আল্লাহই কিয়ামতের দিন তাদের মধ্যে এই মতবিরোধের বিচার করবেন — আল-বাক্বারাহ ১১৩

“না ভাই, আপনি ভুল জানেন। ইসলাম মোটেও এটা সমর্থন করে না। আপনাদের আক্বিদায় গণ্ডগোল আছে।”

– “না জেনে বোকার মত কথা বলবেন না। আমার হুজুর আমাকে দলিল দিয়ে দেখিয়েছেন। আপনাদের আক্বিদা ভুল। যত সব সালাফি বাতিল ফিরকার দল।”

“মুখ সামলে কথা বলবেন। আমার শেখ মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা। আপনারা কোথাকার কোন মাদ্রাসার পণ্ডিতের কাছ থেকে মান্ধাত্না আমলের খারেজি নিয়ম কানুন শেখেন।”

– “কত বড় সাহস! আমার হুজুরকে গালি দাও! তোমাদের সেই শেখ বাইরে থেকে শিখে এসে আমাদের পীর জমানার হাজার বছরের জ্ঞান ছাড়িয়ে গেছে? আজকে মাগরিবে মসজিদে আসো। বড় হুজুর থাকবেন, আমরা সবাই থাকবো। দেখা যাবে কে ঠিক।”

মুসলিমদের মধ্যে এধরনের তর্ক এতটাই জঘন্য ব্যাপার যে, এরকম একটি ঘটনার উদাহরণ আল্লাহ تعالى কু’রআনেই দিয়ে দিয়েছেন, আমাদেরকে সাবধান করার জন্য, যেন আমরা ইহুদি, খ্রিস্টানদের অনুকরণ না করি—

2_113

ইহুদিরা বলে, “খ্রিস্টানদের কোনো ভিত্তি নেই”; খ্রিস্টানরা বলে, “ইহুদিদের কোনো ভিত্তি নেই”; যদিও তারা দুই পক্ষই কিতাব পড়ে। একইভাবে যাদের কোনো জ্ঞান নেই (আরব মুশরিকরা), তারাও একই কথা বলে। আল্লাহ تعالى কিয়ামতের দিন তাদের মধ্যে এই মতবিরোধের বিচার করবেন। [আল-বাক্বারাহ ১১৩]

jerusalem

খ্রিস্টানদের কোনো ভিত্তি নেই

ইহুদিরা ঈসাকে عليه السلام মসিহ হিসেবে মানে না। তাদের দাবি হচ্ছে ঈসা عليه السلام যদি সত্যিই মসিহ হতেন, তাহলে তিনি মসিহ-এর যে বর্ণনা বাইবেলে দেওয়া আছে, তার সবগুলো করে যেতেন। যেমন, সমস্ত ইহুদিদেরকে একত্র করে ইসরাইলে বসবাস করার ব্যবস্থা করে দেওয়া [Isaiah 43:5-6], সারা পৃথিবীতে ইহুদি ধর্মের স্রস্টার শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেওয়া [Zechariah 14:9], একটি শান্তির যুগের সূচনা করা: যেখানে কোনও যুদ্ধ, মারামারি, ভেদাভেদ থাকবে না [Isaiah 2:4]। যেহেতু ঈসা عليه السلام এগুলোর কিছুই করেননি, তাই তিনি মসিহ নন, তাকে মানার কোনও কারণ নেই। খ্রিস্টান ধর্মের তাই কোনও ভিত্তি নেই[২৪৭] যিশুকে ঈশ্বরের সন্তান দাবি করা, ঈশ্বরের তিন রূপের একটি মনে করা —ইহুদি ধর্মের স্রস্টার একত্ববাদের শিক্ষার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে যায়, ঠিক যেরকম তা ইসলাম ধর্মের তাওহীদের শিক্ষার বিরুদ্ধে যায়। তাই তাদের কাছে খ্রিস্টান ধর্মের কোনও গ্রহণযোগ্যতা নেই[২৪৭]

শুধু তাই না, তারা নানা ভাবে তাওরাতের বাণীর অর্থ পরিবর্তন করে বের করেছে যে, ঈসা عليه السلام নবীর মা মারিয়ম عليه السلام কুমারী ছিলেন না, বাইবেলে ‘আল্মাহ’ শব্দটার অর্থ অল্প বয়স্কা মেয়ে, কুমারী নয়। একইভাবে তারা মনে করে: তাদের ধর্ম একমাত্র সঠিক ধর্ম, কারণ অন্য সব ধর্মের মত কোনও একজন নবীর কথায় তাদেরকে বিশ্বাস করতে হয় না; আল্লাহ تعالى তুর পর্বতে বনি ইসরাইলের সত্তুর জন প্রতিনিধির সামনে তাওরাতের শিক্ষা প্রকাশ করেছেন, তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন। বনি ইসরাইল নিজেদের কানে আল্লাহর تعالى কথা শুনেছে। তাদেরকে কোনও একজন মানুষ নবীর কথার উপর বিশ্বাস করতে হয়নি। সুতরাং ইহুদি ধর্মের সত্যতা অন্য যে কোনও ধর্ম থেকে বেশি হতে বাধ্য[২৪৭]

ইহুদিদের কোনও ভিত্তি নেই

খ্রিস্টানদের দাবি হচ্ছে: তাওরাতে লেখা আছে মুসা عليه السلام নবীর মত আরেকজন নবী আসবেন, যিনি ইহুদিদের মাঝে ধর্ম প্রচার করবেন, ইহুদিদের মুক্তি দেবেন। একইভাবে তাওরাতেই বলা আছে যে, তাওরাত একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রযোজ্য, পরবর্তীতে আরেকজন নবী এসে সেই যুগের জন্য প্রযোজ্য বাণী পৌঁছে দেবেন। সুতরাং তাওরাত আর মানার কোনও প্রয়োজন নেই, গস্পেল মানতে হবে। ঈসা عليه السلام নবীকে গ্রহণ করে, তার শিক্ষা অনুসরণ করতে হবে[২৪৮]

তাছাড়া ইহুদিরা মুসা عليه السلام নবীর মৃত্যুর পর থেকেই তাদের রাবাইদের প্রচার করা শিক্ষাকে তাদের ধর্ম বানিয়ে ফেলেছে। তাদের রাবাইদের রচনা করা ‘তালমুদ’ হচ্ছে এখন তাদের মুল ধর্ম গ্রন্থ, যা অনেক ক্ষেত্রেই তাওরাতের নির্দেশের বিরুদ্ধে যায়। অনেকটা মুসলিমদের কু’রআন বাদ দিয়ে শুধুমাত্র হাদিস অনুসরণ করে চলার মত ব্যাপার, তাও আবার এমন সব হাদিস, যা কু’রআনের বিরুদ্ধে যায়। একারণে খ্রিস্টানদের দাবি হচ্ছে তালমুদ ভিত্তিক ইহুদি ধর্মের কোনও ভিত্তি নেই, কোনও গ্রহণযোগ্যতাও নেই। একদিকে ইহুদিরা দাবি করছে তারা মুসা عليه السلام নবীর অনুসারী, আবার অন্যদিকে তারা তাওরাতের শিক্ষা বাদ দিয়ে তালমুদ অনুসরণ করছে। এটা কোনোভাবেই ঠিক হতে পারে না[২৪৮]

কেন মানুষ ধর্ম নিয়ে তর্ক করে?

কেউ এটা মানতে চায় না যে, সে বছরের পর বছর, এমনকি সারাজীবন ভুল পথে ছিল। একারণে সে যেভাবেই হোক চেষ্টা করবে: সে সারাজীবন যা জেনে এবং মেনে এসেছে, সেটাকে সত্য প্রমাণ করার এবং অন্য সব ধারণাকে ভুল প্রমাণ করার, যা তার ধারণার সাথে মিলে না। কেউ যদি মেনে নেয় যে, অন্য কেউ ধর্মের ব্যাপারে তার থেকে বেশি ঠিক, তার মানে হলো এটাই স্বীকার করা যে, সে নিজে সারাজীবন ভুল ধারণা নিয়ে ছিল। তার এত বছরের কষ্টের উপাসনা হয়ত বিফলে গেছে। এটা মেনে নেওয়াটা যে কারো জন্য কঠিন ব্যাপার। হাজার হলেও মানুষকে সৃষ্টিই করা হয়েছে ইগো দিয়ে।

সাইকোলজির ভাষায় এটা হচ্ছে এক ধরনের ‘কনফারমেশন বায়াস’[১৭০] মানুষের ভেতরে একধরনের ঝোঁক বা প্রবণতা থাকে: সে যা বিশ্বাস করে সেটাকে সঠিক হিসেবে প্রমাণ করার। তার কাছে যখন কোনো তথ্য বা প্রমাণ আসে, সে সেটাকে এমনভাবে বুঝে নেয়, যা তার আগে থেকে ধরে রাখা বিশ্বাসকে সমর্থন করে। এমনকি তার কাছে যদি অপ্রাসঙ্গিক কোনো তথ্যও আসে, সে সেটাকে এমনভাবে গ্রহণ করে, যেন সেটা তারই বিশ্বাসকে সমর্থন করছে। তার বিশ্বাসের পক্ষের যুক্তিগুলো সে খুব ভালো করে শোনে, খুব ভালো করে মনে রাখে। কিন্তু তার বিশ্বাসের বিরুদ্ধের যুক্তিগুলো তার এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যায়। তখন তাকে তার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কিছু বললেও কোনো লাভ হয় না। সে ঘুরে ফিরে বিভিন্নভাবে নিজেকে নানাভাবে বোঝাতে থাকে, যেন সে তার বিশ্বাসে অটুট থাকতে পারে। এই কনফারমেশন বায়াস সবার ভেতরেই কম বেশি আছে। অল্প পরিমাণ কনফারমেশন বায়াস মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কিন্তু খুব বেশি করফারমেশন বায়াস নানা ধরনের মানসিক সমস্যার পূর্ব লক্ষণ।

মানুষ কেন সবসময় তার নিজের ধর্ম-মাযহাব-মতবাদকে সবসময় সঠিক এবং অন্যকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করে, তা বোঝার জন্য প্রথমে বোঝা দরকার সে কীভাবে চিন্তা করে। যখন  মানুষ তার বিশ্বাসকে জাহির করার জন্য তর্ক করে, তখন সে আসলে এভাবে চিন্তা করে—

১) আমি সঠিকভাবে স্রস্টাকে বুঝেছি এবং স্রস্টার উপাসনা করছি।
২) তুমি আমার মত করে স্রস্টাকে বোঝো না, বা তাঁর উপাসনা করো না। তাই তোমার ধারণা ভুল, কারণ তুমি এবং আমি একই সাথে সঠিক হতে পারি না। যেহেতু আমি সঠিক, স্বাভাবিকভাবেই তুমি ভুল।
৩) যেহেতু তোমার ধারণা ভুল, তাই তুমি নিশ্চিত ভাবে চিরজীবনের জন্য নরকে যাচ্ছ। সেজন্য আমাকে চেষ্টা করতে হবে তোমাকে নরকে যাওয়া থেকে বাঁচানোর।
৪) যদি আমি তোমাকে আমার সঠিক পথে আনতে না পারি, তাহলে তুমি অন্যদেরকে তোমার ভুল পথে নিয়ে যাবে। আমি অন্যদেরকে নরকে যেতে দিতে পারি না। তাই আমি অবশ্যই চেষ্টা করবো তোমাকে যেভাবেই হোক থামানোর।

আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে: ঠিকই তো, মানুষ তো তার ধর্মের ব্যাপারে সিরিয়াস হলে এভাবেই ভাববে। এখানে সমস্যাটা কোথায়?

এখানে তিনটি সমস্যা: ১) ঔদ্ধত্য: যখন কেউ মনে করে যে, সে যে শিক্ষা পেয়েছে সেটাই একমাত্র সঠিক শিক্ষা এবং অন্যদের শিক্ষা ভুল, তখন সে নিজেকে ভুলের ঊর্ধ্বে মনে করে। তখন তার ভেতরে এমন এক ঔদ্ধত্য তৈরি হয়, যার উৎপত্তি একদম মানুষ সৃষ্টির শুরুর সময়কার, যার উদাহরণ কু’রআনেই দেওয়া আছে — ইবলিস। ইবলিস মনে করত সে সঠিক, আদমের عليه السلام সামনে নত না হয়ে সে ঠিক কাজ করেছে। সে নিজেকে এমন দৃঢ়ভাবে সঠিক মনে করত যে, সে আল্লাহকে تعالى যুক্তি দিয়ে বোঝাচ্ছিল: সে যা করেছে সেটা ঠিক, বরং আদমের সামনে তাকে নত হতে বলে আল্লাহ تعالى কোনও একটা ভুল করে ফেলেছেন! শুধু তাই না, আল্লাহ تعالى যখন তাকে বের করে দিচ্ছিলেন, তখনও সে বলছিল যে, যেহেতু আল্লাহই تعالى তাকে বিপথগামী করেছেন, তাই সে সারাজীবন মানুষের ক্ষতি করে আল্লাহকে تعالى দেখাবে যে, মানুষকে এত বড় সন্মান দেওয়াটা ঠিক হয়নি। নিজেকে সবসময় সঠিক এবং অন্যকে ভুল মনে করার এর থেকে বড় উদাহরণ আর হতে পারে না। এই ধরনের মানসিকতা নিয়ে আমরা ইবলিসেরই জয়গান গেয়ে যাচ্ছি।

২) মনে করা যে, আমি কারো জাহান্নামে যাওয়া আটকাতে পারবো, বা কাউকে আমি জান্নাতের সন্ধান দিতে পারবো। আমরা ভুলে যাই যে, কেউ মুসলিম হবে কি, হবে না, বা আমি যে পথকে সঠিক পথ মনে করি, সেই পথে কেউ আসবে কি, আসবে না, সেটা সম্পূর্ণ আল্লাহর تعالى হাতে। আল্লাহ تعالى মানুষের অন্তর পরিবর্তন করেন, আমরা করি না। আমাদের কাজ শুধুই সত্য বাণী পৌঁছে দেওয়া, যেই বাণী আমরা আমাদের সীমিত জ্ঞান অনুসারে, মনে-প্রাণে, নিরপেক্ষভাবে সঠিক মনে করি। ফলাফল আল্লাহর تعالى হাতে।

৩) সঠিক পথ একটাই: অনেকেই এই ভুল ধারণা নিয়ে থাকেন যে, আল্লাহকে تعالى সঠিক ভাবে ইবাদত করতে হলে কোনও এক বিশেষ গোত্রের কিছু বিশেষ নিয়ম অনুসরণ করতে হবে, এবং তা থেকে কোনও ধরনের বিচ্যুতি ঘটলে তা আর গ্রহণযোগ্য হবে না, এবং যে তা করবে, সে জাহান্নামি হয়ে যাবে। সিরাতুল মুস্তাকিম এবং ৭৩ দলের হাদিসের ভুল অর্থ এবং ব্যাখ্যার কারণ[২৪৯] মানুষের মধ্যে এই চরমপন্থি ভুল ধারণাগুলো চলে এসেছে যে, আমার মাযহাব একমাত্র ঠিক, বাকি সব মাযহাব ভুল। বা আমার মতবাদ একমাত্র সঠিক এবং বাকি সব মতবাদের অনুসারীরা জাহান্নামে যাবে। বা আমার ধর্ম যারা অনুসরণ করে না, তারা সবাই জাহান্নামি। এই ধারণাগুলো যে ভুল, তার জন্য আমরা তিন ধরনের মানুষের উদাহরণ নিয়ে চিন্তা করি—
ক) চৌধুরী সাহেব নিজের ধারণার ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত এবং সন্তুষ্ট একজন মুসলিম। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথাসম্ভব ঠিক ভাবে আদায় করেন, দিনরাত ঘুরে বেড়ান ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য। কিন্তু কিয়ামতের দিন দেখা গেল: যেহেতু তিনি জন্মসূত্রে মুসলিম ছিলেন, ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছেন ইসলামের শিক্ষা নিয়ে, তাই তার জন্য বেশ কিছু কাজ বাধ্যতামূলক ছিল। যেমন, তার গরিব প্রতিবেশীদের খাওয়ানো, গরিব আত্মীয়দের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, তার ছেলে-মেয়েদের ইসলামের শিক্ষা দেওয়া, তার স্ত্রীকে হিজাব পড়তে অনুপ্রাণিত করা, তার অসুস্থ বাবা-মার চিকিৎসা করানো ইত্যাদি। কিন্তু এই সব দায়িত্ব তিনি পালন করেননি, বরং মসজিদ এবং দাওয়াহ’র কাজ নিয়ে তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন। যার ফলে কিয়ামতের দিন তার হিসাব হয়ে গেল ভয়ঙ্কর কঠিন।
খ) জেমস একজন আমেরিকার গ্রামের কৃষক। সে প্রতিদিন মাঠে কাজ করে, সপ্তাহে একদিন রবিবার চার্চে গিয়ে পাদ্রির কাছে যিশুর জয়গান এবং ইসলামের গুষ্ঠি উদ্ধার শুনে আসে। তার জীবনটা একেবারেই সাদামাটা — দিনে ক্ষেতের কাজ, রাতে পরিবারের দেখাশুনা, অসুস্থ বাবা-মার সেবা, ঈশ্বরকে খুশি করার জন্য এলাকার বৃদ্ধাশ্রমে নিয়মিত সবজি দান করা, চার্চের গরিবের ফান্ডে নিয়মিত অর্থ দান, মাসে একদিন রাস্তা বানানো, স্কুল মেরামত, হাসপাতালের কাজে সহযোগিতা করা। শেষ বয়সে গিয়ে লাইব্রেরিতে বসে একদিন ইসলামের উপর একটা বই পড়তে গিয়ে সে বিরাট ধাক্কা গেল। তারা সারাজীবনের ধ্যান ধারণা পাল্টে গেল। একদিন সে পাশের শহরের মসজিদে গিয়ে ইমামের কাছে শাহাদাহ নিয়ে মুসলিম হয়ে গেল। তার বছর খানেক পর সে মারা গেল। কিয়ামতের দিন তার জীবনে করা হাসানাহ অর্থাৎ ভালো কাজের পরিমাণ অনেক বেশি হওয়ায়, এবং শেষ বয়সে মুসলিম হয়ে আগের জীবনের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাওয়ায়, তার পুরস্কার সে আল্লাহর تعالى কাছে পেয়ে গেল।
গ) গুংলু চুঙা আফ্রিকার এক আদি বাসি। তার গোত্রের লোকেরা কখনো ইসলাম, খ্রিস্টান, ইহুদি এধরনের কোনও ধর্মের সংস্পর্শে আসেনি। তারা হাজার বছর ধরে মানব সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বনে বসবাস করত এবং সরল জীবন যাপন করত। তবে তাদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন, প্রতিবেশীর সাথে সুন্দর সম্পর্ক, বয়স্কদের সন্মান এবং দেখাশুনা, সম্পত্তির সুষম বণ্টন ইত্যাদি সুন্দর প্রথাগুলো রয়েছে। গুংলু সেগুলো খুব নিষ্ঠার সাথে পালন করে এসেছে। তার গোত্রের সবাই তাকে একজন খুব ভালো মানুষ হিসেবে জানে। একদিন সে মারা গেল। কিয়ামতের দিন তাকে আহলুল ফাতরাহ’র একজন হিসেবে উঠানো হলো এবং আল্লাহ تعالى তার পরীক্ষা নিলেন। সেই পরীক্ষায় সে পাশ করে গেল। তার জীবনে বিপুল পরিমাণের হাসানাহ অর্থাৎ ভালো কাজ থাকায় তার পুরস্কার সে আল্লাহর تعالى কাছে পেয়ে গেল।

এই তিনটি উদাহরণ দেখলেই বোঝা যায় যে, আমরা যারা মুসলিম হয়ে জন্মেছি, যারা নিজেদেরকে সালাফি, হানাফি, শাফেঈ, সূফী ইত্যাদি মতবাদের অনুসারী হিসেবে একমাত্র সঠিক পথে আছি বলে মনে করি, আমাদের পরিণতি বরং যাদেরকে আমরা দিনরাত কাফির বলে গালিগালাজ করি, তাদের থেকেও ভয়ঙ্কর হতে পারে। সুতরাং ‘আমরা ঠিক, বাকি সবাই কাফির’ — এই ছেলেমানুষি ধারণা থেকে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের মত তর্ক না করে, আমাদের বড় হওয়ার সময় এসেছে। কারণ আল্লাহ تعالى বলেছেন—

আল্লাহ تعالى কিয়ামতের দিন তাদের মধ্যে এই মতবিরোধের বিচার করবেন।

আক্বিদা সম্পর্কিত মতবিরোধের বিচার আল্লাহর تعالى হাতে। আমাদের এই নিয়ে তর্কাতর্কি, মারামারি, অপর পক্ষের দাঈ, ইমামদের গুম করে ফেলা — এই সব বন্ধ করতে হবে। কু’রআন আমাদেরকে এই ধরনের মুসলিম-মুসলিমে মারামারি শেখায় না। এগুলো সবই একদল চরমপন্থি আলেমের স্বার্থসিদ্ধির কারণে প্রচার করা বিকৃত শিক্ষা।

আজকাল অনেকেই যারা ইসলামের দাওয়াহ’র কাজে জড়িত, তারা ইসলামের প্রচারের জন্য কাজ করতে গিয়ে ইসলাম থেকে বরং তার দলের স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দেন। এরা মনে করেন: তাদের দল সঠিক, এবং বাকি সব দল বাতিল; তাদের আলেমদের হক জ্ঞান রয়েছে, বাকিরা সবাই বিদআতি, এবং মুনাফেক। শুধু তাই না, এদের মধ্যে কিছু আছেন যারা অন্যদেরকে কাফির ঘোষণা করেন, যেখানে কিনা অন্যরা এক আল্লাহর تعالى অনুসারী, রাসুল মুহাম্মাদ-এর عليه السلامঅনুসারী, একই কু’রআন পড়েন, একই কিবলার দিকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, যাকাত দেন, একই রমজানে রোজা রাখেন। দলের প্রতি অন্ধভাবে অনুগত এই ধরনের মুসলিমদের সত্য বাণীর প্রতি কোনও আগ্রহ নেই। তাদের আগ্রহ হচ্ছে নিজেদেরকে সঠিক এবং অন্যদেরকে বাতিল বলে জাহির করা, নিজেদেরকে বড় এবং অন্যদেরকে ছোট বলে অপমান করা।

এদের অনেকে এতটাই ধর্মান্ধ যে, তারা তাদের অনুসারীদেরকে কখনো অন্য মতবাদের অনুসারীদের মসজিদে যেতে দেন না, তাদের সাথে সামাজিক মেলামেশা বন্ধ করে দেন, তাদের আলেমদের বই পড়তে কঠিনভাবে নিষেধ করেন। এই ধরনের মুসলিমদেরকে যদি কু’রআন, সুন্নাহ থেকে একদম পরিষ্কার দলিলও দেখানো হয়, তারপরেও তারা তাদের মত পালটাবেন না, কারণ তাদের দলীয় স্বার্থ তখন নষ্ট হয়ে যাবে, দলের মধ্যে তার অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যাবে। তার দলের ফান্ড, সুসজ্জিত অফিস, বিশাল লাইব্রেরি, দলের ফান্ড থেকে দরকার পড়লে টাকা নেওয়া, বিদেশে ওয়াজ-মাহফিলে যাওয়ার টিকেটের খরচ — সব হারিয়ে যাবে।
আরও ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো: এরা জানে যে, তারা যদি তাদের দলের বিরুদ্ধে যায়, বড় হুজুরের ফাতওয়াহ বা মতের বিপরীতে কিছু বলে, তাহলে সর্বনাশ! বড় হুজুর তাকে দল থেকে বের করে দেবেন। তারপর তার সহকর্মীদেরকে তার পেছনে লেলিয়ে দেবেন। তখন তার সহকর্মীরা হায়নার মত ঝাঁপিয়ে পড়বে তার সন্মান শেষ করে দিতে। তিনি আর কোনও মসজিদে গিয়ে ইমামতি করতে পারবেন না, কোনও মাদ্রাসায় পড়াতে পারবেন না। পরিবারকে নিয়ে তার পথে বসতে হবে। তার আর কোনও যোগ্যতাও নেই অন্য কোনও পেশায় ঢুকে পড়ার। তাই এত বড় ক্ষতি কোনোভাবেই হতে দেওয়া যাবে না— বড় হুজুর যা বলেন, সেটাই ঠিক, বাকি সব বাতিল।

এদের সাথে আল-বাক্বারাহ’র এই আয়াতে দেখানো ইহুদি, খ্রিস্টানদের খুব একটা পার্থক্য নেই।

সূত্র:

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • ৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
  • [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
  • [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
  • [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
  • [১৫] তাফসির আল জালালাইন।
  • [২৪৭] ইহুদিদের ঈসা عليه السلام নবীকে অস্বীকারের কারণ — http://www.aish.com/jw/s/48892792.html
  • [২৪৮] খ্রিস্টানদের ইহুদি ধর্মকে অস্বীকারের কারণ — http://www.gospelway.com/religiousgroups/judaism.php, http://www.gci.org/bible/torah/exodus2a
  • [২৪৯] ৭৩ দলের হাদিস সম্পর্কে ভুল ধারণা — https://www.youtube.com/embed/Pr-sf9vzjWM

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *