কুরআনের কথা

এত কিছুর পরেও তোমাদের অন্তর পাথরের মতো কঠিন হয়ে গেছে — আল-বাক্বারাহ ৭২-৭৪

এই তিনটি আয়াতে আমরা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার শিখব: মানুষের জীবনে নানা ধরনের সমস্যা আসে, যেগুলো তাকে ধাক্কা দেয়, যেন সে নিজেকে পরিবর্তন করে, অন্যায় করা বন্ধ করে। কিন্তু তারপরেও অনেক মানুষ অন্যায় করতে করতে একসময় তাদের অন্তর পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়। অন্যায় তখন তাদের কাছে আর অন্যায় মনে হয় না। তারা তাদের নিজেদের ভুলগুলোকে নিয়ে আর ভেবে দেখে না। কেউ তাদেরকে সেই ভুলগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও, সে উপলব্ধি করে না। উপলব্ধি করলেও, নিজেকে পরিবর্তন করার মতো ইচ্ছা তাদের থাকে না।

আজকের যুগের একটি উদাহরণ দেই—

চৌধুরী সাহেব একটা সরকারি প্রোজেক্টে ঘুষ খেতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলেন। তার চাকরি চলে গেল। তিনি বছরের পর বছর ধরে বেকার। পরিবারের খরচ দিতে গিয়ে জমি-জমা বিক্রি করে নিঃস্ব হওয়ার মতো অবস্থা। একসময় তিনি তার প্রতিবেশীর অনেক অনুরোধে নামাজ পড়া শুরু করলেন। তিনি আল্লাহর কাছে বার বার ক্ষমা চাইলেন, যেন আল্লাহ তাকে আরেকবার সুযোগ দেন। এক বছর পর তিনি একটা বিদেশি কোম্পানিতে ভালো বেতনে চাকরি পেলেন।

দুই বছর পরের ঘটনা: চৌধুরী সাহেব সেই বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি করার সময় কোম্পানির খরচে বিদেশে গিয়ে অবৈধভাবে থেকে গেলেন। তারপর শুরু হলো হাজারো আইনগত সমস্যা। একটা সমস্যা কাটাতে গিয়ে তাকে আরেকটা অন্যায় করতে হয়, একে ওকে টাকা খাওয়াতে হয়, কাগজপত্র জাল করতে হয়। তার নিকট আত্মীয়রা তাকে বার বার বোঝালেন, যেন তিনি নিজেকে শোধরান। এভাবে দুই নম্বরি করে অশান্তিতে আর কতদিন থাকবেন? চৌধুরী সাহেব শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি তার লোভ সংবরণ করবেন, যতটুকু সম্ভব হালাল উপায়ে চলার চেষ্টা করবেন।

তিন বছর পরের ঘটনা: চৌধুরী সাহেব নানা ভাবে কাগজ জালিয়াতি করে, ভুয়া ডিগ্রি দেখিয়ে বহাল তবিয়তে বিদেশে বাস করছেন। শুধু তাই না, তিনি তার চৌদ্দ গুষ্টিকে দুই নম্বরি করে বিদেশে নিয়ে এসেছেন। এখন তার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা। সাত মাস পর চেকআপ করতে গিয়ে ডাক্তার বললেন, “এক ভয়ংকর জটিলতা দেখা দিয়েছে: হয় মা বাঁচবে, না হয় সন্তান। তাদেরকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে: কাকে তারা বাঁচাতে চান?”

এরপর থেকে চৌধুরী সাহেব বার বার নামাজে কাঁদেন, “ও আল্লাহ! আমার স্ত্রী এবং সন্তানকে এবারের মতো বাঁচিয়ে দিন। আমি এখন থেকে নিষ্ঠার সাথে ধর্ম মানব, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ব, পরের বছরই হাজ্জ করতে যাব।” খুব শীঘ্রই তার মুখে ঘন দাঁড়ি, কপালে সিজদার দাগ, ঘন ঘন রোজা রাখতে দেখা গেল।

দুই মাস পর ডেলিভারি হলো। কোনো এক অদ্ভুত কারণে মা এবং সন্তান দুজনেই বেঁচে গেলেন। চৌধুরী সাহেব এবং তার স্ত্রী আনন্দে, কৃতজ্ঞতায় চোখের পানি ফেলেন, এবং সন্তানের চেহারার দিকে দিন-রাত অবাক হয়ে পরম শান্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকেন।

এক বছর পরের ঘটনা: চৌধুরী সাহেবের হারাম লোন নিয়ে কেনা বাড়িতে বাচ্চার জন্মদিনের পার্টি হচ্ছে। রঙ বেরঙের পানীয়, টিভিতে প্রায় নগ্ন গায়িকার গানের ভিডিও চলছে। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, ছেলে-মেয়ে সবাই মাখামাখি করে নাচানাচি করছে। চৌধুরী সাহেবের স্ত্রী এক আপত্তিকর পশ্চিমা কাপড় পড়ে তার বন্ধুদের সামনে ঘোরাঘুরি করছেন। এদিকে চৌধুরী সাহেব চকচকে চোখে বন্ধুর গার্লফ্রেন্ডের দিকে তাকিয়ে আছেন…

এত কিছুর পরেও তোমাদের অন্তর পাথরের মতো কঠিন হয়ে গেছে — না তারচেয়েও কঠিন। কারণ পাথরের মধ্যেও এমন পাথর আছে: যা ফেটে নদী ছুটে বের হয়; কিছু পাথর আছে যাকে ভাঙ্গলে তা থেকে পানি বের হয়; আর কিছু পাথর আছে, যা আল্লাহর ভয়ে নীচে পড়ে যায়। তোমরা কী করো, তা আল্লাহর অজানা নয়। [আল বাক্বারাহ ৭৪]

ডিসেন্সিটাইজেশন — প্রতিক্রিয়াহীন, অনুভূতিহীন হয়ে যাওয়া

সাইকোলজির ভাষায় এভাবে ধীরে ধীরে প্রতিক্রিয়াহীন, অনুভূতিহীন হয়ে অন্তর শক্ত হয়ে যাওয়াকে ‘ডিসেন্সিটাইজেশন’ বলে। মানুষ যখন একটা খারাপ জিনিস প্রথম বার দেখে, সে আঁতকে উঠে বলে, “আস্তাগফিরুল্লাহ! একি দেখলাম! ছি ছি!” এরপর সে যখন আবার সেটা দেখে, সে ভাবে, “নাহ! এরকম করা উচিত না।” তারপর আবার যখন দেখে, “কী আর করা যায়। সবসময় কি ভালো হয়ে চলা যায়? এই জীবনে চলতে গেলে একটু-আকটু পাপ সহ্য করতে হবেই।”

তারপর একদিন সে সেই খারাপ কাজ নিজে করার জন্য উসখুস করতে থাকে। একসময় সে সেটা করে ফেলে এবং সাথে সাথে অত্যন্ত অনুতপ্ত হয়। কিন্তু কয়েকদিন পর সে আবার করে। এবার তার অনুতাপ কমে যায়। তারপর আবার, এবং আবার। একসময় সেই খারাপ কাজ করাটা তার জন্য স্বাভাবিক হয়ে যায়। কেউ তখন তাকে বার বার বোঝালেও সে শোনে না। বরং উল্টো রেগে গিয়ে বলে, “আপনারা সব তালেবান হয়ে যাচ্ছেন। এই সব মান্ধাতা আমলের চিন্তা ভাবনা আজকের যুগে চলে না। আমি একা না করলে কী হবে, এটা আজকে সবাই করছে।”

ডিসেন্সিটাইজেশনের ফলে মানুষের অন্তর কঠিন হয়ে যায়। আজকালকার টিভিতে এমন সব অশ্লীল, ভায়োলেন্ট ব্যাপার অহরহ দেখানো হয়, যা ২০ বছর আগে দেখলে আমরা আঁতকে উঠতাম। কিন্তু আজকে আমাদের কাছে এগুলো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। ২০ বছর আগের টিভি প্রোগ্রামগুলো সরাসরি কাউকে মাথায় গুলি করে মেরে ফেলা দেখানো হতো না। অথচ আজকে সেই মাথা, হাত, পা ছুরি দিয়ে কেটে আলাদা করে, রক্তের ফোয়ারা বের করে দেখানো হয়। আর আমাদের কিশোর-তরুণরা ভাবলেশহীনভাবে হাই তুলতে তুলতে সেই দৃশ্যগুলো তাকিয়ে দেখে।

আজকাল তারা এই ধরনের জঘন্য কাজ শুধু টিভিতে বসে দেখে-ই না, কম্পিউটার ছেড়ে ভিডিও গেমে গিয়ে এই কাজগুলো তারা নিজের হাতে করে। এরপর তারা যখন বড় হয়ে রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলোতে যোগ দেয়, মারামারি, ধর্ষণ করে, এমনকি খুনও করে — আমরা তখন অবাক হয়ে ভাবি: কীভাবে তারা এত খারাপ কাজ করতে পারল?

মনোবিজ্ঞানীরা একবার কয়েকজন ৮-১০ বছর বয়েসি বাচ্চাদের নিয়ে একটি গবেষণা করেছিলেন। বাচ্চাদের এক দলকে তারা ২০ মিনিট ভায়োলেন্ট ভিডিও গেম খেলতে দেন। আরেক দলকে তারা সাধারণ ভিডিও গেম খেলতে দেন। তারপর উভয় দলকে ১০ মিনিট ধরে সংবাদ চ্যানেলগুলো থেকে নেওয়া বাস্তব জীবনের যুদ্ধ, মারামারির কিছু ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়। তারপর তাদেরকে পরীক্ষা করে দেখা গেল: যেই দল ভায়োলেন্ট ভিডিও গেম খেলেছিল, তাদের রক্ত চাপ, চামড়ায় ঘামের পরিমাণে সে রকম কোনো পরিবর্তন হলো না। কিন্তু অন্য দলটি, যারা ভায়োলেন্ট ভিডিও গেম খেলেনি, তাদের উত্তেজনায় রক্ত চাপ বেড়ে গেল, আতংকে ঘেমে গেল। এ থেকে বোঝা গেল, ভায়োলেন্ট ভিডিও গেম খেলার ফলে প্রথম দলের বাচ্চাদের যুদ্ধ, মারামারি, খুনাখুনি দেখে আর সেরকম প্রতিক্রিয়া হয় না। তাদের কাছে সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে যায়। এই হলো মাত্র ২০ মিনিট ভায়োলেন্ট ভিডিও গেম খেলার ফলাফল![১৫৮]

এরপর এই দুই দলের বাচ্চাদের প্রত্যেককে একটা রুমে নিয়ে তাদের সাথে কিছু আলাপ করা হলো। আলাপের ফাঁকে হঠাৎ করে টেবিল থেকে কিছু একটা ফেলে দেওয়া হলো। যারা ভায়োলেন্ট ভিডিও গেম খেলেনি, তারা প্রায় সবাই ভদ্রতা বশত উঠে গিয়ে সেটা তুলে নিয়ে আবার টেবিলে রেখে দিলো। কিন্তু যারা মাত্র ২০ মিনিট ভায়োলেন্ট ভিডিও গেম খেলেছে, তাদের বেশির ভাগই সেটা দেখেও না দেখার ভান করল! মাত্র ২০ মিনিটের ভায়লেন্স তাদের ভেতরের সৌজন্যবোধ, অন্যদেরকে সন্মান করা অনেকখানি নষ্ট করে দিল![১৫৮]

একইভাবে আজ থেকে ২০ বছর আগে যেই ধরনের কাপড় শুধুমাত্র যৌন-কর্মীদেরকে রাতের বেলায় পড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত (যেমন: বাংলাদেশে ওড়না ছাড়া কামিজ; বিদেশে: শুধুই টাইট্‌স), যেন তারা খদ্দের ধরতে পারে, আজকে সেই একই পোশাক পড়ে ভদ্রঘরের মেয়েরা দিনে-রাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজকাল মেয়েদের কাপড় দেখে বোঝা মুশকিল সে কোনো যৌন কর্মী, নাকি কোনো ভদ্র ঘরের মেয়ে — সবারই পোশাক এক রকম। মিডিয়া এবং সংস্কৃতি খুব ধীরে ধীরে আমাদেরকে প্রতিক্রিয়াহীন, অনুভূতিহীন, ভোঁতা করে দিয়েছে। আজকাল মেয়েদেরকে এই সব পোশাক পড়তে দেখলে আমরা, “আস্তাগফিরুল্লাহ! ছি! ছি! এইটা কী পড়ে আছো?”, বলে আঁতকে উঠি না। যার ফলাফল: মেয়েদের কাপড় আস্তে আস্তে আরও টাইট, আরও ছোট হতেই থাকে। এভাবে আমাদের অন্তর কঠিন হতে হতে, একসময় পাথর হয়ে যায়, লজ্জা-হায়া সব লোপ পায়।

বনী ইসরাইলের অন্তর কঠিন হয়ে যাওয়া

বনী ইসরাইলকে আল্লাহ تعالى বার বার বাঁচিয়েছিলেন এবং অনেকবার তাদেরকে সুযোগ করে দিয়েছিলেন, যেন তারা নিজেদেরকে সংশোধন করতে পারে। তিনি تعالى প্রথমে তাদেরকে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর কিছু অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে ফিরাউনের বীভৎস অত্যাচার থেকে বাঁচালেন। কিন্তু মুক্তি পেয়ে একসময় তারা একটা সোনার বাছুরের মূর্তিকে পূজা করা শুরু করল। এর শাস্তি হিসেবে আল্লাহ تعالى তাদের প্রতিনিধিদেরকে এক ভীষণ বজ্রপাতে মেরে ফেলে আবার বাঁচিয়ে তুললেন, যেন তারা নিজেদেরকে সংশোধন করতে পারে।

আল্লাহ تعالى তাদেরকে আকাশ থেকে মানন, সালওয়া দিলেন, মরুভূমিতে পানির ব্যবস্থা করে সভ্যতা গড়ে তোলার সুযোগ করে দিলেন। কিন্তু তারপর যখন তাদেরকে তাওরাত অনুসরণ করতে বলা হলো, তারা নানা বাহানা করে একসময় দাবি করল যে, আল্লাহকে تعالى নিজের চোখে না দেখলে, নিজের কানে না শুনলে, তারা তাওরাত মানবে না।

আল্লাহ تعالى তাদেরকে শনিবারে মাছ ধরতে মানা করলেন, কিন্তু তারপরেও তারা নানা ভাবে চালাকি করে মাছ ধরা শুরু করল। তারপর আল্লাহ শাস্তি হিসেবে তাদের একটা দলকে বানর/গরিলা বানিয়ে দিলেন, যাতে করে অন্যরা তাদেরকে দেখে ভয়ে সাবধান হয়ে যায়।

তারপর আল্লাহ تعالى তাদেরকে যখন একটা গরু জবাই করতে বললেন, তারা বিভিন্ন ভাবে বাহানা করে নবী মূসাকে عليه السلام বার বার ঘুরিয়ে, সম্পূর্ণ অবান্তর সব প্রশ্ন করে, চালাকি করে দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করল। এভাবে আল্লাহ تعالى তাদেরকে সংশোধন করার সুযোগ করে দিলেন। কিন্তু তারপরেও তাদের অন্যায় করার অভ্যাস পরিবর্তন হলো না—

মনে করে দেখো, যখন তোমরা এক সত্তাকে হত্যা করেছিলে, এবং তা নিয়ে একে অন্যকে দোষ দিচ্ছিলে। যদিও আল্লাহ প্রকাশ করে দেন: তোমরা যা গোপন কর।[আল বাক্বারাহ ৭২]

এই আয়াতের ভাষা লক্ষ্য করার মতো। আল্লাহ বলেননি, “যখন তোমাদের কোনো একলোক তোমাদের একজনকে খুন করেছিল।” বরং তিনি এখানে, “তোমরা এক সত্তাকে হত্যা করেছিলে” বলে পুরো জাতিকে এই হত্যার জন্য দোষ দিয়েছেন।

হত্যা একটি জাতির ব্যর্থতা

যখন কারো হত্যা করার মতো ঘটনা ঘটে এবং সেটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে একে অন্যকে দোষ দেওয়া শুরু হয়, এবং হত্যাকারী কে, তা খুঁজে বের করা না যায় — তার মানে সেই জাতির শুধু নৈতিক অবক্ষয়ই হয়নি, একই সাথে তাদের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নষ্ট হয়ে গেছে।[১১] একারণেই আল্লাহ تعالى পুরো বনী ইসরাইল জাতিকে দোষ দিচ্ছেন: কীভাবে তোমরা একটি মহামূল্যবান প্রাণকে হত্যা করতে দিলে এবং হত্যাকারী নিজে থেকে এসে দোষ স্বীকার করা তো দূরের কথা, তাকে খুঁজেও পাওয়া গেল না? আর তোমরা একে অন্যকে দোষ দেওয়া শুরু করে দিলে, যেখানে তোমাদের দায়িত্ব ছিল হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার জন্য সবরকম চেষ্টা করা?

আজকালকার সংবাদপত্রগুলো খুললে প্রতিদিন কয়েকটি হত্যার ঘটনা দেখা যায়, যেখানে এক দল আরেক দলকে হত্যার দায় দেওয়ার চেষ্টা করছে। বছরের পর বছর ধরে এই ধরনের ঘটনাগুলোর তদন্ত হয় না, আসল হত্যাকারী কে ছিল, তা বেড়িয়ে আসে না। মাঝখান থেকে দলগুলো তাদের নিজ নিজ সংবাদমাধ্যম গুলোকে হাতিয়ে, অন্য দলের উপর সব দোষ চাপিয়ে দেয়। যেই মহামূল্যবান প্রাণটি হারিয়ে গেল, তার কোনো ফয়সালা হয় না।

আল্লাহ تعالى পুরো বনী ইসরাইল জাতিকে দোষ দিয়েছিলেন সেই মানুষটিকে হত্যা করে একে অন্যকে দোষ দেওয়ার জন্য। তাহলে আজকে প্রতিদিন আমরা কত হত্যার জন্য আল্লাহর কাছে দোষী হচ্ছি? এরপর যখন আমাদের উপর আল্লাহর গজব আসে, দেশে বন্যা, মহামারী, বার্ডফ্লু ইত্যাদি হয়, আমরা প্রশ্ন করি: “আমি কী করেছিলাম? আমি এই গজবের মধ্যে পড়লাম কেন?”

মানুষ নিছক একটি প্রাণী নয়

আরেকটি লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার হলো: আল্লাহ বলেননি, “তোমরা একজন মানুষকে হত্যা করেছিলে।” তিনি এখানে নফস, অর্থাৎ ‘সত্তা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এর মাধ্যমে বোঝা যায়: মানুষের জীবন কত মূল্যবান এবং হত্যা কত জঘন্য অপরাধ। মানুষ প্রাণীজগতের অন্যান্য প্রাণীর মতো শুধুই একটি উন্নততর প্রাণী নয় — যা সেকুলার বিজ্ঞানীরা প্রচার করার চেষ্টা করছে। মানুষ প্রথমত একটি সত্তা বা আত্মা, যা অন্যান্য প্রাণীর মতো রক্ত, মাংসের তৈরি দেহ থেকে উচ্চতর, সম্মানিত সৃষ্টি।[১১] একারণেই নিরীহ একজন মানুষকে হত্যা করাটা আল্লাহর দৃষ্টিতে পুরো মানব জাতিকে হত্যা করার সমান—

হত্যার বদলে হত্যা বা সমাজে চরম বিশৃঙ্খলা (দুর্নীতি, ক্ষয়ক্ষতি) ছড়ানোর প্রতিফল ছাড়া অন্য কোনো কারণে কেউ যদি একজনকেও হত্যা করে, তাহলে সে যেন মানবজাতির সবাইকে হত্যা করল। [আল-মায়িদাহ ৫:৩২]

আল-বাক্বারাহ’র এই আয়াতে আরেকটি লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার হলো: “এবং তা নিয়ে একে অন্যকে দোষ দিচ্ছিলে।” যখন তারা দেখল: তাদের মধ্যে কেউ একজন, তাদেরই একজনকে হত্যা করেছে — তখন তারা হত্যাকারীর অনুসন্ধান না করে, একে অন্যকে দোষ দেওয়া শুরু করল। এভাবেই শয়তান কাজ করে। সে সবসময় আমাদেরকে উস্কানি দেয়, যেন আমরা অন্যায়ের দোষ সবসময় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেই। কখনো যেন মনে না করি, এতে আমারও দোষ আছে।[১১]

আমার কোনো দোষ নেই!

দেশে তরুণ-যুবকদের মধ্যে মারামারি, খুনাখুনি বেড়ে চলছে? দোষ সরকারের। এলাকায় চুরি, ডাকাতি বেড়ে গেছে? দোষ পুলিশের। ছেলে মেয়েরা উচ্ছন্নে যাচ্ছে? দোষ সমাজের। নিজের ছেলেমেয়েরা আপত্তিকর পশ্চিমা কাপড় পরে সারাদিন রেস্টুরেন্টে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মাসে লক্ষ টাকার শপিং করছে, সারাদিন মিউজিকে বুঁদ হয়ে থাকছে? দোষ ওদের বন্ধু-বান্ধবের। দেশে ইসলামের শিক্ষা হারিয়ে গিয়ে দেশটা কুফফারদের দেশে পরিণত হচ্ছে? দোষ অমুক ইসলামী দলের এবং মাদ্রাসাগুলোর; দেশের আলেমরা কোনোই কাজের না ইত্যাদি।

“সব দোষ অন্য কারো না কারো। এখানে আমার নিজের কোনোই দোষ নেই!”

এই হচ্ছে শয়তানের কৌশল। সে আমাদেরকে শেখায়, “এখানে তুমি কী করবে? তোমার তো কোনো উপায় ছিল না: অন্য কোনো দলকে ভোট দিয়ে দেশের অবস্থার পরিবর্তন করার। অমুক দল ছাড়া আর কে আছে ভোট দেওয়ার মতো? তোমার তো কোনো উপায় ছিল না: তোমার ছেলেমেয়েদেরকে ভিডিও গেম, এমপিথ্রি প্লেয়ার, কেব্‌ল টিভির সংযোগ, চব্বিশ ঘণ্টা ইন্টারনেট এবং তাদের ঘরে ব্যক্তিগত কম্পিউটার — এই সবকিছু না দিয়ে থাকার। তোমার প্রতিবেশীর ছেলেমেয়েদের আছে না? তোমার তো কোনোই উপায় ছিল না: তাদেরকে ক্রেডিট কার্ড, মোবাইল ফোন না দিয়ে থাকার। তোমার বন্ধুরা তার ছেলেমেয়েদের দিচ্ছে না? তোমার তো কোনোই উপায় ছিল না: নিজে ইসলাম শিখে সন্তানদেরকে শেখানোর। তাহলে প্রতিদিন জিমে গিয়ে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যায়াম করে, পশ্চাৎ দেশের চর্বি কমাবে কীভাবে? তোমার কোনোই দোষ নেই। তুমি বেশি চিন্তা করো। যাও, বসে বসে টিভিতে সারারাত খেলা দেখো।”

নিজেদেরকে এভাবে ভুলভাল বুঝিয়ে লাভ নেই, কারণ এই আয়াতের শেষটা ভয়ঙ্কর সতর্কবাণী: “যদিও আল্লাহ প্রকাশ করে দেন তোমরা কী গোপন করছিলে।” আল্লাহ ভালো করেই জানেন আমরা নিজেদেরকে কী সব বুঝিয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে চলি। একদিন আল্লাহ تعالى এগুলো সব প্রকাশ করে দেবেন। এর অনেকগুলো হয়ত এই দুনিয়াতেই হবে। একদিন আমিই হয়তো হরতালের মারামারিতে পরে হাত-পা ভেঙ্গে হাসপাতালে পরে থাকব। একদিন আমারই বাড়িতে হয়তো ডাকাতি হয়ে সব চলে যাবে। একদিন আমারই ছেলে হয়তো ড্রাগ নিয়ে জেলে যাবে, মেয়েকে নিয়ে লুকিয়ে ক্লিনিকে যেতে হবে। নিজের চোখের উপরে টিভির রঙ্গিন পর্দা টেনে দিয়ে, কানের উপরে সুরেলা মিউজিক ঢেলে রেখে, সত্য থেকে পালিয়ে থাকার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। আল্লাহ تعالى সব বের করে দেবেন।

তারপর আমি বলেছিলাম, “একে (মৃত ব্যক্তিকে) ওর (জবাই করা গরুর) একটা অংশ দিয়ে আঘাত করো”: এভাবে আল্লাহ মৃতকে পুনরুজ্জীবিত করেন এবং তাঁর নিদর্শন তোমাদেরকে দেখান, যাতে করে তোমরা বিচার-বুদ্ধি ব্যবহার করতে পারো। [আল বাক্বারাহ ৭৩]

আল্লাহ تعالى মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করে দিলেন এবং সে বলে দিলো হত্যাকারী কে ছিল।[১]

মৃত্যুর পরে আবার জেগে উঠবো? অসম্ভব!

বনী ইসরাইল বিশ্বাস করত না যে, মৃত্যুর পরে আবার কেউ বেঁচে উঠতে পারে।[৯] একটা মানুষ মরে পঁচে মাটির সাথে মিশে গেল। তার শরীরের কোনো কিছুই অবশিষ্ট থাকল না। তার দেহের কয়েক ট্রিলিয়ন অণু-পরমাণু মহাবিশ্বে হারিয়ে গেল। কীভাবে তাকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব? বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে এটা একটা সম্পূর্ণ অসম্ভব, অবাস্তব ব্যাপার। কোনো ধরনের গাণিতিক সম্ভাবনার মধ্যে এই ঘটনাকে ফেলা যায় না। যেই জিনিস গাণিতিকভাবে সম্ভাব্য নয়, সেটা কখনই ঘটবে না — এই ধরনের কথা আজকাল অনেক শোনা যায়।

শূন্য থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হওয়া, নানা ধরনের অজৈব পদার্থের মিশ্রণে অ্যামাইনো এসিড থেকে প্রোটিন, আরএনএ, ডিএনএ তৈরি হয়ে প্রাণ সৃষ্টি হওয়া — এগুলো সবই গাণিতিকভাবে অসম্ভব ঘটনা।[১৫৯] কিন্তু তারপরেও আপনি-আমি সহ কয়েক ট্রিলিয়ন প্রাণ এই মহাবিশ্বে ঘোরাঘুরি করছি। আল্লাহ تعالى যদি সেটা করতে পারেন, তাহলে মানুষকে পুনর্জীবিত করা কি তার থেকে বেশি কঠিন কাজ? কোনটা বেশি কঠিন: শূন্য থেকে সবকিছু সৃষ্টি করা, নাকি সৃষ্টিকে এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় পরিবর্তন করা?

আল্লাহ تعالى একটি মৃত ব্যক্তিকে বাঁচিয়ে তাদেরকে দেখিয়ে দিলেন যে, কোনো কিছুই তার জন্য অসম্ভব নয়। তাঁর বেলায় বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা খাটে না। সেগুলো তাঁরই সৃষ্টি। যাদের চিন্তা ভাবনার ক্ষমতা সীমিত, তাদের পক্ষেই একজন স্রস্টার মতো কল্পনাতীত শক্তিশালী কোনো সত্তাকে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সীমার মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলার মতো অবাস্তব চিন্তা করা সম্ভব।

সূত্র:

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Exit mobile version