কুরআনের কথা

এসবের মধ্যে বিবেক-বুদ্ধির মানুষদের জন্য অবশ্যই বিরাট নিদর্শন রয়েছে — আল-বাক্বারাহ ১৬৪ পর্ব ১

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বুদ্ধিমান মানুষদের চিন্তা করার জন্য কিছু নিদর্শন দিয়েছেন। তিনি تعالى বলছেন যে, যদি মানুষ বুদ্ধিমান হয়, তাহলে এই ব্যাপারগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে মানুষ এই উপসংহারে পৌঁছাবেই: আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ থাকতেই পারে না।

আকাশ এবং পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিন-রাতের পরিবর্তনে, মানুষের জন্য পণ্য নিয়ে সমুদ্রে ভেসে চলা জাহাজে, আকাশ থেকে আল্লাহর পাঠানো পানিতে, যা মৃত জমিকে আবার প্রাণ দেয়, এর মধ্যে সব ধরণের প্রাণীকে ছড়িয়ে দেয়, বাতাসের পরিবর্তনে এবং আকাশ এবং পৃথিবীর মাঝখানে মেঘের নিয়ন্ত্রিত চলাচলে —এসবের মধ্যে বিবেক-বুদ্ধির মানুষদের জন্য অবশ্যই বিরাট নিদর্শন রয়েছে। [আল-বাক্বারাহ ১৬৪]

এই আয়াতে একটি খুবই শক্তিশালী বাণী রয়েছে। আল্লাহ تعالى কে —তা তিনি শুধু কু’রআন, হাদিসের বাণীর মাধ্যমেই আমাদেরকে জানাননি, আমাদের চারপাশের এই বিশাল জগতের মধ্যে পরিষ্কারভাবে তাঁর تعالى পরিচয় ছড়িয়ে রয়েছে। তাঁকে জানার জন্য যে, আমাদের শুধু হালাক্বাতে গিয়ে লেকচার শোনা, মসজিদে গিয়ে খুতবা শোনা, বা শুধু ধর্মীয় বই পড়তে হবে তা নয়, তাঁর এই বিশাল সৃষ্টিজগৎ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে, পৃথিবী ঘুরে দেখলে, আকাশ নিয়ে চিন্তা করলে, আমরা তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারবো। আল্লাহর تعالى আয়াত ءَايَٰت—যার অর্থ নিদর্শন—দুই ভাবে আমাদের কাছে এসেছে: ১) তাঁর পাঠানো বাণীর মাধ্যমে, এবং ২) তাঁর সৃষ্টিজগতের মাধ্যমে।[১] যারা বুদ্ধিমান, তারা সৃষ্টিজগতের মধ্যেই আল্লাহর পরিচয় تعالى খুঁজে পায়। তাঁর একত্ব এবং মহত্ত্ব উপলব্ধি করে বিস্ময়ে মাটিতে লুটিয়ে যায়।

তবে এখানে আল্লাহ تعالى শুধুই বুদ্ধিমান মানুষদের কথা বলেননি। يَعْقِلُونَ অর্থ যারা বুদ্ধি খাটায়, যা عقل আক্বল থেকে এসেছে। আক্বল অর্থ কোনো কিছু বেধে নিয়ন্ত্রণে রাখা, যেমন উট দড়ি দিয়ে বেধে রাখা, যেন পালিয়ে না যায়। নিজের রাগ, ঘৃণা, হিংসা, আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রেখে নিরপেক্ষভাবে বুদ্ধি ব্যবহার করা হচ্ছে আক্বল।[১]

মানুষের অনেক বুদ্ধি থাকতে পারে। কিন্তু সেই বুদ্ধিকে যদি লাগাম দেওয়া না হয়, তখন সেই বুদ্ধি থেকে ভয়াবহ সমস্যা তৈরি হয়। মানুষ তখন সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণী হয়ে যায়। তাই বুদ্ধিমান হওয়া মানেই যে একজন ভালো মানুষ হওয়া, তা নয়। যেমন, অনেক মেধাবী, বুদ্ধিমান কিশোর, তরুণদের আমরা দেখেছি: বড় হয়ে তাদের বুদ্ধিকে কাজে লাগায় যত সব খারাপ কাজে। এরা তাদের বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে বের করে যে, চিনির সাথে চিনির মতো দেখতে সার মেশালে, কম খরচে চিনির ওজন বাড়ানো যায়, ব্যবসায় লাভ হয়। তারপর মিষ্টি, কেক, বিস্কিট তৈরি হয় এই কম দামি বিষাক্ত চিনি দিয়ে। সেই বিষাক্ত সার খেয়ে যে মানুষের ভয়ঙ্কর সব সমস্যা হয়, ছোট বাচ্চাদের শরীর যে সারাজীবনের জন্য নষ্ট হয়ে যায়, সেটাতে তাদের কিছু যায় আসে না।

যে তার বুদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে, তার বুদ্ধিকে ভালো কাজে লাগাতে পারে, বুদ্ধি ব্যবহার করে নিজেকে খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখতে পারে, কু’রআনের ভাষায় তারাই বুদ্ধিমান। কু’রআনে যত জায়গায় আক্বল অর্থাৎ বুদ্ধিমান মানুষদের কথা এসেছে, সব জায়গায় এমন সব মানুষদের বোঝানো হয়েছে, যাদের বিবেক তাদের বুদ্ধিকে লাগাম দিয়ে রাখে। এদের বুদ্ধি তাদের কুপ্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণে থাকে না।

উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, এই আয়াতে আল্লাহ تعالى যেই সাতটি নিদর্শন নিয়ে আমাদেরকে চিন্তা করতে বলেছেন, তা বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ শাখাগুলোকে ইঙ্গিত করে—

এই আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল ১৪০০ বছর আগে এক মরুভূমির জাতির কাছে, যাদের বিজ্ঞান বলে কিছু ছিল না। তারা শুধু নিজের চোখে আশেপাশের জগৎ দেখে উপলব্ধি করতো এই আয়াতে কী বলা হয়েছে। তাই দেখা যাক, একজন সাধারণ মানুষ, কোনো ধরণের বিজ্ঞানের জ্ঞান ছাড়াই, শুধুই পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কীভাবে এই আয়াতের স্বাদ উপভোগ করতে পারে।

১) আকাশ এবং পৃথিবীর সৃষ্টিতে

আগে যখন বিদ্যুতের আলো ছিল না, বায়ু দূষণ ছিল না, তখন অন্ধকার পরিষ্কার রাতে আকাশ হতো এক কল্পনাতীত সুন্দর ছবির ক্যানভাস। আমাদের ছায়াপথ এবং মহাবিশ্বের কোটি কোটি তারায় ভরা রাতের আকাশ দেখে, যে কারো মনে সৃষ্টিজগতের সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হতো। যারা সময় নিয়ে, মুগ্ধ হয়ে, রাতের এই অসাধারণ সুন্দর, সুশৃঙ্খল আকাশের ছবি, অনন্ত নক্ষত্র বীথি দেখতেন, গভীরভাবে চিন্তা করতেন: কীভাবে এটা তৈরি হলো? কীভাবে এটা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে? কীভাবে এটাকে এত সুন্দর করে সাজানো হয়েছে? —তাদের পক্ষে অনুধাবন করা কঠিন হতো না যে, এর পেছন এক অসীম সৃজনশীল, প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী কেউ রয়েছেন। যিনি একাই এটি তৈরি করেছেন এবং যিনি একাই সবসময় এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করছেন।

যদি সৃষ্টিকর্তা একজন না হয়ে একাধিক হতেন, বা সৃষ্টিকর্তার পাশাপাশি একাধিক সত্তা থাকত, যাদেরকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে মহাবিশ্বের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, মহাবিশ্বের ডিজাইন করার জন্য, তাহলে রাতের আকাশ কখনো এত সুষম, সুশৃঙ্খল হতো না। আকাশের এক পাশের ডিজাইন থাকত এক রকম, আরেক পাশের ডিজাইন থাকতো একেবারেই আরেক রকম। এছাড়া একাধিক সত্তার একই ক্ষমতা থাকলে এবং তাদের মধ্যে ভিন্ন শিল্পী মনোভাব থাকলে, তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সৃষ্টিজগতে মধ্যে প্রকাশ পেত। আমরা তখন আকাশ এবং পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখতে পেতাম যে, সেখানে একেবারেই ভিন্ন ধরনের, পুরোপুরি বিপরীত ধরণের নানা সৃষ্টি রয়েছে। আকাশে একদিকে তাকিয়ে দেখতাম নক্ষত্র, আরেক দিকে তাকিয়ে হয়তো দেখতাম লতাপাতা ছড়িয়ে আছে, আরেক দিকে তাকিয়ে হয়তো দেখতাম চারকোনা, গোলাকার, ত্রিভুজ ভেসে বেড়াচ্ছে। তারপর দেখতাম ক্রমাগত সেগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছে। এক স্রস্টা, আরেক স্রষ্টার কাছ থেকে জমি দখল করে নিজের আধিপত্য বিস্তার করার জন্য মারামারি করছে।

কিন্তু এরকম কিছুই আমরা দেখতে পাই না। বরং আকাশ এবং পৃথিবীর যেদিকেই তাকাই, সেদিকেই আমরা একই মূল ধারার ডিজাইন, একই শিল্পীর ছোঁয়া দেখতে পাই। অকল্পনীয় বৈচিত্র্য রয়েছে আমাদের আশেপাশের সৃষ্টিজগতে। কিন্তু তারপরেও এই বিশাল বৈচিত্র্যের মাঝে আমরা একজন শিল্পীরই স্বাক্ষর খুঁজে পাই।

কু’রআনে আল্লাহ تعالى কমপক্ষে ৬৪টি আয়াতে আমাদেরকে সৃষ্টির ঘটনা নিয়ে বলেছেন। আকাশ এবং পৃথিবীর সৃষ্টি নিয়ে যেসব বিজ্ঞানের শাখা কাজ করে তা হচ্ছে — মহাকাশ বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান, সৃষ্টিতত্ত্ব। ১৪০০ বছর আগে আজকের আধুনিক বিজ্ঞানের এই শাখাগুলো ছিল না। তাই সেই যুগের মানুষদের ভাষায় আল্লাহ تعالى আমাদেরকে বলছেন যে, বিজ্ঞানের এই শাখাগুলো নিয়ে গবেষণা করতে। কারণ এর মধ্যে বিবেক-বুদ্ধির মানুষদের জন্য ছোটখাটো নিদর্শন নয়, বরং বিরাট নিদর্শন রয়েছে।

আমরা মনে করি ইসলাম মানে হচ্ছে সুর করে কু’রআন তিলাওয়াত করা, সাহিহ হাদিসের বই পড়া, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, রোজা রাখা, যাকাত দেওয়া — এধরনের জ্ঞান অর্জনের মধ্যেই ইসলাম সীমাবদ্ধ। অথচ কু’রআনে কমপক্ষে ৬৪ বার আল্লাহ تعالى আমাদেরকে সৃষ্টি নিয়ে তথ্য দিয়েছেন। সৃষ্টি নিয়ে জানাটা, গভীরভাবে চিন্তা করাটা তাঁর কাছে কতটা গুরুত্ব রাখে রাখে যে, তিনি কু’রআনে এত জায়গা বরাদ্দ করেছেন এই বিষয়ে!

২) দিন-রাতের পরিবর্তনে

কু’রআনে কমপক্ষে ৪২ বার আল্লাহ تعالى আমাদেরকে দিন এবং রাতের ব্যাপারে বলেছেন। আমাদের বোঝা দরকার কেন দিন এবং রাতের পরিবর্তন এত গুরুত্বপূর্ণ।

রাত হওয়াটা একটা বিরাট ঘটনা। আমরা যেই গ্যালাক্সিতে আছি, সেই গ্যালাক্সিতেই বিশ হাজার কোটির বেশি তারা আছে। আর এই রকম অকল্পনীয় সংখ্যার তারা নিয়ে তৈরি বিশাল বিশাল গ্যালাক্সি আছে হাজার হাজার কোটি। আমরা আকাশের যে দিকেই তাকাই না কেন, প্রতিটি বিন্দুতেই অসংখ্য তারা রয়েছে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে: কেন আকাশের প্রতিটি বিন্দু জ্বল জ্বল করছে না?

মহাবিশ্ব এত প্রচণ্ড বেগে সম্প্রসারিত হচ্ছে যে, আমাদের ছায়াপথ থেকে অনেক ছায়াপথ আলোর থেকেও বেশি দ্রুত বেগে দূরে সরে যাচ্ছে। যদি তা না হতো, তাহলে আকাশের প্রতিটি বিন্দুতে আমরা নক্ষত্র থেকে আসা আলো দেখতে পেতাম। পুরো আকাশের প্রীতিটি বিন্দু নক্ষত্রের আলোতে জ্বল জ্বল করতো, কোথাও কোনো অন্ধকার থাকতো না। আজকে আমরা রাতের আঁধার উপভোগ করতে পারছি, কারণ মহাবিশ্ব প্রতি মুহূর্তে আলোর গতিবেগের থেকেও বেশি জোরে সম্প্রসারিত হচ্ছে। একারণে আকাশের অনেক জায়গায় এখনো নক্ষত্র থেকে ছুটে আসা আলোর রশ্মি আমাদের কাছে পৌঁছুতে পারেনি। সেই জায়গাগুলো একারণেই অন্ধকার।[৩০০]

যদি দিনরাত সমান হতো, তাহলে কোনো ঋতু থাকতো না। আজকে আমরা যে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত, হেমন্ত, শীত, বসন্ত ঋতু উপভোগ করছি, তার কারণ দিন-রাতের দৈর্ঘ্য পরিবর্তন হয়। এর কারণ পৃথিবী নিজের কক্ষের উপর একটু কাত হয়ে আছে। যার কারণে কয়েক মাস পৃথিবীর উত্তর ভাগ সূর্যের দিকে হেলে, আর কয়েক মাস দক্ষিণ ভাগ সূর্যের দিকে হেলে। কেউ যদি ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখে কেন দিন-রাতের দৈর্ঘ্য পরিবর্তন হয়, কেন সূর্য দুটি পূর্ব প্রান্তের মধ্যে উদয় হয় এবং দুটি পশ্চিম প্রান্তের মাঝে অস্ত যায়, তাহলে সে বুঝবে যে, এখানে বিরাট রহস্য রয়েছে।[৩০১]

যদি দিন-রাত একই ছন্দ বজায় রেখে প্রতি বছর পরিবর্তন না হতো, তাহলে পৃথিবীর আবহাওয়ায় বিরাট পরিবর্তন হতো। যদি রাতের পরিমাণ বেশি হতো, তাহলে পৃথিবী আস্তে আস্তে শীতল হতে হতে বরফে ঢেকে যেত। আবার যদি দিনের পরিমাণ বাড়তে থাকতো, তাহলে পৃথিবী আস্তে আস্তে গরম হতে হতে, উত্তর দক্ষিণ মেরুর বরফ গলে, সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে, বেশিরভাগ দেশ সমুদ্রে তলিয়ে যেত।

উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য খাবার তৈরি করার শক্তি যোগায় সূর্যের আলো। সূর্যের আলো ব্যবহার করে সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে উদ্ভিদ খাবার তৈরি করে। আর এই প্রক্রিয়া থেকে অক্সিজেন তৈরি হয়, যা সকল প্রাণী নিঃশ্বাসের মাধ্যমে নেয়। দিনের আলো না থাকলে কোনো উদ্ভিদ বেঁচে থাকতো না। কোনো উদ্ভিত না থাকলে, কোনো প্রাণী বেঁচে থাকতো না। এই বিশাল প্রাণী জগৎ এবং মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পৃথিবীতে তৈরি হয়েছে উদ্ভিদের  সালোক সংশ্লেষণের কারণে।

একইসাথে রাত না থাকলেও উদ্ভিদ এবং প্রাণী জগৎ টিকে থাকতো না। অনেক উদ্ভিদের ফুল এবং ফল হওয়ার জন্য রাত প্রয়োজন। একইসাথে প্রাণীদের বিশ্রামের জন্যও রাত প্রয়োজন। ক্রমাগত দিনের আলো প্রাণীর দেহের জন্য ক্ষতিকর এবং রাতে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম নিতে না পারলে জটিল প্রাণ টিকে থাকতে পারতো না।

যদি ক্রমাগত দিন হতো, তখন পৃথিবীর যে দিকে ক্রমাগত দিন থাকবে, সেদিক এত উত্তপ্ত হয়ে যাবে যে, সব পানি বাষ্প হয়ে যাবে। পানি না থাকলে কোনো প্রাণ টিকে থাকতে পারবে না। আর পৃথিবীর অপর প্রান্তে যে দিকে ক্রমাগত অন্ধকার থাকবে, সেদিকে শীতল হয়ে বরফে ঢেকে যাবে। মানুষের টিকে থাকার জন্য দিন এবং রাতের পরিবর্তন অত্যাবশ্যকীয়।

আল্লাহ تعالى অত্যন্ত সূক্ষ্ম হিসেব করে আমাদেরকে দিন-রাতের পরিবর্তন দিয়েছেন। যদি দিন-রাতের পরিবর্তনের এই বৈচিত্র্য এবং প্রতি বছর নিয়মিত ছন্দ বজায় না থাকতো, তাহলে পৃথিবীতে এত সুন্দর ঋতু, এত বৈচিত্র্যের প্রাণ থাকতো না। পৃথিবী কখনো মানুষের বাসের উপযোগী হতো না। দিন-রাতের পরিবর্তন পৃথিবীকে তৈরি করেছে যেন একদিন এখানে মানুষ থাকতে পারে।

৩) মানুষের জন্য পণ্য নিয়ে সমুদ্রে ভেসে চলা জাহাজে

কেন জাহাজ পানিতে ভাসে? এক টুকরা লোহাকে পানিতে ফেলে দিলে তা সাথে সাথে ডুবে যায়। অথচ লোহার তৈরি শত টনের বিশাল জাহাজ ঠিকই পানিতে ভেসে থাকে। শুধু নিজেই ভেসে থাকে না, একই সাথে শত শত গাড়ি, ট্রাক, হাজার হাজার মানুষ, লক্ষ লক্ষ ফলমূল নিয়ে সমুদ্রে ভেসে বেড়ায়। কীভাবে?

জাহাজ পানিতে ভেসে বেড়ানোর কারণ হচ্ছে পানির প্লবতা। যখন কোনো কিছু পানিতে ডোবানো হয়, তখন সে তার আয়তনের সমান পানি সরিয়ে দেয়। এখন সেই বস্তুটা কতখানি পানি সরিয়ে দিতে পারলো, তার উপর নির্ভর করে সেটা পানিতে ডুববে, নাকি ভেসে থাকবে। যদি কোনো বস্তুর ভর হয় ১ কেজি এবং তা পানিতে ফেললে ১ কেজি বা তার বেশি পানি সরে যায়, তাহলে তা ভেসে থাকবে। কিন্তু যদি তা এক গ্রাম পানিও কম সরায়, তাহলে তা ডুবতে থাকবে। জাহাজ বানানোর সময় এমন ভাবে তার ডিজাইন করা হয় যেন, তাকে পানিতে ফেললে তার নিজের ভরের থেকে অনেক বেশি ভরের পানি সরিয়ে দিতে পারে। একারণে জাহাজের ভেতরে অনেক ফাকা জায়গা থাকে, যেন তার ভরের তুলনায় তার আয়তন হয় অনেক বেশি।

পানির এই প্লবতার বৈশিষ্ট্য আল্লাহ تعالى যদি না দিতেন, তাহলে নদী, সমুদ্রে কোনো নৌকা, কোনো জাহাজ ভেসে চলতে পারতো না। নদী, সমুদ্রের পার ঘেঁষে সভ্যতা তৈরি হতো না। মানুষের সভ্যতার দ্রুত উন্নতির কারণ পানির এই অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। এমনকি প্লবতা না থাকলে  কোনো প্রাণী কখনো পানিতে ভেসে সাঁতার কাটতেও পারতো না। সমস্ত স্থলচর প্রাণীর জন্য যে কোনো জলাশয় মৃত্যু ফাঁদ হয়ে যেত। আজকে এত বৈচিত্র্যের প্রাণী যে টিকে আছে, তার কারণ পানির প্লবতা।

পানি পথ একটি দেশের সমৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত জরুরি। কারণ পানি পথে সবচেয়ে কম খরচে মাল পরিবহন করা যায়। স্থল বা আকাশ পথে ভারি মালামাল আনা নেওয়া করা অনেক বেশি ব্যায় বহুল। একারণেই আমরা দেখি যে, যে সমস্ত দেশ পানিপথকে কাজে লাগাতে পেরেছে, সফল নৌবন্দর এবং নৌপথ তৈরি করতে পেরেছে, তারা অত্যন্ত ধনী দেশ হয়ে গেছে। যেমন: সিঙ্গাপুর অত্যন্ত ধনী দেশ, কারণ এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ এবং এর নৌবন্দর ১২৩টি দেশে মাল পরিবহনে ব্যবহার হয়। এই দেশটিতে প্রাকৃতিক সম্পদ, ভূমি না থাকার পরেও এই এক নৌবন্দরকে কাজে লাগিয়ে এটি বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক এবং স্বচ্ছল দেশগুলোর একটি হয়ে গেছে।

(চলবে)

সূত্র:

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Exit mobile version