হে মানুষ, পৃথিবীতে যা কিছু হালাল এবং ভালো, পবিত্র আছে, তা খাও — আল-বাক্বারাহ ১৬৮

2_168_title

2_168হে মানুষ, পৃথিবীতে যা কিছু হালাল এবং ভালো, পবিত্র আছে, তা খাও। আর শয়তানের পথ অনুসরণ করো না। নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। [আল-বাক্বারাহ ১৬৮]

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বলছেন, “হে মানুষ”—এটি শুধু মুসলিমদের জন্যই নয়, বরং সকল যুগের, সকল মানুষের, সে মুসলিম হোক বা অমুসলিম—সবার জন্য নির্দেশ। এখানে আল্লাহ تعالى শুধুই বলেননি হালাল খাবার খেতে, একইসাথে সেটা তাইয়িবও হতে হবে। তাইয়িব طيب হচ্ছে যা ভালো এবং পবিত্র— দুটোই একসাথে।[১] যা কিছুই খেতে ভালো, দেখতে সুন্দর, শ্রুতিমধুর, সুন্দর ঘ্রাণ —সেগুলোই তাইয়িব।[১৬]

আল্লাহ تعالى আমাদেরকে যা দেন, সেটা আমাদের জন্য ভালো এবং পবিত্র। কিন্তু মানুষ অনেক সময় অনেক কিছু তৈরি করে যেটা খেতে ভালো হলেও, পবিত্র নয়। যেমন, আল্লাহ تعالى কলা দিয়েছেন, যা তাইয়িব— ভালো এবং পবিত্র। কিন্তু মানুষ যখন এই কলাকে পোকা মারার বিষ ডিডিটি এবং বিদেশ থেকে আনা কেমিক্যাল দিয়ে পাকিয়ে বিক্রি করে[৩১১], তখন সেটা খাওয়ার যোগ্য হলেও, সেটা আর পবিত্র থাকে না, তাইয়িব-এর দুটি শর্ত পূরণ করে না। সুতরাং, এই ধরনের কলা, ফরমালিন দিয়ে রাখা ফল, মাছ খাওয়ার ঝুঁকি নেওয়া যাবে না, কুর’আনের এই আয়াতের নিষেধের জন্য এবং নিজের স্বাস্থ্যের জন্য।

একইভাবে আল্লাহ تعالى প্রকৃতিতে পানি, চিনি দিয়েছেন। সেগুলো হালাল এবং তাইয়িব। কিন্তু এগুলোর সাথে ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ, এসিড, মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণের চিনি, রঙ ব্যবহার করে যখন নানাধরণের পানীয় তৈরি করে, তখন সেটা আর তাইয়িব থাকে না।

ব্যবসায়ী ফার্মগুলোর জঘন্য পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকা অসুস্থ হাঁসমুরগি, গরুছাগল, যেগুলোর সাথে চরম দুর্ব্যবহার করা হয়, এন্টিবায়োটিক এবং হরমোন ইনজেকশন দিয়ে মোটা থলথলে বানানো হয় – সেগুলোও খাওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে, কারণ সেগুলো তাইয়িব থাকে না। এমনকি মুসলিম বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, এগুলো হালাল থাকারও সম্ভাবনা কম, কারণ হালাল হতে হলে প্রাণীদের উপর এধরনের অন্যায় করা যাবে না, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম এভাবে ভাঙ্গা যাবে না।[৩০৫] এই ধরনের অপবিত্র খাবার খেলে আমরা কু’রআনের এই কঠিন নির্দেশটির অবাধ্য হবো। কু’রআনে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে শুধু হালাল খাবার খেতেই বলেননি, তিনি সমগ্র মানবজাতিকে: মুসলিম-অমুসলিম উভয়কেই তাইয়িব (ভালো এবং পবিত্র) খাবার খেতে বলেছেন।

আমাদের ভেতরে খাবার হালাল হলো কি না, সেটা নিয়ে যতটা সতর্কতা দেখা যায়, খাবার তাইয়িব কি না, সেটা নিয়ে ততটা সতর্কতা দেখা যায় না। অথচ আল্লাহ تعالى কু’রআনে সূরা বাকারাহ’তেই তিন বার মানুষকে হালাল এবং তাইয়িব খাবার খেতে বলেছেন। যদি হালাল খাবার খেলেই হতো, তাহলে তিনি বিশেষ করে তাইয়িব কথাটা বার বার বলতেন না।

আমাদের মনে রাখতে হবে, জেনেবুঝে আল্লাহর تعالى নির্দেশ অমান্য করে আমরা আল্লাহর تعالى কোনো ক্ষতি করি না, বরং নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারি। কেউ যখন বন্ধু-বান্ধবের সাথে পার্টি করে রংবেরঙের পানীয় খায়, সে আল্লাহর تعالى কোনো ক্ষতি করে না, নিজের গায়ে নিজেই ‘কুড়াল’ মারে।[৩০৭] কেউ যখন মরা মুরগি দিয়ে বানানো চিকেন ব্রোস্ট খায়, বা দোকানের ভেজাল তেল, মেয়াদ উত্তীর্ণ ডালে রান্না করা মরা গরুর মাংসের হালিম খায়, তখন সে আল্লাহর تعالى কোনো ক্ষতি করে না, বরং সে নিজের পরিপাকতন্ত্রে নিজেই ‘কুড়াল’ মারে, একসময় জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে, মাসের পর মাস হাসপাতালে পড়ে থেকে, ধুকে ধুকে মারা যায়।[৩০৮]

কেউ যখন অল্প কিছু টাকা বাঁচানোর জন্য দেশি বা অরগানিক প্রাণীর মাংস না খেয়ে ফার্মের অসুস্থ, বিকৃত প্রাণীর মাংস খায় (Meet your meat), সে তখন নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের শরীরে ‘কুড়াল’ মারে, ভবিষ্যতে পরিবারের চিকিৎসার খরচ দিতে গিয়ে দিনরাত খেটে মরে।[৩০৯] কেউ যখন হারাম সুদের ঋণ নিয়ে বাড়ি কেনে, তখন সে আল্লাহর تعالى কোনো ক্ষতি করে না, বরং নিজের পরিবারের ভবিষ্যৎ এবং দেশের অর্থনীতিতে ‘কুড়াল’ মারে: ঋণ শোধ করার দুশ্চিন্তায় ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিস, মানসিক অশান্তি বাড়ায়। লোণ শোধের জন্য বাড়তি কাজ করতে গিয়ে ছেলেমেয়েদেরকে ঠিকমতো সময় না দিয়ে, তাদেরকে উচ্ছন্নে যেতে দেয়। তারপর যখন গুরুতর অসুস্থ হয় বা মারা যায়, তখন পরিবারের উপরে একটা লোণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে চলে যায়।

আল্লাহ تعالى আমাদেরকে যা কিছুই করতে মানা করেছেন, প্রত্যেকটির পিছনে কোনো না কোনো কারণ রয়েছে। আমরা অনেক সময় যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করে দেখি না: সেই কারণগুলো কী। আমরা অনেকে মনে করি, “আমার যেখানে লাভ হচ্ছে, সেখানে এটা মানা করার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? আল্লাহ تعالى কেন খামোখা কোনো কিছু হারাম করে দিবেন, যাতে আমার কোনো ক্ষতি হচ্ছে না?”

আমরা যথেষ্ট গবেষণা করে দেখি না যে, আমরা যা করছি বা যা খাচ্ছি, তাতে সত্যিই আমার কোনো সুদূরপ্রসারী ক্ষতি হচ্ছে কিনা, পরিবারের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে কিনা, সমাজের এবং দেশের অবস্থার অবনতি ঘটছে কিনা। পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রচুর পরিমাণে গবেষণা হয়েছে অ্যালকোহল, সুদ, জুয়া, ফার্মের হাঁসমুরগি, কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা গবাদি পশু, জেনেটিক উপায়ে পরিবর্তন করা শাকসবজি-ফলমূল, সঠিক ভাবে জবাই না করা পশুর মাংস, হিন্দি সিরিয়াল দেখা, পর্ণ দেখা, ব্যভিচার করা, মেয়েদের স্বল্প কাপড় পড়া[৩১০] ইত্যাদির কারণে সৃষ্ট ভয়ংকর সব শারীরিক, মানসিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির উপরে।

হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড, প্রিন্সটন ইত্যাদি বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশ করা শত শত সোসিওলজি (sociology), সাইকোলজি এবং অর্থনীতিবিদ্যার গবেষণা পত্র রয়েছে, যেগুলো পড়লে মনে হবে সেগুলো কু’রআনের আয়াতগুলোরই তাফসীর। সেই গবেষণাপত্রগুলো পড়লে দেখবেন: তারা আল্লাহর تعالى সাবধান বাণীগুলোকেই বৈজ্ঞানিক যুক্তি, প্রমাণ এবং পরিসংখ্যান দিয়ে বার বার প্রমাণ করছে —যেই বাণীগুলো আমরা ১৪০০ বছর আগেই পেয়েছিলাম, কিন্তু সেগুলোর মর্ম বুঝিনি।

প্রথমত, আমরা এইসব গবেষণা পত্রগুলোর খবর রাখি না। দ্বিতীয়ত, পেলেও মনোযোগ দিয়ে পড়ে দেখি না, বা পড়লেও নিজেকে পরিবর্তন করি না। আমাদের উদ্দেশ্য থাকে: যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের চাহিদা-কামনা-বাসনা মিটিয়ে ফেলা। কার কী ক্ষতি হলো তাতে আমার কী যায় আসে?

একারণেই আল্লাহ تعالى আমাদেরকে সাবধান করে দিয়েছেন—

আর শয়তানের পথ অনুসরণ করো না। সে নিঃসন্দেহে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।

যদি আমরা হালাল এবং তাইয়িব খাবার না খাই, তাহলে আসলে আমরা শয়তানকে অনুসরণ করছি। এই শয়তান হতে পারে জ্বীন শয়তান (শয়তান বলতে আমরা সাধারণত যাকে বুঝি), অথবা হতে পারে মানুষ শয়তান। আমাদেরকে এই সব খারাপ খাবার খাওয়ানো শয়তানেরই পরিকল্পনা। শয়তান হাজারো ভাবে ব্যবস্থা করে রেখেছে, যেন আমরা খুব সহজেই খারাপ খাবার খেতে পারি, খারাপ পানীয় পান করতে পারি। প্রতিদিন টিভি ছাড়লেই শয়তান আমাদেরকে বার বার সেগুলোর বিজ্ঞাপন দেখায়। খবরের কাগজে, রাস্তার বিলবোর্ডে শয়তান বিজ্ঞাপন দিয়ে রেখেছে, যেন আমরা বার বার দেখতে দেখতে একসময় আর লোভ সামলাতে না পারি। শয়তানই মানুষকে দিয়ে ফোন করিয়ে আমাদেরকে সেগুলো খেতে নিয়ে যায়। দোকান, বাজার, রেস্টুরেন্ট, হোটেল সব জায়গায় নিষিদ্ধ খাবার এবং পানীয় ভর্তি করে রেখেছে। একজন মুসলিমের জন্য পরীক্ষা হচ্ছে, প্রথমে উপলব্ধি করা যে, শয়তানই পরিকল্পনা করে বার বার আমাদেরকে ডাকছে সেগুলো খাওয়ার জন্য। তারপর সেগুলো থেকে নিজেকে দূরে রাখা। নিজেকে শয়তানের অনুসারীদের একজন করে না ফেলা।

সূত্র:

  • [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
  • [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
  • [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
  • [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
  • [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
  • [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
  • [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
  • [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
  • [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
  • [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
  • [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
  • [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
  • [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
  • [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
  • [১৫] তাফসির আল জালালাইন।
  • [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ।
  • [৩০৫] হালাল মাংস কি আসলেই হালাল? http://www.onislam.net/english/health-and-science/health/422325-halal-organic-or-vegetarian.html
  • [৩০৭] নিয়মিত অ্যালকোহল গ্রহণ করলে লিভারে ক্ষতি হয়, সেটা পরিমিত হলেও — http://www.drinkaware.co.uk/check-the-facts/health-effects-of-alcohol/effects-on-the-body/alcohol-and-your-liver, http://rethinkingdrinking.niaaa.nih.gov/questionsanswers/default.asp, http://www.nhs.uk/Conditions/Liver_disease_%28alcoholic%29/Pages/Introduction.aspx
  • [৩০৮] ফ্রাইড খাবারের ঝুঁকি — http://www.naturalnews.com/034483_fried_foods_health_damage.html
  • [৩০৯] ফার্মের প্রাণীদের বীভৎস জীবন — http://www.youtube.com/watch?v=32IDVdgmzKA
  • [৩১০] মেয়েদের কম কাপড় পড়ার কুফল — http://www.mpm.umd.edu/Gray,%20Knobe,%20Sheskin,%20Bloom%20&%20Barrett.%20(in%20press).%20Objectification.pdf
  • [৩১১] কলা পাকানো হয় পোকা মারার বিষ দিয়ে —  http://www.webcitation.org/6L4q7dv8i, http://www.webcitation.org/6KmuanBN9

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *