কুরআনের কথা

একসময় তোমরা ছিলে নিষ্প্রাণ, তারপর তিনি তোমাদের প্রাণ দিয়েছিলেন — বাকারাহ ২৮

কেমন করে তোমরা আল্লাহকে অস্বীকার/অবিশ্বাস করো [অকৃতজ্ঞ হও]? অথচ একসময় তোমরা ছিলে নিষ্প্রাণ, তারপর তিনি তোমাদের প্রাণ দিয়েছিলেন। এরপর তিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন, তারপর আবার তিনি তোমাদের প্রাণ দিবেন এবং সবশেষে তাঁর কাছেই তোমাদের ফিরে যেতে হবে। [বাকারাহ ২৮]

আল্লাহ تعالى এখানে ঠিক দুইবার নিষ্প্রাণ এবং দুইবার প্রাণ পাবার কথা বলেছেন। প্রথমে আমরা ছিলাম أَمْوَٰتًا —যার অর্থ হয় দুটি—মৃত বা প্রাণহীন।[৫] প্রথমবার নিষ্প্রাণ বলতে আল্লাহ تعالى মানুষের দেহ তৈরির জন্য যা কাঁচামাল দরকার, তার কথা বলেছেন। কারণ চিন্তা করলে দেখা যায়: পৃথিবীতে যত মানুষ এসেছে এবং আসবে তাদের সবার জন্য যে কাঁচামাল দরকার, তা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে আছে নিষ্প্রাণ অবস্থায়। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিষ্প্রাণ কাঁচামাল অবস্থায় এখনই মহাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে।[৪] মানুষের দেহ তৈরির জন্য দরকার ৬০% অক্সিজেন, ১৮% কার্বন, ১০% হাইড্রোজেন, ৩% নাইট্রোজেন, ১.৫% ক্যালশিয়াম, ১.০%ফসফরাস, আর অল্প কিছু অন্যান্য মৌলিক পদার্থ। ভবিষ্যতে যত মানুষ জন্মাবে, তাদের জন্য এই সমস্ত মৌলিক পদার্থ মহাবিশ্বে এখনই ছড়িয়ে আছে, আল্লাহর تعالى নির্দেশের অপেক্ষায়। আল্লাহর تعالى নির্দেশ পেলেই এই নিষ্প্রাণ কাঁচামালগুলো একসাথে হয়ে একটি মানব শিশুর দেহ তৈরি করা শুরু করে দেবে এবং একসময় আল্লাহ تعالى তার মধ্যে প্রাণ দিয়ে দেবেন।

আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এখানে জিজ্ঞেস করছেন: কীভাবে আমরা তাকে অস্বীকার করতে পারি, তার প্রতি অকৃতজ্ঞ হতে পারি, যেখানে আমরা একসময় ছিলাম প্রাণহীন, বিক্ষিপ্ত কিছু জড় পদার্থ? এরপর একসময় তাঁর নির্দেশে সেই প্রাণহীন জড় পদার্থগুলো অসাধারণ সূক্ষ্মতার সাথে অত্যন্ত বুদ্ধিমান এক প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। এই প্রশ্নটি বোঝার জন্য আমাদের প্রথমে বোঝা দরকার কিছু প্রাণহীন জড় পদার্থ থেকে কীভাবে আমরা একটি প্রাণীতে পরিণত হলাম। এবং মানুষ নামের এই প্রাণীর দেহে কী অসাধারণ সব ব্যাপার রয়েছে যে, সৃষ্টিকর্তা নিজে আমাদেরকে চ্যালেঞ্জ করছেন: যদি আমরা সত্যিই বুঝতাম আমরা কীভাবে সৃষ্টি হয়েছি, তাহলে আমরা কোনোদিন তাঁকে অস্বীকার করতাম না, তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞ হতাম না।

আপনি কীভাবে এলেন?

প্রথমে ভেবে দেখুন, আপনি কীভাবে জন্ম নিলেন? আপনি এসেছেন আপনার বাবা-মা’র কাছ থেকে। আপনার বাবা-মা এসেছেন তাদের বাবা-মা’র কাছ থেকে। এভাবে যদি পেছন দিকে যেতে থাকেন, একসময় আপনি পৃথিবীর সর্বপ্রথম বাবা এবং মা পর্যন্ত পৌঁছে যাবেন, যাদেরকে কেউ জন্ম দেয়নি। এখন প্রশ্ন হলো, তারা কোথা থেকে এলেন?

এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে গত দুশো বছরে পৃথিবীতে তোলপাড় হয়ে গেছে। একদল মানুষ বিশ্বাস করে, সৃষ্টিকর্তা নিজে সেই প্রথম মানব এবং মানবীকে বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, অথবা তিনি পৃথিবীতেই তাদেরকে কোনো বিশেষ প্রক্রিয়ায় বানিয়েছেন। আরেকদল মানুষ মনে করে, সেই প্রথম আধুনিক মানব-মানবী এসেছেন কোনো গরিলা/শিম্পাঞ্জীর মতো দেখতে আদি পিতা-মাতা থেকে, যারা ঠিক আজকের মানুষের মতো ছিলেন না। কোনো কারণে প্রথমবারের মতো সেই আদি পিতা-মাতা একটি আধুনিক মানব এবং মানবী শিশুর জন্ম দেন এবং তাদের থেকে পৃথিবীতে আজকের যত মানুষ রয়েছে সবার জন্ম হয়েছে। শুধু তাই নয়, সেই আদি পিতা-মাতারা এসেছেন আরেকটু বেশি বানরের কাছাকাছি দেখতে আদিমানব, আদিমানবী থেকে, যারা নাকি এসেছেন আরও বেশি বানরের মতো দেখতে আরও আদিমানব এবং আদিমানবী থেকে—এই হচ্ছে ডারউইনের বিখ্যাত বিবর্তনবাদ, যা পৃথিবীর মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছে—আস্তিক ও নাস্তিক।

ডারউইনের বিবর্তনবাদ

ডারউইনের বিবর্তনবাদ অনুসারে একজন আদি পিতা ও মাতা—যারা ঠিক আজকের মানুষের মতো মানুষ ছিলেন না—বিশেষ কোনো জেনেটিক মিউটেশনের কারণে তারা প্রথম একজন আধুনিক মানব শিশুর জন্ম দেন। এটি দৈব চক্রে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা মাত্র: এর পেছনে কোনো উদ্দেশ্য নেই, কোনো সৃষ্টিকর্তার হাত নেই। প্রকৃতির হাজার খেলার মধ্যে এটি ছিল একটি খেলা। এই একই প্রক্রিয়ায় পৃথিবীতে সকল প্রাণের উদ্ভব হয়েছে।

বিবর্তনবাদ অনুসারে প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে দৈব চক্রে। কোনো কারণে ৩.৬ বিলিয়ন বছর আগের আদি পৃথিবীতে, কোনো এক জায়গার কাদা মাটিতে কিছু অজৈব পদার্থ কাকতালীয়ভাবে একসাথে মিশে প্রথম অ্যামাইনো অ্যাসিড তৈরি করে। এরকম অনেকগুলো অ্যামাইনো অ্যাসিড কোনো কাকতালীয় কারণে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে একসাথে হয়ে প্রোটিন তৈরি হয়। তারপর কয়েকটি বিশেষ প্রোটিন কোনো কাকতালীয় কারণে একসাথে হয়ে ডিএনএ তৈরি হয় এবং তারপর সেখান থেকে আরও বিরাট কোনো কাকতালীয় কারণে প্রথম এককোষী প্রাণীর সৃষ্টি হয়। সেই এককোষী প্রাণীরা বহু বছর ধরে বিবর্তিত হয়ে একসময় কোনো কারণে বহুকোষী প্রাণীতে পরিণত হয়। তার বহু বছর পরে সেই বহুকোষী প্রাণীরা বিবর্তিত হয়ে আরও জটিল জলচর প্রাণীতে পরিণত হয়। তারপর সেই জলচর প্রাণীগুলো একসময় হাত-পা গজিয়ে ডাঙায় উঠে এসে নানা ধরনের স্থলচর প্রাণীতে পরিণত হয়। এরপর সেই স্থলচর প্রাণীগুলো কোটি কোটি বছর ধরে বিবর্তিত হয়ে একসময় গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগির মতো প্রাণীতে পরিণত হয়। এবং সবশেষে একই প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে বানরররূপী আদিমানব থেকে উদ্ভব হয়েছে আধুনিক মানুষের।

এখানে লক্ষ্য করুন এই গোটা প্রক্রিয়ায় কতগুলো কাকতালীয় ব্যাপার রয়েছে। এই প্রতিটি কাকতালীয় ঘটনা ঘটার সম্ভাব্যতা হচ্ছে কমপক্ষে কোটি কোটি কোটি সম্ভাবনার মধ্যে একটি। যেমন ৩০০ অণু দিয়ে গঠিত একটি প্রোটিন তৈরি হবার সম্ভাবনা হচ্ছে ১০৩৯০ এর মধ্যে একটি। ১০ এর পরে ৩৯০টি শূন্য দিলে যে বিরাট সংখ্যা হয় ততগুলো সম্ভাবনার মধ্যে একটি। যার অর্থ হচ্ছে— এটা গাণিতিক ভাবে দেখলে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

বিবর্তনবাদ কি আসলেই কোনো প্রমাণিত বিজ্ঞান?

বিবর্তনবাদ যদি সত্যি হতো তাহলে—

১) আমরা এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে বিবর্তিত হওয়ার সময়, তার মাঝামাঝি অবস্থার অনেক নিদর্শন প্রকৃতিতে দেখতে পারতাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা যে লক্ষ লক্ষ ফসিল পেয়েছি, তার কোথাও কোনোদিনও এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে বিবর্তিত হওয়ার সময় মাঝামাঝি অবস্থার কোনো প্রাণী দেখা যায়নি।[1] যেমন এখনও পর্যন্ত এমন কোনো বানর বা গরিলার ফসিল পাওয়া যায়নি—যেটার মাথা ছিল মানুষের মতো, বা যেটার গায়ের লোম মানুষের মতো একদম ছোট, বা যেটার হাত মানুষের হাতের মতো—যেগুলো দেখে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, গরিলা বা বানর থেকে ধীরে ধীরে বিবর্তন হয়ে মানুষ এসেছে।

২) প্রাণীদের মধ্যে সূক্ষ্ম বিবর্তনের (Microevolution) নিদর্শন মিললেও বড় ধরনের বিবর্তনের কোনো প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি, যেখানে এক প্রজাতির প্রাণী বিবর্তিত হয়ে আরেক প্রজাতির প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। Macroevolution-এর পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। বিজ্ঞানিরা গবেষণাগারে মাছির বিবর্তন করার চেষ্টা করেছিলেন। অনেক চেষ্টার পরে দেখা গেল তিন ধরনের মাছি তৈরি হলো—১) আগে যেরকম ছিল সেরকমই, ২) মিউটেটেড বা বিকৃত, অথবা ৩) মৃত।[2] ২০১০ সালে একটি গবেষণায় মাছির ৬০০ প্রজন্ম পরীক্ষা করেও কোনো বিবর্তনের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।[3] একইভাবে ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার ৪০,০০০ প্রজন্মের উপর বিবর্তনের চেষ্টা করেও বিবর্তনবাদের পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।[4] সুতরাং অতীতেও বিবর্তন হয়ে একটি প্রজাতির প্রাণী অন্য প্রজাতির প্রাণীতে রূপান্তরের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, বর্তমানেও না।

৩) বিবর্তনবাদ দাবি করে যে, জেনেটিক মিউটেশনের মাধ্যমে প্রাণীদের মধ্যে বিবর্তন হয়ে উন্নততর এবং বেশি টেকসই প্রাণীর সৃষ্টি হয় এবং এইভাবেই আদি-মানুষ থেকে আধুনিক মানুষ এসেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় উলটো প্রমাণ পাওয়া গেছে। উদ্ভিদ এবং মানুষ উভয়েরই উপর গবেষণায় দেখা গেছে বেশিরভাগ মিউটেশনের ফলে দেহে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয় না। কিন্তু খারাপ মিউটেশন হয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে এবং এগুলো কোষের বংশপরম্পরায় টিকে থাকে। একে বলা হয় জেনেটিক এনট্রপি। প্রত্যেক মানুষ তার নিজের মিউটেশন এবং তার পূর্ব পুরুষদের মিউটেশন বহন করে এবং তারপর তার বংশধরের মধ্যে দিয়ে দেয়।[6]

সাম্প্রতিক কালে হিউমেন জিনোম গবেষণার উন্নতির ফলে বিজ্ঞানীরা ২১৯ জন মানুষ এবং ৭৮ জন বাবা-মা এবং তাদের সন্তানদের মধ্যে গবেষণা করে দেখেছেন, প্রতি বংশ পরম্পরায় ৬০টি নতুন মিউটেশন যোগ হয়![8]

বিবর্তনবাদীরা দাবি করে: ২.৪ মিলিয়ন বছর আগে, এক বানর/গরিলার কাছাকাছি দেখতে আদি মানুষ থেকে আধুনিক মানুষের উদ্ভব হয়েছে। যার অর্থ দাঁড়ায় এই পর্যন্ত মানুষের প্রায় ১২০,০০০ প্রজন্ম এসেছে। এখন প্রতি প্রজন্ম যদি ৬০টি মিউটেশন যোগ করে, তাহলে ১২০,০০০ প্রজন্মে আজকে মানুষের মধ্যে ৭,২০০,০০০ মিউটেশন থাকার কথা। এতো মিউটেশন হলে মানুষ আর মানুষ থাকত না, এবং অনেক আগেই মানব জাতি পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।

৪) এক প্রজাতির প্রাণীর থেকে অন্য প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে ধাপে ধাপে বিবর্তন কখনও সম্ভব নয়। যেমন, সরীসৃপের দ্বিমুখী ফুসফুস কখনই পাখির একমুখী ফুসফুসে বিবর্তিত হতে পারে না। সেটা হতে হলে বিবর্তন শেষ না হওয়া পর্যন্ত সরীসৃপকে শ্বাস নেওয়া বন্ধ করে দিতে হবে—যেটা কেবল হাস্যকরই নয় বরং অযৌক্তিক। সুতরাং বিবর্তনবাদীরা যে-দাবি করে সরীসৃপ থেকে পাখির বিবর্তন হয়েছে, সেটা ভুল।[7] একইভাবে উভচর প্রাণীর তিন-কক্ষ-বিশিষ্ট হৃদপিণ্ড থেকে স্তন্যপায়ী প্রাণীর চার-কক্ষ-বিশিষ্ট হৃদপিণ্ডের বিবর্তন হওয়া কখনও সম্ভব নয়, কারণ সেটা হতে হলে প্রথমে উভচর প্রাণীর হৃদপিণ্ডের মধ্যে নতুন দেওয়াল সৃষ্টি হতে হবে, যা রক্ত চলাচল ব্যহত করবে, না হয় নতুন রক্তনালীর সৃষ্টি হতে হবে, যা রক্ত চলাচলকে ব্যহত করবে।

এরকম অনেক প্রমাণ রয়েছে যা থেকে সহজেই দেখানো যায় যে, এক প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে ধীরে ধীরে বিবর্তন হয়ে অন্য প্রজাতির প্রাণী সৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয়। কারণ বিবর্তনের সময় মাঝামাঝি যেই অবস্থাগুলো হতে হবে, সেগুলো প্রাণীর জন্য কোনোভাবেই কল্যাণকর নয়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে এইধরনের অর্ধেক বিবর্তন সেই প্রাণীর জন্য মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং বিবর্তনবাদ শুধুই একটি থিওরি। এর পক্ষে কোনো গ্রহণযোগ্য ও যৌক্তিক প্রমাণ নেই।

প্রকৃতিতে কী ধরনের বিবর্তন হয়?

একটি ব্যাপার পরিষ্কার করা দরকার: Microevolution বা সূক্ষ্ম-বিবর্তন অবশ্যই প্রকৃতিতে হয়। এবং সেটা হয় একই প্রজাতির মধ্যে, অল্প কিছু জেনেটিক পরিবর্তন থেকে। আর এভাবেই একসময় উপ-প্রজাতির সৃষ্টি হয়।[9] কিন্তু এই সূক্ষ্ম বিবর্তন হতে হতে একসময় Macroevolution বা স্থুল-বিবর্তন হয়ে এক প্রজাতির প্রাণী সম্পূর্ণ অন্য প্রজাতির প্রাণীতে পরিণত হয় না—যেটা বিবর্তনবাদীরা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে এটা নিয়ে বিবর্তনবাদীদের মধ্যেই দ্বিমত রয়েছে।[10] কাজেই বলা যায়, বানরের মধ্যে সূক্ষ্ম বিবর্তন হয়ে বিভিন্ন প্রজাতির বানর তৈরি হয়, কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত বানরই থাকে; মানুষ হয়ে যায় না।

বিবর্তনের টেক্সট বইগুলোতে বিবর্তনবাদের পক্ষে যে সব উদাহরণ দেখানো হয়— যেমন ডারউইনের পাখির ঠোটের ‘বিবর্তন’, ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার ‘বিবর্তন’ হয়ে এন্টিবায়োটিকের প্রতি রেজিস্টেন্স, এইচআইভি ভাইরাসের ‘বিবর্তন’—এগুলো সবই হয় একই প্রজাতির মধ্যে। পাখি বিবর্তনের পরে পাখিই থাকে, ব্যাকটেরিয়া শেষ পর্যন্ত ব্যাকটেরিয়াই থাকে।[11]

মানুষের দেহে অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ? সৃষ্টিকর্তার ভুল?

সেক্যুলার স্কুলগুলোতে এবং ডাক্তারি বইগুলোতে এখনও পড়ানো হয় যে, মানুষের দেহে কিছু অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ রয়েছে, যেগুলো বানর থেকে মানুষ বিবর্তন হওয়ার সময় মানুষের দেহে রয়ে গেছে। দেখানো হয় যে, অ্যাপেন্ডিক্স, এডেনয়েড, টনসিল—এগুলো সব অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ। যদি সত্যি সৃষ্টিকর্তা থাকতেন, তাহলে এই অপ্রয়োজনীয় অঙ্গগুলো থাকত না। মানুষের বিবর্তন-প্রকৃতির এক ত্রুটিপূর্ণ খেলা দেখেই এ ধরনের বেশ কিছু অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ এখনও দেখা যায়।

তবে ২০১০ সালে চারজন বিবর্তনবাদীই এটা প্রমাণ করেছেন যে, এডেনয়িড এবং টনসিল হচ্ছে লিম্ফয়েড টিস্যুর ভাণ্ডার, যা মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য প্রয়োজনীয়।[13] বিখ্যাত Grolier Encyclopedia-তে বলা হয়েছে যে, অ্যাপেন্ডিক্সকে এতদিন মনে করা হতো অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ, কিন্তু এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ব্যবহারের জন্য অন্যতম অঙ্গ। সাইন্স ম্যাগাজিনের ফেব্রুয়ারি ২০১৩ সংখ্যায় বলা হয়েছে যে, একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা দল প্রমাণ করেছেন: কমপক্ষে ৩২ বার অ্যাপেন্ডিক্স-এর বিবর্তন হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীতে, যেই প্রাণীগুলো একে অন্য থেকে বিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ অ্যাপেন্ডিক্স অঙ্গটি প্রকৃতির কোনো ভুল নয়, এটি একটি উদ্দেশ্য প্রণোদিত অঙ্গ, যা বিশেষ কিছু প্রাণীকেই দেওয়া হয়েছে। তারা প্রস্তাব করেছেন যে, এই অঙ্গটি মানুষের পরিপাকতন্ত্রে হজমে সুবিধা হবার জন্য প্রয়োজনীয় ভালো ব্যাকটেরিয়াকে সংরক্ষণ করে। যদি কারও বড় ধরনের ডাইরিয়া, কলেরা হয়ে পরিপাকতন্ত্র থেকে প্রচুর পরিমাণে ব্যাকটেরিয়া হারিয়ে যায়, তখন অ্যাপেন্ডিক্স আবার সেই ভালো ব্যাকটেরিয়া পরিপাকতন্ত্রে সরবরাহ করে।[15]

সময়ের পরিক্রমায় বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করছে যে, মানুষের দেহের ডিজাইনে কোনো ভুল নেই, কোনো অপরিকল্পিত ঘটনা নেই। প্রতিটি অঙ্গ নিখুঁতভাবে তৈরি করা হয়েছে কোনো না কোনো জরুরি কাজের জন্য। মহান আল্লাহ تعالى কত নিখুঁতভাবে মানুষের দেহ তৈরি করেছেন, সেটা আমরা ধীরে ধীরে জানতে পারছি। বিবর্তনবাদীদের অপপ্রচারে মুসলিমরা বিভ্রান্ত হয়ে মনে করে—সত্যিই বোধহয় মানুষের দেহে কিছু অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ রয়েছে। তারা বুঝতে পারছে না এভাবে তারা আল্লাহর সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা তৈরি করছে যে, তিনি মানুষকে কিছু অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ দিয়ে তৈরি করেছেন। আল্লাহ تعالى কখনই প্রয়োজন ছাড়া কিছু করেন না, তাঁর প্রতিটা কাজ অত্যন্ত নিখুঁত।

চোখ—এক অসাধারণ সৃষ্টি

চোখ আল্লাহর تعالى এমন এক অসাধারণ সৃষ্টি যার মধ্যে রহস্যের কোনো শেষ নেই। বইয়ের পর বই লেখা হয়েছে চোখের অসাধারণ ডিজাইন নিয়ে; কিন্তু চোখ কীভাবে হলো সেটা বিবর্তনবাদীরা ব্যাখ্যা করতে পারছেন না।

চোখের পানি বিবর্তনবাদীদের জন্য একটি বিরাট প্রশ্ন, কারণ চোখের পানির মতো এরকম অসাধারণ তরল প্রকৃতিতে কীভাবে এমনি এমনিই এল, সেটা তারা ব্যাখ্যা করতে পারেননি। উইলিয়াম ফ্রে ১৫ বছর চোখের পানি নিয়ে গবেষণা করে বলেছেন—

“চোখের পানি কোনো সাধারণ কিছু নয়। এটি পানি, শ্লেষ্মা, তেল, ইলেক্ট্রোলাইট-এর এক জটিল মিশ্রণ। এটি ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী, যা চোখকে ইনফেকশন থেকে রক্ষা করে। এটি নানা ধরনের কাজ করে যা চোখের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। এটি কর্নিয়াকে মসৃণ করে, যা পরিষ্কার দৃষ্টির জন্য অত্যাবশ্যকীয়। এটি কর্নিয়াকে যথেষ্ট আর্দ্র রাখে এবং অক্সিজেন সরবরাহ দেয়। এটি চোখের জন্য ওয়াইপার হিসেবে কাজ করে, যা চোখকে ধুয়ে পরিষ্কার করে ধুলোবালি থেকে।”[17] চোখের পানি যদি শুধুই পানি হতো, তাহলে তা ঘর্ষণের কারণে চোখ শুকিয়ে জ্বালা পোড়া করত। শীতকালে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি হলে পানি শুকিয়ে জমে বরফ হয়ে যেত। আবার চোখের পানি যদি শুধুই এক ধরনের তেল হতো, তাহলে তা চোখের ধুলাবালি পরিষ্কার না করে উলটো আরও ঘোলা করে দিত। চোখের পানির মধ্যে প্রকৃতির লক্ষ উপাদান থেকে এমন বিশেষ কিছু উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে, যার এক বিশেষ মিশ্রণ একই সাথে পরিষ্কার, মসৃণ এবং জীবাণু মুক্ত করতে পারে এবং অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে। কীভাবে এই অসাধারণ মিশ্রণ এমনি এমনিই ‘বিবর্তন’ হয়ে এল, সেটার কোনো ব্যাখ্যা নেই।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, প্রকৃতিতে একমাত্র মানুষের ক্ষেত্রেই আবেগ থেকে চোখের পানি আসে, যা আবার সাধারণ চোখের পানি থেকে আলাদা।[18] এতে ২৪% বেশি প্রোটিন, লিউসিন-এঙ্কেফালিন, প্রোল্যাক্টিন এবং ACTH হরমোন রয়েছে। কান্নার সময় এগুলো চোখের পানির সাথে বেরিয়ে আসে। এই হরমোনগুলো মানুষের মানসিক চাপের জন্য দায়ী। একারণেই কান্নার পরে মানুষের মানসিক চাপ কমে যায়, মানুষ হালকা বোধ করে।[17]

চোখের আরেকটি চমকপ্রদ ঘটনা নিয়ে বলি। মানুষের চোখ প্রতি সেকেন্ডে ৩০-৭০বার কাঁপে। এই কাঁপাটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম: একটি কাগজ যতখানি পাতলা, তার ৭০ ভাগের ১ ভাগ যতখানি হয়, চোখ ততটুকু কাঁপে। এই অত্যন্ত সূক্ষ্ম মাপে কাঁপার কারণে চোখের কর্নিয়া এবং রেটিনা অত্যন্ত অল্প পরিমাণে সবসময় ঘুরতে থাকে এবং বাইরে থেকে আলো রেটিনার আলোক সংবেদনশীল কোষে বিভিন্ন দিক থেকে পড়তে থাকে। যদি তা না হতো, তাহলে আমরা যদি কোনো কিছুর দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকতাম, তাহলে মুহূর্তের মধ্যেই আমাদের দৃষ্টি থেকে সব রঙ চলে গিয়ে সাদা-কালো ছবি তৈরি করত। স্থির জিনিসটি যতক্ষণ না-নড়ত, ততক্ষণ আমরা আর তা শনাক্ত করতে পারতাম না। আমরা কখনও কোনো স্থির জিনিসের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে থাকতে পারতাম না, বার বার চোখ ঘুরাতে হতো অথবা আশেপাশের আলোর দিক বার বার পরিবর্তন করতে হতো।[16]

এসব জানার পরেও—

“কেমন করে তোমরা আল্লাহকে অস্বীকার/অবিশ্বাস করো [অকৃতজ্ঞ হও]? যখন তোমরা নিষ্প্রাণ ছিলে তারপর তিনি তোমাদের প্রাণ দিয়েছিলেন।…”

মৃত্যুর পরে কি কবরের জীবন আছে?

এই আয়াত থেকে কেউ কেউ দাবি করেছেন যে, মৃত্যুর পরে কবরের জীবন নেই। কারণ আল্লাহ تعالى বলছেন তিনি মানুষকে দুবার জীবন দেন, একবার এই পৃথিবীতে এবং আরেকবার কিয়ামাতে—

“যখন তোমরা নিষ্প্রাণ ছিলে তারপর তিনি তোমাদের প্রাণ দিয়েছিলেন (পৃথিবীর জীবন)। তারপর তিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন, তারপর তিনি তোমাদের পুনরায় প্রাণ দিবেন (কিয়ামতের দিন), তারপর তার কাছেই তোমাদের ফেরত যেতে হবে।”

এর মধ্যে কবরের জীবনের কোনো উল্লেখ নেই। কিন্তু সূরা গাফিরে বলা আছে—

তারা বলবে, “ও প্রভু, আপনি আমাদেরকে দুই বার মৃত করেছেন এবং দুই বার জীবন দিয়েছেন। এখন আমরা আমাদের পাপ বুঝতে পেরেছি। এখান থেকে মুক্তি পাবার কোনো উপায় কি আর নেই?” [গাফির ৪০:১১]

বাকারাহতে বলা আছে ‘তোমরা নিষ্প্রাণ ছিলে’ এবং সূরা গাফিরে বলা আছে ‘আমাদেরকে দুই বার মৃত করেছেন’—যা দুটি ভিন্ন ব্যাপার নির্দেশ করে। ‘নিষ্প্রাণ থাকা’ আর ‘মৃত করা’ আলাদা ব্যাপার, কারণ মৃত করতে হলে আগে জীবন থাকতে হবে। সুতরাং ধারণা করা হয় যে, দুই বার মৃত করা বলতে, প্রথম বার পৃথিবীর জীবন থেকে মৃত করা এবং দ্বিতীয় বার কবরের জীবন থেকে মৃত করা বোঝানো হয়েছে।[৭]

বিঃদ্রঃ হে বিবর্তনবাদীরা: আপনারা যারা এই আর্টিকেল পড়ে কমেন্ট করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছেন, অনুগ্রহ করে আপনার এবং আমার সময় নষ্ট করবেন না। আপনার যা বলার নিচের এই রেফারেন্সগুলোর লেখকদেরকে বলুন।

ডারউইন এর বিবর্তনবাদের বিপক্ষে লেখা কিছু উল্লেখযোগ্য বইঃ

বিঃদ্রঃ হে বিবর্তনবাদীরা: আপনারা যারা এই আর্টিকেল পড়ে কমেন্ট করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছেন, অনুগ্রহ করে আপনার এবং আমার সময় নষ্ট করবেন না। আপনার যা বলার উপরের এই রেফারেন্সগুলোর লেখকদেরকে বলুন।

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Exit mobile version