেয়। যদি দেয়, সেটা ফিতনা হবে, এবং সেই ফিতনা দূর করতে মুসলিমরা সংগ্রাম করতে পারবে।[১১]  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)

পুরো মানবজাতি একসময় এক ধর্ম অনুসরণ করতো — আল-বাক্বারাহ ২১৩

বিংশ শতাব্দীতে একদল প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং ইতিহাসবিদদের ব্যাপক অপপ্রচারনায় বিবর্তনবাদের মতোই বিতর্কিত একটি ধারণাকে সত্য বলে প্রচার করা হয়েছে। ধারণাটি হলো: মানবজাতি শুরু থেকেই নানা প্রাকৃতিক শক্তিকে পূজা করতো, মূর্তি পূজা করতো। একাধিক ঈশ্বরে বিশ্বাস ছিল মানুষের স্বাভাবিক বিশ্বাস। এক ঈশ্বরে বিশ্বাস ধর্মের বিবর্তনের মাধ্যমে পরে উদ্ভব হয়। অথচ Sir Charles Marston, যিত্নি একজন বিশ্বখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ, তার বইয়ে প্রমাণ দেখিয়েছেন যে, মানবজাতির প্রথম ধর্ম ছিল এক ঈশ্বরে বিশ্বাস বা এর খুব কাছাকাছি একটি বিশ্বাস।[১০] Dr. Stephen Langdon, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর, সুমেরীয় এলাকা Kish খোঁড়াখুঁড়ির পর প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করে এই উপসংহারে পৌঁছেন যে, মানবজাতির ইতিহাস হচ্ছে এক ঈশ্বরবাদ থেকে বিকৃত হতে হতে চরম পর্যায়ের বহু ঈশ্বরবাদ এবং নানা ধরনের অশুভ শক্তিতে বিশ্বাস। একইসাথে তারা সবাই মৃত্যুর পরে অনন্ত জীবনে বিশ্বাস করতো। তার বই Semitic Religion-এ তিনি দেখান যে, প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতা সম্পর্কে ব্যাপক অপপ্রচারনা চালানো হলেও, তিনি সকল প্রমাণ দেখে নিশ্চিত যে, সুমেরীয় এবং সেমিটিক সভ্যতাগুলো একসময় এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করতো, তারপরে তারা বহু ঈশ্বরবাদে ডুবে যায়।[১০]  

2_213_title

2_213

পুরো মানবজাতি একসময় এক ধর্ম অনুসরণ করতো। তারপর আল্লাহ تعالى নবীদের পাঠালেন যারা সুসংবাদ দেন এবং সাবধান করেন। তাদের মাধ্যমে কিতাব পাঠালেন, অকাট্য সত্য দিয়ে, যেন তারা মানুষের মাঝে মতভেদের মীমাংসা করতে পারেন। অথচ যাদেরকে পরিষ্কার প্রমাণ দেওয়া হয়েছিল, শুধু তারাই অন্যকে দমিয়ে রাখার মনোভাবের কারণে তা নিয়ে মতভেদে জড়িয়ে পড়ে। তারপরে আল্লাহ تعالى বিশ্বাসীদেরকে সঠিক পথ দেখান, সে সব ব্যাপারে, যা নিয়ে তারা মতভেদ তৈরি করেছিল। আল্লাহ تعالى যাকে চান, তাকেই পথ দেখান। [আল-বাক্বারাহ ২১৩]

আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, হিন্দু, খ্রিস্টান, ইহুদি, নাস্তিক — এরা হচ্ছে একই আদমের تعالى বংশধর, আমাদের দূর সম্পর্কের ভাই-বোন। একদল প্রতারকের পাল্লায় পড়ে এদের অনেকে ভুল পথে চলে গেছে, যা তারা বুঝতে পারছে না। আমাদের কাজ হচ্ছে তাদেরকে সঠিক পথের দিকে ডাকা। এদের মধ্যে অনেকেই আছে, যারা কখনোই আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না, উল্টো আমাদেরকে আক্রমণ করবে, প্রতিনিয়ত আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে। এরা কখনোই চায় না ইসলামের প্রসার হোক। এরা কাফির, এদেরকে আমরা ঘৃণা করি এবং এদের থেকে আমরা নিজেদেরকে সাবধান রাখবো, প্রয়োজনে এদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবো।

কিন্তু এদের মধ্যে অনেকেই আছে, যাদেরকে ইসলাম সুন্দর করে বুঝিয়ে একটু সময় দিলেই হবে, তারা মুসলিম হয়ে যাবে। তারা কাফির নয়, তারা শুধুই অমুসলিম বা আহ্লুল ফাতরাহ, ভবিষ্যতের সম্ভাব্য মুসলিম।[৩৪৫] এদেরই কেউ হয়ে যাবে অনেক বড় আলেম, যাদের কাছে গিয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা—জন্মগত মুসলিমরাই—ইসলামের শিক্ষা নেবো। এরকম বহু উদাহরণ আমাদের চোখের সামনেই রয়েছে। বহু ইসলামিক স্কলার আগে অমুসলিম, এমনকি ইসলাম বিরোধীও ছিলেন। তারপরে তারা ইসলাম খুঁজে পেয়ে মুসলিম হয়ে, তাদের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন ইসলামের কাজে। তাই আমাদের কাজ হচ্ছে এই সব অহিংস অমুসলিমদেরকে একই আদমের সন্তান মনে করে, আন্তরিকতার সাথে সত্যের প্রতি আহ্বান জানানো।  (আর্টিকেলের বাকিটুকু পড়ুন)