শপথ আলোকোজ্জ্বল দিনের। শপথ রাতের, যখন তা স্থির হয়ে যায়। তোমার প্রতিপালক মোটেও তোমাকে ছেড়ে যাননি, বা রাগ করেননি। বরং তোমার জন্য আগামী দিনগুলো হবে আগের দিনগুলোর থেকেও ভালো। অচিরেই তোমার রব তোমাকে যা দেবেন তাতে তুমি সন্তুষ্ট হবে। তিনি কি তোমাকে এতিম অবস্থায় পেয়ে আশ্রয় দেননি? পথ হারা পেয়ে পথ দেখাননি? অভাবী পেয়ে অভাবমুক্ত করেননি? তাই, এতিমদের প্রতি কঠোর হবে না। কেউ কিছু চাইতে আসলে তাকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দেবে না। আর তোমার রব তোমার উপর যা অনুগ্রহ করেছেন, তা অন্যকে জানাতে থাকো। —আদ-দুহা
সুরাহ আদ-দুহা একটি বিখ্যাত সুরা। হাজার বছর আগে এই সূরাহ’য় আল্লাহ تعالى রাসুলকে عليه السلام ভীষণ কষ্টের সময় সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। তারপর গত হাজার বছরে অগণিত মুসলিম এই সূরাহ’র মধ্যে ধৈর্য ধরে কষ্টের সময় পার করার সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছেন। সুরাহ আদ-দুহা মুসলিমদের জন্য হতাশা, অবসাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার নিরাময়।
আলো ঝলমল সকাল। সকালের ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাস্তায় মানুষের হট্টগোল শোনা যাচ্ছে। বাজার বসেছে। পুরোদমে বেচাকেনা শুরু হয়ে গেছে। চারিদিকে প্রাণের বন্যা। সবাই ব্যস্ত তাদের জীবিকার সন্ধানে।
রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। বাচ্চারা, বড়রা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। শান্ত, স্থির প্রকৃতি। যারা জেগে আছে, তারা গভীর চিন্তায় আত্মমগ্ন। জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে ভেবে দেখার সঠিক সময় এটা।
লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এই দুটো সময় একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীত। অথচ মানুষের জন্য এদুটোই জরুরি। সকালের ব্যস্ততা, ঝামেলা দরকার জীবিকা অর্জনের জন্য, দুনিয়ার জীবনে সফলতার জন্য। একইসাথে রাতের একাকী সময় দরকার পরকালের সফলতার জন্য। আল্লাহ تعالى আমাদেরকে দিন এবং রাত, ব্যস্ততা এবং স্থিরতা, ঝামেলা এবং শান্তি দিয়েছেন, কারণ একজন মুসলিমের সফলতার জন্য এদুটোই জরুরি। সূরাহ আদ-দুহা’তে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে মনোযোগ দিতে বলছেন জীবনের এই বিপরীত সময়গুলোর প্রতি।[৭] নির্জন বনে গিয়ে সন্ন্যাসী হওয়া ইসলাম সমর্থন করে না। একজন মুসলিমকে জীবনের জটিলতার মধ্যে ডুবে থেকেই আল্লাহর تعالى ইবাদতে সময় বের করতে হয়।
মানুষ বড় হয় জীবনের জটিলতা অতিক্রম করে। কারও জীবনে একের পর এক ঝড় আসে। সে সেই বিপদগুলো মোকাবেলা করে, আর একটু একটু করে বড় হয়। যেমন, মানুষ অভাবে পড়লে যা শেখে, তার মধ্যে যে গুণগুলোর বিকাশ হয়, অভাবে না পড়লে তা কখনই আসে না। একইভাবে মানুষ জটিল পারিবারিক সমস্যায় পড়লে যা শেখে, সমস্যায় না পড়লে তা অনেক সময় শেখে না। মানুষ বই পড়ে বড় হয় না, বরং জীবন যুদ্ধ অতিক্রম করে বড় হয়। তাই বড় দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার জন্য যে অভিজ্ঞতা অর্জন করা দরকার, তা অর্জনের জন্য বই এবং কোর্সের থেকে বরং জীবনে কিছু কঠিন সময় পার করা দরকার। যে যত বেশি কঠিন সময় পার করবে, সে তত জীবন যুদ্ধে পারদর্শী হবে, সমস্যা মোকাবেলায় তত অভিজ্ঞ হবে। তার কাছ থেকে তত কার্যকরী উপদেশ পাওয়া যাবে।
আমরা যদি কুর‘আনে নবী-রাসুলদের জীবনী দেখি, তাহলে দেখবো যে, তারা প্রত্যেকেই অত্যন্ত কঠিন, কষ্টের জীবন পার করেছেন। নবুয়ত পাওয়ার আগে তাদের জীবন যেমন কঠিন ছিল—বহু ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কষ্টের অভিজ্ঞতা তারা পার করেছেন—নবুয়ত পাওয়ার পরেও তাদের জীবন মোটেও সহজ বা সুখের হয়নি। তাদের মতো জীবন যুদ্ধে অভিজ্ঞ মানুষ আর পাওয়া যাবে না। আল্লাহ تعالى তাদেরকে কঠিন সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিয়ে যান, কারণ নবী, রাসুল হিসেবে দায়িত্ব পালন করার জন্য এগুলো একধরনের ট্রেনিং হিসেবে কাজ করে।
একইভাবে আমরা যদি আমাদের জীবনের কঠিন সময়গুলোকে ট্রেনিং হিসেবে নেই, অনেকসময় আমরা উপলব্ধি করতে পারি: কেন আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এই কষ্টকর সময়টা দিচ্ছেন? আমরা যদি গভীরভাবে চিন্তা করি যে, এই বিপদে পরে আমার ভেতরে কী কী পরিবর্তন আসছে, এরপর থেকে আমি কী করবো, আর কী করবো না, তখন আমরা অনেক সময় বিপদের উদ্দেশ্য বুঝতে পারি। কিন্তু যারা বিপদে বা কষ্টে পড়ে চিন্তা করে দেখে না যে, সমস্যাগুলো তার ভেতরে কী পরিবর্তন আনবে, খুঁজে দেখে না যে, সে এখান থেকে কী কী শিক্ষা নেবে, তারাই বিপদে পড়ে চারিদিকে অন্ধকার দেখতে থাকে। হতাশা, অবসাদে ডুবে যায়। আর আল্লাহকে تعالى নিয়ে আজেবাজে কথা বলতে থাকে।
তোমার প্রতিপালক মোটেও তোমাকে ছেড়ে যাননি, বা রাগ করেননি। বরং তোমার জন্য আগামী দিনগুলো হবে আগের দিনগুলোর থেকেও ভালো। অচিরেই তোমার রব তোমাকে যা দেবেন তাতে তুমি সন্তুষ্ট হবে।
এই আয়াতগুলোতে রাসুলকে عليه السلام শুধু সান্ত্বনাই দিচ্ছেন না, একই সাথে আল্লাহ تعالى ভবিষ্যৎ বলে দিচ্ছেন যে, ইসলামের জয় একদিন আসবেই এবং দিনে দিনে রাসুল عليه السلام এর অবস্থা আরও ভালোর দিকে যাবে। এই আয়াতগুলোতে অমুসলিমদের জন্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একই সাথে মুমিনদের জন্য রয়েছে পরীক্ষা। কারণ এই আয়াতগুলো নাজিল হওয়ার পরে রাসুলের عليه السلام অবস্থা ভালো তো হয়নি, বরং আরও কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। বদরের কঠিন যুদ্ধ হয়েছে। সেই যুদ্ধে যদিও মুসলিমরা জয়ী হয়েছিল, কিন্তু তারপরে এসেছিল উহুদের যুদ্ধের শোচনীয় পরাজয়। তারপরে ছিল হুদাইবিয়ায় কষ্টের ঘটনা। মুসলিমদের অবস্থা যেন দিনে দিনে আরও খারাপ হচ্ছিল।
অনেকের কাছেই তখন এই আয়াতগুলো মিথ্যা মনে হতে পারত। অনেকে ভাবতে পারত যে, এই সব কথা রাসুল عليه السلام নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য নিজেই বানিয়েছিলেন। হতে পারে এগুলো ছিল তার অবচেতন মনের খেলা। কিন্তু সব সন্দেহ দূর করে একসময় মুসলিমদের জয় হলো। ইসলামের ব্যাপক প্রচার এবং প্রসার হলো। কুর‘আনের ভবিষ্যৎ বাণীর সত্যতা আবারো প্রমাণিত হলো। যারা সেদিন পর্যন্ত ধৈর্য ধরে ঈমান বজায় রেখেছিল, তারা ঈমানের পরীক্ষায় পাশ করে গেলো।
অনেক সময় আমরা জীবনে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ি। বহুদিন চলে যাওয়ার পরেও দেখা যায় সেই কঠিন সময় পার হচ্ছে না। কষ্টের যেন কোনো শেষ নেই। একটার পর একটা সমস্যায় পড়ে চারিদিকে অন্ধকার দেখতে থাকি। তখন অনেককেই দেখা যায় প্রশ্ন করতে, “আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, গরিবের উপকার করি। যতটা সম্ভব ইসলাম মেনে চলার চেষ্টা করি। তারপরেও আমার জীবনেই কেন এত কষ্ট? আমি কী দোষ করেছি? আল্লাহ কি আমাকে পছন্দ করেন না? আল্লাহ কি আমার উপর রাগ করেছেন?” — তারা আল্লাহর تعالى দেওয়া এই সান্ত্বনার বাণীগুলোর মধ্যে শান্তি খুঁজে পাবেন। কারণ تعالى আল্লাহ কখনই তাঁর পছন্দের বান্দাদেরকে রাগ করে ছেড়ে দেন না। বরং অনেক পছন্দের বান্দারাই দেখা যায় দুনিয়ায় কঠিন সব পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যান। এই আয়াতগুলো তাদেরকে কঠিন বিপদে ধৈর্য ধরে রাখার অনুপ্রেরণা দেয়। কারণ তারা জানেন: আল্লাহ تعالى তাদেরকে একদিন এতই দেবেন যে, তারা সব কষ্ট ভুলে গিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন।
তিনি কি তোমাকে এতিম অবস্থায় পেয়ে আশ্রয় দেননি? পথ হারা পেয়ে পথ দেখাননি? অভাবী পেয়ে অভাবমুক্ত করেননি?
আমরা অনেকেই জীবনে কঠিন সময় পার করেছি। হয়ত কারও ছোটবেলায় পরিবারে ভীষণ অভাব ছিল। অনেক কষ্ট করে তিন বেলা খাবার জোগাড় করতে হয়েছে। বহু কাঠখোর পোড়ানোর পর একসময় গিয়ে সচ্ছলতার মুখ দেখেছেন। আবার, অনেকে ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছেন। বাবা-মার আদর কী, তা কোনোদিন অনুভব করেননি। রাতের পর রাত একা কেঁদেছেন। কেউ এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়নি। তারপর একসময় কিছু মানুষ তাকে ভালোবাসার আশ্রয় দিয়েছেন। — এরা যদি তাদের জীবনের ঘটনাগুলো চিন্তা করে দেখেন, দেখবেন যে, তাদের জীবনে যে পরিবর্তনগুলো এসেছে, তা যতটা না তারা নিজেরা অর্জন করেছেন, তার থেকেও বেশি আল্লাহই تعالى তাদেরকে সঠিক সময়ে, সঠিক মানুষের সাথে থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন বলেই হয়েছে।
আল্লাহ تعالى যদি তাদেরকে নিজেদের অবস্থা পরিবর্তনের সুযোগ করে না দিতেন, তাহলে তারা কখনই আজকে সচ্ছল, স্বনির্ভর, ভালোবাসার জীবন পেতেন না। —এভাবে চিন্তা করলে তারা এই আয়াতগুলোর সাথে নিজেদের জীবনকে মেলাতে পারবেন। উপলব্ধি করতে পারবেন যে, রাসুল عليه السلام একসময় কী কঠিন সময় পার করেছেন, যা আমাদের অনেকের জীবনের কষ্টের থেকে অনেক অনেক বেশি। তারপরও আল্লাহ تعالى তাকে কী অবস্থা থেকে কত বড় সম্মানের অবস্থায় তুলে এনেছেন। আল্লাহ تعالى যদি রাসূলকে عليه السلام এতিম, হতদরিদ্র, পথহারা অবস্থা থেকে এত উপরে তুলে আনতে পারেন, তাহলে আমাদের কষ্টের অবসান ঘটানো তো কোনো ব্যাপারই না।
আবার, আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা একসময় ইসলাম থেকে দূরে ছিলেন। আশেপাশের মানুষকে ইসলাম যেভাবে মানতে দেখতেন, নিজে যতটুকু মানতেন, তাতে মনের ভেতরে হাজারো খটকা কাজ করতো। প্রায়ই মনে হতো: এটা সঠিক ইসলাম হতে পারে না, কিছু একটা ঘাপলা আছে। খুঁজে বেড়াতেন কীভাবে ইসলামকে সঠিকভাবে জানা যায়। তাদের জানার এই আন্তরিক আগ্রহ একদিন আল্লাহ تعالى কবুল করলেন। হঠাৎ একদিন একটা বই, বা একটা লেকচার, বা একজন আলেমের মাধ্যমে সঠিক ইসলাম খুঁজে পেলেন। তার সংস্পর্শে এসে মনে শান্তি খুঁজে পেলেন। অস্থিরতা থেকে মুক্তি পেলেন। আল্লাহর تعالى প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হলেন যে, আশেপাশের হাজারো, লক্ষ মানুষের মধ্য থেকে তিনি تعالى আপনাকে বেছে নিয়েছেন, ইসলামের সঠিক পথে পথ দেখিয়েছেন। এই সৌভাগ্যবান মানুষরা সূরাহ আদ-দুহার এই আয়াতগুলো পড়বেন, আর কৃতজ্ঞতার চোখের পানি ফেলবেন।
তাই, এতিমদের প্রতি কঠোর হবে না। কেউ কিছু চাইতে আসলে তাকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দেবে না।
রাসুল عليه السلام এই দুটোর একটাও করতেন না। কোনো দিন করেছেন বলে কেউ দাবি করেনি। বরং তিনি ছিলেন দয়ার সাগর। তাহলে কুর‘আনে এই দুটো আয়াত দেওয়ার কারণ কি? এই সুরাহ যদি শুধুমাত্র রাসুলকে عليه السلام উদ্দেশ্য করেই দেওয়া হয়, তাহলে এই কথাগুলো তাকে বলার তো কোনো কারণ থাকতে পারে না?
আমরা অনেক সময় ভুলে যাই যে, কুর‘আনের প্রতিটি আয়াতেই আমাদের জন্য শিক্ষা রয়েছে। কুর‘আনের কোনো আয়াতই নিছক ঐতিহাসিক তথ্য নয়, যা আমরা পড়লাম শুধুই জানার জন্য, তারপর নিজেরা কিছুই শিক্ষা নিলাম না। এই আয়াতগুলোও আমাদের প্রতি উদ্দেশ্য করে বলা। বিশেষ করে তাদের প্রতি, যারা জীবনে কঠিন সময় পার করেছেন এবং একসময় আল্লাহর অনুগ্রহে সচ্ছল, সম্মানের জীবন পেয়েছেন। যারা একসময় ইসলাম থেকে দূরে ছিলেন, পাপে ডুবে ছিলেন, তারপর একসময় আল্লাহ تعالى তাদেরকে ইসলামের পথ দেখিয়েছেন। এরা যেন বিশেষভাবে এই আয়াতগুলো থেকে শিক্ষা নেন। তারা যেন কখনই এতিমদের সাথে দুর্ব্যবহার না করেন।
একইসাথে কেউ যদি আমাদের কাছে কিছু চাইতে আসে, তখন তাকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া যাবে না। এই চাওয়া দুই ধরণের হতে পারে। আর্থিক সাহায্য চাওয়া, অথবা কেউ কিছু জানতে চাওয়া। কেউ আর্থিক সাহায্য চাইতে আসলে যেন কখনই দুর্ব্যবহার না করি। একইভাবে প্রশ্নকারিকেও আমরা যেন কখনই ধমক দিয়ে তাড়িয়ে না দেই। সবসময় ভালোভাবে মানুষকে ফিরিয়ে দিতে হবে, যেন তার মধ্যে কোনো ক্ষোভ কাজ না করে।[১৭][১৮]
আর তোমার রব তোমার উপর যা অনুগ্রহ করেছেন, তা অন্যকে জানাতে থাকো।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, জীবনে আমরা যা কিছুই উপভোগ করছি, সেটা মায়ের হাতের রান্না, স্ত্রীর সাজানো সংসার, ছেলেমেয়েদের অর্জন, চাকরির বেতন, ব্যবসায়ের লাভ, নিজেরদের প্রতিভা —এই সবকিছুই আসলে এসেছে আল্লাহর تعالى কাছ থেকে। এগুলো সবই আমাদের রিজিক, যা তিনিই تعالى আমাদের দেন।
মা যখন আদর করে পিঠা বানিয়ে খাওয়ান, সেটা হয় আল্লাহর تعالى ইচ্ছায়। আল্লাহ تعالى আদর করে পিঠা খাওয়াতে চেয়েছেন দেখেই তিনি পিঠা খাওয়ার জন্য একজন জীবিত, সক্ষম মা, পিঠার সরঞ্জাম কেনার অর্থ, সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। মা আল্লাহর تعالى আদরের নির্দেশ কার্যকর করার একটি মাধ্যম মাত্র। আমরা মায়ের প্রতি অবশ্যই কৃতজ্ঞতা দেখাবো, কারণ মানুষকে কৃতজ্ঞতা না দেখালে আল্লাহকেও تعالى কৃতজ্ঞতা দেখানো হয় না।[১৭][১৮] তবে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ হবো আল্লাহর تعالى প্রতি।
একইভাবে আমাদের চারপাশে পরিবার, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব রয়েছে, যারা আমাদের প্রতি আল্লাহর تعالى ভালোবাসা, যত্ন, আদর বাস্তবায়ন করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা দেখাবো। সে সাথে সবসময় মনে রাখবো: সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞতা পাওয়ার অধিকার আল্লাহর تعالى। এগুলো যে সবই আমার প্রতি আল্লাহর تعالى অনুগ্রহ, তা বার বার মানুষকে বলবো।
একইসাথে স্বামী যখন দিনরাত কাজ করে সংসারের জন্য উপার্জন করে, বাইরের হাজারো সমস্যা থেকে পরিবারকে আগলে রাখে, সেটা হয় আল্লাহর تعالى ইচ্ছায়। আল্লাহই تعالى আমাকে মাথার উপরে ছাদ, কলে পানি, চুলার আগুন, টিভি, ফ্রিজ, মোবাইল ফোন উপভোগ করতে দিয়েছেন। স্বামী হচ্ছে তাঁর আদেশ বাস্তবায়ন করার জন্য একটি মাধ্যম মাত্র। স্ত্রী যখন সংসার গুছিয়ে সন্তানদের লালন পালন করে প্রতিদিন নিষ্ঠার সাথে স্বামীর যত্ন নেয়, সেটা আসলে আল্লাহই تعالى যত্ন নেন। স্ত্রী হচ্ছেন আল্লাহর تعالى যত্ন বাস্তবায়ন করার একটি মাধ্যম। তাই স্বামী-স্ত্রী একে অপরের প্রতি সবসময় যেমন কৃতজ্ঞতা দেখাবে, তার থেকেও বেশি কৃতজ্ঞতা দেখাবে আল্লাহর تعالى প্রতি। মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানো হচ্ছে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানোর প্রথম ধাপ। এরপর আলাদাভাবে, বিশেষভাবে আল্লাহর تعالى প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে, তাঁর প্রতি ইবাদত সম্পূর্ণ করতে হয়।
কু’রআনে আল্লাহ تعالى প্রায় ৬০টি আয়াতে কৃতজ্ঞতার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন। সূরাহ আল-বাকারাহ’তে এক কঠিন আয়াত রয়েছে—
… আর আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও, যদি তোমরা শুধু তাঁরই ইবাদত করো। —আল-বাক্বারাহ ১৭২
আয়াতের এই অংশটি কঠিন বাণী। যদি আমরা দাবি করি যে, আমরা শুধু আল্লাহর تعالى ইবাদত করি, তাহলে তাঁর تعالى প্রতি কৃতজ্ঞ হতে হবে। যদি আমরা কৃতজ্ঞ না হই, তাহলে আমরা আসলে শুধুই আল্লাহর تعالى ইবাদত করছি না। আমাদের ইবাদতে ভেজাল রয়েছে।
কৃতজ্ঞতা সম্পর্কে আরেকটি বিখ্যাত আয়াত হলো—
মনে করে দেখো, তোমাদের প্রভু কথা দিয়েছিলেন, “যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে আরও দিতেই থাকবো। কিন্তু যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও…, আমার শাস্তি বড়ই কঠিন। [ইব্রাহিম ১৪:৭]
আল্লাহ تعالى যখন শয়তানকে তার সান্নিধ্য থেকে বের করে দিচ্ছিলেন, তখন শয়তান একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ শপথ করেছিল, যা থেকে মানুষকে ধ্বংস করার অন্যতম একটি প্রধান পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়—
(শয়তান বলল) “আমি মানুষের কাছে আসবো ওদের সামনে থেকে, ওদের পেছন থেকে, ওদের ডান দিক থেকে এবং ওদের বাম দিক থেকে। আপনি দেখবেন ওরা বেশিরভাগই কৃতজ্ঞ না। [আল-আ’রাফ ৭:১৭]
কেন আল্লাহ تعالى আমাদেরকে কৃতজ্ঞ হতে বলেন? তাঁর তো আমাদের কাছ থেকে কিছুই পাওয়ার নেই। আমরা কৃতজ্ঞ হই আর না হই, তাতে তো তাঁর কোনো লাভ নেই। তাহলে কৃতজ্ঞ হয়ে কী লাভ?
Wall Street Journal একটি আর্টিকেলে[২৮৬] বলা হয়েছে—
যেসব বয়ঃস্থ মানুষ প্রতিনিয়ত কৃতজ্ঞতা অনুভব করেন: তাদের কর্মস্পৃহা, জীবনসম্বন্ধে তাদের আস্থা, তাদের সামাজিক মেলামেশা, এবং তাদের সুখানুভূতি, কৃতজ্ঞতাবোধহীনদের তুলনায় অনেক বেশি হয়ে থাকে —প্রায় এক যুগ গবেষণার ফল থেকে এটি জানা গেছে। এদের মধ্যে হতাশা, ঈর্ষা, লোভ অথবা মদ্যপানে আসক্তি হওয়ার সম্ভাবনা কম। এরা অপেক্ষাকৃত বেশি আয় করে থাকে। এরা গভীরভাবে ঘুমাতে পারে। এরা নিয়মিত ব্যায়াম করার সুযোগ পায় এবং ভাইরাসজনিত রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাও এদের বেশি।
তাই, আল্লাহর تعالى প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত পার করতে হবে। সেটা আমাদের দেহ এবং মন দুটোর জন্যই কল্যাণকর। প্রতিদিন ৫ ওয়াক্তে, কমপক্ষে ১৭ বার সুরা ফাতিহায় আমরা যেন মনের গভীর থেকে আবেগ নিয়ে বলি—
আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামিন — সমস্ত প্রশংসা এবং ধন্যবাদ আল্লাহর, যিনি সৃষ্টিজগতের প্রভু।