কুরআনের কথা

তারা মানুষের কাছে হাত পাতেন না — আল-বাক্বারাহ ২৭৩

তোমাদের দান সেই অভাবীরা পাবে, যারা আল্লাহর পথে এমনভাবে নিবেদিত যে, তারা জীবিকার খোঁজে বের হতে পারে না। তারা মানুষের কাছে হাত পাতেন না দেখে অজ্ঞরা মনে করে যে, তাদের কোনো অভাব নেই। কিন্তু তুমি তাদের লক্ষণগুলোর দিকে খেয়াল করলে বুঝতে পারবে। তারা কখনও নাছোড়বান্দার মতো চায় না। আর তোমরা ভালো যা কিছুই দান করবে, আল্লাহ অবশ্যই সে ব্যাপারে সব জানেন। [আল-বাক্বারাহ ২৭৩]

কিছু মানুষ আছেন যারা আল্লাহর রাস্তায় নিজেদেরকে পুরোপুরি বিলিয়ে দেন। এরা এমন সব ত্যাগ স্বীকার করেন, যেগুলো আমরা সাধারণ মুসলিমরা করার মতো সাহস কখনও করতে পারি না। এদের অনেকে নিজেদের ভিটেমাটি, সচ্ছল জীবন ছেড়ে দূর দেশে চলে যান ইসলামের জন্য পড়াশুনা করতে। আবার অনেকে হারাম চাকরি বা ব্যবসা আর করবেন না, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে শুধুই আল্লাহকে খুশি করার জন্য চাকরি বা ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে অভাবের জীবন বেছে নেন। আবার অনেকে এলাকায় অন্যায় শাসন, দুর্নীতি এসব থেকে পালিয়ে সৎভাবে বেঁচে থাকার জন্য সব ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যান। এভাবে আল্লাহর تعالى পথে নিজেদেরকে পুরোপুরি নিবেদিত করে দেওয়ার ফলে তাদের পক্ষে আর জীবিকা অর্জন করে সচ্ছলভাবে জীবন যাপন করার সুযোগ থাকে না। তারা অত্যন্ত অভাবের মধ্যে জীবন পার করতে থাকেন, কিন্তু আশেপাশের কাউকে সেটা নিজে থেকে বুঝতে দেন না।[১১][১২][১৪][১৭]

এই ধরনের মানুষরা ভিখিরি নন। তারা কখনও মানুষের কাছে হাত পাতেন না। তাদের ভেতরে আত্মসম্মান বোধ আছে। সাধারণ ফকিরের মতো মানুষের কাছে গিয়ে তাদের অভাব নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করেন না। এঁদেরকে দেখে আমরা অনেক সময় ভাবি, “অভাব থাকলে তো সে চাইতই। কিছু চাচ্ছে না যখন, তাহলে নিশ্চয়ই টাকাপয়সা ভালোই আছে। নিশ্চয়ই কোনো পার্ট টাইম কাজ করে যেটা আমি জানি না। না হলে হয়ত গ্রামে জমি জমা আছে, যেখান থেকে ভালোই ইনকাম হয়।” —যারা এরকম ভাবে আল্লাহ تعالى তাদের জন্য এই আয়াতে কঠিন একটা শব্দ ব্যবহার করেছেন —জাহিল।

আমরা যারা আমাদের আশেপাশে আল্লাহর تعالى প্রতি নিবেদিত মানুষদের দেখে তাদের অভাবের কথা চিন্তা করি না, তাদেরকে আল্লাহ تعالى জাহিল অর্থাৎ অজ্ঞ,  বিবেকহীন, মূর্খ বলেছেন। যারা পরিষ্কার দেখতে পায় যে, কিছু মানুষ আল্লাহর تعالى পথে নিজেদেরকে পুরোপুরি বিলিয়ে দিয়েছেন, কোনো জীবিকা অর্জনের ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তারপরেও মুখে কিছু চাইছেন না দেখে তাদেরকে গিয়ে কোনো ধরনের সাহায্য করে না, এই ধরনের অবিবেচক মানুষদেরকে আল্লাহ تعالى জাহিল বলে ডেকেছেন। আল্লাহর تعالى সম্মানিত বান্দারা কখনই মানুষের কাছে হাত পাতবেন না, এটাই স্বাভাবিক। তাদের আত্মসম্মান বোধ আছে। তারা তো রাস্তার ফকির নন? কিন্তু তারা মুখ ফুটে কিছু বলছেন না দেখে, আমরা তাদেরকে পাশ কাটিয়ে যাবো, একবারও গিয়ে তাদের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করবো না, কোনো ধরনের সাহায্য করা যায় কিনা দেখবো না, এটা কোনো বিবেক বুদ্ধির মানুষের পক্ষে করা সম্ভব? শুধু মূর্খরাই পারে এতটা অবিবেচক হতে।

কিন্তু তুমি তাদের লক্ষণগুলোর দিকে খেয়াল করলে বুঝতে পারবে

এই ধরনের অভাবী মানুষরা ছেঁড়া কাপড় পরে তাদের অভাবের কথা সবাইকে দেখিয়ে বেড়ান না। এরা যতটা সম্ভব নিজেদের সম্মান বজায় রেখে সমাজে ঘোরাফেরা করেন। তাদের আত্মসম্মান বোধ তাদেরকে বাঁধা দেয় নিজেদের দুরবস্থার অবস্থা অন্যদেরকে বুঝতে দিতে। কিন্তু বিবেকবান মানুষরা তাদের দিকে তাকালেই বুঝতে পারেন যে, তারা কতটা কষ্টে আছেন। তাদের কষ্টের ছাপ তাদের চোখে মুখে থাকে। তাদের খাবারের প্লেটের দিকে তাকালেই বোঝা যায় তারা কীসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের পরিবারের অবস্থা দেখলেই বোঝা যায় তাদের জন্য আমাদের কী করা উচিত। আয়াতের এই অংশে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, আমাদের ভেতরে চেষ্টা থাকতে হবে খেয়াল করার। আশেপাশে অভাবী মানুষেরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আর আমরা তাদের দিকে ভালো করে খেয়াল না করে নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত আছি, অপেক্ষা করছি কে আমার কাছে এসে সাহায্য চাইবে —এটা কোনো বিবেকবান মুসলিমের লক্ষণ হতে পারে না। মসজিদে ঢুকি, নামাজ পড়ি, বের হয়ে যাই। একবারও আশে পাশে মানুষগুলোর চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখি না: কার চেহারায় কষ্টের ছাপ লেগে আছে, কার চেহারায় অসুস্থতা, কে গত এক মাস ধরে একই কাপড় পরে মসজিদে আসছে। এই মানসিকতা জাহিলদের মানসিকতা।

তারা কখনও নাছোড়বান্দার মতো চায় না

সাধারণ ভিক্ষুকরা আমাদের পেছনে ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকবে। আমাদের পথ আগলিয়ে রাখবে। কিন্তু এই ধরনের অভাবী মানুষেরা কখনই সেটা করবেন না। তারা হয়ত বড়জোর একবার দুইবার আমাদেরকে তাদের কষ্টের কথা বলবেন। হয়ত সরাসরি না বলে ইঙ্গিতে বলবেন। আশা করবেন আমরা তাতেই বুঝে যাবো। আমরা যদি বুঝতে না পারি, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ঘটনাটা বারবার বলবেন না। চুপচাপ চলে যাবেন। তাদের আত্মসম্মানবোধকে তারা কখনও অভাবের কাছে পরাজিত হতে দেন না। এরা সম্মানিত মানুষ। আল্লাহ تعالى তাদেরকে এক পরীক্ষা দিয়েছেন, তারা সেই পরীক্ষা মেনে নিয়ে পার করছেন।

ইসলামে ভিক্ষাবৃত্তিকে ঘৃণা করা হয়। পেশাদার ভিক্ষুকদের চাইতে যারা ইসলামের কাজে নিবেদিত, ছাত্র, ছাত্রী, আলিম, এবং চাইতে পারেন না এমন অভাবীদের খুঁজে বের করে দান করতে হবে। ঈমানদারদের গুণ হলো তারা অভাবে থাকার পরেও ভিক্ষা করে না।[১৭] কারও কাছে অল্প রুপার সমান সম্পদ থাকার পরেও যদি সে ভিক্ষা করে, তাহলে সে ঘৃণিত।[১৪] কারও কাছে যদি দুপুরে এবং রাতে খাওয়ার কিছু না থাকে, তাহলে সে ভিক্ষা চাইতে পারে। কিন্তু এরপরেও যদি সে না চায়, তাহলে সেটা বরং বেশি ভালো। কারণ রিজিকের মালিক আল্লাহ।[১৪] কিন্তু কেউ যদি না চাইতেই কিছু পায়, যেমন কোনো উপহার, বা কোনো সহৃদয় ব্যাক্তি নিজে থেকেই দান করে, তাহলে সেটা গ্রহণ করতে দোষের কিছু নেই।[১৪] কিন্তু যে সবসময়ই মানুষের কাছে ভিক্ষা চায়, কিয়ামতের দিন তার মুখ ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় থাকবে।[১৭][১৪][১২]

আর তোমরা ভালো যা কিছুই দান করবে, আল্লাহ অবশ্যই সে ব্যাপারে সব জানেন

এই সব সম্মানিত বান্দাদেরকে আমরা যেন সস্তা, পরিত্যাক্ত কিছু না দেই। ফ্রিজের বাসি খাবার, পুরনো কাপড় যেগুলো নিজেরা পরে বাইরে যাওয়ার কথা চিন্তাও করবো না, মানিব্যাগের যত খুচরা, ভাংতি টাকা যেগুলো গুণতে কষ্ট হয় —এই সব দেওয়ার কথা যেন চিন্তাও না করি। আয়াতটি আল্লাহ تعالى শেষ করেছেন ‘তোমরা ভালো যা কিছুই দান করবে’। তিনি تعالى কিন্তু বলেননি, ‘তোমরা যা কিছুই দান করবে’। ভালো কিছু দান করার কথা তিনি تعالى বিশেষভাবে মনে করিয়ে দিয়েছেন।

আমরা তাদেরকে যা কিছুই দিবো, আল্লাহ تعالى সে ব্যাপারে অবশ্যই জানবেন। এই কথাটা আমরা দুইভাবে দেখতে পারি। আমরা যদি নিজেদের জীবনে কিছু কষ্ট মেনে নিয়ে, কিছু ত্যাগ স্বীকার করে তাদেরকে কিছু দেই, তাহলে আল্লাহ تعالى আমাদের ত্যাগের কথা অবশ্যই জানবেন। তিনি تعالى তার জন্য আমাদেরকে বিরাট প্রতিদান দেবেন। এই সম্মানিত মানুষদের মুখে হাঁসি ফোটানোর প্রতিদান কত বড় হতে পারে, সেটা আমরা চিন্তাও করতে পারবো না। আর আমরা যদি তাদেরকে সামান্য কিছু দিয়ে দায়সারা কাজ করে বিদেয় করে দেই, তাহলেও আল্লাহ تعالى অবশ্যই জানবেন আমরা কী করলাম।

[১] বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর। [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ। [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি। [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী। [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি। [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী। [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ। [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ। [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস। [১৪] তাফসির আল কুরতুবি। [১৫] তাফসির আল জালালাইন। [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ। [১৭] তাফসীর আহসানুল বায়ান — ইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সউদি আরব [১৮] কু’রআনুল কারীম – বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর — বাদশাহ ফাহাদ কু’রআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স। [১৯] তাফসির আল-কাবির। [২০] তাফসির আল-কাশ্‌শাফ।

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Exit mobile version