ওয়াশিংটন ডিসি। ইউনাইটেড নেশনসের কনফারেন্স চলছে। কীভাবে পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থার উন্নতি করা যায়: এনিয়ে অনেক বড় বড় উদ্যোক্তা এসেছেন বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে। WaterAid Sweden-এর চেয়ারম্যান দাঁড়ালেন বক্তৃতা দেওয়ার জন্য।[১০] তিনি তার সামনে রাখা একটা পানির গ্লাস হাতে তুলে বললেন–
This is a luxury, a dream for more than 800 million people in the world.
এটা একটা বিলাস সামগ্রী। আজকে পৃথিবীতে ৮০ কোটির বেশি মানুষ স্বপ্ন দেখে এটাকে পাওয়ার।
আল-বাক্বারাহ’র এই আয়াতটি আমাদেরকে পানি নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা শেখাবে—
মনে করে দেখো, যখন মূসা তার লোকদের জন্য পানির দু’আ করেছিল এবং আমি তাকে বলেছিলাম, “পাথরটাকে তোমার হাতের লাঠি দিয়ে বাড়ি দাও।” সাথে সাথে বারোটা পানির ঝর্ণা ফেটে বেরিয়ে আসলো। প্রত্যেক গোত্র ঠিকভাবে তাদের পানের জায়গা চিনে গেল। “খাও এবং পান করো, যা আল্লাহ তোমাদেরকে জোগান দিয়েছেন। আর কুকর্ম করবে না, দুনিয়াতে দুর্নীতি ছড়াবে না।”
বনী ইসরাইলের হাজার হাজার নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ নিয়ে তাদের বারোটি গোত্রের[৮] এক বিশাল কাফেলা মরুভূমিতে চলছে। নবী মূসা عليه السلام তাদেরকে ফিরাউনের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। তিনি তাদেরকে নিয়ে যাচ্ছেন এক নতুন দেশে, যেখানে তারা স্বাধীনভাবে থাকতে পারবে। কিন্তু যাত্রা পথে মরুভূমির গরমে পানির তেষ্টায় তাদের মারা যাওয়ার মতো অবস্থা।[৯] তখন তারা নবী মূসা عليه السلام-এর কাছে ছুটে গেল পানির জন্য। তিনি আল্লাহর تعالى কাছে দু’আ করলেন পানির জন্য। আল্লাহ تعالى তাকে একটা বিশেষ পাথরে তার লাঠি দিয়ে আঘাত করতে বললেন।[৪] সাথে সাথে পাথর ফেটে বারোটা আলাদা পানির ঝর্ণা তীব্র বেগে বের হয়ে আসলো।[৫] বনী ইসরাইলের বারোটি গোত্র সেটা দেখে বুঝে গেল তাদের প্রত্যেকের পানি সংগ্রহ করার জায়গা কোনটা।[৯]
এখানে একটা সূক্ষ্ম ভাষাগত ব্যাপার রয়েছে: এখানে আল্লাহ تعالى বলছেন ঝর্ণাগুলো ফেটে বেরিয়ে এসেছে। অথচ ঠিক আগের বাক্যেই তিনি বলেছেন: নবী মুসা عليه السلام-কে লাঠি দিয়ে বাড়ি দিতে। এই বাক্যে তিনি ‘কর্তার’ পরিবর্তন করেছেন আমাদের বুঝিয়ে দিতে যে, ঝর্ণা ফেটে বেরিয়ে আসার কাজটি তিনি নিজেই করেছেন এবং এটি যে তাঁর একটি অলৌকিক নিদর্শন, নবী মুসা عليه السلام-এর নয়, সেটি নিয়ে যাতে কারো কোনো সন্দেহ না থাকে। আল্লাহ تعالى এভাবেই প্রত্যেক নবী-রাসূলকে عليه السلام কিছু চমকপ্রদ নিদর্শন দিয়েছেন, যা অলৌকিক। এগুলোকে মু’যিজা বলা হয়।
আল্লাহ تعالى যদি প্রতিটি গোত্রের পানি নেওয়ার জায়গা পরিস্কার করে বুঝিয়ে না দিতেন, তাহলে তাদের মধ্যে পানি নিয়ে মারামারি লেগে যেত।[৮][৯] পানি এক মহামূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। পরিষ্কার পানির উৎসকে ঘিরে জনবসতি গড়ে ওঠে, শহর, কারখানা তৈরি হয়। আল্লাহ تعالى যখন বনী ইসরাইলিদেরকে আলাদা ভাবে প্রত্যেক গোত্রের জন্য পানির ঝর্ণার ব্যবস্থা করে দিলেন, তিনি আসলে তাদেরকে সেখানে স্থায়ী জনবসতি তৈরি করার ব্যবস্থা করে দিলেন, যাতে করে তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। বহু বছর বনী ইসরাইলিরা সেই পানির উৎসকে ঘিরে তাদের সভ্যতা টিকিয়ে রেখেছিল।
পরিস্কার পানির ব্যবসা আজকে পৃথিবীতে অন্যতম লাভজনক ইনভেস্টমেন্ট, যার স্টক মার্কেটে ইনডেক্স-এর বৃদ্ধির হার গত কয়েক বছরে তেল এবং সোনাকে ছাড়িয়ে গেছে।[১২]
আজকের অর্থনীতিতে নিরাপদ পানি হচ্ছে ‘তরল সোনা’, যার মোট বাজার দর ২০২৫ সালের মধ্যে ২০ ট্রিলিয়ন ডলার হতে যাচ্ছে, যা পুরো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির মূল্য থেকেও বেশি![১৩] আগামী ২৫ বছরের মধ্যে দেশগুলো তাদের সমুদ্র বন্দর, রেল ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের পিছনে মোট যত অর্থ খরচ করবে, তার থেকে বেশি অর্থ খরচ করতে হবে পরিষ্কার পানির জন্য।[১৩] সারা পৃথিবীতে ব্যবহারযোগ্য পানির অভাব এত ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে যে, বিশেষজ্ঞদের মতে আগামী বড় যুদ্ধ আর তেল নিয়ে হবে না, হবে পানি নিয়ে।[১৮]
ময়লা পানি পান করে অসুখে প্রতি বছর প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষ মারা যায়, যা কিনা দুই বছরের মধ্যে ঢাকা শহরের সব মানুষ মারা যাওয়ার সমান।[১১] পৃথিবীতে আজকে প্রায় ৭৮ কোটি মানুষ পরিষ্কার পানি পায় না– পুরো বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৫ গুণ মানুষ![১১] পৃথিবীর প্রতি তিন জন মানুষের মধ্যে একজনের, প্রায় ২৫০ কোটি মানুষের ন্যূনতম পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থাও নেই।[১৩] আজকে আমরা শহরের বাড়িতে থেকে বাথরুমে কল ছাড়লেই পানি পাই, যেখানে গরিব অঞ্চলগুলোতে, বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলোতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় আধা ঘণ্টা হাঁটতে হয়[১৯] একটু পানির জন্য। সেই পানি এমন ময়লা যে, আমরা কখনো সেটা পান করার কথা চিন্তাও করব না।
এরপর আপনি যখন এক গ্লাস পানি হাতে নিয়ে পান করতে যাবেন, একটা বার ভালো করে তাকিয়ে দেখবেন। এইটুকু পরিষ্কার পানি আজকে পৃথিবীতে ৮০ কোটি মানুষ দিনরাত কষ্ট করেও যোগাড় করতে পারছে না। অথচ আল্লাহ تعالى আপনার জীবনে কত বড় একটা নি’আমত দিয়েছেন।
পানি শুধু পানের জন্যই নয়, বরং আমাদের খাদ্য তৈরিতে এবং গবাদি পশুর জন্য প্রয়োজন। মাত্র ১ টন গম তৈরিতে ১০০০ টন পানি দরকার হয়।[১৫] গবাদি পশু থেকে এক কেজি মাংসের জন্য তাদেরকে সাত কেজি শস্য খাওয়াতে হয়, অর্থাৎ এক কেজি মাংসের জন্য দরকার প্রায় ৭০০০ লিটার পানি।[১৫] প্রতিদিন একজন মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার তৈরিতে গড়ে ২০০০ লিটার পানি দরকার হয়, বছরে ৭৩০,০০০ লিটার।[২০] মাত্র একটা রুটির জন্য যথেষ্ট আটা/ময়দা তৈরি করতে লাগে ৪০ লিটার পানি।[১৮] একটা মাত্র বার্গার তৈরির সব মালমসলা তৈরি করতে ২৪০০ লিটার পানি লাগে।[১৮] একটা জিন্সের প্যান্ট তৈরিতে দরকার হয় ২৯০০ গ্যালন পানি।[১৬] মানুষের মাত্রাতিরিক্ত ভোগ, আধুনিক মেশিন ব্যবহারের কারণে পানির ব্যবহার আজকে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে আমাদের সন্তানেরা পানি নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার অনেক সম্ভাবনা আছে।
বাংলাদেশে পানির সমস্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইন এবং পানির অধিকার ভেঙ্গে ভারতের তৈরি করা ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা নদীর পানির নাব্যতা ৭০% কমে গেছে।[২১] পলিপ্রবাহ কমে আশেপাশের জমির উর্বরতা কমে গেছে। বড় নদীগুলো দিয়ে কার্বন প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে যায়, যা গ্রিন হাউস এফেক্ট থেকে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া প্রতিরোধ করে। পদ্মা নদীতে সেই কার্বন প্রবাহ ৩০% কমে গেছে।[২১] নদীতে ফাইটোপ্লাঙ্কটন ৩০% কমে গেছে, যা নদীর মাছের খাদ্য এবং একই সাথে বায়ুতে অক্সিজেন সরবরাহ করে। যার ফলে ৩৫ বছর আগের তুলনায় আজকে পদ্মা নদীতে মাত্র ৩৫% মাছ পাওয়া যায়।[২১] ইলিশ মাছ প্রায় শেষ।[২২] একই সাথে বঙ্গোপসাগরে ফাইটোপ্লাঙ্কটন সরবরাহ কমে যাওয়াতে সাগরে মাছ উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে সুন্দরবনে পলি ও পানিপ্রবাহ ব্যহত হওয়ায় সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিলুপ্তির হুমকিতে পড়েছে।[২১]
পদ্মার পানিপ্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় উত্তর অববাহিকায় বিশেষ করে রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জে ভূগর্ভস্থ পানির প্রথম স্তর ১৫ ফুট নিচে নেমে গেছে। খরার মৌসুমে প্রথম স্তর থেকে সেচ তো দূরের কথা, পান করার পানিও উত্তোলন করা যাচ্ছে না। মৌসুমি বৃষ্টি এই স্তরে পানি পুনরায় সরবরাহ করেও কুলিয়ে উঠতে পারছে না। এভাবে চলতে থাকলে এই এলাকাগুলো একসময় মরুভূমিতে পরিণত হবে।[২১]
একটি দৈনিক পত্রিকার রিপোর্ট[২৩], যা ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের বিশেষজ্ঞদের গবেষণা থেকে তৈরি করা হয়েছে, আমাদেরকে এক ভয়ঙ্কর সত্য জানিয়ে দিয়েছে—
সর্বশেষ তথ্য অনুসারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞগণ একমত হন যে, বাংলাদেশের আর্সেনিক দূষণের ব্যাপকতা নজিরবিহীন। পৃথিবীর আর কোনো দেশে আর্সেনিকের এত ব্যাপক দূষণ আর কখনো দেখা যায়নি। বিভিন্ন তথ্যমতে, বর্তমানে ২ থেকে ৫ কোটি মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করায় বাংলাদেশের জনসাধারণ আর্সেনিক সংক্রান্ত পানিসমস্যার প্রত্যক্ষ ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। এছাড়াও ২ লাখেরও অধিক মানুষের শরীরে ইতিমধ্যে আর্সেনিক আক্রান্ত রোগের বিভিন্ন উপসর্গ প্রকাশ পেয়েছে।
প্রতিবেশী দেশ ভারত গঙ্গাসহ হিমালয় থেকে উৎপন্ন বাংলাদেশের ভেতরে প্রবাহিত সকল নদীতে বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিয়েছে এবং বাংলাদেশের সাথে সম্পৃক্ত সকল নদীর পানি ৩০টি খালের মাধ্যমে শুকনো মৌসুমে ভারতের উঁচু ও মরু অঞ্চলে নিয়ে যাচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে দেশ এখন মারাত্মক বিপর্যয়ের দিকে এগুচ্ছে। এরপর যদি আন্তঃনদী সংযোগ এবং টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয় তবে এদেশের পানির স্তর ভীষণভাবে আরও নিচে নেমে যাবে। পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে যাওয়ার কারণে ইতিমধ্যেই সারাদেশে ৩ লাখের বেশি নলকূপে পানি উঠছে না। যা জনজীবনে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনছে। বর্তমানে শুকনো মৌসুমে ভূ-গর্ভস্থ পানির গড় স্তর ৩০ থেকে ৪০ ফুটেরও বেশি নিচে নেমে গেছে।
আশার কথা যে ডিসেম্বর ৬, ২০১৩ তারিখে বিখ্যাত ন্যাচার জার্নালে একটা পেপার বের হয়েছে, যেখানে সমুদ্রের তলদেশের মাটির নিচে বিশাল পরিমাণের ভূগর্ভস্থ পানির সন্ধান পাওয়ার খবর জানা গেছে।[২৯] Vast Meteoric Groundwater Reserves (VMGR) নামের এই পানির বিশাল আধারগুলোতে পানির লবণাক্তটা সমুদ্রের পানির মাত্র তিন ভাগের একভাগ। এই পানির আধারগুলো সারা পৃথিবীতেই যথেষ্ট পরিমাণে ছড়িয়ে আছে। বিজ্ঞানীরা হিসেব করেছেন যে, ১৯০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আমরা মোট যত পানি ভূগর্ভ থেকে তুলেছি, তার কয়েকশ গুন বেশি পানি এই ভূগর্ভস্থ আধারগুলোতে রয়েছে। সেই পানি সংগ্রহ করার জন্য লাভজনক প্রযুক্তি বের হলে, পানি নিয়ে কোনো বড় ধরনের যুদ্ধ হবার সম্ভাবনা কয়েকশ বছর পিছিয়ে যাবে।
আল-বাক্বারাহর এই আয়াতের শেষে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে একটা গুরুত্বপূর্ণ আদেশ দিয়েছেন—
খাও এবং পান করো, যা আল্লাহ তোমাদেরকে জোগান দিয়েছেন। আর কুকর্ম করবে না, দুনিয়াতে দুর্নীতি ছড়াবে না।
আমরা পৃথিবীতে আল্লাহর تعالى তৈরি ভালো-পবিত্র খাবার যখন ইচ্ছে উপভোগ করতে পারি, যদি সেটা আল্লাহর تعالى প্রতি অনুগত অবস্থায়, তাঁর দেওয়া নিয়মের মধ্যে থেকে করি, এবং একই সাথে আমাদের ভুলের জন্য তাঁর কাছে ক্ষমা চাই, নিজেকে পরিবর্তন করি। এরকম বিনীত, কৃতজ্ঞ অবস্থায় পৃথিবীতে আল্লাহর تعالى অসাধারণ অনুগ্রহগুলো পরিমিতভাবে উপভোগ করে, জান্নাতে গিয়ে অনন্তকাল আনন্দ করার চেষ্টার মধ্যে কোনোই বাধা নেই।[১]
এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বনী ইসরাইলকে তাদের ওপর তাঁর নি’আমতের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। বান্দার দায়িত্ব এটাই: সুখে-দু:খে সব অবস্থায় আল্লাহর تعالى নি’আমতগুলোকে মনে রাখা। দুখের সময় ধৈর্য্য ধরা ও দু’আ করা। আর সুখের সময় যে নিয়ামতগুলো পেয়েছে, তার জন্য কৃতজ্ঞতা আদায় করা।
তবে দুনিয়াতে থাকার সময় এই আয়াতের শেষ নির্দেশটি আমাদেরকে সবসময় মনে রাখতে হবে: আর কুকর্ম করবে না, দুনিয়াতে দুর্নীতি ছড়াবে না।
বনী ইসরাইলকে আল্লাহ تعالى বার বার ক্ষমা করেছেন। কিন্তু তারপরেও তারা বার বার সীমালঙ্ঘন করেছে। একারণে এই পর্যায়ে এসে আয়াতের ভাষা কঠোর হয়ে গেছে। আল্লাহ تعالى বলছেন: لَا تَعْثَوْا۟ – লা তা’ছাও। আ’ছাও হচ্ছে মানুষের মনে যে সব দুষ্ট চিন্তা আসে, তা থেকে করা কুকর্ম; ভুল ধারণা, ভুল জ্ঞান থেকে মানুষের মধ্যে যে মানসিক বিকৃতি তৈরি হয়।[১] আরবিতে আ’ছাওছাতুন হচ্ছে গাঁট্টাগোট্টা দেখতে, বুদ্ধি কম, মাস্তান ধরনের লোক, যে কিনা সব জায়গায় গায়ের জোর দেখিয়ে বেড়ায়।[১] এখানে আল্লাহ تعالى যেন রেগে গিয়ে বলছেন, “হে বেকুবের দল, তোমাদের গাধামি বন্ধ করো, যথেষ্ট হয়েছে।” আজকের অনেক মুসলিমরা, যারা বনী ইসরাইলের হুবহু অনুকরণ করছে, তাদের জন্য এটা একটা কঠিন সাবধান বাণী।
সবশেষে এসেছে মুফসিদিন مُفْسِدِين — যা ফাসাদ থেকে এসেছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ এবং কু’রআনে ৫০ বার এই শব্দটি বিভিন্ন রূপে পাবেন। এর অর্থ ব্যাপক[২৮]:
- ১) দুর্নীতি, ক্ষয়ক্ষতি করা: যেমন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলা যেতে পারে, ফারাক্কা বাঁধ বানিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া।
- ২) অপকার, অনিষ্ট করা: যেমন, হলমার্ক কেলেঙ্কারি করে দেশের ২৬৮৬ কোটি টাকার ক্ষতি করে দেওয়া।[২৭]
- ৩) বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা সৃষ্টি: যেমন, দিনের পর দিন দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষতি করা।
- ৪) শারীরিক ক্ষতি করা: যেমন, দলীয় দন্দ থেকে দেশে অশান্তি সৃষ্টি করে অন্যায়ভাবে নিরীহ মানুষদের মেরে ফেলা।
এক কথায় ফাসাদ হলো, যে কোনো কাজের বা বস্তুর স্বাভাবিকতা নষ্ট করা। ফাসাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার কঠোর নিষেধাজ্ঞার কারণ হলো, ফাসাদ যে সেক্টরে ঢুকে, সেটার স্বাভাবিকতা নষ্ট করে দেয়। শিক্ষাখাতে ফাসাদ ঢুকলে সেখান থেকে মুর্খরা ‘শিক্ষিতের’ তকমা লাগিয়ে বের হয়। বিচারখাতে ফাসাদ ঢুকলে ইনসাফ ব্যহত হয়। নিরাপত্তাবাহিনীতে ফাসাদ ঢুকলে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। মিডিয়ায় ফাসাদ ঢুকলে তা জনগণের মেধা-মননের প্রকৃতত্ব নষ্ট করে।
‘ফাসাদ’-এর অনেকরকম উদাহরণ দেখার জন্য একটি আদর্শ জায়গা হচ্ছে বাংলাদেশ। কু’রআনে যত ধরণের ফাসাদ করতে মানা করা হয়েছে, তার প্রায় সবগুলো নিজের চোখে দেখতে আমাদের বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। আজকাল দৈনিক সংবাদপত্রগুলো এক একটা ‘দৈনিক ফাসাদপত্র’ হয়ে গেছে।
আল্লাহ تعالى এই আয়াতে বনী ইসরাইল টাইপের মুসলিমদের বলছেন: তারা যেন নিজেরা খারাপ না হয় এবং অন্যের মাঝে দুর্নীতি (ফাসাদ) না ছড়ায়। অনেকেই মনে করেন, “আরে, আজকে দেশের কী অবস্থা! রাজনৈতিক দলগুলো দুর্নীতিতে একেবারে ভরে গেছে। সরকারি অফিসগুলোতে উঠতে-বসতে দুর্নীতি। বেসরকারি অফিসগুলোতেও স্বজনপ্রীতি, পুকুরচুরি। স্কুল-কলেজে সীমাহীন নোংরামি। যেখানেই যাই, সেখানেই অন্যায়। এর মধ্যে আমি যদি একটু আধটু ঘুষ খাই, একটু বেশি টাকার বিল নেই, একটু হোটেলে যাই —তাতে কার কী যায় আসে?”
না, আল্লাহ এখানে কঠিনভাবে মানা করে দিয়েছেন, যেন আমরা নিজেদের করা দুর্নীতিকে “অন্যেরা তো করছেই!”–এই কথা বলে কোনোভাবে সমর্থন করার চেষ্টা না করি। অন্যে কে কী অন্যায় করল, তার জন্য আমাদের আল্লাহর تعالى সামনে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জবাব নাও দিতে হতে পারে। কিন্তু কিয়ামতের সেই ভয়ঙ্কর দিনে আমাদের আগে নিজেকে বাঁচাতে হবে। সেদিন যখন আমাদের কুকর্মগুলো চোখের সামনে একটার পর একটা, এক অসাধারণ ব্যবস্থায় রিপ্লে করে দেখানো হবে, তখন আমরা আল্লাহর تعالى সামনে দাঁড়িয়ে কী জবাব দিব?
সূত্র
- [১] নওমান আলি খানের সূরা বাকারাহ এর উপর লেকচার।
- [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
- [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
- [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
- [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
- [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
- [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন — আমিন আহসান ইসলাহি।
- [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
- [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
- [১০] Jan Eliasson. “Water as the catalyst for peace, security and prosperity” http://www.worldwaterweek.org/documents/Resources/Best/Jan_Eliasson.pdf
- [১১] MILLIONS LACK SAFE WATER. http://water.org/water-crisis/water-facts/water/
- [১২] Rakteem Katakey and Manish Modi. “Water Stocks Beat Gold, Oil as Shortages Loom: Chart of the Day” http://www.bloomberg.com/news/2013-04-18/water-stocks-beat-gold-oil-as-shortages-loom-chart-of-the-day.html
- [১৩] DAVID ZEILER. “Investing in Water Stocks: Get Your Share of a $20 Trillion Marke.” http://moneymorning.com/2013/11/21/investing-in-water-stocks-get-your-share-of-a-20-trillion-market/
- [১৪] “War over Water (Jordan river)” http://en.wikipedia.org/wiki/War_over_Water_(Jordan_river)
- [১৫] Lester R. Brown. “How Water Scarcity Will Shape the New Century” http://www.earth-policy.org/press_room/C68/stockholm_transcript
- [১৬] “Economic Implications” http://growingblue.com/implications-of-growth/economic-implications/
- [১৭] Larry West. “Water Now More Valuable Than Oil?
- Savvy Investors and Successful Companies are Turning Water Into Gold” http://environment.about.com/od/globalwarming/a/waterinvesting.htm
- [১৮] CLARK S. JUDGE. “The Coming Water War.” http://www.usnews.com/opinion/blogs/clark-judge/2013/02/19/the-next-big-wars-will-be-fought-over-water
- [১৯] Robyn Meeks. “Water Works: The Economic Impact of Water Infrastructure*” http://www.hks.harvard.edu/m-rcbg/heep/papers/Meeks_DP35.pdf
- [২০] Eurasianet. “Water, Not Oil Could Soon Become the World’s Greatest catalyst for Conflict” http://oilprice.com/Metals/Commodities/Water-Not-Oil-Could-Soon-Become-The-Worlds-Greatest-Catalyst-For-Conflict.html
- [২১] সৈয়দ সফিউল্লাহ. “ফারাক্কা বাঁধ: বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এক নিষ্ঠুর পরিবেশ যুদ্ধ” http://meghbarta.info/nature-and-environment/12-nature-and-environment/110-2012-05-30-09-08-04.html
- [২২] আলাউদ্দিন আরিফ. “বড় ইলিশ মিলছে না পদ্মায় : ফারাক্কা বাঁধ ও নদীতে চরপড়াকে দায়ী করলেন জেলেরা” http://www.amardeshonline.com/pages/details/2013/03/10/191233
- [২৩] আখতার হামিদ খান. “ফারাক্কা বাঁধ ও আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাংলাদেশের উপর-এর ক্ষতিকর প্রভাব” http://www.dailysangram.com/news_details.php?news_id=60966
- [২৪] মুফসিদ শব্দের বিস্তারিত অর্থ – http://ejtaal.net/aa/img/br/7/br-0735.png
- [২৫] Randall Hackley. “Saudis Plan $4 Billion in Water Storage Investments, Okaz Says” http://www.bloomberg.com/news/2013-12-10/saudis-plan-4-billion-in-water-storage-investments-okaz-says.html
- [২৬] Reuters. “China to spend $301 billion on water projects” http://www.reuters.com/article/2011/01/20/us-china-water-investment-idUSTRE70J2DL20110120
- [২৭] Daniel Sabet and Ahmed S. Ishtiaque. “Understanding the Hallmark-Sonali Bank Loan Scandal” http://www.ulab.edu.bd/CES/documents/Hallmark_Sonali_Jan_13(sm).pdf
- [২৮] ফাসাদ শব্দের বিস্তারিত অর্থ: http://ejtaal.net/aa/img/br/7/br-0734.png
- [২৯] Vincent E.A. Post, Jacobus Groen, Henk Kooi, Mark Person, Shemin Ge & W. Mike Edmunds. “Offshore fresh groundwater reserves as a global phenomenon” http://www.nature.com/nature/journal/v504/n7478/full/nature12858.html