কুরআনের কথা

দেখবে, এরা তাদের জীবনটাকে অন্য সবার থেকে বেশি কামড়ে ধরে থাকতে চায় — আল-বাক্বারাহ ৯৪-৯৬

আজকে যদি আমাকে ডাক্তার বলে: আপনার রক্তে ক্যান্সার ধরা পড়েছে এবং আপনি আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মারা যাবেন, সিঙ্গাপুরে গিয়েও লাভ হবে না—আমি তখন কী করব? আমি কি তখন কাঁথা জড়িয়ে টিভির সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফালতু তারকা শো, টক শো, হিন্দি সিরিয়াল দেখব? আমি কি পরদিন অফিসে গিয়ে কলিগদের সাথে শেষ বারের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মারব? আমি কি আমার ছেলেমেয়েকে শেষ বারের মতো একটু খুশি করার জন্য ভিডিও গেম কিনে দেব, যেখানে তারা রামদা-ছুরি নিয়ে একপাল অর্ধ মৃত, রক্তাক্ত জম্বিকে মেরে কোনো এক বিকৃত কারণে বড়ই আনন্দ পায়? আমি কি এই অবস্থায় আমার মেয়েকে নৃত্য শিল্পী বানাব, ছেলেকে ব্যান্ডের দলে যোগ দেওয়াব, যেন তারা সেগুলো করে আমার মৃত্যুর পরে আমার জন্য ‘অশেষ সওয়াব’ অর্জন করে?

না, আমরা তখন এগুলোর কিছুই করব না, কারণ জীবনের শেষ দিনগুলি এভাবে নষ্ট করার মতো বোকামি আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু আজকে আমরা ঠিকই সেগুলো করে যাচ্ছি এটা ভালো করে জেনে যে: আমরা আজকে হোক, কালকে হোক, একদিন না একদিন মারা যাবই। তারপর একসময় আমাদেরকে আবার জাগিয়ে তোলা হবে এবং তারপর আমাদেরকে ধরে নিয়ে বিশ্বজগতের সর্বোচ্চ ক্ষমতাবানের সামনে দাঁড় করানো হবে: আমাদের জীবনের প্রতি মুহূর্তের হিসাব দেওয়ার জন্য। সেদিন তাঁর সামনে মাথা নিচু করে আমরা তাঁকে কী বলব—সেটা ঠিক করে রেখেছি কি?

কোনো কারণে আমরা এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি চিন্তা করতে চাই না। এরকম চিন্তা মাথায় এলেই আমাদের কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। আমরা দ্রুত চিন্তার টপিক পাল্টে ফেলি। যদি আমাদের কোনো বন্ধু বা আত্মীয় আমাদেরকে এই ব্যাপারটি নিয়ে কিছু বলা শুরু করে, আমরা জলদি তাকে বলি, “কি বলছেন এইসব! আস্তাগফিরুল্লাহ! এই সব মরা-টরার কথা শুনতে ভালো লাগছে না। বাদ দেন এইসব। আসেন অন্য কিছু নিয়ে কথা বলি।”

বলে দাও, “যদি আখিরাতের জীবনটা আল্লাহর সান্নিধ্যে তোমাদের জন্যই হয়ে থাকে, অন্য কারো জন্য না হয়, তাহলে এখনই মরে যেতে চাচ্ছ না কেন? তোমরা না বড়ই সত্যবাদী?” [আল-বাক্বারাহ ৯৪]

আমরা কোনো এক অদ্ভুত কারণে নিজেদেরকে একধরনের সেলফ ডিলিউশনে ডুবিয়ে রাখি যে, আগামী কয়েক সেকেন্ড পরে আমি যে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যাব না, বা কালকে যে আমি বাসায় ফেরার পথে অ্যাকসিডেন্ট করে মারা যাব না—এ ব্যাপারে আমি একশ ভাগ নিশ্চিত। আল্লাহর সাথে আমার একধরনের চুক্তি আছে: তিনি আমাকে সত্তর-আশি বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখবেনই।

আর মরার পরে কোনো চিন্তা নেই। আল্লাহর تعالى সাথে দেখা হবে। তিনি দুই চারটা শাস্তি দিয়ে আমাকে ছেড়ে দেবেন। তারপর জান্নাতে আমাকে আর পায় কে! বাকি জীবনটা পার্টি করে পার করে দেব।

এই যদি আমাদের ধারণা হয়, তাহলে তো আমরা এখন মরে গেলেই পারি। কষ্ট করে এই দুনিয়ায় আর বেঁচে থেকে লাভ কি? আজকে থেকে প্রতিদিন সকালে উঠে আমরা আল্লাহর تعالى কাছে দু’আ করলেই পারি, “ও আল্লাহ, আমাকে আজকেই নিয়ে যান। আমি এখন জান্নাতে যাওয়ার জন্য রেডি।” এত কষ্ট করে পড়ালেখা করে, চাকরি করে; ক্যারিয়ার, গাড়ি, বাড়ি, জমির জন্য দিনরাত গাধার মত চেষ্টা করে লাভ কী? আমাদের জন্য না জান্নাতের টিকেট বুকিং করা আছে?

যারা কু’রআন কখনো পুরোটা একবারও অর্থ বুঝে পড়ে, গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেননি, ইসলাম সম্পর্কে তারা নিজেদের ভেতরে একটা ধারণা করে নিয়েছেন। তাদের কাছে ইসলাম হচ্ছে: জীবনে যত খারাপ কাজ করেছি, তার জন্য কিছু সময় জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে, তারপর জান্নাতে গিয়ে পার্টি আর পার্টি। অনেকের মধ্যে একটা ধারণা আছে: যারা নামে মুসলিম (ঈমান না থাকলেও), তারা সবাই জান্নাতে যাবেই। পাপের জন্য কয়েকটা দিন হয়ত জাহান্নামে শাস্তি পেতে হবে। তারপর জান্নাতে গিয়ে সব ভুলে যাবে। তাই এই দুনিয়ায় যে পাপ করছি, সেটা কোনো ব্যাপার না। একদিন না একদিন তো জান্নাতে যাবই। “হাজার হোক, আমার নাম আব্দুল্লাহ। আমার পাসপোর্টে ধর্ম লেখা আছে ‘ইসলাম’। আমি মুসলিম দেশে জন্মেছি! আমি জান্নাতে যাব না তো যাবে কে?”[১৬৮]

খ্রিস্টান এবং মুসলিমদের বিশ্বাসের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য হলো— খ্রিস্টানরা মনে করে যিশু তাদের সব পাপ নিয়ে নিয়েছেন। তারা এখন নিষ্পাপ। স্বর্গে তারা যাবেই। আর একজন মুসলিম মনে করে জান্নাতে যাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা তার নেই। সে যতই ভালো কাজ করুক, আল্লাহ تعالى তার কোন কাজটার জন্য তার উপর রেগে আছেন, যার জন্য সে কিয়ামতের দিন জান্নাত হারিয়ে ফেলবে —সেটা সে কোনোভাবেই বলতে পারে না। একারণে একজন মুসলিম সবসময় মনে রাখে যে, তাকে তার জীবনের কুকীর্তিগুলোর জন্য সবসময় আল্লাহর تعالى কাছে মাফ চাইতে হবে, এবং যত বেশি সম্ভব ভালো কাজ করতে হবে। কবে তার ভালো কাজগুলো তাকে জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়ে জান্নাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট হবে —সেটা সে জানে না। তাই যতক্ষণ শ্বাস আছে, ভালো কাজ করে যাওয়ার জন্য প্রতি মুহূর্তে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে।

কিন্তু যাদের ইসলামের জ্ঞান এখনও ঠিকমত হয়নি এবং জীবনের বাস্তবতা নিয়ে তাদের কোনো হুঁশ নেই, এরা প্রতিদিন তিনটা হিন্দি সিরিয়াল দেখে। প্রতি সপ্তাহে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মার্কেটে ঘুরে বেড়ায়। বন্ধু বান্ধব নিয়ে প্রত্যেক মাসে কয়েক রাত পার্টি করে। কাজের ফাঁকে যতটুকু সময় পায় ফেইসবুকের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। বাসায় ফিরে ঘণ্টা খানেক ভিডিও গেম, টিভিতে খেলা দেখা। তারপর কম্পিউটারে একটা মুভি দেখা। তারপর বিছানায় শুয়ে ফোনে খোশ গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে যাওয়া।

এরা মোটামুটি নিশ্চিত: এই মুহূর্তে জান্নাতে তাদের বাড়িটা তাদের জন্য ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করা রাখা হচ্ছে। তাই এই জীবনটা যতটা পারা যায় আমোদ ফুর্তি করে পার করি। তারপর আল্লাহকে تعالى বুঝিয়ে শুনিয়ে জান্নাতে চলে যাওয়া যাবে। জাহান্নামের শাস্তি তাদের মতো অল্প পাপী মানুষদের জন্য না। হাজার হোক, তারা তো আর চুরি, খুন, ধর্ষণ — এইসব করে বেড়াচ্ছে না। তারা কেন জান্নাতে যাবে না?

যদি তাই হয়, তাহলে এই দুনিয়াতে বসে থেকে তারা খামোখা সময় নষ্ট করছে কেন? জান্নাতে গিয়ে তারা কি হাজার গুন বেশি আরামে থাকবে না?

এরা কোনোদিনও সেটা চাইবে না, কখনই না। কারণ, এদের হাত এদের জন্য কী কামাই করে রেখেছে এরা ঠিকই জানে। আল্লাহ এই সব অন্যায়কারীদেরকে ভালো করে চেনেন। [আল-বাক্বারাহ ৯৫]

যারা সারাজীবন কুকর্ম করেছে, ঘুষ খেয়ে বিরাট সম্পত্তির মালিক হয়েছে, দুর্নীতি করে বিদেশের ব্যাংক একাউন্টে কোটি কোটি টাকা সরিয়েছে, প্রতিদিন ড্রিঙ্ক না করে রাতে ঘুমাতে যায় না —এরা কোনোদিনও মরতে চাইবে না। যেভাবেই হোক দুনিয়া কামড়ে ধরে, হাজারো মানুষের জীবন শেষ করে, যত পারে মানুষের সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে, সিঙ্গাপুরে গিয়ে প্রতি বছর নষ্ট শরীর সার্ভিসিং করে, যেভাবেই হোক বেঁচে থাকার চেষ্টা করবেই। মুখে যতই বড় বড় কথা বলুক, মানুষের সামনে যতই টাকার গরম দেখিয়ে চলুক না কেন, প্রতিদিন রাতে এরা ভয়ে ভয়ে ঘুমাতে যায়: আগামীকাল সকালে যদি আর জেগে না ওঠে?

আর কেনই বা তারা মরতে চাইবে? আগামী জীবনের জন্য তারা কিছু কি সঞ্চয় করেছে যে, তারা মরতে চাইবে? ঘুমের থেকে ওঠার পর থেকে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত এদের সমস্ত কাজ, সমস্ত সঞ্চয় হচ্ছে এই দুনিয়াতে ভোগ করার জন্য। এদের আখিরাতের ব্যাংক ব্যাল্যান্স তো শূন্য। এরা আখিরাতে কোন সাহসে যেতে চাইবে? এরা দুনিয়ায় যতই হাসিখুশি, চকচকে মসৃণ চেহারা দেখাক না কেন, ভেতরে ভেতরে এরা খুব ভালো করে জানে: কী সর্বনাশ তারা করে ফেলেছে। একারণে তারা সবসময় চায়—

দেখবে, এরা তাদের জীবনটাকে অন্য সবার থেকে বেশি কামড়ে ধরে থাকতে চায়। এমনকি যারা শির্‌ক করে, তাদের থেকেও বেশি। এদের সবাই চায় তাকে যেন হাজার বছর আয়ু দেওয়া হয়। কিন্তু সেই লম্বা জীবন এদেরকে সামনের শাস্তি থেকে একটুও বাঁচাবে না। আল্লাহ খুব ভালোভাবে দেখছেন এরা কী করছে। [আল-বাক্বারাহ ৯৬]

দেখবে, এরা তাদের জীবনটাকে অন্য সবার থেকে বেশি কামড়ে ধরে থাকতে চায়

চৌধুরী সাহেব বিশাল পরিমাণের ঘুষ খাইয়ে একটা সরকারি প্রজেক্টের কন্ট্রাক্ট হাতালেন। এর জন্য তিনি মন্ত্রীকে গুলশানে দুইটা ফ্ল্যাট কিনে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিলেন। তারপর ব্যাংকের লোণ নিয়ে জোগাড় করা সেই বিশাল অংকের ঘুষ, সুদ সহ শোধ করতে গিয়ে, এবং মন্ত্রীকে কথা দেওয়া দুইটা ফ্ল্যাটের টাকা উঠানোর জন্য শেষ পর্যন্ত তাকে প্রজেক্টের অনেক টাকা এদিক ওদিক সরিয়ে ফেলতে হলো। দুই নম্বর সস্তা কাঁচামাল সরবরাহ করতে হলো। যোগ্য কনট্রাক্টরদের কাজ না দিয়ে অযোগ্য, সস্তা কনট্রাক্টরদের কাজ দিতে হলো, যারা কিনা তাকে প্রচুর ঘুষ খাওয়ালো।

এরপর একদিন তার প্রজেক্ট ধ্বসে পড়ল। তার নামে ব্যাপক কেলেঙ্কারি হয়ে মামলা হয়ে গেলো। মামলায় উকিলের টাকা জোগাড় করতে তাকে আরও বিভিন্ন উপায়ে টাকা মারা শুরু করতে হলো। তারপর কয়েকদিন পর পর তাকে পুলিশ ধরতে আসে, আর তিনি পুলিশের উপরের তলার লোকদের ঘুষ খাইয়ে পুলিশকে হাত করে ফেলেন। প্রজেক্টে দুর্নীতির কারণে ভুক্তভুগি মানুষদের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাকে অনেক টাকা খরচ করে কিছু ‘সোনার ছেলে’ পালতে হয়। তারা মাঝে মাঝেই খুন, ধর্ষণ করে, হোটেলে থেকে … করে এসে বিরাট বিল ধরিয়ে দেয়। তারপর তাদেরকে যখন পুলিশ ধরতে আসে, তিনি পুলিশকে টাকা খাইয়ে তাদেরকে রক্ষা করেন। এত দুশ্চিন্তার মধ্যে তিনি রাতে কোনোভাবেই ঘুমাতে পারেন না। দুশ্চিন্তা ভুলে থাকার জন্য তাকে নিয়মিত মদ খাওয়া ধরতে হয়। তারপর বছরে দুই বার সিঙ্গাপুরে হাসপাতালে গিয়ে শরীরটা ওভারহলিং করে নিয়ে আসেন। যত টাকাই লাগুক, জীবনটাকে আঁকড়ে ধরে নিজের অহংকার, সন্মান, সম্পত্তি, প্রতিপত্তি বজায় রেখে তিনি বেঁচে থাকেবেনই। এর জন্য যা কিছুই করতে হয়, যতই নিচে নামতে হোক না কেন, কিছুই যায় আসে না।

যারা শির্‌ক করে, তারা অন্তত এইটুকু জানে যে, একদিন আল্লাহর تعالى সামনে তাদের এক কঠিন বিচার হবে। এই জন্য তারা নানা ধরনের পীর, দরবেশ, মোল্লা, হুজুর, হাজি সাহেবের কাছে তদবির করে। তাদেরকে বিরিয়ানি খাওয়ায়। মাসে মাসে বখশিশ দিয়ে আসে, যেন একদিন তাদের সুপারিশে তারা জান্নাতে চলে যেতে পারে। এরা জান্নাতে যাওয়ার ভালোই চেষ্টা করে। একারণে এরা চৌধুরী সাহেবদের মতো অতটা নিচে নামে না।

শুধু চৌধুরী সাহেব টাইপের মানুষরাই জীবনটাকে এভাবে কামড়ে ধরে থাকে না। অনেক সময় দেখবেন, বিশেষ ভদ্র মুসলিম ভাই, যার গুলশানে এক বিশাল বাড়ি, বাড়ির সামনে তিনটা নতুন মডেলের বিশাল গাড়ি। ঢাকার বাইরে বিঘা বিঘা জমি। তিনি তার এয়ারকন্ডিশন্ড বিশাল ড্রয়িং রুমে, কয়েক লাখ টাকার মখমলের সোফায় বসে আপনাকে গম্ভীর মুখে বলবে, “ভাই, আমার এই বাড়িটা আমার জন্য যথেষ্ট। আমি এই বাড়িতেই সারাজীবন থাকতে চাই। আমার জান্নাত-টান্নাতের দরকার নেই।”

সূত্র:

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Exit mobile version